বাংলাভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রভাব
কর্জ্যেণিটক র সরকারী ভাষা কন্নড় ৷ বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে প্রচুর কন্নড় শব্দ রয়েছে ৷ সে বিষয়ে যাবার আগে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে ৷ ভারতবর্ষ বহু জাতিগোষ্ঠীর বাস ৷ তাদের ভাষা- সংষ্কৃতিতেও বিভিন্নতা রয়েছে ৷ ভারতের জাতিগোষ্ঠীর প্রধান দুটি ভাগ ৷ ইন্দো-আর্য ও দ্রাবিড় ৷আর্য জাতি উত্তর ভারতে দ্রাবিড়রা দক্ষিণ ভারতে বসবাস করেন ৷ এই দ্রাবিড়রা ভারতের প্রাচীনতম অধিবাসী ৷ খ্রি. পূ.2500 শতকে এই জাতি সিন্ধু নদের উপত্যকায় এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন ৷ আর্যরা ভারতবর্ষে পা রাখার আগে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে দ্রাবিড়দের বসতি ছিল ৷ পরবর্তীকালে আর্যদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে দ্রাবিড়গণ ক্রমশ দক্ষিণে সরে যান ৷ দ্রাবিড় জাতির ভাষার নামও দ্রাবিড় ৷ দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় গোত্রের প্রধান চারটি ভাষা হলো - কন্নড়, মালয়ালি, তামিল ও তেলেগু ৷
বাংলায় একসময় এই দ্রাবিড় জাতিরও বাস ছিলো ৷ বাংলার প্রাচীন অধিবাসীরা হলো অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রোলিয়রা ৷ এরা এবং তাদের সমসাময়িক মঙ্গোলয়েড গোত্রের কিরাতরাও ছিল সে সময় ৷ আর্যরা তাদের সাহিত্যে এই দুই জাতিকে হীনার্থে নিষাদ নামে পরিচিত করে ৷ অস্ট্রিক ও কিরাতদের পরে বাংল দেশে আসেন দ্রাবিড়রা ৷ প্রাচীন বাংলায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিশ্রণে যে সংকর জাতির সৃষ্টি হয়েছিলো তারাই বাঙালি ৷ বালার ভাষা-সংষ্কৃতি-ধর্মে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর গভীর প্রভাব রয়েছে ৷
বাংলাভাষায় অস্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দও বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ৷একসময়ে সারা উপমহাদেশে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যের ফলেই বাংলা ভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রবেশ ঘটে ৷দ্রাবিড় ভাষার কাল (সময়) ,কলা, পুষ্প, মুকুল, পূজা, গণ, কোণ, নীল, ফল, উলু, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, কুন্ড, খড়্গ, দন্ড, বিল, ময়ূর, কাক কাজল, কোদাল, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘুণ, কুটুম্ব, ডালিম্ব, নীল, মীন ইত্যাদি ৷ বাংলার বগুড়া, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ইত্যাদি ড়া, গুড়ি-যুক্ত স্থাননামে দ্রাবিড় প্রভাব রয়েছে ৷ এছাড়া উর, পুর, খিল তালক, পাঠক এগুলোও দ্রাবিড় শব্দ প্রভাবিত ৷ বাংলা ব্যাকরণের অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ভিতের উপর গড়ে উঠেছে ৷
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বাংলার উপরে দ্রাবিড় প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে রয়েছে ৷ বাংলার দেবাদিদেব মহাদেব তো দ্রাবিড় পশুপতিনাথ শিব ৷ আর শৈবসাধনা হলো যোগসাধনা ৷ দ্রাবিড়দের এই সাধনপদ্ধতি বাংলার আধ্যাত্মিক জীবনের গভীরে প্রোথিত ৷ এভাবেই দ্রাবিড় অনার্য দেবদেবীদের মধ্যে চান্ডী(চন্ডী), মঞ্চাম্মা (মনসা) প্রভৃতি এবং উমা, বিষ্ণু, জগন্নাথ,বাসুদেব, শক্তি, শীতলা, বৃক্ষপূজা, যগলমূর্তি পূজার প্রচলন এসেছে ৷
দ্রাবিড়রা নগরজীবনের পাশাপাশি কৃষিজীবনেও পারদর্শী ছিলেন ৷ সংষ্কৃত ব্রীহি ও তন্ডুল অর্থে ধান্য বোঝায় ৷ এদুটিই দ্রাবিড় ভাষা ৷ এতেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে দ্রাবিড়রা প্রাচীন ধান চাষও করতেন ৷ এককথায় দ্রাবিড়রা বহুভাবেই প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