Monday, May 15, 2023

ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্যকলা

ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্যকলা


একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির ক্ষেত্রে অপর কোন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, ভাষা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পের আদান-প্রদানের মাধ্যমে পুষ্ট করে তোলে । ফলে এর মধ্যে একটি সমৃদ্ধ একাত্মবোধ গড়ে ওঠে এবং সেখানে সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে এরকম ভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির আগমন আদান-প্রদান এবং মেলবন্ধন ঘটেছে । ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইরূপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে ত্রিপুরারাজ্য হয়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য । ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতেই হয় যে, রত্নফা যখন মাণিক্য উপাধি নিয়ে ত্রিপুরায় ফিরে এলেন তখন তাঁর সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের । যাদের সহযোগে সেদিন ত্রিপুরায় গড়ে উঠেছিল এক মিশ্রসংস্কৃতির বাতাবরণ । সেকারণে পণ্ডিতদের দ্বারা আমদানি হয় সংস্কৃত সাহিত্য ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির । সঙ্গে সঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের ত্রিপুরায় সে সময় সীমানা ছিল ব্রহ্মদেশের প্রান্ত সীমা থেকে  ঢাকার কিছু অংশ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি নিয়ে । তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ত্রিপুরাতে হিন্দু, বৌদ্ধ, শৈব ও শাক্ত সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় ।  এককথায় ত্রিপুরার সংস্কৃতিতেও 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' পরিবেশ যথেষ্টই রয়েছে ।

ত্রিপুরার রাজারা সংস্কৃতিবান, বিদ্যোৎসাহী, উদার মনোভাবাপন্ন এবং গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সতত সচেষ্ট হিসেবে সর্বজনবিদিত । নৃত্য ও গীতের সুধাসাগরে মহারাজারা শুধু নিজেরাই নিমজ্জিত ছিলেন না, রাজঅন্দরের পুরনারীদেরও সংগীত ও অন্যান্য চারুকলার চর্চায় প্রচন্ড উৎসাহ প্রদান করতেন । ত্রিপুরার  রাজাদের ইতিহাস কালিপ্রসন্ন সেন সম্পাদিত 'শ্রীরাজমালা'য় উল্লেখ রয়েছে–

 'ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্যগীত আনি ।
 রাজ্যতে শিখায় গীত নিত্য নৃপমণি ।।
 ত্রিপুর সকলে সেই গীত ক্রমে গায় ।
 ছাগ অন্তে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।

অর্থাৎ মহারাজা ধন্যমাণিক্য মিথিলা বা ত্রিহুত দেশ থেকে শিল্পী এনে রাজ্যে নৃত্যগীতের প্রচলন করেছিলেন ।

ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ হলো মনিপুরি জনগণ । ২০১১ সালের ভারতের জনগণনা অনুযায়ী ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ৩৬,৭৩,৯১৭ জন । আর মনিপুরি জনসংখ্যা প্রায় ২৪,০০০ । বর্তমানে রাজ্যে মনিপুরি জনসংখ্যার হার ০.৭ শতাংশ । রাজ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মনিপুরিগণ রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের ন্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধির পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । ত্রিপরাজ্যের ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলপুর, খোয়াই ও সদর মহকুমাতে মনিপুরীগণ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।

 মনিপুরিরা মূলত মনিপুরের অধিবাসী । সাধারণত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং রোগ মহামারীর আক্রমণ কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য স্থানে বা অন্য রাজ্যে অভিবাসনে বাধ্য করে । ত্রিপুরারাজ্যের মনিপুরিদের প্রথম অভিবাসন উপরোক্ত কোন একটি কারণের ফলে হয়েছে । রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মনিপুরিগণ দেশত্যাগ করে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮২৪ সালে । ১৭৬২ সালে কৃষ্ণমাণিক্যের আমলে চট্টগ্রামের রেসিডেন্ট মি. ভেরেলিস্টের পত্র থেকে জানা যায় যে, মণিপুররাজ বিখ্যাত গরীবনওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র জগতসাই সিংহাসন থেকে  বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে ভেরেলিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পুনরায় ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসন দখল করার জন্য । কিন্তু মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের ( ১৭৭৩–১৭৯৮ খ্রি. ) তৎপরতায় তিনি সফল হননি । কিন্তু জগৎসাই সম্ভবত কসবা অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন কেননা পরবর্তীকালে ভাগ্যচন্দ্রের আগরতলা আগমনকালে কসবাতে জগৎশাই ভাগ্যচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন বলে জানা যায় । তারপরে অবশ্য জগতসাইয়ের আর কোন সংবাদ জানা যায় না এবং তাঁর বংশধর বা পরিবার-পরিজন এর ত্রিপুরায় পাওয়া যায় না । 

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । ত্রিপুরার অনেক রাজা মণিপুরের রাজকন্যা বিবাহ করেছেন দ্বিতীয় রাজধর মাণিক্য ( ১৭৮৫–১৮০৪ )  মনিপুরাধিপতি ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিবাহ করেন । কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছেন,

 ''মণিপুরের রাজবংশের সহিত ত্রিপুরার রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ ।" 
এই উক্তি পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না । কেননা আমরা দেখি যে, ত্রিপুর বংশধর তইদাক্ষিণের পুত্র দাক্ষিণ মেখলি রাজকন্যা বিবাহ করেন । অবশ্য এই বিবাহ বর্তমান ত্রিপুরার রাজনৈতিক সীমার মধ্যে ঘটেনি । বরঞ্চ বলা চলে ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের সঙ্গে মণিপুর রাজবংশের প্রথম সম্বন্ধ হয় রাজধরমাণিক্যের সঙ্গে । আবার কেহ কেহ মনে করেন কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী মণিপুরের রাজদুহিতা । কৈলাস চন্দ্র জাহ্নবীদেবীর অপর নাম 'রানী তম্পা' বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু কমলজিৎ সিংহ উল্লেখ করেছেন যে, জাহ্নবী দেবীর অপর নাম 'সিজা তম্ফা' ।এই নামীয় কোন মহিলা মনিপুরি ভিন্ন অপর কেউ হতে পারে না । কৈলাসচন্দ্রের রাজমালা তে সিজাতমফার উল্লেখ নেই । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরাতন রাজমালা 'শ্রীরাজমালা'র মুল পাঠে এবং 'দেশীয় রাজা'তে কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নীর নাম জাহ্নবী দেবী লেখা আছে ।  আখাউড়া স্টেশনের নিকটে রাধানগর গ্রামে অবস্থিত রাধামাধব মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী । মুদ্রার সাক্ষ্যেও আমরা তার নাম জাহ্নবী দেবী পাই । কর্নেল দেববর্মা মহাশয় তাকে অসূর্যম্পশ্যা একজন ত্রিপুরী রমণী বলে তার অনেক গুণের উপর আলোকপাত করেছেন । অন্য প্রমাণাভাবে কমলজিৎ সিংহ এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছেন । কৃষ্ণ মাণিক্য ( ১৭৪৭–১৭৮৩ খ্রি. ) শমসের গাজীর উপদ্রবে সিংহাসন দখল করতে না পেরে অনেকদিন কাছাড় ও মনিপুরের রাজসভায় সাহায্য লাভের আশায় রাজ্যত্যাগ করেছিলেন ।

আবার একটি সূত্র থেকে জানা যায়, "আনুমানিক ১৮২১ সাল থেকে ১৮২৬ সাল এই সময়ের মধ্যে ত্রিপুরার মহারাজা রামগঙ্গা মাণিক্যের ( ১৮১৩–১৮২৬ খ্রি. ) সঙ্গে মণিপুরের মহারাজা জয়সিংহের কন্যা চন্দ্ররেখা মতান্তরে চন্দ্রলেখার বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর আত্মীয়তার সূত্রে অনেক অভিজাত মনিপুরিদের বাসস্থান হয়ে ওঠে এই ত্রিপুরা রাজ্য ( রবীন্দ্র সান্নিধ্যে নবকুমার ও মনিপুরী নৃত্যকলা—হীরেন্দ্র সিনহা/ ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ– নিলিপ পোদ্দার, পৌণমী প্রকাশন, আগরতলা ) ।

মহারাজা রাজধর মাণিক্যের পরও বেশ কয়েকজন মহারাজা মণিপুরি কন্যাদের বিবাহ করেছিলেন । ফলে বৈবাহিক সূত্রে বহু মনিপুরি পরিবার ত্রিপুরায় বসবাস করতে শুরু করেন । মহারাজা কাশীচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮২৬–১৮২৯ ),  কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ( ১৮৩০–১৮৪৯ ),  ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৫০৬২ ), বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ), রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ), বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য ( ১৯০৯–১৯২৩ ), বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য ( ১৯২৩–১৯৪৭ ), এঁরা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক মণিপুরি কন্যাকে রাজমহিষী বা রাজপত্নী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ।

ইতিহাসের এই সমস্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এভাবেই খুব সম্ভবত রানি হরিশেশ্বরীর স্বজন, সেবক ও সেবিকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরারাজ্যের প্রথম মনিপুরি অভিবাসন কেন্দ্র । রাজধানীর পাশে মেখলিপাড়া গ্রামে । কমপক্ষে চারটি বিভিন্ন বংশের মণিপুরিগণ এখানে বসবাস করছেন । এরা হলেন মরুংবম, হনজবম, খুমনথেম, লাইপুবমনা নামক বংশের উত্তরপুরুষ । রাজকীয় বহরের অন্তর্ভুক্ত না হলে একসঙ্গে একই স্থানে চারটি বংশের মানুষ সমবেত হয়ে বসবাস করতে পারত না । রাজমালা পাঠে জানা যায় যে, বৈবাহিক সূত্রে মণিপুর রাজবংশের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কিত হন রাজধর মানিক্য ( ১৬১১ খ্রি.)।  তিনি ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রথম রাজধর মাণিক্য । সেই সূত্রে তিনি নিজে ত্রিপুরার নৃপতিদের মধ্যে প্রথম বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি সার্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ নামে পরম বৈষ্ণব পুরোহিত ও ২০০ জন ভট্টাচার্য বৈষ্ণবের সঙ্গে সর্বদা ভাগবত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতেন । 
এভাবেই রাজঅন্তপুরে মণিপুরি মহিলাদের আগমনের ফলে মণিপুরি নৃত্য-গীত, কৃষ্টি সংস্কৃতি, বয়নশিল্প, মণিপুরি ভাষা এমনকি মণিপুরি রন্ধনশৈলী ও মণিপুরি খাদ্যাভ্যাসের প্রচলন করেন । মন্দির, মন্ডপগুলিতে  মণিপুরি নৃত্যধারার  বিস্তার লাভ করে । ত্রিপুরারাজ্যের রাজ অন্তঃপুরের বাইরেও প্রসারলাভ করে মণিপুরি নৃত্যশৈলী ।  মহারাজগণের উৎসাহে রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা রাজবাড়ির অঙ্গনের মধ্যেই নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করতেন ।  রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে হোলি এবং ঝুলন উপলক্ষে দুইদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত । প্রতিটি নৃত্যই মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হত । মণিপুরি নৃত্যগুরুগণ বিভিন্ন সময়ে  রাজকমারীদের নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন । বিশেষ করে রাসোৎসব উপলক্ষে রাজপরিবারের মেয়েরা মণিপুরি 'মহারাস' নৃত্য পরিবেশন করতেন । এককথায় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে  সেকালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ও ধ্রুপদী নৃত্যের পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল ।

বহু প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরার রাজপরিবারে নৃত্যগীতের একটি সাংস্কৃতিক ধারা বহমান থাকলেও বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার মহারাজাদের যোগসূত্র ঘটবার অব্যবহিত পর থেকেই আধুনিক ত্রিপুরার সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতি লাভ করতে শুরু করে । শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ ( ২৭  মার্চ,১৮৯৯ / ১৪  চৈত্র ১৩০৫ বঙ্গাব্দ ) থেকে ১৯২৬ ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দ ) খ্রিস্টাব্দ এই ২৮ বছরে মোট সাতবার আগরতলা ভ্রমণে আসেন  । রবীন্দ্রনাথ  ত্রিপুরায়   ১৮৯৯ সালে ২৭ শে মার্চ (১৩০৫ বঙ্গাব্দে ) চৈত্র মাসে বসন্ত শ্রীপঞ্চমীতে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে প্রথমবার আগরতলায় আসেন । তখন কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকণ্ঠস্থল কুঞ্জবনের শৈলশিখরে কবির সম্মানে বসন্ত উৎসব ও মণিপুরি নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল । তা দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন । দ্বিতীয়বার কবি আসেন ১৯০১ সালে ( ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ) কার্তিক মাসে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে । তৃতীয়বার ১৯০৫ সালে ( ১৩১২ বঙ্গাব্দে ) আষাঢ় মাসে। চতুর্থবার ১৯০৫ সালের কার্তিক মাসে  এবং পঞ্চমবার চৈত্র মাসে । ষষ্ঠবার ১৯১৯ সালে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে কার্তিক মাসে এবং শেষবার তথা সপ্তম বার আসেন মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ) ১০ ফাল্গুন । শেষবার যখন কবি আগরতলায় আসেন তখন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় । মনিপুরি নৃত্যের মাধুর্য কবিকে মুগ্ধ ও আপ্লুত করে ।

১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সিলেট শহরে গুরুদেব গিয়েছিলেন সিলেটবাসীর আমন্ত্রণে । ২০শে  কার্তিক বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে সিলেটের নিকটবর্তী 'মাছিমপুর' নামে মনিপুরিদের একটি গ্রামে মণিপুরি শিল্পকর্ম দেখতে যান কবি । গ্রামের মনিপুরিসমাজ গুরুদেবকে অভ্যর্থনা জানায় ছেলেদের 'রাখাল নৃত্য' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । রাত্রে মনিপুরি বালিকারা নাচ দেখায় গুরুদেবের বাংলোতে এসে । গুরুদেব সেই নাচ দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন । এ সম্পর্কে সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ 'শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে লেখেন—

"... রাত্রে মনিপুরী বালক বালিকারা বাংলোতে এসে উপস্থিত হলো কবিকে নাচ দেখাবার উদ্দেশ্যে । নৃত্য আরম্ভ হবার পূর্বে একজন মণিপুরী হারমোনিয়ামে সুর ধরবার উদ্যোগ করতেই কবি তাকে বারণ করলেন । নয়নাভিরাম জাঁকালো পরিচ্ছদ পরিহিত অপূর্ব লাবণ্যমণ্ডিত মণিপুরী বালিকারা তাদের বাহুগুলো নৃত্যছন্দে লীলায়িত করে, বলয়াকারে ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে তাদের জাতীয়নৃত্য দেখিয়ে তাঁর প্রশংসা অর্জন করল । কবি তাদের নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে ২০ টাকা পুরস্কার দিলেন । কথা প্রসঙ্গে এ নৃত্য সম্বন্ধে বললেন, 'graceful best form of physical exercise'. ( কবি প্রণাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০২ সিলেট ) ।

১৩২৬ বঙ্গাব্দের ২৩ কার্তিক, রবিবার ( ৯ নভেম্বর, ১৯১৯ ) সিলেট থেকে ফিরবার পথে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ষষ্ঠবারের মতো আগরতলা সফরে এসেছিলেন । সেবার তিনি স্লেট পাথরের টালিতে ছাওয়া কুঞ্জবন বাংলোতে অবস্থান করেছিলেন । মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবির সম্মানে মনিপুরি রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় । সেখানে যাওয়ার জন্য কবি উপস্থিত ব্যক্তিদের বলেছিলেন, ''লালুদের বাড়িতে আজ যাচ্ছি মণিপুরী নৃত্য দেখতে এখুনি ওরা আসছেন । তোমরা তৈরী হয়ে নাও—আমি প্রস্তুত হচ্ছি । দক্ষিণ সমীরণে আজ মাধবীর মধুময় মন্ত্র দিকে দিকে বার্তা পাঠিয়েছে । বসন্তের আগমনে আশার বাণীকে রূপ দিতে হবে ।—তবেই না প্রাণগঙ্গাকে আবাহনের সার্থকতা " 

 সেই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এই রাসনৃত্যে ব্রজেন্দ্রকিশোরের কন্যা উত্তরা দেবীও অংশগ্রহণ করেন । সিলেট ও আগরতলায় মনিপুরি নৃত্যশৈলীর বিশেষ লাবণ্যময়তা দেখে কবি শান্তিনিকেতনে মনিপুরি নৃত্য চর্চার উদ্যোগ নেন । ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের ছোটো ভাই মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন । শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তনের কথা চিন্তা করে কবি তখন ত্রিপুরা থেকে একজন অভিজ্ঞ নৃত্যশিল্পীর ব্যবস্থা করতে বললেন ব্রজেন্দ্রকিশোরকে । মহারাজার সঙ্গে পরামর্শ করে মাস কয়েক পরে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর রাজপরিবারের  মনিপুরি নৃত্যশিক্ষক রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠালেন মাঘ মাসের প্রথম দিকে  । তার সঙ্গে ছিলেন সহকারি হিসেবে আরেকজন মৃদঙ্গবাদক । শান্তিনিকেতনে ৭-৮ থেকে ১৪-১৫ বছরের ছাত্রদের বেছে নিয়ে বুদ্ধিমন্ত সিংহ নৃত্যশিক্ষণের কাজ শুরু করেন । সেই প্রথম দলটিতে ছিলেন ভবিষ্যতের ভারতবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শান্তিদেব ঘোষ । রবীন্দ্রনাথ তখন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলকে উৎসাহ দিতেন,  নৃত্যানুশীলন পর্যবেক্ষণ করতেন । শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে প্রতিদিন বিকেলে নাচের ক্লাস হত । শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, 

'কিছু নৃত্যভঙ্গি আয়ত্ত করার পর গুরুদেব তাঁর 'আয় আয়রে পাগল, ভুলবি রে চল আপনাকে' গানটির ছন্দে ওইসব নৃত্যভঙ্গি মিলিয়ে নেবার নির্দেশ দিলেন । বুদ্ধিমন্ত সিংহ গুরুদেবের নির্দেশে গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গি গুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আমাদের শিখিয়েছিলেন । এইভাবে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে গুরুদেবের আগ্রহে প্রথম নিয়মিত নাচ শেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল ।' ( শান্তিদেব ঘোষ : রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, কোলকাতা ) ।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজঅন্তঃপুরে মণিপুরি নৃত্যগীতের যে চর্চা ছিল, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন । হয়তো এ কারণেই রাজা ও মহারাজকুমার এর কাছে কবি নৃত্যশিক্ষক চেয়েছিলেন । ছেলেদের নৃত্য শিক্ষার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কবি স্থির করলেন মেয়েদেরও নাচ শেখানোর ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু পুরুষ শিক্ষকের কাছে মেয়েদের নাচ শেখা তখনকার দিনে অভাবনীয় ব্যাপার ছিল । তাই রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজকে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৯শে মাঘ এক চিঠি লিখে অনুরোধ করেন—

"মহারাজ বুদ্ধিমন্ত সিংহকে আশ্রমে পাঠিয়েছেন সেজন্য আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি । ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে । আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মনিপুরি শিল্পকার্য শিখিতে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছে । মহারাজ যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে । আমাদের দেশের ভদ্রঘরের মেয়েরা কাপড়বোনা প্রভৃতি কাজ নিজের হাতে করিতে অভ্যাস করে ইহাই আমাদের ইচ্ছা । এই জন্য আসাম হইতে একজন শিক্ষয়িত্রী এখানকার মেয়েদের তাঁতের কাজ শিখাইতেছে । কিন্তু সিলেটে আমি মনিপুরি মেয়েদের যে কাজ দেখিয়াছি তাহাই ইহার চেয়ে ভালো । আমি বুদ্ধিমন্তের নিকট আমার প্রস্তাব জানাইয়াছি । সে মহারাজের সম্মতি পাইলে তাহার স্ত্রীকে আনাইয়া এখানকার মহিলাদিগকে মনিপুরি নাচ এবং শিল্পকার্য শিখাইবার ব্যবস্থা করিতে পারিবে এরূপ বলিয়াছে । এই জন্য এ সম্বন্ধে মহারাজের সম্মতি ও আদেশের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম ।"

সেদিন শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চা প্রবর্তনে কবি যে কতটা উৎসাহী ছিলেন তা এই পত্র থেকেই বোঝা যায় ।

কিন্তু বুদ্ধিমন্ত সিংহ বেশিদিন শান্তিনিকেতনে থাকেননি । গ্রীষ্মের ছুটিতে সহযোগীসহ দেশে গিয়ে হয়তো পারিবারিক বা অন্য কোন কারণে তিনি আর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি । কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি যে নৃত্যশিক্ষাদানের পদ্ধতি ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন, পরবর্তীকালে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোরের নিকট তাঁর স্বীকারোক্তিতে এর সত্যতা প্রমাণ করে । তিনি বলেছিলেন, প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের মেয়েরা তাঁর নির্দেশ মতো তাঁর সঙ্গে পদক্ষেপ ও অঙ্গচালন করতে চাইছিল না । রবীন্দ্রনাথ তখন বয়োবৃদ্ধ । তিনিই তখন অগ্রণী হয়ে বুদ্ধিমন্তের নির্দেশ অনুযায়ী অবলীলা ক্রমে নৃত্য শুরু করেন । তখন মেয়েদের লজ্জা ভাঙে । আজকাল উক্ত ঘটনা অভিনব বলেই মেয়েদের নিকট অনুভূত হবে । মনিপুরি নৃত্য তালবদ্ধ ও যৌথ নৃত্য । এই নৃত্যের মাধ্যমে শরীরের আড়ষ্ট ভাব কেটে যায় । ব্যায়াম ও নৃত্যের এক যুগ্ম সাধনায় শরীর সুন্দর ও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে । সম্ভবত এটাই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন যদিও পরবর্তীকালে এই প্রচেষ্টা বাদ যায় ।

 এরপর কয়েকবছর শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায় । কবি যখন আরেকবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান তখন সেই সুযোগে মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবিকে আগরতলায় আসার আমন্ত্রণ জানান । কবি ১৩৩২ সালের ১০ ফাল্গুন, সোমবার ( ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ )  সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন । পূর্ববঙ্গ সফর শেষে সপ্তমবার তথা শেষবার আগরতলায় আসেন ।এবার ১০ থেকে ১৪ ফাল্গুন কবিগুরু আগরতলার 'পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন' । ১৩ ফাল্গুন সন্ধ্যায় রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবি রাসনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখেন । মৃদঙ্গ ও মন্দিরা সহযোগে বালিকাদের সমবেত উদ্যোগে পরিবেশিত বর্ণময় এই রাসনৃত্য প্রত্যক্ষ দর্শন করে কবি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি সেখানে স্থির করলেন শান্তিনিকেতনে পুনরায় নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তন করবেন । মহারাজাকে অনুরোধ করেন, একজন নৃত্য শিক্ষককে পাঠিয়ে দিতে । এবার মহারাজা রাজপরিবারের আরেকজন নৃত্যশিক্ষক নবকুমার সিংহ ঠাকুরকে পাঠিয়ে দেন । এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "কবি এই নৃত্য দেখিয়া এতই মুগ্ধ হইলেন যে, নৃত্য প্রবর্তনার জন্য নবকুমার সিংহ নামে এক মণিপুরি শিক্ষককে শান্তিনিকেতনের জন্য নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করিয়া আসিলেন ।" নবকুমার এসেছিলেন তার অনুজ বৈকুন্ঠ সিংহকে নিয়ে । বাছাই করা একদল ছাত্রীদের নিয়ে তিনি নাচের প্রশিক্ষণ শুরু করেন । ক্লাস হত আড়ালে শান্তিনিকেতনবাসীদের অগোচরে । সেই সময় বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড লিটন সাহেব শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন । তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয় নবকুমারের শেখানো মনিপুরি নাচের একটি অনুষ্ঠানের দ্বারা । সেদিন মনিপুরি রাসলীলা নৃত্যের কিছুটা অংশ দেখানো হয়েছিল ।

১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কবির জন্মদিনে নবকুমারের প্রযোজনায় 'নটীর পূজা' নৃত্যনাট্যের প্রথম সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন হয় । এটি কবির 'পূজারিণী' কবিতার রূপায়ণ । শান্তিনিকেতনের নৃত্যের ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা ।'নটীর পূজা'র মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে । ছাত্রীরাও তখন নিঃসংকোচে নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে । বুদ্ধিমন্তের সময়ে নাচ শেখার আগ্রহ থাকলেও মেয়েরা এগিয়ে আসতে চাইত না । 'নটীর পূজা'র সময় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে । ১৯২৭ সালে কলকাতায় পুনরায় অভিনীত হয় 'নটির পূজা' । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, 'নাটকটির শেষ অংশে ভৈরব রাগিনীতে রচিত 'আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো' গানটির সঙ্গে নন্দলালকন্যা শ্রীমতি গৌরী দেবীর মনিপুরি নৃত্য সহযোগে 'শ্রীমতি'র আত্মনিবেদনের অভিনয় সেদিন শিশু থেকে বয়স্ক দর্শকদের সকলেরই মনে গভীর রেখাপাত করেছিল ।' নৃত্যশিল্পী নটীরূপী গৌরীদেবীর নৃত্যভঙ্গিমার অপূর্ব দক্ষতা সেকালের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল । এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে সম্ভবত, সেই প্রথম উচ্চ ভদ্রবংশীয় কোন মেয়েকে সর্বসমক্ষে নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় । 'নটীর পূজা'তে রবীন্দ্রনাথ প্রথম একটি নৃত্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা সমগ্র নাটকের মূল সুরটিকে ধরে রাখে । পরবর্তী সময়ে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রচিত হয় 'তাসের দেশ' ও 'শাপমোচন' যাতে নৃত্যকে আরো বেশি প্রাধান্য দিয়ে সন্নিবিষ্ট করা হয় নাটকে । 'নটীর পূজা'র সময়কালে নবকুমারের জন্যই শিক্ষিত দেশবাসী মনিপুরি নাচের মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারেন বলে শান্তিদেব ঘোষ উল্লেখ করেছেন । প্রভাতকুমার লিখেছেন, "এই নবকুমারের শান্তিনিকেতনে আগমন একটি বিশেষ ঘটনাই বলিব । কারণ এই নবকুমার হইতে শান্তিনিকেতনে  নৃত্যকলা নতুন রূপ পরিগ্রহ করিল, এতদিন পরে যথার্থ নৃত্য শিক্ষক আসিল ।"

 "এইভাবে গুরুদেবের গানের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র নৃত্যপ্রথা নবকুমারের শিক্ষকতায় 'নটীর পূজা'র অভিনয় থেকে শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রবর্তিত হয় '' । বলা যেতে পারে নবকুমার শান্তিনিকেতনের মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিলেন । ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে পৌষ মাসের  (১৯৩১ ) খ্রিস্টাব্দ নবকুমার সিংহ সৃষ্ট মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে ও ভীমরাও শাস্ত্রীর সংগীত পরিচালনায় প্রথম শাপমোচন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় । পরে কলকাতা নিউ এম্পায়ারে, শান্তিনিকেতনে ও সিংহলে এই নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছিল । এরপর মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে নবরূপায়ণ রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য 'শ্যামা' পরিবেশন করেন । শুধু যে বিভিন্ন রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যেই মনিপুরি ও অন্যান্য ধ্রুপদী ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রা ও শৈলী পরিবেশিত হয়েছে এমন নয় । রবীন্দ্রসংগীত সহযোগে যে সমস্ত নৃত্যের 'কোরিওগ্রাফি' রচনা করা হয়েছে সেখানেও ঠাকুর নবকুমার সিংহের মণিপুরি আঙ্গিকে সৃষ্ট নির্দেশনাকে রবীন্দ্রনাথ যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও মূল্য দিতেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত বিশারদ শান্তিদেব ঘোষ মহাশয় তাঁর লেখনীতে এইভাবে প্রকাশ করেছেন,  'গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি গানের ভাষা, অর্থ, উচ্চারণ, সুরের উঠানামা, লয়, বিস্তার এগুলির প্রতি যত্নশীল ছিলেন' । তাঁর এই কাজে নবকুমার ছিলেন একান্ত আপন । তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য সহযোগে এগুলি পরিবেশিত হলে সেসব সৃষ্টি হয়ে উঠত প্রাণবন্ত । বসন্তোৎসব, অভিসার, শারদোৎসব, পূজারিণী এমন অনেক গীতিনাট্যে নবকুমার সিংহের সুচিন্তিত নৃত্যশৈলীর যথার্থ প্রয়োগ আজও   আলোচনার বিষয় হয়ে আছে । সেই রীতি অধ্যবধি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য চর্চার মধ্য দিয়ে অনুসৃত হয়ে আসছে । 'ঋতুরঙ্গ' নামে আরেকটি সার্থক নৃত্যনাট্যের পরিচালনায় ছিলেন নবকুমার সিংহ । নবকুমার ও মনিপুরি নৃত্য সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' গ্রন্থে বলেছেন—

"... নটীর পূজায় মণিপুরি নাচের সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে ১৯২৭ সালে গুরুদেব নটরাজ গীতিকাব্যের আসর বসালেন দোলপূর্ণিমার দিনে শান্তিনিকেতনে । কেবলমাত্র তালযন্ত্রের নৃত্যছন্দে নাচ দেখানোর চেষ্টা পরবর্তীকালে 'শাপমোচন'-র অভিনয়ের সময়েই বিশেষভাবে শুরু হয় । মনিপুরি বোলের নাচ দিয়েই তার সূত্রপাত । গানের মাঝে মাঝে ছোট খোলের বোল দিয়ে অভিনয় থেকে কেবল নাচের ছন্দে দর্শকের মনকে একটু আন্দোলিত করাই হল এর কাজ । এটির সূত্রপাত করে যান 'শাপমোচন' এর যুগে (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ ) নবকুমার সিংহ, যিনি প্রথম নটীর পূজার যুগে মনিপুরি নাচ শান্তিনিকেতনের মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ।... গুরুদেবের গানকে নাচের অভিনয়ে রূপ দেবার তাঁর মত ক্ষমতা আমি আর কোন নর্তকের মধ্যে দেখিনি । এই সময়ে তাঁর সাহায্যে শান্তিনিকেতনের নৃত্যাভিনয়ের ধারা মনিপুরি পদ্ধতিতে প্রভূত উন্নতি লাভ করে ।"

শান্তিনিকেতনের সাফল্যের সূত্রে নবকুমার আহমেদাবাদ, মুম্বাই প্রভৃতি জায়গা থেকে ডাক পেয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩৪ এ সদলবলে সিংহলে ( শ্রীলংকা ) যান তখন তিনি নবকুমার এবং তাঁর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন নটীর পূজা এবং শাপমোচন অনুষ্ঠানে তাঁদের যোগদানের জন্য ।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নবকুমার সিংহ আগরতলার নিজের বাসভবনে চলে আসেন । মনিপুরি নৃত্যধারাকে সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করার অগ্রপথিক হিসেবে ইম্ফলের মনিপুরি সাহিত্য পরিষদ ২৩ মার্চ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নবকুমার সিংহকে 'নৃত্যগুরু' উপাধিতে ভূষিত  করেন । শিল্পীকে অভিজ্ঞান পত্র ও সম্মানের অঙ্গ হিসেবে কীর্তনের শ্বেতশুভ্র পোশাক ও পাগড়ি দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় । ২১ এপ্রিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিভাধর শিল্পী ৮১ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, 

"গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য ধারার প্রচলন করলেন তার ভিত্তিভূমি রচনা করার সময় নবকুমারকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর সহায়ক হিসেবে । আজ শান্তিনিকেতনের নৃত্যের গৌরবের সঙ্গে তাঁর নাম আমাদের করতেই হবে । আমাদের কাছে তাঁর স্মৃতি কোনদিনই লুপ্ত হবে না ।"

নবকুমারের পর আরো অনেক নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে এসে মনিপুরি নৃত্য ধারাকে অবারিত ও প্রসারিত করে গেছেন । তাঁদের মধ্যে ছিলেন ত্রিপুরা থেকে সাপম বসন্ত সিংহ ও রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ, শিলচর থেকে সেনারিক সিংহ,তদানীন্তন শ্রীহট্টজেলার অন্তর্গত ভানুগাছ থেকে নীলেশ্বর মুখার্জি ( তিনি মনিপুরি ব্রাহ্মণ ) এবং ইম্ফল থেকে হাওবম আতম্বা সিংহ প্রমুখ । তাঁদের মধ্যে অনেকেই শুধু শিক্ষকতায় নয় মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অনেক নৃত্যনাট্যের রূপায়ণে সফলতা লাভ করে অবিস্মরণীয় স্মৃতি রেখে গেছেন ।

নব কুমার সিংহের পর যিনি শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে ত্রিপুরা থেকে গিয়েছিলেন তাঁর নাম নীলেশ্বর মুখার্জি । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের কুলীন ব্রাহ্মণ নীলেশ্বর মুখার্জির জন্মভূমি শ্রীহট্টের ভানুগাছ সংলগ্ন বালিগাঁও । পড়াশোনা শ্রীহট্টের কমলগঞ্জ, ত্রিপুরার কৈলাশহর ও পরবর্তী সময়ে শিলচর । খোলবাদক হিসেবে যৌবনে চারদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল । ত্রিপুরা-শ্রীহট্ট অঞ্চলে মনিপুরি সমাজে গায়কবাদক হিসেবে নীলেশ্বর তখন এক উজ্জ্বল নাম । একসময় আমন্ত্রণ পেয়ে ত্রিপুরা রাজ দরবারেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন । ১৯৩৫ সালে নীলেশ্বর মুখার্জী শান্তিনিকেতনে যোগ দেন । চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা প্রকাশের ৪৪ বছর পর ১৯৩৬ সালে নবরূপ পায় চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য । কলকাতার অ্যাম্পায়ার থিয়েটারে ১৯৩৬ সালের ১১-১৩ মার্চ চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় । রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন—

শান্তিনিকেতনের কলাচর্চার আদর্শ প্রচার ও বিশ্বভারতীর শূন্য তহবিল আংশিকভাবে পূর্ণ করা এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল । কবিগুরু ৭৫ বছর বয়সে স্বয়ং অভিনয়ের বিরাট দল নিয়ে উত্তর ভারতে যাত্রা করেন । অভিনয়ের তারিখ ও হলের নাম :– ১৬-১৭ মার্চ– পাটনা, হুইলার সিনেট হল ও এলিফিনিসটোন পিকচার প্যালেস । উনিশ মার্চ– এলাহাবাদ, রিজেন্ট । ২২-২৩ মার্চ– লাহোর,  প্লজ । ২৬-২৭ মার্চ– দিল্লি, রিগাল থিয়েটার । ২৯ মার্চ– মিরাট । ( রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক, চতুর্থ খন্ড ) ।

নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা নাচের ব্যাপারে এক বিশেষ ভূমিকা ছিল নীলেশ্বর মুখার্জির । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহস্পর্শে শান্তিনিকেতনে কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন তিনি । তিনি ছিলেন মণিপুরি নৃত্যের শিক্ষক । এমনকি শান্তিনিকেতনের সেইদিনের ছাত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর কাছে নৃত্যের তালিম নিয়েছিলেন । ১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । সে সময়ের পত্রপত্রিকায় এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় । নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার নৃত্য সমাবেশে প্রথমে মনিপুরি শৈলীর প্রাধান্য থাকলেও গৌণভাবে এতে কথাকলি ও অন্যান্য প্রদেশের লোকনৃত্য এবং সেইসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের মিশ্ররীতির ধারা । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন,

 "চিত্রাঙ্গদা ১৯৩৬ সালে প্রথম যেবার অভিনীত হয় তাতে মনিপুরী পদ্ধতি ছিল প্রধান। তার সঙ্গে সামান্য কিছু কথাকলি, ও লোকনৃত্যের ভঙ্গি মেশানো ছিল । কিন্তু কথাকলির উপযুক্ত শিক্ষক  পাওয়া যাবার পর অর্জুনের অভিনয়ে কথাকলি নৃত্যপদ্ধতি বেশ খানিকটা প্রাধান্য পেল নাচের সঙ্গে  ।'' 
চিত্রাঙ্গদায় যেসব শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন শান্তিদেব ঘোষ, নীলেশ্বর মুখার্জী, গোবর্ধন পাঞ্চাল, শিশিরকুমার ঘোষ, ডি বাল গঙ্গাধর, সন্তোষ ভঞ্জ চৌধুরী, শিবকুমার দত্ত, হীরেন ঘোষ, বিশ্বরূপ বসু, যমুনা দেবী, নিবেদিতা দেবী, মমতা দেবী, হাসু দেবী, দীপ্তি দেবী, ইন্দু দেবী, মনিকা দেবী, রমা দেবী প্রমুখগণ । পূর্ববঙ্গে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থের জন্য ১৯৩৮ সালে মার্চ মাসে শান্তিদেব ঘোষের দায়িত্বাধীনে যে শিল্পীদল গিয়েছিলেন তাতেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নীলেশ্বর মুখার্জি ।

১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিত্রাঙ্গদা প্রস্তুতি পর্বে ত্রিপুরা থেকে আরো একজন নৃত্য শিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন তাঁর নাম বসন্ত সিংহ । রাজপরিবারের নৃত্য শিক্ষক ছিলেন তিনি । মহারাজা বীর বিক্রমের রাজত্বকালে রাজধানী, বিশেষত রাজবাড়িতে আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে বসন্ত সিংহ সফলভাবে নৃত্য ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা যায় । বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর ত্রিপুরা থেকে অপর একজন নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন । তাঁর নাম রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ । খাঁটি মনিপুরি শৈলী বজায় রেখে তিনি নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন । শান্তিনিকেতনে চন্দ্রজিৎ যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেন । ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি যখন শেষবারের মতো আগরতলা এলেন তখন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে প্রতিদিন মনোজ্ঞ মণিপুরি নৃত্য পরিবেশিত হত । সেখানে  রাসনৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়েছিল । রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজঅন্তঃপুরের মেয়েরা এই নৃত্যে অংশ নিয়েছিল । সেদিন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়ির নৃত্যানুষ্ঠানে কিশোরবয়স্ক চন্দ্রজিৎ 'আবিরখেলা' নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন । কবি তার নৃত্য দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন । ১৯০৬ সালে বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর শান্তিনিকেতনে মনিপুরি নৃত্যশিক্ষকের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । ব্রজেন্দ্রকিশোর তখন চন্দ্রজিৎকে সেখানে পাঠিয়ে দেন । চন্দ্রজিৎ মাত্র দেড়-দুই বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন । মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে চন্দ্রজিৎ শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দিয়েছিলেন । তখন নৃত্যের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মৃদঙ্গ, খুব বেশি হলে সেতার ব্যবহৃত হত । কিন্তু হারমোনিয়াম তবলা কখনো না । 'চিত্রাঙ্গদা', 'তাসের দেশ' ইত্যাদি নৃত্যনাট্যে তাঁর ভূমিকা ছিল । রবীন্দ্রসংগীতের নৃত্যরূপ দিতে তিনি মণিপুরি রাসের 'ভঙ্গিপারেং' মুদ্রাগুলোর সাহায্য নিয়েছিলেন বলে জানা যায় । চন্দ্রজিতের সে যুগের ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন নন্দলাল কন্যা যমুনা, আম্বালাল সারাভাইকন্যা মৃণালিনী, রবীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা নন্দিতা প্রমুখ ।

একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষার জন্য আগরতলা থেকে মনিপুরি নৃত্যশিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন । ত্রিপুরার রাজানকুল্যের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজপরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ থাকার ফলেই তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে মনিপুরি নৃত্যের আন্তর্জাতিক সমাদর বা স্বীকৃতি এসেছে । জহুরি জহর চেনে । 'আজি হতে শতবর্ষ আগে' রবীন্দ্রনাথই চিনেছিলেন এই সম্পদকে । শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় মনিপুরি নৃত্যের সংযোজন এবং রবীন্দ্রসৃষ্টির সংমিশ্রণে আলোকিত হয়ে মণিপুরি নৃত্য সেদিন বিশ্বের অঙ্গনে স্থান করে নিতে পেরেছিল ।

