শ্রাদ্ধ থেকে মঠোৎসর্গ : ত্রিপুরায় প্রচলিত লোকাচারে পূর্বপুরুষপূজা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাস । চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ত্রিপুরার রাজার জমিদারি ছিল ।ত্রিপুরার রাজন্যআমলের জমিদারিত্বেও বাঙালির বসতি ছিল । রাজনৈতিক কারণে দেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেলে এই অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় । ফলে এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্ত হয়ে তদানিন্তন পার্বত্য ত্রিপুরা তথা বর্তমান ভারতভুক্ত ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন । নিজেদের ভদ্রাসন, সহায় সম্পদ, সে দেশে ফেলে এলেও পূর্বপুরুষের কাল থেকে নিজেদের রক্তধারায় প্রবাহিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কিন্তু সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন । সে কারণেই ত্রিপুরার বাঙালি সংস্কৃতি মূলত পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার ।
সেভাবেই এখানেও জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পালিত শাস্ত্রীয় ও লোকাচারেও পূর্বপুরুষদের পালিত আচার-আচরণ অনুসরণ করা হয় । মৃতের সৎকার বা দাহকার্য ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়কালের মধ্যে আরো কিছু ছোটোখাটো অবশ্য পালনীয় লোকাচার রয়েছে । মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত লোকাচার পালন করা হয় সেগুলো প্রকৃতপক্ষে 'টোটেম পূজা' বা 'পূর্বপুরুষ পূজা'র নামান্তর । এই পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে একটা ঈশ্বর ভাবনা নিহিত থাকে । ঈশ্বর ভাবনার মূলে রয়েছে প্রত্নমানুষের ভয়, বিস্ময় আর অজ্ঞানতা । আদিম মানুষ হিংস্র প্রাণী, প্রকৃতির রহস্য, পাহাড়-পর্বত, নদী আকাশ, ঝড়, বজ্রপাত ইত্যাদিকে যেমন ভয় করতে শিখেছিল তেমনি তারা মৃত্যুকেও ভয়ের চোখে দেখত । তারা লক্ষ্য করত যে মানুষটি এতদিন তাদের সঙ্গে কর্মচঞ্চল ছিল সেই মানুষটি হঠাৎ নিথর হয়ে যায় । আকস্মিক ঘটনাটিতে তাদের মনে ভয়ের উদ্রেক হয় এবং এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানারকম অকল্যাণ চিন্তা করতে থাকে । প্রকৃতির বুকে ঘটে যাওয়া নানা বিপর্যয়কে তারা তাদের মৃত আত্মার অসন্তুষ্টির কারণ বলে মনে করতে থাকে । আত্মাকে ঘিরেই তাদের জীবনের নানারকম ক্ষতিকর প্রভাবের সম্পর্ক ভাবতে থাকে । ফলে মৃতব্যক্তির আত্মাকে সন্তুষ্ট করার তাগিদ অনুভব করে প্রত্নমানুষ । মৃতব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার আচার অনুষ্ঠানই হল পূর্বপুরুষ পূজা । ভারতের প্রাকবৈদিক যুগের সভ্যতার ধারক ও বাহক বিভিন্ন প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ দেখা যায় । অস্ট্রিক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মানুষেরা বৃক্ষ পাথর নদী, বজ্র, বিদ্যুৎ ও বিশেষ স্থানকে পবিত্র জ্ঞান করে তার উপর দেবত্ব আরোপ করে পূজা করত । তাদের অনেকে মূর্তি পূজা না করে কোন বিশেষ বিশেষ গাছের তলায় অথবা বিশেষ কোন স্থানে বড়ো বড়ো পাথর রেখে সেই পাথরকে মঙ্গলকারী দৈবীশক্তি হিসেবে মনে করে পূজা করত ।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক ক্রিয়ানুষ্ঠান ও লোকাচার রয়েছে । বাঙালির বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষ পূজারই ক্রমউত্তরণ । গবেষকদের মতে বাঙালির প্রায় সমস্ত লোকাচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এ দেশের কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, খেড়িয়া, বীরহোড় প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পূর্বপুরুষ পূজা সেই অস্ট্রিক উত্তরাধিকার । পরবর্তী সময়ে বাঙালি পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে । ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন– 'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক সম্পর্কে ধারণা, প্রেততত্ত্ব, পিতৃ তর্পণ, পিন্ডদান, শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান, আভ্যুদয়িক ইত্যাদি সমস্ত আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান ।' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা, ৬০৭ ) । পূর্বপুরুষগণ বা পিতৃপুরুষগণ ভারত ও চিনে অতি প্রাচীনকাল থেকেই গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মানের পাত্র । বহুকাল আগে থেকেই মৃতব্যক্তির আত্মাকে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হয় এবং নানা আচার-আচরণের মাধ্যমে মৃতের সন্তুষ্টি বিধান ও পরিবারের মধ্যে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়াস নেওয়া হয় ।
বাঙালির মৃত্যুবিষয়ক সংস্কারগুলোর মধ্যে সৎকারপরবর্তী ও শ্রাদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালকে বলা হয় 'অশৌচকাল' । এই অশৌচকালীন সময়ে মৃতের পুত্র সন্তানেরা 'মাঠা' ( সাদা থান কাপড় ) পরিধান করতে হয় । সঙ্গে কুশাসন ও যষ্টি ব্যবহার করতে হয় । যষ্টি অর্থাৎ একটি হাত দেড়েক বাঁশের কঞ্চির মাথায় একটা পেরেক গেঁথে তা ব্যবহার করা হয় । গলায় পরিধেয় কাপড় থেকে সংগ্রহ করা সরু ফালি গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয় । সেই ফালিতে লোহা বা সিসের টুকরো ব্যবহার করা হয় । এই ফালি বা ধড়ায় ব্যবহৃত ব্যবহৃত লোহা বা সিসে এবং যষ্টিতে ব্যবহৃত পেরেক মৃতের সন্তানকে আত্মার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে । ধড়াটি ব্যবহার করারও বিধি রয়েছে । যদি ধড়াটি ডান বগলের তলায় দিয়ে এনে গলায় ঝুলানো হয় তাহলে ওই ব্যক্তির পিতৃবিয়োগ ঘটেছে বলে ইঙ্গিত করে । অনুরূপভাবে বাঁ বগলের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে গলায় ঝুলালে মাতৃবিয়োগের বিষয়টি চিহ্নিত করে । আসলে বিষয়টির মধ্যে সামাজিক সহমর্মিতার বোধ নিহিত রয়েছে । বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পিতা বা মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করে ভাগ্যহীনকে বিষাদাচ্ছন্ন হতে হয় না । প্রিয়জন বা পরিচিতজনেরা বেশভূষা দেখেই বুঝতে পারেন । তাঁরাও বিষয়টির পুনরুদ্রেক ঘটান না । অশৌচ পালনের কয়দিন মৃতের পুত্রগণ তৃণশয্যায় শয়ন করেন । হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন । ওই কয়দিন স্নানের পর নির্দিষ্ট একটি স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে পানীয় ও ফলাহার নিবেদন করেন । পানীয় নিবেদনেরও একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছে । পাশাপাশি দুটো ছোটো বাঁশের খুঁটিতে আড়াআড়ি একটি বাঁশ বেঁধে তার মধ্যে বাঁশের নলি ঝুলিয়ে সেই নলিতে জল নিবেদন করা হয় । নলির তলায় সুতলি বা কাপড়ের টুকরো জাতীয় কিছু বেঁধে দেওয়া হয় যাতে নলি থেকে জল ছুঁয়ে চুইয়ে পড়ে । যেখানে এই জল পড়ে সেখানে মাটির উপরে এক বিশেষ ধরনের দূর্বা ( ঘোড়া দূর্বা ) বসিয়ে রাখা হয় । লোকবিশ্বাস, এই দূর্বা যদি সতেজ থাকে ও বৃদ্ধি পায় তাহলে মৃতের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখ ও শান্তিময় হবে । মৃতের উদ্দেশ্যে যে ফল জলাদি নিবেদন করা হয় তা সন্তানের জন্য