Thursday, August 31, 2023

রাজন্যত্রিপুরায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরা

রাজন্যত্রিপুরায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরা 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় ধর্ম মানিকের ( ১৭১৪–১৭২৯ ) রাজত্বকালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিনের (১৭২৭–১৭৩৯ ) সঙ্গে যুদ্ধে ত্রিপুরার রাজার অধীনস্থ সমতলক্ষেত্রের একটা অংশ হাতছাড়া হয়ে যায় । সুজাউদ্দিন এই সমতলক্ষেত্রের নাম  দেন রোশনাবাদ । মানে 'আলোর ভূমি' ।  পরে এটি 'চাকলা রোশনাবাদ' নামে পরিচিত হয় । কিছুদিন পর রাজা দ্বিতীয় ধর্মমানিক্য নবাব সুজাউদ্দিনের কাছ থেকে বার্ষিক ৫০ হাজার টাকার রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি ফিরে পান । পরবর্তী সময়ে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের কালে চাকলা রোশনাবাদের উপর ত্রিপুরার রাজার জমিদারির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় । আর ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য অংশ অর্থাৎ পার্বত্য ত্রিপুরা ছিল ত্রিপুরার রাজার স্বাধীনভূমি বা স্বাধীন ত্রিপুরা । ফলে সারা ভারতবর্ষব্যাপী যখন স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করতে থাকে । সেদিনও ত্রিপুরা রাজ্য ছিল স্বাধীন । ফলে এ রাজ্যের প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না ।  কিন্তু  ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী এবং ত্রিপুরার রাজার জমিদারি অঞ্চল হওয়ার সুবাদে ইংরেজ অধিকৃত চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলে এবং তদানীন্তন পূর্ববাংলায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাব পরোক্ষভাবে ত্রিপুরায় পড়েছিল ।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ দেশের প্রথম আন্দোলন হল সিপাহী বিদ্রোহ । ১৯শে মার্চ ১৮৫৭ সালে সিপাহি মঙ্গল পান্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে । মঙ্গল পান্ডের সেই বিদ্রোহের আত্মদানের প্রায় আট মাস পরে পূর্ববঙ্গের বন্দর শহর চট্টগ্রামেও এরূপ বিদ্রোহ দেখা গিয়েছিল । চট্টগ্রামের ঘটনার নায়ক ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খান । তিনি ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাত ন'টা নাগাদ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ বিদ্রোহ করেন । ১৯ শে নভেম্বর ৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের প্রায় ৩০০ জন সৈন্য পিলখানা থেকে তিনটি হাতি, গোলাবারুদ ও ২ লক্ষ ৭৮ হাজার ২৬৭ টাকা কোষাগার থেকে নিয়ে অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন । বিদ্রোহীরা স্বাধীন ত্রিপুরায় নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । হাবিলদার রজব আলী খান বিদ্রোহী সিপাহীদের পরিচালনার দায়িত্ব নেন । চট্টগ্রাম শহরে সেসময় ক্যাপ্টেন P H K Dewool ছিলেন ৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের প্রধান । তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ জানিয়ে ১৮ নভেম্বরের এক সপ্তাহ পরে ২৪ নভেম্বর একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J Hearsey KCB-র কাছে যিনি প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন । সেই দুর্লভ চিঠিতে আছে–'I have been informed by a native named Thakur Bux formarly jemadar of Chittagong provincial battalion, whom the mutineerse forced to go some distance with them, that the pay-havildar of number-4 company, named Rujub Ali Khan, has assumed command of the detachment, which we hear, has crossed the feni river and entered the territories of the Rajah of Tiperah.' । (Orlich Leopold Von ( 1858 )-The Mutiny in India : Its Origin and its Results, T. and W. Boone, 29, New Bond street ) । তিনি ওই পত্রে উল্লেখ করেন যে, বিদ্রোহীরা ফেনীনদী পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের দিকে চলে গেছে । ফেনীনদী পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত বোঝালে সে তো সাব্রুমের বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চলকেই বোঝায় । অর্থাৎ এই বিদ্রোহীরা রাজন্য ত্রিপুরার সাব্রুমের উপর দিয়েই সিলেট হয়ে মনিপুরের দিকে পলায়ন করেছিলেন । এছাড়া সে সময়ের অন্যান্য সরকারি নথিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাওয়ার জন্য বিদ্রোহী সিপাহীরা সীতাকুণ্ড-ফটিকছড়ি-রামগড় হয়ে ফেনীনদী অতিক্রম করেছিলেন । ( চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান-প্রথম খন্ড ) ।

ত্রিপুরারাজ্যের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দী বহু রাজনৈতিক ঘটনায় বর্ণময় হয়ে আছে । ১৯০৫- ১৯০৮ সালের স্বদেশী আন্দোলন এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ ত্রিপুরায়ও এসে লেগেছিল । ১৬ আগস্ট ১৯০৫ সালে পার্বত্য ত্রিপুরারাজ্যেও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়েছিল ।  সেদিন ত্রিপুরার হিন্দু ও মুসলিম জনগণ একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে বন্দেমাতরম ধ্বনি সহযোগে মিছিল করেছিলেন । ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি এবং প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু এ রাজ্যের জনগণের মধ্যেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল । সেদিন উমাকান্ত একাডেমির শিক্ষার্থীরা বন্দেমাতরম সংগীত গাইতে গাইতে পতাকা নিয়ে আগরতলা শহরের প্রধান রাজপথগুলি পরিক্রমা করেছিলেন । গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. জগদীশ গণচৌধুরী লিখেছেন–

'... বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বঙ্গভঙ্গ করার ব্রিটিশ চক্রান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিল । স্বদেশী গ্রহণ ও বিলাতি বর্জন আন্দোলন ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রূপ নিয়াছিল । একাধারে কবি, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন চারণকবি যজ্ঞেশ্বর দে অর্থাৎ মুকুন্দ দাস ( ১৮৭৮–১৯৩৪ ) । তিনি গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগাইলেন । মুকুন্দ দাস ত্রিপুরাবাসী ছিলেন না ; কিন্তু তিনি সমতল ত্রিপুরাতে আসিয়া স্বদেশী গান গাইতেন । তিনি একবার আগরতলায় আসিয়াছিলেন । তাঁহার গান শুনিয়া মহিলারা বিলাতি রেশমি চুড়ি প্রভৃতি অলংকার ফেলিয়া দিত । রক্ষাবন্ধন উৎসব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হইত আগরতলা ও উদয়পুরে । রাধাকিশোর যাদবপুরে স্থাপিত বঙ্গীয় কারিগরি বিদ্যালয় অর্থ দান করেন ।' ( ত্রিপুরার ইতিহাস ড. জগদীশ গণ
চৌধুরী পৃষ্ঠা ২৮১) ।

সেকালে উমাকান্ত একাডেমির পড়াশোনা শেষ করে যে সমস্ত ছাত্ররা কুমিল্লায় পড়তে যেতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন । এ প্রসঙ্গে প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত তাঁর 'স্মৃতির আলো' বইতে লেখেন– 'নারায়ণ ব্যানার্জি, নিলু গাঙ্গুলি ছিলেন  সেরকম ছাত্র । তাঁদের মাধ্যমে আগরতলার সাথে কুমিল্লার যোগাযোগ ঘটে এবং সেটা ছিল বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রথম যুগ' । ঢাকা ও বরিশালের অনুশীলন সমিতির সদস্য নিশিকান্ত ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিপুরায়ও অনুশীলন সমিতির শাখা গঠিত হয়েছিল । তবে এই গুপ্তসমিতি ত্রিপুরাতে শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, সমাজসেবামূলক কাজ এবং স্বদেশীদ্রব্য ব্যবহারের প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । ধীরে ধীরে আগরতলায় অনুশীলন সমিতি তার কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে । ১৯২৭ সালে গড়ে ওঠে ছাত্র সংঘ । দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত লিখেছেন–

 'ছাত্র সংঘ গড়ে উঠেছিল নীলু গাঙ্গুলির বাড়িতে । কিছুদিন চলার পর ছাত্র সংঘ ভেঙে যায় এবং জন্ম নেয় ভ্রাতৃ সংঘ । পুরাতন কর্নেল বাড়িতে মুখ্যত শচীন্দ্রলাল সিংহ ও উমেশলাল সিংহের উদ্যোগে  ভ্রাতৃসংঘ হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত সংঘ । আগরতলার অনেক ছাত্র পূর্বপাড়া মধ্যপাড়া থেকে দলে দলে এখানে এসে লাঠিখেলা, ছুরিখেলা, ও শরীরচর্চা করত । এখানেই আসে সুখময় সেনগুপ্ত ( পরবর্তী সময়  ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ), আশু মুখার্জি, তড়িৎ মোহন দাশগুপ্ত এবং আরো অনেকে । ১৯২৮ সাল নাগাদ ভ্রাতৃ সংঘ তার প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় আগরতলার সমাজ জীবনে ( স্মৃতির আলো–দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত ) ।

সেই সময়ে ব্রিটিশবিরোধী নানা গোপন তৎপরতা ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়ে । বাংলার বিপ্লবীরা সেসময় শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ত্রিপুরায় আসতেন না । পার্বত্য ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্য হওয়ায় এখানে ইংরেজ পুলিশের প্রবেশাধিকার ছিল না । সর্বোপরি ত্রিপুরার অরণ্যের গভীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে বিপ্লবীরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন । ত্রিপুরায় অনুশীলন সমিতির কর্মকান্ড সম্বন্ধে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন–

For the purpose of training of its members the Anusilan had two farms at belonia and Udaipur in hill Tiperah.  these where outwordly and in part really agriculture farms but they served mainly as centres for they were given training.  During daytime the members worked as labourer in the field but at night they are given training in the use of different kinds of arms and practiced shooting in the neighbouring hills.  They had to work hard and lived under Strict military discipline ( History of Freedom Movement–R C Majumdar, vol– ii, 1975 page–286 ).

