একাধিক ভাষা জানা থাকলে ভাষাশিক্ষার্থীর সামনে পাঠদান খুবই সহজ হয় ৷ ভাষা জানার অভিজ্ঞতাকে আমি ক্লাসে ব্যবহার করে বেশ সুফল পেয়েছি ৷ বাংলা ও তার প্রতিবেশী দু তিনটে ভাষায় আমি মোটামুটি বলা, পড়া আর লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারি ৷ আর বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বাংলা আমি যথাযথ বাচনভঙ্গিতে অনায়াসে বলে যেতে সক্ষম ৷ বাংলা ব্যাকরণ পাঠদানের সময় বেশ কার্যকরী ভূমিকাও গ্রহণ করেছে ৷ বিশেষত ভাষাতত্ত্ব পাঠদানের সময় বাংলা বিভিন্ন উপভাষাসমূহের আলোচনার সময় সেগুলোর উচ্চারণ সহযোগে উদাহরণ উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সহজে বিষয়টা বুঝে নিতে পারে ৷
শিক্ষার্থী বাংলার যে অঞ্চলের অধিবাসী হোক না কেন তাকে মান বাংলায় শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় ৷ ফলে বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থী বাঙালি হলেও তার বাংলা শব্দভান্ডার দুর্বল থাকে ৷ মান বাংলায় ব্যবহৃত কোন বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর অজানা হলে সেটা বোঝানোর জন্যে তার নির্দিষ্ট আঞ্চলিক বাংলার শব্দভান্ডারের শরণাপন্ন হতে হয় এবং সেখান যথাযথ প্রতিশব্দ নিয়ে সমস্যা নিরসন সম্ভব হয় অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট শব্দ চেনানো বা বিষয় বোঝানো সহজ হয় ৷
বাংলা ব্যাকরণে 'বর্ণের উচ্চারণ স্থান' নামে একটা অধ্যায় আছে ৷ সেখানে বাকযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে জিহ্বার স্পর্শানুযায়ী বিশেষ বিশেষ বর্ণের বিশেষ বিশেষ নাম রয়েছে ৷ সেই অনুযায়ী কন্ঠ্যবর্ণের উদাহরণ হিসেবে ক,খ,গ,ঘ, ঙ কে সহজেই চেনানো বোঝানো যেত ৷ কিন্তু তালব্যবর্ণ, মূর্ধ্যবর্ণকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হত ৷ দুটোর উচ্চারণ স্থানই আমাদের মুখগহ্বরের ওপরের দিকের শক্ত অংশ ৷ দন্ত্যমূলের পরে যে শক্ত অংশ সেখানে জিহ্বার স্পর্শ পেয়ে উচ্চারিত হয় চ,ছ, জ,ঝ,ঞ ৷ এগুলো তালব্যবর্ণ ৷ আর এই শক্ত অংশের পরে ওপরের দিকের শক্ত অংশে জিহ্বার স্পর্শে উচ্চারিত হয় ট,ঠ,ড,ঢ,ণ ৷ এগুলো মূর্ধ্য বর্ণ ৷কিন্তু পুরো শক্ত অংশ এলাকাকে মান বাংলায় বলা হয় তালু ৷ বিভাজন করলে সম্মুখ তালু ও পশ্চাৎ তালু ৷ কিন্ত সমস্যা হল এই যে, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন আঞ্চলিক বাংলায় একে তালু বলে না ৷ আর তালু বলে এই অঞ্চলে অন্য তিনটি প্রত্যঙ্গ চিহ্নিত ৷ হাতের চেটো - তালু, পায়ের তলা- তালু আর মাথার ওপরের বহিঃত্বক ৷- তালু ৷ ফলে এ জায়গাটায় এসে শিক্ষারথীরা গুলিয়ে ফেলত ৷ তালব্য বর্ণটা যদিও বা কোনোরকমে বোঝানো যেত ৷ মূর্ধ্য বর্ণে এলে জটিলতা বেড়ে যেত ৷ এক্ষেত্রে আমি একটা মজার চুটকির আশ্রয় নিতাম ৷ গল্পটা এইরকম ৷ নতুন জামাই খেতে বসেছে ৷ শাশুড়ি শুরুতেই ভাতের সঙ্গে দিয়েছেন গরম আলুসেদ্ধ ৷ জামাই ভাতের সঙ্গে আলুসেদ্ধটা মেখে প্রথম গ্রাসটা মুখে তুলতেই গরম আলুসেদ্ধ গিয়ে আটকাল মুখগহ্বরের উপরের অংশে ৷ যন্ত্রণায় জামাই বাবাজি মুখ উপরে তুলে হাঁ করে ছনের ছাওয়া রান্নাঘরের বাঁশের কাঠামোর দিকে তাকিয়ে মুখে হাওয়া টানছে ৷ বুদ্ধিমতী শাশুড়ি বুঝতে পেরে মজা করে জামাইকে জিজ্ঞেস করছেন, উপরের দিকে কী চাইতাছো বাবা ৷ জামাইও সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত জবাব দেয়, না মা, দ্যাখতাছি ইডি কোন ঝাড়ের বাঁশ ৷ শাশুড়িও মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিলেন, ইডি টাকরাপোড়া ঝাড়ের বাঁশ ৷ আমি বলতাম শিক্ষারথীদের, বুজছো নি ৷ এই টাকরাই হইলো মূর্ধা ৷ জিহ্বা এইখানে ছুঁইয়া যে বর্ণগুলি উচ্চারিত হয় সেগুলি মূর্ধ্য বর্ণ ৷ক্লাসশুদ্ধ হাসিতে ফেটে পড়ে জবাব দিত চিনছি স্যার ৷ সারাজীবনেও ভুলতাম না ৷