সংগৃহীত আহারাদির প্রথম অংশ । মৃতকে নিবেদন না করে তাঁরা আহার্য গ্রহণ করেন না । এই ফলাহার নিবেদনের সময় 'আয়, আয়' বলে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো হয় । এই আচারটিকে 'কাকবুলি' বলা হয় । লোকবিশ্বাস রয়েছে এই সময়ে মৃতের আত্মা শকুন, কুকুর, কাক প্রভৃতি ইতর প্রাণীর রূপ ধরে ধারণ করে থাকে । ভক্তিপূর্ণ চিত্তে আহ্বান জানালে কাকরূপী আত্মা এসে সেই খাবার খেয়ে যান । অশৌচকালীন সময়ের মধ্যে শনি, মঙ্গলবার অথবা অমাবস্যা ভিন্ন যে কোন তিনটি শুভ দিনে তিনটি মাটির হাঁড়িতে উঠোনের এক কোণে লাকড়ির চুলায় আতপান্ন রান্না করে উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় । মৃতের জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্র এটি প্রস্তুত করেন এবং রান্নার সময় মৌন থাকেন । এটাকে 'পাতিল পোড়া' বলা হয় । এই 'পাতিল' উত্তরপ্রজন্মের কল্যাণকামনায় পোড়ানো হয় বলে লোকবিশ্বাস । রান্নার সময় মাটির হাঁড়িটি যদি তাপে ফেটে যায় তাহলে পরিবারের ভবিষ্যৎ অকল্যাণের আশঙ্কা করা হয় । অশৌচের সমাপ্তিদিনে মস্তকমুন্ডন, স্নানাদি করে শুদ্ধ হয় । অশৌচকালীনসময়ে মৃতের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জল ও খাবার নিবেদনের জন্য তৈরি করা বাঁশের নলিগুলোও অন্যান্য সামগ্রী সেইসঙ্গে জলে বিসর্জন দেওয়া হয় । পরদিন ব্রাহ্মণবিধিমতো শ্রাদ্ধকার্য করা হয় ।
এছাড়াও, এই অঞ্চলে শ্রাদ্ধোত্তর সময়ে পর পর কয়েকটি লোকাচার পালন করা হয় । এগুলো হলো ১. ভাত বাড়ানি ২. মৎস্যস্পর্শ বা মাছ ছোঁয়া ৩.অস্থিবিসর্জন ও ৪. মঠোৎসর্গ । শ্রাদ্ধের দিন রাত্রিবেলা মৃতের কন্যা পুত্রবধূ ও অন্যান্যরা মিলে মৃতের উদ্দেশ্যে অন্নব্যঞ্জন, পিঠেপায়েস, মিষ্টি খাবার ইত্যাদি প্রস্তুত করেন । মৃত ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় যেসব খাদ্য খেতে ভালোবাসতেন সেগুলোসহ তাঁর পছন্দের পিঠেপুলি ইত্যাদি তৈরি করা হয় । তাঁর জন্য ( জীবদ্দশায় অভ্যাস থাকলে ) পান তামাক ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করা হয় । এ সময় শ্রাদ্ধবাসরে বিশেষ কীর্তন চলতে থাকে । কীর্তনের শেষে মৃতের সন্তানগণও পরিবার-পরিজন মৃতের উদ্দেশ্যে রোদন করেন ও ধুলোয় গড়াগড়ি যান । এই গান যে শিল্পী পরিবেশন করেন তিনি এক বিশেষ ধরনের পোশাক ব্যবহার করেন । দক্ষিণ ত্রিপুরায় এই কীর্তনকে 'হটিকীর্তন' বলা হয় । কীর্তনে নিমাইসন্ন্যাস, হরিশচন্দ্রের শ্মশানমিলন ইত্যাদি বিয়োগান্তক পালাকীর্তন পরিবেশন করা হয় । শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতিপুষ্ট অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরার শ্রাদ্ধবাসরেও এই ধরনের কীর্তন পরিবেশনের আচার রয়েছে । তাকে 'যমকীর্তন' বলা হয় । দক্ষিণ ত্রিপুরার হটিকীর্তনের সঙ্গে তার পরিবেশন প্রকরণে তারতম্য থাকলেও কিন্তু একই উদ্দেশ্য ফল্গুধারার মত প্রবাহিত । গোষ্ঠলীলার বিষয়ে যেমন মায়ের সঙ্গে সন্তানের ক্ষণিক বিচ্ছেদ বেদনার আবহাওয়া রয়েছে তেমনি নিমাই এর সন্ন্যাসযাত্রা ও এক বিচ্ছেদ বিধূর কাহিনি, তেমনি ভাগ্যদোষে রাজা হরিশচন্দ্রেরও স্ত্রীপুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্মশানচন্ডালের জীবিকায় দিনযাপন ও বেদনাঘন । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এই পালাগুলো নির্বাচনের মধ্যেও অনির্দেশের পথে চলে যাওয়া প্রিয়জনের জন্য বেদনার সুরটিই ধ্বনিত । সেই বেদনার প্রকাশের প্রতীকী রূপ এই জাতীয় সংগীত । স্থানভেদে প্রকাশভঙ্গি আলাদা কিন্তু অভিপ্রায় এক ।
এরপর বাড়ির পাশে একটি নির্জন স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে খাদ্য পরিবেশন করা হয় । এই লোকাচারটি 'ভাত বাড়ানি' বলা হয় পরিবারের সমস্ত সদস্যরাও আত্মীয়-স্বজন রাতের খাবার গ্রহণ করেন । এখানে আর একটি লোকাচার পালিত হয় । এই রাতে খাওয়ার জন্য এমন কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করা হয় যাদের পিতামাতা উভয়ই পরলোকগত । তাদের খাদ্য গ্রহণের এই আচারটিকে বলা হয় 'ভুরিভোজ' । খাওয়া দাওয়ার পর উপস্থিত সবাই মৃতের উদ্দেশ্যে যেখানে খাদ্য নিবেদন করা হয়েছে সেখানে গিয়ে যাচাই করেন সমস্ত খাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে কিনা । কোন ইতর প্রাণীও যদি সেই খাবার খেয়ে যায় তাহলে সবাই খুশি হন । কোনো ইতর প্রাণী এসে এই খাবারের স্বাদ নিলে মৃতের আত্মা সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন । পাশাপাশি তাঁরা আত্মার কাছে প্রার্থনা করেন যে, তিনি যেন তাঁর পরিবারকে ভুলে না যান এবং অলক্ষ্যে থেকে পরিবারটিকে ভালোবাসেন এবং তাদের সুখশান্তির জন্যে আশীর্বাদ করেন । আর অভুক্ত খাবার পড়ে থাকলে কোথাও ত্রুটি হয়েছে মনে করে মৃতের উদ্দেশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করেন এবং আহার গ্রহণের জন্য মৃতের আত্মাকে আমন্ত্রণ জানান । এই আচারটি আবার কোথাও কোথাও বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন করা হয় । লোকবিশ্বাস, মৃতের আত্মা একবছর তাঁর বাড়িঘরের, পরিবারের আশেপাশেই বিচরণ করেন । সেসময় তিনি অভুক্ত থাকেন । বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন খাবার গ্রহণের পর আত্মা প্রেতলোকে চলে যায় ।
শ্রাদ্ধের পর তিন দিনের মধ্যে সেরে নিতে হয় মৎস্য স্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুষ্ঠান । শনি, মঙ্গলবার, অমাবস্যার ইত্যাদি দিন বাদ দিয়ে অতি দ্রুত এই অনুষ্ঠান সেরে ফেলা হয় । এ দিন মূলত মৃতের পুত্রের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে এই আচার পালিত হয় । আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই এক পংক্তিভোজনে মিলিত হয়ে মৃতের পুত্রগণ মাতুল ও ব্রাহ্মণের নিকট থেকে মৎস্যস্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুমতি আদায় করে । সেদিন থেকে তাদের আর নিরামিষ আহার করতে হয় না । এরপর সময় সুযোগ করে মৃতের পুত্রদের মধ্যে কেউ কেউ শবদাহের পর সংগৃহীত অস্থি পবিত্র কোন নদীতে বিসর্জন দেন । কেউ কেউ এ সময় গয়াতে গিয়ে পিন্ডদান করেন । তারপর অস্থি নিয়ে প্রয়াগে ত্রিবেণীসঙ্গমে মস্তক মুন্ডন করে তা বিসর্জন দেন । হিন্দুসমাজে এ নিয়ে সুন্দর শাস্ত্রীয় আচার রয়েছে । শাস্ত্রকাররা বলে গেছেন, 'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা' এবং 'পুত্র পিন্ড প্রয়োজনম' । পুত্রের জন্য স্ত্রী এবং পিন্ড লাভের জন্যই পুত্র । এই হল পূর্বপুরুষ পূজার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । পিতৃতর্পণ, শ্রাদ্ধকর্ম ও অন্যান্য পারলৌকিক শাস্ত্রীয় কর্মে পিণ্ডদানের বিশেষ বিধি রয়েছে । সারাদেশেই তা নানাভাবে নানারূপে প্রচলিত । পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্বতন্ত্রভাবে এই আচার পরিলক্ষিত হয় । এই লোকাচারটিকে কেন্দ্র করে একটি প্রবাদ আছে–'প্রয়াগে মুড়াইয়া মাথা পাপী যায় যথা তথা ।' হটিকীর্তনের গানেও পদ রয়েছে–'গয়া গঙ্গা গিয়া পুত্র ধরে তিল কুশ / একে একে উদ্ধার করে সপ্ত পুরুষ ।'
এভাবে বছর ঘুরে এলে মৃত্যুতিথিতে বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করা হয় । এর আগে প্রতিমাসে একটি করে বারো মাসে বারোটি মাসিক শ্রাদ্ধের বিধি থাকে । যদি সম্ভব না হয় তাহলে বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন সব কয়টি অসম্পূর্ণ শ্রাদ্ধ একসঙ্গে করতে হয় । এদিন আরেকটি লোকাচার পালিত হয় । সেটির নাম হচ্ছে মঠোৎসর্গ । মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পারিবারিক শ্মশানভূমিতে এই মঠ নির্মাণ করা হয় । এই মঠ ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উৎসর্গ করা হয় । এখানে লোকাচারটি হল, এই বিশেষ মঠটি নির্মাণের সম্যকব্যয় নির্বাহ করে মৃতের কন্যাপক্ষ । অর্থাৎ, এখানে কন্যাকে পরের ঘরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলেও, তার গোত্রান্তর ঘটলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনটি যে ছিন্ন হয় না তাই প্রমাণ করে । কন্যাও সাধ্যমত ব্যয়ের মাধ্যমে পিতা-মাতার মঠ নির্মাণ করে দেয় । লোকাচার রয়েছে, পিতামাতার মঠোৎসর্গকালে কন্যাকে 'আড়াই-অ'র ( আড়াই অক্ষর ) কান্নাকাটি করতে হয় । কোন মাপকাঠিতে এই 'আড়াই অক্ষর' নিরূপন করা হয় তা এই প্রতিবেদক সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি । মঠোৎসর্গ উপলক্ষ্যে নামসংকীর্তন ও ভোজের আয়োজনও করা হয় ।
এভাবে পূর্বপুরুষপূজার মাধ্যমে মৃতমানুষের প্রেতযোনি মোচনের জন্য নানা প্রকার শাস্ত্রবিধি ও আচার-আচরণ পালন করা হয় । তারপরেও মানুষের মনে পূর্বপুরুষের প্রতি আরো কিছু শ্রদ্ধাবোধজনিত কর্ম থেকে যায় । পিতৃপুরুষকে মানুষ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে । দেবতারা যেমন মন্দিরে অবস্থান করেন সেরকম মৃত আত্মার অবস্থানের জন্য এই মরভূমিতে তাঁদের জন্য মন্দির নির্মাণ করা হয় । পিতৃপুরুষের জন্য নির্মিত এই মন্দিরকে সমাধিসৌধ, সমাধিমন্দির, স্মৃতিমন্দির, স্মৃতিসৌধ বা মঠ বলা হয় মৃত্যুর পর অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং মঠনির্মাণ পিতৃত্বের প্রতি ধার্মিকতার নিদর্শন । পূর্বে আলোচনা করেছি যে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক বিষয় ও বস্তু এবং বিশেষ কোন স্থানের প্রতি আদিম মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল । ঠিক সেইরকম পূর্বপুরুষের সৎকারভূমি তথা শ্মশানভূমিও একটি পবিত্র স্থান । পিতৃপুরুষের শ্মশানভূমির মতো পবিত্র স্থানে মন্দির বা মঠ নির্মাণ সেই চিন্তা থেকেই এসেছে । পবিত্রস্থানের উপর দেবত্ব আরোপের ফলে শ্মশান ও সেখানে নির্মিত মঠ ধর্মীয় শ্রদ্ধার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে । অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠী যেমন কোন পবিত্র স্থানে পাথর প্রতিষ্ঠিত করে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজা করতেন সেরকম হয়তো একসময় শ্মশানেও বড় পাথর রেখে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হত । পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে শ্মশান ক্ষেত্রে মঠ নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসে । পূর্ববাংলা ও তৎসন্নিহিত ত্রিপুরার বাঙালি জনগোষ্ঠীর মঠ নির্মাণের পেছনে গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । মঠ নির্মাণের পর মঠের দেওয়ালে হরিনাম মহামন্ত্রের 'ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর' লিখিত থাকে । এছাড়া মৃতের নাম, জন্ম তারিখ, ও মৃত্যু তারিখ ও উল্লেখ থাকে মঠের দেয়ালে । মঠের চূড়া শঙ্কু আকৃতির হয় এবং ভিত থেকে দেওয়াল চতুষ্কোণ বা অষ্টভুজাকৃতি হয় । মঠের চূড়ায় কলস ও ত্রিশূল স্থাপিত হয় । ত্রিশূল শৈবধারার প্রতীক । আবার শ্মশান হল দেবী কালিকার স্থান । ফলে শ্মশান মঠকে নিয়ে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবীয় ধর্মধারার একটা মিশ্রণ ঘটার সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না ।
উত্তরপ্রজন্ম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় এই মঠ তৈরি করেন যাতে মৃত্যুর পরেও পূর্বপুরুষের স্মৃতি উত্তরপুরুষের অন্তরে জাগ্রত থাকে । কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায় আমরা পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের ভালোবাসার নিদর্শন পাই– 'আমাদের কালিদহ–গাঙুড়–গাঙের চিল তবুও ভালোবাসা / চায় যে তোমার কাছে–চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে / এই দহে–এই চূর্ণ মঠে–মঠে–এই জীর্ণ বটে বাঁধো বাসা । ( শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ–জীবনানন্দ দাশ ) । স্মৃতি মানুষকে পিছু টানে । পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে উঠে আসা মানুষের মনের মধ্যেও বাসা বাঁধে পূর্বপুরুষের স্মৃতি এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঠের দৃশ্য । কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ও এমন স্মৃতিচিত্র 'চতুর্দশীর অন্ধকারের' মত জেগে থাকে–'সবাই আমার মুখ দেখে না আমি সবার মুখ দেখি না / তবু তোমার মঠ ছেড়ে যাই না / চতুর্দশীর অন্ধকারে তোমার বুকে আগুন দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি / একা / এইখানে চুপ করে এইখানে ডোবা পেরিয়ে ঝুমকাফুলের মাঝখানে / ঠাকুরদার মঠ ।' আদিম লতাগুল্মময় ( ১৯৭২ ) কাব্যগ্রন্থে সংকলিত এই কবিতাটির নাম 'ঠাকুরদার মঠ' । প্রতিদিনের চলমান বৃত্ত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এই মঠের মধ্য দিয়েই প্রিয় মানুষগুলোর স্মৃতি আমৃত্যু বুকের ভেতর বেঁচে থাকে । অনেকদিন পরে লেখা কবির 'বড় হওয়া খুব ভুল' (২০০২ ) ছড়ার বইটিতেও 'ঠাকুর দাদার মঠ' নামে একটি ছড়া আছে । সেখানেও আছে অন্ধকারের কথা । যে অন্ধকারে কবি জ্বালাতে চান একটি প্রদীপ । এই পৃথিবীতে বহু দিন, মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি বাইরে থেকে না ঘটলেও তার পূর্ণতা এসেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে । ছড়াটির শেষে কবি–'বাইরে যতই কুজ্ঝটিকা / দুই চোখে হোক দিব্য শিখা,/ বুকের মধ্যে ঠাকুরদাদার মঠ' বলে একটা প্রত্যয়ের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এ অঞ্চলের মঠসংস্কৃতি পূর্বপুরুষের উজ্জ্বল স্মৃতিবাহক । বিশেষ বিশেষ তিথি ও পূজা-পার্বনের সন্ধ্যায় জ্বালানো দীপমালার শিখায় পূর্বপুরুষের প্রতি আত্মনিবেদনের অনুভবটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. বাঙালির ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, আদিপর্ব, কলকাতা, ১৩৮২.
২. ধর্ম ও সংস্কৃতি–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৩. বাংলার লোকশ্রুতি–আশুতোষ ভট্টাচার্য, কলকাতা,১৩৯২
৩. সংস্কৃতির রূপান্তর–গোপাল হালদার, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৭৪
৪. টোটেম ও ট্যাবু–সিগমুন্ড ফ্রয়েড,১৯১৩
৫. রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা– ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, ভোলানাথ প্রকাশনী, কলকাতা
৬. আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি–দিব্যজ্যোতি মজুমদার, লোকসংস্কৃতি ও অধিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা ২০০৪
৭. বাংলার লোকসংস্কৃতি–ওয়াকিল আহমেদ, ঢাকা, ১৩৮১
No comments:
Post a Comment