বাংলার বিপ্লবীরা ১৯১১ সালে বিলোনিয়ার বোকাফাতে এবং মাইছরাতে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন । তাঁদের কৃষিখামারটি ছিল মাইছরাতে । বিপ্লবী সতীশচন্দ্র বসুর জবানবন্দী অনুযায়ী জানা যায় যে– বিপ্লবী নরেন সেন, বরদাকান্ত নাগ, সতীশ চন্দ্র বসু ও অন্যান্য বিপ্লবীদের উদ্যোগে বিলোনিয়ায় কৃষিখামারটি স্থাপন করা হয়েছিল । ( ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, কলকাতা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৮৭-৮৮ ) । এসময় বিলোনিয়ায় অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড সারদা চক্রবর্তী এবং তাঁর সহযোগী পুলিনবিহারী গুপ্তের নেতৃত্বে পরিচালিত হত । কিন্তু সারদা চক্রবর্তী পুলিশের গুপ্তচরবৃত্তি করতেন এবং সমিতির গোপন কর্মকাণ্ডের তথ্যাদি ইংরেজ পুলিশের সাথে হস্তান্তর করতেন । ফলে একসময় ইংরেজ পুলিশরা বিপ্লবীদের ধরপাকড় শুরু করে । বিপ্লবীদের কেউ কেউ ধরা পড়েন । আবার কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন । বিপ্লবীরা যখন জানতে পারেন যে, তাঁদের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড ফাঁস হওয়ার পেছনে তাদেরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী সারদা চক্রবর্তীর হাত রয়েছে । তখন বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয় । বিপ্লবীরা এরপর এখান থেকে তাদের কর্মকাণ্ড সরিয়ে নেন ।

 ১৯১২ সালে উদয়পুরকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি গড়ে ওঠে । এখানেও তদানীন্তন নোয়াখালি জেলার লামচর নিবাসী দ্বারিকা রায়ের খামারবাড়িতে বিপ্লবীদের কৃষিখামার গড়ে ওঠে । এই কৃষিখামারটি গড়ে তোলার পেছনে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ( ত্রৈলোক্য মহারাজ ) ও বিপ্লবী প্রতুল গাঙ্গুলি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । তবে এই কৃষিখামারটি স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে মতান্তর রয়েছে । 'ত্রিপুরার শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক রঞ্জিত পালের মতে, এই কৃষি খামাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরেকজন বিপ্লবী কুমিল্লা অনুশীলন সমিতির সদস্য রঞ্জন নাথ রায় । এই কৃষি খামারের মূল বাড়িটির অবস্থান ছিল উদয়পুরের মাতাবাড়ি সন্নিকটে ধোপাইছরির বনের মধ্যে । মূলত, কুমিল্লার ও সমতল ত্রিপুরার ছাত্রদের এখানে পাঠানো হত । তারা খালি পায়ে কৃষকের পোষাক পরে ৩২ মাইল পায়ে হেঁটে কুমিল্লা শহর থেকে এখানে পৌঁছাতেন । বিলোনিয়ার খামার বাড়ির মতই বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটি একটি কৃষিক্ষেত্র মনে হলেও এখানে গোপনে বন্দুক ও পিস্তল তৈরি করা হত । এছাড়া বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র তৈরির কারখানা ও ছিল এটি । স্থানীয় মানুষজনেরা এই খামারটিতে কাজকর্ম করত এবং তাদের রুজিরোজগারের উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছিল এই খামারকে । তারা সারাবছর এখানে ধান, ডালশস্য, শাকসবজি ও আখের চাষে বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করত । ফলে এই খামারটি ত্রিপুরারাজ্যের এবং ব্রিটিশ পুলিশের দৃষ্টিগোচর হয়নি ( জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম–ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী-কলকাতা পৃষ্ঠা-১৪ ) ।

পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে আরও দুই একটি স্থানে এরকম কৃষি খামার গঠন করে গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করা হত । ১৯১২ সালের দিকে কৈলাশহরের মূর্তিছরা টি এস্টেট এলাকায়ও একটি কৃষিখামার স্থাপিত হয়েছিল । এই কৃষি খামারটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন মাধবলাল চ্যাটার্জি ও গিরিজা দত্তসহ সেসময়ের অন্যান্য বিপ্লবীরা । ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার নিজেদের করায়ত্ব করে নিয়েছিলেন । এই ঘটনাটি সে সময়ে নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত তরুণদের মনে প্রেরণা জুগিয়েছিল । চট্টগ্রামের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের সঙ্গে ত্রিপুরার দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী উমেশ লাল সিংহ ও শচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল । এই দুজনের সহযোগিতায় অনন্ত সিংহ ত্রিপুরার রাজার অস্ত্রাগার থেকে একটি রাইফেল ও বেশ কিছু পিস্তল ও গোলাবারুদ চুরি করেছিলেন । ১৯৩০ সালে অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময় ব্যবহৃত একটি রাইফেল ইংরেজরা ত্রিপুরার রাজ সরকারের বলে সনাক্ত করে । 

১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলার উমাকান্ত একাডেমি এবং তুলসীবতী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আগরতলায় তাদের স্কুলের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল । এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ত্রিপুরার রাজসরকার পূর্ণিমা মুখার্জি, সরস্বতী বসাক, ফটিকসেন, বিজয় মুখার্জি সহ আরো কয়েকজনকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে এপ্রিল এক ঘোষণার দ্বারা শচীন্দ্রলাল সিংহকে এক বছরের জন্য রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন । ঘোষণাটি ছিল–

Where as it appears that ex detenue Sachindralal Singha son of Dinadayal Singha of Agartala, has for sometime past been making seditious and inflammatory speeces in different parts of the state which are calculated to promote this satisfaction, hatred and ill will among the people against the government of the state and where as it is hereby ordered that the said Sachindralal Singha be externed from the state for a period of one year for the present. ( ত্রিপুরা স্টেট গেজেট সংকলন–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা. ৬৫-৬৬ ) । জানা যায় যে, রাজাদেশে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হলেও শচীন্দ্রলাল সিংহ সে সময়ে চট্টগ্রামের ও রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতেন । এ সময়ে তিনি সাব্রুমের প্রাচীন অধিবাসী প্রয়াত নিতাই মজুমদারের পিতৃদেব অম্বিকা মজুমদারের বাড়িতে প্রায়ই ফেনীনদী পেরিয়ে ওপার থেকে চলে আসতেন । পরবর্তী সময়েও শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে এই পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক ছিল ।

চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির বিপ্লবীদের অধিকাংশের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্যসেনের যোগাযোগ ছিল । দেশভাগের পরে তাঁদের অনেকে সাব্রুমে ও বিলোনিয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন । বিলোনিয়ায় বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ বিনোদ দত্ত, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী ( হারান দত্ত, যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে রয়েছে ), অমরকৃষ্ণ সরকার, রেবতী পাল, অনাদিরঞ্জন চৌধুরী প্রমুখগণ । সাব্রুমে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে পাঁচভাই হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক, তেজেন্দ্র ভৌমিক,খগেন্দ্র ভৌমিকসহ আশুতোষ দে, বিভূতি চক্রবর্তী, সুধীর চক্রবর্তী, মনীন্দ্র ঢালী, যোগেশ চক্রবর্তী প্রমুখগণ বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন । ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে তাঁদের কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে সাব্রুমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন করতেন । মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী বিপ্লবীদের একটা অংশ  এবং পূর্বোক্ত ভৌমিক পরিবারের পাঁচভাই সাব্রুমের পশ্চিম দিকে হার্বাতলী-বেতাগার গভীর অরণ্যে কৃষিখামার গড়ে তুলেছিলেন । এখানেও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় দিনের বেলায় কৃষি কাজ করা হত । স্থানীয় মানুষেরা এখানে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন । রাত্রিবেলা বিপ্লবীরা এখানে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন । বিপ্লবীরা  বেতাগার জঙ্গলে একটি চানমারিও গড়ে তুলেছিলেন । ভৌমিকদের পাঁচ সহোদর ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে প্রত্যেকেই কয়েকবছর করে কঠোর সাজা ভোগ করেছিলেন । ভারতবিভাগের পর এই ভ্রাতৃবর্গের মধ্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক ও কিরণ ভৌমিক এপাড়ে চলে এসে বিপ্লবীদের সৃষ্ট খামারবাড়িতে স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করেন । তেজেন্দ্র ভৌমিক ও খগেন্দ্র ভৌমিক কিছুদিন অবস্থান করে আবার দেশের বাড়িতে ফিরে যান । যাঁরা এদেশে রয়ে গেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই স্বধীনতা সংগ্রামীর সম্মান, পেনশন ও তাম্রপত্র পেয়েছেন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অ্শগ্রহণকারী এই নীরব বিপ্লবীদের কথা ইতিহাসে আজও তেমনভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি । সেই পরিবারের উত্তরসূরী শান্তিপ্রিয় ভৌমিক স্বাধীনতাসংগ্রামীর বহমান রক্তধারা নিয়ে রাজ্যরাজনীতির সঙ্গে সসম্মানে জড়িত । সজ্জন ও স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতীক এই যুবক ।

বিলোনিয়ার কিরীট বিক্রম ইনস্টিটিউশন এর ছাত্ররা সে সময় নোয়াখালি জেলার কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন । তাঁরা ১৯৪২-৪৩ সালে বিলোনিয়া ও অন্যত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । সেসময়ের বিলোনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগাবাবু শান্তিময় বর্ধনের লেখা এক গোপন সরকারি চিঠি থেকে জানা যায় যে, বিলোনিয়া হাই স্কুলের ছাত্ররা নোয়াখালির ছাত্রদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল এবং তারা ব্রিটিশ অধিকৃত জেলায় ও রাজন্যশাসিত ত্রিপুরায় বড় ধরনের আন্দোলন সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল । তারা উদয়পুর, আগরতলা এবং কৈলাশহরের ছাত্রদের কাছেও এই ধরনের আন্দোলন শুরু করার জন্য যৌথ আবেদন জানিয়েছিল ( Reports B-3, S-9, Tripura Assembly records ) ।

