মানুষ তার জাত্যাভিমানটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে তার হৃদয় প্রসারিত হয় ৷ ভাষা কোন বিষয়ই নয় ৷ অন্তরের ভাষা সবারই এক ৷ এন আর সি কী করতে পারে ৷ কোনো ভাঙন ধরাতে পারে অন্তরমহলে? না পারে না? এমনটাই মনে হয়েছে আমাদের এ যাত্রায় ৷ মানুষ ৷ মানুষই আমার সন্ধান ৷ মানুষের ভেতরের মানুষটাকে কোনদিনই খুঁজে পেলামনা ৷ খুঁজি সেই মানুষকে ৷ যে দূর করে দিতে পারে মনুষ্যনির্মিত ব্যবধান ৷ 'সেই মানুষে খুঁজে বেড়াই দেশ বিদেশে' ৷ দেখাও হয়ে যায় পথে পথে ৷
উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর সন্নিহিত আলুয়াবাড়ি রোড থেকে ফেরার যাত্রা শুরুর কথা আটাশ তারিখ বিকেল চারটে কুড়িতে ৷ স্টেশনে এসে প্রথমেই শুনলাম অবধ-অসম এক্সপ্রেস দশ ঘন্টা লেট ৷ আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি ভীষণ ৷ আমাকে নিয়ে গোবিন্দ, গোপাল দৌড়াল নার্সিং হোমে ৷ সেখানে চিকিৎসায় পেলাম এক মহামানবিকতার পরিচয় ৷ সেটা অল্পকথায় বলার নয় ৷ তাই আমার হৃদয়নিসৃত সেই অনুভব যত্নসহযোগে তুলে ধরার আশায় এখন আর অবতারণা করছিনা ৷
সময় যতো এগুচ্ছে ট্রেনের বিলম্বের ততো বাড়ছে ৷ শেষ পর্যন্ত ঊনত্রিশ তারিখ সকাল দশটায় যখন ট্রেনের নাগাল পেলাম তখন সে উনিশ ঘন্টা পিছিয়ে চলছে ৷ আমরা পরবর্তী ট্রেনের সংযোগ পাব কী পাবনা দুশ্চিন্তার মধ্যে ট্রেনে চাপলাম ৷ দুপুরের মধ্যে এন জে পি পৌঁছুলাম ৷ খাওয়া দাওয়ার পর গোবিন্দ বাঙ্কের উপর শয়ান হল ৷ আমি,গোপাল, সঞ্জীব, অভিক নিচে ৷ এক অসমিয়া তরুণী আমাদের কামরায় এলেন ৷ যেহেতু আমরা চারজন নিচে ৷ ফাঁকা আসন দেখে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাকে বললেন, ইয়াত বহি পারিম? বললাম, বহক ৷ গোপাল সরে এসে আমার পাশে বসলেন ৷ মহিলাকে প্যাসেজের পাশে জায়গা ছেড়ে দিলেন ৷ কথায় কথায় জানা গেল তিনি দ্বাদশ স্তরের ভূগোলের শিক্ষিকা ৷ দু হাজার চৌদ্দতে টেট দিয়ে চাকরি পেয়েছেন ৷সপ্তম পে কমিশন বিন্যস্ত বেতন পাচ্ছেন ৷ নাম মইনু গগৈ ৷ বঙ্গাইগাঁওতে পোস্টেড ৷ তাঁর স্বামীও শিক্ষকতা করেন ৷ রঙ্গিয়াতে আছেন ৷ সেখানে যাচ্ছেন ৷ সাহিত্য ভালোবাসেন ৷ কথাবার্তার মধ্যে জানলাম আমাদের ত্রিপুরার অনেক খবর রাখেন ৷আমরা সপ্তম বঞ্চিত ৷ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী , বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী উভয়ের সম্বন্ধেই ভালো খোঁজ খবর রাখেন ৷ অসমের সমকাল, সংকট, সমাজ সব নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রয়েছে ৷ অসমের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষিক পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোকপাত করলেন ৷ যতক্ষণ ছিলেন কবিতা শুনলেন আমাদের ৷ বাংলাকবিতা হলেও তিনি শুনছেন ৷ আমার সঙ্গীরা বাংলায় কথা বলছেন ৷ তিনি অসমিয়া ও হিন্দিতে বলছেন ৷ আমার সঙ্গে অসমিয়াতে ৷ একবারের জন্যেও আমাদের মনে হয়নি আমরা ভিন ভাষাভাষী মানুষ কথা বলছি এতোক্ষণ ৷ আমাদের কারো কথা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ৷ একটা আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে যেন প্রতিবেশীর সুখদুখের কথা বলছি আমরা ৷
রঙ্গিয়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকার পর তরুণী উঠলেন ৷ বললেন, ময় যাম এতিয়া ৷ ভাল লাগিল আপুনালোকর লগতে ই হময়টো ৷ আমার সঙ্গীরা বিদায় জানালেন ৷ তরুণী আমাকে বললেন, আহক স্যর ৷ আমিও বললাম, কেনেকা সময়টো শেষ হল ৷
তরুণী মইনু গগৈ ট্রেন নেমে ছুটলেন তাঁর প্রিয়পুরুষের সান্নিধ্য লাভের তৃষ্ণায় ৷ সে প্রিয়জনটির নাম জানা হয়নি আমার ৷ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ৷ আমি চেয়ে আছি সেই তরুণীর গমনপথের দিকে ৷ যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি করে গেল ৷যার খোঁজে থাকি আমরা ৷ যার তৃষ্ণায় আমাদের যাপন ৷
Tuesday, May 29, 2018
চ ক্ষে আ মা র তৃ ষ্ণা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment