রাজন্যত্রিপুরায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় ধর্ম মানিকের ( ১৭১৪–১৭২৯ ) রাজত্বকালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিনের (১৭২৭–১৭৩৯ ) সঙ্গে যুদ্ধে ত্রিপুরার রাজার অধীনস্থ সমতলক্ষেত্রের একটা অংশ হাতছাড়া হয়ে যায় । সুজাউদ্দিন এই সমতলক্ষেত্রের নাম দেন রোশনাবাদ । মানে 'আলোর ভূমি' । পরে এটি 'চাকলা রোশনাবাদ' নামে পরিচিত হয় । কিছুদিন পর রাজা দ্বিতীয় ধর্মমানিক্য নবাব সুজাউদ্দিনের কাছ থেকে বার্ষিক ৫০ হাজার টাকার রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে চাকলা রোশনাবাদের জমিদারি ফিরে পান । পরবর্তী সময়ে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের কালে চাকলা রোশনাবাদের উপর ত্রিপুরার রাজার জমিদারির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় । আর ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য অংশ অর্থাৎ পার্বত্য ত্রিপুরা ছিল ত্রিপুরার রাজার স্বাধীনভূমি বা স্বাধীন ত্রিপুরা । ফলে সারা ভারতবর্ষব্যাপী যখন স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমে ক্রমে বিস্তার লাভ করতে থাকে । সেদিনও ত্রিপুরা রাজ্য ছিল স্বাধীন । ফলে এ রাজ্যের প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে কোন ভূমিকা ছিল না । কিন্তু ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী এবং ত্রিপুরার রাজার জমিদারি অঞ্চল হওয়ার সুবাদে ইংরেজ অধিকৃত চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলে এবং তদানীন্তন পূর্ববাংলায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিভিন্ন আন্দোলনের প্রভাব পরোক্ষভাবে ত্রিপুরায় পড়েছিল ।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ দেশের প্রথম আন্দোলন হল সিপাহী বিদ্রোহ । ১৯শে মার্চ ১৮৫৭ সালে সিপাহি মঙ্গল পান্ডে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে । মঙ্গল পান্ডের সেই বিদ্রোহের আত্মদানের প্রায় আট মাস পরে পূর্ববঙ্গের বন্দর শহর চট্টগ্রামেও এরূপ বিদ্রোহ দেখা গিয়েছিল । চট্টগ্রামের ঘটনার নায়ক ছিলেন হাবিলদার রজব আলী খান । তিনি ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাত ন'টা নাগাদ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধাসহ বিদ্রোহ করেন । ১৯ শে নভেম্বর ৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের প্রায় ৩০০ জন সৈন্য পিলখানা থেকে তিনটি হাতি, গোলাবারুদ ও ২ লক্ষ ৭৮ হাজার ২৬৭ টাকা কোষাগার থেকে নিয়ে অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন । বিদ্রোহীরা স্বাধীন ত্রিপুরায় নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । হাবিলদার রজব আলী খান বিদ্রোহী সিপাহীদের পরিচালনার দায়িত্ব নেন । চট্টগ্রাম শহরে সেসময় ক্যাপ্টেন P H K Dewool ছিলেন ৩৪ নম্বর রেজিমেন্টের প্রধান । তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ জানিয়ে ১৮ নভেম্বরের এক সপ্তাহ পরে ২৪ নভেম্বর একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J Hearsey KCB-র কাছে যিনি প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন । সেই দুর্লভ চিঠিতে আছে–'I have been informed by a native named Thakur Bux formarly jemadar of Chittagong provincial battalion, whom the mutineerse forced to go some distance with them, that the pay-havildar of number-4 company, named Rujub Ali Khan, has assumed command of the detachment, which we hear, has crossed the feni river and entered the territories of the Rajah of Tiperah.' । (Orlich Leopold Von ( 1858 )-The Mutiny in India : Its Origin and its Results, T. and W. Boone, 29, New Bond street ) । তিনি ওই পত্রে উল্লেখ করেন যে, বিদ্রোহীরা ফেনীনদী পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তের দিকে চলে গেছে । ফেনীনদী পেরিয়ে ত্রিপুরা সীমান্ত বোঝালে সে তো সাব্রুমের বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চলকেই বোঝায় । অর্থাৎ এই বিদ্রোহীরা রাজন্য ত্রিপুরার সাব্রুমের উপর দিয়েই সিলেট হয়ে মনিপুরের দিকে পলায়ন করেছিলেন । এছাড়া সে সময়ের অন্যান্য সরকারি নথিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাওয়ার জন্য বিদ্রোহী সিপাহীরা সীতাকুণ্ড-ফটিকছড়ি-রামগড় হয়ে ফেনীনদী অতিক্রম করেছিলেন । ( চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান-প্রথম খন্ড ) ।