রাজন্য ত্রিপুরার অভ্যন্তর থেকে পরিচালিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে সময়ে ত্রিপুরারাজ্যের সন্নিহিত মহারাজার জমিদারি চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের মধ্যে কুমিল্লা নোয়াখালি ও পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিলেন । সেকারণেই দক্ষিণ ত্রিপুরা বলে চিহ্নিত না হলেও ত্রিপুরার দক্ষিণ অঞ্চলে তার প্রভাব বেশি মাত্রায় পড়েছিল । বিশেষত, দক্ষিণ ত্রিপুরা অঞ্চল ছিল অরণ্যসংকুল এবং বিরল জনবসতিপূর্ণ যা বিপ্লবীদের পক্ষে অনেকটা সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । এছাড়া আইনগত ও ভৌগোলিক উভয় দিক দিয়েই ত্রিপুরা রাজ্য ছিল তাদের কাছে কম ঝুঁকিপূর্ণ ।  ব্রিটিশ পুলিশ ইচ্ছা করলে রাজ্যে প্রবেশ করে কোন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করতে পারত না । আর ত্রিপুরার দক্ষিণ প্রান্তের খবর অনেক সময় ত্রিপুরার রাজসরকারের কাছে গিয়ে পৌঁছাত না । বিপ্লবীরা ও এখানে অবস্থানকালে সবসময় সতর্ক থাকতেন যাতে তাঁরা স্থানীয় জনসাধারণ বা রাজতন্ত্রের সাথে অনুরূপ ঝামেলায় বা সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা আজও অনালোকিত ও অনালোচিত রয়ে গেছে । আর সময় থাকতে তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করলে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে ।

Tuesday, August 29, 2023

সূর্যাস্তকাল

সূর্যাস্তকাল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সূর্যাস্ত নিপুণ হলে সুদর্শন হয় কোন সন্ধ্যাতারা
আকাশের অন্ধকার বিস্তারে তোমার মুখ ভাসে না ।
ভালোবাসব বলে পরিপাটি হৃদয় রেখেছি তাই
তুমি কি ঘোর কাপালিক নাকি অন্য কোনো তন্ত্রে
তোমার বিছানো আঁচলে যানজট গড়ে রেখেছে বলো ?

হঠাৎ কুয়াশাভোর এলে শরতকালের কথা মনে পড়ে
যে ভোরে আমার মা নক্সিকরা চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে
বাপের বাড়ি নাইওর যাবেন বলে ঘাটে বসে থাকতেন
সম্পর্কিত দেওর মাঝির অপেক্ষায় ।  জারুল গাছের ছায়ায় শীতল হয়ে পানের খিলি বানাতেন ।

এখন তোমার আকাশে সেসব আলপনা ভাসে না আর
এখন চন্দ্রকথা আর চন্দ্রাবলি ছেড়ে চলে গেছে 
শোলোকের মামাবাড়ির চেনা সেইসব চিত্রকথা ।
ঘাট পেরুবার সেই মাতৃমঙ্গল শাঁখাভরা হাত নেই আর
তুমি আমি এখন অনেক অনেক বড়ো হয়ে গেছি

Saturday, August 19, 2023

আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য ( ১৯২৩- ১৯৪৭ )

আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য (১৯২৩–১৯৪৭ )

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য ও যুবরানি অরুন্ধতী দেবীর পুত্র বীরবিক্রম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ২৫ নভেম্বর বীরেন্দ্রকিশোরের রাজ্যভিষেক হয় । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর মাত্র কুড়িবছর বয়সে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট পাশ্চাত্যমতে বীরবিক্রমের  রাজ্যাভিষেক হয় । তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে তদানীন্তন বাংলার গভর্নর জ্যাকশন সাহেব উপস্থিত ছিলেন । ১২৫ টি স্বর্ণমুদ্রা ভারত সরকারের
 প্রতিনিধি গভর্নরকে প্রদান করা হয় এবং গভর্নর একটি মুক্তার হার উপহারস্বরূপ প্রদান করেন । গভর্নর রাজাকে সিংহাসনে বসাবার কালে ১৯ বার তোপধ্বনি করা হয় ।

মহারাজা বীরবিক্রমের রাজত্বেই ত্রিপুরা রাজ্যের উন্নয়নের নবযুগের সূচনা হয় । ত্রিপুরারাজ্যের প্রশাসনিক সংস্কার, শিক্ষার সম্প্রসারণ, শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহারাজা বীরবিক্রম একের পর এক জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ করতে থাকেন । তিনি গ্রামস্তরে গ্রামমন্ডলীও স্থাপন করেছিলেন । এই গ্রাম মন্ডলীর হাতে গ্রামের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । পার্বত্য প্রজাদের জন্য ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১১ হাজার দ্রোণ জমি তিনি সংরক্ষণের আওতায় আনেন । পরে প্রয়োজন বোধ হলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আরও ১৯৫০ বর্গমাইল এলাকা সংরক্ষণের আওতায় আনেন । এ সময়ে বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে । ত্রিপুরাতেও এই ধরনের পরিস্থিতির সম্ভাবনা হতে পারে মনে করে মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বিশাল শস্যভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন । সেসময়ে আগরতলাতে কেন্দ্রীয় গুদাম ও মহকুমাতে ছোটো ছোটো গুদাম গড়া হয়েছিল । এইজন্য খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকা । চরম অভাবের সময় কেনা দামে এই খাদ্যশস্য বন্টন করা হয়েছিল ।

তাঁর সময়েই ত্রিপুরা রাজ্যের স্বদেশী আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছিল । অনুশীলন সমিতির সদস্যরা ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে আশ্রয় নিতেন । উদয়পুর বিলোনিয়া দুটি বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল । সাব্রুমের হার্বাতলিতেও ছিল একটি গোপন ঘাঁটি । এখানে গোপন অবস্থান নিয়ে বিপ্লবীরা নোয়াখালি, চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাঁদের সংগ্রামী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন ।

বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য তাঁর পূর্বসূরীদের মত শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিরও একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক । ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ সকালবেলা উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের দরবার হলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন করা হয় । সেই অনুষ্ঠানেই এক বিশেষ রোবকারি বা ঘোষণাপত্রে ত্রিপুরাধিপতি বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর বিশ্বকবিকে 'ভারত ভাস্কর' উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । এরপর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ৩০শে বৈশাখ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে এক গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বকবির হাতে ত্রিপুরার মহারাজা প্রদত্ত 'ভারত ভাস্কর' উপাধি সনদ তুলে দেওয়া হয় । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তাঁকে হুইলচেয়ারে করে উত্তরায়ণে সভাস্থলে নিয়ে আসা হয়েছিল । সে বছরেই বাইশে শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ ঘটে ।

১৯৪৭ সালের ১৭ই মে ( ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৭ ) রাত্রি ৮ টা ৪০ মিনিটে মহারাজা বীরবিক্রমকিশোরের মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । তাঁর মৃত্যুসংবাদ পরদিন সাব্রুমে পৌঁছায় । সাব্রুমের তদানীন্তন প্রবীণ নাগরিক প্রয়াত প্রমোদরঞ্জন দেওয়ান বহু বছর আগে এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, সে সময়ে সাব্রুমে রেডিও বা বেতার যোগাযোগ ছিল না । সরকারি নির্দেশনামা, কাগজপত্র, চিঠিপত্র ইত্যাদি ডাকহরকরার মাধ্যমে আমলিঘাট থেকে সাব্রুমে আসত । মহারাজা বীরবিক্রমের মৃত্যুসংবাদ সেসময়ে রেডিও মারফত সম্প্রচারিত হয়েছিল । সে সংবাদটি শুনেছিলেন তখনকার রামগড় চা বাগানের ম্যানেজার । তখন সে অঞ্চল ছিল ব্রিটিশ ভারতের অধীন । তিনি পরদিন সকালে ফেনীনদীতে স্নান করার সময় এপারের লোকজনদের জানান যে, ত্রিপুরার মহারাজা আগের রাতে প্রয়াত হয়েছেন । সে সংবাদ সাব্রুম থানায় এসে পৌঁছালে তখন থানার কর্মকর্তারা থানার পতাকা সেসময়ের রাজলাঞ্ছনটি অর্ধনমিত করেন ।

Tuesday, August 15, 2023

সমীর ধর

 আমি বান্ধব সমীর ধরকে চিনি সাতের দশক থেকে । কলেজে একসাথে পড়তে পড়তে জাদুকরের সহকারী হিসেবে, নাটকের সহ অভিনেতা হিসেবে  তাঁর সান্নিধ্যে এসেছি । সুর এই মানুষটার রক্তস্রোতে বহমান । প্রথমদিকে তিনি তবলার চর্চা করতেন । বিলোনিয়া বিদ্যাপীঠের পাশে তাঁদের বাসায় সে সময় জমাট আড্ডা বসত সাহিত্য-সংস্কৃতির আর সঙ্গে । প্রতিদিন ঘরের জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করে এই আড্ডা । পরিবারের কেউই বিরক্ত হতেন না মোটেই । তিয়াত্তর-চুয়াত্তরের দিকে বিলোনিয়া এক নম্বর টিলায় এক সাহিত্যমেলা হয় হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, ভূপাল সিনহা,কৃষ্ণকুসুম পাল, সুবোধ কংসবনিকের উদ্যোগে । স্থাপত্যকর্ম প্রদর্শনী করেছিল শিবপ্রসাদ চৌধুরী । সেইসময়ে একদিন সকালবেলা কোনো একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল সামনের ক্লাবঘরে । এইসময় সমীর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কিছু গুঞ্জন শুনে ঢুকে পড়লেন ক্লাবঘরে । সবাই হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে টুকটাক গান বাজনা করছেন । সমীর ধর এসে পড়ায় সবাই তাঁকে তবলা বাজানোর জন্যে অনুরোধ করল । সমীর ধর তবলায় হাত লাগালেন কিছুক্ষণ । তারপর হারমোনিয়াম নিয়ে অসাধারণ এক নগমা শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে । এখানেই শেষ নয় । পাশে কে একজনের একটা হাওয়াইয়ান গিটার ছিল । ততক্ষণে সমীর সেটা হাতে তুলে নিয়েছেন । দেখি এটা একটু । কোনোদিন তারযন্ত্র বাজাইনি । বলে গিটারের মালিক শিল্পীর কাছ থেকে স্টিল বারটা ধরা ও তারগুলোর স্কেল বুজে নিয়ে আস্তে আস্তে টুং টাং করতে লাগলেন । সেকি! ধীরে ধীরে একটা পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর যেন রূপ পাচ্ছে । কিছুক্ষণের মধ্যে 'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' গানটি বাজিয়ে শুনিয়ে দিলেন । এই হলেন সমীর ধর । সাহিত্যসংস্কৃতির অঙ্গনের এমন বহুমুখী প্রতিভার সান্নিধ্য পেয়ে আমি গর্বিত ।

