Saturday, September 30, 2023

ত্রিপুরার বাংলাভাষা

ত্রিপুরার বাংলাভাষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

ত্রিপুরায় প্রচলিত বাংলাভাষার মধ্যে সম্প্রতি একটা নিজস্বতা তৈরি হচ্ছে । এখানকার বাংলাভাষাটাকে জানতে হলে এই অঞ্চলের ভূগোল ও ইতিহাসকে একটু জানতে হবে । বর্তমান যে ত্রিপুরা তা একসময়ের রাজন্য ত্রিপুরা বা পার্বত্য ত্রিপুরা নামে পরিচিত ছিল  । ১৯৪৮ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরার রাজ্য ভারতভূক্ত হয় । রাজন্য আমলে ত্রিপুরার সন্নিহিত পূর্ববঙ্গের  কুমিল্লা, নোয়াখালি ও শ্রীহট্টে কিয়দংশ ছিল ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারী যা চাকলা রোশনাবাদ বা জিলা ত্রিপুরা নামে খ্যাত । ভারতভাগের পর চাকলা রোশনাবাদের মানুষ তাদের রাজার তালুক ত্রিপুরারাজ্যে আশ্রয় নেন । ফলে ত্রিপুরারাজ্যের বিভিন্ন অংশে তৎসীমান্তবর্তী পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের মানুষের ভাষাটাই বেশি প্রচলিত । ফলে ত্রিপুরার উত্তরাংশে সিলেটি প্রভাব রয়েছে । আগরতলা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রভাব, উদয়পুর, অমরপুর, সোনামুড়া কুমিলা ও কিয়দংশ নোয়াখালি প্রভাবিত । বিলোনিয়া, শান্তিরবাজার নোয়াখালি, সাব্রুম নোয়াখালি ও চট্টগ্রাম প্রভাবিত । মোটামুটি এরকম হলেও রিহ্যাবিলিটেশনের কারণে কোথাও কোথাও এই সূত্রটি মেলে না । রিফিউজি পুনর্বাসনের কারণে কুমারঘাটে 'চিটাগাং বস্তি' আছে । আবার দক্ষিণের সাতচাঁদে তিতাস পারের মানুষ আছেন । এছাড়া সামাজিক সম্পর্কজনিত কারণে এক অঞ্চলের ভাষাভাষী পরিবারের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা মিশে গেছে । এছাড়া অল্পস্বল্প বাংলাদেশের অন্য জেলার মানুষও রয়েছেন । এককথায় ত্রিপুরা একটা মিনি বাংলাদেশ বলা যায় ।‌ আরো কিছু সুক্ষ্ম বিভাজন করা যায়, তবে এই জাতীয় মিশ্রণের ফলে এখানে একটা নতুন ভাষাধারা রূপ নিচ্ছে ভাষাতাত্ত্বিক নিয়মেই ।

Monday, September 18, 2023

ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি

ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হলেও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র । এখানে সরকার কর্তৃক ছয়টি স্বীকৃত ধর্ম হল– ইসলাম, খ্রিস্টানদের দুটি গ্রুপ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও কনফুসিয় । জনসংখ্যার ৮৬.১শতাংশ মুসলমান, ৮.৭ শতাংশ খ্রিষ্টান, এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৩ শতাংশ । ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়াতে ৪৬,৪৬,৩৫৭ জন হিন্দু আছে । ইন্দোনেশিয়া মিশ্র সংস্কৃতির দেশ । ইন্দোনেশিয়া আগে কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের ( দ্বীপপুঞ্জের ) সমষ্টি ছিল । তাদের নাম ছিল জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণিও, বালি ইত্যাদি । খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করে । খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় এক হাজার বছর ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল । সে হিসেবে তারা হিন্দু ধর্মকে অনুসরণ করেছিল । রাজারা হিন্দু দেবতাদের উপাসনা করতেন এবং বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ।

ভারতবর্ষ ও  ইন্দোনেশিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে রামায়ণের কাল থেকে । যবদ্বীপ বা জাভা-র কথা ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়ণের উল্লেখ আছে । সুগ্রীব সীতার খোঁজে তাঁর সৈন্যদের জগতে পাঠিয়েছিলেন । ইন্দোনেশিয়া নামটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) থেকে এসেছে যার অর্থ ভারত এবং গ্রিক 'মেসোস' থেকে যার অর্থ দ্বীপ । এখানে সিন্ধু নদ বা সিন্ধু সভ্যতা না থাকলেও উভয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের কারণে এই নামকরণ হয়েছে ।  ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । জাভাতে প্রম্বানানের খোলা থিয়েটারে জাপানিজ মুসলমানরা পূর্ণিমার রাতে রামায়ণ নৃত্য পরিবেশন করে । ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে গভীর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের উদাহরণ নবম শতাব্দীর বোরোবুদুর এবং প্রম্বানান মন্দির । শৈলেন্দ্র রাজবংশের দ্বারা নির্মিত বোরোবুদুর মন্দিরের নকশা ভারতীয় গুপ্ত স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে । মধ্য দফার প্রম্বানান মন্দিরে হিন্দু স্থাপত্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ইন্দোনেশিয়া মৌখিক ঐতিহ্য ও সাহিত্যের পান্ডুলিপি সংরক্ষণের লিপি ছিল সংস্কৃত । ইন্দোনেশিয়ায় আবিষ্কৃত অষ্টম শতাব্দীর প্রাচীন শিলালিপি গুলো যেমন 'কাংগল' শিলালিপি, তেমনি প্রথম সহস্রাবদের মুর্তিকল্পে শিবলিঙ্গ ও তার সঙ্গী দেবী পার্বতী, গণেশ, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, অর্জুন ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর ব্যাপক গ্রহণ নিশ্চিত করে । বালি, সুমাত্রা ও অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে হিন্দু সংস্কৃতির পুরোমাত্রায় বহমান এবং ইন্দোনেশিয়ায় ভারতের এই সংস্কৃতি যথেষ্ট সমাদর করা হয়ে থাকে । ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের গৌরবজ্জ্বল অতীত তারা বিসর্জন দেয়নি । বরং উত্তরোত্তর তার পরিচর্যা পরিবর্ধন করে দেশটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে । 

মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও হিন্দু ধর্মের অনেক দেবদেবীকেই ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত পবিত্র পাখি গরুড়েএর নামেই ইন্দোনেশিয়ার সরকারি বিমান সংস্থা 'গরুড়' এয়ারলাইন্স নামকরণ করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থার সরকারি ম্যাস্কট হল 'হনুমান' । তাদের লোকো কাহিনীতে 'নাগ' নামে সর্পপ্রতিম চরিত্র পাওয়া যায় । অনেক জায়গায় দেওয়ালে কুবেরের চিত্র অঙ্কিত হতে দেখা যায় । জাকার্তার সেন্ট্রাল পার্কে একাদশ ও বাহিত রথে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে সওয়ার হওয়ার স্থাপত্য ও দেখা যায় ।

Sunday, September 17, 2023

গণেশের বাহন ইঁদুর কেন ?

গণেশের বাহন ইঁদুর কেন ?

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

প্রশ্ন উঠতেই পারে এত এত প্রাণী থাকতে এই খুদে ইঁদুরকে কেন বিশাল বপু গণেশের বাহন করা হলো ? এ নিয়ে একটা পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে । দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় ক্রঞ্চ  নামে এক গন্ধর্ব ছিল । সে দেবসভায় গান পরিবেশন করে দেবতাদের মনোরঞ্জন করত । এভাবে সুখেই তার দিন চলছিল । একদিন সেই দেবসভায় বামদেব নামে এক মুনি এসে উপস্থিত হলেন । মুনি দেবসভায়  উপস্থিত হয়েই দেবতাদের কাছে গান গাওয়ার বায়না ধরলেন । মুনি এমন নাছোড়বান্দা যে দেবতারা মুনিকে অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন । মুনি অনুমতি পাওয়া মাত্র বেসুরো গলায় গান গাইতে আরম্ভ করলেন । মুনির এই উদ্ভট গান শুনে ক্রঞ্চ আর হাসি চেপে রাখতে পারল না । সে ফিক্ করে হেসে ফেলল । তার হাসি মুনির দৃষ্টিগোচর হল । উপহাস করার অপরাধে মুনি তাকে অভিশাপ দিলেন যে, সে মর্তে ইঁদুর হয়ে জন্মগ্রহণ করবে । ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে ক্রঞ্চ কান্নাকাটি শুরু করল । সে মুনির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল । কিন্তু মুনি তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিলেন না । দেবতাদের অনুরোধে শেষে মুনি বললেন, গণেশ যদি তাকে তাঁর বাহন করে তবে সে ইঁদুর জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করবে ।

ক্রঞ্চ ইঁদুর হয়ে মর্ত্যে একটি মাঠের মধ্যে তার বাসা বাঁধল । সেই মাঠের কাছেই ছিল পরাশর মুনির আশ্রম । ইঁদুর প্রতিদিন আশ্রমের ফসল নষ্ট করত ও নানা রকম ক্ষতিসাধন করত । ফলে মুনিরা ও আশ্রমবাসীরা তার উপর ভীষণ বিরক্ত হয় । তারা অতিষ্ঠ হয়ে দেবতা গণেশের শরণাপন্ন হন । দেবতা গণেশ পরাশর মুনির আশ্রমে এসে ইঁদুরকে পাকড়াও করার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেন । একসময় ইঁদুর গণেশের হাতে ধরাও পড়ে । গণেশ যখন তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হন তখন ক্রঞ্চ গণেশের কাছে তার নিজের পরিচয় দেয় এবং পূর্ব অভিশাপের কথা জানায় । সে আরো জানায় যে, গণেশ যদি তাকে তাঁর বাহন করে নেন তাহলে সে মুক্তি পাবে । তখন গণেশ এই ইঁদুরকে তাঁর বাহন করে নেন । সেই থেকে গণেশের বাহন ইঁদুর ।

আজ আজ গণেশ চতুর্থী । সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রসঙ্গক্রমে গণেশের বাহন ইঁদুরের পৌরাণিক কাহিনিটি এখানে তুলে ধরলাম ।

Tuesday, September 12, 2023

নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান

নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 


 ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যময় দেশ । সুদূর অতীত থেকে বহু জনধারা এখানে এসে মিশেছে । সেইসঙ্গে মিশেছে নানাজাতির নানা সংস্কৃতি এখানকার মানুষের যাপনভুবনে । সহস্রস্রোতধারা মিলে মিশে হয়েছে নবীন ভারত । যার বৈশ্বিক নাম ইন্ডিয়া ।  সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের (  article- 1 ) ভাষায় দুটি নামই স্বীকৃত । এই দুই নামের সৃষ্টিতে কত প্রাচীন তথ্য, কত প্রাচীন ইতিহাস । আর সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক উপাদানকে ভুলে গিয়ে স্মরণকালের তথ্য নিয়ে চলছে মাতামাতি ।

