প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি নিয়েই সংসার । জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । মৃত্যুর হাত থেকে কারো পরিত্রাণ নেই । রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে পথের পাশের সহায় সম্পদহীন ভিখারি পর্যন্ত সকলকেই একদিন মৃত্যুর কাছে পরাজয় মানতে হয় । মৃত্যু ধন, মান, গৌরবের তোয়াক্কা করেনা । এতটাই নির্দয় সে । কার্য, কারণ, জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বৃত্তাকার পরম্পরাকে নিয়েই এই জগত সংসার চলছে । হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, অনেকগুলি জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্য দিয়েই জীবাত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ব্রহ্মাত্মার সঙ্গে মিলিত হয় । জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাকুলতা ও তার পুর্ণতালাভের মাধ্যমেই আসে মোক্ষ বা মুক্তি । পরমাত্মায় বিলীন হয়ে গেলে জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে চলে যায় মানবাত্মা । যুগ যুগ ধরে মোক্ষ ও মুক্তির জন্য, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য জীবাত্মা ক্রমাগত দেহান্তর ঘটাতে থাকে । কাজেই এই মৃত্যু বা দেহান্তর শোকের নয় । পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পথে এক একটি ধাপ পেরিয়ে যাওয়া মাত্র । আক্রান্ত বা জীর্ণ দেহকে পরিত্যাগ করে জীবাত্মা নতুন সুন্দর সুস্থ দেহ গ্রহণ করে আবার জীবন শুরু করে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে । মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কোন শোকের বিষয় নয় । প্রিয়জনকে হারিয়েও নির্মোহ নিলিপ্ত থাকা এই এক অদ্ভুত দার্শনিক উপলব্ধি । আর এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া এক প্রতীকী অনুভব ।
মানব জীবনচক্রের চারটি স্তর জন্ম, বয়সন্ধি, বিবাহ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমাজজীবনে নানাধরনের আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকে । আচার দুই প্রকার । শাস্ত্রীয় ও লোকাচার । শাস্ত্রীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে ঐন্দ্রজালিক শক্তি বা বিভিন্ন দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রয়াস থাকে । লৌকিক আচারের মূল উদ্দেশ্য হল ইহজগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও মঙ্গললাভ । এতে শুধুমাত্র ব্যক্তিমঙ্গল নয়, সামাজিক মঙ্গল ও কামনা করা হয় । লৌকিক আচারের দুটি দিক । ক্রিয়া ও অনুষ্ঠান । মানব জীবনব্যাপী আচার বা ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানসমূহের মূলে রয়েছে আদিম মানুষের সর্বপ্রাণবাদী চেতনা । সর্বপ্রাণবাদের যে বিশ্বাসগুলো প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তা হল–ক) জীবিত বা মৃত মানুষের আত্মায় বিশ্বাস বা তার পূজা করা, খ) বস্তু বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস; এবং গ) বস্তুর মধ্যে অবস্থানরত কোন আত্মায় বিশ্বাস ও তার পূজা । এই বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট দৈবীভাবনার মূলে দুটি বিষয় রয়েছে । তার একটি হল ভয় বা ভীতিবোধ । অপরটি হল কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধাবোধ । পূজাপার্বণ আচার অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে এই দুই ভাবনা । ভয় বা ভীতিবোধের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক জড়িত । আত্মাকে সন্তুষ্ট করার প্রক্রিয়া রয়েছে কিছু কিছু শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান ও লৌকিক আচারে । ভয়ের সৃষ্টি হয় সৎকারহীন আত্মা, অপঘাতে বা দুর্ঘটনায় মৃতের অতৃপ্ত আত্মা, প্রভৃতি থেকে । আর স্বাভাবিকভাবে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে থাকে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ । এই শ্রদ্ধাবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে পিতৃপূজা বা পূর্বপুরুষপূজার ।
বাঙালি বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষপূজারই ক্রমোত্তরণ । গবেষকদের মতে, বাঙালির প্রায় সমস্ত লৌকিক আচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এদেশের কোল, ভিল, মুন্ডা হো, শবর, খেরিয়া প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পরবর্তী সময়ে বাঙালিরা পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে । ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন–'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ পরলোক সম্পর্কে ধারণা প্রেরিত তথ্য পিতৃতর্পণ পিণ্ডদান শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান আভ্যুদায়িক ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা-৬০৭ ) ।
বাঙালি হিন্দুর পারলৌকিক ক্রিয়ার দুটি ধারা রয়েছে । একটি শাস্ত্রীয় ও অন্যটি লোকাচার । শাস্ত্রীয় ধারায় রয়েছে ক) অন্তেষ্টিক্রিয়া খ) অশৌচ এবং গ) শ্রাদ্ধ । মৃতের সৎকারসাধন অর্থাৎ শবদাহকে বলা হয় অন্তেষ্টিক্রিয়া । মৃত্যুহেতু মনের অশুচিতাকে বলা হয় মরণাশৌচ । সেরূপ জন্মকালীন অশৌচ অর্থাৎ জন্মাশৌচও রয়েছে । 'শ্রদ্ধা' শব্দ থেকে এসেছে 'শ্রাদ্ধ' । 'শ্রদ্ধা' শব্দের সঙ্গে 'অন' প্রত্যয় যোগে 'শ্রাদ্ধ' শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে । মৃত পুরুষের আত্মার তৃপ্তির জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি অন্ন, ব্যঞ্জন, জল, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত ইত্যাদি প্রদান করাকে শ্রাদ্ধ বলে । পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দু ধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান ।
হিন্দুদের দাহকার্য যেখানে করা হয় সেই স্থানকে শ্মশানভুমি বলা হয় । বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রেও সেই আচার অনুসরণ করা হয় । এক দুটি ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় । 'শ্মশান' শব্দটি সংস্কৃতভাষা থেকে আগত । সরাসরি বাংলায় ব্যবহারের ফলে তা তৎসম শব্দ । 'শ্মশান' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো–'শ্ম' শব্দের অর্থ মৃতদেহ বা শব । 'শন্য' মানে বিছানা । অর্থাৎ মৃতদেহের বিছানা । চলতি কথায় যে স্থানের শব দাহ করা হয় সেই স্থানটির নাম 'শ্মশান' । সাধারণত নদী বা বড়ো জলাশয়ের ধারেই শ্মশানক্ষেত্রের অবস্থান । এই শ্মশানে দেবী কালিকা বিরাজ করেন । শ্মশান ভূমি তান্ত্রিকদের সাধারণ ক্ষেত্র । একে তপস্যাভূমিও বলা হয় । দেবাদিদেব শিবও শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান । ছাইভস্ম গায়ে মাখেন । নির্জন শ্মশানে গেলে জীবনের শেষ পরিণতি উপলব্ধি করে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় । এই জন্য শ্মশানকে 'বৈরাগ্যভূমি'ও বলা হয় ।
মৃতদেহ নিয়ে শবানুগমন থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পর্যন্ত শাস্ত্রীয় আচারের পাশাপাশি বেশ কিছু লৌকিক আচার ও পালন করা হয় বাঙালি হিন্দু সমাজে । মৃতদেহকে বাঁশের তৈরি মইয়ের মতো খাটিয়ায় ধাড়ার বা চাটাইর উপর শবকে শায়িত করে মৃতেরর পুত্রগণ ও নিকট আত্মীয়গণ কাঁধে করে শববহন করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে । প্রাচীন চর্যাপদে ও তার নিদর্শন পাওয়া যায়– 'চারিবাসেঁ গড়িলা রে দিয়া চঞ্চালী / তঁহি তোলি সবরো ডাহ কএলা কান্দই সগুন শিয়ালী ।। / মরিল ভবসত্তা রে দহ দিহে দিধলি বলী ।। / হের সে সবরো নিরেবন ভইলা ফিটিলি যবরালি ।। ( চর্যা–৫০ ) । শ্মশানযাত্রার এই চিত্র বর্তমান বাঙালি হিন্দুসমাজেও প্রচলিত রয়েছে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচণ্ডীর গীতে 'কংস নদীর তটে আছে বড় রম্য স্থল' হিসেবে শ্মশানের চিত্র ফুটে উঠেছে ।
শবদাহের জন্য প্রয়োজন হয় অগ্নিকুণ্ডের । এই অগ্নিকুণ্ডকে বলা হয় চিতা । এই চিতায় মৃতদেহ সৎকারের জন্য তোলার আগে স্নান করিয়ে ঘি চন্দন মাখানো হয় । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে আমরা তার নিদর্শন পাই । রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রয়েছে–'রাবণেরে করাইল স্নান সিন্ধু জলে । /সুগন্ধি চন্দন লেপে কন্ঠে বাহু মূলে ।। তেমনি বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়ে পাই–'দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহু তরে । / করাইয়া স্নান শোয়াইল গঙ্গাধরে ।' চিতায় শব স্থাপনের আচার হিসেবে মৃতের মস্তক উত্তর দিকে স্থাপন করার কথাও জানা যায় রামায়ণে–'করিলেন চিতা রাজা উত্তর শিয়রে / তিনজনে শোয়াইল চিতার উপরে ।' তবে কোনো কোনো অঞ্চলে দক্ষিণদিকে শবের মস্তক স্থাপনের রীতি প্রচলিত আছে । শব চিতায় তোলার পর মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্র, অবর্তমানে কনিষ্ঠপুত্র চিতাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে ও মৃতের মুখাগ্নি করে শব সৎকারের সূচনা করে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচন্ডীর গীতে উল্লেখ আছে–'নানা কাষ্ঠ কুড়াইয়া জ্বালিল অনল ।। / প্রদক্ষিণে অগ্নি দিল মুখের উপর ।।' বিষ্ণু পালের মনসামঙ্গলে আছে–'সনকা জ্বালিয়া কৈল এ মুখ আগুন ।' এ যুগের কবিদের কাব্যে চিতা শয্যার বর্ণনাটিও পাওয়া যায়–'চন্দন কাঠের চিতা করিল সে তীরে / বলিরাজ শোয়াইল তাহার উপরে ।' ( কৃত্তিবাস ওঝা ) । এছাড়া বিপ্রদাস পিপিলাই লিখেছেন–'করিল বিচিত্র চিতা ক্ষিরোদের কূলে । / দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহুতরে ।' ঘনরামের রচনায় রয়েছে–'বেদের বিধান কুন্ড করিল রচনা । / পাতিল চন্দন কাষ্ঠ পরিপাটি ধূনা ।। / কলসে কলসে তায় ঢেলে দিল ঘি । / কর শঙ্খ ত্যজে তবে চারি রাজার ঝি ।।' ( ধর্মমঙ্গল ) দাহকার্য সমাধান হবার পর চিতা ধোয়ানো বা 'চুল্লী শীতল' করার একটি আচারের নিদর্শন পাওয়া যায় জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে–'আপনার উরু তুলি, তাহাতে বান্ধিয়া চুহ্লি, বাপের করয়ে অগ্নি কাজ । / গঙ্গাসাগরের পানি, আগর চন্দন আনি, ধর্মদেবের শরীর ধোয়ায় । / করিয়া উত্তম খাট, চাপায় আগর কাঠ, তাতে নিয়ে ধর্মকে শোয়ায় । / আগর চন্দন খড়ি, চাপায় অনেক করি, অনল ভেজায় তিন ভাই । / মন্ত্র পড়ে ব্রহ্মাহর, অগ্নি দিল মহেশ্বর, পুড়িয়া হইল ছাই । / করিয়া অগ্নির কাজ, ধোয়ায় অঙ্গার কাষ্ঠ, তিন ভাই কান্দে উচ্চস্বরে । / করিলেন তর্পণ, পিণ্ড দিলেন তিনজন, তপস্যাতে চলিল সাগরে ।।' ( মনসামঙ্গল–জগজ্জীবন ঘোষাল ) ।দাহকার্য শেষ হওয়ার পর তিতা শীতল করে পিন্ডদান করা হত ।
