Thursday, March 31, 2022

হারিয়ে যাওয়ার আগে : একটি গ্রন্থপাঠের গৌরচন্দ্রিকা

'হারিয়ে যাওয়ার আগে' : একটি  গ্রন্থপাঠের গৌরচন্দ্রিকা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শিক্ষকতার পেশায় এসে শেখানোর চাইতে শিখেই গেছি দীর্ঘদিন । এখনও শিখছি । আমার চাকরি জীবন শুরু হয় সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে । এই স্কুলে সেকালের ডাকসাইটে দিকপাল শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে ছিলাম আমি । আমাকে প্রথম দিন স্কুলের দরজা থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স‍্যর । হাত ধরে প্রথম ক্লাসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ দাস, অর্থনীতির শিক্ষক । এভাবে ধীরে ধীরে গোপাল দেবনাথ, রমনীমোহন নাথ, রঞ্জিত দেবনাথ, ড.ননীগোপাল চক্রবর্তী,কমল অধিকারী, নারায়ণ রায়, ড. রঞ্জিত দে প্রমুখ বেশ কয়েকজন নামজাদা শিক্ষকের স্নেহের ছায়ায় কাটিয়েছিলাম দীর্ঘদিন । চাকুরি চলাকালীন সময়ে অনেকে নতুন এসে জয়েন করেছেন । অনেকে নতুন কর্মক্ষেত্রে বদলি হয়ে গেছেন । অনেকে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন । আমার কয়েক দিন আগে এই স্কুলে জয়েন করেছিলেন আমার অগ্রজপ্রতিম দীপক দাস । সেসময়ে আমাদের স্টাফ রুম ছিল জমজমাট । পড়াশোনা, আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানচর্চার একটা বৃহৎ পরিসরের মধ্যে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম ‌। শম্ভু চৌধুরী, শিখা ভট্টাচার্য্য, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, গৌরগোপাল দাস, চম্পাকলি বিশ্বাস, নেপাল সরকার, অর্জুন শর্মা, নিতাই ভৌমিক  এঁরাও প্রত‍্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন জ্ঞানভান্ডার । শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষক আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ ছিলেন বেশ কয়েকজন । লক্ষ‍্যণীয় হল এই শিক্ষকমন্ডলীর অধিকাংশেরই ছিল সাহিত‍্যে অগাধ বিচরণ । লিখতেও পারতেন হাত খুলে । যাঁদের মধ‍্যে আজও অনেকে রাজ‍্যের লেখালেখির জগতে সুনামের সঙ্গে বিচরণ করছেন । ফলে 'চন্দন গাছের সঙ্গে থেকে ভেরেন্ডা গাছ ও যেমন চন্দনের বৈশিষ্ট্য লাভ করে তেমনি আমিও এই গুণীজনদের মধ‍্যে মধ‍্যে থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করবার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম । আমাকে বিভিন্নভাবে তাঁরা সাহায‍্য করতেন যাতে লেখালেখিতে উৎকর্ষ আসে । তীক্ষ্ণ সমালোচনাও করতেন । এঁদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি প্রতিদিন আমাকে নতুন করে জাগাত । 

আমার অগ্রজপ্রতিম দীপকদা যার সঙ্গে আমি দীর্ঘ আটাশ বছর এই স্কুলে কাজ করেছি  । বাংলাসাহিত‍্যে অবাধ বিচরণ তাঁর । ক্ষুরধার যুক্তির জাল বিস্তার করে বক্তব‍্য রাখতে পারেন । মুহুর্মুহু বেদ-পুরাণ-নীতিগল্প থেকে উদাহরণ টেনে বক্তব‍্যকে সমৃদ্ধ করতে পারেন তিনি । কবিতা আর গান ছাড়া তাঁর বক্তব‍্য সম্পূর্ণ হয়না । তবে কিছুটা আবেগপ্রবণ তিনি । আবেগের রাশ টানতে পারেননা । আর এই আবেগময়তার কারণেই তাঁর অনেক গুণগ্রাহী শ্রোতা রয়েছেন । আর তাঁর আর একটি গুণ হল কাউকে তিনি অবমূল‍্যায়ন করেননা । তাঁর স্পষ্টবাদিতারও শিল্প রয়েছে । আমার লেখার একজন মনযোগী পাঠক ও গঠনমূলক সমালোচক তিনি । দীর্ঘদিন লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন  । সম্প্রতি তাঁর সেইসব লেখার বাছাই করা কিছু নিবন্ধকে দুই মলাটে বন্দী করেছেন 'হারিয়ে যাওয়ার আগে' শিরোনামে । এবারের বইমেলায় আগরতলার প্রকাশন সংস্থা 'নীহারিকা' থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থ ।  কথাবলার মতো ঝরঝরে ভাষায় লেখা এই লেখায় তাঁর পাঠব‍্যাপ্তি পাঠক প্রতি ছত্রে ছত্রে অনুভব করবেন । প্রতিটি লেখায় ঝরঝরে গদ‍্যশৈলী, কবিতার উদ্ধৃতি, গ্রন্থপাঠের নির্যাস পাঠককে মুগ্ধ করবে । তাঁর লেখা জুড়ে মৃত‍্যুচেতনা এক নিপুণ অনুষঙ্গ । যা জীবনবোধে স্নাত করে ।

 গত পরশু আমাদের পূর্বতন কর্মক্ষেত্র সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বিদ‍্যালয়ের প্রধানশিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয় এবং শিক্ষক নিতাই ভৌমিক  আমাকে ও দীপকদাকে গতকাল স্কুলে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানান । গতকাল নিতাই ভৌমিকের চাকরিজীবনের অবসরগ্রহণ উপলক্ষ‍্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন‍্যে । প্রধানশিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয় কিছুদিন আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে পেয়েছিলেন । সেই অনুষ্ঠানে আচমকাই দীপকদা আমাকে এবং নিতাই ভৌমিককে তাঁর সদ‍্যপ্রকাশিত গ্রন্থ 'হারিয়ে যাওয়ার আগে' তুলে দেন ।
আসলে আমি দীপকদাদের মতো অগ্রজদের স্নেহ এবং দিলীপচন্দ্র দাস স‍্যর এবং নিতাই ভৌমিকদের মতো অনুজদের শুভেচ্ছায় বাঁচার রসদ পাই ।
এই ভরসাতেই ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে পাঠকের রসভঙ্গ করার সাহস পাই  । 

