এবারের কোলকাতা ভ্রমণ যেমন আনন্দদায়ক হয়েছে তেমনি বিষন্নতায় গ্রস্ত হয়েছি প্রবল । আনন্দের বিষয়টা ব্যক্তিগত ।
পাশাপাশি একটা দুঃসংবাদ আমার একার এবং নিজস্ব । এতকিছু নিয়ম মেনে চলার পরও ডায়াবেটিসে আমার পদযুগল বৈরী হয়ে গেছে । পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর 'হাই রিস্ক' বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । সেইসঙ্গে কিছু ঔষধপত্র ও সাবধান বাণী । আঞ্চলিক প্রবাদে আমরা বলি, চরণে জানে মরণের খবর । গুলি মারো 'হাই রিস্ক' ।
দ্বিতীয় বেদনার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলামনা । এটা জানলে পাঠকেরও মন নরম হয়ে যাবে । রাজ্যের সাহিত্যসংস্কৃতিবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর নাম অবশ্যই জানেন । আর এই অধমকে নিয়ে ছিল দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে উঠে আসা মামা-ভাগ্নে জুটি । সাব্রুমের ছোটোখিলের সেকালের সংস্কৃতিমনস্ক দামোদরবাড়ির সন্তান ননী । এ গ্রাম রত্নগর্ভা । এ গ্রামের সন্তান কৃষ্ণধন নাথ । এ গ্রামের সন্তান ড. রঞ্জিত দে প্রমুখ । রাজ্যের সাহিত্যক্ষেত্রের দিকপাল তাঁরা । আরো অনেকে অনেকভাবে প্রতিষ্ঠিত । একসময়ের রাজ্যের বিখ্যাত জাদুকর ডিএন গোপাল এ গ্রামের ভারত আমিনের ছেলে । পরে তাঁরা আগরতলা অভয়নগরে চলে যান । গ্রামের মধ্যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের আত্মীয় । সেই সুবাদে ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী আর আমি মামা-ভাগ্নে । গ্রামে বলে, ধর্ম কুডুম তুন জর্ম কুডুম বড়ো । আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই রঞ্জিতদা ও ননীমামুকে বরিষ্ঠ সতীর্থ হিসাবে পেয়েছি । ৯৩-৯৪ সালের দিকে শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার সাব্রুম স্কুলে এসে হেডমাস্টাররুমে শরৎচন্দ্রের একটা ছবি দেখে এটি কে এঁকেছেন জানতে চান । তখনই ননীমামুকে সামনে এনে হাজির করা হয় । মামুকে কবি আগে থেকেই চিনতেন । অনিল সরকার সাব্রুম এলে দামোদরবাড়িতে উঠতেন । সেসময়ের তরুণ কমরেডদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন । জহুরি জহর চেনে । কবি ও সংস্কৃতিপ্রেমী অনিল সরকার সেসময়ে বহু গুণীজনকে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে । তাঁর প্রিয় ননীকে তুলে নিয়ে গেলেন আগরতলায় । রাজ্যে সাহিত্যসংস্কৃতিক্ষেত্রে মফঃস্বল থেকে উঠে এসে আগরতলায় দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি । রাজ্যের হাতে গোনা কয়েকজন লোকসংস্কৃতি গবেষকের অন্যতম তিনি । ইতোমধ্যে তাঁর টেলিফিল্ম 'ভাঙন' প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর লেখা কবিতা মুখে মুখে দেশের পরিমন্ডল পেরিয়ে বাংলাদেশের আবৃত্তিকারদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে । দৈনিক সংবাদের সাহিত্যের পাতায় ধারাবাহিক বেরিয়েছে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ' । অসাধারণ গল্পের হাত । বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ 'বসুধা' । অসাধারণ কয়েকটি মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন তিনি । ত্রিপুরায় নাট্যচর্চায় লোক আঙ্গিকের ব্যবহারে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী । আকাশবাণীর জন্যে লিখেছেন সিরিজ নাটক । তাঁর নেতৃত্বে আমরা দক্ষিণের প্রান্তিক মহকুমা সাব্রুম থেকে ভারত জনবিজ্ঞান জাঠায় অংশগ্রহণ করেছিলাম চলার পথে প্রতিটি জনপদে তাৎক্ষণিক সৃষ্ট পথনাটক ও গানবাজনায় মাতিয়ে দিয়ে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রখ্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধের রিপোর্টিং করেছেন এক নম্বর সেক্টর থেকে । সেই সুবাদে পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে দৈনিক সংবাদ, আজকের ফরিয়াদ, আরোহন এবং ত্রিপুরা দর্পণে ডেস্কে কাজ করেছেন ।