হাড্ডিসার

হাড্ডি নরম থাকতে থাকতে কাব্যি করো ভাই, 
হাড্ডি শক্ত হলে পরে কাব্যে ভরসা নাই ।
এক অশোকে নিদান দিল আর অশোকে ভাবে
জোঁকেরাই সারাজীবন কাব্য লিখবে তবে–
জোঁকের দল কাব্য করলে মন্দ হবে না,
রক্ত চোষা বন্ধ হবে নেইকো ভাবনা ।

Saturday, August 12, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীপূজার ধারাবাহিকতা

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীপূজার ধারাবাহিকতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


আদিম সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক । যে সময়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন ও বিধিনিষেধ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি, সে সময়ে মাতৃপরিচয়ই ছিল নির্ধারিত । প্রাকৃতিক কারণে মাতৃপরিচয় তখন জরুরি ছিল । জন্মদান, শিশুপালন থেকে শুরু করে কৃষিকর্ম ইত্যাদিতে মাতৃদায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই কৌমজীবনে মাতৃতন্ত্রের প্রাধান্য পায় বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন । যেহেতু গোষ্ঠীজীবনে মায়ের ভূমিকা প্রধান বলে বিবেচিত হয় সে কারণে প্রাচীনতম যে ধর্মবিশ্বাসটি তৈরি হয়েছিল সেখানেও মাতৃপ্রাধান্যই পরিলক্ষিত হয় । কৃষিকেন্দ্রিক জীবন ধারাতেও লক্ষ্য করা যায়, ভূমির উর্বরতার সঙ্গে শস্য উৎপাদনের বিষয়টি জড়িত । নারী ও ধরিত্রী উৎপাদনক্ষেত্রে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় । ফলে কৃষিকেন্দ্রিক জীবনকে কেন্দ্র করে যে ধর্মচেতনার সৃষ্টি হয় তার মধ্যে একটা দেবীভাবনা নিহিত থাকে । এই ধর্মধারাকেই বলা হয় মাতৃকা কৃষ্টি । 

মানবসভ্যতায় প্রাচীন ধর্মধারার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাতৃকাপূজার একটা ধারা প্রবহমান ছিল । বিশিষ্ট পন্ডিতবর্গ ধারণা করেন যে, একসময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে মাতৃপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে, "পন্ডিতদের মতে হিন্দুদের শক্তি উপাসনা এসেছে অনার্যদের কাছ থেকে । কোন কোন পন্ডিতের মতে শক্তি বা মাতৃকা উপাসনা প্রস্তর যুগ থেকে প্রচলিত ছিল । ইউরোপের সুপ্রাচীন যুগে ( Palaeolithic and Neolithic ages )  ভেনাসের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে । দুইটি সন্তান ও স্বামীসহ মাতৃকামূর্তির আবিষ্কারও ওই যুগের শক্তি পূজার প্রমাণ দেয় । সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেস্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রিট ও মিশরে মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে । মার্শাল সাহেবের মতে, নীলনদ থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভুভাগ মাতৃকাপূজার ক্ষেত্র ছিল"  ( হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তৃতীয় পর্ব পৃষ্ঠা ১৬০ ) ।

প্রস্তর যুগের যেসব নগ্নিকামূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোকে প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় 'ভেনাস ফিগারাইন্স' বলা হয় । এই নগ্নিকা মূর্তিসমূহের অন্যান্য প্রত্যঙ্গের তুলনায় মাতৃচিহ্নসূচক প্রত্যঙ্গসমূহ প্রকটভাবে চিহ্নিত করা হত । নারীসূচক দেহলক্ষণ প্রকট হওয়ায় প্রস্তর যুগের এই মূর্তিগুলিকে 'ভগবতী' বলা হয় । প্রাচীন ভারতের হিন্দুসভ্যতার নিদর্শন থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে একটি শিলমোহর চিত্রে দেখা যায় যে, একটি নগ্নিকার বিস্ফারিত জননাঙ্গ থেকে একটি শস্যের গুচ্ছ ঊর্ধ্বোত্থিত হয়ে আছে । সমাজবিজ্ঞানীরা সিলমোহরের এই নারীকে  'শাকম্ভরী' বলে চিহ্নিত করেছেন । হিন্দু পুরাণে দেবী দুর্গার আবাহন মন্ত্রে দেবীকে 'শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা'র রূপদাত্রী বলে কল্পনা করা হয়েছে । পৌরাণিক দুর্গার বোধনের 'নবপত্রিকা' এবং 'দশপ্রহরণধারিণীর' পরিবর্তে দেবীর দশহাতেতে দশ রকম শাকের কল্পনা মহামাত্রিকা দেবীকে শস্যদায়িনী দেবী রূপে প্রতীয়মানেরই নামান্তর । পৃথিবীকে শস্যপূর্ণা করার কারণেই শস্যের দেবী পরবর্তীতে মাতৃকাশক্তি বা শক্তিদেবীকে রূপান্তরিত হয়েছেন ।

শক্তিপূজার আদি উৎস নিরূপণে পন্ডিতগণ  বেদ পুরাণের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন । ঋকবেদের দেবীসূত্রে দেখা যায়–

অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যাহমাদিতৈরুত বিশ্বদেবৈঃ ।
অহং মিত্রাবরুণোভো বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নি অহমাশ্বিনোমা ।।
সরলার্থ : আমি দুষ্টের দমনকারী এবং পৃথিবী আদি সমস্ত লোকের সাথে বাপ্য । আমি ১২ মাস এবং সমস্ত তেজোময় পদার্থের সাথে বাপ্য । দিন ও রাত্রি উভয়কে আমি ধারণ করি । সূর্য ও অগ্নি, দ্যুলোক ও পৃথ্বীলোক উভয়কেও আমি ধারণ করি ।

এছাড়া দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ আর মার্কন্ডেয় পুরাণেও শাক্তধর্মের বিকাশ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় । মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবী মাহাত্ম্যের ত্রয়োদশ  অধ্যায়ের ( যা শ্রীশ্রী চন্ডী নামে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত )  দেবীকল্পনা অবশ্যই উল্লেখ্য । এখানে অসুরদলনী এক পরমা দেবীর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে । তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া । মহাভারতেও বিরাট পর্বে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব এবং ভীষ্ম পর্বে যুদ্ধের প্রারম্ভ কালে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন যে দুর্গাস্তুব করেছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় । এই মহাভারতেই ( ৪/৬, ৬/২৩ ) দুর্গাকে বাসুদেবের ভগিনী এবং নন্দকুলোদ্ভবা বলে ব্যক্ত করা হয়েছে । হরিবংশের আর্যাস্তবে ও তাঁকে লক্ষী, বলদেবের ভগিনী, নন্দগোপুসূতা প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে ।

পন্ডিত শাস্ত্রকারগণ ব্যতীত বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদগণ তাঁদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছেন । তাঁদের মতে আর্যদের এদেশে আগমনের পূর্বে প্রাচীন জাতির মধ্যে কোল, ভিল, মুন্ডা, সাঁওতাল, শবর প্রভৃতি অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল । অরণ্য, পর্বতে বসবাসকারী এই মানুষজনেরা ছিল মাতৃউপাসক । পুরাণে বর্ণিত 'চন্ডী' প্রাগার্য যুগে ওঁরাও, বিরহোড়দের 'চান্দী' বা 'চান্ডী' । আরণ্যক শবর জাতির আরাধ্যা দেবী 'পর্ণশবরী' কুশ বা কৌশিক জাতির দেবী 'কৌশিকী' । আর্যদের ধর্মগ্রন্থেও দেবীকে পুলিন্দ, শবর, কিরাত প্রভৃতি অনার্য জাতির উপাস্য দেবতা বলে স্বীকার করা হয়েছে–
পর্বতাগ্রেষু ঘোরেষু, নদীষু চ গুহাসু চ
 বাসবস্তব মহাদেবী বনেষু পবনেষু চ
 শবরৈব্বরৈশ্চৈব পুলিন্দৈশ্চ সুপূজিতা
ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনি লোকান্ ক্রমিশ সর্বশঃ
( খি‌ল হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব,তৃতীয় অধ্যায় )

লোকসংস্কৃতিবিদগণ প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বৃক্ষপূজার মাধ্যমেও দেবীর প্রতীক অর্চনার সূত্র সন্ধান করেছেন । ডঃ উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'দুর্গা মাহাত্ম্য ও পূজা প্রসঙ্গে' উল্লেখ করেছেন যে,  "বৃক্ষ প্রতীকে দেবীপূজা ও অনার্য গোষ্ঠীর মধ্যে অনেককাল আগে থেকে প্রচলিত ছিল । বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গ্রামদেবীরা এখনো বৃক্ষে বসবাস করেন বলেই বিশ্বাস । বিভিন্ন গ্রামের দেবীস্থানগুলি বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ তলে অবস্থিত । ওইসব দেবীস্থানে যেসব গাছকে দেবীজ্ঞানে বা দেবীর আবাস হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয় সেগুলির সর্বদাই যে শাস্ত্রীয় মর্যাদা আছে তাও নয় । মনসা গাছে দেবী মনসার পূজা বাংলা সর্বত্র প্রচলিত । বৃক্ষকে দেবীর বাসস্থান হিসেবে শাস্ত্রকাররা উল্লেখ করেছেন । দুর্গাপূজার সময় যে নবপত্রিকা পূজিতা হন তার মধ্যে বৃক্ষরূপিণী দেবীর পূজার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে । 

