নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যময় দেশ । সুদূর অতীত থেকে বহু জনধারা এখানে এসে মিশেছে । সেইসঙ্গে মিশেছে নানাজাতির নানা সংস্কৃতি এখানকার মানুষের যাপনভুবনে । সহস্রস্রোতধারা মিলে মিশে হয়েছে নবীন ভারত । যার বৈশ্বিক নাম ইন্ডিয়া । সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের ( article- 1 ) ভাষায় দুটি নামই স্বীকৃত । এই দুই নামের সৃষ্টিতে কত প্রাচীন তথ্য, কত প্রাচীন ইতিহাস । আর সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক উপাদানকে ভুলে গিয়ে স্মরণকালের তথ্য নিয়ে চলছে মাতামাতি ।
ভারতবর্ষের প্রাচীন নাম ছিল জম্বুদ্বীপ । যারা আক্ষরিক অর্থ 'জাম গাছে ভরা দ্বীপ' । সনাতন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ শব্দের প্রকৃত অর্থ 'সাধারণ মানুষের বাসভূমি' । সূর্যসিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন লিপিতে ও ধর্মগ্রন্থে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ আছে । প্রাচীনকালে ভারতকে 'আর্যাবর্ত'ও বলা হত । চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের নামে এ দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ । আমরা এখন শুধু ভারত বলি । 'ভারত' নামটি বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণ থেকে এসেছে । ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার মতে, 'ভরত' নামে এক প্রাচীন উপজাতির নাম অনুসারে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে । ঋকবেদে এই 'ভরত' নামক প্রাচীন উপজাতির উল্লেখ আছে । অনেক ঐতিহাসিকের মতে কলিঙ্গরাজ খারবেল-এর হস্তিগুম্ফার শিলালিপিতে 'ভারধবস' শব্দের ব্যবহার দেখা যায় এবং এই নাম গুপ্তযুগে ভারতবর্ষ নামে খ্যাতি লাভ করে । তেমনি 'ইন্ডিয়া' নামের পিছনেও বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে । খ্রিস্টপূর্ব তিনশো দুই অব্দে মেগাস্থিনিস ভারতে এসেছিলেন । তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের নাম 'ইন্ডিকা' অর্থাৎ ভারত সম্পর্কিত । ক্লডিয়াস টলেমির ( ৯০–১৬৮খ্রি. পূ. ) ভূগোল গ্রন্থটিও এপ্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ । খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চমশতকে হেরোডোটাস এর সময়ে গ্রীক শব্দ 'ইন্দ' থেকে তার উৎপত্তি । প্রাচীন গ্রীকরা ভারতীয়দের বলত 'ইন্দোই' বা ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) নদী অববাহিকার অধিবাসী । সিন্ধুনদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে ইংরেজিতে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি এসেছে । অ্যাংলো-স্যাকশনদের কাছে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি পরিচিত ছিল এবং রাজা আলফ্রেডের Orosius অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায় । Middle English-এ ফরাসি প্রভাবে শব্দটি Ynde বা Inde-তে পরিণত হয় । এটিই Early modern English-এ India হিসাবে পরিচিত হয় ।বর্তমান India নামটি ১৭শতক থেকে প্রচলিত । কাজেই আজকের দিনে India নামের উৎস নিয়ে যে বিতর্ক তা কতটা সঠিক সে নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে । মোটকথা দেশের নাম পরিবর্তনের এই বিতর্কের ফলে ভারতবর্ষের কয়েকহাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । এত কিছু করেও এই দেশের মহাকালের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভারতবর্ষের সংস্কৃতির যে নান্দনিক সৌন্দর্য মানুষের অন্তরে গেঁথে গেছে তা কিছুতে এড়ানো যাবে না ।