মনে পড়ে উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা কাটার সময় বাংলার শিক্ষকদের তরফে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে তাঁর ভূমিকা । খাতা কাটার ফাঁকে ফাঁকে প্রত্যেকের হাতে হাতে চিরকুট ঘুরে ছড়ার মালা তৈরি । সবশেষে প্রধান পরীক্ষক পর্যন্ত পৌঁছে যেত তা । মফঃস্বল থেকে যে সব পরীক্ষকরা খাতা কাটতে আসতেন তাদের থাকতে দেওয়া হত বিভিন্ন স্কুলের হোস্টেলের ফ্লোরে । চূড়ান্ত অব্যবস্থার মধ্যে । একবার উমাকান্ত স্কুলের অস্থায়ী শিবিরের পরিবেশের ছবি তুলে মামা-ভাগ্নে মিলে তখনকার ভাবী ভারত পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল লিড নিউজ করে দিয়েছিলাম । পরদিন সকালে পত্রিকা বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরা মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ভিত কেঁপে উঠেছিল সেদিন । অন্যদিকে উদয়পুরের বর্তমান পুরপিতা শীতলচন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল উত্তরপত্র মূল্যায়নের সাম্মানিক বৃদ্ধির আন্দোলন । আমরা পত্রিকায় সংবাদ করি । কর্তৃপক্ষ মাথা নোয়ায় সেবার । আরো বহু বহু ভাবনার ফসল বেরিয়েছে আমাদের দুজনের মাথা থেকে সেদিন । আগরতলায় চলে যাওয়ার পরও আমার যোগাযোগ ছিল তাঁর সঙ্গে । আগরতলায় গেলে যত রাত হোক আমার ঠিকানা ছিল তাঁর সরকারি আবাস । কি ছিল না সেখানে ।পুরো খেতকৃষিতে ভরে রেখেছিলেন সামনের উঠোনটা । চাকরির পর জগৎপুরে একটা ছোটো ছিমছাম বাড়ি করেন ।
কোভিডের সময়কাল থেকে আর তাঁর যোগাযোগ রাখা যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজখবর করে নাট্যজন সুভাষ দাসের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম তিনি ভীষণ অসুস্থ । ছেলে রানা এসে কোলকাতা নিয়ে গেছে । ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মধ্যে কথা বলেছি । মামি ফোন ধরতেন । কুশল সংবাদ জানাতেন । এবারে কোলকাতা যাওয়ার সুযোগে ভাবলাম দেখা করে আসব । সেইভাবে মামির সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছি । বাড়ির লোকেশানটাও জেনে নিয়েছি । কিন্তু আমার হঠাৎ অসুস্থতা, ডাক্তার দেখানো, নতুনমা, নতুন কুটুম্বদের আতিথেয়তা সব মিলিয়ে সময় করে উঠতে পারছিলামনা । এর মধ্যে গত শুক্রবার রাতে মামি ফোন করলেন । ভাইগনা, আইবা কইছিলা । আইলানা দেহি । কন্ঠে অভিমানের সুর । বুঝতে পেরে পরদিন সকালে যাব মন স্থির করলাম । কিন্তু ছেলের কাজ পড়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়ার পর রওনা হলাম দমদম ছাতাকলের ঠিকানায় । রানা এসে এগিয়ে নিয়ে গেল । সিঁড়িতে আমার গলা শুনেই অতি কষ্টে দরজার চৌকাঠে চলে এলেন । কথাবার্তায় সেই আগের মতোই উইট আছে । নিজের অসুস্থতা নিয়ে নিয়ে নিজেই মজা করছেন । আমি নির্বিকার চেয়ে দেখছি তাঁর দিকে । কাকে দেখছি আমি ! এই কি অসম্ভব ঈর্ষনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ননী চক্রবর্তী ? চিত্রাঙ্গদা নাটকের অর্জুন ? ডাকসাইটে এনসিসি কমিশনড অফিসার ননীগোপাল চক্রবর্তী? বাংলাসাহিত্যের শিক্ষক ননীস্যর ? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাশব্যাকের ধামাকায় । পা ফুলে আছে হাঁটু অব্দি । স্ট্রোকে মুখটা বেঁকে গেছে । মুখে জড়তা এসে গেছে । অনেকক্ষণ না শুনলে কি বলছেন বোঝা যায়না । তবু আমার শ্রীমান নাতির সঙ্গে মজা করছেন শরীরের কষ্ট ভুলে । মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন । আমি মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা টেনে আনন্দ নিতে চাইলাম । রানা বলল, তাঁর বাড়ির প্রতি বড়ো টান । মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তে চান বাড়ি ফেরার জন্যে । আমি আশ্বাস দিই, বাড়ি তো যাবেনই । আগরতলায় এসে আবার নাটক করবেন, লিখবেন । কে জানত, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষা করছে । কথায় কথায় মামি বললেন তাঁর নিজের কেমো চলছে । ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে এই ছোট্ট আবাসে তাঁদের সামলাতে । কিন্ত তাঁর নাকি শরীরের কোনো কষ্ট হচ্ছেনা । মামার জন্যে, সন্ততির জন্যে তিনি ভাবছেন । আহা ! সর্বংসহা মামি আমার !
একসময় উজ্জ্বল ইতিহাসকে ফেলে আমায় উঠতেই হল আমার সন্তানকে নিয়ে । আমার চোখে দেখা বাস্তবের নায়ক আজ বিধ্বস্ত কিং লিয়রের মতো । এদিকে একপশলা বৃষ্টি আমার হয়ে কেঁদে নিয়েছে । আমি চাইছি আমার ননীমামু-মামি ফিরে আসুন সুস্থ হয়ে ।
২০ জুলাই, ২০২২.
No comments:
Post a Comment