সবার জন‍্যে শুভকামনা ।

Wednesday, March 30, 2022

এক চিরঞ্জীব বজ্রকন্ঠের সঙ্গে ক্ষীণ পরিচয়

এক চিরঞ্জীব বজ্রকন্ঠের সঙ্গে ক্ষীণ পরিচয়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি একাদশ শ্রেণির ছাত্র । তার আগের বছর অর্থাৎ  ১৯৭০ সাল থেকে মোটামুটি আমি বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র সম্বন্ধে পরিচিত হই । সে বছর বাংলাদেশে এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল । একদিন আমাদের ক্লাসের ভূগোল স্যার সুখেন্দু চৌধুরী ক্লাসে ঢুকে খুব মনমরা হয়ে বসে রইলেন । অনেকক্ষণ যাবৎ কিছু পড়াচ্ছেন না । আমরাও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি । আমাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়ো সহপাঠী কৃষ্ণকান্তদা সাহস করে স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আপনার কি হয়েছে ? চুপচাপ বসে রয়েছেন কেন ?

স্যার ধীরে ধীরে বললেন, পাকিস্তানে আমার বাড়ি । সেখানে আমার পূর্ব পুরুষরা রয়েছেন । আমাদের যেখানটায় বাড়ি নোয়াখালীর সন্দীপ । সেটা দ্বীপাঞ্চল । গতকাল সেখানে প্রচন্ড জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেছে । বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে । আমার মা বাবারা এখনো সেখানে রয়েছেন । দেশের মায়া ছেড়ে সেখান থেকে আসেননি । জানিনা তারা কেমন আছেন । আদৌ বেঁচে আছেন কিনা বলতে পারছিনা । বলতে বলতে তাঁর চোখ ছল ছল করে উঠেছিল সেদিন ।

একটু পরেই তিনি একজন ছাত্রকে স্টাফরুম থেকে গ্লোবটা আর ভারত ও পাকিস্তানের দুটো ম্যাপ আনার জন্য বললেন । একজন গিয়ে সেগুলো নিয়ে এল । প্রথমে তিনি গ্লোব থেকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের সামনে তুলে ধরলেন । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন আমাদের কাছে ম্যাপের মাধ্যমে । তারপর পূর্ব-পাকিস্তানের কোথায় সন্দ্বীপ-হাতিয়া ও অন্যান্য চরাঞ্চল রয়েছে সেগুলো আমাদের দেখাতে লাগলেন । স্যার যখন বর্ণনা করছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, তিনি যেন পূর্বপাকিস্তানে অবস্থান করছেন । মনে হচ্ছিল যেন তিনি সন্দ্বীপের তার জন্মভিটে দাঁড়িয়ে আছেন । তাঁর নিজের গ্রামের বর্ণনা করছিলেন আবেগের সঙ্গে । আমরাও পরিচিত হচ্ছিলাম আমাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভূমি পূর্ববাংলা তথা পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে । যে দেশের কথা আমি আমার মা-বাবার মুখে বারবার শুনেছি । একসময় স্যার থামলেন । আমাদের সামনে মানচিত্র তুলে ধরে সেখানকার বর্ণনা করে সেদিন তিনি নিজেকে অনেক হালকা বোধ করেছিলেন ।

সেই সুখেন্দু স্যারের কাছে আমরা পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মার্চের এক ভোরে পড়া বুঝতে যাই । সুদর্শন সুখেন্দু স‍্যার তার ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে সকালের প্রাতরাশ সারছিলেন । সামনে মারফি কোম্পানির একটা রেডিওতে সংবাদ চলছে । তিনি ইঙ্গিতে আমাদের বসতে বললেন । কথা বলতে বারণ করলেন । আমরা চুপচাপ বসে পড়লাম। একটু পরেই ভরাট এবং জোরালো কণ্ঠস্বর রেডিওতে ভেসে এলো । "ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি । আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন । আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি । কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে । আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায় ।...." যেন এক দৈবীকণ্ঠস্বরে স‍্যারের রুমটা গম গম করে উঠল । রেডিওর ছোটো ছোটো লাইটগুলো মুহুর্মুহু লাফিয়ে লাফিয়ে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে । কারো মুখে কোন কথা নেই আমরা কয়েকটা ছাত্র মগ্ন হয়ে বসে আছি স্যারের সামনে । এমন কণ্ঠস্বর আমি কখনো শুনিনি । আমার চোখের সামনে যেন হাওয়ায় ভাসছে আমাদের ইতিহাস বইয়ের 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে'র পাতা গুলো । ভেসে উঠছে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর মুখ, মাস্টারদা সূর্যসেনের মুখ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মুখ । তাহলে তারা কি এভাবেই জলদগম্ভীর ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ?  "...তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো । মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব ।এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । জয় বাংলা । জয় বাংলা । একসময় ১৮মিনিটের দীর্ঘ এই ভাষণ শেষ হয় । এক বিধ্বংসী ঝড় থেমে গেলে যেমন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ । তেমনি স্যারের পড়ার টেবিলে বসা আমরা কয়েকজন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলাম ।

সেদিন আর স্যার পড়ালেন না । তিনি জানালেন আগের দিন ৭ মার্চ বিকাল বেলা ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানের ( বর্তমান সোরোয়ার্দী উদ্যান ) এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি ধীরে ধীরে আমাদের সামনে সেদিন তুলে ধরলেন সেদেশের ৫২র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তখনকার সময় পর্যন্ত গণআন্দোলনের ইতিহাস । সে দেশের সামরিক শাসক বর্গ যে বারবার তাদের উপর আঘাত হেনেছে তার কথা । আইয়ুব খানের মার্শাল ল'র কথা । ইয়াহিয়া খানের কূটনৈতিক চালের কথা । সে দেশের পূর্বপ্রান্তের এই অংশটি যে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছে তার ইঙ্গিতও সেদিন দিলেন সুখেন্দু স‍্যার । প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম আর বারবার ভাবছিলাম এই মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী মানুষটি না জানি কেমন !