আমাদের এক প্রান্তের সংস্কৃতি আর এক প্রান্তের জনগণের মধ্যে অজান্তেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে । বহু প্রাচীনকাল থেকে বহু মানবের ধারা এ দেশে মেশার ফলে আজকের ভারতীয় সংস্কৃতি রূপ পেয়েছে । আর্যদের আগমনের পূর্বে এ দেশে অনার্যদের বসবাস ছিল । এদেশের আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক্ট, দ্রাবিড় ও ভোটচিনিয়, এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল । অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ইন্দোচিন থেকে আসাম হয়ে অস্ট্রিক জাতি বাংলাদেশের প্রবেশ করে অন্তত পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে । আর্যরা অস্ট্রিকদের 'নিষাদ' বলত । ভারতবর্ষে মূলত বিহার ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গ ও বিভিন্ন প্রদেশে এই অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, বিরহোর, কুরকু,সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি অস্ট্রিক জাতির অংশ । তাদের ভাষা ও অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্গত । এদেশে কৃষিকাজের প্রচলন অস্ট্রিকদের উত্তরাধিকার । অস্ট্রিকদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল কৃষি নির্ভর । তারা কলা, লাউ, বেগুন, নারকোল, পান, সুপারি হলুদ, আদা প্রভৃতি ফসলের চাষ করত । হাতিকে তারা পোষ মানিয়েছিল । অস্ট্রিকরা সুতিবয়ন ও আখের রস থেকে চিনি তৈরি করত । তাদের মধ্যে পঞ্চায়েত প্রথার প্রচলন ছিল । বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতেও তাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । কার্পাস, তাম্বুল মরিচ, নারিকেল, কদলী, গুবাক প্রভৃতি ফল অস্ট্রিক শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে পরবর্তী সময়ে বাংলা শব্দভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । বাখারি, খড়, খামার, খোকা, খুকি, ডাঙা, ডিঙা, চোয়াল, চোঙা, ঝাউ, ঝিঙা, ঝাঁটা প্রকৃতির শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারের স্থান করে নিয়েছে । বাঙালির অনেক প্রচলিত সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানে অস্ট্রিক জাতির প্রভাব রয়েছে যেমন কৃষি সম্পর্কিত পৌষপার্বন, নবান্ন ইত্যাদি উৎসব চড়ক ও গাজন, পূজায় ঘটের ব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাল, দুর্বা, পান সুপারি, সিঁদুর, কলার ব্যবহার ও নানামুখী মেয়েলি ব্রত, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি অস্ট্রিক প্রভাবিত । তান্ত্রিক বৌদ্ধ, নাথপন্থ, ধর্মঠাকুর, লিঙ্গরূপী শিবপূজা, বৃক্ষপূজা, মাতৃপূজা ইত্যাদির মধ্যে অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাবনা বিদ্যমান ।আমাদের শাক্ত, বৈষ্ণবরা মাতৃকা ( রাধারানি ) উপাসক । সাঁওতাল গ্রামে গেলে সারিবদ্ধ মাটির বাড়ির সমস্ত দেওয়াল জুড়ে তাদের স্বকীয় চিত্রে ভরে উঠতে দেখা যায় । যেখানে অন্যান্য জাতির চিত্রকলায় ধর্মীয় ভাবাবেগ ও আস্থা ফুটে ওঠে সেখানে সাঁওতালি চিত্রকলায় প্রকৃতি এবং তাদের জীবন যাপনের চিত্রই হয়ে ওঠে প্রধান উপজীব্য । সে কারণেই সাঁওতালি চিত্রকলার এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে ।
অস্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড়জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা বিস্তার লাভ করে । দ্রাবিড়রা সর্বপ্রথম বাংলাঅঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে । বাংলাদেশের মানুষ নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে অধিকাংশই দ্রাবিড় জাতির বংশধর । বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর গভীর প্রভাব রয়েছে ।
বাংলার লোকধর্মে অধিদেবতার পূজা, পবিত্র বৃক্ষ ও প্রাণীর ধারণাগুলিকেও প্রাক্ বৈদিক দ্রাবিড় ধর্মের উদ্বর্তন হিসেবে মেনে নেওয়া হয় । আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সঙ্গে আর্যদের সংঘাত শুরু হয় । আর্যরা দ্দেরাবিড়র 'অসুর' বলে নিন্দা করত । বাংলার স্থাননামে এখনো দ্রাবিড় প্রভাব রয়ে গেছে । পূর্বভারতের পাঁচটি আদি জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, সুহ্ম সম্ভবত দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল । এই পাঁচজন ছিলেন অসুররাজ বলির পুত্র । বলি অবশ্যই দ্রাবিড় সভ্যতার প্রাচীনতম কিংবদন্তির একজন । অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালিজাতি । এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান । আর্যদের সঙ্গে সংঘাতের ফলে দ্রাবিড়রা ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে যায় । আর্যজাতি উত্তরভারতে, দ্রাবিড়রা দক্ষিণভারতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ৷ দ্রাবিড়জাতির ভাষার নামও দ্রাবিড় ৷ দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় গোত্রের প্রধান চারটি ভাষা হলো - কন্নড়, মালয়ালি, তামিল ও তেলেগু ৷ এই ভাষাভাষী অঞ্চল তাই দ্রাবিড়ভূমি ।