গ্রন্থঋণ :

১. রবি জীবনী-সপ্তম খন্ড, প্রশান্ত পাল পৃ. ৪৪২
২. রাজপ্রাসাদে মনিপুরী নৃত্য-গীতের চর্চা–( ত্রিপুরার রাজ অন্দর- রাজকুমার জীতেন্দ্রজিৎ সিংহ, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, আগরতলা ) পৃ. ১৯–৩০
৩. ত্রিপুরায় মনিপুরী নৃত্যচর্চা, নীলমণি দত্ত, ( ত্রিপুরা প্রসঙ্গ ১৯৭৫ ) পৃ. ১০০-১০১
৪. ত্রিপুরা রাজ পরিবার ও মনিপুরী সমাজ–রাজকুমার কমলজিৎ সিংহ ( উজ্জয়ন্ত ২০০১ )পৃ. ১৪৭
৫. ত্রিপুরায় রবীন্দ্র স্মৃতি–সত্য রঞ্জন বসু ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ) আগরতলা, পৃ ১–৬
৬. স্মৃতি ভারে পড়ে আছি আমি–নবকুমার সিংহ ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ২৪৫ )  আগরতলা
৭.  গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য–শান্তিদেব ঘোষ, কলকাতা
৮. উত্তর-পূর্ব ভারত ও রবীন্দ্রনাথ ( কোলকাতা ) বিকচ চৌধুরী ।
৯. উত্তর পূর্বাঞ্চল ও রবীন্দ্রনাথ–পান্নালাল রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা ) ।
১০. অন্য রবীন্দ্রনাথ–ড. দেবব্রত দেব রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা )
১১. রবীন্দ্র আলোকে মনিপুরী নৃত্য ও সাহিত্য–নোংথোম্বম কুঞ্জমোহন সিংহ ( প্রবন্ধ ) আগরতলা বইমেলা স্মরণিকা ২০১২-পৃ, ২২- ৩২
১২. চিত্রাঙ্গদা দেশের রবীন্দ্রনাথ–বিকচ চৌধুরী ( প্রবন্ধ ) গোমতী রবীন্দ্রসংখ্যা ২০১০-পৃ. ৭–১৪
১৩. শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় ত্রিপুরার ভূমিকা–পান্নালাল রায় ( প্রবন্ধ ) গোমতি রবীন্দ্র সংখা ২০১০পৃ. ১১০–১১১
১৪. মণিপুর ও মণিপুরি–এল বীরমঙ্গল সিংহ, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, আগরতলা ।
১৫. রবীন্দ্রজীবন কথা– প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ সংস্করণ ।
১৬. গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য– শান্তিদেব ঘোষ, আনন্দ, কলকাতা ।

Saturday, May 13, 2023

সাব্রুম

সাব্রুম

উত্তর-পুবের দক্ষিণ-পশ্চিমে শেষ শহরটির পাশে,
পাশের দেশের শহরের নামে জলধারাটি আছে ।
জলের উপর নবীন সেতু নবীন পাড়ার ধারে,
শুকনো হলেও প্রতিবেশী জলের বদনাম করে ।

জাদু বনাম যাদু

'জাদু' মানে ইন্দ্রজাল,ম্যাজিক । ( ফারসি শব্দ ) ।
'যাদু'  মানে বাছা, সন্তান । যদু বংশীয় বা যাদবসন্তান অর্থে 'যাদু' । শ্রীকৃষ্ণ সেই অর্থে 'যাদু বাছাধন' । 'যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন' ।

Friday, May 12, 2023

ত্রিপুরার প্রকাশনাশিল্প : ইতিহাস ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

ত্রিপুরার প্রকাশনাশিল্প : ইতিহাস ও সাম্প্রতিক প্রবণতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মানুষের মননচর্চার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক গভীরভাবে সন্নিবিষ্ট । কোন জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের মাপকাঠি শুধু তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, মননচর্চার উৎকর্ষতার মধ্যেও তার উন্নয়ন নিহিত থাকে । মানুষের অনুভূতি, আবেগ, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, প্রকাশভঙ্গি, মনীষা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটে বইয়ের মাধ্যমে । বইকে সমাজ সভ্যতা থেকে আলাদা করে দেখলে পৃথিবীকে আবার আদিম প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে চলে যেতে হবে ।‌ এবং সভ্যতা অচল, অসাড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে ।  সেই জন্য সভ্যতার অগ্রগমনকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যেই বই প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয় । উন্নত ও সভ্য দেশসমূহে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বই প্রকাশকে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে । প্রাচীন রাজা-বাদশা-সম্রাটের আমলে জ্ঞানচর্চার জন্য বই প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায় । সে সময় হাতে লেখা মূল পান্ডুলিপি তৈরি করা হত । পরে মূল পান্ডুলিপি থেকে বহু অনুলিপি তৈরি হত । প্রাচীন রাজা-বাদশাদের রাজসরকারে মাসোহারাধারী কর্মচারী রাখা হত  অনুলিখনের জন্য । তাদের 'করণ' বা 'করণিক' নামে পরিচিত হত । ত্রিপুরার মহারাজা ধর্মমাণিক্যের আমলে ( ১৪৩১ ১৪৬২ খ্রি. ) পন্ডিত শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর রাজপুরোহিত ও রাজার সভাপন্ডিত ছিলেন । মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নির্দেশে চন্তাই দুর্লভেন্দ্রের সহায়তায় তাঁরা রাজমালা রচনা করেছিলেন ।

পরবর্তী সময়ে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথেই গ্রন্থপ্রকাশ সহজতর হয়ে ওঠে । ১৯০০ সালে বিশ্বের প্রাচীন মুদ্রিত গ্রন্থ 'হীরক সূত্র' পাওয়া যায় চীনের পশ্চিমাঞ্চলের তুং হুয়াং শহরের হাজার বুদ্ধের গুহায় । এই গ্রন্থটির মুদ্রণকাল ছিল ১১ মে ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ । কাঠ খোদাই করে এর লিপি লেখা হয়েছিল । এই গ্রন্থটি বুদ্ধের উপদেশাবলিতে পূর্ণ । ১৯০৭ সালে গবেষক ডক্টর অরেন স্টাইন এই পুস্তকটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম মুদ্রিত গ্রন্থ বলে প্রমাণ করেন ।

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির গুটেনবার্গ ( ১৪০০-১৪৬৮ )  প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন করেন । জার্মানিতে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার এর সাথে সাথে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । তার ফলে সেসময় সারা ইউরোপের সর্বত্র প্রবল রেনেসাঁর জোয়ার দেখা দেয় । জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা সর্বক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটে যায় সমগ্র পশ্চিমাবিশ্বে । ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ।

ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন পর্তুগিজরা । ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের বছর অর্থাৎ মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ( ১৫৫৬-১৬০৫ )  ভারতে প্রথম ছাপাখানার প্রবর্তন করেন পর্তুগিজরা । ভারতে প্রথম ছাপা বইয়ের যে নিদর্শনটি পাওয়া যায় তা ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের ছাপা । বইটির নাম হল, 'কম্পেনডিও স্পিরিচ্যুয়াল দ্য ভিডা খ্রিস্টা' ( Compendio Espiritual da vida Christa ) । বইটি নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে । বাংলা ছাপাখানার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস । কোম্পানির কর্মচারীরা যাতে বাংলা ভাষা শিখতে পারে তার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস এর অন্যতম বন্ধু ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেব রচনা করেন, 'A grammar of the Bengali language' . বইটি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিদেশি বইব্যবসায়ী জন এন্ড্রুজ সাহেবের হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা থেকে ছেপে বের হয় । বাংলা ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রথম বই এটি । মুদ্রাকর ছিলেন চার্লস উইলিকিনস । এন্ড্রুজের ছাপাখানায় বাংলাদেশের প্রথম ছাপাখানা । বাংলার দ্বিতীয় ছাপাখানা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'কোম্পানির প্রেস' । ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে স্থাপিত হয় শ্রীরামপুর মিশন । ওই বছরেই মার্চ মাসে উইলিয়াম কেরি 'শ্রীরামপুর মিশন প্রেস' নামে একটি ছাপাখানা খোলেন । এই মাসেই পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ 'মথী রচিত মঙ্গল সমাচার' ছাপা হয় মিশন প্রেস থেকে । উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাইবেল বাংলা ছাড়াও হিন্দি, অসমীয়া, উড়িয়া, মারাঠি প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বই  প্রকাশিত হয় এই প্রেস থেকে । ১৮৩৭ সালে এই ছাপাখানা টি বন্ধ হয়ে যায় ।

রাজন্য ত্রিপুরায়ও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায় । ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২-১৮৯৬ ) উদ্যোগে ত্রিপুরায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র অর্থাৎ ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এই ছাপাখানা নাম ছিল 'বীর যন্ত্র' এই 'বীর যন্ত্র' থেকেই ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল 'গোবিন্দবাহ কৌমুদী' । বীরচন্দ্রের লেখা অকাল কুসুম ( ১৮৮৬ খ্রি. ) এবং ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল দুর্গামণি উজিরের 'রাজমালা' ।

আরো একটি তথ্য থেকে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র ছাপার আগ্রহের কথা প্রকাশ পায় । ১৯৬১ সালের ২৫ শে বৈশাখ ( ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ) ত্রিপুরার রাজ দরবার সেদিন  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মদিবস পালন করেছিল । ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীর বিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর সেদিনের অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে 'ভারত ভাস্কর' উপাধিতে ভূষিত করবেন । পাঁচ দিন পরে ( ৩০ বৈশাখ ) শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে আয়োজিত হয়েছিল সেই বিশেষ অনুষ্ঠান । অসুস্থ কবিকে সেদিন একটি হুইলচেয়ারে বসিয়ে সভাস্থলে আনা হয়েছিল । ত্রিপুরা রাজপ্রতিনিধিরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে কবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন 'ভারত ভাস্কর' সম্মাননা এবং অর্ঘ । কবি ত্রিপুরার মহারাজার মানপত্র সসম্মানে গ্রহণ করেন । সেদিন  কবির হাতে স্বাক্ষর করা ভাষণটি পাঠ করেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই ভাষণে কবি উল্লেখ করেছিলেন—

"ত্রিপুরা রাজবংশ থেকে একদা আমি অপ্রত্যাশিত সম্মান পেয়েছিলাম তা আজ বিশেষ করে স্মরণ করবার ও স্মরণীয় করবার দিন উপস্থিত হয়েছে ।  এরকম প্রত্যাশিত সম্মান ইতিহাসের দুর্লভ । সেদিন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য এই কথাটি আমাকে জানাবার জন্য তাঁর দূত আমার কাছে প্রেরণ করেছিলেন যে, তিনি আমার তৎকালীন রচনার মধ্যে একটি বৃহৎ ভবিষ্যতের সূচনা দেখেছেন । সেদিন এ কথাটি সম্পূর্ণ আশ্বাসের সহিত গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল । আমার তখন বয়স অল্প; লেখার পরিমাণ কম। এবং দেশের অধিকাংশ পাঠক তাকে বাল্যলীলা বলে বিদ্রুপ করত । বীরচন্দ্র তা জানতেন এবং তাতে তিনি দুঃখবোধ করেছিলেন । সেজন্য তাঁর একটি প্রস্তাব ছিল লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার অলংকৃত কবিতা সংস্করণ ছাপানো হবে । তখন তিনি ছিলেন কার্শিয়াং পাহাড়ে, বায়ু পরিবর্তনের জন্য । কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয় ।"

বীরচন্দ্র মানিক্য তাঁর স্বপ্নের সেই ছাপাখানাটি করে যেতে না পারলেও তাঁর রাজত্বকালে 'বীর যন্ত্র' ছাড়াও 'ললিত যন্ত্র' নামে আরেকটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন । এরপরে ত্রিপুরায় পর্যায়ক্রমে স্থাপিত হয়েছিল রাজমালা প্রেস  ও ত্রিপুরা স্টেট প্রেস । এই ছাপাখানাগুলো থেকে তখনকার সময়ে কিছু কিছু বইপত্র ছাপা হয়েছিল । ভারতভূক্তির পরে ত্রিপুরারাজ্যের আগরতলা ছাড়াও কৈলাসহর, উদয়পুর ও বিলোনিয়াতে ছোটো ছোটো ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল । সেগুলো থেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছাপার কাজ না হলেও কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।

মূলত, ছাপাখানা থাকলেই প্রকাশনার গুরুত্ব বাড়ে । ছাপাখানাকে কেন্দ্র করেই প্রকশনাশিল্প উন্নতির পথ খুঁজে পায় । ত্রিপুরারাজ্যেও বিগত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশক থেকে প্রকাশনাশিল্প উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির পথে এগোতে থাকে । ষাট সত্তরের দশকে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে সলিলকৃষ্ণ দেববর্মনের 'জলের ভেতর বুকের ভেতর', গল্পকার বিমল চৌধুরীর 'মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ' স্বপন সেনগুপ্ত-র ' নীল আকাশ : পাখী, প্রবীর দাস ও শ্রীবাস ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় কবিতা সংকলন 'এক আকাশ তারা', মিহির দেবের 'বাংলাদেশ, স্বদেশ ও আমি, কল্যাণব্রত চক্রবর্তীর কবিতার বই 'অন্ধকারে প্রণামের ইচ্ছা হয়',তাপস শীলের 'কার্বন লাইট', নকুল রায়ের শানিত দীপমল্লিকা, মানস পালের 'ঘুম নেই অরণ্য চোখে', অধ্যাপক কমলকুমার মিত্রের 'ক্রীড়াঞ্জলি' উল্লেখযোগ্য । এই সময়ে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হতে থাকে । আটের দশকের শুরুতেই আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে । প্রথমদিকে আগরতলা বইমেলায় প্রকাশিত রাজ্যের বিভিন্ন প্রকাশনীর বইগুলো পাঠকের খুব একটা আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারলেও বর্তমানে ত্রিপুরার প্রকাশিত গ্রন্থ দেশের তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ঈর্ষণীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে । 

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনাশিল্প ভীষণ বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে । করোনাকালীন সময় থেকেই প্রকাশনা শিল্পের বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে । তবে শুধু প্রকাশনাশিল্পই নয় । সারা বিশ্ববাজারে বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে । এক্ষেত্রে করোনা মহামারী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, টাকার মূল্যের অস্বাভাবিক পতন ইত্যাদি কারণে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ব্যবসায়ী, ভোক্তা, লেখক, পাঠক প্রকাশক, সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । বর্তমানে আর্থিক মন্দার বাজারে সংসারের প্রতিদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতেই মানুষ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন । ফলে পারিবারিক সমস্ত ব্যয়ভার নির্বাহ করে বই কেনার কথা ভাবতেই পারেন না পাঠকসমাজ ।

এছাড়া প্রকাশনা জগতের প্রতি বর্তমানে অনেকেই আকৃষ্ট হওয়ার ফলে এই শিল্পক্ষেত্রে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে । বই প্রকাশের বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে কাগজ, কালি, প্লেট ইত্যাদির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে । ফলে ব্যবসার পুঁজি এবং ঝুঁকি ও বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে । আগে যেরকম পাঁচশো হাজার কপি ছাপানো হত সেই জায়গায় বর্তমানে তা একশো কপিতে এসে দাঁড়িয়েছে । বেশি বই ছাপিয়ে কেউ এখন আর ঝুঁকি নিতে চান না । এখন প্রকাশনার ক্ষেত্রে 'প্রি বুকিং' চালু হয়েছে । বাজারের অবস্থা বুঝে বই ছাপানো হয় । কিছু কিছু প্রকাশক এখন আর ব্যবসা ক্ষেত্রে পুঁজি খাটাতে চান না । তাঁরা কইয়ের তেলে কই ভাজার মত লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপেন । টাকা নিয়ে বই ছাপাটা মোটেই দোষের কিছু নয় । 'আউটসোর্সিং' বিষয়টা এখন সব ব্যবসাতেই রয়েছে । তবে এতে  প্রকাশকের কোন দায় থাকে না । এতে প্রকাশনাশিল্পের উৎকর্ষ ও লেখকের সৃজনশীলতার মানের মূল্যায়ন হয় না । টাকার বিনিময়ে প্রকাশক লেখক এর পান্ডুলিপির গুণগত মান যাচাই না করেই বই ছাপেন । আসলে যজমানের পয়সা দিয়েই একশ্রেণীর প্রকাশক তাদের নৈবেদ্য সাজান । তেল অনুযায়ী নির্ধারিত হয় ভাজা কতটা মুচমুচে হবে । বই প্রকাশের পূর্বাহ্নেই লেখকের সঙ্গে দর কষাকষি করে ঠিক করে নেওয়া হয় বইয়ের মান অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয়ের হিসাব । তার উপরে নির্ভর করে বইয়ের গুণগত মান, নির্ভুলভাবে প্রকাশ করার আগ্রহ, সুন্দর সম্পাদনা ইত্যাদি ।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পে যুগান্তর সাধিত হয়ে গেছে । আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের সুবিধা নিয়ে এখন যে কোনো মুহূর্তেই ঝাঁ চকচকে বই প্রকাশ করা যায় যা এক নজরে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ । শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দন প্রকাশনাই গ্রন্থপ্রকাশের শেষ কথা নয় । বই প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও পেশাদারী মনোভাবের খুবই গুরুত্ব রয়েছে । বইপ্রকাশ এক ধরনের নেশা ও বটে । বই প্রকাশিত হয়ে পরিচিতি পেলে কিংবা মর্যাদা পেলে সেই প্রকাশককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না ।‌ ভালো বিক্রি হলে বই প্রকাশের উৎসাহ আরো বেড়ে যায় । প্রকাশনা জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় । পরিচিতি বেড়ে যায় । সমাজের মননশীল মানুষজনের  সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে । বলা যায়, প্রকাশকেরও যশের মহিমা রয়েছে । সেজন্যে বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে খুব সচেতন ভাবে কাজ করতে হয় । ভালো প্রকাশক হতে গেলে ভালো বইয়ের পান্ডুলিপির খোঁজ করতে হবে । ভালো লেখককে বই প্রকাশে উৎসাহিত করতে হবে ।

আমাদের রাজ্যে প্রকাশনাশিল্পের তেমন দৈন্যদশা না থাকলেও হাতেগোনা অল্প কয়েকটি সংস্থা সুপরিকল্পিতভাবে বই প্রকাশ করেন । দায়িত্বশীল ও পেশাদারী মনোভাবাপন্ন প্রকাশকের অভাব রয়েছে এই রাজ্যে । আমাদের রাজ্যের মধ্যে গুণগত মানের প্রকাশনার চাইতে সংখ্যাগত দিক দিয়ে বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করার আগ্রহ বা মানসিকতা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে । এটা বাস্তব যে, অধিক সংখ্যক বই একবারে প্রকাশ করলে সবগুলোর ক্ষেত্রে বইয়ের গুণগত মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায় না । প্রকাশনার বাজারটি প্রতিযোগিতামূলক । তবে সংখ্যাগত দিকের প্রতিযোগিতা নয় । গুণগত মানের দিকের প্রতিযোগিতা । এই কথাটা প্রকাশককে মনে রাখতে হবে ।

আমাদের রাজ্যে বইপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্যের সকল শাখায়  ততটা বিস্তৃত নয় । সৃজনশীল প্রকাশনার একটি সংকট এই রাজ্যে রয়েই গেছে । আমাদের এখানে সাহিত্যসমালোচনার ধারাটি এখনো সংগঠিত হয়ে ওঠেনি । সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে যেমন ধ্রুপদী সাহিত্য সমূহের সমালোচনা থাকবে, তেমনি ত্রিপুরার বুকে স্থানীয় লেখকরা যে সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি করছেন তারও সমালোচনামূলক গ্রন্থ থাকা দরকার । তবেই তো রাজ্যের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, লেখকদের সৃজনশীলতা সম্পর্কে বহির্রাজ্যের পাঠকরা জানতে পারবেন । পাশাপাশি লেখকরা ও বৃহত্তর ও পরিসরে আলোচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন । এতে তাঁরা সাহিত্যসৃষ্টিতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন । তবে সম্প্রতি রাজ্যের সমালোচনাসাহিত্যের অঙ্গনে  বেশ কয়েকজন এ প্রজন্মের প্রতিনিধি উঠে এসেছেন । তাঁদের মধ্যে তমালকিশোর দে, সুস্মিতা দাস, সৌম্যদীপ দেব, রণিতা নাথ প্রমুখগণ এই ধারাটি সমৃদ্ধ করার জন্য এগিয়ে এসেছেন । এর দ্বারা প্রকাশকরা ও উপকৃত হবেন । ভালো লেখক ও  তাঁরা নির্বাচন করতে পারবেন । সাহিত্য ক্ষেত্রে সমালোচনাসাহিত্য যত সমৃদ্ধ হবে সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তত সুদৃঢ় হবে ।

মননশীল ও সৃজনশীল লেখক তৈরীর ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সরকারি তরফে লেখককে উৎসাহ দেওয়া, লেখকের গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশককে বিশেষ কিছু সুযোগ ও আর্থিক অনুদান প্রদান করা যেতে পারে । সরকার উদ্যোগী হয়ে বই কিনে নিলেও প্রকাশক উপকৃত হন । কিন্তু কখনো কখনো প্রকাশনাশিল্পে সরকারি একদেশদর্শিতা লক্ষ্য করা যায় । যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন তখন তাঁর নিজ দলের মতাদর্শের অনুসারী লেখক বা প্রকাশকের বই বেশি করে সরকারি উদ্যোগে কিনে নেওয়া হয় । বিগত দিনগুলোতে রাজ্যে এই ধরনের প্রবণতার ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায় । প্রকাশকরা ও বিক্রয়ের ও ব্যবসার আশায় সেই অনুযায়ী লেখক নির্বাচন করেন । তাতে ব্যবসার ঝুঁকি থাকে না । সৃজনশীল প্রকাশনাকে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ স্পষ্ট থাকা দরকার । সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গন যেন রাজনৈতিক মতবাদ প্রভাবিত না হয় সেই দিকে সরকার খেয়াল রাখতে পারেন  ।

প্রকাশনাশিল্পকে শুধু শিল্প হিসেবেই মনে করলে চলবে না । সমৃদ্ধ ও সুশিক্ষিত জাতিগঠনে প্রকাশনাশিল্পের বিরাট ভূমিকা রয়েছে । সেক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি তেমনি প্রকাশকদেরও বিভিন্ন গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন । দেশে ও বিদেশে বহু প্রকাশন সংস্থা দেশের সৃজনশীল চর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন । বইমেলা, গ্রন্থপ্রকাশ, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, সম্মেলন, লেখকদের সম্মানিত করা ইত্যাদি প্রকাশক সংস্থাগুলো নিয়মিত করে থাকেন । ত্রিপুরারাজ্যে প্রকাশকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন রয়েছে । সৃষ্টিশীল কাজ ও প্রকাশনাকে জনপ্রিয় করার জন্য তাঁরাও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন । কিন্তু তা যথেষ্ট নয় । প্রকাশকদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু রাজ্যিক বা জাতীয় স্তরের কাজ করা দরকার । প্রকাশকদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় স্তরের সম্মেলন, সমাবেশ ইত্যাদি করলে তার বিস্তৃতি লাভ ঘটে । বিভিন্ন রাজ্যের লেখক, পাঠক এক মঞ্চে এলে পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় সম্ভবপর হয় । রাজ্যের প্রকাশকরা বহির্রাজ্যের লেখকের গ্রন্থও এতে প্রকাশ করার সুযোগ পান । আবার বহির্রাজ্যের প্রকাশকও এই রাজ্যের লেখককে বড় পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে পারেন ।

প্রকাশকদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ইচ্ছে করলে লেখকদের কাছ থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে প্রকাশনা চালিয়ে যেতে পারেন । তাতে সবাই একযোগে এগিয়ে যেতে পারবেন । লেখকের পান্ডুলিপি নিয়ে বসে পর্যালোচনা করার সময় লেখককে সামনে রেখে তাঁর সৃষ্টিকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন প্রকাশক সংগঠন । প্রয়োজনে লেখককে সহায়ক পুস্তক সরবরাহ করা যেতে পারে । এছাড়া প্রকাশকদের সম্মিলিত মঞ্চ থেকে প্রকাশনার দায়িত্বও নেওয়া যায় । সমষ্টির পুঁজিতে প্রকাশনা চললে কোন একক উদ্যোগীর কাঁধে আর্থিক চাপ পড়ে না । প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত থাকেন তাঁরাই বোঝেন এই শিল্পের সমস্যাটা কোথায় ? এ ব্যাপারে সরকারি কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন হলে তা প্রকাশকরা সম্মিলিতভাবে সরকারের গোচরে আনতে পারেন । প্রকাশনাশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ ভর্তুকিতে পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন । প্রসঙ্গত, আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটা অংশের প্রকাশকের সঙ্গে সরকারের যে মান অভিমানের পালা চলছে হাঁপানিয়াতে বইমেলা স্থানান্তরিত করায় । সেক্ষেত্রে মেলার স্টল গুলোর ভাড়ায় কিছুটা ছাড় দিলে বোধহয় এই প্রকাশকদের মান ভাঙবে । সেমিনার, সম্মেলন করার ক্ষেত্রে হল ভাড়া মুকুব, সরকারি উদ্যোগে অতিথিদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা, এ ধরনের আরও বহু বিষয়ে প্রকাশকগণ সম্মিলিতভাবে সরকারকে জ্ঞাত করতে পারেন । এর দ্বারা রাজ্যের প্রকাশনাশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে । পাশাপাশি রাজ্যের মননশীল লেখালেখির উন্নয়ন ঘটবে । প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে লেখক ও পাঠকের সরাসরি যোগ ঘটে । প্রকাশক বুঝেন পাঠকের রুচি । পাঠক মনস্তত্ত্ব বুঝে প্রকাশক লেখককে উৎসাহিত করবেন । সৃজনের ফসল পেতে এক কথায়, প্রকাশন শিল্পই 'পান্ডুলিপি পরে আয়োজন ।'

Tuesday, May 9, 2023

রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনা : প্রসঙ্গ ত্রিপুরা

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনা : প্রসঙ্গ ত্রিপুরা

 কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অসামান্য প্রতিভার অধিকারী । তিনি সাহিত্যকর্ম ছাড়াও শিক্ষা, পল্লী উন্নয়ন, আধুনিক কৃষি উন্নয়ন, কর্মশিক্ষা, সমবায় ভাবনা, ইত্যাদি বহুমুখী চিন্তা চেতনার ধারক । তাঁর নানা লেখালেখি এবং বিস্তৃত কর্মকাণ্ডে কৃষি উন্নয়ন ভাবনার বহু পরিচয় পাওয়া যায় । এদেশে আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ।  গ্রামীন কৃষির  আধুনিকীকরণের মাধ্যমে তিনি এদেশের দরিদ্র কৃষকদের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন । তিনি শ্রীনিকেতনে ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আধুনিক ধরনের খামার গড়ে তোলার জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে যখন রাশিয়া ভ্রমণে যান তখন তিনি সেখানকার কৃষকদের কর্মতৎপরতা আর দৃঢ় প্রত্যয়ী মানসিকতা দেখেন ও তার বিপরীতে এ দেশের কৃষকদের দুর্দশার কথা ভেবে তাঁর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল । এদেশের চাষীদের দুর্দশা দেখে কবি বলেছেন, 'কেবল ভাবছি আমাদের এ দেশের চাষীদের আমাদের দেশ জোড়া চাষীদের দুঃখের কথা । আমার যৌবনের আরম্ভকাল থেকেই বাংলাদেশে পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট–পরিচয় হয়েছে । তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ ছিল দেখাশোনা–ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে ।' ( রাশিয়ার চিঠি, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলিকাতা পৃ. ২০ )

বাংলাদেশের ঠাকুর পরিবারের তিনটি জমিদারি এস্টেট ছিল । এগুলো হলো বিরামপুর, শাহজাদপুর ও কালিগ্রাম । বিরামপুরের সদর দপ্তর ছিল কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ । শাহজাদপুর এবং কালিগ্রামের সদর দপ্তর ছিল নওগাঁ জেলার পতিশর । ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ পৈত্রিক সম্পত্তি দেখাশোনা করা এবং খাজনা আদায়ের জন্য বাংলাদেশের এ অঞ্চলে প্রথম আসেন । সেখানে তিনি দেখেছেন মহাজনের ঋণের জলে বাঁধা পড়া কৃষকদের দুঃসহ জীবন, তিনি দেখেছেন সেখানকার পতিত জমি, অনুর্বর জমি ও এক ফসলী জমিগুলো । এই কৃষকদের কথা ভেবে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন বাংলার কৃষি উন্নয়নে । জমিদারদের কবল থেকে বাংলার কৃষকদের রক্ষা করার জন্য ১৮৯৪ সালে শিলাইদহে এবং ১৯০৫ সালে পতিসরে স্থাপন করেছিলেন কৃষি ব্যাংক । উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ করেছিলেন । ১৯০৬ সালে তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং বন্ধুর ছেলে সন্তোষ মজুমদারকে ও ১৯০৭ সালে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে ( কন্যা মীরার বর ) আমেরিকার ইলিয়নস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন কৃষিতে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য । কৃষির আধুনিকায়নের জন্য ট্রাক্টরের ব্যবস্থা করেছিলেন । জৈব সার ব্যবহারের প্রয়াস নিয়েছিলেন । জমির আইল ও পতিত জমি ব্যবহার করে কৃষির ফলন বাড়ানো, সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদির উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি । কৃষি বিকাশে তাঁর অবদান সত্যি ইতিহাস হয়ে রয়েছে । আসলে এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের মানবতার আরেকটি উজ্জ্বল দিক উন্মোচিত হয়েছিল ।

১৮৮১ সালের ২৩ জুন প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে বিশেষ করে রাধাকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে সখ্যতায় আবদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন । ত্রিপুরা রাজ্যের পর পর চারজন রাজার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর সম্পর্ক ছিল । মহারাজা বীরচন্দ্রের ( ১৮৬২— ১৮৯৬ ) পর ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ( ১৩০৩ বঙ্গাব্দ ) রাজা হন রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৬–১৯০৯ ) । বীরচন্দ্রের আমলের শেষদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের সামগ্রিক অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটেছিল । বিপুল আর্থিক ঋণের ভার মাথায় নিয়ে রাধাকিশোর মাণিক্য সিংহাসনে আরোহন করেন । তাঁর রাজ্যভার গ্রহণের আগে থেকেই রাজপরিবারের মধ্যে অন্তর্কলহ সৃষ্টি হয় । রাজপরিবারের একটা গোষ্ঠী কৌশলে অনেক মূল্যবান কাগজপত্র সরিয়ে ফেলেন । সিংহাসনের দাবি নিয়ে রাধাকিশোর মাণিক্যের বিরোধী একটা অংশ ইংরেজ সরকারের আদালতে মামলা করেন । রাধাকিশোর সিংহাসনে বসার পর তার পুত্র বীরেন্দ্রকিশোরকে যুবরাজ বলে ঘোষণা করায় বড়ঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র ইংরেজদের আদালতে মামলা করেন । অন্যদিকে ১৮৯৭ সালের এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ত্রিপুরার রাজবাড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে । একদিকে আর্থিক সংকট, প্রাসাদের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র, সবমিলিয়ে রাধাকিশোর ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেও ধৈর্যচ্যুত হননি । সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকায় ইংরেজ সরকার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি ।রাধাকিশোর এই সময় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন । ১৮৯৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে সমস্যাদীর্ণ  ত্রিপুরাকে রবীন্দ্রনাথ বারবার সাহায্য করে গেছেন । রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পরামর্শদানকে রাজ পারিষদের অনেকে সুনজরে নেননি । তারা মনে করতেন, ত্রিপুরার রাজকার্যে রবীন্দ্রনাথ অনধিকার হস্তক্ষেপ করছেন । কিন্তু কবি প্রতিনিয়ত ত্রিপুরার মঙ্গলচিন্তা করতেন । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য সব সমালোচনা উপেক্ষা করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ গ্রহণ করতেন । রবীন্দ্রনাথ ও নানা বিষয়ে মহারাজকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন । রাজার ঋণ গ্রহণ, বাজেট নোট তৈরি, রাজকুমারদের শিক্ষা, রাজ্য পরিচালনা ইত্যাদি নানা বিষয় কবি রাজাকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন ।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের অর্থাৎ ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখ দোল পূর্ণিমার দিন মহারাজা রাধা কিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমবার ত্রিপুরায় আসেন । সে সময় তিনি সপরিবারে শিলাইদহে ছিলেন । লেখালেখি এবং চাষাবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর দিন অতিবাহিত হচ্ছিল । অল্প কিছুদিন আগে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুতে কবি গভীর শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন । এছাড়া কুষ্টিয়ায় ঠাকুর কোম্পানির ক্ষতি, কবির ঋণগ্রস্থ হওয়া, আর্থিক সংকট, পারিবারিক রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর মন ভারাক্রান্ত থাকায় বন্ধু রাধাকিশোর তাঁর মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ত্রিপুরায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথও সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ত্রিপুরায় এসেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ সব মিলিয়ে সাতবার আগরতলা পরিভ্রমণে এসেছিলেন । এর মধ্যে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমলে মোট পাঁচবার এসেছিলেন । ১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের বিশেষ আমন্ত্রণে শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথ ষষ্ঠবার আগরতলায় বেড়াতে এসেছিলেন । এরপর ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ফাল্গুন মাসের ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ ১০ থেকে ১৪ তারিখ মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে সপ্তমবার তথা শেষবার আগরতলায় এসেছিলেন ।

শিলাইদহে অবস্থানকালীন সময় রবীন্দ্রনাথ বাংলার কৃষির আধুনিকায়নের যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেই কৃষিভাবনা তিনি পরবর্তী সময়েও অন্তরে বহন করে  বেড়িয়েছিলেন । গঠনমূলক ও স্বাবলম্বী সমাজ গঠনের ভাবনাতেও তাঁর স্বকীয়তার ভাব স্পষ্ট ছিল । রবীন্দ্রনাথের কৃষিভাবনার মধ্যে কৃষিতে মাটির গুরুত্ব, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার, পতিত ও অনুর্বর জমিকে কাজে লাগানো, কৃষিতে সমবায় ভাবনা, জমিতে চাষির স্বত্ব এবং কৃষকদের জীবন যাপনের মানোনোন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে দুটি মেলার আয়োজন করেছিলেন । হলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ, নবান্ন প্রভৃতির মত উৎসবের সূচনা তাঁর কৃষিভাবনা ও গ্রামীণ অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর স্বকীয়তার পরিচয়কেই বহন করে ।

রবীন্দ্রনাথ শেষবার তথা সপ্তমবার যখন আগরতলায় আসেন তখন তাঁকে দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল রাজপারিষদ হরিদাস ভট্টাচার্যের উপর । হরিদাস ভট্টাচার্য মহাশয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্যের এই কয়টি দিনের অভিজ্ঞতা দিনলিপির আকারে লিখে রেখেছিলেন । তিনি লিখেছিলেন, '১০ই ফাল্গুন রাত্রি প্রায় দশ ঘটিকার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কুঞ্জবন প্রাসাদে পদার্পণ করেন ।' তারপরের দিনগুলোর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরাভূমিতে পদার্পণ করার পাশাপাশি  এখানকার কৃষি উন্নয়নের বিষয়টি তাঁর ভাবনায় রেখেছিলেন । হরিদাস ভট্টাচার্য তাঁর 'আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে ১১ই ফাল্গুন তারিখে লেখেন—

"................ তারপর কবি পূর্ববঙ্গে পরিভ্রমণ সম্বন্ধে আলোচনা উপস্থিত হইলে বলিলেন 'তোদের দেশটা ( পূর্ববঙ্গ)  কর্মীর দেশ— কলেজের নিষ্ফল উচ্চশিক্ষার তোদের  কোন দরকার নেই— তোরা কিছু লেখাপড়া শিখে জমি সংগ্রহ করে রীতিমতো চাষ আরম্ভ করে দে ।' আজ এই বাণী বিশেষ অনুধাবনযোগ্য । এমনকি মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরকেও এইমত কাজকর্ম ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে তার সাব্রুম তালুকে বসে বিস্তৃতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রণালী অবলম্বনে agriculture করবার পরামর্শ দেন । ( আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ, হরিদাস ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা,পৃ. ২৮৮ )

তাঁর ১৩ ফাল্গুনের দিনলিপিতে হরিদাস ভট্টাচার্য মহোদয় উল্লেখ করেন—

"সেদিন বিকালে কবি প্রতাপগড় কৃষি ক্ষেত্র ( দি টিপারা হিল ডেভেলপমেন্ট এন্ড কোম্পানি লিমিটেডের বাগান )  দেখিতে যান । সেখানে তাঁহার ও সমবেত ভদ্রমণ্ডলীর জন্য সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা ছিল । বাগানটি দেখিয়া তিনি বড়ই আনন্দিত হন । চাষ-আবাদ সম্বন্ধে তিনি নিজে বড়ই উৎসাহী । জমিতে রস সংরক্ষণ সম্বন্ধে তিনি নিজে যে experiment করিয়াছেন তাহা ভদ্রচাষীর পক্ষে বিশেষ উপকারে আসিবে । জমিতে একহাত পরিমাণ গর্ত্ত করিয়া জমির সমুদয় মাটি একস্থানে জমা করিয়া রাখিয়া সমস্ত জমিটাকে খুব দুরমুস করিয়া দিতে হইবে । তারপর জমা করা মাটি সারের সহিত মিশ্রিত করিয়া জমিতে ছড়াইয়া দিবে । ইহাতে শীত বা গ্রীষ্ম কোন ঋতুতেই জমিতে রসের অভাব হইবে না । প্রত্যেক বর্ষার পর মাটি আলগা করিয়া দিতে হইবে ।( আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ, হরিদাস ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা,পৃ. ২৮৮ )

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ত্রিপুরার মহারাজারাও নানাবিধ কৃষি বিষয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য রাজ্যের কৃষি ও শিল্প বিভাগ গঠন করেছিলেন । ১৩১৪ ত্রিপুরাতে বসন্ত উৎসবে রাজধানীতে শিল্প ও কৃষি প্রদর্শনীর মেলা হয়েছিল । বীরেন্দ্রকিশোরের আমলেই ত্রিপুরাতে চা বাগান গড়ে উঠেছিল । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চা বাগানের সংখ্যা ৪০ শে পৌঁছায় এবং চা কৃষিতে বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক প্রায় এক কোটি টাকা লগ্নী করা হয়েছিল বলে জানা যায় । তার আমলেই রেশম শিল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল । মূলত রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার উর্বর এবং পতিত টিলাভূমিকে আবাদযোগ্য করার জন্য চা বাগান শিল্পের পক্ষে রাজাদের উৎসাহিত করেছিলেন । বীরবিক্রমের আমলে চা বাগানের সংখ্যা বাড়তে থাকে । ১৯৬৪ সালে ত্রিপুরা রাজ্যে চা বাগানের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬ তে । চা উৎপাদনকারী রাজ্যসমূহের মধ্যে ত্রিপুরা পঞ্চম স্থানের অধিকারী হয় । ( আধুনিক ত্রিপুরা : প্রসঙ্গ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য, ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, পৃ. ৭০ )

 বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে খাদ্যাভাব দূর করার জন্য রাজ্যের খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বাড়ি বাড়ি চাষ-আবাদ করার জন্য বীরবিক্রম উদ্যোগ নিয়েছিলেন । এতে রাজার আহবানে সাড়া দিয়ে নাগরিকবৃন্দ 'কিচেন গার্ডেন' শুরু করেছিল এবং অফিসের সামনে খালি জমিতে খাদ্য শস্য চাষ শুরু করে ।

রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে গৃহীত কৃষি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড গুলি শিলাইদহে ব্যর্থ হলেও তাঁর ভাবনা কিন্তু সেদিনের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরায়ও সঞ্চারিত হয়েছিল । রাধাকিশোর মাণিক্য থেকে শুরু করে বীরেন্দ্রকিশোর এবং বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের কৃষি উন্নয়নমূলক পদক্ষেপসমূহ তারই সাক্ষ্য বহন করে ।









সহায়ক গ্রন্থ :
১. রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা– রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, ত্রিপুরা সরকার

২. মাণিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস– ডক্টর নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী

 ৩. তথ্যপঞ্জি– শ্রী দ্বিজেন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা 

৪. নতুন হাভেলির ছয় মানিক্য– পান্নালাল রায়, পৌলমী প্রকাশন, আগরতলা 

৫. আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ– হরিদাস ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা 

৬. আধুনিক ত্রিপুরা : প্রসঙ্গ
 বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য– ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, অক্ষর পাবলিকেশন, আগরতলা

৭. রাশিয়ার চিঠি– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, কলিকাতা 

৮. অন্য রবীন্দ্রনাথ– দেবব্রত দেবরায়, স্রোত প্রকাশন, কুমারঘাট, ত্রিপুরা ।

Friday, May 5, 2023

রবীন্দ্রনাথ ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ

রবীন্দ্রনাথ ও উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ 



 ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা শহরটি ২৩°৫০' উত্তর অক্ষাংশ ও ৯১°১৭ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ৭৬ দশমিক ৫০৪ কোটি কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হাওড়া নদীর তীরে অবস্থিত এবং উত্তর দিকের পাহাড়ের ঢালু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত । এই শহর বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । শহরটি রাজ্যের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ । পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত যোগাযোগ থাকার ফলে আগরতলা আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ । এই আগরতলা শহরে রয়েছে একটি শ্বেতশুভ্র প্রাসাদ যার নাম 'উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ' । এটি একসময়  ত্রিপুরারাজ্যের  রাজাদের রাজপ্রাসাদ ছিল । আগরতলার চিলড্রেন পার্কের বিপরীতে দিকে  লক্ষীনারায়ণবাড়ী রোডের পাশ দিয়ে রাজবাড়ীতে প্রবেশের প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে প্রাসাদটির মূল অবস্থান ২৩°৫০'১২.৬৭'' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°১৬'৫৭.৭২" পূর্ব দ্রাঘিমাংশ । প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ও প্রায় ২০ একর জমি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই প্রাসাদ । এই প্রাসাদটির স্থাপত্যশিল্প অভিনব । ত্রিতলবিশিষ্ট এই প্রাসাদের শীর্ষে রয়েছে তিনটি গম্বুজ যার মধ্যে সর্বোচ্চটির উচ্চতা ৮৬ ফুট ( ২৬ মিটার ) । এটি চারতলাবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় টাওয়ারের উপর প্রতিষ্ঠিত । প্রাসাদটির নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৯০১ সালে । এই প্রাসাদের নির্মাণশৈলীতে মুঘল, রোমান ও ব্রিটিশ স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব রয়েছে । প্রাসাদের মেঝেতে মূল্যবান টাইলস বসানো । দরজা জানালা ও কাঠের সিলিংগুলি সুন্দর কারুকার্যময় । প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে সিংহাসন-কক্ষ, দরবার হল, পাঠাগার, অভ্যর্থনা হল, চাইনিজ রুম ও পাবলিক হল । প্রাসাদের সামনেই রয়েছে দুটি বিশাল জলাশয় ।  ইউরোপীয় ধাপে বিশাল বাগিচাও রয়েছে । বর্তমানে প্রাসাদপ্রাঙ্গনে সরকারি উদ্যোগে মিউজিক্যাল ফাউন্টেন এর ব্যবস্থাও রয়েছে । ২০১১ সাল পর্যন্ত এই রাজবাড়িতেই ছিল ত্রিপুরা বিধানসভা । বর্তমানে এটি রাজ্যের সংরক্ষিত জাদুঘর । সম্প্রতি আগরতলা শহরে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে আগত বিদেশি অতিথিরা এই রাজপ্রাসাদের স্থাপত্যসৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান । আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ত্রিপুরার রাজাদের এই প্রাসাদটি নির্মানের ইতিহাসের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের নাম জড়িয়ে আছে । 


ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, ত্রিপুরার রাজারা তাঁদের রাজত্বকালের বিভিন্ন সময়ে তাঁদের রাজধানী স্থানান্তরিত করেছেন । পরবর্তী সময়ে তাঁরা দীর্ঘদিন প্রাচীন রাঙ্গামাটি বা উদয়পুরে রাজ্যপাট চালাতে থাকেন । মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্যের(  ১৭৪৮– ১৭৮৩ ) সময় ত্রিপুরার রাজধানীকে আবার সরিয়ে আনতে বাধ্য হন । ত্রিপুরার দক্ষিণ অঞ্চলে দক্ষিণশিক পরগনায় তাঁর এক প্রজা শমসের গাজী বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন । শমসের গাজীর সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণমাণিকের যুবরাজ থাকাকালীন সময় থেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয় । শমসেরের হাতে রাজা কৃষ্ণমাণিক্যকে পরাজিত হয়ে পশ্চাৎ অপসারণও করতে হয় । শমসের গাজীর সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি উদয়পুর থেকে তাঁর রাজধানী পরিত্যাগ করে পুরাতন আগরতলা এসে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । এই বিষয়ে ভুপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর রাজমালা গ্রন্থে লিখেছেন,


 "শমসেরের হস্তে পরাজিত হইয়া কৃষ্ণমনি উদয়পুর ত্যাগ করিয়া ( পুরাতন আগরতলা ) বসতি স্থাপনপূর্বক সেইখানে বসবাস করিতে আরম্ভ করিলেন । ধীরে ধীরে অনেকেই তাঁহার দলভুক্ত হইতে লাগিল" ( রাজমালা, ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, শমসের গাজী, পৃষ্ঠা. ১৯৮ ) ।  এই প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে–


" কৃষ্ণ মানিক্য যৌবরাজ্য কালে তিনি আগরতলায় ( পুরাতন আগরতলা ) বসতি নির্মাণ করেন একথা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে । শৈলমালার বেষ্টনে স্থানটি অপেক্ষাকৃত  নিরাপদ বলিয়া প্রতিভাত হওয়ায় তিনি সেখানে নদীর ধারে বসতি নির্মাণ করিয়া শমসের গাজী হইতে আত্মরক্ষা করেন ।" ( ওই পৃষ্ঠা ২০৪–২০৫ )


পুরাতন আগরতলা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার পরপরই তিনি রাজধানীকে সাজিয়ে তোলার জন্য সচেষ্টা হয়ে পড়েন ।


 বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হওয়ার  সময়কালেই কৃষ্ণমাণিক্য তাঁর রাজধানী উদয়পুর থেকে আগরতলা স্থানান্তরিত করেন । এই সময়ে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তিনি তাঁর হৃতরাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন । এ সম্পর্কে ত্রিপুরার প্রখ্যাত গবেষক রমাপ্রসাদ দত্ত বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন–


চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকেও জানা যায় যে ১৭৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে মোহম্মদ রেজা খাঁ সে বছরেই ত্রিপুরা আক্রমণ করেন রেজা খাঁ দেওয়ান রামশংকর ৮ হাজার সৈন্য নিয়ে দক্ষিণশিকের গড় আক্রমণ করলেন । কৃষ্ণমাণিক্যের পক্ষে জয়দেব কবরা ও লুচি  এক হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কিন্তু যুদ্ধে জয় লাভের আশা নেই জেনে তারা 'ফাল্গুন কড়া' গড়ে আশ্রয় নেন । সেখান থেকে কসবা দুর্গে কৃষ্ণমাণিক্যের সঙ্গে যুক্ত হন । রামশংকর দেওয়ান এবার কসবা দুর্গ আক্রমণ করে জয় লাভ করেন । মহারাজ কৃষ্ণ মানিক্য পরাজিত ও নিরুপায় হয়ে কসবা দুর্গ ত্যাগ করে ভাদুগড়ে আশ্রয় নেন । সেখান থেকে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে রওনা হয়ে যান ।


 

রেজা খাঁর দেওয়ান সেনাপতি রামশংকর যখন নিশ্চিন্তমনে রাজ্য শাসন করছেন, সে সময় সংবাদ এল মিস্টার হ্যারিভার লেস্ট চট্টগ্রাম আক্রমণ করে রেজা খাঁকে পরাজিত করেন ।  সে খবর পেয়ে দেওয়ান রামশংকর ত্রিপুরা রাজ্য ত্যাগ করে চট্টগ্রামের দিকে চলে যান । এদিকে বিনা যুদ্ধে কৃষ্ণমাণিক্য ত্রিপুরারাজ্য পুনরায় হস্তগত করেন ।


 অপরদিকে ইংরেজগণ চট্টগ্রামের শাসনভার নিয়ে নেন । Mr Harryvarlest চিফ আফিসার Mr. Thomas Rumbold, Mr. Ramdolf Marriatt ও Walter Wilkins মেম্বার এসিস্টেন্ট পদে নিযুক্ত হন । গোকুল ঘোষাল তাদের  দেওয়ান হন । ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি মহম্মদ রেজা খাঁর নিকট হতে ইংরেজরা শাসনভার গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পরে ম্যরিয়ট সাহেব ত্রিপুরার জমিদারি বিভাগে ইংরেজের অধিকার স্থাপনের উদ্দেশ্যে কুমিল্লায় আসেন । তার সঙ্গে আসেন লেফটেন্যান্ট মথি সাহেব । 'কৃষ্ণমালা' গ্রন্থে তাঁকে 'মাতিছ' সাহেব বলে উল্লেখ করা হয়েছে । লেফটেন্যান্ট মথি কৈলারগর ( কসবা ) দুর্গের নিকট এসে শিবির স্থাপন করেন । কৃষ্ণমাণিক্য সে খবর পেয়ে কৈলারগড় দুর্গ ছেড়ে তিনকড়ি ঠাকুর, গোবর্ধন ঠাকুর ও জয়দেব রায়কে সঙ্গে নিয়ে সিংঙ্গারবিল গ্রামে চলে গেলেন । মথি সাহেব তখন কৃষ্ণমাণিক্যকে জানালেন, ' যুদ্ধের অভিপ্রায়ে আমি আসিনি । আমি মহারাজের সঙ্গে জমিদারি বিষয়ে আলাপ আলোচনার জন্য এসেছি ।' এ খবর পেয়ে কৃষ্ণমাণিক্য 'মনিঅন্ধ' গ্রামে ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করলেন । সেখান থেকে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনা সেরে কৈলাগড়ে ফিরে এলেন । কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর পুনরায় তিন হাজার সৈন্য নিয়ে আব্দুর রাজ্জাক দক্ষিণ দিকে লুচিদর্পকে আক্রমণ করেন । লুচিদর্প তখন কৃষ্ণমাণিক্যের অধীনে দক্ষিণশিকের শাসনকর্তা ।  সেনাপতি জয়দেব রায় লুচিদর্পকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন এবং উভয়ের সম্মিলিত আক্রমণে আব্দুল রেজ্জাক পরাজিত হন । তখন কৃষ্ণমাণিক্য দেখলেন বারবার মগ ও মুসলমানেরা রাজধানী উদয়পুর আক্রমণ করে । সুতরাং অনেক চিন্তার পর তিনি উদয়পুর থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা স্থানান্তরিত করেন  এবং সেখানে তিনি নগর স্থাপন করেন । এ সম্পর্কে রাজমালায় আছে–


"আশ্বিন মাসের দুর্গোৎসব দশমীর দিনে ।

 ত্রিপুরা এগার শ সত্তৌরের  সনে ।।

কৃষ্ণমাণিক্যের রাজ্য খ্যাতি হইল তখন ।

(  রাজমালা–কৃষ্ণমাণিক্য খন্ড, পৃষ্ঠা ৫০ )


 আগরতলা সংক্রান্ত প্রাচীন তথ্যাদির  সন্ধান পেতে গেলে প্রধানত ত্রিপুরার রাজনৈতিক ইতিহাসসম্বলিত দুটি প্রাচীন গ্রন্থে সাহায্য নিতে হয় । একটি হল শ্রীরাজমালা–চতুর্থ লহর ও দ্বিতীয়টি কৃষ্ণমালা গ্রন্থ । কৃষ্ণমাণিক্য যে তাঁর রাজধানী পুরাতন আগরতলায় স্থানান্তরিত করেছিলেন তা রাজমালায় উল্লেখিত তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় । রাজমহলায় আরেকটি জায়গায় লেখা হয়েছে–


এগার শ সত্তৈর সন হএত যখন ।

 আগরতলা রাজধানী করিল তখন ।।

( শ্রী রাজমালা–চতুর্থ লহর, কৃষ্ণমাণিক্য খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১ )


ত্রিপুরা থেকে খ্রিস্টাব্দের ৫৯০ বছরের ব্যবধান থাকে সেই হিসেবে ১১৭০ ত্রিপুরাব্দ + ৫৯০ = ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পুরাতন আগরতলায় রাজধানী পত্তন হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় । 


এছাড়া কৃষ্ণমালাতেও এ বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে । কৃষ্ণমালার ১৩০–১৩১ পৃষ্ঠা ও ১৪৬ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লেখা আছে–


কর করি রিপু চন্দ্র শাকের সময় ।

জৈষ্ঠ মাসে সময়েতে করিয়া বিজয় ।।

 যুবরাজ আদেশেতে জয়দেব রায় ।

মন কৌতুহলে আসিলেক কসবায় ।।

 তবে যুবরাজার পাইয়া অনুমতি ।

 কুমিল্লাতে রহে ভদ্রমনি সেনাপতি ।।

 যুবরাজের শাসে দেশ সুখে আছে প্রজা ।

 আশ্বিন মাসে নির্বাহিল দুর্গাপূজা ।। 

তারপরে মন্ত্রীগণে মন্ত্রনা করিয়া ।

যুবরাজ ঠাঁই নিবেদন করে গিয়া ।।

 নিজ দেশ হইল বশ রিপু নাহি আর ।

 এখন উচিত অভিষেক হইবার ।।

( পৃষ্ঠা ১৩০–১৩১ )

****************************"

তারপরে রাজা গেল আগরতলায় ।

বসতি কারণে পুরি করিল তথায় ।।

তারপরে পাত্র মিত্র গনে রাজার আদেশে ।

নির্ম্মাইল নগর আগরতলা দেশে ।।


উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, কৃষ্ণ মাণিক্যের আমলেই পুরাতন আগরতলায় রাজধানী স্থাপিত হয় । এরপর কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজত্বকালে ( ১৮৩০–১৮৪৯ ) পুরাতন আগরতলা বা পুরান হাউলি থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ১০ মে ১২৪০ ত্রিপুরাব্দে তিনি সিংহাসনে আরোহন নতুন হাউলি নামে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন । কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য বর্তমান রাজধানী আগরতলা বা আগরতলা শহরের প্রথম রূপকার হলেও তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল পুরাতন আগরতলাতেই । করেন । সে সময় ভারতের গভর্নর লর্ড বেন্টিংক এর পক্ষে মিস্টার টমসন পুরাতন আগরতলা এসে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যকে সনদ ও খেলাত প্রদান করেছিলেন । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তার প্রতিদানে ব্রিটিশ রাজ সরকার কে ৬৩ টাকা আট আনা মূল্যের সোনার ও রূপার অলংকার, দুটি সোনার মোহর ও ১৬ টি রূপার মুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যবাহাদুর 1১৮৩৮ সালে পুরাতন আগরতলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে হাওড়া নদীর তীরে তার রাজধানী সরিয়ে আনেন । এই হাওড়া নদীর প্রাচীন নাম ছিল 'সাইদ্রা' । পরবর্তী সময়ে এই নামের বিলোপ সাধন ঘটে । রাজধানী নতুন জায়গায় স্থানান্তরের বিষয়ে ডঃ নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী  লিখেছেন—


 কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল পুরাতন হাবেলি বা আগরতলা থেকে বর্তমান আগরতলায় রাজধানী স্থাপন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে শিকারের সুবিধার জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে কৃষ্ণকিশোর মানিক্য নতুন হাবেলি নামক নগর নির্মাণ করে সেখানে রাজ্যপাট স্থাপন করেছিলেন । ( মানিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী, জ্ঞান বিচিত্রা আগরতলা, পৃ. ৬৮ )


ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে স্থানান্তরের কাল উল্লেখ না করলেও J E Cumming এর গ্রন্থ Sarvey and sSettlement of the Chakla Roshnabad Estate in District Tipperah and Noakhali গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন–New Agartala or nutan habili was founded in 1838 in the time of Raja Krishna Kishore Manikya. ( page 65. )


শুধুমাত্র যে শিকারের উদ্দেশ্যেই রাজধানী বর্তমানে আগরতলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল তা নয় । হাওড়া নদী বেয়ে সেকালে ভাটির অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে পার্বত্য ত্রিপুরায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসতেন । নদীপথ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে বর্তমান আগরতলার উজানে আর নৌকাগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না । ব্যবসায়ীরা নতুন হাবেলি অংশে তাঁদের নৌকা বাঁধতেন । আর পুরাতন আগরতলা পাহাড়বেষ্টিত হওয়ার ফলে পূর্বদিক থেকে প্রায়শই কুকিরাএসে রাজধানীতে হামলা করত । ব্যবসায়িক ও প্রতিরক্ষাজনিত কারণেও কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজধানী বর্তমান আগরতলায় সরিয়ে এনেছিলেন । একসময় এই জায়গার নাম ছিল সাইদ্রা । কৃষ্ণ মাণিক্য সাইদ্রা নামের বিলোপসাধন ঘটিয়ে পুরানো রাজধানী আগরতলার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন রাজধানীর নামও আগরতলা রাখলেন । ১২৫৯ ত্রিপুরাব্দের দোসরা বৈশাখ কৃষ্ণকিশোরের মৃত্যুর পর ঈশানচন্দ্র মাণিক্য রাজপদে অধিষ্ঠিত হন । তাঁর অভিষেক হয়েছিল ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের পহেলা ফেব্রুয়ারি । ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ইংরেজ সরকারকে ১১১ টি স্বর্ণ মুদ্রা নজরানা দিয়েছিলেন 


১৮৬২ সালে ঈশানচন্দ্র মাণিক্য আগরতলায় একটি নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন । এই প্রাসাদে প্রবেশের একদিন পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে বাতব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রাজা পরলোকগমন করেন । ( মাণিক্যশাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস– ড. নলিনীরঞ্জন রায় চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৭৪ )


এরপর বীরচন্দ্র মাণিক্য  ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) রাজা হন । তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকালে পিতার নির্মিত রাজপ্রাসাদেই অতিবাহিত করেন । এই রাজপ্রাসাদেই তাঁর পুত্র রাধাকিশোরের অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল । কিন্তু রাধাকিশোরের রাজ্যভিষেকের পরপরই ১৮৯৭ সালের ১২ মে এক বিধংসী ভূমিকম্পে মহারাজা ইশানচন্দ্র মাণিক্য নির্মিত রাজপ্রাসাদটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ফলে সেটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় । তখন মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য সপরিবারে এই প্রাসাদ ত্যাগ করে জগন্নাথবাড়ির উত্তরাংশে ছনবাঁশের তৈরি অস্থায়ী বাংলোয় চলে যান ।