 দু'একদিনের মধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিরাট ছবিসহ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সভার ছবি ফলাও করে প্রকাশিত হয় । সাদা রংয়ের  পাঞ্জাবির উপর কালো হাতাকাটা কোট গায়ে পেছনদিকে আঁচড়ানো চুলের অধিকারী এক বিরাট সুপুরুষের তর্জনী তুলে ধরা শেখ মুজিবর এর ছবি সেদিন সব কাগজে বেরিয়েছিল ‌। তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণের উন্মাদনা সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল এদেশের মাটিতেও । সেদিন রাজ্যের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একটি সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পুরোপুরি তুলে ধরা হয়েছিল ‌। পাশে ব্লক করে তুলে দেওয়া হয়েছিল 'জাগো অনশন বন্দী ওঠো রে যত / জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত'–গানটি ।

সেদিন থেকেই এদেশের পথে-প্রান্তরে, হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি সকলের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল । তারপর ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান বাহিনী নেমে পড়ে ঢাকার রাজপথে । ব্যাপক ধরপাকড়, নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে । গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান এবং তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণাটি সম্প্রচারিত হয় । নিজেদের জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে সেদেশ থেকে শরণার্থীর ঢল নামে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় রাজ্যের বুকে । পরদিন স্কুলের প্রেয়ার মিটিংয়ে সুখেন্দু চৌধুরী স‍্যার, সুনীল বর্মন সার, কাশিনাথ দাশ স‍্যার সংক্ষেপে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন । শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য বার্তা দেন প্রধান শিক্ষক পূর্ণেন্দু বিকাশ দত্ত মহোদয় । সে অনুযায়ী আমি, প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের ছেলে মৃন্ময় দত্ত ও একাদশ শ্রেণির আরো কয়েকজন ছাত্রের নেতৃত্বে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ শুরু করি । আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকমন্ডলীর অধিকাংশেরই পূর্ব বাসস্থান পূর্ববঙ্গে হওয়ায় তাঁরা আমাদের একাজে উৎসাহ দিতে থাকেন । দেখতে দেখতে আমাদের লোকালয় শরণার্থীতে ভরে যায় । 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেদিন যেন আমাদের প্রাণেও দোলা দিয়েছিল ১৯৭১ এর ১৩ এপ্রিল রাতে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিচিত্রায় প্রকাশ করা হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ । সেইসঙ্গে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা "শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি /  আকাশে বাতাসে ওঠে রণি / বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ" গানটি বাজানো হয় । এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এপারের বিশিষ্ট শিল্পী অংশুমান রায় । হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে ৪৫ আরপিএম এর একটি রেকর্ড বের করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং অংশুমান রায়ের গানের । রেকর্ডটি সেদিন এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে সেটি সে সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পূজা প্যান্ডেলে প্রচুর বাজতে থাকে । সেই গানের রেকর্ড সেদিন ত্রিপুরার প্রত্যন্ত গ্রাম সাব্রুমের ছোটখিলের রানির বাজারের অনিল চৌধুরীর ( অনিল ঠাকুর ) চায়ের দোকানে অনবরত বাজত । সে সময় সারা সাব্রুমে একমাত্র অনিল ঠাকুরের কাছেই মাইকসরঞ্জাম ছিল । বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সেদিন অনবরত শুনতে শুনতে আমাদের মত কিশোর ও তরুণদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। 

তারপর ১০ মাস ব্যাপী বাংলাদেশের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের কথা সবারই জানা । ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের কাঙ্খিত স্বাধীনতা । দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসীর মনে শান্তি ছিল না । তাঁরা খুঁজছিলেন তাদের দেশ নায়ককে । আমরা এদেশের তরুণরাও সন্ধান করছিলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ককে ।  বঙ্গবন্ধুকে । তিনি তখন পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন সহ্য করছেন ।তাঁর মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সাথে আমাদের দেশের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন । চাপে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে মুক্তি দেয় । পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে একটি কবরও খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল ।  
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭জানুয়ারি রাত ২ টায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বিমান লন্ডনের উদ্দেশ‍্যে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে । লন্ডন থেকে নয়াদিল্লি ফিরে এসে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । তিনি জনসমক্ষে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী ও 'ভারতের জনগণ আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু' বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন । ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি তিনি তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন ।

দেশে ফিরেই তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন । দেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিবিড় করার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন ‌। কিন্তু তার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেদিন স্বাধীনতার শত্রুরা পার পেয়ে যায় ‌। আর সেই সুযোগে তারা গোপনে বিষদাঁত, নখ বিস্তার করতে থাকে সে দেশের মাটিতে ।

তখন আমি কলেজে পড়ি । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট । যেদিন আমাদের দেশে স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছে । রাত পোহালেই যেদিন দেশজুড়ে উড়বে তেরঙ্গা পতাকা । ঠিক সেদিনই ভোররাতে একদল সেনা কর্মকর্তা ট্যাংক নিয়ে সদ্যোজাত প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর ঘিরে ফেলে । ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাসভবন এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার ও ব্যক্তিগত কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করে । 
সেদিন ভোরে আমরা ছোটখিল থেকে দলবেঁধে সাব্রুম শহরে এসেছিলাম মেলার মাঠে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখার জন্য । সকালের আকাশবাণীর সংবাদ সম্প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেনে যায় নির্মম মুজিব হত্যাকাণ্ডের সংবাদ । আমরা একদল ছুটে যাই সাব্রুম বাজার ঘাটে ফেনী নদীর পাড়ে । ওপারেই বাংলাদেশের পার্বত‍্য চট্টগ্রামের রামগড় থানা । দেখি সৈনিকের পোশাকপরা একজন থানার পেছনে নদীর দিকে এসে চিৎকার করে কাঁদছে আর থানার দেওয়ালে মাথা ঠুকছে । তার বুকফাটা আর্তনাদে দুপারের আকাশ-বাতাস ভারি  হয়ে উঠেছে । কিছুক্ষণ পরে কয়েক জন অস্ত্রধারী সৈনিক এসে তাকে নিয়ে যায় ভেতরের দিকে । সেদিন আমাদের এখানেও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান নিষ্প্রভ হয়ে যায় । সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের পর সবাইকে দ্রুত স্থান ত্যাগ এর নির্দেশ দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ।

আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি ২০২২ এ । বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক ও একটি জাতিরাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ পূর্তিলগ্নে । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিকালে । হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭-তম শাহদত বার্ষিকীতে । কৈশোর থেকে বার্ধক্যকালীন সময় ধরে আমার জীবনের এই পথ চলায় গোমতী-ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার বুক বেয়ে অবিরত জলধারা বয়ে গেছে । আমাদের প্রজন্ম দেখেছে আমাদের পূর্বজদের স্বপ্নে দেখা বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, আর জীবনানন্দের রূপসী বাংলার,প্রথম শুভক্ষণ । চোখে না দেখলেও শুনেছি তার জনকের উদাত্ত কণ্ঠস্বর । তার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের প্রবাহ বহমান নদীর মতো আমাদেরও চেতনায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তাঁর ঘোষিত ভ্রাতৃত্ববোধই আমাদের প্রতিবেশী সম্পর্ককে দৃঢ় করবে । ভালোভাবে চেনার আগেই নৃশংস ঘাতক তাঁকে কেড়ে নিয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে । এ শূন‍্যতা পূর্ণ হবার নয় । তবুও দুই দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রতিবশীর মতো হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে । বঙ্গবন্ধু জেগে থাকবেন আমার হৃদয়ে, আমাদের অন্তরে । জয় হিন্দ । জয় বাংলা । ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক ।

Monday, March 28, 2022

বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা

বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কবিতার ধারাটি সমৃদ্ধ । এরাজ্যে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় নিরন্তর কবিতা রচনা হচ্ছে । ছিলোমিলো এখানকার চা-বাগান অঞ্চলের মানুষজনের ভাষা  । এই ভাষাতে যে কয়জন কবিতা রচনা করে ইতোমধ্যে পাঠকমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন তাদের মধ্যে বিপ্লব উরাং এর নাম অবশ্যই উচ্চারণ করতে হয় । বিপ্লব উরাং মোহনপুর মহকুমার ঈশানপুরে চা-শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ফলে তাঁর মাতৃভাষাও ছিলোমিলো । পাশাপাশি বাংলা কবিতায় ও তিনি সমান দক্ষতার ছাপ রাখেন ।তাঁর কবিতায় চা বাগান অঞ্চলের জীবন-সংস্কৃতি ও তাদের সংগ্রামের পাশাপাশি বর্তমান সময়ের মানুষের যন্ত্রণা ও লড়াকু মানসিকতার কথা তীক্ষ্ণ ও তীর্যকভাবে ফুটে ওঠে একেবারে সরল শব্দে । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এক বিঘত জমিন' প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে । তারপর থেকে তাঁর কাব্য খ্যাতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে আরও বৃহত্তর সড়কপথে যাত্রা করেছে ।

আগরতলা বইমেলার চতুর্থদিন সন্ধ‍্যায় লিটল ম‍্যাগাজিন এনক্লেভে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । এই সময়ে একটি টেবিলে চোখে পড়ল 'বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা' বইটির দিকে । সদ‍্য বেরিয়েছে আগরতলার প্রকাশনা সংস্থা 'তিনকাল' থেকে । সংগ্রহ করলাম বইটি । বত্রিশ পাতার ছোট্ট শরীরের বইটিতে রয়েছে একুশটি কবিতা । কবি তাঁর শৈশব থেকে দেখে এসেছেন চা-শ্রমিকদের নিত‍্যদিনের জীবনযুদ্ধ । পুরুষানুক্রমে বাহিত হয়ে আসা এই সংগ্রামের কথা লেখার জন‍্যে তিনি তাগিদ অনুভব করেন । তাই তিনি লেখেন ১.'তকে লিখতে হবেক/ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘরে থাকে/কুপিবাতি জ্বলায় করে/লিখাই পড়হা করেছিস ।/ঘরপেন্দারে স্কুল নাই ছিল ।/গাড়িভাড়ার অভাবে কখন সখন পায়ে হাঁটে স্কুল করেছিস ।' ( তকে লিখতে হবেক )
২.'বাগানে কলঘরে কাম করতে যাইয়ে/বেনুকাকার হাত দুইটা/মেসিনে দুই টুকরা হইয়ে যাইয়েছিল/বিনা চিকিচ্ছায় তিনমাস পিছে/টপাস করে চলে গেল ।' ( তকে লিখতে হবেক ) । সময়ের প্রেক্ষিতে কবি লিখতে গিয়ে সংশয়াপন্নও হয়ে পড়েন । 'চখেত কত কিছুই দেখছি ।/সাচ কথা লিখতে গেলে ডর ডর লাগে ।' ( মনটা ছটফটাছে ) ।উৎকন্ঠাসংকুল মন নিয়েও কবি দগ্ধ সময়ের রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেন । 'আনধার চারদিকেই আন্ধার ।/আনধারে ডুবে থাকেও ক‍্যানে/কে জানি লতুন সকালের জনে/হামরা একসঙ্গে লড়তে নাই পারি ।/সপন দেখি এক সুন্দর সকালের ।' ( সপন দেখা ) 
বিপ্লব উরাং এর কবিতায় কবি বারবার 'বেচারাম'কে এনেছেন । ১. বেচারাম পড়ে শুনায়-/হাঁ করে শুনি আর বিড়বিড়ায়-/চুতিয়ারা মুরগির ঠ‍্যাং খাইয়ে/ঝুটা কথা লিখে দিয়েছিস-/শরমিকরা ভাল আছে ! ( খবরিওয়ালা ) ২. নাই বেচারাম, চুপ করে আর ঝোপতে/ থাকলে চাকরী নাই পাবি । ( ছিনাই করে লিব ) ৩. বেচারাম,/ শুনলম তুই ন কবি। হয়েছিস ।/ কবতা লিখছিস ।/ বাঃ, ভালা কথা । ( তকে লিখতে হবেক ) ।

মনে হয় বেচারাম কবিরই আত্মসী । অথবা সেইসব শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধি, যুগ যুগ ধরে যাদের শ্রম-ঘাম বিক্রি হয়ে আছে মালিকের গদিতে । যারা 'মাথাপিছু হপ্তাহে/চাল আটা মিলায় তিন কেজি, দুইশগেরাম' রেশন দেয় শ্রমের বিনিময়ে । তাও ' ক‍্যামন চাল জানিস/পাথর মিশাইল !/আর আটায় ভুষি ভর্তি ।' ( রেশন ) । কী নিদারুণ দুঃখভরা রসিকতা উঠে আসে বিপ্লব উরাং-র কবিতায় ।

