Monday, May 15, 2023
ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্যকলা
Saturday, May 13, 2023
সাব্রুম
জাদু বনাম যাদু
Friday, May 12, 2023
ত্রিপুরার প্রকাশনাশিল্প : ইতিহাস ও সাম্প্রতিক প্রবণতা
Tuesday, May 9, 2023
রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা : প্রসঙ্গ ত্রিপুরা
Friday, May 5, 2023
রবীন্দ্রনাথ ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ
রবীন্দ্রনাথ ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরটি ২৩°৫০' উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°১৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ৭৬ দশমিক ৫০৪ কোটি কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হাওড়া নদীর তীরে অবস্থিত এবং উত্তর দিকের পাহাড়ের ঢালু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত । এই শহর বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । শহরটি রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ । পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত যোগাযোগ থাকার ফলে আগরতলা আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ । এই আগরতলা শহরে রয়েছে একটি শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ যার নাম 'উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ' । এটি একসময় ত্রিপুরারাজ্যের রাজাদের রাজপ্রাসাদ ছিল । আগরতলার চিলড্রেন পার্কের বিপরীতে দিকে লক্ষীনারায়ণবাড়ী রোডের পাশ দিয়ে রাজবাড়ীতে প্রবেশের প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে প্রাসাদটির মূল অবস্থান ২৩°৫০'১২.৬৭'' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৬'৫৭.৭২" পূর্ব দ্রাঘিমাংশ । প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ও প্রায় ২০ একর জমি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই প্রাসাদ । এই প্রাসাদটির স্থাপত্যশিল্প অভিনব । ত্রিতলবিশিষ্ট এই প্রাসাদের শীর্ষে রয়েছে তিনটি গম্বুজ যার মধ্যে সর্বোচ্চটির উচ্চতা ৮৬ ফুট ( ২৬ মিটার ) । এটি চারতলাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় টাওয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত । প্রাসাদটির নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৯০১ সালে । এই প্রাসাদের নির্মাণশৈলীতে মুঘল, রোমান ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব রয়েছে । প্রাসাদের মেঝেতে মূল্যবান টাইলস বসানো । দরজা জানালা ও কাঠের সিলিংগুলি সুন্দর কারুকার্যময় । প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে সিংহাসন-কক্ষ, দরবার হল, পাঠাগার, অভ্যর্থনা হল, চাইনিজ রুম ও পাবলিক হল । প্রাসাদের সামনেই রয়েছে দুটি বিশাল জলাশয় । ইউরোপীয় ধাপে বিশাল বাগিচাও রয়েছে । বর্তমানে প্রাসাদপ্রাঙ্গনে সরকারি উদ্যোগে মিউজিক্যাল ফাউন্টেন এর ব্যবস্থাও রয়েছে । ২০১১ সাল পর্যন্ত এই রাজবাড়িতেই ছিল ত্রিপুরা বিধানসভা । বর্তমানে এটি রাজ্যের সংরক্ষিত জাদুঘর । সম্প্রতি আগরতলা শহরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে আগত বিদেশি অতিথিরা এই রাজপ্রাসাদের স্থাপত্যসৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান । আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ত্রিপুরার রাজাদের এই প্রাসাদটি নির্মানের ইতিহাসের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে আছে ।
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, ত্রিপুরার রাজারা তাঁদের রাজত্বকালের বিভিন্ন সময়ে তাঁদের রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন । পরবর্তী সময়ে তাঁরা দীর্ঘদিন প্রাচীন রাঙ্গামাটি বা উদয়পুরে রাজ্যপাট চালাতে থাকেন । মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্যের( ১৭৪৮– ১৭৮৩ ) সময় ত্রিপুরার রাজধানীকে আবার সরিয়ে আনতে বাধ্য হন । ত্রিপুরার দক্ষিণ অঞ্চলে দক্ষিণশিক পরগনায় তাঁর এক প্রজা শমসের গাজী বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন । শমসের গাজীর সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণমাণিকের যুবরাজ থাকাকালীন সময় থেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয় । শমসেরের হাতে রাজা কৃষ্ণমাণিক্যকে পরাজিত হয়ে পশ্চাৎ অপসারণও করতে হয় । শমসের গাজীর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি উদয়পুর থেকে তাঁর রাজধানী পরিত্যাগ করে পুরাতন আগরতলা এসে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । এই বিষয়ে ভুপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর রাজমালা গ্রন্থে লিখেছেন,
"শমসেরের হস্তে পরাজিত হইয়া কৃষ্ণমনি উদয়পুর ত্যাগ করিয়া ( পুরাতন আগরতলা ) বসতি স্থাপনপূর্বক সেইখানে বসবাস করিতে আরম্ভ করিলেন । ধীরে ধীরে অনেকেই তাঁহার দলভুক্ত হইতে লাগিল" ( রাজমালা, ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, শমসের গাজী, পৃষ্ঠা. ১৯৮ ) । এই প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে–
" কৃষ্ণ মানিক্য যৌবরাজ্য কালে তিনি আগরতলায় ( পুরাতন আগরতলা ) বসতি নির্মাণ করেন একথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে । শৈলমালার বেষ্টনে স্থানটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলিয়া প্রতিভাত হওয়ায় তিনি সেখানে নদীর ধারে বসতি নির্মাণ করিয়া শমসের গাজী হইতে আত্মরক্ষা করেন ।" ( ওই পৃষ্ঠা ২০৪–২০৫ )
পুরাতন আগরতলা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার পরপরই তিনি রাজধানীকে সাজিয়ে তোলার জন্য সচেষ্টা হয়ে পড়েন ।
বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হওয়ার সময়কালেই কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর রাজধানী উদয়পুর থেকে আগরতলা স্থানান্তরিত করেন । এই সময়ে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি তাঁর হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন । এ সম্পর্কে ত্রিপুরার প্রখ্যাত গবেষক রমাপ্রসাদ দত্ত বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন–
চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকেও জানা যায় যে ১৭৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে মোহম্মদ রেজা খাঁ সে বছরেই ত্রিপুরা আক্রমণ করেন রেজা খাঁ দেওয়ান রামশংকর ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে দক্ষিণশিকের গড় আক্রমণ করলেন । কৃষ্ণমাণিক্যের পক্ষে জয়দেব কবরা ও লুচি এক হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু যুদ্ধে জয় লাভের আশা নেই জেনে তারা 'ফাল্গুন কড়া' গড়ে আশ্রয় নেন । সেখান থেকে কসবা দুর্গে কৃষ্ণমাণিক্যের সঙ্গে যুক্ত হন । রামশংকর দেওয়ান এবার কসবা দুর্গ আক্রমণ করে জয় লাভ করেন । মহারাজ কৃষ্ণ মানিক্য পরাজিত ও নিরুপায় হয়ে কসবা দুর্গ ত্যাগ করে ভাদুগড়ে আশ্রয় নেন । সেখান থেকে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে রওনা হয়ে যান ।
রেজা খাঁর দেওয়ান সেনাপতি রামশংকর যখন নিশ্চিন্তমনে রাজ্য শাসন করছেন, সে সময় সংবাদ এল মিস্টার হ্যারিভার লেস্ট চট্টগ্রাম আক্রমণ করে রেজা খাঁকে পরাজিত করেন । সে খবর পেয়ে দেওয়ান রামশংকর ত্রিপুরা রাজ্য ত্যাগ করে চট্টগ্রামের দিকে চলে যান । এদিকে বিনা যুদ্ধে কৃষ্ণমাণিক্য ত্রিপুরারাজ্য পুনরায় হস্তগত করেন ।
অপরদিকে ইংরেজগণ চট্টগ্রামের শাসনভার নিয়ে নেন । Mr Harryvarlest চিফ আফিসার Mr. Thomas Rumbold, Mr. Ramdolf Marriatt ও Walter Wilkins মেম্বার এসিস্টেন্ট পদে নিযুক্ত হন । গোকুল ঘোষাল তাদের দেওয়ান হন । ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি মহম্মদ রেজা খাঁর নিকট হতে ইংরেজরা শাসনভার গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পরে ম্যরিয়ট সাহেব ত্রিপুরার জমিদারি বিভাগে ইংরেজের অধিকার স্থাপনের উদ্দেশ্যে কুমিল্লায় আসেন । তার সঙ্গে আসেন লেফটেন্যান্ট মথি সাহেব । 'কৃষ্ণমালা' গ্রন্থে তাঁকে 'মাতিছ' সাহেব বলে উল্লেখ করা হয়েছে । লেফটেন্যান্ট মথি কৈলারগর ( কসবা ) দুর্গের নিকট এসে শিবির স্থাপন করেন । কৃষ্ণমাণিক্য সে খবর পেয়ে কৈলারগড় দুর্গ ছেড়ে তিনকড়ি ঠাকুর, গোবর্ধন ঠাকুর ও জয়দেব রায়কে সঙ্গে নিয়ে সিংঙ্গারবিল গ্রামে চলে গেলেন । মথি সাহেব তখন কৃষ্ণমাণিক্যকে জানালেন, ' যুদ্ধের অভিপ্রায়ে আমি আসিনি । আমি মহারাজের সঙ্গে জমিদারি বিষয়ে আলাপ আলোচনার জন্য এসেছি ।' এ খবর পেয়ে কৃষ্ণমাণিক্য 'মনিঅন্ধ' গ্রামে ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করলেন । সেখান থেকে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা সেরে কৈলাগড়ে ফিরে এলেন । কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর পুনরায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক দক্ষিণ দিকে লুচিদর্পকে আক্রমণ করেন । লুচিদর্প তখন কৃষ্ণমাণিক্যের অধীনে দক্ষিণশিকের শাসনকর্তা । সেনাপতি জয়দেব রায় লুচিদর্পকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এবং উভয়ের সম্মিলিত আক্রমণে আব্দুল রেজ্জাক পরাজিত হন । তখন কৃষ্ণমাণিক্য দেখলেন বারবার মগ ও মুসলমানেরা রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ করে । সুতরাং অনেক চিন্তার পর তিনি উদয়পুর থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা স্থানান্তরিত করেন এবং সেখানে তিনি নগর স্থাপন করেন । এ সম্পর্কে রাজমালায় আছে–