 ভারতবর্ষের প্রাচীন নাম ছিল জম্বুদ্বীপ । যারা আক্ষরিক অর্থ 'জাম গাছে ভরা দ্বীপ' । সনাতন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ শব্দের প্রকৃত অর্থ 'সাধারণ মানুষের বাসভূমি' । সূর্যসিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন লিপিতে ও ধর্মগ্রন্থে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ আছে । প্রাচীনকালে ভারতকে 'আর্যাবর্ত'ও বলা হত । চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের নামে এ দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ । আমরা এখন শুধু ভারত বলি । 'ভারত' নামটি বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণ থেকে এসেছে । ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার মতে, 'ভরত' নামে এক প্রাচীন উপজাতির নাম অনুসারে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে । ঋকবেদে এই 'ভরত' নামক প্রাচীন উপজাতির উল্লেখ আছে । অনেক ঐতিহাসিকের মতে কলিঙ্গরাজ খারবেল-এর হস্তিগুম্ফার শিলালিপিতে 'ভারধবস' শব্দের ব্যবহার দেখা যায় এবং এই নাম গুপ্তযুগে ভারতবর্ষ নামে খ্যাতি লাভ করে । তেমনি 'ইন্ডিয়া' নামের পিছনেও বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে । খ্রিস্টপূর্ব তিনশো দুই অব্দে মেগাস্থিনিস ভারতে এসেছিলেন । তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের নাম 'ইন্ডিকা' অর্থাৎ ভারত সম্পর্কিত । ক্লডিয়াস টলেমির ( ৯০–১৬৮খ্রি. পূ. ) ভূগোল গ্রন্থটিও এপ্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ । খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চমশতকে হেরোডোটাস এর সময়ে গ্রীক শব্দ 'ইন্দ' থেকে তার উৎপত্তি । প্রাচীন গ্রীকরা ভারতীয়দের বলত 'ইন্দোই' বা ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) নদী অববাহিকার অধিবাসী । সিন্ধুনদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে ইংরেজিতে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি এসেছে । অ্যাংলো-স্যাকশনদের কাছে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি পরিচিত ছিল এবং রাজা আলফ্রেডের Orosius অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায় । Middle English-এ  ফরাসি প্রভাবে শব্দটি Ynde বা Inde-তে পরিণত হয় । এটিই Early modern English-এ India হিসাবে পরিচিত হয় ।বর্তমান India নামটি ১৭শতক থেকে প্রচলিত । কাজেই আজকের দিনে India নামের উৎস নিয়ে যে বিতর্ক তা কতটা সঠিক সে নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে  । মোটকথা দেশের নাম পরিবর্তনের এই বিতর্কের ফলে ভারতবর্ষের কয়েকহাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে  ।  এত কিছু করেও এই দেশের মহাকালের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভারতবর্ষের সংস্কৃতির যে নান্দনিক সৌন্দর্য মানুষের অন্তরে গেঁথে গেছে তা কিছুতে এড়ানো যাবে না । 

আমাদের এক প্রান্তের সংস্কৃতি আর এক প্রান্তের জনগণের মধ্যে অজান্তেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে । বহু প্রাচীনকাল থেকে বহু মানবের ধারা এ দেশে মেশার ফলে আজকের ভারতীয় সংস্কৃতি রূপ পেয়েছে । আর্যদের আগমনের পূর্বে এ দেশে অনার্যদের বসবাস ছিল । এদেশের আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক্ট, দ্রাবিড় ও ভোটচিনিয়, এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল । অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ইন্দোচিন থেকে আসাম হয়ে অস্ট্রিক জাতি বাংলাদেশের প্রবেশ করে অন্তত পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে । আর্যরা অস্ট্রিকদের 'নিষাদ' বলত । ভারতবর্ষে মূলত বিহার ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গ ও বিভিন্ন প্রদেশে এই অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, বিরহোর, কুরকু,সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি অস্ট্রিক জাতির অংশ । তাদের ভাষা ও অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্গত । এদেশে কৃষিকাজের প্রচলন অস্ট্রিকদের উত্তরাধিকার । অস্ট্রিকদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল কৃষি নির্ভর । তারা কলা, লাউ, বেগুন, নারকোল, পান, সুপারি হলুদ, আদা প্রভৃতি ফসলের চাষ করত । হাতিকে তারা পোষ মানিয়েছিল । অস্ট্রিকরা সুতিবয়ন ও আখের রস থেকে চিনি তৈরি করত । তাদের মধ্যে পঞ্চায়েত প্রথার প্রচলন ছিল । বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতেও তাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । কার্পাস, তাম্বুল মরিচ, নারিকেল, কদলী, গুবাক প্রভৃতি ফল অস্ট্রিক শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে পরবর্তী সময়ে বাংলা শব্দভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । বাখারি, খড়, খামার, খোকা, খুকি, ডাঙা, ডিঙা, চোয়াল, চোঙা, ঝাউ, ঝিঙা, ঝাঁটা প্রকৃতির শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারের স্থান করে নিয়েছে । বাঙালির অনেক প্রচলিত সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানে অস্ট্রিক জাতির প্রভাব রয়েছে যেমন কৃষি সম্পর্কিত পৌষপার্বন, নবান্ন ইত্যাদি উৎসব চড়ক ও গাজন, পূজায় ঘটের ব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাল, দুর্বা, পান সুপারি, সিঁদুর, কলার ব্যবহার ও নানামুখী মেয়েলি ব্রত, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি অস্ট্রিক প্রভাবিত । তান্ত্রিক বৌদ্ধ, নাথপন্থ, ধর্মঠাকুর, লিঙ্গরূপী শিবপূজা, বৃক্ষপূজা, মাতৃপূজা ইত্যাদির মধ্যে অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাবনা বিদ্যমান ।আমাদের শাক্ত, বৈষ্ণবরা মাতৃকা ( রাধারানি ) উপাসক । সাঁওতাল গ্রামে গেলে সারিবদ্ধ মাটির বাড়ির সমস্ত দেওয়াল জুড়ে তাদের স্বকীয় চিত্রে ভরে উঠতে দেখা যায় । যেখানে অন্যান্য জাতির চিত্রকলায় ধর্মীয় ভাবাবেগ ও আস্থা ফুটে ওঠে সেখানে সাঁওতালি চিত্রকলায় প্রকৃতি এবং তাদের জীবন যাপনের চিত্রই হয়ে ওঠে প্রধান উপজীব্য । সে কারণেই সাঁওতালি চিত্রকলার এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে । 

অস্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড়জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা বিস্তার লাভ করে । দ্রাবিড়রা সর্বপ্রথম বাংলাঅঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে । বাংলাদেশের মানুষ নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে অধিকাংশই দ্রাবিড় জাতির বংশধর । বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর গভীর প্রভাব রয়েছে ।
বাংলার লোকধর্মে অধিদেবতার পূজা, পবিত্র বৃক্ষ ও প্রাণীর ধারণাগুলিকেও প্রাক্ বৈদিক দ্রাবিড় ধর্মের উদ্বর্তন হিসেবে মেনে নেওয়া হয় । আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সঙ্গে আর্যদের সংঘাত শুরু হয় । আর্যরা দ্দেরাবিড়র 'অসুর' বলে নিন্দা করত । বাংলার স্থাননামে এখনো দ্রাবিড় প্রভাব রয়ে গেছে । পূর্বভারতের পাঁচটি আদি জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, সুহ্ম সম্ভবত দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল । এই পাঁচজন ছিলেন অসুররাজ বলির পুত্র । বলি অবশ্যই দ্রাবিড় সভ্যতার প্রাচীনতম কিংবদন্তির একজন । অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালিজাতি । এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান । আর্যদের সঙ্গে সংঘাতের  ফলে দ্রাবিড়রা ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে যায় । আর্যজাতি উত্তরভারতে, দ্রাবিড়রা দক্ষিণভারতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ৷  দ্রাবিড়জাতির ভাষার নামও দ্রাবিড় ৷ দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় গোত্রের প্রধান চারটি ভাষা হলো - কন্নড়, মালয়ালি, তামিল ও তেলেগু ৷ এই ভাষাভাষী অঞ্চল তাই দ্রাবিড়ভূমি ।
বাংলাভাষায় অস্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দও বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ৷ একসময় সারা উপমহাদেশে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যের ফলেই বাংলাভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রবেশ ঘটে ৷ দ্রাবিড় ভাষার কাল (সময়), কলা, পুষ্প, মুকুল, পূজা, গণ, কোণ, নীল, ফল, উলু, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, কুন্ড, খড়্গ, দন্ড, বিল, ময়ূর, কাক কাজল, কোদাল, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘুণ, কুটুম্ব, ডালিম্ব, নীল, মীন ইত্যাদি ৷ বাংলার বগুড়া, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ইত্যাদি ড়া, গুড়ি-যুক্ত স্থাননামে দ্রাবিড় প্রভাব রয়েছে ৷ এছাড়া উর, পুর, খিল তালক, পাঠক এগুলোও দ্রাবিড় শব্দ প্রভাবিত ৷ বাংলা ব্যাকরণের অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ভিতের উপর গড়ে উঠেছে ৷
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বাংলার উপরে দ্রাবিড় প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে রয়েছে ৷ বাংলার দেবাদিদেব মহাদেব তো দ্রাবিড় পশুপতিনাথ শিব ৷ আর শৈবসাধনা হলো যোগসাধনা ৷ দ্রাবিড়দের এই সাধনপদ্ধতি বাংলার আধ্যাত্মিক জীবনের গভীরে প্রোথিত ৷ এভাবেই দ্রাবিড় অনার্য দেবদেবীদের মধ্যে চান্ডী(চন্ডী), মঞ্চাম্মা (মনসা) প্রভৃতি এবং উমা, বিষ্ণু, জগন্নাথ,বাসুদেব, শক্তি, শীতলা, বৃক্ষপূজা, যুগলমূর্তি পূজার প্রচলন এসেছে ৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন হরপ্পা সভ্যতা থেকেই বাঙালির মাতৃকা উপাসনার দ্রাবিড় উত্তরাধিকার ।
দ্রাবিড়রা নগরজীবনের পাশাপাশি কৃষিজীবনেও পারদর্শী ছিলেন ৷ সংষ্কৃত ব্রীহি ও তন্ডুল অর্থে ধান্য বোঝায় ৷ এদুটিই দ্রাবিড় ভাষা ৷ এতেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে দ্রাবিড়রা প্রাচীন ধান চাষও করতেন ৷ এককথায় দ্রাবিড়রা বহুভাবেই প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷

ইতিহাসের বিবর্তনে এক সময়ে পাশাপাশি থাকা একাধিক জনগোষ্ঠী যে কালক্রমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানেই না । কিন্তু বহু বহু শতাব্দী প্রাচীনকালে পারস্পরিক সহাবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আত্মীকরণ ঘটে গেছে এবং তার রেশ যে বহু দীর্ঘ সময় পরেও জীবনের গভীরে বেঁচে আছে, তা দেখে চমকে উঠতে হয় । তার একটি নিদর্শন গতকাল হঠাৎ চোখে পড়ায় এই লেখার অবতারণা ।

গত পরশু এসেছি ব্যাঙ্গালুরুতে বড়ো শ্রীমানের কাছে । মানবেতিহাসের ধারা বেয়ে বাঙালির আদিরক্তের সন্ধানে এক খোঁজ মনে হল এই পরিক্রমণ । গতকাল বিকেলে এই মেট্রো শহরের এ ই সি এস লে-আউটে ঘুরতে ঘুরতে একটা কাফেটোরিয়াতে সপরিবারে ঢুকেছিলাম কিঞ্চিৎ জলযোগের জন্যে । ভেতরে ঢুকে বসতেই চোখ পড়ল সুদৃশ্য শোকেসের উপরের দিকে । ওপরের কার্নিশ জুড়ে টানা অস্ট্রিক চিত্রশিল্প, সাঁওতালি চিত্রের অলংকরণ । শান্তিনিকেতনে দেখেছি এ জাতীয় চিত্র । আমার সারা শরীর শিউরে উঠল । অতীত ইতিহাসের এক আবছা সময়ে এখানকার দ্রাবিড় জাতির পূর্বপুরুষেরা আর্যবিতাড়িত হয়ে প্রতিবেশী অস্ট্রিকদের সান্নিধ্য ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও প্রতিবাসীসংস্কৃতি অজান্তেই রক্তে মিশে গেছে এবং তা বয়ে চলেছে আজও । এ যে তারই প্রতিফলন । ক্যাফেটোরিয়ার মালিক নিজেও জানেন না এই সৃজন তাঁরই পূর্বপুরুষের রক্তধারায় বয়ে আনা উত্তরাধিকার । সেই অধিকারেই অস্ট্রিকশিল্প স্থান পেয়েছে দ্রাবিড়ভুবনে । এই নির্মানই ভারতশিল্প । ভারতকথা । মহান ভারতের কথা । 'ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান' ।

এইসিটিএস লে-আউট, ব্যাঙ্গালুরু,
১২. ৯. ২০২৩.

Friday, September 8, 2023

ম'ানিকে মাগে হিতে'—অনুবাদ

সুপ্রভাত

আমি দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে গেলে অনেকে আমার নাম শুনে জিজ্ঞাসা করেন , রায়ওয়ার্ডেনে ? আপনি কী শ্রীলংকার ? জানিনা আমার পূর্বপুরুষ সিংহলী কিনা । সমুদ্রপথে দক্ষিণবঙ্গে এসে বসতি গড়েছেন কিনা । সেটা গবেষণার বিষয় ।জিনগত সংযোগ  আমরা বাংলায় যাকে বলে নাড়ির টান থাকার ফলেই আমরা এখন শ্রীলংকার গানও বুঝতে পারি । সাম্প্রতিক ভাইরাল হয়ে যাওয়া 'মানিকে মাগে হিথে' গানটির কথা বলছিলাম । বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ তো হেলায় লংকা জয় করেছিলেন । তাহলে আমরা তাদের ভাষা বুঝবনা কেন । পড়ুন গানটির বঙ্গানুবাদ । ভালো লাগবে অবশ‍্যই ।

'মানিকে মাগে হিথে'–র বাংলা অনুবাদ

মানিকে মাগে হিথে মুদলে নুরা হেগুময়াইবি অ্যায়িলেয়ি

আমার মনের সমস্ত ভাবনা তোমাকে নিয়েই চলে, এ যেন এক আগুনের শিখা, জ্বলছেই

নেরিয়ে নুম্বে নাগে, মাগে নেত্তেরা মেহা ইয়ায়ি শিয়েয়ি

তোমার শরীরী আদল আমি চোখে হারাই, আমি সারাক্ষণ তোমাকেই দেখে চলি

মা, হিথা লাগামা দেওয়াতেনা, হুরু পেমাকা পাতেলেনা

তুমি আমার হৃদয়ের অনেক কাছে, যেন অনেককাল ধরেই তোমাকে চিনি

রুয়া নারি মানামালি সুকুমালি নুম্বাথামা

তুমি পরীর মতো, তুমি আমার প্রিয়তম

ইথিন এপা মাতানামাঙ্গু গাথা হিথা নুম্বা মাগেমা হ্যাঙ্গু

তুমি আমার লুকোনো মন খুঁজে বের করেছো, আর জটিল হয়ো না

আলে নুম্বাতামা ওয়ালাঙ্গু মানিকে ওয়েন্নেপা থাওয়া সুন্যাঙ্গু

আমার এই প্রেম শুধু তোমারই জন্য

গামে কাটাকারামা কেল্লা হিথা ওয়েলা নুম্ব রুয়াতা বিল্লা

এই গ্রামে তুমি সবচেয়ে বেশি বকবক করো, আমার মন তাতেই মজেছে

নাথিন্নেথা গাথামা আল্লা মাগে হিথাথ না মাটামা মেল্লা

তোমার চোখে যখন আমার চোখ পড়ল, আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি

কেল্পে কেক্সে ওয়েলা মাগে হিথা পাথথু ওয়েনাওয়াদা থাওয়া টিকাক

ওরে মেয়ে, আমার পরাণ জ্বলছে, আরও একটু কাছে আয়

কিতু মাতা পিসসু থাদাওয়েনা উইদিহাতা গাসসু

তোমার জাদু আমায় পাগল করে দেয়

ওয়া দুমু ইঙ্গিয়াতা মাথ্যু বাম্বারেকি মামা থাতু ইসসু, ওয়া ওয়াতাকারাগেনা রাসসু

তুমিই আমায় ডাকছো, আমি মৌমাছি, মধুর খোঁজে আছি

রথেন হিথা আরাগাথু বাম্বারা

একমাত্র আমার সঙ্গেই তোমার থাকা উচিত

মা, হিথা লাগামা দেওয়াতেনা, হুরু পেমাকা পাতেলেনা

তুমি আমার হৃদয়ের অনেক কাছে যেন অনেককাল ধরেই তোমাকে চিনি

রুয়া নারি মানামালি সুকুমালি নুম্বাথামা

তুমি পরীর মতো, তুমি আমার প্রিয়তম

মানিকে মাগে হিথে মুদলে নুরা হেগুময়াইবি অ্যায়িলেয়ি

আমার মনের মধ্যে সমস্ত ভাবনা তোমাকে নিয়েই চলে, এ যেন এক আগুনের শিখা জ্বলছে

নেরিয়ে নুম্বে নাগে, মাগে নেত্তেরা মেহা ইয়ায়ি শিয়েয়ি

তোমার শরীরী আদল আমি চোখে হারাই, আমি সারাক্ষণ তোমাকেই দেখে চলি

*** মাফ করবেন । অনুবাদ আমার নয় । নেট থেকে সংগৃহীত ।

Tuesday, September 5, 2023

সমুখে শান্তি পারাবার

সমুখে শান্তি পারাবার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শিক্ষকতা কখনই পেশা নয় । ব্রত । আর এই  ব্রতের সিদ্ধি আসে জীবনের শেষ প্রান্তে । ব্রতফল দিয়ে যায় গর্বিত অনুভব । অনর্বচনীয় প্রশান্তি । আজ শিক্ষক দিবসে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম সাব্রুমের দৌলবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে । আমার সঙ্গে মঞ্চে যাঁরা ছিলেন, বিদ্যালয় পরিদর্শক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, রাজ্যপাল পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক, এস এম সি কমিটির কর্মকর্তগণ প্রত্যেকেই আমার একসময়ের ছাত্র । বিদ্যালয়ের একটা বড়ো অংশের শিক্ষক আমার ছাত্র, কাউকে আবার ডিএল এড ও অন্যান্য ট্রেনিং প্রোগ্রামে পেয়েছি । বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে উচ্চশ্রেণিতে পাঠরত  কয়েকজনকে আমি পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ে আমার চাকুরির শেষলগ্নে একেবারে নিচের ক্লাসে পেয়েছিলাম । বেশ কয়েকঘন্টা আমার  জীবনের বিভিন্নসময়ের শিক্ষার্থীপরিবৃত হয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিল । দেখছিলাম স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিভাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁরা । মনে মনে খুঁজছিলাম, তাঁদের কর্মতৎপরতার মধ্যে আমার অতীতের কর্মচঞ্চলতার কোনো অনুকৃতি আছে কিনা । আমি বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলাম । বর্তমানে বিদ্যালয় পরিদর্শক আমার ছাত্র জানাং মগ । জানাং শব্দটি পালি । সংস্কৃত জ্ঞানং থেকে পরিবর্তিত । মগ জনজাতিরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । সেকারণেই মগভাষায় ত্রিপিটকসূত্রে বহু পালি শব্দ রয়েছে । গত শতাব্দীর আট-নয়ের দশকে আমি ছাত্র হিসাবে পেয়েছি জানাংকে । বর্তমানে কঠিন দায়িত্ব সামলাচ্ছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলীপ দাস ও দিলীপ দেবনাথও আমার ছাত্র । দিলীপ দাস বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত । দিলীপ দেবনাথ রাজ্যপাল পুরস্কার প্রাপ্ত । শারীরিক সমস্যাকে সরিয়ে রেখে তাঁরা দুজনেই স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের নিয়ে মেতে আছেন । শিক্ষকদের মধ্যে যদুগোপাল দেবনাথ, শক্তিম দাস নিজ নিজ গুণ বিস্তার করে ছাত্রছাত্রীদের মনে স্থান করে নিয়েছেন । রামকৃষ্ণানুসারী যদুগোপাল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও গুছানো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন । গুণী শিক্ষক শক্তিম দাস চিত্রে চিত্রে ভরিয়ে দিয়েছেন স্কুলের দেয়াল । প্রতিবছর শিক্ষক দিবসে প্রকিশিত হয় বিদ্যালয়ের দেওয়ালপত্রিকা 'নতুন কুঁড়ি' । শিক্ষার্থীদের লেখালেখিতে পূর্ণ এই পত্রিকার সামগ্রিক অলংকরণ রক্তিমের । ২০০৭ সালে এই বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অর্জুন শর্মা ছাত্রছাত্রীদের মননচর্চা বিকাশের লক্ষ্যে এই দেওয়াল পত্রিকার সূত্রপাত করেছিলেন । আজও তাঁর ও আমার সুযোগ্য ছাত্র শক্তিম দাস ফলেফুলে ভরিয়ে তুলছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণ এইসব শিক্ষকদের প্রচেষ্টারই সুবর্ণফসল । আরও যাঁরা শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন প্রত্যেকেই অত্যন্ত আন্তরিক ও অমায়িক । শিক্ষকতার ব্রতফল আমার জীবনসায়াহ্নে এই অনির্বচনীয় তৃপ্তি এনে দিয়েছে । দিয়েছে শান্তির বারি ।

Sunday, September 3, 2023

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি নিয়েই সংসার । জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । মৃত্যুর হাত থেকে কারো পরিত্রাণ নেই । রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে পথের পাশের সহায় সম্পদহীন ভিখারি পর্যন্ত  সকলকেই একদিন মৃত্যুর কাছে পরাজয় মানতে হয় । মৃত্যু ধন, মান, গৌরবের তোয়াক্কা করেনা । এতটাই নির্দয় সে । কার্য, কারণ, জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বৃত্তাকার পরম্পরাকে নিয়েই এই জগত সংসার চলছে । হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, অনেকগুলি জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্য দিয়েই জীবাত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ব্রহ্মাত্মার সঙ্গে মিলিত হয় । জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাকুলতা ও তার পুর্ণতালাভের মাধ্যমেই আসে মোক্ষ বা মুক্তি । পরমাত্মায় বিলীন হয়ে গেলে জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে চলে যায় মানবাত্মা । যুগ যুগ ধরে  মোক্ষ ও মুক্তির জন্য, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য জীবাত্মা ক্রমাগত দেহান্তর ঘটাতে থাকে । কাজেই এই মৃত্যু বা দেহান্তর শোকের নয় । পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পথে এক একটি ধাপ পেরিয়ে যাওয়া মাত্র । আক্রান্ত বা জীর্ণ দেহকে পরিত্যাগ করে জীবাত্মা নতুন সুন্দর সুস্থ দেহ গ্রহণ করে আবার জীবন শুরু করে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে । মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কোন শোকের বিষয় নয় । প্রিয়জনকে হারিয়েও নির্মোহ নিলিপ্ত থাকা এই এক অদ্ভুত দার্শনিক উপলব্ধি । আর এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া এক প্রতীকী অনুভব ।

মানব জীবনচক্রের চারটি স্তর জন্ম, বয়সন্ধি, বিবাহ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমাজজীবনে নানাধরনের আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকে । আচার দুই প্রকার । শাস্ত্রীয় ও লোকাচার । শাস্ত্রীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে ঐন্দ্রজালিক শক্তি বা বিভিন্ন দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রয়াস থাকে । লৌকিক আচারের মূল উদ্দেশ্য হল ইহজগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও মঙ্গললাভ । এতে শুধুমাত্র ব্যক্তিমঙ্গল নয়, সামাজিক মঙ্গল ও কামনা করা হয় । লৌকিক আচারের দুটি দিক । ক্রিয়া ও অনুষ্ঠান । মানব জীবনব্যাপী আচার বা ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানসমূহের মূলে রয়েছে আদিম মানুষের সর্বপ্রাণবাদী চেতনা । সর্বপ্রাণবাদের যে বিশ্বাসগুলো প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তা হল–ক) জীবিত বা মৃত মানুষের আত্মায় বিশ্বাস বা তার পূজা করা, খ) বস্তু বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস; এবং গ) বস্তুর মধ্যে অবস্থানরত কোন আত্মায় বিশ্বাস ও তার পূজা । এই বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট দৈবীভাবনার মূলে দুটি বিষয় রয়েছে । তার একটি হল ভয় বা ভীতিবোধ । অপরটি হল কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধাবোধ । পূজাপার্বণ আচার অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে এই দুই ভাবনা । ভয় বা ভীতিবোধের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক জড়িত । আত্মাকে সন্তুষ্ট করার প্রক্রিয়া রয়েছে কিছু কিছু শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান ও লৌকিক আচারে । ভয়ের সৃষ্টি হয় সৎকারহীন আত্মা, অপঘাতে বা দুর্ঘটনায় মৃতের অতৃপ্ত আত্মা, প্রভৃতি থেকে । আর স্বাভাবিকভাবে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে থাকে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ । এই শ্রদ্ধাবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে পিতৃপূজা বা পূর্বপুরুষপূজার ।

 বাঙালি বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষপূজারই ক্রমোত্তরণ । গবেষকদের মতে, বাঙালির প্রায় সমস্ত লৌকিক আচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এদেশের কোল, ভিল, মুন্ডা হো, শবর, খেরিয়া প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পরবর্তী সময়ে বাঙালিরা পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে । ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন–'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ পরলোক সম্পর্কে ধারণা প্রেরিত তথ্য পিতৃতর্পণ পিণ্ডদান শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান আভ্যুদায়িক ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা-৬০৭ ) ।

বাঙালি হিন্দুর পারলৌকিক ক্রিয়ার দুটি ধারা রয়েছে । একটি শাস্ত্রীয় ও অন্যটি লোকাচার । শাস্ত্রীয় ধারায় রয়েছে ক) অন্তেষ্টিক্রিয়া খ) অশৌচ এবং গ)  শ্রাদ্ধ । মৃতের সৎকারসাধন অর্থাৎ শবদাহকে বলা হয় অন্তেষ্টিক্রিয়া । মৃত্যুহেতু মনের অশুচিতাকে বলা হয় মরণাশৌচ । সেরূপ জন্মকালীন অশৌচ অর্থাৎ জন্মাশৌচও রয়েছে । 'শ্রদ্ধা' শব্দ থেকে এসেছে 'শ্রাদ্ধ' ।  'শ্রদ্ধা' শব্দের সঙ্গে 'অন' প্রত্যয় যোগে 'শ্রাদ্ধ' শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে । মৃত পুরুষের আত্মার তৃপ্তির জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি অন্ন, ব্যঞ্জন, জল, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত ইত্যাদি প্রদান করাকে শ্রাদ্ধ বলে । পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দু ধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান ।

হিন্দুদের দাহকার্য যেখানে করা হয়  সেই স্থানকে শ্মশানভুমি বলা হয় । বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রেও সেই আচার অনুসরণ করা হয় । এক দুটি ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় । 'শ্মশান' শব্দটি সংস্কৃতভাষা থেকে আগত । সরাসরি বাংলায় ব্যবহারের ফলে তা তৎসম শব্দ । 'শ্মশান' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো–'শ্ম' শব্দের অর্থ মৃতদেহ বা শব । 'শন্য' মানে বিছানা । অর্থাৎ মৃতদেহের বিছানা । চলতি কথায় যে স্থানের শব দাহ করা হয় সেই স্থানটির নাম 'শ্মশান' । সাধারণত নদী বা বড়ো জলাশয়ের ধারেই শ্মশানক্ষেত্রের অবস্থান । এই শ্মশানে দেবী কালিকা বিরাজ করেন । শ্মশান ভূমি তান্ত্রিকদের সাধারণ ক্ষেত্র । একে তপস্যাভূমিও বলা হয় । দেবাদিদেব শিবও শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান । ছাইভস্ম গায়ে মাখেন । নির্জন শ্মশানে গেলে জীবনের শেষ পরিণতি উপলব্ধি করে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় । এই জন্য শ্মশানকে 'বৈরাগ্যভূমি'ও বলা হয় ।

মৃতদেহ নিয়ে শবানুগমন থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পর্যন্ত শাস্ত্রীয় আচারের পাশাপাশি বেশ কিছু লৌকিক আচার ও পালন করা হয় বাঙালি হিন্দু সমাজে । মৃতদেহকে বাঁশের তৈরি মইয়ের মতো খাটিয়ায় ধাড়ার বা চাটাইর উপর শবকে শায়িত করে মৃতেরর পুত্রগণ ও নিকট আত্মীয়গণ কাঁধে করে শববহন করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ।  প্রাচীন চর্যাপদে ও তার নিদর্শন পাওয়া যায়– 'চারিবাসেঁ গড়িলা রে দিয়া চঞ্চালী /  তঁহি তোলি সবরো ডাহ কএলা কান্দই সগুন শিয়ালী ।। /  মরিল ভবসত্তা রে দহ দিহে দিধলি বলী ।। / হের সে সবরো নিরেবন ভইলা ফিটিলি যবরালি ।। ( চর্যা–৫০ ) । শ্মশানযাত্রার  এই চিত্র বর্তমান বাঙালি হিন্দুসমাজেও প্রচলিত রয়েছে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচণ্ডীর গীতে 'কংস নদীর তটে আছে বড় রম্য স্থল' হিসেবে শ্মশানের চিত্র ফুটে উঠেছে ।