Tuesday, March 22, 2022

হোরিবীজ

হোরিবীজ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

হৃদয়ের রঙে ডোবে হোলির পিচকিরি
আবির কুমকুমে মুষ্ঠি পিরিতি পাততাড়ি

রাঙাবাঁশি প্রিয়নামে ডাকে গোপীজনে 
নৌকাডুবি আজ সই যমুনার গহনে

কৃষ্ণের চাতুরি গুণে আবির পরাগ 
রাধিকার সম্ভ্রম রাখে ঋতুরক্তরাগ

সেই তো পুরুষ ঢাকে পরমার লাজ
প্রকৃতির বুকে ছোঁড়ে ফাগ ফুলসাজ ৷

Wednesday, March 9, 2022

গাইল-ছ‍্যেহাইট

গাইল-ছ‍্যেহাইট নিয়ে অনেক লোকসাংস্কৃতিক কর্মকান্ড রয়েছে । এখন এর ব‍্যবহার বিরল । করইগাছ দিয়ে গাইল এবং গাবগাছের কাঠ দিয়ে ছ‍্যেহাইট দক্ষ কারিগররা তৈরি করতেন । বলা হয় গাইল হল ভাই ও ছ‍্যেহাইট হল বোন ।

Sunday, March 6, 2022

খাসপুর

কিল মারবার গোঁসাই ৷

 বলছিলাম ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কথা ৷ ঘুরতে ঘুরতে আজ এসে পৌঁছুলাম খাসপুর প্রত্নক্ষেত্রে ৷ দুতিনটে প্রাচীর ও পরিখাবেষ্টিত চারচালা প্রাচীন ইমারত ছাড়া আর কিছু নেই ৷ যত্নের ছাপও নেই ৷ অফিস বলতে একটা ছোট্ট দালান ৷ বসার ব্যবস্থা বলতে একটা প্লাস্টিকের টেবিল, দুটো চেয়ার সম্বল ৷ কর্মী আছেন দুজন একজন পুরষ ও মহিলা ৷ খই ভাজেন কিনা জানিনা ৷ তবে তাঁরা আছেন ৷ কোনো আলমারি বা আসবাবপত্র কিছুই নেই ৷ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে লিপিখোদিত কয়েকটা প্রস্তরখন্ড ৷ আর আছে একটা পাওয়ার ট্রিলার ৷ প্রত্নস্থলটি সম্বন্ধে অফিসে যখন তথ্য চাইলাম তখন পুরুষ কর্মী ভদ্রলোক একটা পেটমোটা বাজারের থলে থেকে একটাল কাগজ বের করে  তার থেকে দুমড়ানো একটা কাগজ বের করলেন ৷ তাতে কিছু তথ্য আছে ৷ আবছা ৷ তারই ছবি নিলাম ৷ জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের আলমারি, ফাইলপত্র নেই ৷ বললেন, আমরার কথা আর কইন না যে ৷ যা বললেন তাতে তাঁরা যে কতোটা অসহায় অব্যবস্থার শিকার তা সহজেই অনুমান করা গেল ৷ ভিজিটরস বুকের কথা আর তুললামই না ৷ বললেন এটা ক্যাম্প অফিস ৷ গুয়াহাটি থেকে প্রত্নতত্ব দপ্তর এটা দেখভাল করেন ৷ কোনো রেকর্ডপত্র কিছুই নেই ৷ কথায় কথায় জানলাম ভদ্রলোক ত্রিপুরায় ঊনকোটিতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন ৷ উদয়পুরে তাঁর এক সহকর্মী আছেন ৷ মাধব সাহার বাড়ির উল্টোদিকে বাড়ি সহকর্মীটির অর্থাৎ নারায়ণ দেবনাথের ৷ দক্ষিণের পিলাকের কথাও বললেন কথাপ্রসঙ্গে ৷ আমার আগ্রহ দেখে তাঁর সংগ্রহে রাখা ডিমাসা জাতির ইতিহাসসংক্রান্ত কয়েকপাতার একটা প্রবন্ধের একটা জেরক্স কপি দেখালেন ৷ বললেন,কিছুই তো নেই ৷ অনেকেই তো জানতে এর ইতিহাস ৷ এটা উনি ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করে রেখেছেন ৷ প্রবন্ধটি অসমিয়া ভাষায় লেখা ৷ আমার জন্যে মহামূল্যবান সম্পদ ৷ পড়ে ফেললাম ঝটিতি ৷ গতকাল আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগে গিয়েছিলাম ৷ উত্তরপূর্বের সাহিত্যসম্পর্কিত প্রচুর রেফারেন্স দেখলাম কিন্তু প্রাচীন ত্রিপুরা রাজ্য ও ডিমাসা রাজ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের সূত্র বা সমকাল সম্বন্ধে কোন রেফারেন্স পাইনি ৷ অবশ্য আমি সেখানে খুব অল্প সময়ের জন্যে অবস্থান করি ৷ তবে তাঁদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি ৷ ক্লাসের ব্যস্ততার মধ্যেও অধ্যাপক ড. দেবাশিস ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক ড. রাহল দাস আমাকে সঙ্গসুধায় ঋণী করেছেন  ৷ ওহো ভুলেই গেছি ৷ অধ্যাপক রাহুল দাস আমার হাতে তুলে দিয়েছেন  উত্তরপূর্বের বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মিথিলেশ ভট্টাচার্যের একটি গল্পগ্রন্থ ও দ্বিরালাপ সাহিত্যপত্রের কয়েকটি সংখ্যা ৷যাই হোক, খাসপুর প্রত্নক্ষেত্রের কথায় আবার আসি ৷ আমাকে ওখানকার এই চিরকুটগুলো নিয়েই তৃপ্ত  থাকতে হল ৷ প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের তরফ থেকে কোনো ইতিহাসনির্দেশক বোর্ড নেই ৷ এ ব্যাপারে নিজেদের হুঁশ না থাকলে কী হবে ৷ দপ্তরের মুরুব্বিসুলভ হুঁশিয়ারনামাটা  ঠিক প্রবেশপথের মুখেই জ্বল জ্বল করছে ৷ এর আগে পরশুদিন গিয়েছিলাম উধারবন্দের কাঁচাকান্তি কালিবাড়িতে ৷ তথ্য জানার জন্যে টুকটাক প্রশ্ন করতে দুই পুরোহিত আমারদিকে এমনভাবে তাকালেন যেন বন থেকে বেরুনো নতুন চিড়িয়া দেখছেন ৷ জয় মা, অপরাধ নিওনা ৷ এই দুজন কিছুক্ষণ বাদে বাদে থালা থেকে প্রণামী তুলে নিয়ে মায়ের চরণের উপরে রাখা পুষ্পস্তুপের তলায় রাখা ঠোঙায় মজুদ করছেন ৷ আকাটদুটো মায়ের ইতিহাস কিছুই জানেনা ৷ শুধু রাঙ কামাইর ধান্দা ৷ এন আর সির খসড়ায় সাফল্য খুঁজে এরা আহ্লাদে অষ্টাশিখানা হয়ে মিষ্টিমুখ করছে বিদেশিবিতাড়নের উল্লাসে অথচ নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষায় উদাসীন ৷ 'নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার' ৷

Friday, March 4, 2022

কবিতা অস্ত‍্যর্থক চেতনার মন্ত্র

কবিতা অস্ত‍্যর্থক চেতনার মন্ত্র



'মন রে কৃষিকাজ জানো না । এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা'– লোককবির অনুভব থেকে যে বার্তা এসেছে সেটাই সৃষ্টির প্রেরণা । কবিতা বা কাব্য অনুভূতি প্রতিটা মানুষের মননের গর্ভের অভ্যন্তরে নিহিত আছে । যে কোনো ধরনের শিল্প জীবন প্রবাহের মর্মমূলে যুক্ত থাকে তাকে নিরলস চর্চা এবং আয়াশ সাধ্য অভ‍্যাসের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি কে জাগিয়ে তুলতে হয় । এই যে মানবজমিন আবাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা মূলত মানবমনের গভীরে নিহিত সৃষ্টি পটভূমি । অনন্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেভাবে জমিকে ফসলের উপযোগী করে তোলা হয় ঠিক তেমনি মানুষের চিত্তভূমিকেও কর্ষণ ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীল করে তুলতে হয় । জীবন কর্ষণই হলো সৃষ্টির প্রয়াস । একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে কর্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তার সৃষ্টিকে মূর্তরূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হয় । এভাবে  সৃষ্ট শিল্প ও সাহিত্য যখন পাঠকের মনে রস ও আনন্দ সৃষ্টি করে তখনই সেই সৃষ্টি সার্থক হয়ে উঠেছে বলে মনে করা হয় । শিল্প প্রকাশেরও বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে । কবিতা তেমনি একটা মাধ্যম । একজন শিল্পী তার জীবন অভিজ্ঞতা কে আবহমান পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে শ্রম করে সেই শ্রমের ফসল হলো সাহিত্য । সাহিত্য রূপায়িত হয় অক্ষরের মাধ্যমে । অক্ষর শিল্প সাহিত্যের উপাদান । সাহিত্যের একটা ধারা কবিতা । স্বপ্ন ও কল্পনা, ধ‍্যান ও মননের জগত পরিশীলিত হয় যে প্রক্রিয়ায় তাকে প্রকাশ করার বিশেষ মাধ্যম হলো কবিতা ।

কবিতা বলি আর কথাসাহিত্যই বলি, দুই ক্ষেত্রেই সময়ের চিত্র এবং সেইসঙ্গে ব্যক্তিসত্তার ভেতরে বিভিন্ন পরিবর্তন, অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট অথবা ইঙ্গিতে প্রকাশিত হয় । যদিও একই সময় বৃত্তের মধ্যে থেকে দুই সৃষ্টিই হয় তবুও এই দুটি মাধ্যমের নির্মাণশৈলী একেবারেই আলাদা । কথাসাহিত‍্যে সহজ গদ‍্যে শব্দ ব‍্যবহারের মধ‍্য দিয়ে জীবনবর্ণনায় উঠে সে সময় ও মানুষ । এখানে কিছুটা তথ্য থাকে আর কিছুটা কল্পনা । আর কথাসাহিত্যের  ভাষা বহুবিস্তৃত হলেও সর্বজনবোধ‍্য হয়ে থাকে । কিন্তু কিন্তু কবিতার শব্দ ব্যবহার শব্দকে পেরিয়ে তার কথকতা ভাষা ও ইশারা এক গভীর বাচনের সৃষ্টি করে ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথামালার ভাবনাবলয় সৃষ্টি হয় কবিতায় । শব্দের ভেতরের নৈঃশব্দ‍্যকে ভাব-ভাষা ও ইশারায় প্রকাশ করেন কবি । তার সৃজনপ্রক্রিয়ায় শব্দের ভেতরে ও বাহিরে যে গভীর অর্থ থাকে, গভীর বোধ থাকে, ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত একটা সম্পর্ক থাকে সেটাকে প্রকাশ করেন কবি । কথাসাহিত‍্যে যেমন বাহ‍্যিক বহুমাতৃক ও বহুবিচিত্র গতি থাকে । কবিতা তেমন নয় । কবিতা তার অন্তর্মন্ডলের পরিসরে স্বনির্মিত পরিসরে চেতনার বিপুলবিশ্বকে উন্মোচিত করেন  । সুধীন্দ্রনাথ বলেছেন রেখার উপর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত গদ্য যে ছবি আঁকে গোটাকয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের জাদু সেই ছবিতে ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে । কাব্যের এই  মরমি ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীক এর সাহায্যে । শব্দ মাত্রেরই দুটো দিক আছে ; একটা তার অর্থের দিক,  অন্যটা তার রসপ্রতিপত্তির দিক । গদ‍্যের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক এই প্রথম দিকটার খাতিরে । গদ‍্যে শব্দগুলো চিন্তার আধার । কিন্তু কাব্য শব্দের শরণ নেয় ওই দ্বিতীয় গুণের লোভে;  কাব্যের শব্দ আবেগবাহী' । কবি এইশব্দ কে সাথে করে নিয়ে কাব্যের মরমী স্মৃতিতে পৌঁছার প্রয়াস নেন কিন্তু তাই বলে শব্দের অনুশাসন সর্বক্ষণ মেনে কবিতাকে নির্ধারিত শাসনে সর্বক্ষণ বেঁধে রাখার অভিলাসী হননা কবি । কবিতার পথে কবির সিদ্ধি আসে অবিরাম শব্দের উপত‍্যকায় নিরবচ্ছিন্ন শব্দের শোভাযাত্রায় ও তার সৃজনপথে রেখার পর রেখা এঁকে এগিয়ে যাওয়ার পদনিক্কনে । এই পর্যায়ে কবিতার স্তরের পর স্তরে চলে ধ্বনিবহুল শব্দের কারুকার্য । দৃশ্যের পর দৃশ্য যুক্ত হয়ে চিত্রময়তার নির্মান হয়, চিত্রের স্পর্শে ধ্বনিময় মাধুর্য সৃষ্টি করে । কবির বয়ান হল নৈশব্দের বয়ান ।

জীবনবীক্ষণেরর পরিশীলিত ফসল কবিতা । জীবনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তার বহুবর্ণিল বিচ্ছুরণকে গ্রহণ করা যে অপার আনন্দ, সেই আনন্দের মধ্যে গভীর প্রেরণাবোধের মহল নির্মাণ হয় । অনুভবে থেকে যায় আবিষ্কারের উৎসবিন্দু । নবীন প্রেরণা থেকে অপার বিস্ময়ের মনোভূমি জেগে ওঠে অদ্ভুত নান্দনিকতায় । মনোভূমির সৃজনক্ষেত্রে বিশ্লিষ্ট হয় বাগ্ বন্ধ থেকে শব্দ, শব্দ থেকে অক্ষর, অক্ষর থেকে ধ্বনি, শব্দের ধ্বনিতরঙ্গে চিত্রের বর্ণময়তায় বাক‍্যবন্ধ নিবিড় স্পর্শময় হয়ে ওঠে । ধ্বনি থেকে অনুভব । এই অনুভবকে প্রিয়সৃজন হিসেবে  কবির অন্তর গ্রহণ করে । ‌ এই গ্রহণে কবির অন্তরে জাগে অপত‍্যবোধ ।আপন কবিতা লালনের যে তৃপ্তি তা কবি ছাড়া অন‍্যের বোধগম‍্য নয় । কবি তাঁর কবিতায় আশ্চর্যসৌষ্ঠব আনেন । তাঁর কবিতার ভাববস্তু ও আঙ্গিক সংকেতপ্রবণ শব্দে সাজিয়ে তোলেন । তখনই কবিতা হয়ে ওঠে সংকেতের শিল্প  । জীবনগূঢ়তার সূচনাবিন্দু । সেই বিন্দু থেকে চেতনা বলয় প্রতিভাত হতে থাকে । জীবনকে মহৎজীবনে উৎক্রমণের প্রয়াস নিরলস চলতে থাকে কবির কলমে । নতুন নতুন শব্দের সন্নিবেশে নান্দনিক নির্মাণই কবির সাধমন্ডল । নতুন শৈলীতে, নতুন প্রকৌশলে ব‍্যতিক্রমী গ্রন্থনায় কবিতাকে পৌঁছে দিতে হয় পাঠকের প্রাঙ্গনে । নবীন উচ্চারণের মিলিত প্রয়াসে আশ্চর্য নবীন বার্তা পৌঁছে যায় উৎসুক পাঠকের দরবারে ।

কবিকে চিহ্নিত করে কবিতানির্মানে কবির শব্দপ্রীতি ও ব্যঞ্জনা । শব্দকে   কবিতায় ব‍্যবহারের সেই প্রকৌশলে  শব্দচয়নের নতুনত্ব থাকে কিংবা চেনা শব্দকে তিনি নূতনভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন । পাঠক আপ্লুত হন তাঁর শব্দ ব্যবহারে বা শব্দের ব্যঞ্জনায় । সেই শব্দে সৃষ্ট কবিতায় পাঠক কখনো উৎফুল্ল হন । কখনো বেদনা বোধ বা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হন । কখনো তার উত্তরণ ঘটে মৃত্যু চেতনায় । আমাদের পরিপার্শ্বের চেনা অঙ্গনকে অপরূপ রূপে পরিচিত করেন কবি । কবিতার শব্দ চয়নের এবং ব্যঞ্জনায় পাঠকের অন্তরে কবির শব্দবন্ধ স্বপ্ন সৃষ্টি করে । অথবা মায়াবী নদীর তীরে নীল জ্যোৎস্নায় নিয়ে যায় পাঠককে । এক মায়লোকের সন্ধান পান পাঠক ।
 পাঠকও কবিতার মধ্য দিয়ে কবির প্রতি যে একাত্মতার অভিন্নতা অনুভব সৃষ্টি হয়ে যায় সেখানেই কবির জন্য তৈরি হয়ে যায় চিরায়ত স্থান । কবি হৃদয় দিয়ে কবিতার সঙ্গে একাত্ম হন আবার  তাঁর শব্দশৈলীর  মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গেও কবিতার সম্পর্ক তৈরি করেন । স্বাভাবিকভাবেই কবিতা এখানে পাঠক এবং কবির মধ্যে নিবিড়  নৈকট‍্য এনে দেয় । হৃদয়সংবেদে পাঠকের বোধের ভূমিতে পৌঁছায় ।

অনেক ক্ষেত্রেই থাকে প্রশ্নমনস্কতা । কবিতার কথায়ও উঠে আসে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন । কবিতা কি জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা ? জীবন জিজ্ঞাসা ? নাকি জীবন দর্শন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কবিতার অর্থ পাঠকের কাছে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয় ।