"আশ্বিন মাসের দুর্গোৎসব দশমীর দিনে ।
ত্রিপুরা এগার শ সত্তৌরের সনে ।।
কৃষ্ণমাণিক্যের রাজ্য খ্যাতি হইল তখন ।
( রাজমালা–কৃষ্ণমাণিক্য খন্ড, পৃষ্ঠা ৫০ )
আগরতলা সংক্রান্ত প্রাচীন তথ্যাদির সন্ধান পেতে গেলে প্রধানত ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসসম্বলিত দুটি প্রাচীন গ্রন্থে সাহায্য নিতে হয় । একটি হল শ্রীরাজমালা–চতুর্থ লহর ও দ্বিতীয়টি কৃষ্ণমালা গ্রন্থ । কৃষ্ণমাণিক্য যে তাঁর রাজধানী পুরাতন আগরতলায় স্থানান্তরিত করেছিলেন তা রাজমালায় উল্লেখিত তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় । রাজমহলায় আরেকটি জায়গায় লেখা হয়েছে–
এগার শ সত্তৈর সন হএত যখন ।
আগরতলা রাজধানী করিল তখন ।।
( শ্রী রাজমালা–চতুর্থ লহর, কৃষ্ণমাণিক্য খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১ )
ত্রিপুরা থেকে খ্রিস্টাব্দের ৫৯০ বছরের ব্যবধান থাকে সেই হিসেবে ১১৭০ ত্রিপুরাব্দ + ৫৯০ = ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পুরাতন আগরতলায় রাজধানী পত্তন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
এছাড়া কৃষ্ণমালাতেও এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে । কৃষ্ণমালার ১৩০–১৩১ পৃষ্ঠা ও ১৪৬ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লেখা আছে–
কর করি রিপু চন্দ্র শাকের সময় ।
জৈষ্ঠ মাসে সময়েতে করিয়া বিজয় ।।
যুবরাজ আদেশেতে জয়দেব রায় ।
মন কৌতুহলে আসিলেক কসবায় ।।
তবে যুবরাজার পাইয়া অনুমতি ।
কুমিল্লাতে রহে ভদ্রমনি সেনাপতি ।।
যুবরাজের শাসে দেশ সুখে আছে প্রজা ।
আশ্বিন মাসে নির্বাহিল দুর্গাপূজা ।।
তারপরে মন্ত্রীগণে মন্ত্রনা করিয়া ।
যুবরাজ ঠাঁই নিবেদন করে গিয়া ।।
নিজ দেশ হইল বশ রিপু নাহি আর ।
এখন উচিত অভিষেক হইবার ।।
( পৃষ্ঠা ১৩০–১৩১ )
****************************"
তারপরে রাজা গেল আগরতলায় ।
বসতি কারণে পুরি করিল তথায় ।।
তারপরে পাত্র মিত্র গনে রাজার আদেশে ।
নির্ম্মাইল নগর আগরতলা দেশে ।।
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কৃষ্ণ মাণিক্যের আমলেই পুরাতন আগরতলায় রাজধানী স্থাপিত হয় । এরপর কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজত্বকালে ( ১৮৩০–১৮৪৯ ) পুরাতন আগরতলা বা পুরান হাউলি থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মে ১২৪০ ত্রিপুরাব্দে তিনি সিংহাসনে আরোহন নতুন হাউলি নামে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বর্তমান রাজধানী আগরতলা বা আগরতলা শহরের প্রথম রূপকার হলেও তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল পুরাতন আগরতলাতেই । করেন । সে সময় ভারতের গভর্নর লর্ড বেন্টিংক এর পক্ষে মিস্টার টমসন পুরাতন আগরতলা এসে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যকে সনদ ও খেলাত প্রদান করেছিলেন । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তার প্রতিদানে ব্রিটিশ রাজ সরকার কে ৬৩ টাকা আট আনা মূল্যের সোনার ও রূপার অলংকার, দুটি সোনার মোহর ও ১৬ টি রূপার মুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যবাহাদুর 1১৮৩৮ সালে পুরাতন আগরতলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে হাওড়া নদীর তীরে তার রাজধানী সরিয়ে আনেন । এই হাওড়া নদীর প্রাচীন নাম ছিল 'সাইদ্রা' । পরবর্তী সময়ে এই নামের বিলোপ সাধন ঘটে । রাজধানী নতুন জায়গায় স্থানান্তরের বিষয়ে ডঃ নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী লিখেছেন—
কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল পুরাতন হাবেলি বা আগরতলা থেকে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থাপন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে শিকারের সুবিধার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে কৃষ্ণকিশোর মানিক্য নতুন হাবেলি নামক নগর নির্মাণ করে সেখানে রাজ্যপাট স্থাপন করেছিলেন । ( মানিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী, জ্ঞান বিচিত্রা আগরতলা, পৃ. ৬৮ )
ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে স্থানান্তরের কাল উল্লেখ না করলেও J E Cumming এর গ্রন্থ Sarvey and sSettlement of the Chakla Roshnabad Estate in District Tipperah and Noakhali গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন–New Agartala or nutan habili was founded in 1838 in the time of Raja Krishna Kishore Manikya. ( page 65. )
শুধুমাত্র যে শিকারের উদ্দেশ্যেই রাজধানী বর্তমানে আগরতলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল তা নয় । হাওড়া নদী বেয়ে সেকালে ভাটির অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে পার্বত্য ত্রিপুরায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসতেন । নদীপথ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে বর্তমান আগরতলার উজানে আর নৌকাগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না । ব্যবসায়ীরা নতুন হাবেলি অংশে তাঁদের নৌকা বাঁধতেন । আর পুরাতন আগরতলা পাহাড়বেষ্টিত হওয়ার ফলে পূর্বদিক থেকে প্রায়শই কুকিরাএসে রাজধানীতে হামলা করত । ব্যবসায়িক ও প্রতিরক্ষাজনিত কারণেও কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজধানী বর্তমান আগরতলায় সরিয়ে এনেছিলেন । একসময় এই জায়গার নাম ছিল সাইদ্রা । কৃষ্ণ মাণিক্য সাইদ্রা নামের বিলোপসাধন ঘটিয়ে পুরানো রাজধানী আগরতলার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাজধানীর নামও আগরতলা রাখলেন । ১২৫৯ ত্রিপুরাব্দের দোসরা বৈশাখ কৃষ্ণকিশোরের মৃত্যুর পর ঈশানচন্দ্র মাণিক্য রাজপদে অধিষ্ঠিত হন । তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পহেলা ফেব্রুয়ারি । ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ইংরেজ সরকারকে ১১১ টি স্বর্ণ মুদ্রা নজরানা দিয়েছিলেন
১৮৬২ সালে ঈশানচন্দ্র মাণিক্য আগরতলায় একটি নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন । এই প্রাসাদে প্রবেশের একদিন পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বাতব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রাজা পরলোকগমন করেন । ( মাণিক্যশাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস– ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৭৪ )
এরপর বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) রাজা হন । তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে পিতার নির্মিত রাজপ্রাসাদেই অতিবাহিত করেন । এই রাজপ্রাসাদেই তাঁর পুত্র রাধাকিশোরের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল । কিন্তু রাধাকিশোরের রাজ্যভিষেকের পরপরই ১৮৯৭ সালের ১২ মে এক বিধংসী ভূমিকম্পে মহারাজা ইশানচন্দ্র মাণিক্য নির্মিত রাজপ্রাসাদটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ফলে সেটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় । তখন মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য সপরিবারে এই প্রাসাদ ত্যাগ করে জগন্নাথবাড়ির উত্তরাংশে ছনবাঁশের তৈরি অস্থায়ী বাংলোয় চলে যান ।
তারপরে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসে । কিন্তু ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজবাড়িসহ রাজধানীর সমস্ত বাড়িঘর তছনছ হয়ে যাওয়ার ফলে এবং রাজ তহবিলের আর্থিক অবস্থাও সংকটাপন্ন হওয়ায় সর্বোপরি প্রাসাদাভ্যন্তরে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় তিনি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না । বড়ঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র বীরেন্দ্রকিশোরকে যুবরাজ পদে নিয়োগ করায় তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে অভিযোগ জানান । এরকম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই রাধাকিশোর রবীন্দ্রনাথকে ত্রিপুরায় আগমনের আমন্ত্রণ জানান ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখ দোল পূর্ণিমার দিন প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ করেন । রাজবাড়ির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হওয়ায় সেবার রবীন্দ্রনাথ কর্নেল বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন । সেবার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংকট, প্রশাসনিক বিষয় এবং নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন ও পরামর্শ দান করেন । সেদিন যে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার বাইরে আরেক নতুন রবীন্দ্রনাথকে সবার সামনে হাজির করেছিলেন । এই রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি কূটনীতিতেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ । রবীন্দ্রনাথ এই চক্রান্ত কুটিল সময়ে রাধাকিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন । ঋণভারে জর্জরিত রাধাকিশোর কিভাবে ঋণ পেতে পারেন, কিভাবে তাঁর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবেন সে ব্যাপারে তিনি রাধাকিশোরকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন ।
'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' গ্রন্থে চিঠিপত্রের বিভাগে একটি তারিখ বিহীন পত্র সংযোজন করা হয়েছে । সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে রাধা কিশোরকে জানান যে–