বাংলাভাষায় অস্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দও বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ৷ একসময় সারা উপমহাদেশে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যের ফলেই বাংলাভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রবেশ ঘটে ৷ দ্রাবিড় ভাষার কাল (সময়), কলা, পুষ্প, মুকুল, পূজা, গণ, কোণ, নীল, ফল, উলু, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, কুন্ড, খড়্গ, দন্ড, বিল, ময়ূর, কাক কাজল, কোদাল, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘুণ, কুটুম্ব, ডালিম্ব, নীল, মীন ইত্যাদি ৷ বাংলার বগুড়া, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ইত্যাদি ড়া, গুড়ি-যুক্ত স্থাননামে দ্রাবিড় প্রভাব রয়েছে ৷ এছাড়া উর, পুর, খিল তালক, পাঠক এগুলোও দ্রাবিড় শব্দ প্রভাবিত ৷ বাংলা ব্যাকরণের অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ভিতের উপর গড়ে উঠেছে ৷
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বাংলার উপরে দ্রাবিড় প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে রয়েছে ৷ বাংলার দেবাদিদেব মহাদেব তো দ্রাবিড় পশুপতিনাথ শিব ৷ আর শৈবসাধনা হলো যোগসাধনা ৷ দ্রাবিড়দের এই সাধনপদ্ধতি বাংলার আধ্যাত্মিক জীবনের গভীরে প্রোথিত ৷ এভাবেই দ্রাবিড় অনার্য দেবদেবীদের মধ্যে চান্ডী(চন্ডী), মঞ্চাম্মা (মনসা) প্রভৃতি এবং উমা, বিষ্ণু, জগন্নাথ,বাসুদেব, শক্তি, শীতলা, বৃক্ষপূজা, যুগলমূর্তি পূজার প্রচলন এসেছে ৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন হরপ্পা সভ্যতা থেকেই বাঙালির মাতৃকা উপাসনার দ্রাবিড় উত্তরাধিকার ।
দ্রাবিড়রা নগরজীবনের পাশাপাশি কৃষিজীবনেও পারদর্শী ছিলেন ৷ সংষ্কৃত ব্রীহি ও তন্ডুল অর্থে ধান্য বোঝায় ৷ এদুটিই দ্রাবিড় ভাষা ৷ এতেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে দ্রাবিড়রা প্রাচীন ধান চাষও করতেন ৷ এককথায় দ্রাবিড়রা বহুভাবেই প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷
ইতিহাসের বিবর্তনে এক সময়ে পাশাপাশি থাকা একাধিক জনগোষ্ঠী যে কালক্রমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানেই না । কিন্তু বহু বহু শতাব্দী প্রাচীনকালে পারস্পরিক সহাবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আত্মীকরণ ঘটে গেছে এবং তার রেশ যে বহু দীর্ঘ সময় পরেও জীবনের গভীরে বেঁচে আছে, তা দেখে চমকে উঠতে হয় । তার একটি নিদর্শন গতকাল হঠাৎ চোখে পড়ায় এই লেখার অবতারণা ।
গত পরশু এসেছি ব্যাঙ্গালুরুতে বড়ো শ্রীমানের কাছে । মানবেতিহাসের ধারা বেয়ে বাঙালির আদিরক্তের সন্ধানে এক খোঁজ মনে হল এই পরিক্রমণ । গতকাল বিকেলে এই মেট্রো শহরের এ ই সি এস লে-আউটে ঘুরতে ঘুরতে একটা কাফেটোরিয়াতে সপরিবারে ঢুকেছিলাম কিঞ্চিৎ জলযোগের জন্যে । ভেতরে ঢুকে বসতেই চোখ পড়ল সুদৃশ্য শোকেসের উপরের দিকে । ওপরের কার্নিশ জুড়ে টানা অস্ট্রিক চিত্রশিল্প, সাঁওতালি চিত্রের অলংকরণ । শান্তিনিকেতনে দেখেছি এ জাতীয় চিত্র । আমার সারা শরীর শিউরে উঠল । অতীত ইতিহাসের এক আবছা সময়ে এখানকার দ্রাবিড় জাতির পূর্বপুরুষেরা আর্যবিতাড়িত হয়ে প্রতিবেশী অস্ট্রিকদের সান্নিধ্য ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও প্রতিবাসীসংস্কৃতি অজান্তেই রক্তে মিশে গেছে এবং তা বয়ে চলেছে আজও । এ যে তারই প্রতিফলন । ক্যাফেটোরিয়ার মালিক নিজেও জানেন না এই সৃজন তাঁরই পূর্বপুরুষের রক্তধারায় বয়ে আনা উত্তরাধিকার । সেই অধিকারেই অস্ট্রিকশিল্প স্থান পেয়েছে দ্রাবিড়ভুবনে । এই নির্মানই ভারতশিল্প । ভারতকথা । মহান ভারতের কথা । 'ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান' ।
এইসিটিএস লে-আউট, ব্যাঙ্গালুরু,
১২. ৯. ২০২৩.