ত্রিপুরারাজ্যের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দী বহু রাজনৈতিক ঘটনায় বর্ণময় হয়ে আছে । ১৯০৫- ১৯০৮ সালের স্বদেশী আন্দোলন এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঢেউ ত্রিপুরায়ও এসে লেগেছিল । ১৬ আগস্ট ১৯০৫ সালে পার্বত্য ত্রিপুরারাজ্যেও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়েছিল । সেদিন ত্রিপুরার হিন্দু ও মুসলিম জনগণ একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে বন্দেমাতরম ধ্বনি সহযোগে মিছিল করেছিলেন । ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি এবং প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু এ রাজ্যের জনগণের মধ্যেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল । সেদিন উমাকান্ত একাডেমির শিক্ষার্থীরা বন্দেমাতরম সংগীত গাইতে গাইতে পতাকা নিয়ে আগরতলা শহরের প্রধান রাজপথগুলি পরিক্রমা করেছিলেন । গবেষক ও ইতিহাসবিদ ড. জগদীশ গণচৌধুরী লিখেছেন–
'... বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বঙ্গভঙ্গ করার ব্রিটিশ চক্রান্ত তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিল । স্বদেশী গ্রহণ ও বিলাতি বর্জন আন্দোলন ব্যাপক গণ-আন্দোলনের রূপ নিয়াছিল । একাধারে কবি, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন চারণকবি যজ্ঞেশ্বর দে অর্থাৎ মুকুন্দ দাস ( ১৮৭৮–১৯৩৪ ) । তিনি গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগাইলেন । মুকুন্দ দাস ত্রিপুরাবাসী ছিলেন না ; কিন্তু তিনি সমতল ত্রিপুরাতে আসিয়া স্বদেশী গান গাইতেন । তিনি একবার আগরতলায় আসিয়াছিলেন । তাঁহার গান শুনিয়া মহিলারা বিলাতি রেশমি চুড়ি প্রভৃতি অলংকার ফেলিয়া দিত । রক্ষাবন্ধন উৎসব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হইত আগরতলা ও উদয়পুরে । রাধাকিশোর যাদবপুরে স্থাপিত বঙ্গীয় কারিগরি বিদ্যালয় অর্থ দান করেন ।' ( ত্রিপুরার ইতিহাস ড. জগদীশ গণ
চৌধুরী পৃষ্ঠা ২৮১) ।
সেকালে উমাকান্ত একাডেমির পড়াশোনা শেষ করে যে সমস্ত ছাত্ররা কুমিল্লায় পড়তে যেতেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন । এ প্রসঙ্গে প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত তাঁর 'স্মৃতির আলো' বইতে লেখেন– 'নারায়ণ ব্যানার্জি, নিলু গাঙ্গুলি ছিলেন সেরকম ছাত্র । তাঁদের মাধ্যমে আগরতলার সাথে কুমিল্লার যোগাযোগ ঘটে এবং সেটা ছিল বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রথম যুগ' । ঢাকা ও বরিশালের অনুশীলন সমিতির সদস্য নিশিকান্ত ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিপুরায়ও অনুশীলন সমিতির শাখা গঠিত হয়েছিল । তবে এই গুপ্তসমিতি ত্রিপুরাতে শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, সমাজসেবামূলক কাজ এবং স্বদেশীদ্রব্য ব্যবহারের প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । ধীরে ধীরে আগরতলায় অনুশীলন সমিতি তার কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে । ১৯২৭ সালে গড়ে ওঠে ছাত্র সংঘ । দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত লিখেছেন–
'ছাত্র সংঘ গড়ে উঠেছিল নীলু গাঙ্গুলির বাড়িতে । কিছুদিন চলার পর ছাত্র সংঘ ভেঙে যায় এবং জন্ম নেয় ভ্রাতৃ সংঘ । পুরাতন কর্নেল বাড়িতে মুখ্যত শচীন্দ্রলাল সিংহ ও উমেশলাল সিংহের উদ্যোগে ভ্রাতৃসংঘ হয়ে ওঠে একটি জীবন্ত সংঘ । আগরতলার অনেক ছাত্র পূর্বপাড়া মধ্যপাড়া থেকে দলে দলে এখানে এসে লাঠিখেলা, ছুরিখেলা, ও শরীরচর্চা করত । এখানেই আসে সুখময় সেনগুপ্ত ( পরবর্তী সময় ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ), আশু মুখার্জি, তড়িৎ মোহন দাশগুপ্ত এবং আরো অনেকে । ১৯২৮ সাল নাগাদ ভ্রাতৃ সংঘ তার প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় আগরতলার সমাজ জীবনে ( স্মৃতির আলো–দেবপ্রসাদ সেনগুপ্ত ) ।
সেই সময়ে ব্রিটিশবিরোধী নানা গোপন তৎপরতা ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়ে । বাংলার বিপ্লবীরা সেসময় শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ত্রিপুরায় আসতেন না । পার্বত্য ত্রিপুরা স্বাধীন রাজ্য হওয়ায় এখানে ইংরেজ পুলিশের প্রবেশাধিকার ছিল না । সর্বোপরি ত্রিপুরার অরণ্যের গভীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে বিপ্লবীরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে পারতেন । ত্রিপুরায় অনুশীলন সমিতির কর্মকান্ড সম্বন্ধে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন–
For the purpose of training of its members the Anusilan had two farms at belonia and Udaipur in hill Tiperah. these where outwordly and in part really agriculture farms but they served mainly as centres for they were given training. During daytime the members worked as labourer in the field but at night they are given training in the use of different kinds of arms and practiced shooting in the neighbouring hills. They had to work hard and lived under Strict military discipline ( History of Freedom Movement–R C Majumdar, vol– ii, 1975 page–286 ).
বাংলার বিপ্লবীরা ১৯১১ সালে বিলোনিয়ার বোকাফাতে এবং মাইছরাতে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন । তাঁদের কৃষিখামারটি ছিল মাইছরাতে । বিপ্লবী সতীশচন্দ্র বসুর জবানবন্দী অনুযায়ী জানা যায় যে– বিপ্লবী নরেন সেন, বরদাকান্ত নাগ, সতীশ চন্দ্র বসু ও অন্যান্য বিপ্লবীদের উদ্যোগে বিলোনিয়ায় কৃষিখামারটি স্থাপন করা হয়েছিল । ( ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, কলকাতা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৮৭-৮৮ ) । এসময় বিলোনিয়ায় অনুশীলন সমিতির কর্মকাণ্ড সারদা চক্রবর্তী এবং তাঁর সহযোগী পুলিনবিহারী গুপ্তের নেতৃত্বে পরিচালিত হত । কিন্তু সারদা চক্রবর্তী পুলিশের গুপ্তচরবৃত্তি করতেন এবং সমিতির গোপন কর্মকাণ্ডের তথ্যাদি ইংরেজ পুলিশের সাথে হস্তান্তর করতেন । ফলে একসময় ইংরেজ পুলিশরা বিপ্লবীদের ধরপাকড় শুরু করে । বিপ্লবীদের কেউ কেউ ধরা পড়েন । আবার কেউ কেউ পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন । বিপ্লবীরা যখন জানতে পারেন যে, তাঁদের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড ফাঁস হওয়ার পেছনে তাদেরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী সারদা চক্রবর্তীর হাত রয়েছে । তখন বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয় । বিপ্লবীরা এরপর এখান থেকে তাদের কর্মকাণ্ড সরিয়ে নেন ।
১৯১২ সালে উদয়পুরকে কেন্দ্র করে বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি গড়ে ওঠে । এখানেও তদানীন্তন নোয়াখালি জেলার লামচর নিবাসী দ্বারিকা রায়ের খামারবাড়িতে বিপ্লবীদের কৃষিখামার গড়ে ওঠে । এই কৃষিখামারটি গড়ে তোলার পেছনে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ( ত্রৈলোক্য মহারাজ ) ও বিপ্লবী প্রতুল গাঙ্গুলি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । তবে এই কৃষিখামারটি স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে মতান্তর রয়েছে । 'ত্রিপুরার শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক রঞ্জিত পালের মতে, এই কৃষি খামাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরেকজন বিপ্লবী কুমিল্লা অনুশীলন সমিতির সদস্য রঞ্জন নাথ রায় । এই কৃষি খামারের মূল বাড়িটির অবস্থান ছিল উদয়পুরের মাতাবাড়ি সন্নিকটে ধোপাইছরির বনের মধ্যে । মূলত, কুমিল্লার ও সমতল ত্রিপুরার ছাত্রদের এখানে পাঠানো হত । তারা খালি পায়ে কৃষকের পোষাক পরে ৩২ মাইল পায়ে হেঁটে কুমিল্লা শহর থেকে এখানে পৌঁছাতেন । বিলোনিয়ার খামার বাড়ির মতই বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটি একটি কৃষিক্ষেত্র মনে হলেও এখানে গোপনে বন্দুক ও পিস্তল তৈরি করা হত । এছাড়া বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র তৈরির কারখানা ও ছিল এটি । স্থানীয় মানুষজনেরা এই খামারটিতে কাজকর্ম করত এবং তাদের রুজিরোজগারের উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছিল এই খামারকে । তারা সারাবছর এখানে ধান, ডালশস্য, শাকসবজি ও আখের চাষে বিপ্লবীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করত । ফলে এই খামারটি ত্রিপুরারাজ্যের এবং ব্রিটিশ পুলিশের দৃষ্টিগোচর হয়নি ( জেলে ত্রিশ বছর ও পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম–ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী-কলকাতা পৃষ্ঠা-১৪ ) ।
পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে আরও দুই একটি স্থানে এরকম কৃষি খামার গঠন করে গোপনে বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিচালনা করা হত । ১৯১২ সালের দিকে কৈলাশহরের মূর্তিছরা টি এস্টেট এলাকায়ও একটি কৃষিখামার স্থাপিত হয়েছিল । এই কৃষি খামারটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন মাধবলাল চ্যাটার্জি ও গিরিজা দত্তসহ সেসময়ের অন্যান্য বিপ্লবীরা । ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার নিজেদের করায়ত্ব করে নিয়েছিলেন । এই ঘটনাটি সে সময়ে নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত তরুণদের মনে প্রেরণা জুগিয়েছিল । চট্টগ্রামের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের সঙ্গে ত্রিপুরার দুই স্বাধীনতা সংগ্রামী উমেশ লাল সিংহ ও শচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল । এই দুজনের সহযোগিতায় অনন্ত সিংহ ত্রিপুরার রাজার অস্ত্রাগার থেকে একটি রাইফেল ও বেশ কিছু পিস্তল ও গোলাবারুদ চুরি করেছিলেন । ১৯৩০ সালে অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সময় ব্যবহৃত একটি রাইফেল ইংরেজরা ত্রিপুরার রাজ সরকারের বলে সনাক্ত করে ।
১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলার উমাকান্ত একাডেমি এবং তুলসীবতী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আগরতলায় তাদের স্কুলের সামনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিল । এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ত্রিপুরার রাজসরকার পূর্ণিমা মুখার্জি, সরস্বতী বসাক, ফটিকসেন, বিজয় মুখার্জি সহ আরো কয়েকজনকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন । ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে এপ্রিল এক ঘোষণার দ্বারা শচীন্দ্রলাল সিংহকে এক বছরের জন্য রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন । ঘোষণাটি ছিল–
Where as it appears that ex detenue Sachindralal Singha son of Dinadayal Singha of Agartala, has for sometime past been making seditious and inflammatory speeces in different parts of the state which are calculated to promote this satisfaction, hatred and ill will among the people against the government of the state and where as it is hereby ordered that the said Sachindralal Singha be externed from the state for a period of one year for the present. ( ত্রিপুরা স্টেট গেজেট সংকলন–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা. ৬৫-৬৬ ) । জানা যায় যে, রাজাদেশে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হলেও শচীন্দ্রলাল সিংহ সে সময়ে চট্টগ্রামের ও রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতেন । এ সময়ে তিনি সাব্রুমের প্রাচীন অধিবাসী প্রয়াত নিতাই মজুমদারের পিতৃদেব অম্বিকা মজুমদারের বাড়িতে প্রায়ই ফেনীনদী পেরিয়ে ওপার থেকে চলে আসতেন । পরবর্তী সময়েও শচীন্দ্রলাল সিংহের সঙ্গে এই পরিবারের নিবিড় সম্পর্ক ছিল ।
চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির বিপ্লবীদের অধিকাংশের সঙ্গে মাস্টারদা সূর্যসেনের যোগাযোগ ছিল । দেশভাগের পরে তাঁদের অনেকে সাব্রুমে ও বিলোনিয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন । বিলোনিয়ায় বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের ঘনিষ্ঠ বিনোদ দত্ত, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী ( হারান দত্ত, যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে রয়েছে ), অমরকৃষ্ণ সরকার, রেবতী পাল, অনাদিরঞ্জন চৌধুরী প্রমুখগণ । সাব্রুমে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে পাঁচভাই হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক, তেজেন্দ্র ভৌমিক,খগেন্দ্র ভৌমিকসহ আশুতোষ দে, বিভূতি চক্রবর্তী, সুধীর চক্রবর্তী, মনীন্দ্র ঢালী, যোগেশ চক্রবর্তী প্রমুখগণ বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন । ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে তাঁদের কেউ কেউ সীমান্ত পেরিয়ে সাব্রুমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মগোপন করতেন । মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী বিপ্লবীদের একটা অংশ এবং পূর্বোক্ত ভৌমিক পরিবারের পাঁচভাই সাব্রুমের পশ্চিম দিকে হার্বাতলী-বেতাগার গভীর অরণ্যে কৃষিখামার গড়ে তুলেছিলেন । এখানেও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় দিনের বেলায় কৃষি কাজ করা হত । স্থানীয় মানুষেরা এখানে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন । রাত্রিবেলা বিপ্লবীরা এখানে রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন । বিপ্লবীরা বেতাগার জঙ্গলে একটি চানমারিও গড়ে তুলেছিলেন । ভৌমিকদের পাঁচ সহোদর ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে প্রত্যেকেই কয়েকবছর করে কঠোর সাজা ভোগ করেছিলেন । ভারতবিভাগের পর এই ভ্রাতৃবর্গের মধ্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক ও কিরণ ভৌমিক এপাড়ে চলে এসে বিপ্লবীদের সৃষ্ট খামারবাড়িতে স্থায়ী বসবাস করতে শুরু করেন । তেজেন্দ্র ভৌমিক ও খগেন্দ্র ভৌমিক কিছুদিন অবস্থান করে আবার দেশের বাড়িতে ফিরে যান । যাঁরা এদেশে রয়ে গেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই স্বধীনতা সংগ্রামীর সম্মান, পেনশন ও তাম্রপত্র পেয়েছেন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অ্শগ্রহণকারী এই নীরব বিপ্লবীদের কথা ইতিহাসে আজও তেমনভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি । সেই পরিবারের উত্তরসূরী শান্তিপ্রিয় ভৌমিক স্বাধীনতাসংগ্রামীর বহমান রক্তধারা নিয়ে রাজ্যরাজনীতির সঙ্গে সসম্মানে জড়িত । সজ্জন ও স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতীক এই যুবক ।
বিলোনিয়ার কিরীট বিক্রম ইনস্টিটিউশন এর ছাত্ররা সে সময় নোয়াখালি জেলার কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন । তাঁরা ১৯৪২-৪৩ সালে বিলোনিয়া ও অন্যত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । সেসময়ের বিলোনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগাবাবু শান্তিময় বর্ধনের লেখা এক গোপন সরকারি চিঠি থেকে জানা যায় যে, বিলোনিয়া হাই স্কুলের ছাত্ররা নোয়াখালির ছাত্রদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল এবং তারা ব্রিটিশ অধিকৃত জেলায় ও রাজন্যশাসিত ত্রিপুরায় বড় ধরনের আন্দোলন সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল । তারা উদয়পুর, আগরতলা এবং কৈলাশহরের ছাত্রদের কাছেও এই ধরনের আন্দোলন শুরু করার জন্য যৌথ আবেদন জানিয়েছিল ( Reports B-3, S-9, Tripura Assembly records ) ।
রাজন্য ত্রিপুরার অভ্যন্তর থেকে পরিচালিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সে সময়ে ত্রিপুরারাজ্যের সন্নিহিত মহারাজার জমিদারি চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের মধ্যে কুমিল্লা নোয়াখালি ও পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিলেন । সেকারণেই দক্ষিণ ত্রিপুরা বলে চিহ্নিত না হলেও ত্রিপুরার দক্ষিণ অঞ্চলে তার প্রভাব বেশি মাত্রায় পড়েছিল । বিশেষত, দক্ষিণ ত্রিপুরা অঞ্চল ছিল অরণ্যসংকুল এবং বিরল জনবসতিপূর্ণ যা বিপ্লবীদের পক্ষে অনেকটা সহায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । এছাড়া আইনগত ও ভৌগোলিক উভয় দিক দিয়েই ত্রিপুরা রাজ্য ছিল তাদের কাছে কম ঝুঁকিপূর্ণ । ব্রিটিশ পুলিশ ইচ্ছা করলে রাজ্যে প্রবেশ করে কোন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করতে পারত না । আর ত্রিপুরার দক্ষিণ প্রান্তের খবর অনেক সময় ত্রিপুরার রাজসরকারের কাছে গিয়ে পৌঁছাত না । বিপ্লবীরা ও এখানে অবস্থানকালে সবসময় সতর্ক থাকতেন যাতে তাঁরা স্থানীয় জনসাধারণ বা রাজতন্ত্রের সাথে অনুরূপ ঝামেলায় বা সংঘাতে জড়িয়ে না পড়েন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা আজও অনালোকিত ও অনালোচিত রয়ে গেছে । আর সময় থাকতে তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করলে তা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে ।