ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হলেও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র । এখানে সরকার কর্তৃক ছয়টি স্বীকৃত ধর্ম হল– ইসলাম, খ্রিস্টানদের দুটি গ্রুপ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও কনফুসিয় । জনসংখ্যার ৮৬.১শতাংশ মুসলমান, ৮.৭ শতাংশ খ্রিষ্টান, এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৩ শতাংশ । ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়াতে ৪৬,৪৬,৩৫৭ জন হিন্দু আছে । ইন্দোনেশিয়া মিশ্র সংস্কৃতির দেশ । ইন্দোনেশিয়া আগে কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের ( দ্বীপপুঞ্জের ) সমষ্টি ছিল । তাদের নাম ছিল জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণিও, বালি ইত্যাদি । খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করে । খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় এক হাজার বছর ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল । সে হিসেবে তারা হিন্দু ধর্মকে অনুসরণ করেছিল । রাজারা হিন্দু দেবতাদের উপাসনা করতেন এবং বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ।
ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে রামায়ণের কাল থেকে । যবদ্বীপ বা জাভা-র কথা ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়ণের উল্লেখ আছে । সুগ্রীব সীতার খোঁজে তাঁর সৈন্যদের জগতে পাঠিয়েছিলেন । ইন্দোনেশিয়া নামটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) থেকে এসেছে যার অর্থ ভারত এবং গ্রিক 'মেসোস' থেকে যার অর্থ দ্বীপ । এখানে সিন্ধু নদ বা সিন্ধু সভ্যতা না থাকলেও উভয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের কারণে এই নামকরণ হয়েছে । ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । জাভাতে প্রম্বানানের খোলা থিয়েটারে জাপানিজ মুসলমানরা পূর্ণিমার রাতে রামায়ণ নৃত্য পরিবেশন করে । ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে গভীর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের উদাহরণ নবম শতাব্দীর বোরোবুদুর এবং প্রম্বানান মন্দির । শৈলেন্দ্র রাজবংশের দ্বারা নির্মিত বোরোবুদুর মন্দিরের নকশা ভারতীয় গুপ্ত স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে । মধ্য দফার প্রম্বানান মন্দিরে হিন্দু স্থাপত্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ইন্দোনেশিয়া মৌখিক ঐতিহ্য ও সাহিত্যের পান্ডুলিপি সংরক্ষণের লিপি ছিল সংস্কৃত । ইন্দোনেশিয়ায় আবিষ্কৃত অষ্টম শতাব্দীর প্রাচীন শিলালিপি গুলো যেমন 'কাংগল' শিলালিপি, তেমনি প্রথম সহস্রাবদের মুর্তিকল্পে শিবলিঙ্গ ও তার সঙ্গী দেবী পার্বতী, গণেশ, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, অর্জুন ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর ব্যাপক গ্রহণ নিশ্চিত করে । বালি, সুমাত্রা ও অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে হিন্দু সংস্কৃতির পুরোমাত্রায় বহমান এবং ইন্দোনেশিয়ায় ভারতের এই সংস্কৃতি যথেষ্ট সমাদর করা হয়ে থাকে । ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের গৌরবজ্জ্বল অতীত তারা বিসর্জন দেয়নি । বরং উত্তরোত্তর তার পরিচর্যা পরিবর্ধন করে দেশটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে ।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও হিন্দু ধর্মের অনেক দেবদেবীকেই ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত পবিত্র পাখি গরুড়েএর নামেই ইন্দোনেশিয়ার সরকারি বিমান সংস্থা 'গরুড়' এয়ারলাইন্স নামকরণ করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থার সরকারি ম্যাস্কট হল 'হনুমান' । তাদের লোকো কাহিনীতে 'নাগ' নামে সর্পপ্রতিম চরিত্র পাওয়া যায় । অনেক জায়গায় দেওয়ালে কুবেরের চিত্র অঙ্কিত হতে দেখা যায় । জাকার্তার সেন্ট্রাল পার্কে একাদশ ও বাহিত রথে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে সওয়ার হওয়ার স্থাপত্য ও দেখা যায় ।
No comments:
Post a Comment