মেলাবেন তিনি মেলাবেন
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বাংলার ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমন্বয়ধর্মীতার ধারাটি বহু প্রাচীন । সেই ধারাকেই অনুসরণ করে আউল বাউল পীর ফকিরদের ধর্মধারাটি প্রবাহিত হয়ে এসেছে । তাদের আচরিত ধর্মে মানুষের, মানবতার জয়গানই উচ্চারিত হয়েছে বারবার । সেই ধারা বিভিন্নভাবে আজও বহমান । আজ পাশাপাশি অবস্থানকারী দুই ধর্মের জনগোষ্ঠীর দুটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন । হিন্দুদের অক্ষয় তৃতীয়া ও মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর । বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত হলে তাকে অক্ষয় তৃতীয়া বলে । অক্ষয় অর্থ হল যার ক্ষয় নাই । মানুষের মনে বিশ্বাস এই তিথিতে কোন সম্পদ সৃষ্টি করলে তা অক্ষয় থাকে । এছাড়াও হিন্দু ধর্মীয় বিধি অনুসারে নানা আনুষ্ঠানিকতা জড়িয়ে আছে এই তিথিকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে মুসলমানদের রমজান মাসে দীর্ঘ একমাস ব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধনের পর আসে ঈদ । ঈদ মানে উৎসব । ঈদ-উল- ফিতরের এই উৎসবে মুসলমান জনগণ আনন্দে মেতে ওঠেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে এই দিনটি পালন করেন ।
এই তিথিতে শ্রীশ্রীরামঠাকুর মাতৃদেহে প্রবেশ করেন । আবার এই তিথিতে তিনি তিরোহিত হন । এই অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতেই তিনি সূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় প্রক্রিয়ায় গুরু মন্ত্র লাভ করেন । তিনি তাঁর সুদীর্ঘ প্রায় নব্বই বছরের জীবনে সবধরনের বৈষম্যহীন কুসংস্কার মুক্ত সমাজগঠনে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানবতার জাগরণের মধ্য দিয়ে মানবের আধ্যাত্বিক মুক্তির উপায় সন্ধান করেছেন । তিনি প্রকৃত অর্থে ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সম্প্রদায়ের ধর্মের প্রচার করেছিলেন । জাতি-ধর্ম-বর্ণ সূচি অশুচির কোনো ভেদ তাঁর ধর্মাদর্শে ছিলনা ।
উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজ জীবনে কুসংস্কার, ব্রিটিশ রাজশক্তির সৃষ্টি করা বিভেদনীতি ও ধর্মীয় দাঙ্গার বিরুদ্ধে শুধু আধ্যাত্মিক চেতনায় মানুষকে বলিয়ান করাই নয় পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের এক সার্থক রূপকার ছিলেন শ্রী শ্রীশ্রীরাম ঠাকুর ।
আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান বাংলাদেশে ধর্ম সমন্বয়ের একটি প্রাচীন ধারা বিদ্যমান । এই সমন্বয়ধর্মীতার ফলে এখানে বাঙালি হিন্দুর লৌকিক দেবী বনদেবী, ওলাইচন্ডী পরিণত হয়েছে মুসলমানের বনবিবি ও ওলাবিবি রূপে । শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেব ভারতের এই সুপ্রাচীন ধর্মসমন্বয়ের ধারাটিকে তাঁর আধ্যাত্মিকতাবাদ প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন । তিনি এখানে দেবতা হিসেবে সত্যনারায়ণ পূজার প্রবর্তন করছেন । সত্যনারায়নকে তিনি বলছেন সত্যপীর । তার হস্তলিখিত সত্যনারায়ণের পাঁচালিতে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন– 'সত্য সত্য সত্য পীর সর্ব সিদ্ধি দাতা / বাঞ্ছা বড় বাড়িল বর্ণিতে ব্রত কথা ।' এই সত্যপীর ইসলাম এবং স্থানীয় লৌকিকধর্মের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক আধ্যাত্মিক পুরুষ যাকে বাংলার লোকধর্মের ধারার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে মুসলিম সত্যপীর এবং হিন্দু সত্যনারায়ন একই বিশ্বাস এবং আচারের প্রতিনিধিত্ব করে । বাংলাদেশ সুফিবাদ যখন প্রাধান্য লাভ করে সেই সময়ে বাংলাসহ সংলগ্ন রাজ্য উড়িষ্যায় তার জনপ্রিয়তা অর্জন করে । এই সত্যপীর ঐতিহ্যকে মান্য করে আজও হিন্দুরা সত্যনারায়ন ও পীরকে একসঙ্গে পূজা করেন । শ্রীশ্রীরামঠাকুর আমাদের ধর্মীয় সমন্বয়ের প্রতিভূ এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে তাঁর ধর্মসাধনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন । তার আসল উদ্দেশ্য হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনগণের মধ্যে শাসক শ্রেষ্ঠ যে বিভেদ রয়েছে তাকে দূরীভূত করা এবং পাশাপাশি আধ্যাত্মিক উপাসনার পদ্ধতি অনুসরণ করা । ফলে দুই ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থান ও ধর্মাচরণ এই যুগসন্ধিক্ষণের দুই ধর্মের মানুষকে একসূত্রে গাঁথার একটা প্রয়াস সেতু তৈরি করবে । সত্যনারায়ণ পূজায় যে সিন্নি ব্যবহার করা হয়– দুধ, কলা' আটা / ময়দা কিংবা চাল' নারকেল ও অন্যান্য হল ফলপসারযুক্ত যে ভোগ নৈবেদ্য তা মুসলিম সংস্কৃতি থেকেই পাওয়া । ডক্টর গিরীন্দ্রনাথ দাসের মতে–''পীর' শব্দের আভিধানিক অর্থ 'বৃদ্ধ' বা প্রাচীন এবং ভাবার্থ আধ্যাত্মিক গুরু । শব্দটি ফারসি থেকে আগত । ফারসি 'পীর' শব্দের ন্যায় বৌদ্ধগণ কর্তৃক ব্যবহৃত 'থের' শব্দের অর্থ বৃদ্ধ । সংস্কৃত 'স্থবির' শব্দের একটি অর্থ বৃদ্ধ ।পীরগণ ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ।'' ( বাংলা পীর সাহিত্যের কথা ) । তাঁরা সুফি নামে অভিহিত । সুফি শব্দটি আরবি 'তসাওফ' বা 'সুফ' শব্দ থেকে এসেছে । রাজা গণেশ ( শাসনকাল ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ ) বা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ( শাসনকাল ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯ খ্রি) আমলে সমাজের সত্যপীর পূজার প্রচার করেন বলে অনেকে অনুমান করেন । ( যাই হোক এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করা যাবে । ) এখানে লক্ষণীয় যে শ্রীশ্রী রামঠাকুর শুধু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন না সমাজের সংকটময় মুহূর্তে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে যেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির নামে শুচিবায়ুগ্রস্ত মনোভাব, বর্ণবৈষম্য এবং ধর্মান্ধতার মত কুপ্রথার প্রভাব ছিল সেখানে সমাজ সংস্কারের এক সার্থক রূপকার হিসেবে শ্রীশ্রীরামচন্দ্রদেব তাঁর ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করে গেছেন । ফলে তাঁর বহু মুসলমান শিষ্যও রয়েছেন ।
আজ এমনই একটা দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলমানরা ও তাদের ঈদ উৎসব পালন করে আসছেন । আদিকালের কৃষিউৎসবই যে পর্যায়ক্রমে ঈদ উৎসবে রূপান্তরিত এবং সে সময়ে মানুষ আজকের মত ধর্মীয় বিভিন্নতা মধ্যে জীবনযাপন করতেন না । পরবর্তী সময়ে ধর্মীয়চিন্তা এসেছে । হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি নানা ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে । মূলত এই সত্যপীর বা সত্যনারায়ন সেই একই সত্তারই প্রতীক ।
আজও যেন সেই বাঙালির চিরঐতিহ্য এক সূত্রে এসে মিলিত হয়েছে । আজও সমস্বরে উচ্চারিত হোক, আমাদের ধর্মীয় সমন্বয়ধর্মীতার জয় হোক । জয় হোক মানবতার ।
No comments:
Post a Comment