গতকাল ( ২৭.৭. ২০২২ ) সকাল নটা নাগাদ আগরতলা থেকে ফোন পাই আমার প্রিয়জন রাজ্যের বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী ও সঞ্চালক উদয়শংকর ভট্টাচার্যের কাছ থেকে । তিনজন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সাব্রুম আসছেন । সকালের ট্রেনটা মিস হওয়ার তাঁরা বাসে রওনা হয়েছেন । সাব্রুম শহরটা ঘুরে দেখবে । আমি যেন একটু তাঁদের পাশে থাকি । আমার শরীরটা ভালো না থাকায় বেশ কদিন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলামনা । পায়ের সমস্যাটা কমছেনা । তবুও একে তো নাচনী বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি । বাইরে বেরুনোর প্রস্তাবে আমার ভেতরটা লাফিয়ে উঠল । বার্ধক্যে গুণীজনসঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো যাবে । বাসটা কটার মধ্যে সাব্রুম পৌঁছুবে আন্দাজ করে আমি ধীরে সুস্থে তৈরি হতে থাকি । আমি উদয়শংকরদাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তাঁরা বাস থেকে কোথায় নামবেন তারপর কোথায় অবস্থান করবেন । সাব্রুমের সঙ্গে যাঁদের সামান্য যোগাযোগও আছে তাঁরা সবাই জানেন যে, সাব্রুমের শিক্ষক-কর্মচারী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়াবিদ ও মননশীল মানুষজনের মরুদ্যান হল আমাদের অগ্রজপ্রতিম অশোকদার অর্থাৎ অশোক বসাকের চায়ের দোকান । সংক্ষেপে আমরা বলি এবিসিডি । সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে শুধুমাত্র এককাপ চা সেবন করলেও দোকানের মালিকরা বিরক্ত হন না । অশোকদাও মজাদার মানুষ । উদয়শংকরদাকে এই ঠিকানা দিলাম । যথারীতি দশটার সময়ে তাঁরা ওখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমাকে ফোন করলেন । আমি একটু সময় নিয়ে হালকা খাবার ও ঔষধ খেয়ে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম ।
তারপর সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা বলার পর একটা টোটো নিয়ে বেরুলাম সাব্রুম শহর পরিক্রমায় । শহরের লোকনাথ মন্দির থেকে শুরু করে রামঠাকুর মন্দির, দৈত্যেশ্বরী কালিবাড়ি ইত্যাদি দেখার ফাঁকে ঢুকলাম গার্লস স্কুলে । এই স্কুলে ঢুকলেই সামনে পড়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ । এই সাবেক দালানটাই রাজন্য আমলে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । এখানেই ছিল বিচারশালা ।বড়ো হাকিম বসতেন । তাঁর মাথার উপর ছিল টানা পাখা । বছর কুড়ি আগেও কার্নিশের উপর পাখার ভারি কাপড় ও দড়ি গুটানো ছিল । ভারতভুক্তির পরেও প্রায় দুদশক এখানে অফিসটি ছিল । যার দরুণ এখনও এই নাতিউচ্চ টিলাভূমি ও জনবসতিটার নাম পুরাতন অফিস টিলা । স্কুলে বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন আমার ছাত্র সুশীল দে । খবর পেয়ে ছুটে এলেন । সবাইকে অতিথির মতো নিয়ে ক্যানটিনে বসিয়ে আপ্যায়ণ করলেন । সুশীলবাবুর আতিথেয়তায় মুগ্ধ তাঁরা । শিক্ষক হিসাবে আমি গর্বিত । আমাদের তো এটাই প্রাপ্তি ।
কালীমন্দিরটাও বহু প্রাচীন। পাশেই তহশিল কাছারি । রাজন্য আমলে এখানে খাজনা আদায় হত । পুণ্যাহ হত । আমি চলতে চলতে সংক্ষেপে তাঁদের এই প্রতিষ্ঠান গুলোর ইতিহাস বলে গেলাম । তাঁরা নদীটা দেখতে চাইছিলেন । তাই টোটোকে বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়ার কথা বললাম । নদীটা দেখালাম । ওপারের পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় শহরের বাড়িঘর দেখালাম । তাঁদের দর্শনের মূল আগ্রহ মৈত্রীসেতু । তাই টোটো ঘুরিয়ে ছোটোখিল রোড হয়ে চললাম মৈত্রীসেতুর দিকে ।
সকালের চড়া রোদ থাকায় বেশ গরম লাগছিল । অনেকক্ষণ কথা হল ফেনীনদীর গতিপথ, দুপারের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে । দুদিকেই জোর নির্মানকাজ চলছে । পণ্য আদানপ্রদান না হলেও মানুষজন আসাযাওয়ার কাজ একদুমাসের মধ্যে শুরু হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ।
ফিরে আসার সময় আমি স্বগতোক্তি করলাম, দেখবেন আগামী একবছর পরে এই জায়গা জমজমাট হয়ে যাবে । তাঁরা সমস্বরে জবাব দিলেন । জমজমাট না হলেই ভালো । আমাদের আর ভিড়ঘিঞ্জি ভালো লাগেনা । আমরা এগুলো ছাড়াতে চাইছি । বোঝা গেল সাব্রুমের সৌম্য শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশটা তাঁদের আকৃষ্ট করেছে ।
ফেরার পথে আমার এক ছাত্র বিভাস বসাক তাদের সাংগঠনিক প্রয়োজনে টোটোটার সাহায্য চাইছিল । আর কাউকে বোধহয় পাচ্ছিলনা । আমি বিষয়টা বুঝে ড্রাইভারকে বললাম আমাদের সাব্রুম বয়েজ স্কুলের সামনে নামিয়ে দিতে । স্কুল কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা হরি চৌমুহুনীতে হেঁটে চলে যাব । সে যেন এইফাঁকে ওদের কাজটা সেরে ফিরে আসে ।
এরপর সাব্রুম স্কুলে প্রধান শিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয়ের কক্ষে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কথাবার্তা বলে আমাদের ছাত্র বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক রতন চক্রবর্তীসহ ছবি তোলা হল । হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চুমকি হোটেলের সামনে । মিছিল শেষ হওয়ার পর টোটোটা ফিরে এল ।
সেখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার পথে তাঁদের কয়েকমিনিট সময় নষ্ট করে আমার বাসাটা দেখিয়ে নিলাম । আমার ঘরে বসে একটু কথা হল । এতক্ষণ আমি কারো নাম ধাম জেনে নিইনি । এখন আমার আর মনে থাকেনা । তাই ডায়েরিতে লিখে নিলাম । যাঁদের নিবিড় সান্নিধ্যে কালকের দিনের প্রথমার্ধ স্বর্গপুরীর নন্দনভ্রমণের অনুভব হল, সেই স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীরা হলেন–
১. ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক- কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ।
২. দেবজিৎ পাল, শিক্ষক- জাশেদপুর পাবলিক স্কুল, জামশেদপুর, ঝাড়খন্ড ।
৩. বিরাজকুমার পাল, অধ্যাপক- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ।
অল্পসময়ের জন্যে হলেও তাঁদের সান্নিধ্য আমার সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে । খুবই খারাপ লাগছিল আমার বাড়ির সামনে থেকে তাঁদের বিদায় জানাতে গিয়ে । আর কবে দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা । ভালো থাকুন, আমার শহরের এই ক্ষণিকের অতিথিরা ।
২৮. ৭. ২০২২.
No comments:
Post a Comment