মৃতের দাহকার্য অবশ্য সম্পাদনীয় বিষয় । সেকালে মৃতদেহ বাসি হতে দেওয়াও একটি গর্হিত কাজ বলে ধরে নেওয়া হত । লক্ষিন্দরের মৃত্যুর পর চাঁদ সদাগর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন–'কান্দিতে কান্দিতে হইল দশ দন্ড বেলা । / জ্ঞাতি লোকে খোঁটা দিব দ্বারে বাসি মড়া ।। / ( পদ্মাপুরাণ–বিজয়গুপ্ত ) । সর্পাঘাত মৃত্যু হলে দাহকার্য করার বিধি ছিল না । এক্ষেত্রে মৃতদেহকে কলার ভেলায় তুলে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত । 'সর্পাঘাত হইলে অগ্নিতে না পুড়ে' ( পদ্মাপুরাণ বিজয় গুপ্ত ) ।
মৃতের সৎকারের পর নির্দিষ্ট দিন অশৌচ পালন করার পর হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান । শ্রাদ্ধ আবার দুই প্রকারের । তেরাত্রির শ্রাদ্ধ ও অশৌচান্ত শ্রাদ্ধ । দুর্ঘটনা বা অপঘাতে মৃত্যু হলে তেরাত্রির শ্রাদ্ধ করা হয় । 'সোমাই পন্ডিত বলে স্থির কর মন / তেরাত্রি শ্রাদ্ধ হবে বেবস্থার বচন ।।' ( পদ্মাপুরাণ–বিজয় গুপ্ত ) । অশৌচান্তিক শ্রাদ্ধের উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে–'পঞ্চ ভাই দিল পিণ্ড ক্ষত্রিয় বিধান / ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান ।' শ্রাদ্ধ শেষে পিণ্ড জলে বিসর্জন দেওয়ার প্রথাও রয়েছে । 'শ্রাদ্ধ করি প্রভু পিণ্ড ফেলে সেই জ্বলে / গয়ালি ব্রাহ্মণ সব ধরি ধরি গিলে ।' ( শ্রীচৈতন্য ভাগবত বৃন্দাবন দাস ) । ধনবান ব্যক্তিগণ গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান করেন ও তর্পণ করেন । মৃতের উদ্দেশ্যে জল দানকে বলা হয় তর্পণ । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম গয়াতে গিয়ে পিন্ডদানের কথা উল্লেখ করেছেন–'পড়িয়া শুনিয়া পুত্র হয় সুপুরুষ / পিন্ডদান করে ধরিয়া তিল কুশ ।' ( চন্ডীমঙ্গল ) । শ্রাদ্ধবাসরে গৃহকর্তার সামাজিক অবস্থান সাপেক্ষে ব্রাহ্মণকে অন্নদান, বস্ত্রদান, গোদান ও কাঞ্চন দান ইত্যাদি করা হত । দ্বিজ বংশীদাসের কাব্যে উল্লেখ আছে যে, চাঁদ সদাগর পিতার মৃত্যুর পর 'দানসাগর' শ্রাদ্ধ করেন–'চন্দ্রধরের মাতা পিতা মৈল কাল পায়্যা । / শত পুত্র কার্য করে এক পুত্র হয়্যা ।। / রজত কাঞ্চন ধেনু জল ভূমি আদি । / দানসাগর শ্রাদ্ধ কইল বৃষোৎসর্গ বিধি ।।' ( পদ্মা পুরাণ ) । বিপ্রদাসে পাই–'বিধি মতো শ্রাদ্ধ কৈল দানযজ্ঞ আদি । / ক্ষিতি পরিতোষ কৈল দিয়া রত্ন নিধি ।। / সুবর্ণের ভান্ডার পুরিয়া লক্ষ লক্ষ । / হেনমতে দ্বিজ দান করিল অসংখ্য' ( মনসা বিজয়–বিপ্রদাস পিপিলাই ) ।। কাশীরাম দাস লেখেন–'ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান / স্বর্ণদান ভূমিদান করে গবীদান' ( মহাভারত আদিপর্ব ) ।
বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ও প্রাচীন সাহিত্যে যে সমস্ত মৃত্যুজনিত লোকাচার দেখা যায়, সেগুলোতে সেসময়ের বাঙালি জীবনের চিত্রই কবিদের কাব্যে ফুটে উঠেছে । পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের সমাজ জীবনে পালিত আচারগুলোই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কবিদের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে । ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আচারসমূহের মূলধারা একই থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ব্যতিক্রম দেখা যায় । এই ব্যতিক্রম বা রূপান্তরের কারণেই কোনো আচারকে আঞ্চলিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় । পরবর্তীকালেও বাঙালি হিন্দুদের মধ্য সেই ধারাকেই অনুসরণ করতে দেখা যায় ।
No comments:
Post a Comment