তারপরে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা তাঁর মাথায় আসে । কিন্তু ভয়াবহ ভূমিকম্পে রাজবাড়িসহ রাজধানীর সমস্ত বাড়িঘর তছনছ হয়ে যাওয়ার ফলে এবং রাজ তহবিলের আর্থিক অবস্থাও সংকটাপন্ন হওয়ায় সর্বোপরি প্রাসাদাভ্যন্তরে রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় তিনি তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না । বড়ঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র বীরেন্দ্রকিশোরকে যুবরাজ পদে নিয়োগ করায় তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি ইংরেজ সরকারের কাছে অভিযোগ জানান । এরকম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই রাধাকিশোর রবীন্দ্রনাথকে ত্রিপুরায় আগমনের আমন্ত্রণ জানান ।


রবীন্দ্রনাথ তাঁর আমন্ত্রণ  গ্রহণ করে ১৮৯৯ সালের মার্চ মাসের ২৭ তারিখ দোল পূর্ণিমার দিন প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ করেন । রাজবাড়ির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হওয়ায় সেবার রবীন্দ্রনাথ কর্নেল বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন । সেবার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সংকট, প্রশাসনিক বিষয় এবং নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন ও পরামর্শ দান করেন । সেদিন যে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুমুখী প্রতিভার বাইরে আরেক নতুন রবীন্দ্রনাথকে সবার সামনে হাজির করেছিলেন । এই রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি কূটনীতিতেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ । রবীন্দ্রনাথ এই চক্রান্ত  কুটিল সময়ে রাধাকিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন । ঋণভারে জর্জরিত রাধাকিশোর কিভাবে ঋণ পেতে পারেন, কিভাবে তাঁর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবেন সে ব্যাপারে তিনি রাধাকিশোরকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন ।


'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' গ্রন্থে চিঠিপত্রের বিভাগে একটি তারিখ বিহীন পত্র সংযোজন করা হয়েছে । সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে রাধা কিশোরকে জানান যে–


 "বিপুল সম্মানপূর্বক নিবেদন—

 সমস্ত অবস্থা আমার কাছে যে রূপ প্রতিভাত হইতেছে খোলাসা করিয়া বলিবার চেষ্টা করি । মহারাজ গবর্নমেন্টের যোগে ঋণসংগ্রহ করেন ইহা এখানকার কয়েকজনের বিশেষ আগ্রহের বিষয় হইয়াছে দেখিতেছি । গবর্ণমেন্ট যে লোককে ঋণশোধের উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করিবে শুনিতেছি সে লোকটি প্লান্টার শ্রেণীয়– তাহাকে আয়ত্ত করা স্যান্ডস প্রভৃতি লোকের পক্ষে কঠিন হইবে না । 

তাহা হইলে নাগপাশে এ রাজাকে রীতিমতো বেষ্টন করিতে পারিবে এবং গবর্ণমেন্টের ভারপ্রাপ্ত লোকের সহিত মহারাজের স্বার্থঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের যোগ ঘটে তবে মহারাজকে নিতান্ত দুর্বল হইতে হইবে ।******** 'ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল' হইতে ঋণ পাওয়া যাইবে না, অন্য কোন প্রাইভেট ব্যাংক হইতে ঋণ গ্রহণ করিতে হইবে এ কথাটি সন্দেহজনক । প্রাইভেট ব্যাঙ্কের সহিত গোপন স্বার্থের সম্বন্ধ স্থাপন করা সহজ । এমনকি গবর্নমেন্টের উচ্চ কর্মচারীর পক্ষেও তাহা দুঃসাধ্য নহে ।" 


সেদিন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে অবশেষে ব্যাংক অব বেঙ্গল থেকে ঋণ পাওয়া গিয়েছিল । কবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ফলে মেসার্স মার্টিন বার্ন কোম্পানির স্থপতি আলেকজান্ডার মার্টিন ও বাবু রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।


"১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বারের মতো আগরতলা সফর করেন । সে সময় রাজ্যের জন্য ঋণগ্রহণ ও মন্ত্রী নিয়োগের ব্যাপারে রাজা চিন্তা-ভাবনা করছিলেন । রাধা কিশোর এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কবির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন । রাজনৈতিক স্বার্থপ্রণোদিত নাম চক্রান্তে রাজা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই জন্য রবীন্দ্রনাথ চাইলেন বিশ্বস্ত দক্ষ নিষ্ঠাবান রমণীর মোহন চট্টোপাধ্যায়কে ( দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা ) মন্ত্রীপদে নিয়োগ করতে । রমণীবাবু কবির আত্মীয় । তিনি তখন কলকাতায় উচ্চপদে কর্মরত । সেই স্থায়ী কাজ থেকে ছুটি নিয়ে তাঁকে আসতে হবে ত্রিপুরার রাজ দরবারে । রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যবস্থা করেছিলেন । কবি এটাও চাইছিলেন যে রমণীবাবুকে নিয়োগের পূর্বে যেন ঋণসংগ্রহের ব্যাপারটি স্থগিত রাখা হয় । কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় কেন মন্ত্রী পদে নিযুক্ত হবেন ? সেদিন আগরতলার প্রভাবশালী মহলের কেউ কেউ এটা চাইছিলেন না । তাই এর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচারও শুরু হয়ে যায় । ত্রিপুরা থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে কবি ফিরে গেলেন কলকাতা ।এ যাত্রায় ত্রিপুরাতে তার কি অভিজ্ঞতা হল ? মহারাজকে তিনি লিখলেন, "আমি ইহা দেখিলাম যে, সেখানে দলাদলি খুব প্রবল হইয়াছে– এরূপ অবস্থায় মহারাজের তরফে তাকানো কোন দলের পক্ষে সম্ভব হয় না– অপর দলকে ব্যর্থ করা ও নিজের দলের জন্য বল সংগ্রহ করা ইহাই প্রত্যেক পক্ষের প্রধান চিন্তনীয় হয় । এমন স্থলে মহারাজের অনিষ্ট অবশ্যম্ভাবী । ( নতুন হাভেলির ছয় মানিক্য–পান্নালাল রায় / পৌনমী প্রকাশনী, আগরতলা, পৃ. ৬৪ )


১৮১১ শকাব্দের ১০ বৈশাখ শনিবার তথা ২৩ এপ্রিল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ এক শুভক্ষণে এই প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় । এই বিষয়ে প্রস্তরফলকে লিখিত সংস্কৃত শ্লোকটি ছিল—


শীতাংশুদ্বন্দ্ধরন্দ্রোদধিজ পরিশিতে শাক্যবর্ষে সুলগ্নে

বৈশাখ সুরজাহে গগনবিধুমিতে রোপিতা যস্য ভিত্তি ;

সোহয়ং 'নামোজ্জয়ন্ত' সুরগণ কৃপয়া পূর্ণতা প্রাপ্য সৌধ

শ্রীশ্রী রাধাকিশোর ত্রিপুর নৃপপদ স্বরণযোগ্যা বিভাতু"

সন ১৩০৯ ত্রিপুরাব্দ । ( তথ্য :  শিলালিপি সংগ্রহ– ৩৫ পৃ. )


"১৮২১ শকাব্দের বৈশাখ মাসের ১০ তারিখ শনিবার শুভলগ্নে যাহার ভিত্তি স্থাপিত হইল সেই 'উজ্জয়ন্ত' নামক প্রাসাদ দেবগণের কৃপায় পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া ত্রিপুরা নৃপতি শ্রী শ্রী রাধাকিশোর মাণিক্যের পাদস্পর্শে বিরাজ করুক ।"


 পরবর্তী সময়ে মহারাজ রাধাকিশোরের আদেশে এবং দায়িত্ব পেয়ে  ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে শিলালিপি সংগ্রহের পরে চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ শ্লোকটি  গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন । শ্লোকে উল্লিখিত  চন্দ্রোদয় বিদাবিনোদ কর্তৃক প্রাসাদটির নামকরণের তথ্য ঠিক নয় । চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ প্রাসাদটি নির্মাণের পরে ১৯০২ সালে খ্রিস্টাব্দে রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন ।


এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নামকরণ রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন বলে একটা জনশ্রুতি জড়িয়ে আছে । কিন্তু এই তথ্যটি মনে হয় ঠিক নয় । কারণ উজ্জয়ন্ত নামের সঙ্গে রাধাকিশোর পূর্বেই পরিচিত ছিলেন । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য যুবরাজ থাকাকালীন সময়েই 'উজ্জয়ন্ত নাট্য সমাজ' নামে তাঁর একটি নিজস্ব নাট্যদল ছিল । শক্তি হালদার মহোদয় কর্তৃক সম্পাদিত এবং কলকাতা বইমেলা ২০০১-এ প্রকাশিত 'ত্রিপুরা নাট্য আন্দোলনের ধারা' গ্রন্থে রমাপ্রসাদ দত্ত লিখিত রচনায় রাজন্য আমলে ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য নাট্যসংস্থার যে অনুষ্ঠানসূচির উল্লেখ রয়েছে তাতে উজ্জন্ত নাট্য সমাজের প্রযোজনায় অভিনীত অনেকগুলো নাটকের নামোল্লেখ পাওয়া যায় । এতে করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই উজ্জয়ন্ত নাট্য সমাজ থেকে পরবর্তী সময়ে রাজপ্রাসাদের নাম 'উজ্জয়ন্ত' রাখা হয়েছে ।


"রাধাকিশোর মাণিক্য এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পুরো ব্যয়ভার চাকলা রোশনাবাদের আয় থেকে মিটিয়ে ছিলেন । রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মত ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল থেকে  ১০ লক্ষ টাকা ধার নিয়ে এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল । চাকলার তহবিল থেকে ওই ঋণ সুদসমেত পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছিল ।" ( আধুনিক ত্রিপুরা : প্রসঙ্গ রাধাকিশোর মাণিক্য, ড. দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, অক্ষর পাবলিকেশন, আগরতলা ) এবং ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা-চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ১৯ ) 


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার সম্পর্কের সূত্র ধরে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে তাঁর যে সখ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সেই সুবাদে কবি রাজ্যের রাজকুলের এবং জনগণের সুখ-দুঃখেরও ভাগীদার হয়েছিলেন । রাজা যখনই রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রাসাদে কিংবা প্রশাসনে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখনই রবীন্দ্রনাথ পাশে দাঁড়িয়েছেন । সবসময় ত্রিপুরার মঙ্গল চিন্তা করেছেন তিনি । রাজ পারিষদ কর্নেল মহিম ঠাকুরকে তিনি লিখেছেন, "ত্রিপুরা রাজ্যের মঙ্গল সাধনের জন্য আমি বারংবার তোমার দিকে তাকাই । এই রাজ্যের সঙ্গে যেন আমার ধর্মের সম্বন্ধ বাঁধিয়া গেছে– আমি যতই ইচ্ছা করি ইহার সম্বন্ধে আমার মনকে উদাসীন করিতে পারি না—"( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ) । বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরারাজ্যের স্বার্থে তাঁর  রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে সেদিন মহারাজাকে যে সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন তার ফলেই সেদিন ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য স্থাপত্যশিল্পের অভিনব নিদর্শন, কারুকার্যময় এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন । পরোক্ষে হলেও রবীন্দ্রনাথের নাম এই প্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ।


সহায়ক গ্রন্থতালিকা :


১. রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা— রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ, ত্রিপুরা সরকার 


২. রাজমালা— ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী 


 ৩. আগরতলার ইতিবৃত্ত— রমাপ্রসাদ দত্ত 


৪. শ্রীরাজমালা 


৫. কৃষ্ণমালা 


৬. মানিক্য শাসনাধীন ত্রিপুরার ইতিহাস— ড. নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী, জ্ঞান-বিচিত্রা, আগরতলা


৭.  নতুন হাবেলির ছয় মাণিক্য— পান্নালাল রায়, পৌনমী প্রকাশনী, আগরতলা 


৮.  রবীন্দ্রনাথ ও প্রাসাদ রাজনীতি— পান্নালাল রায়, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী, আগরতলা


৯.  শিলালিপি সংগ্রহ— চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ


১০. Survey and Settlement of the Chakla Roshnabad Estate in District Tripperah and Noakhali— J E Cumming

Tuesday, May 2, 2023

হৃদয়ের কথা বলিতে..

হৃদয়ের কথা বলিতে...




ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের । ত্রিপুরার রাজপরিবারের মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) থেকে শুরু করে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ), বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ( ১৯০৯–১৯২৬ ), এবং মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য ( ১৯২৬–১৯৪৭ ) পর্যন্ত পরপর চারজন রাজার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত নিবিড় সম্পর্ক ছিল । প্রকৃতপক্ষে এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকে । বীরচন্দ্র মাণিক্যের পিতা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ( ১৮৩০–১৮৪৯ ) হঠাৎ করে একটি সমস্যায় পড়ে যান । ১৮৩৬ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামের কমিশনার হঠাৎ করে ঘোষণা করেন যে, ত্রিপুরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশীয় রাজ্য । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন । তিনি জানান যে, ত্রিপুরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য । কখনোই ব্রিটিশ সরকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল না । ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে ত্রিপুরারাজ্যকে রক্ষা করার জন্য সে সময়ে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্য তখনকার প্রখ্যাত আইনজীবী প্রিন্স দ্বারকানাথের কাছে আইনি সাহায্য প্রার্থনা করেন । সেসময় ব্রিটিশের কবল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য ত্রিপুরাকে রক্ষা করার জন্য প্রিন্স দ্বারকানাথ ত্রিপুরার মহারাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ব্রিটিশকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিলেন । এ কারণে ত্রিপুরার রাজন্যগণ শুধু নয়, ত্রিপুরার জনগণ ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ।


 রবীন্দ্রনাথের পিতামহের সঙ্গে যে ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের নিবিড় সম্পর্ক ছিল একথা রবীন্দ্রনাথ জানতেন । তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের পুরনো সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন ।


 ১২২৯ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর প্রয়াণ ঘটে । প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে বীরচন্দ্র গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন । এই সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি । কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে তিনি তাঁর অকালপ্রয়াতা পত্নী বিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন । মহারাজা বীরচন্দ্রের বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ বছর । মহারাজা বীরচন্দ্র ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো বয়স্ক কোনো কবি । তিনি যে মাত্র কুড়ি বছর বয়সের একজন তরুণ কবি তা মহারাজা বীরচন্দ্র ধারণাও করতে পারেননি । মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে তাঁকে 'কবি' হিসেবে সম্মান জানানোর জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সচিব রাধারমন ঘোষকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠান । রবীন্দ্রনাথও সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনের প্রথম সম্মান লাভের সুযোগে আপ্লুত হয়ে পড়েন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে এই ঘটনার কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন । উনিশ শতকের শেষ ভাগে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথকে কবি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন । 


মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের গভীর সখ্যতার সৃষ্টি হয় । রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে নানাভাবে ত্রিপুরার রাজাকে সহায়তা করে গেছেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রগবেষক বিকচ চৌধুরী মহাশয় তাঁর 'রবীন্দ্র সান্নিধ্যে ত্রিপুরা' গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন । তিনি লিখেছেন–


" রাজকোষের সংকট, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিঘ্ন, ইংরেজ সরকারের কুমন্ত্রণা, রাজকুমারদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা, মন্ত্রী নিয়োগ, প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি নানান সমস্যার জাল থেকে এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে মুক্তি দেবার দুরুহ ব্রত রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । আর কি বিপুল নিষ্ঠায় তিনি তা পালন করেছিলেন তা ভেবে আজও অবাক হতে হয় । রবীন্দ্রনাথের এই বিরল বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর গোটা রবীন্দ্রকান্ডের মধ্যে আর কোথাও কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না । ত্রিপুরা এখানেই এক অনন্য গৌরবের অধিকারী । এই দুর্লভ গৌরবের দাবি কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেই বারবার ধন্য হয়েছে ।"


মহারাজা বীরচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় এর সূত্রপাত হলেও মহারাজা রাধা কিশোরের মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ( ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ) সাল মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ করেন । দ্বিতীয়বার আসেন ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই । পুনরায় রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে এসে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতিত্ব করেন । চতুর্থবার তিনি আসেন ১৩১২ বঙ্গাব্দের ১৭ কার্তিক রমনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের রাজমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হওয়ার দিন । ১৩১২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে বরিশালে 'প্রাদেশিক বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে' সভাপতিত্ব করতে যাওয়ার পথে তিনি পঞ্চমবার ত্রিপুরায় আসেন । এরপর ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি পূর্ব বঙ্গ, শ্রীহট্ট ভ্রমণের পর ত্রিপুরায় আসেন । সপ্তমবার অর্থাৎ শেষবার রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় আসেন ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে । সেবার কবিকে কিশোর সাহিত্য সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় ।


গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পণের বর্ষটি থেকে হিসাব করলে এই বছর তা একশো পঁচিশতম বর্ষে পদার্পণ করল । কবির ত্রিপুরায় পদধূলি দেওয়ায় ত্রিপুরা পূণ্য কবিতীর্থে পরিণত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ যেমন ত্রিপুরাকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন তেমনি ত্রিপুরার মানুষও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের আত্মার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে নিয়েছেন । রবীন্দ্র পদধূলি ত্রিপুরার মাটিকে অভিষিক্ত করার ইতিহাস কে স্মরণীয় করার লক্ষ্যেই এই গ্রন্থ রচনার প্রয়াস । এব্যাপারে আমাকে নানা তথ্য ও প্রচুর সহায়ক গ্রন্থ সরবরাহ করে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করেছেন রাজ্যের বিশিষ্ট কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধর । তাছাড়া তাঁর মননশীল প্রকাশনা 'স্রোত' থেকে গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন । গ্রন্থে লিখিত প্রতিটি প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় অবস্থানের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটগুলি উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছি । গ্রন্থটি পাঠ করে সুধী পাঠক সমাজ যদি ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার আন্তরিক সম্পর্কটি অনুধাবন করতে পারেন তাহলেই আমার শ্রম সার্থক হবে বলে আমি মনে করি ।

                                                                            


     ২৬ মে, ২০২৩

আগরতলা, ত্রিপুরা                                         

                                



                           ‌‌                                    রবীন্দ্রানুগত

                                                        অশোকানন্দ রায় বর্ধন

রবীন্দ্রতীর্থ আগরতলার কুঞ্জবন









রবীন্দ্রতীর্থ আগরতলার কুঞ্জবন 


অশোকানন্দ রায়বর্ধন


ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা তথা ত্রিপুরা সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ( ১৮৬১–১৯৪১ ) দীর্ঘদিনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল । ত্রিপুরার রাজন্যআমলে রাজাদের সঙ্গে, রাজকুমার ও অন্যান্য অমাত্যবর্গের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে রাজ্যের শিল্প ও সংস্কৃতি এক উন্নততর অবস্থানে পৌঁছেছিল । ত্রিপুরার জনগণের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয় । রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার স্ফুরণকালেই ত্রিপুরার রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । আর এই সময় থেকে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ষাট বছর আগরতলা তথা ত্রিপুরার সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জনগণকে ভালোবেসে কবি বারবার ত্রিপুরায় এসে অবস্থান করেছিলেন । রবীন্দ্রকাব্য পাঠ করেই মহারাজা বীরচন্দ্র তাঁর কবিতায় নিয়ে এলেন নতুন ছন্দ ও বিষয়বস্তু । ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন তাঁর  ঝুলন হোরী, অকালকুসুম, উচ্ছ্বাস, সোহাগ, প্রেম মরীচিকা ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে । রবীন্দ্রকবিতার প্রভাব পড়ল বীরচন্দ্রকন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবীর কবিতায় । 'মুকুট', 'রাজর্ষি', 'বিসর্জন' আর 'জীবনস্মৃতি' ও বহু পত্রাবলী মাধ্যমে রবীন্দ্রসাহিত্য ত্রিপুরাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ স্থান করে দিয়েছে । রাজপরিবারের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তা রবীন্দ্রপ্রয়াণের পর থেকে আজ পর্যন্ত ত্রিপুরার জনগণ রক্ষা করে চলেছেন নানাভাবে । বারবার ত্রিপুরা রাজ্য রবীন্দ্র পদধূলি ধন্য হওয়ায় ভারতবাসীর কাছে ও বিশ্বের বাঙালির কাছে আগরতলা রবীন্দ্র তীর্থের পরিণত হয়েছে ।


