কার্তিকের কাব্যকথা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– দীপালিকায় জ্বালাও আলো
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে । ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
বাঙালি জীবনের বারোমাস্যায় কার্তিকেরও ভূমিকা রয়েছে ।আশ্বিনের সংক্রান্তির সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় কার্তিকের আবাহন । হেমন্তের ঋতুর শুরুও এই সময় । প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কার্তিকমাসব্যাপী রাত্রিবেলা প্রতি গৃহস্থের উঠোনে জ্বালানো হয় আকাশপ্রদীপ । ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সারা কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয় । শাস্ত্রে আছে ভগবান বিষ্ণু দীর্ঘ চারমাস যোগনিদ্রায় অভিভূত থেকে এই মাসেই জেগে ওঠেন । তিনি পৃথিবীকে পালন করেন । তাই তাকে সন্তুষ্ট রাখতে ধর্মপ্রাণ হিন্দু জনগণ সারা কার্তিক মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঘি বা তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে । বাড়ির সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পূর্ব বা উত্তরমুখী করে প্রদীপ জ্বালানো হয় ।
এই মাটির প্রদীপ আসলে মানবদেহেরই প্রতীক । ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম এই পঞ্চভূতে যেমন নশ্বর দেহ তৈরি হয় মাটির প্রদীপ ঠিক তেমনি । ক্ষিতি বা মাটি দিয়ে প্রদীপের শরীর তৈরি হয় । অপ বা জল দিয়ে তার আকৃতি গঠন করা হয় । তেজ বা আগুন আত্মার মতো স্থিত হয় প্রদীপের অন্তরে । বাতাস সেই আগুনকে দহনে সহায়তা করে । আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে । জীবন্ত কর্মময় মানুষের প্রতীক প্রদীপ নির্বাপিত হওয়া জীবনেরই পরিসমাপ্তি । লোকবিশ্বাস মানুষ মৃত্যুর পরে বিষ্ণুলোকে গমন করে । কাজেই মৃত্যুর পরে মানুষের উপর বিষ্ণুরই অধিকার রয়েছে । সেকারণেই পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির লক্ষ্যেই ভগবান বিষ্ণুকে প্রসন্ন রাখার উদ্দেশ্যে এই সময়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ।
এছাড়া এইসময়ে শীতের শুরু হয়ে যেত একসময় । বর্তমানে পরিবেশে বিশাল পরিবর্তন হওয়ার ফলে মূল শীত ঋতুতেও ততটা শীত থাকে না । প্রাচীন মানুষ শীতনিবারণের জন্য অগ্নির ব্যবহার করত । শীত ঋতুতে অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাসের কারণেও এই প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা । আবার এইসময়ে নতুন ধান পাকতে শুরু করে । এই সুযোগে সুপুষ্ট ধানকে পোকায় কেটেও নষ্ট করতে থাকে । এই মাসে আকাশ প্রদীপের আলো দেখে ধানের পোকাগুলো আলোর দিকে উড়ে আসে । খেতের ফসল পোকার হাত থেকে রক্ষা করার লৌকিক পদ্ধতিও ছিল এই প্রদীপ প্রজ্জলন । এক কথায় কার্তিকমাসের এই প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে বেশ কয়েকটা ধর্মীয় লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার এবং লোকবিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে ।
কার্তিক মাস এলেই প্রকৃতি অপরূপ রূপ নিতে থাকে । গাছে গাছে সাদা শিউলি ফুটে থাকে । ভোরের দিকে ঝরে পড়া এই ফুল কুয়াশায় মিশে খইয়ের মত গাছ তলায় পড়ে থাকে । শিউলির মৃদুগন্ধ ভোরের পরিবেশকে মধুর করে তোলে । বিস্তীর্ণ ক্ষেতের ধান ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ধরতে থাকে । কুয়াশামাখা সোনালি ধান মাঠের বুকে যখন ছড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় সোনার বসন পরে যেন এক অপরূপা রমণী মাঠময় শুয়ে আছে । একদিন ঘরে নতুন ধান উঠে । কৃষকের প্রাণে নতুন বার্তা সঞ্চারিত হয় । আয়োজন চলে নবান্নের । কার্তিকের প্রকৃতির অপরূপ রূপ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে–
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়– হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়
( রূপসী বাংলা )
কার্তিক মাস এলেই নতুন ধানের সৌরভের প্রত্যাশায় প্রকৃতি আর মাঠের সোনালি ধানের সোনারঙের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয় আবহমান বাঙালি । তার ভরসার মাস এই কার্তিক ।