করোনাকালে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গভীর কালো মেঘের ছায়া
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সারা পৃথিবী এই মুহূর্তে সীমাহীন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে ৷ ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আজ ঘরবন্দী মানুষ ৷ একটিমাত্র সমস্যায় বিপন্ন হয়ে আতংকে আজ দিন কাটাতে হচ্ছে সারা পৃথিবীকে ৷ বিশ্বজুড়ে এক করাল বিষন্নতা আর মৃত্যুভয় এক অপরিচিত ও অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে ৷ কোভিড-19এর থাবায় জনজীবন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও সেবা সর্বত্রই এক স্থবিরতা বিরাজ করছে ৷ লকডাউনের ফলে অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ৷
গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে করোনাকালীন এই দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ৷ গতবছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনা অতিমারীর থেকে বাঁচার জন্যে লকডাউন লাগু হওয়ার পর থেকে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে ৷ ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব জুড়ে ১৯১টি দেশের ১৫৭কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাগ্রহণ প্রভাবিত হয়েছে, তার মধ্যে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩২ কোটি । স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে যে ব্যবস্থা অনুসরণ করা হত তা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে ৷ বিশ্বের আশি শতাংশ শিক্ষার্থী আজ এই বিরাট সমস্যার সম্মুখীন ৷
নিবন্ধের এইটুকুতে এলেই হয়তো অনেকে হা রে রে রে করে উঠবেন ৷ পড়াশুনা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা এক অংশের, মানুষ, মানতেই চাইবেননা ৷ তাঁরা বলবেন, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলে কী হবে, অনলাইনে তো পড়াশুনা চলছে ৷ এই অনলাইন পড়াশুনা নিয়ে একটা বিতর্ক চলছে সর্বত্রই ৷ একদল বলছেন, অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পঠনপাঠনে ব্যাঘাত ঘটছেনা ৷ আর একদল বলছেন এতে শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৷ তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি বা ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং আকস্মিকভাবে অনলাইন শিক্ষা চালু করে দেওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি একেবারে উদোম হয়ে পড়ছে ৷ দেশের শাসকগোষ্ঠীও করোনাকালীন বিপদসংকুল পরিস্থিতির ডামাডোলে শিক্ষাক্ষেত্রে একতরফাভাবে সিদ্ধান্তের অদলবদল করে চলছে ৷ এই তুঘলকী সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষাপরিবেশের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ৷
অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতি পুরোটাই হল ইন্টারনেট নির্ভর ৷ আমাদের দেশের সব প্রান্তে এখনও ইন্টারনেট পরিষেবা সহজলভ্য নয় ৷ কোথাও কোথাও দেখা যায়, ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়া গেলেও তার স্পিড অত্যন্ত কম ৷ দুর্বল গতির কারণে ঘন ঘন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ৷ ভারতের বিশাল সীমান্ত এলাকা জুড়ে বহু মানুষের বাস ৷ রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষাজনিত কারণে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় ইন্টারনেট পাওয়া যায়না ৷ খবরের কাগজ খুললে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্যে প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে চেষ্টা করছে ৷ কোথাও কোথাও ঘরের চাল, ছাদে কিংবা গাছের উপর চড়ে বসে বিপজ্জনকভাবে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জালের সুযোগ নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে ৷ ফলে অনলাইন কার্যক্রমে শিক্ষা নিতে গিয়ে খাজনার থেকে বাজনা বেশি হচ্ছে ৷