"বিপুল সম্মানপূর্বক নিবেদন—
সমস্ত অবস্থা আমার কাছে যে রূপ প্রতিভাত হইতেছে খোলাসা করিয়া বলিবার চেষ্টা করি । মহারাজ গবর্নমেন্টের যোগে ঋণসংগ্রহ করেন ইহা এখানকার কয়েকজনের বিশেষ আগ্রহের বিষয় হইয়াছে দেখিতেছি । গবর্ণমেন্ট যে লোককে ঋণশোধের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করিবে শুনিতেছি সে লোকটি প্লান্টার শ্রেণীয়– তাহাকে আয়ত্ত করা স্যান্ডস প্রভৃতি লোকের পক্ষে কঠিন হইবে না ।
তাহা হইলে নাগপাশে এ রাজাকে রীতিমতো বেষ্টন করিতে পারিবে এবং গবর্ণমেন্টের ভারপ্রাপ্ত লোকের সহিত মহারাজের স্বার্থঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের যোগ ঘটে তবে মহারাজকে নিতান্ত দুর্বল হইতে হইবে ।******** 'ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল' হইতে ঋণ পাওয়া যাইবে না, অন্য কোন প্রাইভেট ব্যাংক হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে হইবে এ কথাটি সন্দেহজনক । প্রাইভেট ব্যাঙ্কের সহিত গোপন স্বার্থের সম্বন্ধ স্থাপন করা সহজ । এমনকি গবর্নমেন্টের উচ্চ কর্মচারীর পক্ষেও তাহা দুঃসাধ্য নহে ।"
সেদিন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে অবশেষে ব্যাংক অব বেঙ্গল থেকে ঋণ পাওয়া গিয়েছিল । কবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে মেসার্স মার্টিন বার্ন কোম্পানির স্থপতি আলেকজান্ডার মার্টিন ও বাবু রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।
"১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বারের মতো আগরতলা সফর করেন । সে সময় রাজ্যের জন্য ঋণগ্রহণ ও মন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে রাজা চিন্তা-ভাবনা করছিলেন । রাধা কিশোর এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কবির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন । রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত নাম চক্রান্তে রাজা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই জন্য রবীন্দ্রনাথ চাইলেন বিশ্বস্ত দক্ষ নিষ্ঠাবান রমণীর মোহন চট্টোপাধ্যায়কে ( দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা ) মন্ত্রীপদে নিয়োগ করতে । রমণীবাবু কবির আত্মীয় । তিনি তখন কলকাতায় উচ্চপদে কর্মরত । সেই স্থায়ী কাজ থেকে ছুটি নিয়ে তাঁকে আসতে হবে ত্রিপুরার রাজ দরবারে । রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যবস্থা করেছিলেন । কবি এটাও চাইছিলেন যে রমণীবাবুকে নিয়োগের পূর্বে যেন ঋণসংগ্রহের ব্যাপারটি স্থগিত রাখা হয় । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় কেন মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হবেন ? সেদিন আগরতলার প্রভাবশালী মহলের কেউ কেউ এটা চাইছিলেন না । তাই এর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচারও শুরু হয়ে যায় । ত্রিপুরা থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কবি ফিরে গেলেন কলকাতা ।এ যাত্রায় ত্রিপুরাতে তার কি অভিজ্ঞতা হল ? মহারাজকে তিনি লিখলেন, "আমি ইহা দেখিলাম যে, সেখানে দলাদলি খুব প্রবল হইয়াছে– এরূপ অবস্থায় মহারাজের তরফে তাকানো কোন দলের পক্ষে সম্ভব হয় না– অপর দলকে ব্যর্থ করা ও নিজের দলের জন্য বল সংগ্রহ করা ইহাই প্রত্যেক পক্ষের প্রধান চিন্তনীয় হয় । এমন স্থলে মহারাজের অনিষ্ট অবশ্যম্ভাবী । ( নতুন হাভেলির ছয় মানিক্য–পান্নালাল রায় / পৌনমী প্রকাশনী, আগরতলা, পৃ. ৬৪ )
১৮১১ শকাব্দের ১০ বৈশাখ শনিবার তথা ২৩ এপ্রিল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ এক শুভক্ষণে এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় । এই বিষয়ে প্রস্তরফলকে লিখিত সংস্কৃত শ্লোকটি ছিল—
শীতাংশুদ্বন্দ্ধরন্দ্রোদধিজ পরিশিতে শাক্যবর্ষে সুলগ্নে
বৈশাখ সুরজাহে গগনবিধুমিতে রোপিতা যস্য ভিত্তি ;
সোহয়ং 'নামোজ্জয়ন্ত' সুরগণ কৃপয়া পূর্ণতা প্রাপ্য সৌধ
শ্রীশ্রী রাধাকিশোর ত্রিপুর নৃপপদ স্বরণযোগ্যা বিভাতু"
সন ১৩০৯ ত্রিপুরাব্দ । ( তথ্য : শিলালিপি সংগ্রহ– ৩৫ পৃ. )
"১৮২১ শকাব্দের বৈশাখ মাসের ১০ তারিখ শনিবার শুভলগ্নে যাহার ভিত্তি স্থাপিত হইল সেই 'উজ্জয়ন্ত' নামক প্রাসাদ দেবগণের কৃপায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া ত্রিপুরা নৃপতি শ্রী শ্রী রাধাকিশোর মাণিক্যের পাদস্পর্শে বিরাজ করুক ।"
পরবর্তী সময়ে মহারাজ রাধাকিশোরের আদেশে এবং দায়িত্ব পেয়ে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে শিলালিপি সংগ্রহের পরে চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ শ্লোকটি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন । শ্লোকে উল্লিখিত চন্দ্রোদয় বিদাবিনোদ কর্তৃক প্রাসাদটির নামকরণের তথ্য ঠিক নয় । চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ প্রাসাদটি নির্মাণের পরে ১৯০২ সালে খ্রিস্টাব্দে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন ।
এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নামকরণ রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন বলে একটা জনশ্রুতি জড়িয়ে আছে । কিন্তু এই তথ্যটি মনে হয় ঠিক নয় । কারণ উজ্জয়ন্ত নামের সঙ্গে রাধাকিশোর পূর্বেই পরিচিত ছিলেন । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য যুবরাজ থাকাকালীন সময়েই 'উজ্জয়ন্ত নাট্য সমাজ' নামে তাঁর একটি নিজস্ব নাট্যদল ছিল । শক্তি হালদার মহোদয় কর্তৃক সম্পাদিত এবং কলকাতা বইমেলা ২০০১-এ প্রকাশিত 'ত্রিপুরা নাট্য আন্দোলনের ধারা' গ্রন্থে রমাপ্রসাদ দত্ত লিখিত রচনায় রাজন্য আমলে ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য নাট্যসংস্থার যে অনুষ্ঠানসূচির উল্লেখ রয়েছে তাতে উজ্জন্ত নাট্য সমাজের প্রযোজনায় অভিনীত অনেকগুলো নাটকের নামোল্লেখ পাওয়া যায় । এতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই উজ্জয়ন্ত নাট্য সমাজ থেকে পরবর্তী সময়ে রাজপ্রাসাদের নাম 'উজ্জয়ন্ত' রাখা হয়েছে ।
"রাধাকিশোর মাণিক্য এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পুরো ব্যয়ভার চাকলা রোশনাবাদের আয় থেকে মিটিয়ে ছিলেন । রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মত ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল থেকে ১০ লক্ষ টাকা ধার নিয়ে এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল । চাকলার তহবিল থেকে ওই ঋণ সুদসমেত পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছিল ।" ( আধুনিক ত্রিপুরা : প্রসঙ্গ রাধাকিশোর মাণিক্য, ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, অক্ষর পাবলিকেশন, আগরতলা ) এবং ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা-চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ১৯ )
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার সম্পর্কের সূত্র ধরে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে তাঁর যে সখ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সেই সুবাদে কবি রাজ্যের রাজকুলের এবং জনগণের সুখ-দুঃখেরও ভাগীদার হয়েছিলেন । রাজা যখনই রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রাসাদে কিংবা প্রশাসনে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখনই রবীন্দ্রনাথ পাশে দাঁড়িয়েছেন । সবসময় ত্রিপুরার মঙ্গল চিন্তা করেছেন তিনি । রাজ পারিষদ কর্নেল মহিম ঠাকুরকে তিনি লিখেছেন, "ত্রিপুরা রাজ্যের মঙ্গল সাধনের জন্য আমি বারংবার তোমার দিকে তাকাই । এই রাজ্যের সঙ্গে যেন আমার ধর্মের সম্বন্ধ বাঁধিয়া গেছে– আমি যতই ইচ্ছা করি ইহার সম্বন্ধে আমার মনকে উদাসীন করিতে পারি না—"( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ) । বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরারাজ্যের স্বার্থে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে সেদিন মহারাজাকে যে সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন তার ফলেই সেদিন ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য স্থাপত্যশিল্পের অভিনব নিদর্শন, কারুকার্যময় এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন । পরোক্ষে হলেও রবীন্দ্রনাথের নাম এই প্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ।
সহায়ক গ্রন্থতালিকা :
১. রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা— রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, ত্রিপুরা সরকার
২. রাজমালা— ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
৩. আগরতলার ইতিবৃত্ত— রমাপ্রসাদ দত্ত
৪. শ্রীরাজমালা
৫. কৃষ্ণমালা
৬. মানিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস— ড. নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী, জ্ঞান-বিচিত্রা, আগরতলা
৭. নতুন হাবেলির ছয় মাণিক্য— পান্নালাল রায়, পৌনমী প্রকাশনী, আগরতলা
৮. রবীন্দ্রনাথ ও প্রাসাদ রাজনীতি— পান্নালাল রায়, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী, আগরতলা
৯. শিলালিপি সংগ্রহ— চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ
১০. Survey and Settlement of the Chakla Roshnabad Estate in District Tripperah and Noakhali— J E Cumming
Tuesday, May 2, 2023
হৃদয়ের কথা বলিতে..