শবদাহের জন্য প্রয়োজন হয় অগ্নিকুণ্ডের । এই অগ্নিকুণ্ডকে বলা হয় চিতা । এই চিতায় মৃতদেহ সৎকারের জন্য তোলার আগে স্নান করিয়ে ঘি চন্দন মাখানো হয় । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে আমরা তার নিদর্শন পাই । রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রয়েছে–'রাবণেরে করাইল স্নান সিন্ধু জলে । /সুগন্ধি চন্দন লেপে কন্ঠে বাহু মূলে ।। তেমনি বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়ে পাই–'দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহু তরে । / করাইয়া স্নান শোয়াইল গঙ্গাধরে ।'  চিতায় শব স্থাপনের আচার হিসেবে মৃতের মস্তক উত্তর দিকে স্থাপন করার কথাও জানা যায় রামায়ণে–'করিলেন চিতা রাজা উত্তর শিয়রে / তিনজনে শোয়াইল চিতার উপরে ।' তবে কোনো কোনো অঞ্চলে দক্ষিণদিকে শবের মস্তক স্থাপনের রীতি প্রচলিত আছে । শব চিতায় তোলার পর মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্র, অবর্তমানে কনিষ্ঠপুত্র চিতাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে ও মৃতের মুখাগ্নি করে শব সৎকারের সূচনা করে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচন্ডীর গীতে উল্লেখ আছে–'নানা কাষ্ঠ কুড়াইয়া জ্বালিল অনল ।। /  প্রদক্ষিণে অগ্নি দিল মুখের উপর ।।' বিষ্ণু পালের মনসামঙ্গলে আছে–'সনকা জ্বালিয়া কৈল এ মুখ আগুন ।' এ যুগের কবিদের কাব্যে চিতা শয্যার বর্ণনাটিও পাওয়া যায়–'চন্দন কাঠের চিতা করিল সে তীরে / বলিরাজ শোয়াইল তাহার উপরে ।' ( কৃত্তিবাস  ওঝা ) । এছাড়া বিপ্রদাস পিপিলাই লিখেছেন–'করিল বিচিত্র চিতা ক্ষিরোদের কূলে । / দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহুতরে ।' ঘনরামের রচনায় রয়েছে–'বেদের বিধান কুন্ড করিল রচনা । / পাতিল চন্দন কাষ্ঠ পরিপাটি ধূনা ।। / কলসে কলসে তায় ঢেলে দিল ঘি । /  কর শঙ্খ ত্যজে তবে চারি রাজার ঝি ।।' ( ধর্মমঙ্গল ) দাহকার্য সমাধান হবার পর চিতা ধোয়ানো বা 'চুল্লী শীতল' করার একটি আচারের নিদর্শন পাওয়া যায়  জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে–'আপনার উরু তুলি, তাহাতে বান্ধিয়া চুহ্লি, বাপের করয়ে অগ্নি কাজ । / গঙ্গাসাগরের পানি, আগর চন্দন আনি, ধর্মদেবের শরীর ধোয়ায় । / করিয়া উত্তম খাট, চাপায় আগর কাঠ, তাতে নিয়ে ধর্মকে শোয়ায় । / আগর চন্দন খড়ি, চাপায় অনেক করি, অনল ভেজায় তিন ভাই । / মন্ত্র পড়ে ব্রহ্মাহর, অগ্নি দিল মহেশ্বর, পুড়িয়া হইল ছাই । /  করিয়া অগ্নির কাজ, ধোয়ায় অঙ্গার কাষ্ঠ, তিন ভাই কান্দে উচ্চস্বরে । / করিলেন তর্পণ, পিণ্ড দিলেন তিনজন, তপস্যাতে চলিল সাগরে ।।' ( মনসামঙ্গল–জগজ্জীবন ঘোষাল ) ।দাহকার্য শেষ হওয়ার পর তিতা শীতল করে পিন্ডদান করা হত ।

মৃতের দাহকার্য অবশ্য সম্পাদনীয় বিষয় । সেকালে মৃতদেহ বাসি হতে দেওয়াও একটি গর্হিত কাজ বলে ধরে নেওয়া হত । লক্ষিন্দরের মৃত্যুর পর চাঁদ সদাগর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন–'কান্দিতে কান্দিতে হইল দশ দন্ড বেলা । / জ্ঞাতি লোকে খোঁটা দিব দ্বারে বাসি মড়া ।। / ( পদ্মাপুরাণ–বিজয়গুপ্ত ) । সর্পাঘাত মৃত্যু হলে দাহকার্য করার বিধি ছিল না । এক্ষেত্রে মৃতদেহকে কলার ভেলায় তুলে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত । 'সর্পাঘাত হইলে অগ্নিতে না পুড়ে' ( পদ্মাপুরাণ  বিজয় গুপ্ত ) ।

মৃতের সৎকারের পর নির্দিষ্ট দিন অশৌচ পালন করার পর হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান । শ্রাদ্ধ আবার দুই প্রকারের । তেরাত্রির শ্রাদ্ধ ও অশৌচান্ত শ্রাদ্ধ । দুর্ঘটনা বা অপঘাতে মৃত্যু হলে তেরাত্রির শ্রাদ্ধ করা হয় । 'সোমাই পন্ডিত বলে স্থির কর মন / তেরাত্রি শ্রাদ্ধ হবে বেবস্থার বচন ।।' ( পদ্মাপুরাণ–বিজয় গুপ্ত ) ।‌ অশৌচান্তিক শ্রাদ্ধের উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে–'পঞ্চ ভাই দিল পিণ্ড ক্ষত্রিয় বিধান / ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান ।'  শ্রাদ্ধ শেষে পিণ্ড জলে বিসর্জন দেওয়ার প্রথাও রয়েছে । 'শ্রাদ্ধ করি প্রভু পিণ্ড ফেলে সেই জ্বলে / গয়ালি ব্রাহ্মণ সব ধরি ধরি গিলে ।' ( শ্রীচৈতন্য ভাগবত বৃন্দাবন দাস ) । ধনবান ব্যক্তিগণ গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান করেন ও তর্পণ করেন । মৃতের উদ্দেশ্যে জল দানকে বলা হয় তর্পণ । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম গয়াতে গিয়ে পিন্ডদানের কথা উল্লেখ করেছেন–'পড়িয়া শুনিয়া পুত্র হয় সুপুরুষ / পিন্ডদান করে ধরিয়া তিল  কুশ ।' ( চন্ডীমঙ্গল ) । শ্রাদ্ধবাসরে গৃহকর্তার সামাজিক অবস্থান সাপেক্ষে ব্রাহ্মণকে অন্নদান, বস্ত্রদান, গোদান ও কাঞ্চন দান ইত্যাদি করা হত । দ্বিজ বংশীদাসের কাব্যে উল্লেখ আছে যে, চাঁদ সদাগর পিতার মৃত্যুর পর 'দানসাগর' শ্রাদ্ধ করেন–'চন্দ্রধরের মাতা পিতা মৈল কাল পায়্যা । / শত পুত্র কার্য করে এক পুত্র হয়্যা ।। / রজত কাঞ্চন ধেনু জল ভূমি আদি । / দানসাগর শ্রাদ্ধ কইল বৃষোৎসর্গ বিধি ।।' ( পদ্মা পুরাণ ) । বিপ্রদাসে পাই–'বিধি মতো শ্রাদ্ধ কৈল দানযজ্ঞ আদি । / ক্ষিতি পরিতোষ কৈল দিয়া রত্ন নিধি ।। / সুবর্ণের ভান্ডার পুরিয়া লক্ষ লক্ষ । / হেনমতে দ্বিজ দান করিল অসংখ্য' ( মনসা বিজয়–বিপ্রদাস পিপিলাই ) ।। কাশীরাম দাস লেখেন–'ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান / স্বর্ণদান ভূমিদান করে গবীদান' ( মহাভারত আদিপর্ব ) ।

বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ও প্রাচীন সাহিত্যে যে সমস্ত মৃত্যুজনিত লোকাচার দেখা যায়, সেগুলোতে সেসময়ের বাঙালি জীবনের চিত্রই কবিদের কাব্যে ফুটে উঠেছে । পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের সমাজ জীবনে পালিত আচারগুলোই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কবিদের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে । ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আচারসমূহের মূলধারা একই থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ব্যতিক্রম দেখা যায় । এই ব্যতিক্রম বা রূপান্তরের কারণেই কোনো আচারকে আঞ্চলিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় । পরবর্তীকালেও বাঙালি হিন্দুদের মধ্য সেই ধারাকেই অনুসরণ করতে দেখা যায় ।

শ্রাদ্ধ থেকে মঠোৎসর্গ : ত্রিপুরায় প্রচলিত লোকাচারে পূর্বপুরুষ পূজা

শ্রাদ্ধ থেকে মঠোৎসর্গ  :  ত্রিপুরায় প্রচলিত লোকাচারে পূর্বপুরুষপূজা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাস । চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ত্রিপুরার রাজার জমিদারি ছিল ।ত্রিপুরার রাজন্যআমলের জমিদারিত্বেও বাঙালির বসতি ছিল । রাজনৈতিক কারণে দেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেলে এই অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় । ফলে এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্ত হয়ে তদানিন্তন পার্বত্য ত্রিপুরা তথা বর্তমান ভারতভুক্ত ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন । নিজেদের  ভদ্রাসন, সহায় সম্পদ, সে দেশে ফেলে এলেও পূর্বপুরুষের কাল থেকে নিজেদের রক্তধারায় প্রবাহিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কিন্তু সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন । সে কারণেই  ত্রিপুরার বাঙালি সংস্কৃতি মূলত পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার । 

সেভাবেই এখানেও জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পালিত শাস্ত্রীয় ও লোকাচারেও পূর্বপুরুষদের পালিত আচার-আচরণ অনুসরণ করা হয় । মৃতের সৎকার বা দাহকার্য ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়কালের মধ্যে আরো কিছু ছোটোখাটো অবশ্য পালনীয়  লোকাচার রয়েছে । মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত লোকাচার পালন করা হয় সেগুলো প্রকৃতপক্ষে 'টোটেম পূজা' বা 'পূর্বপুরুষ পূজা'র নামান্তর । এই পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে একটা ঈশ্বর ভাবনা নিহিত থাকে । ঈশ্বর ভাবনার মূলে রয়েছে প্রত্নমানুষের ভয়, বিস্ময় আর অজ্ঞানতা ।  আদিম মানুষ হিংস্র প্রাণী, প্রকৃতির রহস্য, পাহাড়-পর্বত, নদী আকাশ, ঝড়, বজ্রপাত ইত্যাদিকে যেমন ভয় করতে শিখেছিল তেমনি তারা মৃত্যুকেও ভয়ের চোখে দেখত । তারা লক্ষ্য করত যে মানুষটি এতদিন তাদের সঙ্গে কর্মচঞ্চল ছিল সেই মানুষটি হঠাৎ নিথর হয়ে যায় । আকস্মিক ঘটনাটিতে তাদের মনে ভয়ের উদ্রেক হয় এবং এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে  নানারকম অকল্যাণ চিন্তা করতে থাকে । প্রকৃতির বুকে ঘটে যাওয়া নানা বিপর্যয়কে তারা তাদের মৃত আত্মার অসন্তুষ্টির কারণ বলে মনে করতে থাকে ।  আত্মাকে ঘিরেই তাদের জীবনের নানারকম ক্ষতিকর প্রভাবের সম্পর্ক ভাবতে থাকে । ফলে মৃতব্যক্তির আত্মাকে সন্তুষ্ট করার তাগিদ অনুভব করে প্রত্নমানুষ । মৃতব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার আচার অনুষ্ঠানই হল পূর্বপুরুষ পূজা । ভারতের প্রাকবৈদিক যুগের সভ্যতার ধারক ও বাহক বিভিন্ন প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ দেখা যায় । অস্ট্রিক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মানুষেরা বৃক্ষ পাথর নদী, বজ্র, বিদ্যুৎ  ও বিশেষ স্থানকে পবিত্র জ্ঞান করে তার উপর দেবত্ব আরোপ করে পূজা করত । তাদের অনেকে মূর্তি পূজা না করে কোন বিশেষ বিশেষ গাছের তলায় অথবা বিশেষ কোন স্থানে বড়ো বড়ো পাথর রেখে সেই পাথরকে মঙ্গলকারী দৈবীশক্তি হিসেবে মনে করে পূজা করত ।  