আমাদের দেশের জনসংখ্যার এক বৃহত অংশ দৈনিক শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে ৷ অসংগঠিতক্ষেত্রের এই শ্রমিকরা একদিন কাজে না গেলে তাদের ভাত জোটেনা ৷ এমনিতে সরকারি সুযোগ পেতে ও বিশেষ করে পারিবারিক যোগাযোগ, রেশন, রান্নার গ্যাস, ব্যাংকের লেনদেন ইত্যাদিক্ষেত্রে তথ্যের আদান-প্রদানের জন্যে আজকাল প্রত্যেক পরিবারেই অত্যন্ত স্বল্পমূল্যের হলেও একটি মোবাইল ফোন রাখতে হয় ৷ এদিকে করোনা অতিমারীর কারণে দেশের বহু শ্রমজীবী পরিবারের আয় কমে গেছে কিংবা কর্মহীন হয়ে গেছে ৷ জীবনধারণের জন্যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগাড় করতেই জেরবার হয়ে যেতে হচ্ছে ৷ সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্যে একটা স্মার্টফোন কিনে দেওয়া আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে দেবার মতোই অবস্থা ৷ তার উপরে পরিবারে যদি একাধিক পড়ুয়া সন্তান থাকে তাহলে তো এ চাপ আরো বাড়তে বাধ্য ৷ কারণ একই সময়ে একাধিক সন্তানের ক্লাশ থাকতে পারে ৷ ফলে প্রত্যেকের হাতে একটি একটি করে এন্ডরয়েড ফোন জুগিয়ে যাওয়ার মতো ব্যয়ভার বহন করতেগিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের । আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী শ্রমজীবী পরিবার থেকেই উঠে আসে ৷ ফলে আর্থিক দৈন্যে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণে পিছিয়ে পড়ে ৷ তা থেকে তাদের মনে হীনন্মন্যতার জন্ম হয় ৷ খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, বাবা-মায়ের কাছে স্মার্টফোনের আব্দার করে না পেয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৷
পূর্বের কোনো ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইন পঠনপাঠনে অংশগ্রহণ করছে । এই পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ করতে গেলে যে উন্নতমানের ভিডিওচিত্র, রেফারেন্স ফাইল, স্পষ্ট শ্রবণের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমানে ডিভাইস সংগ্রহ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল । এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকলে শিক্ষার্থীকে পাঠদানের পূর্বে ও পাঠদানকালে অনলাইন কোর্স ম্যাটেরিয়াল ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রয়োজনীয় তথ্য, স্লাইড ইত্যাদি সরবরাহ করা সম্ভব হয় । কোর্স ম্যাটেরিয়ালের মাধ্যমে বছরের শুরুতেই পুরো কোর্সের পরিকল্পনা এবং লেকচার প্রেজেন্টেশান, পরীক্ষার নম্বর বিভাজন ইত্যাদি পূর্বাহ্নেই জানা না থাকায় শিক্ষার্থীরা একট ভাসা ভাসা ধারনা নিয়ে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে । দীর্ঘসময় পাঠগ্রহণের পর দেখা যায়, হঠাৎ করে সিলেবাস সংক্ষেপ করে ফেলা হয় । এতে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয় ।
বাস্তবজীবনে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেরই স্মার্টফোন ব্যবহারের তেমন কোনো। প্রয়োজন পড়েনি । এই করোনাকালীন সময়ে তাঁদের স্মার্টফোনের ব্যবহার ঠেকে শিখতে হচ্ছে । হঠাৎ করে এই ডিভাইস ব্যবহার করতে গিয়ে তাঁরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন । অনলাইন ক্লাশ করতে বসে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধান করতে না পারার কারণে পাঠদান প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে । এছাড়া এই ডিভাইস ব্যবহার করতে গিয়ে শিক্ষক মহাশয়কে যে আর্থিক দায়ভার বহন করতে হচ্ছে সেটা এই করোনাকালে তাঁর জীবিকার উপরও আর্থিক চাপ ফেলছে ।
''বর্ষে বর্ষে দলে দলে / আসে বিদ্যা মঠতলে / চলে যায় তারা কলরবে। / কৈশোরের কিশলয় /পর্ণে পরিণত হয় / যৌবনের শ্যামল গৌরবে ।'' ( ছাত্রধারা– কালিদাস রায় )–করোনাকলীন সময়ে কবিশেখর কালিদাস রায়ের সেই চিরন্তন চিত্রটি একেবারে পাল্টে গেছে । করোনা ভাইরাস শিক্ষাব্যবস্থাকে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সামনে এনে ফেলে দিয়েছে । অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কোনোভাবেই বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন পদ্ধতির বিকল্প হতে পারেনা । বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত আমরা দেখে আসছি শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে উপস্থিত থেকে পাঠপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে । এই বিষয়টি যুগপরম্পরাক্রমে আমাদের রক্তের ভেতর গেঁথে গেছে। সেই ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাকে রাতারাতি ভার্চ্যুয়াল করে ফেললে শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের মানসিক সংগঠনে বেশ বাধার সৃষ্টি করে ।
অনলাইন শিক্ষাপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের তাত্ত্বিক ক্লাশ করা সম্ভবপর হলেও ব্যবহারিক ক্লাশ সম্ভব নয় । লকডাউনের ফলে শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ পরিষেবাগুলো নিতে পারছেনা । তাছাড়া অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাযুক্ত শিশুরা খুব একটা সুফল লাভ করতে পারেনা । বিশেষ করে অটিস্টিক বিশেষ চাহিদাযুক্ত ( শ্রবণ, দর্শন ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ) শিশুদের শিক্ষণক্ষেত্রে শিক্ষককে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় ।
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় যে আন্তরিকতা, যে মূল্যবোধ ছিল আধুনিক শিক্ষবিদগণও শিক্ষাক্ষেত্রে সেই মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করছেন। মহাভারতের কাহিনি 'আরুণির উপাখ্যান'–এ পাই, গুরু ঋষি আয়োদধৌম্য শিক্ষার্থীকে নির্দেশ দিচ্ছেন–'ধান্যক্ষেত্রে সব জল যাইছে বহিয়া / যত্ন করি আলি বাঁধি জল রাখ গিয়া / আজ্ঞা মাত্র আরুণি যে করিল গমন/আলি বাঁধিবারে বহু করিল যতন / দন্ডেতে খুদিয়া মাটি বাঁধে লয়ে ফেলে / রাখিতে না পারে মাটি অতি বেগ জলে । / জল সব যায় গুরু পাছে ক্রোধ করে / আপনি শুইল নিজে বাঁধের উপরে ।' গুরুর আজ্ঞা পালনের জন্যে শিষ্যের কী অসীম প্রচেষ্টা । গুরু-শিষ্যের মধ্যে গভীর আত্মিক যোগাযোগ না থাকলে এমনটা হওয়া সম্ভব নয় । শুধু গুরু-শিষ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক নয় দীর্ঘকাল যাবত শিক্ষক মহাশয়গণ অভিভাবক কিংবা সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । মূল্যবোধের শিক্ষা সমাজকে বিশেষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল । মধ্যযুগেও আমরা দেখতে পাই যে, বাদশাহ্ আলমগির একদিন তাঁর সন্তান ও অন্যান্য রাজপুরুষের সন্তানগণের পাঠশালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা জিনিস লক্ষ করে মৌলবি সাহেবকে ডেকে পাঠালেন । মৌলবি সাহেব তো বাদশাহের ডাক পেয়ে দুরু দুরু বুকে তাঁর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন । 'বাদশাহ কহেন, সেদিন প্রভাতে/দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে / নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন / পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ / নিজ হামনেতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
/ ধুয়ে দিল নাকো কেন সে চরণ স্মরি ব্যথা পাই । ( শিক্ষকের মর্যাদা-কাজি কাদের নিওয়াজ ) । বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স শিক্ষার ক্ষেত্রকে পুরোপুরি যান্ত্রিক করে ফেলছে । শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্কের বাতাবরণ, জীবনের রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির নিবিড় উপলব্ধি থেকে বা প্রতিদিনের জীবনের ঘটে যাওয়া নানা বিচিত্র ঘটনাবলি থেকে টেনে আনা উপমা, উদাহরণ, হাসি-মজা-আনন্দ মিলিয়ে শ্রেণিকক্ষের যে আনন্দঘন পরিবেশ তা বর্তমান ব্যবস্থায় সত্যিই দুর্লভ । ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে । এছাড়া অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতিতে শারীরশিক্ষা কিংবা সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা একঘেয়েমির শিকার হয়ে পড়ে ।
''অন্ন চাই প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু;/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,/ সাহসবিস্তৃত বক্ষপট'' ( এবার ফিরাও মোরে,চিত্রা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) । প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ করতে হলে একটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকর পরিবেশের দরকার । ঘরে বসে অনলাইন শিক্ষাগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা, দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে । ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে ইন্টারনেটের সামনে বসে থাকতে হচ্ছে ক্লাশ করার জন্যে । ফলে শিশুর শরীরের দেখা দিচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ওজন বেড়ে যাচ্ছে । ঘরে বসে থাকতে থাকতে মেদবহুল হয়ে যাচ্ছে তারা ।