দুর্গাপূজায় দেবীকাঠামোয় গণেশের মূর্তির পাশে নবপত্রিকা স্থাপনের বিধি রয়েছে । গণেশের পাশে অবস্থান করার কারণে একে অনেকের 'গণেশের বউ' বা 'কলা বউ' বলে থাকেন । এই নবপত্রিকায় একটি স্বপত্র কলাগাছের সঙ্গে আরো আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেষ্টন করে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে এই নবপত্রিকা তৈরি করা হয় । নবপত্রিকায় ব্যবহৃত নয়টি গাছের নাম হল– কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, সাধারণ কচু, বেল,অশোক ও জয়ন্তী । স্মৃতি শাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের 'তিথি তত্ত্ব'র একটি শ্লোকে এই নবপত্রিকার বিবরণ পাওয়া যায়–

কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ ।
বিল্বশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা ।।

এই নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে পরিচিত হন । নবপত্রিকায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি উদ্ভিদ দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয় । এই নবদুর্গা এবং নয়জন দেবী হলেন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা, কচ্চাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, বিল্লাধিষ্টাত্রী শিবা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, জয়ন্তাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী । নবপত্রিকায় অধিষ্ঠাত্রী এই নয়জন দেবীকে 'নবপত্রিকা বাসীন্যৈই নবদুর্গায়ৈ নমঃ' মন্ত্রে পূজা করা হয় । শাস্ত্রকারগণ এবং লোকসংস্কৃতিবিদগণ একবাক্যে এই নবপত্রিকাকে শস্যদেবী বলেই অভিমত প্রকাশ করেন । নবপত্রিকার পূজা মানে শস্যদেবীর পূজা । শশীভূষণ দাশগুপ্ত মহোদয়ও উল্লেখ করেন যে, "এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজার মূলে বোধ হয় এই শস্য দেবীরই পূজা । পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে ।......বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটি সচেতন চেষ্টা । এই শস্যদেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ । সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে ।"(  ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য পৃষ্ঠা ২৫-২৬ )

 বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের অনুসৃত শস্যপূজা ভূমির উর্বরতাশক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জানিয়ে তার সৃজনক্ষমতাকে মাতৃরূপে পূজা বা শক্তি পূজার বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলার ধর্মসাধনায় দেবীভাবনার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছিল । সেখান থেকেই শাক্ততান্ত্রিক ভাবধরার জন্ম নিয়েছে । তারও একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে । 

প্রাকবৈদিক যুগ থেকে মাতৃকাপূজা বা শক্তিসাধনার একটা ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয় ও তার পাশাপাশি তন্ত্রসাধনারও একটি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে সেই সময় থেকে । বৌদ্ধ প্রভাবে তন্ত্রসাধনার ধারাটি বাংলায় পরিপুষ্টি লাভ করেছিল । বৌদ্ধরা 'তারা', 'প্রজ্ঞা', 'পারমিতা', একজটা দেবীর কল্পনা করেছেন । প্রায় দেড়হাজার বছর কাল আগে থেকে বাংলাদেশ শাক্ত ও তন্ত্র পীঠস্থান হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে ।বাংলায় পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে । অষ্টম ও দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মহাজনপন্থী বৌদ্ধধর্মের তন্ত্রের প্রভাব ছিল । তার প্রমাণ আমরা চর্যাপদের মধ্যে পেয়ে থাকি । চর্যাপদে ডোম্বি জোইনি, চন্ডালী ইত্যাদি মাতৃকাচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় । চর্যায় উল্লেখ আছে যে, 'আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভৈলি । নিঅ নারী ছাড়ি চন্ডালি লেলি ।'

 চর্যায় শূন্যতার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞা ও করুণার নৈব্যক্তিক সাধনার পথে মাতৃকার জয়জয়কার করা হয়েছে । তারাদেবী অবলোকিতেশ্বরের করুণা থেকে সৃষ্ট এবং বৌদ্ধধর্ম মতাদর্শে পূজিতা । তিনি উমা, কুশলা, পদ্মাবতী ( মনসা ) এবং বেদমাতা গায়ত্রীর সাথে একীভূত হয়েছেন । ফলে মাতৃকা বৈদিক, বৌদ্ধ, লৌকিক ও পৌরাণিক ধর্মের মাধ্যমে আবর্তিত হয়েছে । ক্রমাগত সংমিশ্রণ ও বিমিশ্রণের মাধ্যমে বিশ্বমাতার রূপ পরিগ্রহ করেছে । এই সময়ে মহিপালের মুদ্রায় বিশ্বপ্রসবিনী মাতৃকার চিত্র দেখা যায় । মহিপালের তাম্রশাসনের শুরু হয় দেবী ভবানীর জয়গান করে । এই সময়ে বাঙালির সর্বাধিক পুজিতা মাতৃকাশক্তি দেবী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে । ধীরে ধীরে সেনযুগের এই সূত্র ধরেই একাধিক শক্তিপীঠের পুনরুত্থান ঘটে । বাংলাদেশের সপ্তদশ শতাব্দীতে শাক্ত ধর্মের প্রসার হয় । ঊনবিংশ শতক থেকে 'শাক্ত পদাবলি' নামে একটি স্বতন্ত্র কাব্য ও সঙ্গীতধারা বাংলাসাহিত্যে স্থান করে নেয় ।

মানবসভ্যতায় প্রাচীন ধর্মধারার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাতৃকাপূজার একটা ধারা প্রবাহমান ছিল । এই মাতৃকাপূজা থেকেই পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে শক্তিপূজার বা দেবীভাবনার উদ্ভব হয় । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাতৃপূজা, শক্তিপূজা বা দেবীপূজার ধারা পরিলক্ষিত হয় । প্রাচীন বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না । 

প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । এমনকি ত্রিপুরার রাজাগণ একসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগেও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন । খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজা ছেংথুমফা বা নামান্তরে কীর্তিধর মেহেরকুল ( প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটিকারা রাজ্য ) জয় করেছিলেন । তিনি ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী কোনো এক রাজাকে পরাজিত করে মেঘনা নদ পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন । মহারাজা বিজয়মানিক্য বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তী সমগ্র সমগ্র সুহ্মদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল ও বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমসাময়িক বাংলায় যে ধর্মধারার প্রচলন ছিল তার প্রভাব ত্রিপুরার উপরও পড়ে । এইভাবে ত্রিপুরার সেই সময়ের শাসকবৃন্দ ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীপূজার প্রচলন করেন ।

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস অনুধাবন করলে জানা যায় যে, ডাঙ্গরফার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নফা গৌড়ের নবাবের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করেন । কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি গৌড়ের নবাবকে  একশ হাতিসহ একটি মণি উপহার দেন । গৌড়েশ্বর তাঁকে মানিক্য উপাধি প্রদান করেন । সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা মানিক্য উপাধি ব্যবহার শুরু করেন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে রত্নমানিক্য ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা সিংহাসন দখল করলেও আগরতলার মিউজিয়ামের রক্ষিত রত্নমানিক্যের যে মুদ্রা দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের ও অন্যটি ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী রত্নমানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয় । কারণ, পরবর্তীকালে রাজা মুকুট মানিক্যের ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া যায় । রত্নমানিক্যই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার অন্যান্য রাজারাও মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । এইসব মুদ্রা ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি । ভাষা সংস্কৃত হলেও অক্ষর ছিল বাংলা । ব্যবহৃত অব্দ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শকাব্দ ও পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরাব্দ । এই মুদ্রাগুলিতে পুরুষ দেবতার সঙ্গে স্ত্রীদেবতার প্রতীক অঙ্কিত থাকত । শিবদুর্গা, হরপার্বতী, লক্ষীনারায়ন ইত্যাদি দেবদেবী ও প্রতীক হিসাবে দেবীবাহন সিংহ, ত্রিশূলও মুদ্রাতে উৎকীর্ণ থাকত । 

দ্বিতীয় রত্নমানিক্যের ( ১৬৮৫–১৭৭২ ) কীর্তি হলো প্রাচীন কৈলাগড় বা কসবা দুর্গে মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা, ভগবতীর মূর্তি স্থাপন । এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিকগণের মতে কল্যাণ মানিক্য কসবায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন রত্নমানিক্য । এই সম্পর্কে প্রাচীন রাজমালায় আছে—

" কসবাতে কালী মূর্তি করিল স্থাপন
 দশভূজা ভগবতীর পতিত তারণ ।"

 দশভুজা দেবীমূর্তি হলেও এটি সাধারণ্যে জয়কালী মন্দির বা কসবা কালীবাড়ি নামে পরিচিত । ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এই মূর্তিটির ব্যতিক্রমী রূপ বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । এই রত্নমানিক্য বারানসী থেকে মূর্তি এনে কুমিল্লায় রাজরাজেশ্বরী বিগ্রহকে স্থাপন করেন । এই প্রসঙ্গে ত্রিপুর বংশাবলিতে আছে—

"মহারাজ রত্ন মানিক্য বাহাদুর 
কাশীধাম হইতে কালী আনিল সত্ত্বর
 সেই কালি কুমিল্লা নগরের স্থাপিল
 রাজরাজেশ্বরী বলি নামকরণ দিল ।"

ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মানিকের কীর্তি ত্রিপুরার আরেকটি মন্দির উদয়পুরের মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির । এটি ৫১ পীঠের একপীঠ বলা হয় । এখানে দেবীর দক্ষিণপদ পড়েছিল । পীঠমালা তন্ত্রে উল্লেখ আছে–