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক ক্রিয়ানুষ্ঠান ও লোকাচার রয়েছে । বাঙালির বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষ পূজারই ক্রমউত্তরণ । গবেষকদের মতে বাঙালির প্রায় সমস্ত লোকাচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এ দেশের কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, খেড়িয়া, বীরহোড় প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পূর্বপুরুষ পূজা সেই অস্ট্রিক উত্তরাধিকার । পরবর্তী সময়ে বাঙালি পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে ।  ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন– 'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক সম্পর্কে ধারণা, প্রেততত্ত্ব, পিতৃ তর্পণ, পিন্ডদান, শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান, আভ্যুদয়িক ইত্যাদি সমস্ত আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান ।' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা, ৬০৭ ) । পূর্বপুরুষগণ বা পিতৃপুরুষগণ ভারত ও চিনে অতি প্রাচীনকাল থেকেই গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মানের পাত্র । বহুকাল আগে থেকেই মৃতব্যক্তির আত্মাকে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হয় এবং নানা আচার-আচরণের মাধ্যমে মৃতের সন্তুষ্টি বিধান ও পরিবারের মধ্যে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়াস নেওয়া হয় ।

 বাঙালির মৃত্যুবিষয়ক সংস্কারগুলোর মধ্যে সৎকারপরবর্তী ও শ্রাদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালকে বলা হয় 'অশৌচকাল' । এই অশৌচকালীন সময়ে মৃতের পুত্র সন্তানেরা 'মাঠা' ( সাদা থান কাপড় ) পরিধান করতে হয় । সঙ্গে কুশাসন ও যষ্টি ব্যবহার করতে হয় । যষ্টি অর্থাৎ একটি হাত দেড়েক বাঁশের কঞ্চির মাথায় একটা পেরেক গেঁথে তা ব্যবহার করা হয় । গলায় পরিধেয় কাপড় থেকে সংগ্রহ করা সরু ফালি গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয় । সেই ফালিতে লোহা বা সিসের টুকরো ব্যবহার করা হয় । এই ফালি বা ধড়ায় ব্যবহৃত ব্যবহৃত লোহা বা সিসে এবং যষ্টিতে ব্যবহৃত পেরেক মৃতের সন্তানকে আত্মার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে । ধড়াটি ব্যবহার করারও বিধি রয়েছে । যদি ধড়াটি ডান বগলের তলায় দিয়ে এনে গলায় ঝুলানো হয় তাহলে ওই ব্যক্তির পিতৃবিয়োগ ঘটেছে বলে ইঙ্গিত করে । অনুরূপভাবে বাঁ বগলের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে গলায় ঝুলালে মাতৃবিয়োগের বিষয়টি চিহ্নিত করে । আসলে বিষয়টির মধ্যে সামাজিক সহমর্মিতার বোধ নিহিত রয়েছে । বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পিতা বা মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করে ভাগ্যহীনকে বিষাদাচ্ছন্ন হতে হয় না । প্রিয়জন বা পরিচিতজনেরা বেশভূষা দেখেই বুঝতে পারেন । তাঁরাও বিষয়টির পুনরুদ্রেক ঘটান না ।  অশৌচ পালনের কয়দিন মৃতের পুত্রগণ তৃণশয্যায় শয়ন করেন । হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন । ওই কয়দিন স্নানের পর নির্দিষ্ট একটি স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে পানীয় ও ফলাহার নিবেদন করেন । পানীয় নিবেদনেরও একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছে । পাশাপাশি দুটো ছোটো বাঁশের খুঁটিতে আড়াআড়ি একটি বাঁশ বেঁধে তার মধ্যে বাঁশের নলি ঝুলিয়ে সেই নলিতে জল নিবেদন করা হয় । নলির তলায় সুতলি বা কাপড়ের টুকরো জাতীয় কিছু বেঁধে দেওয়া হয় যাতে নলি থেকে জল ছুঁয়ে চুইয়ে পড়ে । যেখানে এই জল পড়ে সেখানে মাটির উপরে এক বিশেষ ধরনের দূর্বা ( ঘোড়া দূর্বা ) বসিয়ে রাখা হয় । লোকবিশ্বাস, এই দূর্বা যদি সতেজ থাকে ও বৃদ্ধি পায় তাহলে মৃতের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখ ও শান্তিময় হবে । মৃতের উদ্দেশ্যে যে ফল জলাদি নিবেদন করা হয় তা সন্তানের জন্য সংগৃহীত আহারাদির প্রথম অংশ । মৃতকে নিবেদন না করে তাঁরা আহার্য গ্রহণ করেন না । এই ফলাহার নিবেদনের সময়  'আয়, আয়' বলে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো হয় । এই আচারটিকে 'কাকবুলি' বলা হয় । লোকবিশ্বাস রয়েছে এই সময়ে মৃতের আত্মা শকুন, কুকুর, কাক প্রভৃতি ইতর প্রাণীর রূপ ধরে ধারণ করে থাকে । ভক্তিপূর্ণ চিত্তে আহ্বান জানালে কাকরূপী আত্মা এসে সেই খাবার খেয়ে যান । অশৌচকালীন সময়ের মধ্যে শনি, মঙ্গলবার অথবা অমাবস্যা ভিন্ন যে কোন তিনটি শুভ দিনে তিনটি মাটির হাঁড়িতে উঠোনের এক কোণে লাকড়ির চুলায় আতপান্ন রান্না করে উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় । মৃতের জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্র এটি প্রস্তুত করেন এবং রান্নার সময় মৌন থাকেন । এটাকে 'পাতিল পোড়া' বলা হয় । এই 'পাতিল' উত্তরপ্রজন্মের কল্যাণকামনায় পোড়ানো হয় বলে লোকবিশ্বাস । রান্নার সময় মাটির হাঁড়িটি যদি তাপে ফেটে যায় তাহলে পরিবারের ভবিষ্যৎ অকল্যাণের আশঙ্কা করা হয় । অশৌচের সমাপ্তিদিনে মস্তকমুন্ডন, স্নানাদি করে শুদ্ধ হয় । অশৌচকালীনসময়ে মৃতের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জল ও খাবার নিবেদনের জন্য তৈরি করা বাঁশের নলিগুলোও অন্যান্য সামগ্রী সেইসঙ্গে জলে বিসর্জন দেওয়া হয় । পরদিন ব্রাহ্মণবিধিমতো শ্রাদ্ধকার্য করা হয় ।

এছাড়াও, এই অঞ্চলে শ্রাদ্ধোত্তর সময়ে পর পর কয়েকটি লোকাচার পালন করা হয় । এগুলো হলো ১. ভাত বাড়ানি ২. মৎস্যস্পর্শ বা মাছ ছোঁয়া ৩.অস্থিবিসর্জন ও ৪. মঠোৎসর্গ । শ্রাদ্ধের দিন রাত্রিবেলা মৃতের কন্যা পুত্রবধূ ও অন্যান্যরা মিলে মৃতের উদ্দেশ্যে অন্নব্যঞ্জন, পিঠেপায়েস, মিষ্টি খাবার ইত্যাদি প্রস্তুত করেন । মৃত ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় যেসব খাদ্য খেতে ভালোবাসতেন সেগুলোসহ তাঁর পছন্দের পিঠেপুলি ইত্যাদি তৈরি করা হয় । তাঁর জন্য ( জীবদ্দশায় অভ্যাস থাকলে ) পান তামাক ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করা হয় । এ সময় শ্রাদ্ধবাসরে বিশেষ কীর্তন চলতে থাকে । কীর্তনের শেষে মৃতের সন্তানগণও পরিবার-পরিজন মৃতের উদ্দেশ্যে রোদন করেন ও ধুলোয় গড়াগড়ি যান । এই গান যে শিল্পী পরিবেশন করেন তিনি এক বিশেষ ধরনের পোশাক ব্যবহার করেন । দক্ষিণ ত্রিপুরায় এই কীর্তনকে 'হটিকীর্তন' বলা হয় । কীর্তনে নিমাইসন্ন্যাস, হরিশচন্দ্রের শ্মশানমিলন ইত্যাদি বিয়োগান্তক পালাকীর্তন পরিবেশন করা হয় । শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতিপুষ্ট অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরার শ্রাদ্ধবাসরেও এই ধরনের কীর্তন পরিবেশনের আচার রয়েছে । তাকে 'যমকীর্তন' বলা হয় । দক্ষিণ ত্রিপুরার হটিকীর্তনের সঙ্গে তার পরিবেশন প্রকরণে তারতম্য থাকলেও কিন্তু একই উদ্দেশ্য ফল্গুধারার মত প্রবাহিত । গোষ্ঠলীলার বিষয়ে যেমন মায়ের সঙ্গে সন্তানের ক্ষণিক বিচ্ছেদ বেদনার আবহাওয়া রয়েছে তেমনি নিমাই এর সন্ন্যাসযাত্রা ও এক বিচ্ছেদ বিধূর কাহিনি, তেমনি ভাগ্যদোষে রাজা হরিশচন্দ্রেরও স্ত্রীপুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্মশানচন্ডালের জীবিকায় দিনযাপন ও বেদনাঘন । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এই পালাগুলো নির্বাচনের মধ্যেও অনির্দেশের পথে চলে যাওয়া প্রিয়জনের জন্য বেদনার সুরটিই ধ্বনিত । সেই বেদনার প্রকাশের প্রতীকী রূপ এই জাতীয় সংগীত । স্থানভেদে প্রকাশভঙ্গি আলাদা কিন্তু অভিপ্রায় এক ।