এছাড়া দীর্ঘক্ষণ ধরে কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখার ফলে কানেও নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মোবাইল বা ল্যাপটপের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখেরও নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। করোনকালীন সময়েঅনলাইন ক্লাশ করার ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে । তাদের মধ্যে একধরনের একঘেয়েমির ও অবসাদ ঘিরে ধরেছে। সারাদিন ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকার ফলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । চিন্তার জগতেও পরিবর্তন আসছে । মোবাইল, ল্যাপটপ সঙ্গে থাকার সুবাদে ভালো মন্দ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিচরণেরও সুযোগ থাকছে শিক্ষার্থীদের । ফলে তার প্রভাবে শিক্ষার্থীর মনে কুচিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটে ও তাদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটছে । তাদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে। তাদের স্বভাবে উগ্রতা লক্ষ করা যায়। এমনকি মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও পর্যন্ত করতে শুরু করে তারা। সরকারিভাবে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা নেই।এছাড়া ইন্টারনেট কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, ইন্টারনেটের ভালো দিক, মন্দ দিক ইত্যাদি বিষয়ে কোনো ধারণাই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়না । অনলাইন শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের হাতে হঠাৎ করে মুঠোফোন চলে আসায় একাংশ এটার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে এবং ক্রমশ মোবাইল এডিক্টেড হয়ে পড়ছে। বাস্তববর্জিত অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে, নানারকম খারাপ ভিডিও দেখে বিপথগামী হচ্ছে , অনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, নেশায় আসক্ত হচ্ছে, এমনকি হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে । অভিভাবক, শিক্ষক মহাশয় কিংবা সচেতন মানুষের কোনো সুযোগ নেই জানার যে শিক্ষার্থীরা মোবাইল নিয়ে আসলে কী করছে । আর যখন জানা যাচ্ছে তখন ঘটনা অনেকদূরগড়িয়ে যায়। সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই মোবাইলফোন হাতে পেয়ে অল্পবয়সী শিশুকিশোরদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনৈতিক আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। ফলে নানারকম অঘটনও ঘটছে। জীবন শুরু হওয়ার আগেই অকালে ঝরে পড়ছে তারা ।
দেশে বহু শ্রমজীবী পরিবার রয়েছে যাদের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাশে, কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে । তাদের মা-বাবারা নিম্ন আয়ের হওয়ার ফলে তারা পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহের জন্যে মা বাবা কিংবা অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি না করে ছুটকো ছাটকা কাজ করে অথবা নিচের ক্লাশের ছাত্র পড়িয়ে তাদের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করত । কিন্তু করোনাকালীন সময়ের নানা বিধিনিষেধের মান্যতা দিতে গিয়ে তাদের সেই সমস্ত রোজগারের রাস্তাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে । দেশের সরকার ইতোমধ্যে 'হিফা' অর্থাৎ Higher Education Funding Agency-র মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্ত পরিকাঠামোগত বরাদ্দ বন্ধ করে ৮'৫% হারে ঋণের প্রকল্প চালু করেছে । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্যে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নরকম ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় আর্থিক সুযোগ করে দেওয়ার নামে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ঋণের বেড়াজালে ।
শিশুশ্রমিক ও স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখী করার উদ্দেশ্যে সর্বশিক্ষা অভিযানের মাধ্যমে দেশের সমস্ত বিদ্যালয়গুলোতে মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু করা হয়েছিল । তাতে দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল । সারা দেশে ১২ কোটি ( মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ ) শিক্ষার্থী এই প্রকল্পের সুফল লাভ করেছিল । কিন্ত্ত এই দুঃসময়ে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার ফলে আবার শিশুশ্রমিক ও স্কুলছুটের সংখ্যাবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী । করোনাকালীন সময়ে বহু পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে । পণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপেরও কোনো প্রয়াস নেই। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেকেই তাদের সংসারে আয়ের রাস্তাকে বাড়াবার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার পাট চুকিয়ে রোজগারের পথে নামিয়ে দিচ্ছে । কারণ 'এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে'রা এতই অসহায় যে, তারা 'নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতরে স্মরি, / মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান / শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ রেখে দেয় বাঁচাইয়া' । ( এবার ফিরাও মোরে, চিত্রা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমও অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে ।নেই ব্যবহারিক পাঠগ্রহণের ব্যবস্থা। ফলে বর্ষশেষে শিক্ষার্থীরা তাদের হাতে হয়তো মূল্যায়নপত্র বা সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। সুরক্ষার লক্ষ্যে এবছর রাজ্যে ও সারাদেশে সমস্ত শিক্ষাপর্ষদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চলেছে । দুঃসময়ে লব্ধ তাদের এই যোগ্যতা একটি ক্ষত বা ক্ষতি হিসাবে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সারাজীবন সমাজে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে অবস্থান করতে হবে। প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষককেন্দ্রিকতার বদলে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার উপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা আবার 'পুনর্মুষিকঃ ভব' অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ।
অনলাইন শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও ছন্দপতন ঘটেছে । বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের আয়ের উপর আঘাত এসেছে । স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রভর্তি কম হওয়ার কারণে তাদের আয় কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষকদের ছাঁটাই করছে অথবা বেতন কমিয়ে দিচ্ছে । এছাড়া যারা শুধুমাত্র বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের অবস্থা আরো চরম ।অবর্ণনীয় দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন রাজ্যের চাকুরিচ্যুত ১০৩২৩ সংখ্যায় আখ্যায়িত শিক্ষকগণ । এই অতিমারীর ডামাডোলে তাদের কাতর আবেদন প্রশাসনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছেনা । করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা উপকরণ ও শিখনসামগ্রীর চাহিদাও কমে গেছে । ফলে এই ধরনের সামগ্রীর সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরাও সাংঘাতিকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন । পাশাপাশি বিদ্যালয়ের স্কুলবাসের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিদ্যালয় চত্বরে ক্যানটিন বা টিফিনের দোকান করেও অনেকে সংসার প্রতিপালন করছিলেন । তারাও এইসময়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছেন । করোনাকালীন সময়ে সরকারি নজরদারি না থাকায় বিদ্যালয়গুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে । বিদ্যালয় চত্বরে অসামাজিক কার্যকলাপ, নেশার আড্ডা ও দুর্বৃত্তের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্কুলবাড়ির দরজা-জানলা,ফ্যান-লাইট ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী, কম্পিউটার ইত্যাদির মতো মূল্যবান সামগ্রী । নষ্ট করা হচ্ছে চেয়ার টেবিল ব্যাঞ্চ ও অন্যান্য আসবাবপত্র। করোনার অবসান হওয়ার পর স্কুল খুললেও সেখানে ক্লাশ করার মতো পরিবেশ সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যাবেনা । সর্বোপরি বিদ্যালয়কে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে গেলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে বহু অর্থ ব্যয় করার ঝুঁকি নিতে হবে । করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ফলে একদিকে যেমন শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় মন্থর গতি এসেছে তেমনি তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবও অপেক্ষা করছে যা এই মুহূর্তে ধারনাও করা যাচ্ছেনা ।
এই সীমাহীন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রগুলোকে এখনই চিহ্নিত করে মোকাবেলায় উদ্যোগ না নিলে এর কুফল দীর্ঘদিন জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে । আর মানবসম্পদের উন্নয়ন ব্যহত হলে জাতির অগ্রগতিও ব্যহত হতে বাধ্য ।