হৃদয়ের কথা বলিতে...
ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের । ত্রিপুরার রাজপরিবারের মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) থেকে শুরু করে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ), বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ( ১৯০৯–১৯২৬ ), এবং মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য ( ১৯২৬–১৯৪৭ ) পর্যন্ত পরপর চারজন রাজার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত নিবিড় সম্পর্ক ছিল । প্রকৃতপক্ষে এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকে । বীরচন্দ্র মাণিক্যের পিতা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ( ১৮৩০–১৮৪৯ ) হঠাৎ করে একটি সমস্যায় পড়ে যান । ১৮৩৬ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামের কমিশনার হঠাৎ করে ঘোষণা করেন যে, ত্রিপুরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশীয় রাজ্য । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন । তিনি জানান যে, ত্রিপুরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য । কখনোই ব্রিটিশ সরকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল না । ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে ত্রিপুরারাজ্যকে রক্ষা করার জন্য সে সময়ে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্য তখনকার প্রখ্যাত আইনজীবী প্রিন্স দ্বারকানাথের কাছে আইনি সাহায্য প্রার্থনা করেন । সেসময় ব্রিটিশের কবল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য ত্রিপুরাকে রক্ষা করার জন্য প্রিন্স দ্বারকানাথ ত্রিপুরার মহারাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ব্রিটিশকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিলেন । এ কারণে ত্রিপুরার রাজন্যগণ শুধু নয়, ত্রিপুরার জনগণ ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ।
রবীন্দ্রনাথের পিতামহের সঙ্গে যে ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের নিবিড় সম্পর্ক ছিল একথা রবীন্দ্রনাথ জানতেন । তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের পুরনো সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন ।
১২২৯ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর প্রয়াণ ঘটে । প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে বীরচন্দ্র গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন । এই সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি । কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে তিনি তাঁর অকালপ্রয়াতা পত্নী বিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন । মহারাজা বীরচন্দ্রের বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ বছর । মহারাজা বীরচন্দ্র ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো বয়স্ক কোনো কবি । তিনি যে মাত্র কুড়ি বছর বয়সের একজন তরুণ কবি তা মহারাজা বীরচন্দ্র ধারণাও করতে পারেননি । মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে তাঁকে 'কবি' হিসেবে সম্মান জানানোর জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সচিব রাধারমন ঘোষকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠান । রবীন্দ্রনাথও সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনের প্রথম সম্মান লাভের সুযোগে আপ্লুত হয়ে পড়েন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে এই ঘটনার কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন । উনিশ শতকের শেষ ভাগে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথকে কবি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ।
মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের গভীর সখ্যতার সৃষ্টি হয় । রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে নানাভাবে ত্রিপুরার রাজাকে সহায়তা করে গেছেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রগবেষক বিকচ চৌধুরী মহাশয় তাঁর 'রবীন্দ্র সান্নিধ্যে ত্রিপুরা' গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন । তিনি লিখেছেন–
" রাজকোষের সংকট, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিঘ্ন, ইংরেজ সরকারের কুমন্ত্রণা, রাজকুমারদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা, মন্ত্রী নিয়োগ, প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি নানান সমস্যার জাল থেকে এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে মুক্তি দেবার দুরুহ ব্রত রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । আর কি বিপুল নিষ্ঠায় তিনি তা পালন করেছিলেন তা ভেবে আজও অবাক হতে হয় । রবীন্দ্রনাথের এই বিরল বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর গোটা রবীন্দ্রকান্ডের মধ্যে আর কোথাও কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না । ত্রিপুরা এখানেই এক অনন্য গৌরবের অধিকারী । এই দুর্লভ গৌরবের দাবি কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেই বারবার ধন্য হয়েছে ।"
মহারাজা বীরচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় এর সূত্রপাত হলেও মহারাজা রাধা কিশোরের মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ( ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ) সাল মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ করেন । দ্বিতীয়বার আসেন ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই । পুনরায় রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে এসে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতিত্ব করেন । চতুর্থবার তিনি আসেন ১৩১২ বঙ্গাব্দের ১৭ কার্তিক রমনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের রাজমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হওয়ার দিন । ১৩১২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে বরিশালে 'প্রাদেশিক বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে' সভাপতিত্ব করতে যাওয়ার পথে তিনি পঞ্চমবার ত্রিপুরায় আসেন । এরপর ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি পূর্ব বঙ্গ, শ্রীহট্ট ভ্রমণের পর ত্রিপুরায় আসেন । সপ্তমবার অর্থাৎ শেষবার রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় আসেন ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে । সেবার কবিকে কিশোর সাহিত্য সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় ।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পণের বর্ষটি থেকে হিসাব করলে এই বছর তা একশো পঁচিশতম বর্ষে পদার্পণ করল । কবির ত্রিপুরায় পদধূলি দেওয়ায় ত্রিপুরা পূণ্য কবিতীর্থে পরিণত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ যেমন ত্রিপুরাকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন তেমনি ত্রিপুরার মানুষও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের আত্মার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে নিয়েছেন । রবীন্দ্র পদধূলি ত্রিপুরার মাটিকে অভিষিক্ত করার ইতিহাস কে স্মরণীয় করার লক্ষ্যেই এই গ্রন্থ রচনার প্রয়াস । এব্যাপারে আমাকে নানা তথ্য ও প্রচুর সহায়ক গ্রন্থ সরবরাহ করে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করেছেন রাজ্যের বিশিষ্ট কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধর । তাছাড়া তাঁর মননশীল প্রকাশনা 'স্রোত' থেকে গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন । গ্রন্থে লিখিত প্রতিটি প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় অবস্থানের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটগুলি উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছি । গ্রন্থটি পাঠ করে সুধী পাঠক সমাজ যদি ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার আন্তরিক সম্পর্কটি অনুধাবন করতে পারেন তাহলেই আমার শ্রম সার্থক হবে বলে আমি মনে করি ।
২৬ মে, ২০২৩
আগরতলা, ত্রিপুরা
রবীন্দ্রানুগত
অশোকানন্দ রায় বর্ধন
রবীন্দ্রতীর্থ আগরতলার কুঞ্জবন
রবীন্দ্রতীর্থ আগরতলার কুঞ্জবন
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা তথা ত্রিপুরা সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ( ১৮৬১–১৯৪১ ) দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল । ত্রিপুরার রাজন্যআমলে রাজাদের সঙ্গে, রাজকুমার ও অন্যান্য অমাত্যবর্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে রাজ্যের শিল্প ও সংস্কৃতি এক উন্নততর অবস্থানে পৌঁছেছিল । ত্রিপুরার জনগণের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় । রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার স্ফুরণকালেই ত্রিপুরার রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । আর এই সময় থেকে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ষাট বছর আগরতলা তথা ত্রিপুরার সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জনগণকে ভালোবেসে কবি বারবার ত্রিপুরায় এসে অবস্থান করেছিলেন । রবীন্দ্রকাব্য পাঠ করেই মহারাজা বীরচন্দ্র তাঁর কবিতায় নিয়ে এলেন নতুন ছন্দ ও বিষয়বস্তু । ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন তাঁর ঝুলন হোরী, অকালকুসুম, উচ্ছ্বাস, সোহাগ, প্রেম মরীচিকা ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে । রবীন্দ্রকবিতার প্রভাব পড়ল বীরচন্দ্রকন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবীর কবিতায় । 'মুকুট', 'রাজর্ষি', 'বিসর্জন' আর 'জীবনস্মৃতি' ও বহু পত্রাবলী মাধ্যমে রবীন্দ্রসাহিত্য ত্রিপুরাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ স্থান করে দিয়েছে । রাজপরিবারের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তা রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর থেকে আজ পর্যন্ত ত্রিপুরার জনগণ রক্ষা করে চলেছেন নানাভাবে । বারবার ত্রিপুরা রাজ্য রবীন্দ্র পদধূলি ধন্য হওয়ায় ভারতবাসীর কাছে ও বিশ্বের বাঙালির কাছে আগরতলা রবীন্দ্র তীর্থের পরিণত হয়েছে ।
আগরতলার ইতিহাস
প্রাচীন ত্রিপুরা রাজ্য বহুবার বহির শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছে যে কারণে বারবার রাজ্যের রাজধানী ও স্থানান্তর করতে হয়েছে ১৭৬০ সালে মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্য ও 1748 1783 তার রাজধানী উদয়পুর থেকে স্থানান্তরিত করে আগরতলায় স্থাপন করেন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালা ও কৃষ্ণমালা পাঠিয়ে তা জানা যায় অবশ্য সেই রাজধানী বর্তমান আগরতলা শহর নয় তা বর্তমান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত কিন্তু সে জায়গাও নিরাপদ ছিল না কুকিদের দ্বারা প্রায়ই এই অঞ্চল আক্রান্ত হতো এছাড়া হাওড়া নদীর তীরবর্তী স্থানে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের জন্য আরো কিছুটা পশ্চিমে রাজধানীর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্যের আমলে রাজধানী নতুন হাবিলিতে অর্থাৎ বর্তমান আগরতলায় ১৮৩৮ সালের ১০ই মে সরিয়ে আনা হয় ঈশান চন্দ্র মানিক্য সেখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভয়াবহ ভূমিকম্পে সেই প্রাসাদ টি ধ্বংস হয়ে যায় । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ) একটি নতুন প্রাসাদ নির্মানের কাজে হাত দেন । তিনি ১৮৯৯ সালে শ্বেতশুভ্র উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মানকার্য শুরু করেন এবং ১৯০১ সালে নির্মানকার্য সম্পন্ন হয় ।
এই রাজপ্রাসাদের কিছুটা দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সু উচ্চ টিলার উপরে বিস্তীর্ণ নির্জন বনভূমি ছিল । রাজন্যবর্গরা সেখানে অবকাশ যাপন করতেন । রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরা ভ্রমণে এলেও শেষ দুবার এখানে অবস্থান করেছিলেন । এই নির্জন বনপ্রান্তরে অবস্থানের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে বারবার উচ্চারণ করেছিলেন । তাঁর পূর্বের আগরতলা ভ্রমণের তুলনায় প্রকৃতিপ্রেমিক কবির কাছে এই অখ্যাত স্থানে অবস্থানের অভিজ্ঞতা তাঁর অন্তরে বিশেষ পুলকের সৃষ্টি করেছি । রবীন্দ্রনাথের আগরতলা ভ্রমণে এসে এই নির্জনস্থানে পদার্পণ ও অবস্থান করার ফলে কুঞ্জবন
রবীন্দ্রভক্তদের কাছে তীর্থক্ষেত্রস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) সাথে রবীন্দ্রনাথের যে পরিচয় সূত্র গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী সময়ের তিন রাজার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল । ত্রিপুরার সাথে নিবিড় বন্ধন এর সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ পর পর সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন ও অবস্থান করেছিলেন । ত্রিপুরায় এসে রবীন্দ্রনাথ কর্নেল বাড়ি, জোড়া বাংলো, কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাস ও কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ তথা পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অবস্থান করে গেছেন । কুঞ্জবনের ও তার সন্নিহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত টিলাভূমির দৃশ্য অবলোকন করে রবীন্দ্রনাথ এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মাকে ( লালুকর্তা ) এখানকার পরিবেশের মধ্যে তাঁর জন্য একটি কুটির নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । জীবনের অন্তিম পর্যায়ের দিনগুলি তিনি এখানে অতিবাহিত করে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকন করতে চান ।
চারিদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ সারি সারি ফুলের বাগানের সমারোহ, বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি ও অজস্র পাখিদের কলকালিতে মুখর এই কুঞ্জবন, কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাস আর কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ তার ইতিকথা বুকে নিয়ে আজও অবস্থান করছে । কালের বিবর্তনে হয়তো আগরতলা শহরের নিবিড় নগরায়নের ফলে সে কুঞ্জবন আজ আর আগেকার অবস্থানে নেই । কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ ও অবস্থানের কারণে সেই অতীতের কুঞ্জবন আজ রবীন্দ্রতীর্থে পর্যবসিত হয়েছে । কাজেই এই তীর্থভূমি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে ।
কুঞ্জবনের ইতিহাস
একসময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ কুঞ্জবনের প্রতি রাজন্যবর্গের আকর্ষণের একটি ইতিহাস রয়েছে । প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রই আজ কুঞ্জবন টাউনশিপ হিসেবে আগরতলা শহরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে । মহারাজা কৃষ্ণমানিক্য নানা কারণে তাঁর রাজপ্রাসাদকে আগরতলায় স্থানান্তরিত করেছিলেন । সে আগরতলা আজকের আগরতলা নয় । বর্তমান আগরতলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল সে রাজধানী আগরতলা । যা পরবর্তী সময়ে 'পুরোনো হাবেলি' নামে পরিচিত হয়ে যায় । এই পুরোনো হাবেলি থেকে মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজধানী ( ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ১০ মে ) বর্তমান আগরতলায় স্থানান্তরিত করেন । নতুন রাজধানী আগরতলার কিছু দূরে পূর্ব দিকে নানা ধরনের গাছগাছালি সারি সারি পুষ্প কানন ও পাখপাখালির কলতানমুখর নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চলটি ত্রিপুরার সেসময়ের রাজন্যবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । এখানকার নাতি উচ্চ তিনটি টিলাকে কেন্দ্র করে ছিল কুঞ্জবন এলাকা । তার মধ্যে একটি টিলায় ছিল বিশাল কাঁঠাল বাগান । একটা অংশের কাঁকর মিশ্রিত ভূভাগ থাকার কারণে নাম ছিল 'কাংকইরা টিলা' বা 'কাঁকরিয়া টিলা' । আজ তার দক্ষিণ দিকের টিলাটিতে হল মালঞ্চাবাস আর কুঞ্জবন প্রাসাদের অবস্থান । অতীতে এই তিনটি টিলা মিলিয়েই ছিল কুঞ্জবন যা সময়ের প্রয়োজনে বর্তমান কুঞ্জবন টাউনশিপে পরিণত হয়েছে । ফলে কিছু কিছু প্রাচীন স্থাপত্য ও স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া বর্তমান কুঞ্জবনে আর কিছুই নেই ।
এই সবুজ বন প্রান্তরের মাঝে যে অতীত কুঞ্জবন ছিল তার কিছু বিবরণ রাজ্যের বিশিষ্ট প্রবন্ধকারগণ এবং রাজ্যের রাজন্যবর্গরা লিপিবদ্ধ করে গেছেন । প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের লেখক ডঃ দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামী মহোদয় এক জায়গায় লিখেছেন–
"দ্বিতীয় বিশ্বসমরের সমসাময়িক কালে সারা কুঞ্জবনের চেহারার সঙ্গে কিছু কিছু নামেরও পরিবর্তন হয় । যথা– ৭৯ টিলা, হাসপাতাল টিলা ইত্যাদি । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডার ( SEAC ) প্রয়োজনের সারা অঞ্চলটায় ব্রিগেড ও ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার, বেস হসপিটাল, যুদ্ধের উপকরণ ট্রান্সপোর্ট এর সমাবেশ ইত্যাদি কারণে দ্রুত পরিবর্তন আসে । ওদিকে আগরতলা বিমান ঘাঁটির স্থানটটিও আর এ এফ–এর সাথে থাকায় বিমান ঘাঁটি ও তথায় যাতায়াতের পথঘাটের দ্রুত উন্নয়ন হয় ।
শহর আগরতলায় তৎকালে অনেক বছরই বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবং বসতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে স্থানাভাবের আশঙ্কায়– সর্বোপরি রাজধানীর নির্বাচিত স্থান অপেক্ষা কুঞ্জবন এলাকায় শহর নির্মাণের পক্ষে অধিকতর উপযোগী বলে মহারাজা বীরবিক্রমের ত্রিশদশক জুড়ে পরিকল্পনা ছিল, কুঞ্জবন অঞ্চলে শহরের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্রমশ অপসারণ, বিদ্যাপতন পরিকল্পনার মধ্যেই তার এই ইচ্ছা সূচিত হয়েছিল । বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ও তৎপরেই মহারাজার মৃত্যুতে সে সকল পরিকল্পনা রূপ পরিগ্রহ করে নাই । তারপরেই দেশে স্বাধীনতা আসার ও ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পর সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত যেসব পরিকল্পনা নিতান্ত প্রয়োজনীয় বলেই পুনরায় গৃহীত ও ক্রমে রূপায়িত হতে থাকে । তারই ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিরাট গোবিন্দবল্লভ হাসপাতাল, কুঞ্জবন টাউনশিপ, আইটিআই সংখ্যাটি সরকারি কর্মচারীদের কোয়ার্টার, পথঘাট ইত্যাদি গড়ে ওঠে ।"
কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদ
চির সবুজ বনরাজিবেষ্টিত কুঞ্জবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য বাহাদুর গড়ে তুলেছিলেন এক মনোরম প্রাসাদ । মূলত নতুন হাবেলিতে রাজধানী পত্তনের পর থেকেই পাশের এই বিস্তীর্ণ বনভূমি ত্রিপুরার রাজ পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । সে সময়ে রাজ পরিবারের সদস্যরা বিনোদনমূলক ভ্রমণের জন্য, শিকারের জন্য কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য তাদের রানিদের, রাজঅন্তঃপুরের নারীদের ও রাজপুরুষদের নিয়ে রীতিমতো পাঁজিপুঁথি দেখেই কিছুদিনের জন্য এই অঞ্চল ভ্রমণের জন্য যেতেন । সেই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর তাঁর রাজ্যাভিষেকের ( ১৯০৯ ) পরপরই রাজ্যের এবং রাজ্যের প্রজাসাধারনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । ধীরে ধীরে সেই পরিকল্পনা তিনি বাস্তবায়িত করতে লাগলেন । উন্নয়নের প্রতি ক্ষেত্রেই মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর তাঁর মননশীলতা ও সংস্কৃতির ছাপ রাখতে প্রয়াসী হন । তাঁর উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত হয় অরণ্যশোভিত কুঞ্জবনে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা । নিজের কলা নৈপুণ্যবোধের স্বাক্ষর রেখে মহারাজা সেদিন ( ১৯১৭ ) নির্মাণ করেন এই কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদ এই পুষ্পবন্ত প্রসাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর 'রাজমালা'য় লেখেন–
"একটি স্থাপত্যবিদ্যার উত্তম নিদর্শন বীরেন্দ্র কিশোরের চিত্রপ্রতিভার সর্বোত্তম দান হইতেছে কুঞ্জবন নির্মাণ । যাহারা আকবরের ফতেপুর সিক্রি দেখিয়েছেন তাঁহারাই বুঝতে পারিবেন স্থান নির্বাচনের তুলনায় ফতেপুর সিক্রি হইতে কুঞ্জবন কোন অংশেই ন্যূন নয় । ফতেপুর সিক্রির চতুষ্পার্শ্বে প্রকৃতির সৌন্দর্যের নতুনত্ব কিছুই নাই । সিক্রি নিজের সৌন্দর্যেই নিজেই উদ্ভাসিত কিন্তু কুঞ্জবন তাহা নহে । কুঞ্জবনের মধ্যে এমন একটি লুকায়িত মহিমা আছে যাহা শিল্পী বীরেন্দ্রকিশোরের দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই । তিনি সেই মহিমার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই কুঞ্জবনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়াছেন ।" ( পৃষ্ঠা ২১৩১৪ )
লেখক ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মহোদয় নিপুণ চিত্রশিল্পী ও কলাকবিদ মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুরের এই সৃষ্টি সম্পর্কে আরো উল্লেখ করেছেন–
"উদয়পুরের জলে প্রাসাদের যেরূপ ঐতিহাসিক খ্যাতি কুঞ্জবনের শৈল প্রাসাদেরও সেরূপ একটি অপূর্ব নৈপুণ্য রহিয়াছে । যাহা কালে প্রসিদ্ধি লাভ করিবে । এই প্রাসাদের পরিকল্পনায় শিল্পী একটি চমকপ্রদ কৌশল ফুটাইয়া তুলিয়াছেন ।প্রাসাদটি দেখা মাত্রই মনে হয় ইহা দ্বিতল অথচ আসলে তাহা নহে । সূর্যের উদয়াচল অভিমুখী বড় প্রকোষ্ঠটি পর্যন্ত দ্বিতল অথচ ভিতরে কোঠা একতলা । এইরূপ বিস্ময়ের বেষ্টনে যেন এই শোভন অর্ঘ্য আবৃত হইয়া রহিয়াছে । ছাদপ্রকোষ্ঠে বিশাল মুকুরে দূরের উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের চিত্র প্রতিফলিত করিয়া ইহা যেন অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপনের যত্নশীল ।
বন প্রাসাদের অনতিদূর একটি শৈলশিখরে শ্বেত বাংলা প্রস্তুত হইয়াছিল, সিক্রির প্রাসাদের নিচে নিচে যেমন আবুল ফজল ও ফৈজির বাসগৃহ দৃষ্ট হয় বন প্রাসাদের অনতিদূরে এই মর্মের কলাভবনেও মহারাজের বিশিষ্ট অতিথি কখনো কখনো বাস করিতেন । সেই শৈল শিখরে উঠিলেই পৃথিবী যে গোল ইহা পলকে চোখে ঠেকিয়া যায় ।
মহারাজা যখন রাজকার্যে ক্লান্ত হইতেন আকবরের সিক্রি ধামের ন্যায় তিনি কখনো কখনো বনবাস করিতে এখানে চলিয়া আসিতেন । প্রকৃতির মধুময় নিবিড় বেষ্টনে থাকিয়া সংসারের তাপ ভুলিয়া যাইতেন ( পৃষ্ঠা ২১৪ ) ।"
ত্রিপুরার প্রাচীন তথ্যের জহুরী বহু প্রবন্ধের লেখক এবং রমাপ্রসাদ গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা রমা প্রসাদ দত্তও এই পুষ্পবন্ত প্রাসাদ সম্বন্ধে এক ই কথা বলেছেন ।
KD Menon ( IAS ) Tripura state gazetteers ( 1975 ) এ কুঞ্জবন প্রাসাদ সম্পর্কে লিখেছেন–
A picturesque hillock known as kunjaban for its scenic beauty stands to the north of Agartala town and within a mile from the royal palace ( Ujjayanta Palace ) with tracts of some more low-lying hillocks. Though not far away yet being a countryside, this place came to be regarded as ideal for relaxation and pleasure strolls in the past for its green beauty, fine gardens, orchards and a small zoo opened by the government.
it was maharaja Biredrakishore Manikya who selected this beautiful place for construction of Suburban palace to be used for retreats. The construction of the palace was completed in 1917 when it was named 'Pushvanta Palace'. The Maharaja being a good artist is said to have repaired himself the plan of the palace and the adjoining gardens. The palace was subsequently extended and the approach road and the gardens re-aligned in accordance with the desire and requirements of the later rulers. This royal residence at the credit of accommodating royal guests occasionally. It may be interesting to add that Rabindranath stayed in the eastern apartment of this palace during his 7th and last visit in 1926. A round Verandah attched to this eastern part named as 'Gol Varandah', was the most favourite place for the distance view of Baramuraa hills on the eastern horizon. This Varandah had been the mute witness of many a dear moment when the poet composed popular songs, not less than five in number and all the corperated in 'Vaikali' series or remained absorbed in silence ( page 348 ).
উপরের লেখাটি থেকে জানা যায় যে, মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ১৯১৭ সালে এই কুঞ্জবন প্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদটির নির্মাণ কার্য সমাধা করেন । কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একসময় আগরতলায় এসেছিলেন এবং কিছুদিন এখানে অবস্থানও করেছিলেন । ফিরে গিয়ে তিনি 'অভিযাত্রিক' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন । সেখানে তিনি সেকালের আগরতলার একটি বর্ণনা দিয়েছিলেন তার বর্ণনায় ছিল–
"আমার ভাল লেগেছিল মহারাজার নতুন প্রাসাদ । ছোট চিড়িয়াখানায় কয়েকটি বন্যজন্তু, কুঞ্জবন প্রাসাদ ও বড় একটি ফুলের বাগান । মহারাজার নতুন প্রাসাদের বড় ফটকে বন্দুকধারী গুর্খা বা কুকিসৈন্য পাহাড়াওয়ালা । অনুমতি ভিন্ন কাউকে প্রাসাদ দেখতে দেওয়ার নিয়ম নেই । কুঞ্জবন প্যালেস একটা অনুচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থিত । পুরানো আমলের তৈরি বলেই ঢের ভালো লাগে মার্টিন কোম্পানি তৈরি মহারাজের নতুন প্রাসাদের চেয়ে । কুঞ্জবন প্যালেসের একটা ঘরে অনেক প্রাচীন চিত্র, হাতির দাঁতের শিল্প, ত্রিপুরা রাজবংশের পূর্বপুরুষদের বড় বড় ছবি ইত্যাদি ।"
কুঞ্জবন মালঞ্চাবাস ও পুষ্পবন্ত প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ
মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলে কলকাতায় যুবরাজ রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল । তবে সেসময় তিনি তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । সিংহাসনে আরোহণের ( ১৯০০ খ্রি. ) পর প্রথমদিকে তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন । তার মধ্যেও রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । রাধাকিশোর মাত্র বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন । এই সময়ের মধ্যে কবির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে । কবি ও রাজাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন । মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সে সম্বন্ধে 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থের একটি লেখায় আমরা পাই–
"কবি সম্বর্ধনার আয়োজন হইল পুরাতন কুঞ্জবনের সুউচ্চটিলায় শ্রী পঞ্চমী উপলক্ষে বসন্ত উৎসবে ( ১৩০৬ ) । ত্রিপুরার আদিবাসী টংঘরে নমুনায় সম্বর্ধনা মঞ্চ তৈরি হইল । মুলিবাঁশের তৈরি মঞ্চের গড়ন ও ফুল পাতায় সজ্জা পরিপাটি শিল্পশোভার নিদর্শন । মঞ্চের উপর হইতে নজর পড়ে চারিদিকে উচ্চ নিচ পাহাড়গুলি থরে থরে ঢেউ খেলিয়া দূর দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে–আকাশের নীল চন্দ্রাতপ দিগন্ত রেখাকে চুম্বন করিয়া ঋতু উৎসবকে আরো কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে । এই প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনকে আরো সংবর্ধিত করিয়াছে দলে দলে নৃত্য গীতরত মনিপুরী শিল্পী বৃন্দ । নগ্ন গাত্র, পরিধানে বাসন্তী রঙের কাপড়, লম্বমান বাসন্তী চাদর গলায়, মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ী, খোল মন্দিরা, করতালের সমতলে পদক্ষেপ ও দেহ ভঙ্গিমা দীর্ঘলয়ে কীর্তনের সুর এক মোহময় আবেশ রচনা করিতেছিল । দর্শক যাহারা তাহারাও স্ত্রী পুরুষ সেই বাসন্তী রঙের পরিচ্ছদে ভূষিত । এই পরিবেশের মধ্যে কবি ও রাজা মঞ্চোপরি ফরাস বিছানায় আসীন । কালোপযোগী নৃত্যগীত ও পুষ্পশয্যার উপহার– রাজা প্রজার সমব্যবহার কবির মনকে এক অভূতপূর্ব আনন্দে ও বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া দিল । ( ত্রিপুরায় রবীন্দ্রস্মৃতি, সত্যরঞ্জন বসু / রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, তৃতীয় মুদ্রণ– মে ২০১১ পৃ. ১৫ )