এরপর বাড়ির পাশে একটি নির্জন স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে খাদ্য পরিবেশন করা হয় । এই লোকাচারটি 'ভাত বাড়ানি' বলা হয়  পরিবারের সমস্ত সদস্যরাও আত্মীয়-স্বজন রাতের খাবার গ্রহণ করেন । এখানে আর একটি লোকাচার পালিত হয় । এই রাতে খাওয়ার জন্য এমন কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করা হয় যাদের পিতামাতা উভয়ই পরলোকগত । তাদের খাদ্য গ্রহণের এই আচারটিকে বলা হয় 'ভুরিভোজ' । খাওয়া দাওয়ার পর উপস্থিত সবাই মৃতের উদ্দেশ্যে যেখানে খাদ্য নিবেদন করা হয়েছে সেখানে গিয়ে যাচাই করেন সমস্ত খাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে কিনা । কোন ইতর প্রাণীও যদি সেই খাবার খেয়ে যায় তাহলে সবাই খুশি হন । কোনো ইতর প্রাণী এসে এই খাবারের স্বাদ নিলে মৃতের আত্মা সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন । পাশাপাশি তাঁরা আত্মার কাছে প্রার্থনা করেন যে, তিনি যেন তাঁর পরিবারকে ভুলে না যান এবং অলক্ষ্যে থেকে পরিবারটিকে ভালোবাসেন এবং তাদের সুখশান্তির জন্যে আশীর্বাদ করেন । আর অভুক্ত খাবার পড়ে থাকলে কোথাও ত্রুটি হয়েছে মনে করে মৃতের উদ্দেশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করেন এবং আহার গ্রহণের জন্য মৃতের আত্মাকে আমন্ত্রণ জানান । এই আচারটি আবার কোথাও কোথাও বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন করা হয় । লোকবিশ্বাস, মৃতের আত্মা একবছর তাঁর বাড়িঘরের, পরিবারের আশেপাশেই বিচরণ করেন । সেসময় তিনি অভুক্ত থাকেন । বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন খাবার গ্রহণের পর আত্মা প্রেতলোকে চলে যায় ।

শ্রাদ্ধের পর তিন দিনের মধ্যে সেরে নিতে হয়  মৎস্য স্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুষ্ঠান । শনি, মঙ্গলবার, অমাবস্যার ইত্যাদি দিন বাদ দিয়ে অতি দ্রুত এই অনুষ্ঠান সেরে ফেলা হয় । এ দিন মূলত মৃতের পুত্রের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে এই আচার পালিত হয় । আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই এক পংক্তিভোজনে মিলিত হয়ে মৃতের পুত্রগণ মাতুল ও ব্রাহ্মণের নিকট থেকে মৎস্যস্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুমতি আদায় করে । সেদিন থেকে তাদের আর নিরামিষ আহার করতে হয় না । এরপর সময় সুযোগ করে মৃতের পুত্রদের মধ্যে কেউ কেউ শবদাহের পর সংগৃহীত অস্থি পবিত্র কোন নদীতে বিসর্জন দেন । কেউ কেউ এ সময় গয়াতে গিয়ে  পিন্ডদান করেন  । তারপর অস্থি নিয়ে প্রয়াগে ত্রিবেণীসঙ্গমে মস্তক মুন্ডন করে তা বিসর্জন দেন । হিন্দুসমাজে এ নিয়ে সুন্দর শাস্ত্রীয় আচার রয়েছে । শাস্ত্রকাররা বলে গেছেন, 'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা' এবং 'পুত্র পিন্ড প্রয়োজনম' । পুত্রের জন্য স্ত্রী এবং পিন্ড লাভের জন্যই পুত্র । এই হল পূর্বপুরুষ পূজার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । পিতৃতর্পণ, শ্রাদ্ধকর্ম ও অন্যান্য পারলৌকিক শাস্ত্রীয় কর্মে পিণ্ডদানের বিশেষ বিধি রয়েছে । সারাদেশেই তা নানাভাবে নানারূপে প্রচলিত । পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্বতন্ত্রভাবে এই আচার পরিলক্ষিত হয় । এই লোকাচারটিকে কেন্দ্র করে একটি প্রবাদ আছে–'প্রয়াগে মুড়াইয়া মাথা পাপী যায় যথা তথা ।' হটিকীর্তনের গানেও পদ রয়েছে–'গয়া গঙ্গা গিয়া পুত্র  ধরে তিল কুশ / একে একে উদ্ধার করে সপ্ত পুরুষ ।'

এভাবে বছর ঘুরে এলে মৃত্যুতিথিতে বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করা হয় । এর আগে প্রতিমাসে একটি করে বারো মাসে বারোটি মাসিক শ্রাদ্ধের বিধি থাকে । যদি সম্ভব না হয় তাহলে বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন সব কয়টি অসম্পূর্ণ  শ্রাদ্ধ একসঙ্গে করতে হয় । এদিন আরেকটি লোকাচার পালিত হয় । সেটির নাম  হচ্ছে মঠোৎসর্গ । মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পারিবারিক শ্মশানভূমিতে এই মঠ নির্মাণ করা হয় । এই মঠ ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উৎসর্গ করা হয় । এখানে লোকাচারটি হল, এই বিশেষ মঠটি নির্মাণের সম্যকব্যয় নির্বাহ করে মৃতের কন্যাপক্ষ । অর্থাৎ, এখানে কন্যাকে পরের ঘরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলেও, তার গোত্রান্তর ঘটলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনটি যে ছিন্ন হয় না তাই প্রমাণ করে । কন্যাও সাধ্যমত ব্যয়ের মাধ্যমে পিতা-মাতার মঠ নির্মাণ করে দেয় । লোকাচার রয়েছে, পিতামাতার মঠোৎসর্গকালে কন্যাকে 'আড়াই-অ'র ( আড়াই অক্ষর ) কান্নাকাটি করতে হয় । কোন মাপকাঠিতে এই 'আড়াই অক্ষর' নিরূপন করা হয় তা এই প্রতিবেদক সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি । মঠোৎসর্গ উপলক্ষ্যে নামসংকীর্তন ও ভোজের আয়োজনও করা হয় ।

এভাবে  পূর্বপুরুষপূজার মাধ্যমে মৃতমানুষের প্রেতযোনি মোচনের জন্য নানা প্রকার শাস্ত্রবিধি ও আচার-আচরণ পালন করা হয় । তারপরেও মানুষের মনে পূর্বপুরুষের প্রতি আরো কিছু শ্রদ্ধাবোধজনিত কর্ম থেকে যায় । পিতৃপুরুষকে মানুষ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে । দেবতারা যেমন মন্দিরে অবস্থান করেন সেরকম মৃত আত্মার অবস্থানের জন্য এই মরভূমিতে তাঁদের জন্য মন্দির নির্মাণ করা হয় । পিতৃপুরুষের জন্য নির্মিত এই মন্দিরকে সমাধিসৌধ, সমাধিমন্দির, স্মৃতিমন্দির, স্মৃতিসৌধ বা মঠ বলা হয় মৃত্যুর পর অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং মঠনির্মাণ পিতৃত্বের প্রতি ধার্মিকতার নিদর্শন । পূর্বে আলোচনা করেছি যে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক বিষয় ও বস্তু এবং বিশেষ কোন স্থানের প্রতি আদিম মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল । ঠিক সেইরকম পূর্বপুরুষের সৎকারভূমি তথা শ্মশানভূমিও  একটি পবিত্র স্থান । পিতৃপুরুষের শ্মশানভূমির মতো পবিত্র স্থানে মন্দির বা মঠ নির্মাণ সেই চিন্তা থেকেই এসেছে । পবিত্রস্থানের উপর দেবত্ব আরোপের ফলে শ্মশান ও সেখানে নির্মিত মঠ ধর্মীয় শ্রদ্ধার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে । অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠী যেমন কোন পবিত্র স্থানে পাথর প্রতিষ্ঠিত করে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজা করতেন সেরকম হয়তো একসময় শ্মশানেও বড় পাথর রেখে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হত । পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে শ্মশান ক্ষেত্রে মঠ নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসে । পূর্ববাংলা ও তৎসন্নিহিত ত্রিপুরার বাঙালি জনগোষ্ঠীর মঠ নির্মাণের পেছনে গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । মঠ নির্মাণের পর মঠের দেওয়ালে হরিনাম মহামন্ত্রের 'ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর' লিখিত থাকে । এছাড়া মৃতের নাম, জন্ম তারিখ, ও মৃত্যু তারিখ ও উল্লেখ থাকে মঠের দেয়ালে । মঠের চূড়া শঙ্কু আকৃতির হয় এবং ভিত থেকে দেওয়াল চতুষ্কোণ বা অষ্টভুজাকৃতি হয় । মঠের চূড়ায় কলস ও ত্রিশূল স্থাপিত হয় । ত্রিশূল শৈবধারার প্রতীক । আবার শ্মশান হল দেবী কালিকার স্থান । ফলে শ্মশান মঠকে নিয়ে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবীয় ধর্মধারার একটা মিশ্রণ ঘটার সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না ।

 উত্তরপ্রজন্ম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় এই মঠ তৈরি করেন যাতে মৃত্যুর পরেও পূর্বপুরুষের স্মৃতি উত্তরপুরুষের অন্তরে জাগ্রত থাকে । কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায় আমরা পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের ভালোবাসার নিদর্শন পাই– 'আমাদের কালিদহ–গাঙুড়–গাঙের চিল তবুও ভালোবাসা / চায় যে তোমার কাছে–চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে / এই দহে–এই চূর্ণ মঠে–মঠে–এই জীর্ণ বটে বাঁধো বাসা । ( শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ–জীবনানন্দ দাশ ) । স্মৃতি মানুষকে পিছু টানে । পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে উঠে আসা মানুষের মনের মধ্যেও বাসা বাঁধে পূর্বপুরুষের স্মৃতি এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঠের দৃশ্য । কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ও এমন স্মৃতিচিত্র 'চতুর্দশীর অন্ধকারের' মত জেগে থাকে–'সবাই আমার মুখ দেখে না আমি সবার মুখ দেখি না / তবু তোমার মঠ ছেড়ে যাই না / চতুর্দশীর অন্ধকারে তোমার বুকে আগুন দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি / একা  / এইখানে চুপ করে এইখানে ডোবা পেরিয়ে ঝুমকাফুলের মাঝখানে / ঠাকুরদার মঠ ।' আদিম লতাগুল্মময় ( ১৯৭২ ) কাব্যগ্রন্থে সংকলিত এই কবিতাটির নাম 'ঠাকুরদার মঠ' । প্রতিদিনের চলমান বৃত্ত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এই মঠের মধ্য দিয়েই প্রিয় মানুষগুলোর স্মৃতি আমৃত্যু বুকের ভেতর বেঁচে থাকে । অনেকদিন পরে লেখা কবির  'বড় হওয়া খুব ভুল' (২০০২ ) ছড়ার বইটিতেও 'ঠাকুর দাদার মঠ' নামে একটি ছড়া আছে । সেখানেও আছে অন্ধকারের কথা । যে অন্ধকারে কবি জ্বালাতে চান একটি প্রদীপ । এই পৃথিবীতে বহু দিন, মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি বাইরে থেকে না ঘটলেও তার পূর্ণতা এসেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে । ছড়াটির শেষে কবি–'বাইরে যতই কুজ্ঝটিকা / দুই চোখে হোক দিব্য শিখা,/ বুকের মধ্যে   ঠাকুরদাদার মঠ' বলে একটা প্রত্যয়ের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এ অঞ্চলের মঠসংস্কৃতি পূর্বপুরুষের উজ্জ্বল স্মৃতিবাহক ।  বিশেষ বিশেষ তিথি ও পূজা-পার্বনের সন্ধ্যায় জ্বালানো দীপমালার শিখায় পূর্বপুরুষের প্রতি আত্মনিবেদনের অনুভবটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. বাঙালির ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, আদিপর্ব, কলকাতা, ১৩৮২.  
২. ধর্ম ও সংস্কৃতি–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৩. বাংলার লোকশ্রুতি–আশুতোষ ভট্টাচার্য, কলকাতা,১৩৯২ 
৩. সংস্কৃতির রূপান্তর–গোপাল হালদার, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৭৪
৪.  টোটেম ও ট্যাবু–সিগমুন্ড ফ্রয়েড,১৯১৩
৫.  রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা– ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, ভোলানাথ প্রকাশনী, কলকাতা 
৬. আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি–দিব্যজ্যোতি মজুমদার, লোকসংস্কৃতি ও অধিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা ২০০৪
৭.  বাংলার লোকসংস্কৃতি–ওয়াকিল আহমেদ, ঢাকা, ১৩৮১