ত্রিপুরায়াং দক্ষিণপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বভিষ্ট ফলপ্রদঃ ।

কথিত আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া অমরপুরে অমরসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে মঙ্গলচন্ডীর মন্দির । অমরপুরের গভীর অরণ্যে গোমতী নদীর তীরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা দেবীমূর্তি রয়েছে । স্থানটিকে ছবিমুড়া বলা হয় । পিলাকের প্রত্নক্ষেত্রেও দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে । আগরতলা শহরে রয়েছে লক্ষীনারায়ণ মন্দির । দিঘির পূর্ব পাড়ে উমামহেশ্বর মন্দির অবস্থিত । ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মহকুমা সদরে কিম্বা মহকুমার মধ্যে বহু দেবীমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । তার মধ্যে সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়াকালী বাড়ি, মুহুরীপুরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, কমলপুরে কমলেশ্বরী, কুমারঘাটে ভুবনেশ্বরী মন্দির, ধর্মনগরের কালিবাড়ি বিখ্যাত । একদিকে বাংলার শক্তিপীঠসমূহ অন্যদিকে আসামের শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দিরের প্রভাবে ত্রিপুরাও শক্তি আরাধনার একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সুবাদে ত্রিপুরা রাজ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে কালিকাপূজা ও দুর্গাপূজা প্রচলন রয়েছে । রাজন্য প্রতিষ্ঠিত দুর্গাবাড়ি ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায় প্রাণকেন্দ্রে  রয়েছে । এখানে নিয়মিত দেবীর পূজার্চনা হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন প্রামাণ্য তথ্য এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব । 

রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ১৬৯৬–১৭৭৪ ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি ১৬৩২ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( জুন-জুলাই ১৭১০ ) খ্রিস্টাব্দ রত্নমানিক্যের আমলে রত্নকন্দলি ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূতকে ত্রিপুরার রাজধানী রাঙামাটিতে ( বর্তমান উদয়পুর ) পাঠিয়েছিলেন । সেই ভ্রমণকাহিনির উপর ভিত্তি করে অহমিয়া ভাষায় লেখা হয়েছিল "ত্রিপুরা দেশের কথা" । এটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরচন্দ্র সেন । এই ভ্রমণ বিবরণীতে সেকালের ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে । এই বিবরণীটির সপ্তম অধ্যায়ে ত্রিপুরার দূতগণের দুর্গোৎসব দর্শনের বর্ণনা রয়েছে–

"ত্রিপুরার দুতগণের বিদায় দেওয়া হইয়া গেলে পর দুর্গোৎসবের কাল আসিল । তখন মহারাজা বড়বড়ুয়াকে দিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তাহারা সেখানের দুর্গাপূজা দেখিতে ইচ্ছা করে কিনা ।' এই কথা শুনিয়া ত্রিপুরার দূতগণ বলিলেন, 'বড়বড়ুয়া, নবাবের অনুগ্রহে যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করিতে পাই ; ঠাকুরানীর দর্শন করিতে পাই  তবে আমাদের পরম ভাগ্য বলিতে হইবে ।" এরপর মহারাজের আদেশে এই দূতদ্বয়কে অষ্টমীর দিন সূর্য, গণেশ, নারায়ণসহ দুর্গাপূজার জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেবী দুর্গাকে দর্শন করানো হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুপ্রাচীনকালেও ত্রিপুরারাজ্যে দেবীদুর্গা পূজার প্রচলন ছিল । এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীভাবনা ও দেবীপূজার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে স্থানাভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. শ্রী রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
২. ত্রিপুরা রাজমালা–পুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী
 ৪. ত্রিপুরার ইতিহাস–ডক্টর জগদীশ পণ চৌধুরী 
৫.ত্রিপুরার ইতিহাস–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. শতাব্দীর ত্রিপুরা–সম্পা.  নির্মল দাস     রামপ্রসাদ দত্ত
 ৭. ত্রিপুরার স্মৃতি–শ্রী সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন
 ৮. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৯. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

Friday, August 11, 2023

লোকসাধারণের শিল্পী বিশ্বকর্মা : মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের আলোকে

লোকসাধারণের শিল্পী বিশ্বকর্মা :   মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের আলোকে

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী । পুরাণে তিনি স্বর্গের একজন দেবতা । স্বর্গ মর্ত্যে নির্মাণ ও যন্ত্রপাতির দেবতা তিনি । কারিগরি সকল বিদ্যা বিশ্বকর্মার হাতে । ব্রহ্মাপুত্র বিশ্বকর্মা গোটা বিশ্বের নকশা তৈরি করেন । ঈশ্বরের প্রাসাদের নির্মাতাও বিশ্বকর্মা । মহাভারত অনুযায়ী বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পকলার দেবতা । সকল দেবতার প্রাসাদ, সকল প্রকার অলংকারের নির্মাতা । স্বর্গের অন্যান্য দেবতাদের ন্যায় বিশ্বকর্মারও পূজা হয় ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে অর্থাৎ কন্যাসংক্রান্তিতে । সাধারণত দু'ধরনের বিশ্বকর্মা পূজা হয় । 'তাঁত বিশ্বকর্মা' ও 'লোহা বিশ্বকর্মা' । শারদীয়ার আগে পূজা করা হয় 'লোহা বিশ্বকর্মাকে' । এই বিশ্বকর্মা চতুর্ভুজ এবং বাহন হাতি । আর 'তাঁত বিশ্বকর্মা' পূজা হয় শারদীয়া মহানবমীর নব্বই দিনের মাথায় । এই 'তাঁত বিশ্বকর্মা'র দুটি হাত মাত্র । এর বাহন ঘোড়া । এক হাতে তাঁতের মাকু ও লাটাই । অন্য হাতে চাবুক । বিশ্বকর্মা পূজা এলে বাংলার আকাশ বাতাস মেতে উঠে রংবেরঙের ঘুড়িতে ।

ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের দুটি বিশিষ্ট সূক্তে ( ৮১, ৮২ ) বিশ্বকর্মাকে স্তব করা হয়েছে । ঋগ্বেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ । তাঁর চক্ষু, মুখমন্ডল, বাহু ও পদ সর্বদিকে পরিব্যাপ্ত । তিনি বাচস্পতি মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত । তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি । কোনো কোনো পুরাণে উল্লেখিত আছে বিশ্বকর্মার পিতা প্রভাস । প্রভাস হলেন অষ্টবসুর একজন । আর বিশ্বকর্মার মাতা হলেন বরবর্ণিনী । বরবর্ণিনী হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী । আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । আবার কোথাও বলা হয়েছে শিবের শরীর থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বিশ্বকর্মা । বিশ্বকর্মার জন্ম ও পিতামাতা সম্বন্ধে নানা গ্রন্থে নানা মত রয়েছে । ফলে তা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে । আসলে আমাদের বেদ পুরাণগুলোই আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে । এরকম অন্যান্য বহু দেবদেবীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় । বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে । উপবেদ গুলো হল, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ ও স্থাপত্যবেদ । এই স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা । বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নাম "বিশ্বকর্মা বাস্তুশাস্ত্রম" । বাস্তুশাস্ত্রের শুরুতেই উল্লেখ আছে, 'জগতের কল্যাণ কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করেছেন' । 'বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যায়া' । বিশ্বকর্মা অগস্ত্য মুনির ভবন, কুবেরের অলকাপুরী ও দিব্য বিমান, রাবণের স্বর্ণালংকা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাপুরী । রাবণের রাজপ্রাসাদের সাথে সুন্দর উদ্যান, গোষ্ঠ, মন্ত্রণাগৃহ, মনোরম ক্রীড়াস্থান, রাজপ্রাসাদের কারুকার্য ইত্যাদি নিখুঁতভাবে রচনা করেন । তাঁর অপর নিখুঁত নির্মাণ হল দেবপুরী । যে ধনুক দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন সেই ধনুক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । বৃত্রাসুরকে বধ করার জন্য বিশ্বকর্মা দধীচি মুনির অস্থি থেকে বজ্র নির্মাণ করে দেবেন্দ্রকে দিয়েছিলেন । শিবের ত্রিশূল বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবী মহামায়াকে তীক্ষ্ণ বর্শা, অভেদ্য কবচ,পরশু এবং বহু মারণাস্ত্র বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন । পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরিতেও তিনি হাত লাগিয়েছিলেন বলে কথিত আছে । কিন্তু রাজার অতিরিক্ত ঔৎসুক্যের কারণে সেই মূর্তি অসমাপ্ত রাখতে হয় বিশ্বকর্মাকে ।

বিশ্বকর্মা বিয়ে করেছিলেন ব্রহ্মার কন্যা বিশ্বকলাকে । বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে । এরা হলেন ঠাটের ( যারা পাথরের কাজ করেন  ), সোনার ( স্বর্ণকার বা স্যাকরা ), বারহাই ( ছুতোর ), মকান ( কারিগর বা রাজমিস্ত্রি ), কুমহার ( কুম্ভকার বা কুমোর ) । তবে অন্যান্য সূত্রে উল্লেখ রয়েছে বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে হল, লোহার, কারাই, সালট, গুর্জর ও সাইভেস্ত । বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, লোহার নাকি বিশ্বকর্মার ছেলে নয় । আসলে বিশ্বকর্মা নিজেই নাকি লোহার । তিনি উপবীত ধারণ করেন । পদ্মাপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার পুত্র দৈত্যশিল্পী ময়দানব । আবার রামায়ণ অনুসারে বানরশিল্পী নল ও নীল বিশ্বকর্মার পুত্র । বিশ্বকর্মার স্ত্রী এক বানরী ।ক্ষণিক প্রেমের ফলশ্রুতিতে বিশ্বকর্মার ঔরসে বানরীর গর্ভে নল ও নীল নামে দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে । তারা রামরাবণের যুদ্ধে ইন্দ্রজিতের হাতে নিহত হয়েছিলেন । বাংলার লোকাচারে ব্রহ্মার প্রতিমার দুইপাশে নল ও নীল মানুষরূপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে বিশ্বকর্মা ও তাঁর স্ত্রী ঘৃতাচী দুজনেই শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন । ঘৃতাচী ছিলেন স্বর্গের নর্তকী । তিনি এক গোপকন্যা হিসেবে প্রয়াগে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের নয়টি সন্তান । যথা– মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শংখকার, সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার ও চিত্রকার । বিশ্বকর্মা প্রত্যেককেই নানা শিল্প শিক্ষা দান করেন । তিনি মালাকারকে পুষ্পশিল্প, কর্মকারকে লৌহশিল্প, কাংস্যকারকে কাংস্যশিল্প, শঙ্খকারকে শঙ্খশিল্প, সূত্রধারকে দারুশিল্প, কুবিন্দককে বয়নশিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎশিল্প, স্বর্ণকারকে অলংকারশিল্প, চিত্রকারকে অঙ্কনশিল্প শেখান ।

শাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মাকে দেবশিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হলেও দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বকর্মা মানব সমাজের বিভিন্ন লোকশিল্পীর জনক ও শিক্ষক । সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে সমস্ত শিল্পোপকরণ নির্মাণ ও ব্যবহার করে থাকেন সেগুলোই লোকশিল্প । এই লোকশিল্প সমাজের নানা প্রয়োজনে সৃষ্টি হয় । পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অন্তরের সৌন্দর্যপ্রতিভারও প্রকাশ  ঘটায় । এই লোকশিল্পের মাধ্যমে লোকশিল্পীদের মধ্য থেকে সমাজে কিছু বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়ও গড়ে ওঠে । গ্রাম জনপদে এইসব শিল্পীরা তাদের নানারকম শিল্পকর্মকে জীবিকারূপে গ্রহণ করে থাকেন । তার ফলে সমাজে কিছু পেশাজীবী সম্প্রদায়েরও সৃষ্টি হয় । লোকপ্রযুক্তিতে দক্ষ  এইসব লোকশিল্পীর শিল্পসত্তার উৎসে আমরা বিশ্বকর্মাকেই পাচ্ছি । ফলে বিশ্বকর্মাকে আমরা শুধুমাত্র দেবশিল্পী না বলে তাঁকে লোকশিল্পীও বলতে পারি । তিনি শুধুমাত্র শিল্পী নন । দক্ষ শিল্পী, সংগঠক ও শিল্পশিক্ষকও বটে । পুরাণমতে তিনি শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করে থাকলে তিনি তো মর্ত্যের মানবই । পেশাদারী বৃত্তিতে নিয়োজিত লৌকিক শিল্পীদের গুরু । বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়ের লোকশিল্পাচার্য  ।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যগুলোতে আমরা দেখি যে, যখনি কোনো নির্মাণ বা স্থাপত্য কর্মের প্রয়োজন হয় তখনই বিশ্বকর্মার ডাক পড়ে । বিশ্বকর্মা যে সেকালে বাস্তুশাস্ত্রবিশারদ ছিলেন তা শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে জানা যায় । সেকারণে মধ্যযুগীয় কাব্য সমূহের ঘটনাক্রমের বর্ণনায় নির্মাণশৈলীর প্রয়োজনে বিশ্বকর্মার ডাক পড়ত । মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে 'দ্বারকা নির্মাণ' অংশে আমরা দেখি, জরাসন্ধের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সমুদ্রের তীরে দ্বারকাপুরী নির্মাণের জন্য কৃষ্ণ ও বলরাম বিশ্বকর্মাকে দায়িত্ব অর্পণ করেন ।এখানে বিশ্বকর্মা পরিখা, প্রাচীরবেষ্টিত গড় নির্মাণ করেন । দ্বারকাপুরী নির্মাণের বর্ণনায় পাই–"গোঁসাঞির আজ্ঞা সিরেতে বন্দিয়া ।/ বিশ্বকর্মা রচে পুরী বৈকন্ঠ ভাবিয়া ।।/ বিচিত্র চৌখন্ডি ঘর দেখিতে সুন্দর ।/ আকাস মন্ডল পাইল গোঁসাঞির ঘর ।।/সমুদ্রের যথাযথ রত্ন দ্রর্ব্য ছিল ।/ সমুদ্র আনিয়া দ্রর্ব্য তড়িত জোগাইল।।/  নাটশাল পাকশাল অতি সুশোভিত ।/ চতুস্বালা সুখশালা কনক রচিত ।/  উগ্রসেন রাজধানী তিরপাট কৈল ।/ অক্রুর উদ্ধবের ঘর বিচিত্র বনাইল ।/ পাত্র মিত্র বন্ধুগণ যতেক আছএ ।/ মথুরা নগরের লোক যতেক বসএ ।/ একে একে রচিল সভাকার ঘর ।/ গড় পরিখা দুর্গ করিল গদাধর।।/.............../চিত্রবিচিত্র হইল দেখিতে নগর ।/ দ্বারকা বলিয়া নাম থুইল গদাধর ।।/ দ্বিতীয় বৈকন্ঠ হৈল পুরি অনুপাম ।/ মহাদুর্গ পুরী হৈল দ্বারাবতী নাম ।

পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে বিশিষ্ট কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ । বিশ্বকর্মা কর্তৃক লোহার বাসর নির্মাণের একটি সুন্দর বর্ণনা তাঁর কাব্যে পাই– 'নানা অস্ত্র সঙ্গে আছে, লৌহ কাটে লৌহ চাঁচে, লোহার বাসর গড়ে।/  লোহার বান্ধিল পাড়ি, বন্ধন করিল সিঁড়ি, লোহার দেওয়াল চারিভিতে । –বাসর ঘরটি লোহার চাল, লোহার মেঝে যুক্ত, লোহার দেওয়াল জুড়ে কুলুঙ্গি । লোহার কপাট ও খিলযুক্ত দরজাকে শক্ত করতে 'করিয়া লোহার কপাট, দিল চারি চৌকাঠ, বজ্র সম গঠন বিরাজ ।'–রূপে নির্মাণ করেন । শুধু তাই নয়, বিশ্বকর্মা এখানে হনুমানের সহায়তা নিয়ে শত শত শাল, পিয়াশাল কাঠ যোগাড় করে সমুদ্রযাত্রার উপযুক্ত ডিঙাও বানিয়েছিলেন ।

মনসামঙ্গলের আরেকজন কবি বিজয়গুপ্ত । তাঁর লিখিত 'পদ্মপুরাণে' 'বিশ্বকর্মা কর্তৃক জয়ন্তীনগরের মনসার পুরী নির্মাণ' পর্বে মনসার নির্দেশে বিশ্বকর্মার পুরী নির্মাণের প্রসঙ্গ আছে– 'পদ্মার আদেশ বিশাই যখন শুনিল ।/  আপনার অস্ত্র লয়ে জয়ন্তীতে গেল ।।/  বিশ্বকর্মা বলে শুন দেবী বিষহরি ।/ যে কর্ম করিতে কহ সেই কর্ম করি ।।/বিষহরি বলে যদি রাখ মোর মান ।/ সুন্দর করিয়া গড় পুরী একখান ।।/  .................../কহিলা যদি দেবী বিষহরি ।/ বিশ্বকর্মা আপনে নির্মাণ করে পুরী ।/ অতি সুললিত পুরী দেখিতে সুঠাম ।/ সুন্দর রতনপুরী করিল নির্মাণ ।।/......................./ দেউড়ি বিস্তর বিশাই করে স্থানে স্থান ।/সুবর্ণ খচিত ঘর করিল নির্মাণ ।।/– বিশ্বকর্মা পুরী নির্মাণের পাশাপাশি ঘাটবাঁধানো সরোবরও খনন করে দিয়েছিলেন ।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চন্ডীমঙ্গলে' বিশ্বকর্মা দেবী চণ্ডীর জন্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । সেই মন্দিরে শ্বেতচামরও রেখেছিলেন । কবির ভাষায় পাই, 'ধবল চামর দিল ত্রিসক  পতাকা ।/ রাকাপতি বেড়ি যেন ফিরএ বলাকা ।।/–এই কাব্যে কবি পুরীনির্মাণ এবং কালকেতুর গৃহনির্মাণের কথা বলেছেন । দেবীর আজ্ঞায় বিশ্বকর্মা হনুমানকে সঙ্গে নিয়ে পুরী নির্মাণ করেছেন । 'প্রথমে প্রাচীর বিশাই কৈল চারিপাট ।/ বাউটি পাথরের বীর দিল ঝানকাট ।।/ তাল তরু সম উচ্চ হৈল প্রাচীর ।/ পাথরের দাঁত্যা দিল হনুমান বীর ।।/ মুড়লি রচিয়া তাহে আরোপিল কাট ।/  চারি হালা খড়েতে ছাইল চারি পাট।।/ উত্তরে খিড়কি সিংহদ্বার পূর্ব দেশে ।/ শিলাতে রচিত নাটশাল চারিপাশে।।/

