Wednesday, June 15, 2022

সাত্তাই বা হাত্তাই ব্রত

'সাত্তাই' বা 'হাত্তাই' পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিশেষ ব্রত বা বর্ত । জৈষ্ঠ‍্যমাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন এই বর্ত পালন করা হয় । এই বর্তের মূল উপাদান ছাতু । এই ছাতু তৈরি হয় চালভাজা, খই, বিভিন্ন রকমের ডাল ইত‍্যাদির মিহি গুড়ো দিয়ে । সেকালে ঢেঁকিতে কুটে এসব গুড়ো করা হত । মূলত এদিনটি এই ছাতু খাওয়ারই অনুষ্ঠান ‌। সকালবেলা মায়েরা স্নান সেরে আলতাসিঁদুর পরে এই বর্ত করতে বসতেন । বর্তের সময় ছাইতরানি/ছাইত্তানি মতান্তরে ছাতুকুমারীর নামে একটি জলপূর্ণ ঘট আম্রপল্লবসহ বসানো হত । পুজোর জন‍্যে কোনো বৈদিকবিধি নেই । নৈবেদ‍্যের উপকরণ হিসেবেও থাকত ছাতু , কলা ও কাঁচা দুধ । ভোগ নিবেদনের পর ব্রতীদের একজন পূর্বোক্ত লৌকিক দেবীর ব্রতকথা বলতেন ‌। অন‍্য ব্রতীগণ গলবস্ত্র হয়ে ব্রতকথাটি শুনতেন । ব্রতকথা সমাপ্তির পর উলুধ্বনির মাধ‍্যমেই ব্রতসাঙ্গ হত । প্রণামের সময় ব্রতীগণ বাংলা ছড়ার ঢংএ দেবীর কাছে বলবুদ্ধি বৃদ্ধি, আয়ু বৃদ্ধি,ছিরি বৃদ্ধির কামনা করতেন । তারপর ছাতুসহ পুজোর অন‍্যান‍্য উপকরণ প্রসাদ হিসাবে সবার মধ‍্যে বিলি করা হত । তবে শিশুদের মধ‍্যে সর্বাগ্রে প্রসাদ বিতরণ করার নিয়ম ছিল ।
 এই বর্ত প্রাচীন কৌম জনগোষ্ঠীর উর্বরতাকৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত । ছাতুর মূল উপাদান হল বীজ । বীজের রয়েছে সৃজনক্ষমতা । এই বীজ সরাসরি গ্রহণের চিন্তার মধ‍্য দিয়ে আদিম মানুষ নিজেকে উর্বর করার বা উৎপাদন করার জাদুবিশ্বাসে প্রভাবিত হতেন । সংস্কৃত 'শক্তু' শব্দ থেকে এসেছে ছাতু । ছাতুর সঙ্গে নামসাদৃশ‍্যে শক্ত ও শত্রুর একটা সম্পর্ক রয়েছে । ছাতুভক্ষণের মধ‍্য দিয়ে শক্ত হওয়া ও নিজদেহে শক্তিধারণের কৌমচেতনায় সমৃদ্ধ হতেন আদিম মানুষ ।  সেসময়ে শত্রুকে প্রতিহত করার জন‍্য দৈহিক শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজন ছিল মানুষের । হাত্তাইর দিন আর একটি আচার পালন করত শিশুকিশোররা । এদিন তারা লাটিম বা লাডুমখেলা বা লাডুমঘুরানিতে মেতে উঠত । লাডুম দিয়ে পরস্পরকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতা হত । এই লোকক্রীড়াও শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার একটা প্রতীকী অনুষ্ঠান। এদিন স্নান করে উপুড় হয়ে দুপায়ের ফাঁক দিয়ে পেছনের দিকে ছাতু উড়িয়ে দেওয়ার মাধ‍্যমে শত্রুকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার চেতনা কাজ করে । পায়ের তলা দিয়ে উড়ানো মানে শত্রুকে একেবারে তাচ্ছিল্য করার প্রতীক ।
 হাত্তাই বা সাত্তাই এককথায় কৌমজনগণের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিক শক্তি অর্জনের অনুষ্ঠান । কারণ আদিমজীবনে গোষ্ঠীসংঘর্ষ ছিল নিত‍্যদিনের ঘটনা ।

Tuesday, June 14, 2022

ভাবনা

সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই তো আপডেট হয় । কুশপুতুল দহনের পর কুশপুতুল পদাঘাত । ভাবনার উন্নয়ন ঐতিহাসিক ঘটনা । গিনেস বুকে তোলার মতো । এরপরে হয়তো আসবে কুশপুতুলে মলত‍্যাগ । কার ভাগ‍্যে আছে জানিনা । বোধহয় সেটাও অচিরেই দেখা যাবে । দহন, পদাঘাতকে মান‍্যতা দিলে এই সংযোজনকেও মানতেই হবে ।

Wednesday, June 1, 2022

জয়মৃদঙ্গ

জয়মৃদঙ্গ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

পিরিতির ভাইলভাট্টা জানার কোন দরকার নেই
নেই কোনো ডুবস্নানের কৌশলকলার উদ্যম
শুধুই নরম ও লোভনীয় প্রত্যঙ্গগুলো খুবলে খাবার
রাক্ষুসে ক্ষুধাকে ঐতরেয় নষ্টামিতে ভরে চলেছি

সভ্যতার সমস্ত অলঙ্কারে গাঁথা গর্বিত প্রজন্ম
শুধু পশুচর্ম গায়ে তুলতে বাকি রেখেছো 

অহো  ! মানব তোমার জয়মৃদঙ্গ বাজে বাতাসে  !

Saturday, May 28, 2022

কালু কামার

কালু কামার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কালু কামার ৷ কে কালু কামার?  গায়ের রঙ কালো বলে কী কালু কামার?  নাকি কালো পাথরের সাথে ছেনিসঙ্গমে জাগিয়েছে প্রাণ তার জন্যে? যে দেবতারা জীবকে সৃষ্টি করে বলে অহংকৃত মিথমগজ জনারণ্যে দাপিয়ে বেড়ায়,  সেই দেবতার জন্মদাতা কালু কামার? 

এতোবড়ো ধৃষ্টতার জন্যেই ঊনকোটি দেবতারা স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস পেলি না তোদের জনককে ৷ 

পরিচয়হীন কালু কামার ৷ মজাদার বাক্যবন্ধের জন্যে বিখ্যাত যে রমাকান্ত কামার ৷ তেমন কেউও হতে পারল না কালু কামার ৷ 

যুগে যুগে  পাহাড় কন্দরে জন্ম ও লালনে দেবতা গড়ে তোলে  তিলে তিলে ঘাম ও রক্তে ৷ 
নিভৃত লুঙ্গায় মশালের আলোয় আর মশার কামড়ের যন্ত্রণা ভুলে যে দেবকুলকে গড়ে তোলে কালু কামার, 

ত্রিভুবনবাসের আভিজাত্যে তারা কালু কামারকে চেনে না ৷ পিতা নেই তাদের ৷ তাদের গোষ্ঠীপতি স্বয়ম্ভুনাথ ৷ ঊনকোটিপতি ৷

কালু কামার আজো সাব অল্টার্ণ একলব্যপ্রতিম ৷

Tuesday, May 24, 2022

স্বপ্নদাদা

স্বপ্নদাদা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি । দাদাদের বয়সী । দাদারা কেউ কেউ আছেন । অনেক দাদা নেই । তাঁরা শূন্যটিলায় ফিরে গেছেন । যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের আমি দাদা ডাকি । আর যে দাদার রয়েছেন তাঁরা তো দাদাই । বয়সকালে এই দুই দাদারাই দাদাগিরি করতেন । আমি অনুজ সেই দাদাদের অনুকরণ করেছি । একসময় আমিও দাদা হয়ে উঠেছি । আমাকে এখন অনেকেই দাদা ডাকে । আসলে আমি আমি আমার দাদাদের নিয়ে সবসময় ভাবতাম । কিকরে যে তারা দাদা হল । আমি তাদের রাতে ঘুমুলে স্বপ্ন দেখতাম । কখনও কখনও দিনেও স্বপ্ন দেখতাম ।  তাঁরা আমার স্বপ্নদাদা ।

এই স্বপ্নদাদাদের একজন আমার ঘরেও ছিল । তবে আমি তাঁকে দেখিনি । বড়ো হয়ে মা-বাবার মুখে শুনেছি । পাড়া পড়শি সেই দাদার গল্প করত । সেও একদিন আমার স্বপ্নদাদা হয়ে যায় । আমার মা-বাবা নাকি গঙ্গার অভাবে তাকে ব্রহ্মপুত্রে বিসর্জন দিয়েছেন । কারণ সেকালে আমরা ব্রহ্মপুত্রের পারে থাকতাম । আমার ঘরের স্বপ্নদাদাকে তাঁরা কেন বিসর্জন দিয়েছেন তা কেউ জানে না । জানলেও আমাকে বলে না । না মা বাবা । না পড়শিরা । সে ঘটনার বহু পরে নাকি আমি আসি । তখন থেকে সবাই আমাকে দেখে । আমার ঘরোয়া স্বপ্নদাদাকে দেখে না । আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে । কখনও আমাকেও বলে । আমার ব্রহ্মপুত্র দাদাই নাকি আমার শরীর নিয়ে ফিরে এসেছিল মায়ের কাছে । তার সব দাদাগিরিও ভর করেছিল আমার শরীরে । চারদিকে আমার অগণিত অনুজ । গণদাদা আমি । আমার দাদাগিরি আমার এবং তাদের উপর । 

এখন মাও নেই । বাবাও নেই । সর্বশেষ যে কজন দাদা ছিলেন তাঁরাও নেই । দাদাগিরির শংসাপত্র হিসেবে বাবা আমাকে বাজারের শূন‍্য থলেটা দিয়ে গেছেন । আমাকে রোজ সেটা ভরে তুলতে হয় । থলেটা শূন্য হয় ।...আবার আমাকেই ভরে তুলতেই হয় ।...
              

Tuesday, May 17, 2022

মিলন হবে কত দিনে...

মিলন হবে কতদিনে

মেলা ভেঙে গেলে মনটা নরম হয়ে যায় । ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে । কেবল শূন‍্যতা । কেবল ভাঙার শব্দ । ভাঙনের আওয়াজ। মেলার মাঠে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে আবর্জনা । ভাঙা বেড়া বাঁশের খুঁটি । পলিপ‍্যাকের টুকরো । হাজার মানুষের পায়ের চাপে ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর মাটি । নিঃসঙ্গ বুদ্ধমন্দিরের নীরব গৈরিক চূড়া । বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ । প্রতিটি মেলা শেষে সেই পরিচিত চিত্র। 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!'

গত রাতে শেষ হয়েছে সাব্রুমের বৈশাখীমেলা। ত্রিপুরার দক্ষিণ সীমান্তিক শহরের প্রাচীনতম মেলা । বহু মানুষের স্বপ্নের মেলা । প্রতি বছরই বহু মানুষের সমাগম হয় এই মেলায় । এই জেলার মানুষজন ছাড়াও বাইরে থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে মেলার দিনগুলোতে । আত্মীয়তার সূত্রে । পরিচয়ের সূত্রে । নাম শুনে । পেশাগত কারণে যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁরাও বাড়ি ফেরেন মেলাকে কেন্দ্র করে । বাইরে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েরা বাপের বাড়িতে নাইওর আসেন মেলা উপলক্ষে । প্রায় প্রতি বাড়িতে কদিন হাট-বাজার একটু বেশি করতে হয় এ কদিন । 'অতিথি দেব ভব' ভাবনায় । 

   গত দুই বছর করোনা মহামারীর কারণে মেলা হয়নি । ঘরবন্দী মানুষ দিন গুনেছেন মুক্তির । প্রকৃতিসৃষ্ট হোক বা মনুষ‍্যসৃষ্ট । মানুষকে বেঁধে রাখতে পারেনা কেউই । মানুষ ভেঙে ফেলে বন্দীত্বের শৃঙ্খল । সামাজিক দূরত্বের কারণে সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ আবার মিলনের উৎসবে সম্মিলিত হয়েছে এই বৈশাখীমেলাকে কেন্দ্র করে । বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছে মেলার মাঠে । ঝড়-বাদলে প্রকৃতির পরিবর্তন, রাজ‍্য রাজনীতির পরিবর্তন এই মেলাপাগল মানুষের গায়ে কোনো
আঁচ ফেলতে পারেনি । নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব আনন্দের অংশীদার হয়েছেন তাঁরা । মেলার পরিধি এবারে অনেক বিস্তৃত হলেও তিলধারণের জায়গা ছিলনা কোথাও । মেলাকে ঘিরে জনপ্লাবন বয়ে গেছে । এতো এতো মানুষের সমাগম । একটাও অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ নেই । এটাই এই মেলার বৈশিষ্ট্য। শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা সাব্রুমের চিরন্তন ঐতিহ‍্য । যার জন‍্যে সাব্রুমবাসী গর্ব করে । আশির দাঙ্গার বীভৎসতা দেখেনি এ মাটি । ঐক‍্য ও সম্প্রীতি সাব্রুমের মুকুটের বৈদুর্যমণি । সদ‍্যসমাপ্ত সেই মেলাতেও সেই ধারা রক্ষিত হয়েছে ।

      তার পরেও মেলা শেষ হয় । বিষাদ নেমে আসে প্রান্তর জুড়ে । ফাঁকা ফাঁকা লাগে কোথায় যেন । ঘরে ফেরা মানুষের পায়ের ধুলো ওড়ে বাতাসে । আকাশেও মেঘ গুড় গুড় করে যেন বিসর্জনের বাজনা বাজায় । ক্লান্ত মানুষ ঘরে ফেরে । ফেরে যার যার সধ‍্যমতো তৈজসপত্র নিয়ে । ফেরে মিলনের বার্তা নিয়ে । প্রিয়জনের হাত ধরে ঘুম জড়ানো চোখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে, আবার 'মিলন হবে কত দিনে...' ।

Monday, May 16, 2022

স্বপ্ন ও চাঁদ

স্বপ্ন ও চাঁদ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

ঠাকুমার স্বপ্নবোনা চাঁদ ঘরে ঢুকে পড়েছে ভেবে 
আমপাতা জামপাতায় সাজাই ভাঙা ঘরের চারধার
 উঠোনে দু'চারটে বিদেশি ফুলের চারা টবে বাড়ে
 আম্রপালি আম গাছ বেড়েছে জলে ও জৈব সারে 

বছরের পর বছর শরৎ আর বসন্ত যায় চাকা বেয়ে
 গাছেদের মত বেড়ে ওঠে স্বপ্ন ডালপালা নিয়ে 
ঘরে বাড়ে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, আরও কত কি 
বারবার দিতে হয় অকাট‍্য প্রমাণ নাগরিক পরিচয়ের
এখন আর তারাদের মিছিলে তাকানোর সময় হয়না 
উপরের জগৎটা বন্দি হয়ে যায় করপোরেট চুক্তিতে ।

অভায়ারণ্যে পর্যটনে গেলে অপেক্ষার পর দেখা যায় 
বাঘ আসে, বাঘ গেলে  সিংহ আসে, সিংহের পর গন্ডার
 যে যায় কিংবা আসে হিংস্রতার হেরফের হয় না
 তবুও অভয়ারণ্যের  জন‍্যে বের করতে হয় উইক এন্ড ।

ভোট এলেই স্বপ্নেরা উড়ে আসে গাছের ডালে ও পাতায়
স্থবির গাছেরাও হওয়ায় দুলে ওঠে পাতাদের নাচায় 
ভোটের পরে ছিটেফোঁটা নিয়েও গাছেদের দিন গুজরান 
ছাপ্পা ভোটের কোনো ঝুঁকি নেই সবটাই বিজয় ।

লাইটপোস্ট থেকে নেমে আসে দাগি কালোবাজারি 
মই বেয়ে । সে মই বেয়ে আকাশে উঠে যায় তেলের দাম 
নিত্যদিন জিনিসের দাম বাড়লেও কর্পোরেট দুনিয়া 
নতুন শিবালিক পর্বত গড়ে ভঙ্গিল মানুষ নিয়ে
 দূরে যায় স্বপ্ন ও চাঁদ, ঠাকুমার শোলকের আঁচল ।