সমুখে শান্তি পারাবার
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
শিক্ষকতা কখনই পেশা নয় । ব্রত । আর এই ব্রতের সিদ্ধি আসে জীবনের শেষ প্রান্তে । ব্রতফল দিয়ে যায় গর্বিত অনুভব । অনর্বচনীয় প্রশান্তি । আজ শিক্ষক দিবসে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম সাব্রুমের দৌলবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে । আমার সঙ্গে মঞ্চে যাঁরা ছিলেন, বিদ্যালয় পরিদর্শক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, রাজ্যপাল পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক, এস এম সি কমিটির কর্মকর্তগণ প্রত্যেকেই আমার একসময়ের ছাত্র । বিদ্যালয়ের একটা বড়ো অংশের শিক্ষক আমার ছাত্র, কাউকে আবার ডিএল এড ও অন্যান্য ট্রেনিং প্রোগ্রামে পেয়েছি । বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে উচ্চশ্রেণিতে পাঠরত কয়েকজনকে আমি পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ে আমার চাকুরির শেষলগ্নে একেবারে নিচের ক্লাসে পেয়েছিলাম । বেশ কয়েকঘন্টা আমার জীবনের বিভিন্নসময়ের শিক্ষার্থীপরিবৃত হয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিল । দেখছিলাম স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিভাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁরা । মনে মনে খুঁজছিলাম, তাঁদের কর্মতৎপরতার মধ্যে আমার অতীতের কর্মচঞ্চলতার কোনো অনুকৃতি আছে কিনা । আমি বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলাম । বর্তমানে বিদ্যালয় পরিদর্শক আমার ছাত্র জানাং মগ । জানাং শব্দটি পালি । সংস্কৃত জ্ঞানং থেকে পরিবর্তিত । মগ জনজাতিরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । সেকারণেই মগভাষায় ত্রিপিটকসূত্রে বহু পালি শব্দ রয়েছে । গত শতাব্দীর আট-নয়ের দশকে আমি ছাত্র হিসাবে পেয়েছি জানাংকে । বর্তমানে কঠিন দায়িত্ব সামলাচ্ছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলীপ দাস ও দিলীপ দেবনাথও আমার ছাত্র । দিলীপ দাস বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত । দিলীপ দেবনাথ রাজ্যপাল পুরস্কার প্রাপ্ত । শারীরিক সমস্যাকে সরিয়ে রেখে তাঁরা দুজনেই স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের নিয়ে মেতে আছেন । শিক্ষকদের মধ্যে যদুগোপাল দেবনাথ, শক্তিম দাস নিজ নিজ গুণ বিস্তার করে ছাত্রছাত্রীদের মনে স্থান করে নিয়েছেন । রামকৃষ্ণানুসারী যদুগোপাল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও গুছানো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন । গুণী শিক্ষক শক্তিম দাস চিত্রে চিত্রে ভরিয়ে দিয়েছেন স্কুলের দেয়াল । প্রতিবছর শিক্ষক দিবসে প্রকিশিত হয় বিদ্যালয়ের দেওয়ালপত্রিকা 'নতুন কুঁড়ি' । শিক্ষার্থীদের লেখালেখিতে পূর্ণ এই পত্রিকার সামগ্রিক অলংকরণ রক্তিমের । ২০০৭ সালে এই বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অর্জুন শর্মা ছাত্রছাত্রীদের মননচর্চা বিকাশের লক্ষ্যে এই দেওয়াল পত্রিকার সূত্রপাত করেছিলেন । আজও তাঁর ও আমার সুযোগ্য ছাত্র শক্তিম দাস ফলেফুলে ভরিয়ে তুলছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণ এইসব শিক্ষকদের প্রচেষ্টারই সুবর্ণফসল । আরও যাঁরা শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন প্রত্যেকেই অত্যন্ত আন্তরিক ও অমায়িক । শিক্ষকতার ব্রতফল আমার জীবনসায়াহ্নে এই অনির্বচনীয় তৃপ্তি এনে দিয়েছে । দিয়েছে শান্তির বারি ।
No comments:
Post a Comment