এছাড়া প্রাগুক্ত গ্রন্থে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনী–প্রথম খন্ড থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত মহোদয় লেখেন–
"বসন্তসমাগমে ( ১৩০৬ ) সম্ভবত শ্রীপঞ্চমীর সময় মহারাজের নিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় সর্বপ্রথম আগমন করেন এবং রাজ অতিথিরূপে কর্নেল মহিম ঠাকুরের নির্মিত গৃহে অবস্থান করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ কার্য তখনও চলিতেছে । কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকণ্ঠস্থ পুরান কুঞ্জবনের শৈলশিখরে কবির সম্মানে বসন্ত উৎসবের ও মনিপুরী নৃত্য গীতাদির মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান আয়োজিত হইল ।" ( তথ্য ক্রমপঞ্জি–শ্রী দ্বিজেন্দ্র দত্ত / রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১২৫–১২৬ )
১৩০৬ বঙ্গাব্দের বসন্তপঞ্চমীতে রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আগমনের তারিখ সম্বন্ধে পরবর্তী সময়ে মতান্তর দেখা দেয় । সম্ভবত প্রাগুক্ত দুই লেখক রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের তখনকার মতো প্রামাণ্য গ্রন্থটি অনুসরণ করার কারণেই এরূপ তথ্যবিভ্রাটের কারণ হয়েছে । ত্রিপুরা আঞ্চলিক রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সমিতি আগরতলা কর্তৃক রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৬৮ বাংলা । পুনর্মুদ্রণ হয় ফাল্গুন ১৩৯৩ বাংলা ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ এবং তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ হয় বৈশাখ ১৪১৮ বাংলা মে ২০১১ ইংরেজি । এই গ্রন্থের তৃতীয় মুদ্রণের মুখবন্ধের সংযোজনীতে ( ২ ক–খ ) তথ্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় প্রথম এসেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ইংরেজি ( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ : কিছু তথ্য-অশোকানন্দ রায়বর্ধন / ত্রিপুরা দর্পণ, ৯ এপ্রিল ২০২৩ ) ।
তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা স্থির নিশ্চিত হওয়া যায় যে, রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পণের পর তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল এই কুঞ্জবনেই । অবশ্য তখন কুঞ্জবনে কোন প্রাসাদ তৈরি হয়নি । ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য জানতেন যে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিপ্রেমিক । প্রকৃতির সৌন্দর্যে কবির মনপ্রাণ আপ্লুত হয়ে যাবে । এই আশা করে তিনি কুঞ্জবনের সবুজ বনানীর মাঝখানে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন । গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে মিলিয়ে সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন । তিনি ১৯১৯ সালে ষষ্ঠববার কুঞ্জবন মালঞ্চাবাসে এবং সপ্তম বার অর্থাৎ শেষবার ১৯২৬ সালে কুঞ্জবন প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন । কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাসটিও নির্মাণ করেছিলেন শিল্পবোদ্ধা মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুর ( ১৯১৯ ) । এই মালঞ্চাবাসের একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে প্রফুল্ল চন্দ্র সেনগুপ্তের স্মৃতিকথায় । তাঁর সুলিখিত বয়ানটি থেকে আমরা পাই মালঞ্চা বাসের বিবরণ ও রবীন্দ্র সংবর্ধনার বর্ণনা ।
"আগরতলার শৈল চূড়ায় বিহঙ্গের কুঞ্জবনের কলকাকলিতে ভরা নয়নাভিরাম ঘন সবুজ বনানীর কোলে চারদিকে অজস্র প্রস্ফুটিত ফুলের মনোরম উদ্যানে একটি অস্থায়ী আবাস বা বিশ্রামাগার নির্মিত হয়েছিল । শিল্পী মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর এর নাম রাখলেন 'মালঞ্চআবাস' ।
আবাসটি ছিল মোটা উলুছনের ছাউনিযুক্ত চৌচালাগৃহ । বাঁশ ও বেতের অপূর্ব কারুকার্য খচিত নকশা দেওয়া চারদিকের বেড়া তথা ঘেরাটোপ । মেঝেতে কাঠের পাটাতনে সুদৃশ্য কার্পেট বিছানো, রাতে জ্বলতো চিনা ঝাড়লন্ঠন । প্রশস্ত কাঠের বারান্দা বাঁকানো সিঁড়ি । দুদিকে পার্শ্বচর ও পরিচর্যা কারীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘর । সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গন । দুদিকে গোলাপ ও কাঁঠালচাঁপার সুমিষ্ট সুবাসে ভরপুর থাকত ও চারিদিকে অপূর্ব শ্যামলিমা, গেরুয়া মাটির ছোট ছোট পাহাড় কলকাকলিতে মুখরিত । দিগন্ত প্রসারী নিস্তব্ধ নীরব প্রকৃতি । কবির মনোরঞ্জনার্থে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মনিপুরী মেয়েরা ( লাইছবি ) তাদের চিরাচরিত গোপরাস ও বসন্তরাসে নিজেদের অঙ্গচালন ও মুদ্রায় কবিকে আপ্লুত করে রেখেছিল । পুরুষ কীর্তনীয়া ও নর্তক দল পরিবেশন করেন পুংচোলম ও করতালচোলম । গীতগোবিন্দের পদাবলীর সুললিত ছন্দে মনিপুরী ভাষায় ও সুরে অংশগ্রহণ করেন বুদ্ধিমন্ত, জিতেন্দ্রজিৎ ও নবকুমার সিংহ প্রমুখ নৃত্যগুরু ও প্রশিক্ষকগণ ।
অনুষ্ঠানের মূলভাব, রস ও পদলালিত্য এবং ব্রজবুলি মৈথিলী এবং বাংলাভাষার সংমিশ্রণে রচিত ও শ্রুতিমধুর ভাষা ও সুরের জালে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্ট ও অভিভূত ও মোহাবিষ্ট ।" ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১২৮, ১৯৭, প্রথম প্রকাশ আশ্বিন, ১৩৬৮ বাংলা )
রবীন সেনগুপ্তও তাঁর লেখায় এই সংবর্ধনার উল্লেখ করে বলেছেন–
"রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যগীত দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন । তিনি মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোরকে অনুরোধ করেছিলেন এই নাচের গুরু বাবু বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যের প্রশিক্ষক করে পাঠাতে । মহারাজা সানন্দে এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন ।"
এই মালঞ্চাবাসের কথা রবীন্দ্রনাথের মনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তিনি সপ্তম বার অর্থাৎ শেষবার যখন আগরতলায় ( ১৯২৬ ) আসেন তখন কুঞ্জবনপ্রাসাদে বসে আগের বারের ত্রিপুরা আগমন উপলক্ষে মালঞ্চাবাসের অবস্থানের স্মৃতি রোমন্থন করতেন । বার্ধক্যে এসেও তিনি শান্তিনিকেতনে বসে তাঁর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেছেন–
"পৃথিবীর প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈলশ্বেতভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না ।" ( সূত্র রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, পৃ. ২১৫ ) । কিন্তু কবির স্মৃতি বিজড়িত সে মালঞ্চাবাস বহু আগেই কালের করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । পরবর্তী সময়ে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য একটি বাড়ি তৈরি করেন ( ১৯৩৬ ) । সেটি 'মালঞ্চ-নিবাস' নামে পরিচিত হলেও তা বর্তমানে একেবারেই ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হয়েছে । যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সেটিও কালস্রোতে বিলীয়মান ।
রবীন্দ্রনাথ সপ্তমবার অর্থাৎ শেষবার আগরতলায় এসেছিলেন ১৯২৬ সালে । ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০-১৪ ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অতিবাহিত করেছিলেন । এই সময়ে প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথকে দেখাশুনা ও সাহচর্য দানের দায়িত্বে ছিলেন রাজপারিষদ হরিদাস ভট্টাচার্য । তিনি বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র ও কবির স্নেহধন্য ছিলেন । এবার কবি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথকে আগরতলায় আসার আমন্ত্রণ জানানোয় তিনি আগরতলা ভ্রমণে এসেছিলেন । এ ভ্রমণে আগরতলায় আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কিশোর সাহিত্য সমাজ কর্তৃক সংবর্ধনা গ্রহণ সহ তরুণ মহারাজ বীর বিক্রমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর ও শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হওয়া ।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই কয়দিন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতার কথা হরিদাস ভট্টাচার্য পরবর্তী সময়ে মাসিক সাহিত্যপত্র 'রবি'তে 'আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ' শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক রচনা প্রকাশ করেন । সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের পুষ্পবন্ত প্রাসাদে পদার্পণ থেকে শুরু করে যে কয়দিন সেখানে অবস্থান করেছিলেন তার আনুপুর্বিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন । তিনি লিখেছেন–
"১০ই ফাল্গুন রাত্রি প্রায় দশ ঘটিকার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কুঞ্জবন প্রাসাদে পদার্পন করেন । দেখিয়া তাঁহাকে অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন বোধ হইল । রাস্তা হইতে সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া প্রাসাদের দরজায় আসিতে রীতিমত পরিশ্রম বোধ করিতেছেন বলিয়া অনুমান করিলাম । সমবেত ভাইস প্রেসিডেন্ট বাহাদুর ও চিফ সেক্রেটারি মহোদয় প্রভৃতির সহিত সাদর সম্ভাষণান্তর আহারে বসিয়া তিনি রাজপরিবারের সকলের কুশল প্রশ্নাদি করিলেন ।
***********************************************************************আহারের পর অধিক রাত্রি হইয়া যাওয়ায়, কবি সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন । বলা বাহুল্য যে, আখাউড়া হইতে আরম্ভ করিয়া মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর ও রণবীরকিশোর আহারের পর কবির বিদায় গ্রহণ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন । খুব সম্ভব সেই রাত্রি শুক্লপক্ষের দশমী তিথি ছিল । জ্যোৎস্নালোকের কুঞ্জবন ও তৎপার্শ্বস্থিত সমুদয় স্থানসমূহ এক অপূর্ব শোভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল । চতুর্দিক নিস্তব্ধ–কবি পূর্ব দিকে খোলা বারান্দায় বসিয়া প্রকৃতির অপূর্ব লীলা প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন । আমরা আহারাদি সমাপন করিয়া নিদ্রাদেবীর আশ্রয় গ্রহণ করিলাম ।কবি নিদ্রা গিয়েছিলেন কি প্রকৃতির ধ্যানে রাত্রি প্রভাত করিয়াছিলেন তাহা জানিনা ।
পরদিন ( ১১ই ফাল্গুন ) খুব ভোরে উঠিয়া দেখি কবি তাঁর বসিবার কোঠা হইতে অনিমেষ নয়নে সূর্যোদয়ের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন । রক্তিম আভায় পূর্বদিক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে–নানা রঙের পাখীগুলি নানা সুরে গান করিয়া কবিকে সংবর্ধনা করিতেছে সে বলিয়া মনে হইল । কবির হৃদয়ে বড়ই পুলক সঞ্চার হইয়াছে বলিয়া তাঁহাকে দেখিয়া অনুমান করিলাম ।"
রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় অবস্থানকালে এই পুষ্পবন্ত প্রাসাদে বসে প্রকৃতির শোভা অবলোকন করতে করতে সংগীত রচনায় মগ্ন হয়ে যেতেন । হরিদাস ভট্টাচার্য অবশ্য তাঁর স্মৃতিকথায় সে বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেননি । মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য কবির শুভাগমনকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে পাথরে খোদাই করে স্মৃতিফলক ঘরের দেওয়ালে সেটে দিয়েছিলেন । সেই স্মৃতিফলকে লেখা থেকে জানা যায় যে, 'দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা' ও 'ফাগুনের নবীন আনন্দে' এই গান দুখানি রবীন্দ্রনাথ এই প্রাসাদে থাকার সময় রচনা করেছিলেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' স্মারক গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ 'দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা', 'ফাগুনের নবীন আনন্দে', 'এসো আমার ঘরে এসো', 'বনে যদি ফুটল কুসুম' এবং 'আপন হারা মাতোয়ারা' এই পাঁচটি গান রচনা করেছিলেন । তবে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, আরও একটি গান 'অনন্তের বাণী তুমি'সহ মোট ছটি গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগরতলায় বসে রচনা করেছিলেন ( সম্ভাব্য রচনাকাল– ১০ ফাল্গুন থেকে ১৪ ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ ) ।
হরিদাস ভট্টাচার্য মহোদয়ের লেখনী থেকে জানা যায়, "পরদিন সকালবেলা ( ১২ই ফাল্গুন ) কবি কিশোর সাহিত্য সমাজে যান এবং সেখানে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় । সেদিন বিকালে মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর ও রণবীর কিশোর কবিকে লইয়া মোটরের শহরের বেড়াইতে যান রাত্রিতে হারাদির পর কবি পূর্ব দিকের বারান্দায় জোসনা লোকে কতক্ষণ বসে ছিলেন তাহা জানিনা ।" ১৩ ফাল্গুন কবি প্রতাপগড় কৃষিক্ষেত্র ( দি টিপারা হিল ডেভেলপমেন্ট কোং লিমিটেডের বাগান ) পরিদর্শনে যান । বাগানটি দেখে তিনি খুব খুশি হন । সেদিন সন্ধ্যায় মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবিকে মনিপুরী মেয়েদের রাসলীলা প্রদর্শন করানো হয় । রাসলীলা দেখে কবি মুগ্ধ অভিভূত হয়ে যান । সখীদের নৃত্যভঙ্গিমা দেখে আপ্লুত হয়ে কবি বলেছিলেন, 'ইহা দেখায় আমার পূর্ববঙ্গে আসা সার্থক হইল । পরদিন ( ১৪ ফাল্গুন ) দুপুরবেলা কবি কুঞ্জবন ত্যাগ করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান । সেদিন সন্ধ্যায় কুঞ্জবন প্রাসাদ থেকে মেঘে ঢাকা আকাশের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরকে বলেছিলেন,
"আমার নাম বদলাইয়া তোমরা এখানে আমাকে একখানা কুটির বাধিয়া দাও জীবনের শেষ কয়টা দিন প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিয়াই অতিবাহিত করিব ।"
রবীন্দ্রনাথের এই শেষবারের ত্রিপুরা ভ্রমণ সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত 'তথ্যক্রমপঞ্জী'-তে উল্লেখ করেছেন,
" ১৩৩২ বঙ্গাব্দ– পূর্ববঙ্গের ঢাকা ময়মনসিংহ কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চল সফর শেষে মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ কয়দিন নিরালায় বিশ্রামের উদ্দেশে সদলবলে আগরতলায় শুভ পদার্পণ করিলেন (১০ই ফাল্গুন সপ্তম ও শেষবার ) । এবার কবি অবস্থান করিলেন কুঞ্জবনপ্রাসাদে ( যাহা বর্তমানে চিফ কমিশনারের সরকারীরা বাসভবন ) ।
********************************************************************************
আগরতলায় অবকাশ যাপনের কর্মসূচির মধ্যে কবি শহরের সন্নিকটস্থ প্রতাপগড় কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন, মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের গৃহে একাধিকবার রাসনৃত্যগীতাদি অনুষ্ঠানে যোগদান করিয়া তথায় কিশোর মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ পরিচয়, 'রাজমালা' ও 'গীতচন্দ্রোদয়' সম্পাদন সম্বন্ধে আলোচনা, ত্রিপুরার সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক মন্দির প্রাসাদাদি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়াদী সংরক্ষণ, দীর্ঘদিনের পুরাতন বন্ধু কর্নেল মহিম চন্দ্রের পরিবারবর্গের সঙ্গে পুনর্মিলন ইত্যাদি বহুবিধ কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন । ( তথ্যক্রমপঞ্জী, শ্রীদ্বিজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১৫৩–১৫৪ )
কুঞ্জবনের ও পুষ্পবন্ত প্রাসাদ থেকে দেখা সেদিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজীবন কবির স্মৃতির মণিকোঠায় সমুজ্জ্বল হয়ে বেঁচে রয়েছিল । ত্রিপুরায় আগমণের প্রথমদিন কবি এখানেই জীবনের প্রথম মণিপুরী নৃত্য অবলোকন করেছেন মুগ্ধ নয়নে । আবার শেষদিনও মনিপুরী নৃত্যের মাধ্যমে রাজ্য থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন । মণিপুরী নৃত্যের রস আস্বাদন তিনি এতটাই গভীরভাবে করেছিলেন যে, পরবর্তী সময়ে কবি এই নৃত্যধারাকে শান্তিনিকেতনে চালু করেন । এবং তার মননস্পর্শেই এই মনিপুরী নৃত্য একদিন বিশ্ব সভায় ধ্রুপদী নৃত্যের আসন গ্রহণ করে ।
১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়ার পর ৪'৩২ একরের প্রাসাদটি প্রধান কমিশনারের বাংলো হিসাবে এবং তারপরে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাজভবন হিসেবে কাজ করে । ২০১৮ সালে রাজভবনটি নতুন একটি ভবনে স্থানান্তরিত করা হয় । ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদীর মুর্মু ২০২২ সালের ১৪অক্টোবর এই পুরাতন রাজকীয় পুষ্পবন্ত প্রাসাদে ত্রিপুরার প্রথম ডিজিটাল জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন । এই হেরিটেজ ভবনকে Maharaja Birendrakishore Manikya Museum করা হয়েছে । এই প্রাসাদকে মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তুলে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ও নানা কার্যের নিদর্শন তুলে ধরা হবে । গত অক্টোবর মাস থেকে এখানে রেক্টোফিটিং এর কাজ শুরু হয়েছে । নয়া দিল্লির কে এন ও এস পি-ই এবং সিও এল এল পি কোম্পানি এই রেক্টোফিটিং এর কাজ করছেন ।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
১. শ্রীরাজমালা–চতুর্থ লহর
২. রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ( শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ )– চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়, ত্রিপুরা সরকার ।
৩. রবীন্দ্রসান্নিধ্যে ত্রিপুরা– বিকচ চৌধুরী, ত্রিপুরা দর্পণ আগরতলা
৪. রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা– পান্নালাল রায়,পারুল প্রকাশনী'
৫. রবীন্দ্রনাথ : প্রসঙ্গ ত্রিপুরা– দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, অক্ষর, আগরতলা
৬. রবীন্দ্রনাথ ও অনন্যা ত্রিপুরা– রবীন সেনগুপ্ত
৭. আগরতলাযর ইতিবৃত্ত– রমাপ্রসাদ দত্ত, পৌনমী প্রকাশন, আগরতলা
৮. নতুন হাভেলির ছয় মানিক্য– পান্নালাল রায়, পৌণমী প্রকাশন
৯. ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী– রাজমালা
১০. কুঞ্জবনের রবীন্দ্রনাথ– জ্যোতির্ময় রায়, পূর্বমেঘ আগরতলা
১১. ত্রিপুরায় রবীন্দ্রস্মৃতি– সত্যরঞ্জন বসু ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা )
১২. তথ্যপঞ্জী– শ্রী দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা )
১৩. আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ– হরিদাস ভট্টাচার্য ( রবি পত্রিকা )
১৪. Tripura State Gazetters–K K Menon ( I A S )