ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব- 2018 : একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনসমুহের চলমান সংকট ও সমস্যার পর্যালোচনা করার জন্যে, নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে একটা প্ল্যাটফরমের প্রয়োজন অনুভব হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে ৷ সেই লক্ষে প্রাথমিকভাবে বার্তা ছড়ানোর জন্যে গঠন করা হয় ছোটো একটা অস্থায়ী কমিটি ৷ এই কমিটি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোটোখাটো সভা করার মধ্য দিয়ে একটা উৎসব করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ৷ ভিতরে একটা বেদনাও ছিল ৷ উত্তর-পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের তিনসুকিয়ার অনুষ্ঠানে আগরতলায় পরবর্তী সম্মেলন করার সিদ্ধান্তে স্বীকৃতি দানের পর ত্রিপুরায় এসে পরবর্তী একবছরেও সেই অনুষ্ঠান করা যায়নি উদ্যোগের অভাবে, পরনির্ভরতায় ও অকারণে ৷ আসলে যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা উত্তর পূর্বাঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিনের মেজাজটাই ধরতে পারেননি ৷লিটল ম্যাগাজিনের সৈনিক যে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে লড়াই করেনা তা তাঁরা অনুমানই করতে পারেননি ৷ সমালোচনা হলেও বলতে হচ্ছে, দাদা কখন কাঁধ পেতে দেবেন সেই আশায় অপেক্ষা করতে করতে সুবর্ণ সময়টা হারিয়ে গেল ৷ সেই বেদনায়ও এই উৎসব করার তাগিদ বোধহয় রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের ৷ সিদ্ধান্ত হয় উৎসব করার ৷ চারিদিকে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের কাছে ৷ সোস্যাল মিডিয়ায়ও পোস্ট দিলেন গোবিন্দ ধর, সঞ্জীব দে, গোপাল দাস, অপাংশু দেবনাথ প্রমুখ কবি ও সম্পাদকবৃন্দ ৷ কিন্তু তেমন বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি ৷ একটা নীরব শীতলতা লক্ষ করা যায় ৷ ফলে উৎসবের প্রচেষ্টা সংকটের মুখে এসে দাঁড়ায় ৷ আর্থিক সাশ্রয় এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজনে কুমারঘাটকেই বেছে নেওয়া হয় সম্মেলনের স্থান হিসেবে ৷ দায়িত্ব বর্তায় রাজ্যের শক্তিমান সাহিত্যসংগঠক , কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধরের উপর ৷ স্রোত প্রকাশনার কর্ণধার গোবিন্দ ধরের এই ধরণের বড়ো অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ সহযোগী আছেন কবি ও সম্পাদক গোপাল দাস ৷ আর আছেন মাথার উপর ছাতা ধরে রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি ও সপ্তপর্ণা সাহিত্যপত্রের সম্পাদক নিয়তি রায়বর্মন, কবি ও পূর্বমেঘ সম্পাদক রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কবি দিলীপ দাস , কবি ও জলজ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক সন্তোষ রায়, উত্তরপূর্বের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক দেবব্রত দেব, কবি ও গল্পকার রণজিৎ রায় প্রমুখ ৷ এনারা যদি স্নেহের পরশ রাখেন তাহলে রাজ্যের যে কোনো প্রান্তেই সাহিত্য সংস্কৃতিতে ঝড় বইয়ে দেওয়া যায় ৷ তাঁরা প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহচর্য দিয়ে গেছেন ৷কাজেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিদীপ্ত নীরবতা লক্ষ করা গেলেও কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি ৷ গত দোসরা সেপ্টেম্বর বিশেষ আলোচনসভা ডাকা হল ৷ দেশের ও দেশের বাইরের অতিথিদের আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল ৷ আরো দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ৷ সাবেক সমগ্র উত্তর ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ৷ গোবিন্দ ধরের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই সাহিত্য-সংস্কৃতির মহীরুহের এক একটি ডালপালা ৷ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন সপরিবারে গোপাল দাস এবং রণজিৎ চক্রবর্তী ৷ সবাই মিলে তাঁরা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন ৷ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বাংলাদেশের অগ্রণী কথাসাহিত্যিকেরও দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি ৷
তেইশ সেপ্টেম্বর কুমারঘাটে হয়ে গেল 'ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব—2018 এতদিনের কী হয়! কী হয় উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে সেদিন ৷ কুমারঘাটের 'মাঙ্গলিক'এ আছড়ে পড়ে ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ঢেউ ৷ কবিরা সাহিত্যসেবীরা মঙ্লচিন্তাই তো করেন ৷ জগতের মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল, যাপনে মঙ্গল ৷ তাই এদিন মাঙ্গলিকে মিশেছিল সমস্ত শুভচেতনারা ৷ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, কোনো দাদার শ্রীপাদুকা ছাড়া, কোনো রাজপুরুষের কাঠিছোঁয়া ছাড়া শুধুমাত্র সংহতিচেতনার অবগাহনে এতোবড়ো একটা অনুষ্ঠান করা যায় তা এদিন দেখা গেল কুমারঘাটে ৷আর্থিক দৈন্যে হয়তো সম্মানিত অতিথিদের যথাযোগ্য মর্যাদায় আপ্যায়ণ করা যায়নি কিন্তু আন্তরিকতায় খাদ ছিলনা ৷ গোবিন্দ ধর, গোপাল দাস, রণজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁদের গৃহকে রীতিমতো অতিথিশালা বানিয়ে ফেলেন ৷
সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আসেন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, কবি জয়দুল হোসেন, প্রাবন্ধিক মানবর্ধন পাল ও কবি দেবব্রত সেন ৷
কথায়, কবিতায়, গানে, আলোচনায় টানটান ছিল অনুষ্ঠান ৷ লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে বিজ্ঞাপন নীতি নিয়ে দাবি ওঠে উৎসবে ৷ একশো জনেরও অধিক কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এই উৎসবে যোগ দেন ৷ ত্রিশটিরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উত্তরবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের কুড়িটির বেশি এক ফর্মার কবিতাসংকলন প্রকাশিত হয় ৷
অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে কবি হারাধন বৈরাগি ও ছড়াকার অমলকান্তি চন্দ জানালেন আগামী উৎসব জম্পুই পাহাড়ের পাদদেশে কাঞ্চনপুরে অনুষ্ঠিত হতে হবে ৷
এতোবড়ো সাফল্যের পরেও কথা থেকে যায় লিটল ম্যাগাজিনের পরিচয়জনিত যে দুর্বলতা, ছোটো করে রাখার যে প্রবণতা তাকে কাটিয়ে উঠতে হলে তাহলে আরো বেশি সাংগঠনিক শক্ত দরকার ৷ আরো বেশি নিবিড় হওয়া দরকার পারস্পরিক সম্পর্ক ৷ এই বার্তাই দেন উদ্বোধক কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস ৷
No comments:
Post a Comment