 মানুষের জীবন ও প্রকৃতি একই সুরে বাঁধা থাকে । মানুষ ও প্রকৃতির মধ‍্যে কোনো বিভাজন নেই । তা একই মহাশক্তির দুই রূপ । কবির অন্তরের মানবচেতনা তার কবিতার অক্ষরে বিন‍্যস্ত হয়ে বিশ্ববোধ গড়ে তোলে । এই পৃথিবীর চিরপরিচিত মানবসমাজ, গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য, আকাশ, ছায়াপথ, নীহারিকা, গাছপালা, বৃষ্টি, ঝড়, নদী-প্রান্তর, পাহাড
পর্বত, জলপ্রপাত, চাঁদ, ফুল, জল,পশু-পাখি এমনকি ক্ষুদ্রতম ঘাসের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন এবং তার মধ্য দিয়েই কবি প্রকৃতির সান্নিধ‍্যে সৌন্দর্য,মাধুর্য,প্রশান্তি ও মুগ্ধতার বোধের অনুভব করেন । জগৎ, জীবন ও প্রকৃতির মিলিত উৎসার ঘটে বিশ্ববোধে । রবীন্দ্রনাথ এই মহাবিশ্বের মহাকালের এই অখন্ড সত্তার মধ‍্যে ডুব দিয়েছেন । কবির প্রধান প্রকরণ হল তাঁর সমৃদ্ধ মানসলোকের পরিক্রমণদক্ষতা । মানসপথ ধরে কবি তাঁর কল্পনার বিস্তার ঘটান । দৃশ্য জগৎ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জগত ,প্রত্যক্ষগোচর জগত এবং বস্তুজগৎকে এক করে দেন কল্পনা শক্তির মাধ্যমে পাঠকের কাছে । এই বিস্তৃতির পথেই আসে কবির সাফল‍্য । প্রাচীন কালিদাস কিংবা জয়দেব  মানসভ্রমণে সাফল‍্যের সূত্র ধরে যুগ যুগ ধরে পাঠকের আকর্ষণবিন্দু হয়ে আছেন । রবীন্দ্রনাথও একেই বলছেন মনোভূমি । 'কবি তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ‍্যা চেয়ে সত‍্য জেনো ' ।

কল্পনালোকের পটভূমিতে মানুষ কবিতার মধ্যেই খুঁজে পেতে চায় বিশ্বাসবোধ,  জীবন এবং জীবনযাপনের রসদ । কবিকেও । কবিতা সৌন্দর্যের প্রতীক, শান্তির উপকরণ হয়ে মানুষকে স্নিগ্ধতা দেয় । আজকের এই মূল্যবোধহীন জীবনযাপনেও কবিতা আবহমান মানবতার রূপে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবোধকে দূরে সরিয়ে মানুষের অতৃপ্ত অন্তরে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করে ।   কবিতার শরীর বেয়ে মাটির বুকে নেমে আসে । সময়ের প্রবলপ্রবহমানতায় ভ্রাম্যমাণ মানবতা এক যুগ থেকে অপর যুগে অখন্ড ঐক্যে উপনীত হয় । ভেতরের সুপ্ত কল্পনা স্বপ্নের বীজ হয়ে জেগে উঠে কবিতার মধ্যে । কল্পনা নতুনভাবে ব্যবহৃত হয় কবিতায় বাস্তবতার পটভূমি থেকে কতটা দূরে পৌঁছে কল্পনা নিয়ন্ত্রিত হয় তা কবির কারুকার্য এর মধ্যে উপলব্ধি করা যায় । কল্পনাভুবনেরর ভেতরে বেড়ে উঠতে  থাকে জীবনের আবহমান শুদ্ধবোধ । প্রকৃত কল্পনালোকের আলোর রেখা দর্শন পেলে মানুষ নিজের চলার পথকে সহজ করে নিতে পারে ।মানুষ নিজে তার ক্লীবকৈবল্যের প্রাচীর ভেঙে ক্রমশ সময়ের সুনাবিক হয়ে উঠতে পারে । কবি তাঁর কল্পনালোকের শক্তি দিয়ে উত্তরণ ঘটান জীবনের পরম পথে । কল্পনালোকের পথ ধরেই মৃত্যুকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হন কবি । একথা সত্য যে আজকের যুগ যত অগ্রসর হচ্ছে সমস‍্যাও ততই বাড়ছে । সাথে সাথে এও সত্য যে সমস্যা ও সংকট যত তীব্রতর হচ্ছে, কবিতার স্থায়িত্বও বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত । যার অন্তর্সূত্রে মানুষের বিশ্বাসও গভীর হচ্ছে কবির কাছে ।  সেই ভাবেই  উচ্চারিত হয় চেতনার অভিমন্ত্র । সে পথেই পাঠকের মননেও শ্রদ্ধায় নিত্য জাগরিত থাকেন কবি । তাঁর সৃষ্টির অচেনা ঝাঁপি অপরূপ আলোতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে । পাঠকের এখানেই কাঙ্ক্ষিত তৃপ্তি ।
জীবনকে উন্মোচন করে কবিতা ।

 জীবনকে দর্শনের পর্যায়ে নিয়ে যায় কবিতা । দর্শনচিন্তা কাব‍্যকে লাবণ‍্যময় করে তোলে । মানবসত্তার স্বরূপকে খোঁজার নিরন্তর প্রয়াস থাকে কবির ।মানবসত্তা দূরধিগম‍্য । অবিরাম সন্ধানপ্রয়াসের পরও তাকে জানা যায়না । ভাসমান হিমশৈলের মতো তার অধিকাংশই রয়ে যায় অজানা । এই দর্শনচিন্তা থেকেও নির্মান হয় কাব‍্যের শরীর । জীবনের যন্ত্রণার বেদনাবোধে ত্রস্ত হয় মানবিক সত্তা । জীবনের দ্বারপ্রান্ত থেকে মৃত্যুর শূন‍্যমন্ডল, হতাশা, নিত‍্য যন্ত্রণা,বিচ্ছিন্নতা, ক্ষয়, আত্মগ্লানি ও ক্লান্তির তিমির থেকে উঠে দৈবী পরিণতির কাছে আত্মসমর্পণ এবং  মানবিকতার পুনরুজ্জীবন মিলিয়ে বেঁচে থাকার পরম আর্তি একটি কবিতার বিষয় হয়ে উঠতে পারে । অনাদিকাল থেকে কবিদের কবিতায় উঠে আসে মৃত‍্যু আর জীবনান্তের বিপরীতে জীবনের উত্তাপ আর বিষাদের মাঝে লুক্কায়িত উজ্জ্বল আলোবিন্দু । স্পন্দমান জীবনকে অনুভব করার নন্দিত সৃজনই কবিতার উপজীব‍্য । কবি চিরকাল তাঁর ধ্বনিময় অলৌকিক স্বরলিপি নির্মানের মাঝে প্রতীক্ষা করে থাকেন ভোরের উজ্জ্বল আলোর জন‍্যে । জীবনের সৌন্দর্যের জন‍্যে । মৃত‍্যুত্তীর্ণ এক  জীবনবোধের জন‍্যে ।