রামেশ্বর ভট্টাচার্যের 'শিবায়ন' অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত । এই শিবায়ন কাব্যে শিবের চাষবাস প্রসঙ্গে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপকরণের কথা আছে । মূলত, মধ্যযুগের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর । সেইসময়ে প্রচলিত পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ চলত । ফলে কাব্যেও এসেছে সেকালের সেইসব কৃষিসরঞ্জামের বর্ণনা । শিবের কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় লাঙ্গল, জোয়াল, ফাল, মই, নিরানি, কোদাল ইত্যাদি বিশ্বকর্মা নির্মাণ করে শিবকে দিয়েছিলেন । কৃষিকাজের প্রস্তুতির জন্য শিব ও পার্বতীর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে– 'শিবা বলে সে হলে যদ্যপি পাইলে ভয় ।/ বিশ্বকর্মা হৈতে কোন কর্ম নাহি হয় ।।/ দেখো বিনা বেতনে বিশাইয়ে বলে কালি ।/গাছ কাটি গড়াইব লাঙ্গল-জুয়ালি ।।/ ঘাত করে ঘরে তার পাতাইব শাল ।/ শূল ভাঙ্গি সাজসজ্জা করাইব ফাল ।।/ শূল ভেঙে কৃষি সরঞ্জাম তৈরির কথা শুনে শিব রেগে যান । পরে 'ঈশ্বরীর ইচ্ছায় বিশাই পায়ে পড়ে ।/ লাঙ্গল জুয়ালি মই সদ্য দিল গড়ে ।।/–বিশ্বকর্মা নৈপুণ্যের সহিত বিভিন্ন কৃষিসরঞ্জাম তৈরি করে দেন । 'বিশাই বুঝিয়া কার্য কৈল সাবধান ।/  লাঙ্গল-জোয়াল ফাল করিল নির্মাণ ।।/  হলধর পাশী মাইরা পুরাইল ফল ।/ আড় চাল লাঙলের জোড়া রাখে আল ।।/ বাটা দিল কোদালে জোয়ালে দিল সলি ।/  পুরস্কার পাইয়া বিশ্বকর্মা গেল চলি ।।

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গলে'ও কয়েকটি নির্মাণকার্যে বিশ্বকর্মার প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করি । ভব ভাবি চিতে, পুরী নির্মাইতে, কইলো ধ্যান ।/ বিশ্বকর্মা আসি, প্রবেশিলা কাশী, জোড়হাতে সাবধান।। বিশ্বকর্মে হর, কহিলা বিস্তর,  শুনরে বাছা বিশাই ।/ বিশ্বকর্মা শুনি,  নিজ পূণ্য গণি,  দেউল কইলা নির্মাণ ।' দেউল নির্মাণের পর বিশ্বকর্মা সেখানে দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি নির্মাণ করেন । তিনি অন্নদাকে রত্নকিঙ্কিনি, রত্নমুকুট, পানপাত্র, হাতা, ভূষণ, কাঁচুলি, শাড়ি ইত্যাদি আভরণে সজ্জিত করেন । বিশ্বকর্মা দেউলের শোভা দেখে মোহিত হয়ে সেখানে অন্নপূর্ণার পুরীও নির্মাণ করেন । সামনে ঘাটবাঁধানো সরোবর, স্ফটিকের তৈরি রাজহংস, সূর্যকান্ত মণি দিয়ে পদ্ম, চন্দ্রকান্ত মণি দিয়ে উৎপল, নীলমণি দিয়ে মৌচাক, নানা রকম জলচর পাখি, হাঙ্গর, কুমির ইত্যাদি জলচর প্রাণী, নানা রকম মাছ, বাগানে নানারকম ফুলের ও ফলের গাছের সমারোহে  গড়ে তোলেন অন্নপূর্ণার পুরী । গাছে গাছে নানারকম পাখি, নানা আরণ্যক প্রাণী, সরীসৃপ 'সৃষ্টি হেতু জোরে জোরে সৃজিলা বিশাই ।'

মধ্যযুগের কাব্য থেকে আমরা দেখতে পাই, বিশ্বকর্মা এখানে দেবতাদের শিল্পী নন । তিনি সমাজের সাধারণ একজন মানুষের মতোই কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত । এবং লক্ষ করা গেছে যে, তিনি লোকপ্রযুক্তিতে দক্ষ একজন শিল্পী । তিনি কখনো গৃহনির্মানে পটু । কখনো কর্মকার । ত্রিশূল ভেঙে লাঙল, ফাল, কোদাল তৈরি করছেন । কখনো ছুতারদের ন্যায় কাঠ দিয়ে ডিঙা, লাঙল, জোয়াল তৈরি করছেন । কখনো অলংকার তৈরি করছেন । কখনো শঙ্খ কেটে শাঁখা তৈরি করছেন, কখনো বাগিচা-কৃষি করছেন, বনায়ন করছেন । লোকশিল্প ও প্রযুক্তি তাঁর নখদর্পণে । রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখেছেন,–'তুমি বিশ্ব গড়......তাই বিশ্বকর্মা নাম ।' তিনি সমাজের অনেকগুলি বৃত্তিজীবির স্রষ্টা ও শিক্ষক । কাজেই তিনি শুধুমাত্র দেবশিল্পী নন । লোকশিল্পীও । তিনিও সাধারণ মানুষ । প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই তাঁকে 'বিশাই' সম্বোধন করে মানবত্ব আরোপ করে আপন করে নেওয়া হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আমি' কবিতায় লিখেছেন–'মানুষের অহংকার পটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প ।'

সহায়ক গ্রন্থ :
১. বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস–ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য 
২. শ্রীকৃষ্ণ বিজয়–মালাধর বসু
৩. মনসামঙ্গল–ক্ষেমানন্দ দাস ৪. চন্ডীমঙ্গল–কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
৪. শিবায়ন–রামেশ্বর ভট্টাচার্য
৫.  অন্নদামঙ্গল–রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র
৬.  মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংলা ও বাঙালি সমাজ–মুহম্মদ আব্দুল জলিল
৭.  বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত–তৃতীয় খন্ড, দ্বিতীয় পর্ব–অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।

Sunday, August 6, 2023

বা রি ধা রা

বারিধারা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সময় থাকতে এলে না ।
তাপদাহে কালো হয়ে বকেছি তোমায় কত 
ভেবেছি তুমি আমাদের ছেড়ে যাচ্ছ ।

ঘরের পাশে বাগানের গাছগাছালি 
শরীর খুলে মিলিত নৃত্যে মেতেছে ।
আর তুমি তার সাথে তাল মিলিয়ে 
সোচ্চার একটানা ঝুমুর
 অনেকক্ষণ বেজে যাওয়া এ কনসার্টে ক্লান্তি আসে না ।

সারা আকাশ ঢেকে রেখেছে তোমার মেঘ, 
বেলা হয়ে গেলেও স্পষ্ট নয় সবকিছু 
আধো আলোতে চোখ বন্ধ করে শুনেছি প্রকৃতির গান ।

মাঝে মাঝে তুমি আমাদের ফাঁকি দিয়ে
 কোথায় চলে যাও খুঁজে পাই না ।
তুমি এলেই চারধারে সম্মিলিত মল বাজে ।
 শরীর জুড়ে জেঁকে বসে শীতল আবেশ,
 মৃত জীবন আবার প্রাণ পায়, সজল হয় ।

সৈয়দ মুজতবা আলি

শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী । ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুজতবা আলির শেষ দেখা হয় । রবীন্দ্রনাথ সেদিন পরিহাস ছলে আলি সাহেবকে 'বরোদার মহারাজা' বলে সম্বোধন করেছিলেন । তিনি বিষন্নবদনে সেদিন বলেছিলেন, 'তোদের আমি গড়ে তুলেছি । এখন আমার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তোদের প্রয়োজন । গোখলে, শুক্ল, তোরা সব এখন থেকে আমাকে সাহায্য করবি । কিন্তু তোদের আনবার সামর্থ্য আমার কোথায় ? মুজতবা আলি উত্তরে বলেছিলেন, 'বিশ্বভারতীর সেবার জন্য যদি আমাকে প্রয়োজন হয় তবে ডাকলেই আমি আসব । যা দেবেন হাত পেতে নেব । রবীন্দ্রনাথ তখন এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলেন, 'বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে?' মুস্তাফা আলি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, 'মহাপুরুষ তো আসবেন শঙ্খ,চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে । কাঁচি হাতে করে?' রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'হ্যাঁ,হ্যাঁ  । কাঁচি হাতে নিয়ে । সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পিছনের টিকিট কেটে দেবেন । হিন্দু-মুসলমান আর কতদিন আলাদা থাকবে ?' সেদিন মুসলমান এক কৃতি ছাত্রকে গুরুদেব পরম স্নেহে এই কথাগুলো বলেছিলেন । সম্ভবত এই ছিল তাদের শেষ কথোপকথন । রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলির আদর্শ

আমার বানানবোধ

আমার বানানবোধ

কোথাও কোথাও বানান বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উল্টো পাল্টা টিপ্পনি শুনে এই বিষয়ে আমি কোনো পাঠ দিই না । মন্তব্যও করিনা । এখন প্রায় সর্বত্রই ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় । আমি ঠিকঠাক লিখলে কি হবে প্রেসে গিয়ে তা বকচ্ছপ হবে না কে বলতে পারে । আমি আমার পদবি 'রায়বর্ধন' লিখলে প্রুফরিডার 'রায়বর্মণ' করে দেন ।তবে চেষ্টা করি নিজের লেখা একশো শতাংশ শুদ্ধ রাখতে । আমার প্রিয় পাঠকরা আমি কতটা সফল ।

Tuesday, August 1, 2023

কবি অরুণ বনিকের প্রজ্ঞা ও শিল্পীসত্তা

শিল্পীর মনের খবর শিল্পী ছাড়া আর কেউ বোঝো না । সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি অরুণ বনিক চাকুরিসূত্রে সাব্রুমে থাকতেন । একদিন বিকেলবেলা এক চায়ের দোকান বন্ধুবান্ধবসহ আড্ডা দিচ্ছেন ও চা খাচ্ছেন । হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই অরুণদা তাঁর সামনের চায়ের কাপ থেকে চা ছুঁড়ে মারলেন তাঁর মুখোমুখি চা পানরত আরেক মাস্টারমশাইর মুখের ওপর । আর যায় কোথা ! লেগে গেল তুমুল হট্টগোল । অরুণদার ওপর বাজারের কিল পড়ার উপক্রম । তাড়াতাড়ি তিমিরবরণ চাকমা এবং আরো কয়েকজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে অবস্থাটা সামাল দেন । পরে বিষয়টা নিয়ে অরুণদার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেছিলেন, সেই মুহূর্তে ওই ভদ্রলোকের মুখটি তাঁর ভয়ংকর মনে হয়েছিল । তাই তিনি একাজটি করে ফেলেন ।