সংস্কৃত বর্ণমালায় দুটি 'ব' । এই দুটির উচ্চারণ ও আকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে । বাংলা বর্ণমালি সংস্কৃত বর্ণমালা দ্বারা অনুপ্রাণিত । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা বর্ণমালা রচনা করেন ।
বাঙলা বর্ণমালা যথেষ্ট ফোনেটিক বা ধ্বনি-অনুসারী। 'ব'-ব্যঞ্জনটি যাকে ইংরেজিতে বলে bilabial plossive অর্থাৎ দুটি ঠোঁট একজায়গায় লাগে এবং আবার ছেড়ে দেয়, ও মাঝখান দিয়ে খানিকটা বিস্ফোরণের মত হাওয়া বেরিয়ে 'ব' উচ্চারণ হয়। প ফ ব ভ, 'প'-বর্গের ব্যঞ্জনগুলি এভাবেই উচ্চারিত হয়। 'ম'-এও ঠোঁট জড়ো হয় তবে ধ্বণিটি বিস্ফোরক নয় বরং নাসিক্য। এই বর্গভূক্ত বলে একে বর্গীয় ব বলে। ব্যঞ্জনগুলিকে এভাবেই তাদের উচ্চারণ স্থান ও বৈশিষ্টতা অনুযায়ী বিভিন্ন বর্গে ভাগ করা হয়েছে।
বাংলা বর্ণমালায় 'ব'-এর আকৃতিগত কোনো পার্থক্য নেই । বর্ণমালায় একটি 'ব' বর্গীয়-ব । প-বর্গের অন্তর্গত । প ফ 'ব' ভ ম ( এগুলি পঞ্চম বর্গীয় বর্ণ ) । শব্দের শুরুতে, মধ্যে বা শেষে অবস্থিত একক 'ব' হল বর্গীয়-ব । যেমন-দেবালয়, বাড়ি, বাহির, বাবা ইত্যাদি । এটি স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হয় । কিন্তু ব এর আরেকরকম উচ্চারণ চলে আসে যখন এই দুটির যেটির ক্ষেত্রে ঠোঁট জোড়া লাগতে চায় না বা লাগানো আয়াসসাধ্য। সে ক্ষেত্রে ওয়া গোছের উচ্চারণ হয়ে হাওয়া বেরিয়ে যায়। যেমন দুটি স্বরের মধ্যবর্তী বা অন্তঃস্থ বা intervocalic 'ব'-এর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায়।
এটা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। এই 'ব'-কে বর্গীয় 'ব'-এর থেকে পৃথক করে অন্যত্র রাখা হয়েছে। এটি অন্তস্থ-'ব' । য র ল এর পরে আসে এই 'ব' ( য র ল 'ব'- এগুলো অন্তস্থ বর্ণ ) । যুক্তবর্ণে, বা যুক্তব্যঞ্জনে, বা যুক্তক্ষরে যা ব্যবহৃত হয় । অর্থাৎ 'ব'-ফলা হিসাবে যা ব্যবহৃত হয় । যেমন-জিহ্বা ( জিওহা ), স্বদেশ ( সদেশ ), স্বাধীনতা ( সাধীনতা ), আহ্বান ( আওহান ), স্বামী ( সামী ) ইত্যাদি । এই ফলা-র 'ব'টি 'ও' বা 'ওয়' উচ্চারিত হয় । বর্ণদ্বিত্বও হয় । যেমন- বিশ্ব ( বিশশো ), আশ্বাস ( আশশাস ) । অথবা যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় তার সঙ্গে মিশে যায় । এই 'ব'কে অর্ধস্বরও বলা হয় ।
হিন্দি ও উর্দুতে এই 'ব'(ওয়)এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । যেমন- ওয়াক্ত, ওয়াজির, ওয়তন, দেওকীনন্দন, দেওধর, দেওনাথ ইত্যাদি ।
অধুনা বাংলায়, অন্তস্থ ব বর্ণটি তুলে নেওয়া হয়েছে, তাই এখন বাংলায় সব ব-ই বর্গীয়-ব । এর উচ্চারণ ইংরেজী B- এর মতো। বাংলায় এখন আর 'উঅ' উচ্চারণ-যুক্ত ব নেই, যদিও এই উচ্চারণ সেই অর্থে বাংলা ভাষায় কোনোদিনই ব্যবহার করা হয়নি।
অধুনা বাংলা বর্ণমালায়, য, র, ল, শ, ষ....এই ক্রম পাবেন। ল-এর পরে ব পাবেন না। ফলে বর্তমান প্রজন্মের যারা তারা বর্ণমালায় একটি 'ব'-ই দেখতে বা পড়তে পাবে । ফলে তাদের কাছে আর বর্ণমালায় দুই 'ব' নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবেনা । আমরা যারা পুরোনো বর্ণমালা অনুসরণ করে এসেছি তাদের কাছেই এই দুই 'ব' নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় । এবং এটা হওয়া স্বাভাবিক । এর মধ্যেই বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে ।
No comments:
Post a Comment