আগরতলার ইতিহাস


 প্রাচীন ত্রিপুরা রাজ্য বহুবার বহির শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছে যে কারণে বারবার রাজ্যের রাজধানী ও স্থানান্তর করতে হয়েছে ১৭৬০ সালে মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্য ও 1748 1783 তার রাজধানী উদয়পুর থেকে স্থানান্তরিত করে আগরতলায় স্থাপন করেন ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালা ও কৃষ্ণমালা পাঠিয়ে তা জানা যায় অবশ্য সেই রাজধানী বর্তমান আগরতলা শহর নয় তা বর্তমান শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত কিন্তু সে জায়গাও নিরাপদ ছিল না কুকিদের দ্বারা প্রায়ই এই অঞ্চল আক্রান্ত হতো এছাড়া হাওড়া নদীর তীরবর্তী স্থানে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের জন্য আরো কিছুটা পশ্চিমে রাজধানীর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্যের আমলে রাজধানী নতুন হাবিলিতে অর্থাৎ বর্তমান আগরতলায় ১৮৩৮ সালের ১০ই মে সরিয়ে আনা হয় ঈশান চন্দ্র মানিক্য সেখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভয়াবহ ভূমিকম্পে সেই প্রাসাদ টি ধ্বংস হয়ে যায় । মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ) একটি নতুন প্রাসাদ নির্মানের কাজে হাত দেন । তিনি ১৮৯৯ সালে শ্বেতশুভ্র উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মানকার্য শুরু করেন এবং ১৯০১ সালে নির্মানকার্য সম্পন্ন হয় ।


এই রাজপ্রাসাদের কিছুটা দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সু উচ্চ টিলার উপরে বিস্তীর্ণ নির্জন বনভূমি ছিল । রাজন্যবর্গরা সেখানে অবকাশ যাপন করতেন । রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরা ভ্রমণে এলেও শেষ দুবার এখানে অবস্থান করেছিলেন । এই নির্জন বনপ্রান্তরে অবস্থানের স্মৃতি রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে বারবার উচ্চারণ করেছিলেন ।  তাঁর পূর্বের আগরতলা ভ্রমণের তুলনায় প্রকৃতিপ্রেমিক কবির কাছে এই অখ্যাত স্থানে অবস্থানের অভিজ্ঞতা তাঁর অন্তরে বিশেষ পুলকের সৃষ্টি করেছি । রবীন্দ্রনাথের আগরতলা ভ্রমণে এসে এই নির্জনস্থানে পদার্পণ ও অবস্থান করার ফলে কুঞ্জবন 

রবীন্দ্রভক্তদের কাছে তীর্থক্ষেত্রস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।


  মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) সাথে রবীন্দ্রনাথের যে পরিচয় সূত্র গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী সময়ের তিন রাজার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিল । ত্রিপুরার সাথে নিবিড় বন্ধন এর সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ পর পর সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন ও অবস্থান করেছিলেন । ত্রিপুরায় এসে রবীন্দ্রনাথ কর্নেল বাড়ি, জোড়া বাংলো, কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাস ও কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ তথা পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অবস্থান করে গেছেন । কুঞ্জবনের ও তার সন্নিহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত টিলাভূমির দৃশ্য অবলোকন করে রবীন্দ্রনাথ এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মাকে ( লালুকর্তা ) এখানকার পরিবেশের মধ্যে তাঁর জন্য একটি কুটির নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন । জীবনের অন্তিম পর্যায়ের দিনগুলি তিনি এখানে অতিবাহিত করে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য অবলোকন করতে চান ।


চারিদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ সারি সারি ফুলের বাগানের সমারোহ, বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি ও অজস্র পাখিদের কলকালিতে মুখর এই কুঞ্জবন, কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাস আর কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ তার ইতিকথা বুকে নিয়ে আজও অবস্থান করছে । কালের বিবর্তনে হয়তো আগরতলা শহরের নিবিড় নগরায়নের ফলে সে কুঞ্জবন আজ আর আগেকার অবস্থানে নেই ।  কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ ও অবস্থানের কারণে সেই অতীতের কুঞ্জবন আজ  রবীন্দ্রতীর্থে পর্যবসিত হয়েছে । কাজেই এই তীর্থভূমি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে ।


কুঞ্জবনের ইতিহাস 


একসময়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ কুঞ্জবনের প্রতি রাজন্যবর্গের আকর্ষণের একটি ইতিহাস রয়েছে । প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রই আজ কুঞ্জবন টাউনশিপ হিসেবে আগরতলা শহরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে । মহারাজা কৃষ্ণমানিক্য নানা কারণে তাঁর রাজপ্রাসাদকে আগরতলায় স্থানান্তরিত করেছিলেন । সে আগরতলা আজকের আগরতলা নয় । বর্তমান আগরতলা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ছিল সে রাজধানী আগরতলা । যা পরবর্তী সময়ে 'পুরোনো হাবেলি' নামে পরিচিত হয়ে যায় । এই পুরোনো হাবেলি থেকে মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য তাঁর রাজধানী ( ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ১০ মে ) বর্তমান আগরতলায় স্থানান্তরিত করেন । নতুন রাজধানী আগরতলার কিছু দূরে পূর্ব দিকে নানা ধরনের গাছগাছালি সারি সারি পুষ্প কানন ও পাখপাখালির কলতানমুখর নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত অঞ্চলটি ত্রিপুরার সেসময়ের রাজন্যবর্গের  দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । এখানকার নাতি উচ্চ তিনটি টিলাকে কেন্দ্র করে ছিল কুঞ্জবন এলাকা । তার মধ্যে একটি টিলায় ছিল বিশাল কাঁঠাল বাগান । একটা অংশের কাঁকর মিশ্রিত ভূভাগ থাকার কারণে নাম ছিল 'কাংকইরা টিলা' বা 'কাঁকরিয়া টিলা' ।  আজ তার দক্ষিণ দিকের টিলাটিতে হল মালঞ্চাবাস আর কুঞ্জবন প্রাসাদের অবস্থান । অতীতে এই তিনটি টিলা মিলিয়েই ছিল কুঞ্জবন যা সময়ের প্রয়োজনে বর্তমান কুঞ্জবন টাউনশিপে পরিণত হয়েছে । ফলে কিছু কিছু প্রাচীন স্থাপত্য ও স্মৃতিচিহ্ন ছাড়া বর্তমান কুঞ্জবনে আর কিছুই নেই । 


এই সবুজ বন প্রান্তরের মাঝে যে অতীত কুঞ্জবন ছিল তার কিছু বিবরণ রাজ্যের বিশিষ্ট প্রবন্ধকারগণ এবং রাজ্যের রাজন্যবর্গরা লিপিবদ্ধ করে গেছেন । প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের লেখক ডঃ দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামী মহোদয় এক জায়গায় লিখেছেন–


"দ্বিতীয় বিশ্বসমরের সমসাময়িক কালে সারা কুঞ্জবনের চেহারার সঙ্গে কিছু কিছু নামেরও পরিবর্তন হয় । যথা– ৭৯ টিলা, হাসপাতাল টিলা ইত্যাদি । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া কমান্ডার ( SEAC ) প্রয়োজনের সারা অঞ্চলটায় ব্রিগেড ও ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার, বেস হসপিটাল, যুদ্ধের উপকরণ ট্রান্সপোর্ট এর সমাবেশ ইত্যাদি কারণে দ্রুত পরিবর্তন আসে । ওদিকে আগরতলা বিমান ঘাঁটির স্থানটটিও আর এ এফ–এর সাথে থাকায় বিমান ঘাঁটি ও তথায় যাতায়াতের পথঘাটের দ্রুত উন্নয়ন হয় ।


শহর আগরতলায় তৎকালে অনেক বছরই বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবং বসতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে স্থানাভাবের আশঙ্কায়– সর্বোপরি রাজধানীর নির্বাচিত স্থান অপেক্ষা কুঞ্জবন এলাকায় শহর নির্মাণের পক্ষে অধিকতর উপযোগী বলে  মহারাজা বীরবিক্রমের ত্রিশদশক জুড়ে পরিকল্পনা ছিল, কুঞ্জবন অঞ্চলে শহরের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্রমশ অপসারণ, বিদ্যাপতন পরিকল্পনার মধ্যেই তার এই ইচ্ছা সূচিত হয়েছিল । বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ও তৎপরেই মহারাজার মৃত্যুতে সে সকল পরিকল্পনা রূপ পরিগ্রহ করে নাই । তারপরেই  দেশে স্বাধীনতা আসার ও ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পর সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত যেসব পরিকল্পনা নিতান্ত প্রয়োজনীয় বলেই পুনরায় গৃহীত ও ক্রমে রূপায়িত হতে থাকে । তারই ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বিরাট গোবিন্দবল্লভ হাসপাতাল, কুঞ্জবন টাউনশিপ, আইটিআই সংখ্যাটি সরকারি কর্মচারীদের কোয়ার্টার, পথঘাট ইত্যাদি গড়ে ওঠে ।"


কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদ


চির সবুজ বনরাজিবেষ্টিত কুঞ্জবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য বাহাদুর গড়ে তুলেছিলেন এক মনোরম প্রাসাদ । মূলত নতুন হাবেলিতে রাজধানী পত্তনের পর থেকেই পাশের এই বিস্তীর্ণ বনভূমি ত্রিপুরার রাজ পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল । সে সময়ে রাজ পরিবারের সদস্যরা বিনোদনমূলক ভ্রমণের জন্য, শিকারের জন্য কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য তাদের রানিদের, রাজঅন্তঃপুরের নারীদের ও রাজপুরুষদের নিয়ে রীতিমতো পাঁজিপুঁথি দেখেই কিছুদিনের জন্য এই অঞ্চল ভ্রমণের জন্য যেতেন । সেই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর তাঁর রাজ্যাভিষেকের ( ১৯০৯ ) পরপরই রাজ্যের এবং রাজ্যের প্রজাসাধারনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । ধীরে ধীরে সেই পরিকল্পনা তিনি বাস্তবায়িত করতে লাগলেন । উন্নয়নের প্রতি ক্ষেত্রেই মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর তাঁর মননশীলতা ও সংস্কৃতির ছাপ রাখতে প্রয়াসী হন । তাঁর উন্নয়ন কর্মকান্ডে যুক্ত হয় অরণ্যশোভিত কুঞ্জবনে একটি সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণের পরিকল্পনা । নিজের কলা নৈপুণ্যবোধের স্বাক্ষর রেখে মহারাজা সেদিন ( ১৯১৭ ) নির্মাণ করেন এই কুঞ্জবন রাজপ্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদ এই পুষ্পবন্ত প্রসাদ সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর 'রাজমালা'য় লেখেন–


"একটি স্থাপত্যবিদ্যার উত্তম নিদর্শন বীরেন্দ্র কিশোরের চিত্রপ্রতিভার সর্বোত্তম দান হইতেছে কুঞ্জবন নির্মাণ । যাহারা আকবরের ফতেপুর সিক্রি দেখিয়েছেন তাঁহারাই বুঝতে পারিবেন স্থান নির্বাচনের তুলনায় ফতেপুর সিক্রি হইতে কুঞ্জবন কোন অংশেই ন্যূন নয় । ফতেপুর সিক্রির চতুষ্পার্শ্বে প্রকৃতির সৌন্দর্যের নতুনত্ব কিছুই নাই । সিক্রি নিজের সৌন্দর্যেই নিজেই উদ্ভাসিত কিন্তু কুঞ্জবন তাহা নহে । কুঞ্জবনের মধ্যে এমন একটি লুকায়িত মহিমা আছে যাহা শিল্পী বীরেন্দ্রকিশোরের দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই । তিনি সেই মহিমার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই কুঞ্জবনের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়াছেন ।" ( পৃষ্ঠা ২১৩১৪ ) 


লেখক ভূপেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মহোদয় নিপুণ চিত্রশিল্পী ও কলাকবিদ মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুরের এই সৃষ্টি সম্পর্কে আরো উল্লেখ করেছেন–


"উদয়পুরের জলে প্রাসাদের যেরূপ ঐতিহাসিক খ্যাতি কুঞ্জবনের শৈল প্রাসাদেরও সেরূপ একটি অপূর্ব নৈপুণ্য রহিয়াছে । যাহা কালে প্রসিদ্ধি লাভ করিবে । এই প্রাসাদের পরিকল্পনায় শিল্পী একটি চমকপ্রদ কৌশল ফুটাইয়া তুলিয়াছেন ।প্রাসাদটি দেখা মাত্রই মনে হয় ইহা দ্বিতল অথচ আসলে তাহা নহে । সূর্যের উদয়াচল অভিমুখী বড় প্রকোষ্ঠটি পর্যন্ত দ্বিতল অথচ ভিতরে কোঠা একতলা । এইরূপ বিস্ময়ের বেষ্টনে যেন এই শোভন অর্ঘ্য আবৃত হইয়া রহিয়াছে । ছাদপ্রকোষ্ঠে বিশাল মুকুরে দূরের উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের চিত্র প্রতিফলিত করিয়া ইহা যেন অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপনের যত্নশীল ।


 বন প্রাসাদের অনতিদূর একটি শৈলশিখরে শ্বেত বাংলা প্রস্তুত হইয়াছিল, সিক্রির প্রাসাদের নিচে নিচে যেমন আবুল ফজল ও ফৈজির বাসগৃহ দৃষ্ট হয় বন প্রাসাদের অনতিদূরে এই মর্মের কলাভবনেও মহারাজের বিশিষ্ট অতিথি কখনো কখনো বাস করিতেন । সেই শৈল শিখরে উঠিলেই পৃথিবী যে গোল ইহা পলকে চোখে ঠেকিয়া যায় ।


 মহারাজা যখন রাজকার্যে ক্লান্ত হইতেন আকবরের সিক্রি ধামের ন্যায় তিনি কখনো কখনো বনবাস করিতে এখানে চলিয়া আসিতেন । প্রকৃতির মধুময় নিবিড় বেষ্টনে থাকিয়া সংসারের তাপ ভুলিয়া যাইতেন ( পৃষ্ঠা ২১৪ ) ।"


ত্রিপুরার প্রাচীন তথ্যের জহুরী বহু প্রবন্ধের লেখক এবং রমাপ্রসাদ গবেষণাগারের প্রতিষ্ঠাতা রমা প্রসাদ দত্তও এই পুষ্পবন্ত প্রাসাদ সম্বন্ধে এক ই কথা বলেছেন ।


KD Menon ( IAS ) Tripura state gazetteers ( 1975 ) এ কুঞ্জবন প্রাসাদ সম্পর্কে লিখেছেন–


A picturesque  hillock known as kunjaban for its scenic beauty stands to the north of Agartala town and within a mile from the royal palace ( Ujjayanta Palace )  with tracts of some more low-lying hillocks. Though not far away yet being a countryside, this place came to be regarded as ideal for relaxation and pleasure strolls in the past for its green beauty, fine gardens, orchards and a small zoo opened by the government.

it was maharaja Biredrakishore Manikya who selected this beautiful place for construction of Suburban palace to be used for retreats. The construction of the palace was completed in 1917 when it was named 'Pushvanta Palace'. The Maharaja being a good artist is said to have repaired himself the plan of the palace and the adjoining gardens. The palace was subsequently extended and the approach road and the gardens re-aligned in accordance with the desire and requirements of the later rulers. This royal residence at the credit of accommodating royal guests occasionally.  It may be interesting to add that Rabindranath stayed in the eastern apartment of this palace during his 7th and last visit in 1926. A round Verandah attched to this eastern part named as 'Gol Varandah', was the most favourite place for the distance view of Baramuraa hills on the eastern horizon. This Varandah  had been the mute witness of many a dear moment when the poet composed popular songs, not less than five in number and all the corperated in 'Vaikali' series or remained absorbed in silence ( page 348 ).


উপরের লেখাটি থেকে জানা যায় যে, মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ১৯১৭ সালে এই কুঞ্জবন প্রাসাদ বা পুষ্পবন্ত প্রাসাদটির নির্মাণ কার্য সমাধা করেন । কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একসময় আগরতলায় এসেছিলেন এবং কিছুদিন এখানে অবস্থানও করেছিলেন । ফিরে গিয়ে তিনি 'অভিযাত্রিক' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন । সেখানে তিনি সেকালের আগরতলার একটি বর্ণনা দিয়েছিলেন তার বর্ণনায় ছিল–


"আমার ভাল লেগেছিল মহারাজার নতুন প্রাসাদ । ছোট চিড়িয়াখানায় কয়েকটি বন্যজন্তু, কুঞ্জবন প্রাসাদ ও বড় একটি ফুলের বাগান । মহারাজার নতুন প্রাসাদের বড় ফটকে বন্দুকধারী গুর্খা বা কুকিসৈন্য পাহাড়াওয়ালা । অনুমতি ভিন্ন কাউকে প্রাসাদ দেখতে দেওয়ার নিয়ম নেই । কুঞ্জবন প্যালেস একটা অনুচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থিত । পুরানো আমলের তৈরি বলেই ঢের ভালো লাগে মার্টিন কোম্পানি তৈরি মহারাজের নতুন প্রাসাদের চেয়ে । কুঞ্জবন প্যালেসের একটা ঘরে অনেক প্রাচীন চিত্র, হাতির দাঁতের শিল্প, ত্রিপুরা রাজবংশের পূর্বপুরুষদের বড় বড় ছবি ইত্যাদি ।"


কুঞ্জবন মালঞ্চাবাস ও পুষ্পবন্ত প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথের পদার্পণ 


মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলে কলকাতায় যুবরাজ রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল । তবে সেসময় তিনি তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । সিংহাসনে আরোহণের ( ১৯০০ খ্রি. ) পর প্রথমদিকে তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন । তার মধ্যেও রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । রাধাকিশোর মাত্র বারো বছর  রাজত্ব করেছিলেন । এই সময়ের মধ্যে কবির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে । কবি ও রাজাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন । মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সে সম্বন্ধে 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থের একটি লেখায় আমরা পাই–


 "কবি সম্বর্ধনার আয়োজন হইল পুরাতন কুঞ্জবনের সুউচ্চটিলায় শ্রী পঞ্চমী উপলক্ষে বসন্ত উৎসবে ( ১৩০৬ ) । ত্রিপুরার আদিবাসী টংঘরে নমুনায় সম্বর্ধনা মঞ্চ তৈরি হইল । মুলিবাঁশের তৈরি মঞ্চের গড়ন ও ফুল পাতায় সজ্জা পরিপাটি শিল্পশোভার নিদর্শন । মঞ্চের উপর হইতে নজর পড়ে চারিদিকে উচ্চ নিচ পাহাড়গুলি থরে থরে ঢেউ খেলিয়া দূর দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে–আকাশের নীল চন্দ্রাতপ দিগন্ত রেখাকে চুম্বন করিয়া ঋতু উৎসবকে আরো কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে । এই প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনকে আরো সংবর্ধিত করিয়াছে দলে দলে নৃত্য গীতরত মনিপুরী শিল্পী বৃন্দ । নগ্ন গাত্র, পরিধানে বাসন্তী রঙের কাপড়, লম্বমান বাসন্তী চাদর গলায়, মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ী, খোল মন্দিরা, করতালের সমতলে পদক্ষেপ ও দেহ ভঙ্গিমা দীর্ঘলয়ে কীর্তনের সুর এক মোহময় আবেশ রচনা করিতেছিল । দর্শক যাহারা তাহারাও স্ত্রী পুরুষ সেই বাসন্তী রঙের পরিচ্ছদে ভূষিত । এই পরিবেশের মধ্যে কবি ও রাজা মঞ্চোপরি ফরাস বিছানায় আসীন । কালোপযোগী নৃত্যগীত ও পুষ্পশয্যার উপহার– রাজা প্রজার সমব্যবহার কবির মনকে এক অভূতপূর্ব আনন্দে ও বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া দিল । ( ত্রিপুরায় রবীন্দ্রস্মৃতি, সত্যরঞ্জন বসু / রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, তৃতীয় মুদ্রণ– মে ২০১১ পৃ. ১৫ )


 এছাড়া প্রাগুক্ত গ্রন্থে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র জীবনী–প্রথম খন্ড থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত মহোদয় লেখেন–


 "বসন্তসমাগমে ( ১৩০৬ ) সম্ভবত শ্রীপঞ্চমীর সময় মহারাজের নিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় সর্বপ্রথম আগমন করেন এবং রাজ অতিথিরূপে কর্নেল মহিম ঠাকুরের নির্মিত গৃহে অবস্থান করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণ কার্য তখনও চলিতেছে । কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকণ্ঠস্থ পুরান কুঞ্জবনের শৈলশিখরে কবির সম্মানে বসন্ত উৎসবের ও মনিপুরী নৃত্য গীতাদির মনোজ্ঞ  অনুষ্ঠান আয়োজিত হইল ।" ( তথ্য ক্রমপঞ্জি–শ্রী দ্বিজেন্দ্র দত্ত / রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১২৫–১২৬ )


 ১৩০৬ বঙ্গাব্দের বসন্তপঞ্চমীতে রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আগমনের তারিখ সম্বন্ধে পরবর্তী সময়ে মতান্তর দেখা দেয় । সম্ভবত প্রাগুক্ত দুই লেখক রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের তখনকার মতো প্রামাণ্য গ্রন্থটি অনুসরণ করার কারণেই এরূপ তথ্যবিভ্রাটের কারণ হয়েছে । ত্রিপুরা আঞ্চলিক রবীন্দ্র শতবার্ষিকী সমিতি আগরতলা কর্তৃক রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৬৮ বাংলা । পুনর্মুদ্রণ হয় ফাল্গুন ১৩৯৩ বাংলা ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ এবং তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ হয় বৈশাখ ১৪১৮ বাংলা মে ২০১১ ইংরেজি । এই গ্রন্থের তৃতীয় মুদ্রণের মুখবন্ধের সংযোজনীতে ( ২ ক–খ ) তথ্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় প্রথম এসেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ইংরেজি ( বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ : কিছু তথ্য-অশোকানন্দ রায়বর্ধন / ত্রিপুরা দর্পণ, ৯ এপ্রিল ২০২৩ ) ।


তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা স্থির নিশ্চিত হওয়া যায় যে, রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পণের পর তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল এই কুঞ্জবনেই । অবশ্য তখন কুঞ্জবনে কোন প্রাসাদ তৈরি হয়নি । ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য জানতেন যে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিপ্রেমিক । প্রকৃতির সৌন্দর্যে কবির মনপ্রাণ আপ্লুত হয়ে যাবে । এই আশা করে তিনি কুঞ্জবনের সবুজ বনানীর মাঝখানে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন । গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন সময়ে মিলিয়ে সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন । তিনি ১৯১৯ সালে ষষ্ঠববার কুঞ্জবন মালঞ্চাবাসে এবং সপ্তম বার অর্থাৎ শেষবার ১৯২৬ সালে কুঞ্জবন প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন । কুঞ্জবনের মালঞ্চাবাসটিও নির্মাণ করেছিলেন শিল্পবোদ্ধা মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য বাহাদুর ( ১৯১৯ ) । এই মালঞ্চাবাসের একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে প্রফুল্ল চন্দ্র সেনগুপ্তের স্মৃতিকথায় । তাঁর সুলিখিত বয়ানটি থেকে আমরা পাই মালঞ্চা বাসের বিবরণ ও রবীন্দ্র সংবর্ধনার বর্ণনা ।


 "আগরতলার শৈল চূড়ায় বিহঙ্গের কুঞ্জবনের কলকাকলিতে ভরা নয়নাভিরাম ঘন সবুজ বনানীর কোলে চারদিকে অজস্র প্রস্ফুটিত ফুলের মনোরম উদ্যানে একটি অস্থায়ী আবাস বা বিশ্রামাগার নির্মিত হয়েছিল । শিল্পী মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর এর নাম রাখলেন 'মালঞ্চআবাস' ।


 আবাসটি ছিল মোটা উলুছনের ছাউনিযুক্ত চৌচালাগৃহ । বাঁশ ও বেতের অপূর্ব কারুকার্য খচিত নকশা দেওয়া চারদিকের বেড়া তথা ঘেরাটোপ । মেঝেতে কাঠের পাটাতনে সুদৃশ্য কার্পেট বিছানো, রাতে জ্বলতো চিনা ঝাড়লন্ঠন ।  প্রশস্ত কাঠের বারান্দা বাঁকানো সিঁড়ি । দুদিকে পার্শ্বচর ও পরিচর্যা কারীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘর । সামনে প্রশস্ত প্রাঙ্গন । দুদিকে গোলাপ ও কাঁঠালচাঁপার সুমিষ্ট সুবাসে ভরপুর থাকত ও চারিদিকে অপূর্ব শ্যামলিমা, গেরুয়া মাটির ছোট ছোট পাহাড় কলকাকলিতে মুখরিত । দিগন্ত প্রসারী নিস্তব্ধ নীরব প্রকৃতি । কবির মনোরঞ্জনার্থে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মনিপুরী মেয়েরা ( লাইছবি ) তাদের চিরাচরিত গোপরাস ও বসন্তরাসে নিজেদের অঙ্গচালন ও মুদ্রায় কবিকে আপ্লুত করে রেখেছিল । পুরুষ কীর্তনীয়া ও নর্তক দল পরিবেশন করেন পুংচোলম ও করতালচোলম । গীতগোবিন্দের পদাবলীর সুললিত ছন্দে মনিপুরী ভাষায় ও সুরে অংশগ্রহণ করেন বুদ্ধিমন্ত, জিতেন্দ্রজিৎ ও নবকুমার সিংহ প্রমুখ নৃত্যগুরু ও প্রশিক্ষকগণ ।

অনুষ্ঠানের মূলভাব, রস ও পদলালিত্য এবং ব্রজবুলি মৈথিলী এবং বাংলাভাষার সংমিশ্রণে রচিত ও শ্রুতিমধুর ভাষা ও সুরের জালে রবীন্দ্রনাথ আবিষ্ট ও অভিভূত ও মোহাবিষ্ট ।" ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১২৮, ১৯৭, প্রথম প্রকাশ আশ্বিন, ১৩৬৮ বাংলা )


রবীন সেনগুপ্তও তাঁর লেখায় এই সংবর্ধনার উল্লেখ করে বলেছেন–


 "রবীন্দ্রনাথ এই নৃত্যগীত দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন । তিনি মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোরকে অনুরোধ করেছিলেন এই নাচের গুরু বাবু বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যের প্রশিক্ষক করে পাঠাতে । মহারাজা সানন্দে এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন ।"


 এই মালঞ্চাবাসের কথা রবীন্দ্রনাথের মনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল তিনি সপ্তম বার অর্থাৎ শেষবার যখন আগরতলায় ( ১৯২৬ ) আসেন তখন কুঞ্জবনপ্রাসাদে বসে আগের বারের ত্রিপুরা আগমন উপলক্ষে মালঞ্চাবাসের অবস্থানের স্মৃতি রোমন্থন করতেন । বার্ধক্যে এসেও তিনি শান্তিনিকেতনে বসে তাঁর স্মৃতিচারণ প্রসঙ্গে বলেছেন–


 "পৃথিবীর প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈলশ্বেতভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না ।" ( সূত্র রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, পৃ. ২১৫ ) । কিন্তু কবির স্মৃতি বিজড়িত সে মালঞ্চাবাস বহু আগেই কালের করাল গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে । পরবর্তী সময়ে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য একটি বাড়ি তৈরি করেন ( ১৯৩৬ ) । সেটি 'মালঞ্চ-নিবাস' নামে পরিচিত হলেও তা বর্তমানে একেবারেই ভগ্নদশাপ্রাপ্ত হয়েছে । যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সেটিও কালস্রোতে বিলীয়মান । 


রবীন্দ্রনাথ সপ্তমবার অর্থাৎ শেষবার আগরতলায় এসেছিলেন ১৯২৬ সালে । ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০-১৪ ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অতিবাহিত করেছিলেন ।‌ এই সময়ে প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথকে দেখাশুনা ও সাহচর্য দানের দায়িত্বে ছিলেন রাজপারিষদ হরিদাস ভট্টাচার্য । তিনি বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র ও কবির স্নেহধন্য ছিলেন । এবার কবি পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর রবীন্দ্রনাথকে আগরতলায় আসার আমন্ত্রণ জানানোয় তিনি আগরতলা ভ্রমণে এসেছিলেন । এ ভ্রমণে আগরতলায় আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কিশোর সাহিত্য সমাজ কর্তৃক সংবর্ধনা গ্রহণ সহ তরুণ মহারাজ বীর বিক্রমের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর ও শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মিলিত হওয়া । 


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই কয়দিন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের অভিজ্ঞতার কথা হরিদাস ভট্টাচার্য পরবর্তী সময়ে মাসিক সাহিত্যপত্র 'রবি'তে 'আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ' শীর্ষক স্মৃতিচারণমূলক রচনা প্রকাশ করেন । সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের পুষ্পবন্ত প্রাসাদে পদার্পণ থেকে শুরু করে যে কয়দিন সেখানে অবস্থান করেছিলেন তার আনুপুর্বিক বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন । তিনি লিখেছেন–


 "১০ই ফাল্গুন রাত্রি প্রায় দশ ঘটিকার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কুঞ্জবন প্রাসাদে পদার্পন করেন । দেখিয়া তাঁহাকে অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন বোধ হইল । রাস্তা হইতে সিঁড়ি ভাঙ্গিয়া প্রাসাদের দরজায় আসিতে রীতিমত পরিশ্রম বোধ করিতেছেন বলিয়া অনুমান করিলাম । সমবেত ভাইস প্রেসিডেন্ট বাহাদুর ও চিফ সেক্রেটারি মহোদয় প্রভৃতির সহিত সাদর সম্ভাষণান্তর আহারে বসিয়া তিনি রাজপরিবারের সকলের কুশল প্রশ্নাদি করিলেন । 

***********************************************************************আহারের পর অধিক রাত্রি হইয়া যাওয়ায়, কবি সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন । বলা বাহুল্য যে, আখাউড়া হইতে আরম্ভ করিয়া মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর ও রণবীরকিশোর আহারের পর কবির বিদায় গ্রহণ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন । খুব সম্ভব সেই রাত্রি শুক্লপক্ষের দশমী তিথি ছিল । জ্যোৎস্নালোকের কুঞ্জবন ও তৎপার্শ্বস্থিত  সমুদয় স্থানসমূহ এক অপূর্ব শোভায় উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল । চতুর্দিক নিস্তব্ধ–কবি পূর্ব দিকে খোলা বারান্দায় বসিয়া প্রকৃতির অপূর্ব লীলা প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন । আমরা আহারাদি সমাপন করিয়া নিদ্রাদেবীর  আশ্রয় গ্রহণ করিলাম ।কবি নিদ্রা গিয়েছিলেন কি প্রকৃতির ধ্যানে রাত্রি প্রভাত করিয়াছিলেন তাহা জানিনা ।


 পরদিন ( ১১ই ফাল্গুন ) খুব ভোরে উঠিয়া দেখি কবি তাঁর বসিবার কোঠা হইতে অনিমেষ নয়নে সূর্যোদয়ের শোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন । রক্তিম আভায় পূর্বদিক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে–নানা রঙের পাখীগুলি নানা সুরে গান করিয়া কবিকে সংবর্ধনা করিতেছে সে বলিয়া মনে হইল । কবির হৃদয়ে বড়ই পুলক সঞ্চার হইয়াছে বলিয়া তাঁহাকে দেখিয়া অনুমান করিলাম ।"


রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় অবস্থানকালে এই পুষ্পবন্ত প্রাসাদে বসে প্রকৃতির শোভা অবলোকন করতে করতে সংগীত রচনায় মগ্ন হয়ে যেতেন । হরিদাস ভট্টাচার্য অবশ্য তাঁর স্মৃতিকথায় সে বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেননি । মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য কবির শুভাগমনকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে পাথরে খোদাই করে স্মৃতিফলক ঘরের দেওয়ালে সেটে দিয়েছিলেন । সেই স্মৃতিফলকে লেখা থেকে জানা যায় যে, 'দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা' ও 'ফাগুনের নবীন আনন্দে' এই গান দুখানি রবীন্দ্রনাথ এই প্রাসাদে থাকার সময় রচনা করেছিলেন ।‌ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' স্মারক গ্রন্থে লেখা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ 'দোলে প্রেমের দোলনচাঁপা', 'ফাগুনের নবীন আনন্দে', 'এসো আমার ঘরে এসো', 'বনে যদি ফুটল কুসুম' এবং 'আপন হারা মাতোয়ারা' এই পাঁচটি গান রচনা করেছিলেন । তবে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, আরও একটি গান 'অনন্তের বাণী তুমি'সহ মোট ছটি গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগরতলায় বসে রচনা করেছিলেন ( সম্ভাব্য রচনাকাল– ১০ ফাল্গুন থেকে ১৪ ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দ ) ।


হরিদাস ভট্টাচার্য মহোদয়ের লেখনী থেকে জানা যায়, "পরদিন সকালবেলা ( ১২ই ফাল্গুন ) কবি কিশোর সাহিত্য সমাজে যান এবং সেখানে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় । সেদিন বিকালে মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্র কিশোর ও রণবীর কিশোর কবিকে লইয়া মোটরের শহরের বেড়াইতে যান রাত্রিতে হারাদির পর কবি পূর্ব দিকের বারান্দায় জোসনা লোকে কতক্ষণ বসে ছিলেন তাহা জানিনা ।" ১৩ ফাল্গুন কবি প্রতাপগড় কৃষিক্ষেত্র ( দি টিপারা হিল ডেভেলপমেন্ট  কোং লিমিটেডের বাগান ) পরিদর্শনে যান । বাগানটি দেখে তিনি খুব খুশি হন । সেদিন সন্ধ্যায় মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবিকে মনিপুরী মেয়েদের রাসলীলা প্রদর্শন করানো হয় । রাসলীলা দেখে কবি মুগ্ধ অভিভূত হয়ে যান । সখীদের নৃত্যভঙ্গিমা দেখে আপ্লুত হয়ে কবি বলেছিলেন, 'ইহা দেখায় আমার পূর্ববঙ্গে আসা সার্থক হইল । পরদিন ( ১৪ ফাল্গুন ) দুপুরবেলা কবি কুঞ্জবন ত্যাগ করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান । সেদিন সন্ধ্যায় কুঞ্জবন প্রাসাদ থেকে মেঘে ঢাকা আকাশের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরকে বলেছিলেন, 


"আমার নাম বদলাইয়া তোমরা এখানে আমাকে একখানা কুটির বাধিয়া দাও জীবনের শেষ কয়টা দিন প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিয়াই অতিবাহিত করিব ।"



রবীন্দ্রনাথের এই শেষবারের ত্রিপুরা ভ্রমণ সম্বন্ধে দ্বিজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত 'তথ্যক্রমপঞ্জী'-তে উল্লেখ করেছেন,


" ১৩৩২ বঙ্গাব্দ– পূর্ববঙ্গের ঢাকা ময়মনসিংহ কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চল সফর শেষে মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ কয়দিন নিরালায় বিশ্রামের উদ্দেশে সদলবলে আগরতলায় শুভ পদার্পণ করিলেন (১০ই ফাল্গুন সপ্তম ও শেষবার ) । এবার কবি অবস্থান করিলেন কুঞ্জবনপ্রাসাদে ( যাহা বর্তমানে চিফ কমিশনারের সরকারীরা বাসভবন ) ।

********************************************************************************

আগরতলায় অবকাশ যাপনের কর্মসূচির মধ্যে কবি শহরের সন্নিকটস্থ প্রতাপগড় কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন, মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের গৃহে একাধিকবার রাসনৃত্যগীতাদি অনুষ্ঠানে যোগদান করিয়া তথায় কিশোর মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের সহিত সাক্ষাৎ পরিচয়, 'রাজমালা' ও 'গীতচন্দ্রোদয়' সম্পাদন সম্বন্ধে আলোচনা, ত্রিপুরার সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক মন্দির প্রাসাদাদি ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়াদী সংরক্ষণ, দীর্ঘদিনের পুরাতন বন্ধু কর্নেল মহিম চন্দ্রের  পরিবারবর্গের সঙ্গে পুনর্মিলন ইত্যাদি বহুবিধ কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন । ( তথ্যক্রমপঞ্জী, শ্রীদ্বিজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ১৫৩–১৫৪ )


কুঞ্জবনের ও পুষ্পবন্ত প্রাসাদ থেকে দেখা সেদিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আজীবন কবির স্মৃতির মণিকোঠায় সমুজ্জ্বল হয়ে বেঁচে রয়েছিল । ত্রিপুরায় আগমণের প্রথমদিন কবি এখানেই জীবনের প্রথম মণিপুরী নৃত্য অবলোকন করেছেন মুগ্ধ নয়নে । আবার শেষদিনও মনিপুরী নৃত্যের মাধ্যমে রাজ্য থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন । মণিপুরী নৃত্যের রস আস্বাদন তিনি এতটাই গভীরভাবে করেছিলেন যে, পরবর্তী সময়ে কবি এই নৃত্যধারাকে শান্তিনিকেতনে চালু করেন । এবং তার মননস্পর্শেই এই মনিপুরী নৃত্য একদিন বিশ্ব সভায় ধ্রুপদী নৃত্যের আসন গ্রহণ করে । 


১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা রাজ্য ভারতীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়ার পর ৪'৩২ একরের প্রাসাদটি প্রধান কমিশনারের বাংলো হিসাবে এবং তারপরে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাজভবন হিসেবে কাজ করে । ২০১৮ সালে রাজভবনটি নতুন একটি ভবনে স্থানান্তরিত করা হয় । ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদীর মুর্মু ২০২২ সালের ১৪অক্টোবর এই পুরাতন রাজকীয় পুষ্পবন্ত প্রাসাদে ত্রিপুরার প্রথম ডিজিটাল জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন । এই হেরিটেজ ভবনকে Maharaja Birendrakishore Manikya Museum করা হয়েছে । এই প্রাসাদকে মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তুলে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান ও নানা কার্যের নিদর্শন তুলে ধরা হবে । গত অক্টোবর মাস থেকে এখানে রেক্টোফিটিং এর কাজ শুরু হয়েছে । নয়া দিল্লির কে এন ও এস পি-ই এবং সিও এল এল পি কোম্পানি এই রেক্টোফিটিং এর কাজ করছেন ।



সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :


১. শ্রীরাজমালা–চতুর্থ লহর

২. রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ( শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ )– চট্টোপাধ্যায় ও গঙ্গোপাধ্যায়, ত্রিপুরা সরকার ।

৩. রবীন্দ্রসান্নিধ্যে ত্রিপুরা– বিকচ চৌধুরী, ত্রিপুরা দর্পণ আগরতলা 

৪. রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরা– পান্নালাল রায়,পারুল প্রকাশনী'

৫. রবীন্দ্রনাথ : প্রসঙ্গ ত্রিপুরা– দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ গোস্বামী, অক্ষর, আগরতলা 

৬. রবীন্দ্রনাথ ও অনন্যা ত্রিপুরা– রবীন সেনগুপ্ত

৭. আগরতলাযর ইতিবৃত্ত– রমাপ্রসাদ দত্ত, পৌনমী প্রকাশন, আগরতলা

৮. নতুন হাভেলির ছয় মানিক্য– পান্নালাল রায়, পৌণমী প্রকাশন 

৯. ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী– রাজমালা 

১০. কুঞ্জবনের রবীন্দ্রনাথ– জ্যোতির্ময় রায়, পূর্বমেঘ আগরতলা 

১১. ত্রিপুরায় রবীন্দ্রস্মৃতি– সত্যরঞ্জন বসু ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা )

১২. তথ্যপঞ্জী– শ্রী দ্বিজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা )

১৩. আগরতলায় রবীন্দ্রনাথ– হরিদাস ভট্টাচার্য ( রবি পত্রিকা )

১৪. Tripura State Gazetters–K K Menon ( I A S )