Friday, September 1, 2023

সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে

সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আমার ফ্রেন্ডসার্কেল বিচিত্র । বাবার চাকুরিসূত্রে পরিযায়ী জীবনের কারণে প্রকৃত অর্থে জমাটি বাল্যবন্ধু আমার নেই । কিন্তু পরবর্তীকালে অসাধারণ সব অভিভাবক, সুহৃদ, বন্ধুবৎসল, শুভার্থী,প্রিয়জন পেয়েছি আমি । আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা যেমন রয়েছেন আমার বন্ধুবৎ তেমনি আমার এককালের ছাত্র এখন আমার বন্ধু । আমার জীবনশিক্ষক । আড্ডাগুরু, আখড়াই গোঁসাই তারাই । এদের নিয়েই প্রাতঃভ্রমণ আর জীবনসন্ধ্যাযাপন । 

বালককালের বেশ কজন বন্ধুর সঙ্গে সুখকর স্মৃতি এখনও হৃদয়ে জীবন্ত থাকলেও তাদের সঙ্গে বাকি জীবনে আর দেখা হয়নি । কখনো কোথাও কথাপ্রসঙ্গে কারো কারো সংবাদ পাই । ভালো আছে বা ভালো নেই । কেউ কেউ অসময়ে চলে গেছে ভবের বাজার থেকে । বাল্যবন্ধুর বিয়োগে যতটা শোকাতুর হওয়ার কথা তেমন কিছু মনে হয় না ।কেমন যেন আর দশটা মৃত্যুসংবাদের মতোই ভুলে যাই একদিন । মা বলতেন, মাটির বুকে থাকলে একদিন না একদিন দেখা হয় । নেই যখন আর দেখা হবে কি করে ! এটাই সান্ত্বনা । তবে দেখা হলে সেই বন্ধুটির নাক দিয়ে সিকনি পড়ত কিনা, পোস্টাপিস খোলা থাকত কিনা, কে গোরু চরাতে গিয়ে রহস্যময় সুরে রূপবান গান গাইত,গাছে চড়ায় কে তুখোড় ছিল, গুল্লি ও ডাগ্গি খেলায় কে বেশি কান্টামি করত অনর্গল স্মৃতি থেকে বলে দিতে পারতাম । তার মাঝেও অসীম অন্ধকারের মধ্যে ক্ষীণ আলোরেখার মতো দুএকজনের সাথে যোগাযোগ হয় যায় কোনো সূত্র ধরে । হেলে পড়া জীবনবৃক্ষের মেদুর চাহনিতে দিগন্তরেখায় ভেসে ওঠা দু একটি মুখ । প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের কালে সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে জীবনে যোগাযোগ হবে ভাবিনি তেমন কারো কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । খোঁজও পেয়ে যাই কারো কারো ।

কুলাইতে শৈশব-কৈশোরকালের আমার প্রায় সমবয়সী আমার মেজোভাইয়ের সহপাঠী শিবাজী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় একদিন । দেখাও হয়ে যায় । শিবাজীর বাবা ডা. এম. এল. বোস । মা ডা. লীলাবতী বোস । ভারতভুক্ত ত্রিপুরার প্রথম মহিলা চিকিৎসক । শিবাজী এবং তার দিদি রত্নাদি, ছোটোবোন বুলা এখন পশ্চিমবঙ্গবাসী ।শিবাজী কোলকাতা হাইকোর্টের নামজাদা ব্যারিস্টার । মনটা আগের মতোই সরল । দুঁদে উকিলের মারপ্যাঁচ নেই । মাস ছয়েক আগে শুধুমাত্র আমার মোবাইল ফোনে সাড়া দিয়ে দিদিকে নিয়ে দমদমে আমার ছেলের বিয়েতে উপস্থিত হয়েছে । পঞ্চাশ বছর পরে ওদের সঙ্গে দেখা । আমার শব্দভান্ডার গড়ে ওঠার পেছনে তাদের কোয়ার্টার্সের ছিল বিশাল ভূমিকা ।

 তখনকার দিনে প্রায় হাজার খানেক বইয়ের সংগ্রহ ছিল তাদের । শুকতারা, নবকল্লোল, দেশ, আনন্দবাজার, ইংরেজী হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, ব্লিৎস নিয়মিত আসত তাদের বাড়িতে । আর ছিল অনেকগুলো বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ গ্রন্থ, দেব সাহিত্য কুটিরের মোটা মোটা পূজাবার্ষিকীগুলো । ছিল হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, টারজান ইত্যাদি কমিকসের বই । সিলেটি প্রবাদ আছে, ভাঙ খাইলা শিবে, নিশা ধরছে বল্ দর । ওদের সংগৃহীত ও আলমারিতে রাখা বইগুলো আমি মুখ গুঁজে পড়তাম । শিবাজী মানে কুশলের বাবা-মা পিসেমশাই-পিসিমা খুব খুশি হতেন আমার আগ্রহ দেখে । তাদের একটা ফ্যাট গাড়ি ছিল । আগরতলায় গেলে গাড়িভর্তি পূজাবার্ষিকী দেশ, আনন্দবাজার, অমৃত,নবকল্লোল, শুকতারা ইত্যাদি নিয়ে আসতেন ।

মান্য বাংলা উচ্চারণের ধারাটা আমি তেমনি রপ্ত করেছিলাম কুলাইয়েই আর এক চিকিৎসক পরিবারের কাছ থেকে । সেসময়ের সুচিকিৎসক ডা. কাজি আব্দুল মান্নান সপরিবারে আসেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে । কাকু ছিলেন হুগলির লোক । কাকিমা খোদ কোলকাতার বনেদি পরিবারের মেয়ে । তাঁদের ছোটো দুটি মেয়ে জলি ও মলি । তিনি এতোবড়ো চিকিৎসক কিন্তু তাঁর পারিবারিক অসুস্থতায় আমার বাবার পরামর্শ নিতেন । তাঁরা আসার কিছুদিন পর  কামাল ও বুড়ি নামে দুই ভাই ভাইঝিকে তাঁদের কাছে নিয়ে আসেন পড়াশুনো করানোর জন্যে । কাজী কামালুদ্দীন ছিল আমার সহপাঠী । ভাইঝি বুড়ি রহমতুন্নেসা আমাদের এক ক্লাশ নিচে পড়ত । কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তাঁদের সঙ্গেই কাটত আমার খেলাধূলা, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া যৌথপাঠ । সম্ভবত নিজের ছেলে না থাকায় কাকিমণি আমাকে ছেলের মতো যত্ন করতেন । ওখানে থাকলে আমার মা-বাবাও নিশ্চিন্ত থাকতেন । নইলে আমার নামে সারাদিন নালিশ আসত আমার গুণপনার জন্যে । কামালদের উচ্চারণে হুগলি অঞ্চলের প্রভাব ছিল । আমরা যারা নাটকে সিনেমায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ডায়ালগ শুনেছি তাঁরা অনুমান করতে পারব হুগলি অঞ্চলের উচ্চারণ কেমন । কাকিমা পুরোপুরি ঘটি । মাঝে মাঝে তাদের উচ্চারণের সমালোচনা করে বলতেন, কি বলছিস তোরা সব । দেখ তো, বাঙাল ছেলেটা কি সুন্দর করে আমার সঙ্গে কথা বলছে । তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন কথোপকথনের ফলে আমি ক্লাশে উত্তরপত্রে সুন্দর চলিত বাংলা লিখতে পারতাম । পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতায় এসেও আমি ক্লাসরুমে চলিত বাংলায় পাঠদান করেছি ।আমি ভাবতাম আমার উচ্চারিত একটা শব্দও যদি শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয় তাহলে তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে । ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা খুবই দরকার । 

যাই হোক, একটা সময় কামাল ওরা ওদের বাড়ি চলে যায় । কামাল পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত । খুব সুন্দর ছিল হাতের লেখা । স্কুলে যাওয়ার সময় চিঠিটা ডাকবাক্সে ফেলে যেত । যতটা মনে পড়ে ঠিকানা লেখা থাকত– কাজি আব্দুল ওয়াহাব, গ্রাম গোলানন্দপুর, আরামবাগ, হুগলি । দীর্ঘ বছর এই বন্ধুটির কোনো সন্ধান জানিনা । গতবছর পুজোর সময় দৈনালীর অনুষ্ঠান এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক আব্দুল গফফার । তিনি হুগলির লোক । তাঁর কাছেও কথাটা পেড়েছিলাম । হয়তো হয়ে যাবে কামালের সাথে দেখা—'হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে–/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে–তখন হলুদ নদী/নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়–মাঠের ভিতরে ।'

প্রায় সাতান্ন বছর পরে কয়েকমাস আগে আচমকাই যোগাযোগ হয় শৈশবের এক সহপাঠীর সঙ্গে এই ফেসবুকের একটি সূত্র ধরে । রাজ্যের একজন গুণী ব্যক্তিত্ব লোকসঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, লোকযন্ত্রশিল্পী, ভ্রমণপিপাসু, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার স্বপনকুমার দাশ । ফেসবুকে সবসময় সজাগ থাকেন । তাঁর একটা পোস্টের সূত্র ধরে যোগাযোগ হয়ে যায় ছোটোবেলার সহপাঠী নিখিল দাসের সঙ্গে । সেও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক অফিসার । সাহিত্যরসবেত্তা ও তুখোড় সমালোচক । ব্যাংক কর্মচারী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিল একসময় । ফেসবুকে পরিচয় হতেই শৈশবস্মৃতি উগরে দিয়েছি । এখনও দেখা হয়নি সে বল্যবন্ধুর সঙ্গে । কোনোদিন 'হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !'