Wednesday, December 25, 2024

বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদান : লোকশিক্ষার উপায়

বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদান : লোকশিক্ষার উপায়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
Abstract : Folklore is specially based on oral literature. It has a deep impact on society in various aspects.  It is commonly seen in any community and society that a tradition of folk culture is hereditarily practiced from the time in memorial. The main object of Bengali oral literature is to create an ideal life for human being. Various components of culture enriches the people mentally and philosophically. The folk tales, folk songs, proverbs, riddles,rhymes, folk dance, folk drama etc have plenty of component for folk teaching. Bengali folk literature in imbibes morality in humans to make their life with ethics and religious.  Apart from this, the paper will also stress on the element of Bengali folk culture which plays a vital role in building values and morality.

key word : lokojiban, lokosanskriti, lokoshiksha,
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ভূমিকা :

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক একটি জনসংগঠন বা জনগোষ্ঠী । প্রতিটি জনসংগঠন বা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু জীবন যাপন প্রণালী রয়েছেই । যাপনরীতি বা প্রণালী হল সংস্কৃতি । সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক । সমাজের মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই কিছু রীতিনীতির সৃষ্টি করেছে । পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে মানুষ সমাজে টিকে থাকার তাগিদ অনুভব করে । সেই তাগিদই নিয়ম নীতি নির্ধারণের প্রেরণা দেয় । এই নিয়মনীতির মধ্যে যে সমস্তগুলো দিয়ে মননের চর্চা করা হয় সেগুলোই হল সংস্কৃতি । নৃতত্ত্ববিদ হারসকোডিটস তাঁর Man and his works গ্রন্থের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন – 'A culture is a way of life of people' অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালী ।

লোকসমাজের সমষ্টিগত আত্মিক সংযোগ ও জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতি লোকসংস্কৃতি । লোকসংস্কৃতি বিষয়ের প্রবরপুরুষ উইলিয়াম ব্যাসকম ( W R Bascom ) এর ভাষায়–'folklore includes folk art, folk crafts, folk tools, for custumes, folk costoms, folk belief, folk medicine, folk recipes, folk music, folk games, folk gester and Folk speach as well as verbal art .'

লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য, শিল্পতত্ত্ব প্রভৃতি এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অন্বিত যে স্বতন্ত্র বিষয়রূপে লোকসংস্কৃতির শিক্ষাগত শৃঙ্খলা ও স্থাপন অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার । লোকসংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভূমিকা থাকে তাদের সমষ্টিগত জ্ঞানচর্চা ও মননচর্চার মাধ্যমেই লোকসংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধিত হয় । লোকসংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানানুশীলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্মোচন ঘটে । এই বহুমুখী তৎপরতার ফলে যে সমস্ত দিকগুলি লোকসংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় সেগুলি হল–অতীত অনুসন্ধান, আঙ্গিক সংস্থান, শৈল্পিক রসাস্বাদন, ব্যবহারিক উপযোগ, প্রসঙ্গানুষঙ্গগত অনুধাবন, ফলিত প্রয়োগ, ভবিষ্যৎ অনুশীলন এবং লোকশিক্ষা ।

'লোকসংস্কৃতি' শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই 'লোক' আর 'সংস্কৃতি' ।  'লোক' বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন । তারা যখন বংশপরম্পরায় একই রকম আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, একই রকম খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত, তাদের শিল্পসাহিত্য, সংগীত, লৌকিক দেবদেবী, লোকাভিনয়, একই জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিষ্ঠিত করে অর্থাৎ একই রকম রাজনৈতিক, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে জীবনধারা দোলায়িত হয় তখন সেই ঐতিহ্যনির্ভরসংহত গোষ্ঠী লোক বলে বিবেচিত হয় । আর এই সমস্ত মানুষদেরকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সংস্কৃতি আবর্তিত হয় তাকেই লোকসংস্কৃতি বলা হয় ।  লোকসংস্কৃতির স্রষ্টা সংহত ব্যক্তি মানুষ অথবা সমগ্র সমাজ । লোকসংস্কৃতি সমগ্র সমাজে আজও স্বীকৃত বলেই এর রেণুসমূহ সজীব, সচল ও প্রাণবন্ত বলেই অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের ত্রিবেনীস্পর্শ হয়ে অনন্তকাল বিস্তৃত ধারায় বয়ে চলেছে । রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন– প্রাচীন হয়েও চির নতুন ।

লোকসংস্কৃতির উপাদান :

লোকসংস্কৃতি বা বিষয়কে অনুধাবনের জন্য তার উপাদান বৈচিত্র্যকে জানা প্রয়োজন । যে উপাদানগুলো লোকসংস্কৃতির পরিচয় গ্রহণ করে সেগুলোকে বলা হয় লোকসংস্কৃতির উপাদান । লোকসংস্কৃতিবিদগণ তাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং নানাভাবে বর্গীকরণও করেছেন । এক্ষেত্রে মার্কিন লোকসংস্কৃতির আর এম ডরসন ( R M Dorson ) বিশেষ অবদান রেখেছেন । তিনি লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবনের অধ্যয়নের জন্য এ বিষয়কে চারটি বর্গে বিভক্ত করেছেন । বর্গগুলো হল– যথাক্রমে ১. মৌখিক সাহিত্য ২. বস্তুগত সংস্কৃতি ৩. সামাজিক লৌকিক প্রথা এবং ৪. লোকঅভিকরণ শিল্প । এই বর্গ বিভাজনটি লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । প্রসঙ্গক্রমে বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদানবৈচিত্র্য সম্পর্কে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিচে আলোচনা করা হচ্ছে ।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লোকবিজ্ঞানের প্রধান বারটি শাখার উল্লেখ করেছেন ।  ১. গাথা ২.উপকথা ৩. ছড়া ৪.পল্লীগান ৫. প্রবাদ ৬. হেঁয়ালি ৭. পুরান কথা ৮. লোকাচার ৯.লোকসংস্কার ১০. খেলাধুলা ১১. খাওয়া-দাওয়া ১২. হস্তশিল্প ।

প্রবীণ লোকসংস্কৃতিবি ড. দুলাল চৌধুরী বাংলা লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির উপাদান সংক্রান্ত আলোচনায় লোকসংস্কৃতিকে ২৪টি ভাগে ভাগ করেছেন:- ১. ছড়া ২.গীত/গান ৩. ধাঁধা ৪. প্রবাদ প্রবচন ৫. কথা–রূপকথা, উপকথা, ইতিহাসকথা, ব্রতকথা, ৬. গীতিকা/গাথা ৭. লোকনৃত্য ৮. লোকউৎসব-অনুষ্ঠান মেলা ৯. আচার, মন্ত্র-তন্ত্র ১০. লৌকিক দেবদেবী ১১. লোকনাট্য ১২. লোকশিল্প ১৩. লোকভাষা ১৪. লোকাচার ১৫. লোকবিশ্বাস-সংস্কার ১৬. লোকদর্শন ১৭. লোকক্রীড়া ১৮. লোকঔষধ ১৯. কিংবদন্তি ২০. লোকবাদ্য ২১. লোকচিত্র ২২. লোকঅলংকার সজ্জা ২৩. লোকযান ও ২৪.লোকঐতিহ্য ।

আবার ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর 'লোক সাহিত্য' শীর্ষক গ্রন্থে মূলত লোকসংস্কৃতির ১৩ টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন–১. ধাঁধা ২. ছড়া ৩. মন্ত্র ৪. খেলাধুলা ৫. লোককথা ও লোককাহিনি  ৬. লোকপুরাণ ৭. কিংবদন্তি ৮. প্রবাদ ৯.গীতিকা/গাথা, ১০.গীতি ও গান ১১.লোকঔষধ ১২.উৎসব ও অনুষ্ঠান ১৩. বিবাহ উৎসব, ঈদ উৎসব, দুর্গোৎসব ।

লোকশিক্ষা :

অরণ্যবাসী এবং গুহাবাসী মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেছে এবং অন্যদিকে বন্য হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গেও যুদ্ধ করে তাকে টিঁকে থাকতে হয়েছে । ক্রমাগত সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ সমাজবদ্ধতা ও আন্তরিক জৈবিক মানবিক সম্পর্কের খোঁজ পেয়েছে । এভাবে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে শিষ্টাচার, সংঘবদ্ধতা ও শৃঙ্খলার পাঠ গ্রহণ করেছে । এছাড়া তার জীবনযাপনের জন্য প্রকৃতির বিভিন্ন গতিপ্রকৃতিকে সে লক্ষ্য রেখেছে এবং তার দ্বারা সে ঋতুপরিক্রমার পরিচয় জানতে পেরেছে । এটা তার কৃষিজীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে । মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । সমাজে বসবাস করতে করতে মানুষ তার যাপনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে । এই শিক্ষা আবার দুই প্রকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । লোকজীবন অতিবাহিত করার ফাঁকে ফাঁকে লোকসমাজের মানুষের মনে যে সংস্কৃতির প্রবণতা বা চাহিদা তৈরি হয় তা সে নিবৃত্তি করতে পারে লোকশিক্ষার মাধ্যমে । লোকশিক্ষার মধ্যেও আমরা দুটি শব্দ পাই 'লোক' এবং 'শিক্ষা' । 'লোক' মানে সাধারণ মানুষ । 'শিক্ষা' শব্দের অর্থ জ্ঞান অর্জন, শাসন, নির্দেশনা বা নিয়ন্ত্রণ । পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে মানুষ প্রকৃতির এবং পারিপার্শ্বিকতার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম শিক্ষা লাভ করে থাকে সেটাই লোকশিক্ষা । প্রতিদিনের যাপনের পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই লোকসমাজ এই শিক্ষা লাভ করে থাকে । এই শিক্ষা মানুষকে তার মনের দিক থেকে ভাবের দিক থেকে এবং আবেগের দিক থেকে সবল ও সক্ষম করে গড়ে তোলে । লোকশিক্ষা মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে অর্জন করে থাকে । প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ শিক্ষাই হল লোকশিক্ষা । লোকের শিক্ষা লোকের জন্য শিক্ষা এবং লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষা ।

লোকশিক্ষার উপাদান :

সমগ্র শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় কয়েকটি মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করেই চলমান থাকে । তেমনি লোকশিক্ষার উপাদানক্ষেত্র বলতেও তেমনি কিছু চলমান উপাদানের ক্রিয়াশীল সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে । লোকশিক্ষার যদিও কোন সংঘটিত মাধ্যম নেই তবুও তার মধ্যে কিছু উপাদান লক্ষণীয়ভাবে ধরা পড়ে সেগুলো হল ১. শিক্ষার্থী : গ্রামের চাষী শ্রমিক আমার কুমোর ও লোকসমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন ২. শিক্ষক : লোকগায়ক, কথক ঠাকুর, যাত্রাপালা পটুয়া, বাউল প্রকৃতির শিল্পীসমাজ ৩. বিদ্যালয় : খেলার মাঠ, চন্ডীমন্ডপ, বৈঠকখানা, গাছতলা প্রভৃতি স্থান ৪. পাঠ্যক্রম : লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগ । যেমন লোককাহিনি, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, রূপকথা ডাক ও খনার বচন, গীতিকা, লোকসংগীত লোকনৃত্য, লোকশিল্প, লোকচিকিৎসা, লোকনাটক এবং লোকগণিত ইত্যাদি ।

লোকসংস্কৃতির উপাদান ও লোকশিক্ষা

লোকসংস্কৃতির জন্ম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে, চিন্তা এবং কর্মে । হাজার বছর ধরে এই সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । লোকসংস্কৃতির উপাদানসমূহকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । ১. বস্তুগত সংস্কৃতি ও ২. অবস্তুগত সংস্কৃতি । লোকসংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান বলতে সেই সমস্ত উপাদানকে বুঝায় যেগুলোকে স্পর্শ করা যায় ও চোখে দেখা যায় । আর অবস্তুগত সংস্কৃতি হল, যেগুলো আমরা অনুভব করি । চোখে দেখতে পাই না । মানুষের চিন্তা থেকে এইসব সংস্কৃতির জন্ম নেয় এবং মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে । বস্তুগত সংস্কৃতির তিনটি বিভাগ–লোকশিল্প, লোকপ্রযুক্তি ও লোকযান । বাংলা লোকশিল্পের মধ্যে পড়ে তাঁতশিল্প, শাঁখা বা শঙ্খশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেতশিল্প, দারুশিল্প, গৃহনির্মাণ শিল্প, নকশী কাঁথা, পিঠে পুলি ইত্যাদি । লোকপ্রযুক্তি হল লাঙ্গল জোয়াল,কাস্তে, মই ও বিভিন্ন কৃষিকাজের উপযোগী সরঞ্জাম, জাল, ঢেঁকি, চরকা ইত্যাদি । লোকযানসমূহ হলো নৌকা, পালকি, চাঙ্গাড়ি ইত্যাদি । লোকজীবনের প্রয়োজনীয় এইসব শিল্প দ্রব্যাদি নির্মাণের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় না । মানুষজন কাজ করতে করতেই এগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠে এই দক্ষতা প্রজন্মান্তরেও বাহিত হয়ে থাকে । কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষ কোনো লোকউপাদান  উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ পেশাজীবী লোকজন সমাজে থাকেন যেমন কামার, কুমোর,ছুতোর ইত্যাদি । এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মননের উৎকর্ষতাও ঘটে । যার ফলে সৃষ্ট লোকউপাদান দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে । 

লোকসংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদানের পরিসরটি বিশাল । এখানে রয়েছে লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য, লোকসংগীত, লোকউৎসব, লোককাহিনি, লোকক্রীড়া, লোকচিকিৎসা, লোকনাটক ও লোকগণিত ইত্যাদি । আগেই বলা হয়েছে বস্তুগত উপাদানগুলি মূলত মননচর্চার ফসল । মানুষের মনের অন্তর্নিহিত চেতনার অভিব্যক্তি প্রকাশ ঘটে এই অবস্তুগত লোকসংস্কৃতিক অবদান সমূহের মধ্যে । ফলে তার মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষেরা নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের বিকাশ, আচার-আচরণের শিক্ষা, সর্বোপরি জীবনযাপনের উপযোগী নানা তথ্যের সন্ধান পেয়ে থাকে ।

লোকসাহিত্যের প্রধান উপাদান হলো লোককথা ছোট ছোট লোককথার মধ্য দিয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে নীতিমূলক নির্দেশিকা পাওয়া যায় । যেমন 'দশের লাঠি একের বোঝা' । এই গল্পটির মধ্য দিয়ে এক বৃদ্ধ তার মৃত্যুকালে সন্তানদের মধ্যে একতাবোধের বার্তাটি দিয়ে যান । বৃদ্ধ যখন তার সন্তানদের হাতে একটি কঞ্চি দিয়ে ভাঙ্গার নির্দেশ দেন তখন তারা সহজেই এই কঞ্চিগুলি ভেঙে ফেলে । আবার তিনি যখন সেই কঞ্চিগুলিকে একত্র করে আঁটি বেঁধে একে একে প্রত্যেককে ভাঙার জন্য দেন তখন তারা কেউই এই আঁটিবদ্ধ কঞ্চিগুলি ভাঙতে সক্ষম হয় না । এর দ্বারা তাদের কাছে বার্তা যায় যে, তারা যদি নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদে মত্ত থাকে তাহলে অন্যেরা এসে তার সুযোগ নেবে । অপরদিকে যদি তারা একতাবদ্ধ থাকে তাহলে কেউ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না বা বিরোধে জড়াতে পারবে না । লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে এরকম বহু লোক কথা ছড়িয়ে রয়েছে যার দ্বারা মানুষ সমাজ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে । 

লোকনৃত্যের মধ্যেও লোকশিক্ষার বিষয় নিহিত রয়েছে । বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে লোকনৃত্যের পরিবেশন করা হয় । তার মধ্য দিয়ে লোকসাধারণ আধ্যাত্মিকতা ও পার্থিব ভাবনার পাঠ গ্রহণ করে থাকে ।

লোকসংগীতেও রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ । যেমন, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, মুর্শিদি, জারি, সারি ইত্যাদি । এইসব সংগীতের কিছু কিছুতে যেমন বিনোদনের সম্ভার রয়েছে তেমনি সমাজ ভাবনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার বাস্তব পাওয়া যায় । যেমন বাউল গানে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা পাওয়া যায় । সাম্প্রদায়িক ঐক্য স্থাপনার ক্ষেত্রে লোকসংগীত এটা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে । লালনের গানে আমরা যেমন পাই– 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে / লালন বলে যেতে কি রূপ দেখলাম না এই নজরে । তেমনি কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির কন্ঠে শুনতে পাই– কৃষ্টে আর খ্রিস্টে কিছুই ভেদ নাই রে ভাই / শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে'
আবার অন্য গানে পাই 'টাকা পয়সা সোনার গয়না / মরলে কারো সঙ্গে যায় না ।' কিংবা 'রইল রে তোর সাধের ঘরবাড়ি....' ইত্যাদি জীবনবোধের পরিচায়ক বার্তাবাহী সংগীত ।

লোকসাহিত্যের একটি শক্তিমান ধারা হল প্রবাদ । প্রবাদ মূলত জীবনঅভিজ্ঞতার নির্যাস l প্রবাদের মাধ্যমে লোকচরিত্রসহ বিভিন্ন বিষয় খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা হয় এবং প্রবাদোক্ত বাক্য থেকেই লোকমানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন । যেমন প্রবাদে পাই– 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম' । এখানে বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রামের বার্তাটি নিহিত রয়েছে । আবার দেখি দৈবের উপর ছেড়ে দিয়ে বলতে 'অদৃষ্টের ফল কে খন্ডাবে বল' বা 'অদৃষ্টের কিল পুতেও কিলায়' এর মধ্য দিয়ে জীবনের বাস্তব চিত্র ও অভিজ্ঞতাই প্রকাশ পায় । রূপকথার গল্পে প্রকাশ পায় কঠোর নিষ্ঠা ও অসম সাহসিকতার চিত্র । সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ক্ষীর সরোবরের মাঝখান থেকে এক নিঃশ্বাসে মন্দিরের চূড়া ভেঙে রাক্ষসের প্রাণভোমরা নিয়ে আসা সত্যিই কষ্টের কথা । জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও এজাতীয় কষ্ট স্বীকার করতেই হয় । রূপকথার গল্পের অভ্যন্তরে সেই শিক্ষনীয় বার্তাটি লিখিত থাকে ।

ডাক ও খনার বচন হল জ্ঞানীদের বচন । কবিতার ভাষায় লেখা এই বচনগুলোতে পুরনো বাংলা ইতিহাসের উপাদান, কৃষি নির্ভর সমাজের চিত্র তুলে ধরে । আবহাওয়া, খরা, বৃষ্টি, শস্যের খবর এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় । খনার বচনে কৃষি সম্পর্কে জানা যায়–'একহাত অন্তর দুহাত খাই / কলা রোও চাষি ভাই / যদি না কাটো পাত / তাতেই কাপড় তাতেই ভাত' । প্রকৃতির রুদ্ররোষের লক্ষণ ধরা পড়ে খনার একটি বচনে–'ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোনো পতির পিতা / ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা / রাজ্য নাশ গো নাশ হয় অগাধ বান / হাতে কাঠা ফেরে কিনতে না পায় ধান' । ফসল বোনার ক্ষণ হিসাবে খনার বচনে পাওয়া যায়–'শুক্লপক্ষে ফসল বোনে / ছালায় ছালায় টাকা গোনে' । ইত্যাদি ।

বাংলা ধাঁধার মধ্যে রয়েছে লোকশিক্ষার বার্তা । পারিবারিক জীবনে বা গার্হস্থ্য জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন বা আকর্ষণ হল মা । তাইতো মায়ের স্থান সংসারের সবার উপরে । গ্রাম্য ধাঁধায় পাওয়া যায়–'এক অক্ষরে আকার দিয়া / নাম তার লিখো গিয়া / সেই নাম সংসারে / বড়ো সবার উপরে' । ঠিক যেমনটি প্রবাদেও পাওয়া যায় 'মুড়ি বল চিড়ে বলো / ভাতের সমান নয় / মাসী বলো পিসি বলো / মায়ের সমান নয়' । মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি নিয়ে যে বাঙালির সুখের সংসার এই পারিবারিক জীবনের শিক্ষাটি এখানেই পাওয়া যায় ।

লোকসংস্কৃতির আরেকটি শাখা হল লোকগণিত । বাংলার প্রাচীন কাব্যে এমন প্রচুর লোকগণিতের সন্ধান পাওয়া যায় । বিশেষত কাব্যগ্রন্থগুলোতে কবি যখন আত্মপরিচয় দেন তার সময়কাল বা জন্মসন ইত্যাদি ছদ্ম লোকগণিতের মাধ্যমে প্রকাশ করেন । বাঙালি সমাজজীবনে মহিলাদের মধ্যে একটা প্রচলিত লোকনিষেধ রয়েছে যে, তাঁরা স্বামীর নাম উচ্চারণ করেন না । সেই ক্ষেত্রে অনেক সময় হেঁয়ালিপূর্ণ লোকগাণিতিক শব্দে তাঁরা স্বামীর পরিচয় দিয়ে থাকেন । এমন একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি–'তিন তেরো মধ্যে বারো / চার দিয়ে পূরণ করো / আমার বাড়ি নন্দীগ্রাম / আমার স্বামীর এই নাম' ।( ৩×১৩=৩৯+১২=৫১+৪=৫৫ —পঞ্চানন–শিবের অপর নাম )
এ রকম আরেকটি লোকগণিতে পাই–'অংক মুনি বলে গেছে শঙ্খ মুনির কথা / আশিহাজার তেঁতুল গাছে কত হাজার পাতা' ? ( ৮০,০০০×২=১,৬০,০০০—অঙ্কুরোদ্গমের সময় তেঁতুলগাছে দুটি পাতা থাকে ) । এছাড়া মেয়েলি ব্রতকথাগুলোর মধ্যেও সামাজিক অনুশাসনের নানা শিক্ষামূলক বার্তা থাকে । ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা সাধারণ মানুষকে নীতিশিক্ষা ও ধর্মীয় উপদেশ দেওয়ার জন্যেও অনেক সময় ছোটো ছোটো গল্পের অবতারণা করেন । তাঁরাও প্রকৃত অর্থে লোকশিক্ষক । গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের একজন শ্রেষ্ঠ লোকশিক্ষক হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব । ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নবজাগরণের কালে বাঁধাধরা শিক্ষার বাইরে অপ্রথাগত পদ্ধতিতে ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে তিনি লোকশিক্ষা দিয়েছিলেন ।

মূল্যায়ন

লোকসংস্কৃতির উপাদানের দ্বারা সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবন গঠনের ও বুদ্ধিবিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব । লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানগুলি ব্যক্তির নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক । পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সম্প্রীতিবোধের চেতনাও সঞ্চার করা সম্ভব । লোকসাধারণের নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কারসহ একটা নিজস্ব জীবনদর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা যে অসীম তা আমরা এই আলোচনার মধ্য দিয়ে অনুভব করতে পারি । বর্তমানে যেভাবে কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাটা বিবর্তিত হচ্ছে তাতে আমাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে যে শিক্ষার বার্তাগুলো রয়েছে তা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে । ফলে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের একটা সংকট তৈরি হচ্ছে । সেগুলোকে দূর করতে হলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতির উপাদানের পুনরুদ্ধার এবং পাঠ্যসূচিতে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেই হচ্ছে ।

আপনি

আপনি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আপনি কি রঙের জামা পরেন তা কেউ দেখে না ।
তাই কেউ বলেন আপনি সাদা জামা, 
আপনি নীল জামা অথবা‌লাল জামা ।
আপনার রঙ নিয়ে হয় চুলচেরা গবেষণা 

 বিপননশিল্পেও নেই । আপনি জমি কেনাবেচায় কাটমানি খান না । গোপনে জায়গামতো ত্রাণ বিলি করেন না ।
আপনি চলেন আপনখেয়ালে ।

আপনি মশাই বনেদি ক্লাবের মেম্বার হতে পারলেন না । আপনি অযোগ্য । আপনি সখের বোটের সেই বাবুমশাই ।

আপনার মোবাইল নম্বর সবাই জানে । ঠেকলেই ফোন করে আপনার কুশল জানবে । ইনিয়ে বিনিয়ে কাজ গুছিয়ে নেবে ।

কাজ ফুরোলেই পাজি আপনাকে কুৎসার মালায় সাজাবে ।
আপনি বড্ডো হ্যাংলা মশাই, কিসস্যু বোঝেন না ।

আপনার কবিতা, পড়াশুনো সব পন্ডশ্রম ।
এগুলো আপনার চারপাশে যারা আছে তাদের ঈর্ষামত্ত করে । 
ওরা পরের জা'গা পরের জমিনে বসত করে
আপনাকে বাস্তুহারা করার পায়তাড়া কষে ।

চারদিক থেকে ঢিল, উড়োচিঠি, গণবিরোধ এলেও
আপনি শীতলপাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে বসন্তের জোছনা দেখেন ।
আপনি বড্ডো বেহায়া তো ! আপনাকে
 কে বলেছে সমাজে থাকতে !

আপনার বুকে এত আবেগ এত কান্না
 আর এত উদাসীনতা কেন হে !
আপনি তো আমাদের হিসেবে একেবারে অনুপযুক্ত, মশাই ।

Wednesday, December 4, 2024

রাজনৈতিক অস্থিরতা : বাংলাকবিতায় ভিন্ন স্বরায়ন

রাজনৈতিক অস্থিরতা : বাংলা কবিতায় ভিন্নতর স্বরায়ণ

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কবিতা মানুষের আবেগ অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে । তাই সাহিত্যক্ষেত্রে কবিতার বহুমুখী প্রভাব থাকে । মানুষের জীবনযাপন নানাঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় । তেমনি কবিতাও মানবমনের পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়াকে প্রস্ফুটিত করে তোলে । বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট নানারকম রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে মানুষকে এগোতে হয় । ইতিহাসের এটাই বিধান । অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানব হৃদয়ের গভীরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় । কখনো বা হাহাকার ধ্বনিত হয় । মানবের গহন হৃদয়ের আর্তনাদের শৈল্পিক প্রকাশ ঘটে কবিতায় । বাংলা কবিতার ধারার মধ্যে এই চাঞ্চল্যের লক্ষণ বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে । তা কখনো উচ্চকিত ও কখনো নিচুস্বরে । প্রেম-প্রকৃতি-ঐশ্বর্য-আধ্যাত্মিকতা-বিদ্রোহ ইত্যাদি প্রকাশের উজ্জ্বল হাতিয়ার কবিতা । বিষয়বৈচিত্র্যের অভিনবত্বের মধ্যে প্রকট হয় বাংলাকবিতার নানা স্বর । জীবনরসের বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণের ফলেই সৃষ্টি হয় বহুবিধ স্বরের । আধুনিক জীবন রাজনৈতিক আবর্তে চালিত হয় ।তাই সময় সময়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাকাব্যক্ষেত্রেও নতুন স্বরায়ন ঘটে । রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই স্বরায়নের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় কবিতার এক একটি পর্যায়ের । সৃষ্টি হয় এক একটি আন্দোলনের ধারার । সেই ধারা বাংলাকাব্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য শাক্তপদাবলী ও আধুনিক গীতি কবিতা, গদ্য কবিতা এবং সমকালের উত্তরাধুনিক কবিতার পর্যায় পর্যন্ত সমানভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে ।

বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এদেশকে বহু সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে । নদীমাতৃক বঙ্গভূমির উর্বর পলিমাটিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয় । যার ফলে এই জনপদের মানুষজন সুখে সম্ভোগে জীবন যাপন করতে পারতেন । কিন্তু বাংলাদেশের অফুরন্ত শস্যভান্ডার ও প্রাকৃতিক সম্পদ এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনে আঘাত হয়ে নেমে এসেছে বারবার । 'অপনা মাসে হরিণা বৈরী'র মতো এদেশের সম্পদের লোভে বারবার বিদেশি অত্যাচারীরা এদেশকে আক্রমণ করেছে । বহিঃশত্রুর সঙ্গে লড়াই করে প্রতিরোধ করার মত ক্ষমতা এদেশের মানুষের একসময় ছিল না । ফলে ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে বাঙালির পরাজয়ই ভবিতব্য ছিল । সে সময়ে বাঙালিজাতির মধ্যে জাতীয় চেতনার অভাবের কারণেই বিদেশী শত্রুরা অনায়াসে এ দেশ আক্রমণ ও অধিকার করতে পেরেছিল ।

বাংলাদেশের মানুষের সহজ সরল জীবনযাত্রা, ভাবপ্রবণতা ও কল্পনা প্রিয়তার কারণে তাদের সৃষ্ট সাহিত্যে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাপ তেমন পড়েনি । বাঙালির কাব্যের আদি নিদর্শন 'চর্যাপদে' সমাজের দুঃখ দুর্দশার চিত্র ডাকাতদল সহ নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার চিত্র পাওয়া যায় । 
কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ও কোন যোগাযোগ তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না । তাঁছাড়া তাদের জীবনের অসঙ্গতিগুলোকে তাঁরা দৈবের হাতেই ছেড়ে দিতেন । কোনরকম প্রতিবাদমুখরতা এই সময়ের সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায় না  সেইসময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ জানতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয় । কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থাকে । সেসময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছিলেন তারা মূলত ছিলেন বিজয়ী শাসকদলের প্রতিনিধি । বিজিত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন । ফলে তার মধ্য থেকে বাঙালির রাজনৈতিক জীবনের সঠিক চিত্র প্রকাশিত হয় না । স্বাভাবিক কারণেই সে সময়ে বাঙালি মননে প্রতিবাদী চেতনার উপস্থিতি থাকলেও তা সেই সব ইতিহাসকারগণ চেপে গিয়েছেন । বরং তাঁদের লেখায় বাঙালিচেতনা দুর্বল, অসত্য ও পলায়নপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে । ইতিহাসের শুরুর দিকে বাঙালির পরাজয়ের প্রসঙ্গটি অধিক মাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে । আত্মরক্ষা ও স্বদেশরক্ষায় বাঙালি চরিত্রের দুর্বলতার কথা মুখ্যরূপে প্রকাশ করা হয়েছে ।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাসাহিত্যের কোনো প্রামাণ্য নিদর্শন না থাকায় ও তুর্কিবিজয় ও পাশাপাশি সময়ে সৃষ্ট ধ্বংসলীলাকে লক্ষ্য রেখে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত একটা সময়কে বাংলাসাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে । ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সেনবংশের শাসক বৃদ্ধ লক্ষণ সেনের রাজধানী নদিয়া বিনা বাধায় জয় করে এদেশে মুসলমান রাজত্বের সূত্রপাত করেন । এখানে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের ঘটনাটি সত্য । কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি বা শাসকের যে গালগল্প সৃষ্টি করা হয়েছিল তা সর্বতোভাবেই বানানো । এইসময়ে বাংলাভাষায় রচিত সাহিত্যের নিদর্শন না পাওয়া গেলেও অন্যান্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় । প্রাকৃত ভাষায় রচিত গীতিকবিতা 'প্রাকৃতপৈঙ্গল' এইসময়ের রচনা । রামায়ণ পণ্ডিতের 'শূন্যপুরাণ', ডাক ও খনার বচন, হলায়ুধ মিশ্রের সেক শুভোদয়া এবং বেশ কিছু সঙ্গীত এই সময়ে সৃষ্টি হয় । রামাই পন্ডিতের শূন্যপুরাণ ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ । গদ্যপদ্যমিশ্রিত চম্পুকাব্য । এই কাব্য সেসময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কিছু চিত্র পাওয়া যায় । ব্রাহ্মণ্যশাসনের অবসান ও মুসলমান শাসনের প্রবর্তনের ফলে সৃষ্ট তৎকালীন সামাজিক চিত্র এখানে পাওয়া যায় । 'আপনি চন্ডিকা দেবী তিই হৈলা হায়া বিবি / পদ্মাবতী হৈলা বিবি নূর । / যথেক দেবতাগণে সবে হয়্যা এক মন / প্রবেশ করিল জাজপুর । / দেউল দেহরা ভাঙ্গে কাইড়া ফিড়া খায়ে রঙ্গে / পাখড় পাখড় বোলে বোল । / ধরিয়া ধর্মের পাএ / রামাই পন্ডিত গাএ / ঈই বড় বিষম গন্ডগোল ।।' এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় নবাগত মুসলমান শাসকদের অত্যাচার ও ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেকালের লৌকিক দেবদেবীদের গায়ে ইসলামের মোড়ক লাগানোর প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল । কারণ মুসলিম বিজয়ীগণ এ দেশ দখল করেই প্রথমে ধর্মের উপর আঘাত হানে। প্রজাসাধারণের উপর অত্যাচার, উৎপীড়ন, লুণ্ঠন, বিগ্রহ, মন্দির ধ্বংস করতে শুরু করে । ধর্মহানির সম্ভাবনা যখন প্রকট হয়ে ওঠে তখন সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁদের আরাধ্যা দেবদেবীকে মুসলিম নামের রূপান্তরিত করেন । ক্ষমতালোভী বিদেশী শাসকদের জিঘাংসা, রাজ্যলিপ্সা, যুদ্ধ, হত্যা ও ধ্বংসলীলার মাঝে পড়ে অসহায় মানুষ সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে না পারলেও গোপন কৌশল নিয়ে বাংলার ব্রাত্য দেবদেবী সমূহকে আঘাত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন । পাল ও সেন যুগে বাংলাদেশে বসবাসকারী অনার্যদের সঙ্গে ধর্ম, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ছিল । তারা স্বাধীনচেতা ও দুর্ধর্ষ হলেও একসময় আর্যদের কাছে নতিস্বীকার করেছিল । ফলে তাদের লোকধর্মের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু আর্যীকরণ ঘটেছিল । লৌকিক দেবদেবীরা আর্য দেবতায়  রূপান্তরিত হয়ে যায় । আবার মুসলমান আক্রমণের ফলে এই লোকায়ত দেবদেবীদের আরেক প্রস্থ পরিবর্তন ঘটে । রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র রচিত সংস্কৃত চম্পুকাব্য শেখ শুভোদয়া  ( ১২ শতকের শেষে বা ১৩ শতকের গোড়ার দিকে ) অধ্যাত্মমহিমা ও পিরের মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য । এখানেও তেমন কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না । শুধুমাত্র রোগ শোক ও প্রেতাত্মার  প্রভাব সংক্রান্ত কিছু লৌকিক সংস্কারের চিত্র পাওয়া যায় । বস্তুত লক্ষণ সেনের পতনের পরপরই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটিও চাপা পড়ে গিয়েছিল । সেসময়ের সাহিত্যের নিদর্শনে বাঙালিজাতির এই দুঃখজনক পরাজয়ের কোন ছাপ স্পষ্টত পড়েনি । অর্থাৎ বাঙালিজাতির যে আত্মবোধ বা জাতীয়তা বোধ তা তখনো এই জাতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেনি । জাতীয়তাবোধ থাকলেই তার মধ্যে স্বদেশচেতনার উপলব্ধি জাগ্রত হত ।

মধ্যযুগে বাংলাদেশ যখন বিদেশি শাসকের পুরোপুরি করায়ত্ত সেসময়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে আবির্ভাব ঘটে শ্রী চৈতন্যদেবের । মুসলমানদের অত্যাচারে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ যখন বিপন্ন ও বিনষ্ট হওয়ার অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়ে আবির্ভাব ঘটে চৈতন্যদেবের । তিনি বাংলাদেশে প্রেমের বার্তা ও ক্ষমার মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন । বিপন্ন বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য । ধর্মীয় চেতনার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে তিনি একটি বহুধা বিভক্ত জাতিকে একত্রিত করলেন । আপাত দৃষ্টিতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এর সংশ্রব না থাকলেও বাঙালির রাষ্ট্রীয়চেতনার একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় । এই ধর্মীয় জাগরণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের মধ্যে এক নতুন জীবনবোধ সৃষ্টির প্রয়াস তখন থেকেই শুরু হয় । এই নবচেতনার মধ্যে জাতীয়চেতনারও একটা অস্পষ্ট উপলব্ধি নিহিত ছিল । আমরা দেখি উনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয় চেতনাও এই ধর্মীয় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ।


চৈতন্যপরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে অনার্য বাঙালির শৌর্যের চিত্র ধরা পড়েছে । বন্য হিংস্র পশুকে পর্যদস্থ করবার, বধ করবার ক্ষেত্রে সুকৌশলী এই দুর্ধর্ষ জাতির কাহিনি পড়লে বিশ্বাস করতে প্রাণ চায় না যে, এরা অনায়াসে বিদেশির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে । এরা ভীতু । আসলে এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সমকালীন ইতিহাসলেখকরা বাঙালির এরকম দুর্বল চরিত্র চিত্রণ করেছেন ।

চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু চরিত্রটিতে তো এরকম কোন দুর্বলতার স্থান নেই । ধর্মমঙ্গল কাব্যে আধ্যাত্মিকতার প্রচার থাকলেও রাজনীতি এখানে প্রধান বিষয় । সপ্তদশ শতাব্দীর যুদ্ধদীর্ণ সময়ে ঘনরাম চক্রবর্তী সমাজের অন্ত্যজদের দেবতাকে নিয়ে এই কাহিনি রচনা করেন । আর এই ধর্মমঙ্গল কাব্যেই স্বদেশচেতনার আভাস দেখতে পাওয়া যায় । এই কাব্যের গৌড়যাত্রা পালায় রানি তার পুত্রকে গৌড়ে পাঠাবার সময় বলেছেন, 'পরাধীন পরান বিফল হেন গণি' । প্রাণপ্রিয় পুত্র যুদ্ধে চলে যাচ্ছে । তার বিচ্ছেদে তিনি শংকিতা । কিন্তু এত দুঃখের মধ্যেও পরাধীনতার বিড়ম্বনা ও তার ফলে পরান অর্থাৎ জীবন যে অর্থহীন তা তিনি অনুভব করতে পারছেন । এটা প্রকৃতপক্ষে স্বদেশানুভব । মঙ্গলকাব্যের যুগে একমাত্র ধর্মমঙ্গল এই রাষ্ট্রচেতনার প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায় । 

তারপর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগের রচিত ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বাঙালির শক্তি ও শৌর্যের পরিচয় পাওয়া যায় । দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের ফলে যে জাতি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে দেখা যায় সে জাতির প্রতিনিধি এক রাজপুরুষ তার সংগ্রামী চেতনা ও বৈভবের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন । ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের বর্ণনায়— 'যশোর নগর ধাম  / প্রতাপাদিত্য নাম / মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ । / নাহি মানে পাতসায় / কেহ নাহি আঁটে তায় / ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ ।।' প্রতাপাদিত্যের শৌর্য প্রসঙ্গে কবি আরো বলেছেন— 'বর পুত্র ভবানীর / প্রিয়তম পৃথিবীর / বায়ান্ন হাজার যার ঢালী । / ষোড়শ  হলকা হাতি / অজুত তরঙ্গ সাথী / যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী ।। তৎকালীন বাংলাদেশে প্রতাপাদিত্যের সমরশক্তি দেখে তদানীন্তন সম্রাটেরও টনক নড়ে গিয়েছিল । প্রতাপাদিত্যের পরেই সংগ্রামী মেজাজের ভূস্বামী হলেন সীতারাম রায় । সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামকে নিয়ে উপন্যাসও রচনা করেছেন । দেশপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসসমূহের চরিত্রের মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন । তার মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব 'আনন্দমঠ' । তাঁর অন্যান্য রচনায় স্বদেশ প্রীতি ও ইতিহাসানুরাগ যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার তুলনায় আনন্দময় একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি । আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র একটি যুগোপযোগী সশস্ত্র বিপ্লবের কথা চিত্রিত করেছেন । অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে এই উপন্যাসে শক্তিসাধনার একটি নতুন ধারা বাঙালি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন । মাতৃভাবনা এখানে স্বদেশভাবনায় রূপান্তরিত হয়েছে । এখানেই উদ্ধৃত হয়েছে মাতৃরূপা জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি । তাঁর বিখ্যাত বন্দেমাতরম কবিতা ও সংগীতে এই বন্দেমাতরম সংগীত গাইতে গাইতে ফাঁসির রজ্জুকে চুম্বন করে শহিদ হয়েছেন বাংলার বিপ্লবীরা ।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-রামায়ণ-মহাভারত-মঙ্গলকাব্য-বৈষ্ণব সাহিত্য-শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি কাব্যচর্চার মাধ্যমে বাঙালির প্রাচীন ও মধ্যযুগের যথেষ্ট মননশীল ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে । কিন্তু এই কাব্যসৃষ্টিতেও বাঙালির জাতিসত্তাকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস তেমনভাবে নেওয়া হয়নি । উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহিত্য ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ঘটতে শুরু করল । বাংলাকাব্যেও এই স্বদেশভাবনার উপস্থিতির প্রসঙ্গে একজন আলোচক উল্লেখ করেছেন— '১৮৩০ হইতে ১৮৯৬ পর্যন্ত এই পর্বের বাংলাকাব্যকে জাতীয় আন্দোলনের কাব্য বলা যাইতে পারে।  এ যুগের কাব্যের লক্ষ্য যে অনির্দেশ্য সৌন্দর্যালোক নয়, জাতীয় আদর্শ প্রচারের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করিয়া এ যুগের কাব্যের লক্ষ্যকে ভিন্নমুখী করা হইয়াছে । যে কাব্য লঘু পক্ষবিস্তার করিয়া শূন্যাভিমুখী হইবে সেই কাব্যের স্কন্ধে গুরু বস্তুভার ঝুলাইয়া দিয়া তাহাকে বাস্তব জগতের দিকে টানিয়া রাখা হইয়াছে । ( আধুনিক বাংলা কাব্যের ভূমিকা তারাপদ মুখোপাধ্যায় )  ।

এই সময়ের কবিদের মধ্যে স্বদেশভাবনার কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অগ্রগণ্য । তাঁর 'স্বদেশ' কবিতা দেশপ্রীতির বড়ো উদাহরণ । 'জানো নাকি জীব তুমি / জননী জনমভূমি / যে তোমারে হৃদয়ে রেখেছে / থাকিয়া মায়ের কোলে, / সন্তানের জননী ভোলে /কে কোথায় এমন দেখেছে ?/ মিঠা মণি মুক্তা হেম / স্বদেশের প্রিয় প্রেম / তার চেয়ে রত্ন নাই আর ।' দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি এখানে মাতৃভাষার প্রতিও গভীর মমত্ব প্রকাশ করা হয়েছে । 'বৃদ্ধি কর মাতৃভাষা / পুরাও তাহার আশা / দেশে কর বিদ্যাবিতরণ ।' পাশাপাশি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসঙ্গটি ও এখানে উল্লেখ্য । প্রসঙ্গত এই মাতৃভাষাপ্রেমই পরবর্তীকালে বাংলাভাষা আন্দোলন নাম নিয়ে বৃহত্তর রূপ নিয়েছিল । ঈশ্বর গুপ্ত বাঙালিজাতিকে দেশভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস নিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাবানুসারীদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয় । তাঁদের মধ্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় নবীনচন্দ্র সেন, তাঁদের কাব্য রচনার মাধ্যমে দেশপ্রেমকে বিকশিত করেছেন । রঙ্গলালের , ‌‌পদ্মিনী উপাখ্যান দেশপ্রেমের বক্তব্যে পুরোপুরি সময়োপযোগী কাব্য । বাংলা কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে রঙ্গলালের উত্তরসূরী হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যজীবনের স্থায়িত্বকাল অত্যন্ত অল্প । এই সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাকাব্যকে বেগবতী করে তোলেন । বাংলাকাব্যের ক্ষেত্রে তিনি নবযুগের প্রবর্তক । এক সৌরপ্রতিম শৌর্যের অধিকারী মধুসূদনের মাতৃভাষা ও সাহিত্যপ্রীতির পাশাপাশি অনন্য স্বদেশপ্রেম ও তাঁর কাব্যের উপযোগ্য বিষয় ছিল । দেশবন্দনা মাতৃভাষাপ্রেম এবং স্বজাতিপ্রীতি মধুসূদনের ভাবলোক ও কল্পনার জগতকে নিবিড়ভাবে বেষ্টন করেছিল । তার মেঘনাথদ বধ কাব্যে লঙ্কাবাসীর দেশাত্মবোধের মহিমা পরিস্ফুটিত হয়েছে । এই কাব্যে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রটি স্বদেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক । তাঁর চতুর্দশপদী কবিতা বলিতেও তিনি স্বদেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন । মধুসূদনের পর হেমচন্দ্র তাঁর কবিতাবলিতে বৃত্রসংহারে বীরবাহুতে বিশুদ্ধ দেশচেতনার ফল্গুধারা প্রবাহিত করেছেন । তাঁর ভারতসংগীতে জনজাগরণের উদাত্ত আহ্বান রয়েছে । 'বাজরে শিংগা বাজ এই রবে / শুনিয়া ভারতে জাগুক সবে / সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে / সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে / ভারত শুধুই ঘুমাইয়ে রবে ?/ ।  এই সময়ের আরেকজন কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর 'অবকাশরঞ্জিনি' প্রথম ভাগ ( ১৮৭১ ) এবং রঙ্গমতি ( ১৮৮০ ) কাব্যে তাঁর স্বদেশানুভূতির প্রকাশ করেন । তারপর পলাশীর যুদ্ধ তাঁর সার্থকতম রচনা । তাঁর 'রঙ্গমতি' কাব্যে স্বাধীনচেতা শিবাজীর মহৎ আদর্শকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন । 

কবিদের কবিতায় স্বদেশভাবনা ও অন্যদিকে রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালিমানসকে উন্মাদনা মুখর করে তুলেছিল । স্বদেশমন্ত্রে উজ্জীবিত জনগণের মধ্যে এক নতুন বেগের সঞ্চার হয় । জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকামী মানুষ সারা ভারতব্যাপী বজ্রহুংকার দিয়ে ওঠে । দেশের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের আওয়াজ ওঠে দিকে দিকে । রাজনৈতিক পারদ চড়ার সাথে সাথে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সরলা দেবী চৌধুরানী যে উঠলেন, 'গাহ হিন্দুস্তান / অতীত গৌরব বাহিনী মম বাণী / গাহ আজি হিন্দুস্থান ।' তার আগে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র, গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখগণ হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন । শিবাজী উৎসবকে জাতীয় উৎসবের পরিণত করা হয় । রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'শিবাজী উৎসব' কবিতা । প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর স্বদেশপ্রেমমূলক কাব্যচেতনাই যে পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছিল তা বোঝার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয় না ।

উনিশ শতকের শেষভাগে সারা দেশব্যাপী অসংখ্য গণআন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে । শাসক শ্রেণী ও বাংলা বিভাজনের চিন্তা করতে থাকে । ১৯০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে সে সময়ের লাট সাহেব লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ইঙ্গিত দেন । ফলে চারিদিক জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে ওঠে । ১৯০৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতার টাউন হলে সমগ্র বাংলার প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন । কিন্তু স্বৈরাচারী ইংরেজ প্রতিনিধি লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করে ফেলেন । ১৯০৫ সালের ৫ জুলাই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে । তার পাশাপাশি বাঙালি কবিরাও তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হন । এই সময় স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতার মাধ্যমে জনজাগরণ সৃষ্টি করেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস, সরলাবালা দেবীচৌধুরানী, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন প্রমুখগণ । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানের মাধ্যমে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন । 

এরই মধ্যে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সাধারণ জীবনে এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলে । জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় । পূর্বের গতিশীল পৃথিবীকে স্থবির করে ফেলে একদল স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবাজ । সমাজ অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই এক পালাবদলের সূচনা ঘটে । পুরানো মূল্যবোধগুলো গুরুত্ব হারাতে শুরু করে । অবিশ্বাস স্বার্থসংঘাত এবং নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিগুলো সমাজের বুকে প্রকট হয়ে ওঠে । প্রথম মহাযুদ্ধের সঙ্গে  বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের তেমন যোগাযোগ‌ না থাকলেও দেশের শাসক ইংরেজ থাকার ফলে তার প্রভাব এ দেশের উপর ভীষণভাবে পড়েছিল । এ সময় বিশ্বজুড়ে যে আতঙ্ক যুদ্ধোত্তর নৈরাজ্য, হতাশা, ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তার প্রভাবে পাশ্চাত্য কাব্যে এক নতুন বাঁকবদল ঘটে যায় । মহাযুদ্ধের চার বছর পর বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি টি এস এলিয়ট ( ১৮৮৮–১৯৬৫ ) রচনা করেন ' The Waste Land. ( ১৯২২ ) । প্রথম যুদ্ধের ফলে যে মানবিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল যে নিদারুণ হতাশা, কুৎসিত জীবনধারণের সমরোহ, ক্লেদাক্ত মানসিকতা নিয়ে অনুষ্ঠিত নৈরাশ্যের আবর্তে বন্দী হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এই সময়েই ইয়েটস লেখেন, What shall I do with this absurdity / O heart, O troubled heart–this caricature / the decreepit ahe that has tide to me.'

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্বময় যে অচলাবস্থায় সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর একাধিক কবিতায় ছত্রে ছত্রে তা ফুটে উঠেছে । তৃতীয় বিশ্বের কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বযুদ্ধকে যেভাবে দেখেছেন তা বলাকা ( ১৯১৬ ) কাব্যের ৪৫টি কবিতার অধিকাংশ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে । এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় তিনি লেখেন– 'এবার যে ওঈ এল সর্বনেশে গো / 'বেদনায় যে বান ডেকেছে, /  রোদনে যায় ভেসে গো / রক্তমেঘে ঝিলিক মারে, / বজ্র বাজে গহন পারে / কোন পাগলে বারে বারে /উঠছে অর্থ হেসে গো এবার যে ওই এলো সর্বনাশে গো । / জীবন এবার মাতল মরণ-বিহারে / এই বেলা নে মোর বরণ করে / সব দিয়ে তোর ইহারে / ।এই কাব্যগ্রন্থের 'ঝড়ের খেয়া' কবিতায় বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন– 'দূর হতে কি শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন / ওরে উদাসীন / ওই ক্রন্দনের কলরোল, লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল ।।' প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা সবচেয়ে আলোচিত কবিতা 'ঝড়ের খেয়া' । এখানেই তিনি বলেছেন 'এ আমার, এ তোমার পাপ' । এখানেই রয়েছে আশাবাদ 'শান্তি সত্য, শিব সত্য সত্য সেই চিরন্তন এক ।' তাঁর 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৬৪ সংখ্যক কবিতায়ও রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের কথা । 

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলা কবিতায় কল্লোল ( ১৯২৩ ) কালিকলম ( ১৯২৬ ) প্রগতি ( ১৯৮৭ ) পরিচয় ( ১৯৩১ ) প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল কবি বাংলা কবিতার পঠন পাঠন শ্রুতির ভূগোলে এক নতুন আন্দোলন সৃষ্টি করেন । এই পর্বে এলেন নজরুল । ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরার পরে দেশের মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন, অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নজরুল কলম হাতে নেন । ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'বিজলী' সাহিত্য পত্রে তাঁর অমর সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশিত হয় । দেশের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নজরুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সংগীত ও কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন । তাঁর 'কান্ডারী হুঁশিয়ার', 'সাম্যবাদী' ইত্যাদি কবিতা সেসময়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ইন্ধন যুগিয়ে ছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৪২ এর বিপ্লব, সবমিলিয়ে যখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল এসময় ভারতের রাজনৈতিক বাতাবরণ বহু তরঙ্গ আবর্তে সংক্ষুব্ধ। একদিকে ফ্যাসিষ্ট বিরোধী আন্দোলন ।কমিউনিস্ট ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ ।বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সুভাষচন্দ্রের অধিনায়কত্ব, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, খন্ডিত স্বাধীনতা উদ্বাস্তু স্রোত, তেভাগা আন্দোলন, গান্ধীজীর হত্যা, সর্বোপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর পরিণামে ( ১.৯.১৯৩৯– ২.৯.১৯৪৫ ) সমগ্র জাতি উদভ্রান্ত ও হতাশায় নিমজ্জিত । বাংলাকবিতায় চল্লিশের দশক মূলত ত্রিশের দশকের বাংলার জনমানসের রূপান্তরের অভিঘাত । এই সময়ে ভাবনার জগতেও বিস্তৃতি ঘটেছে । সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নবীন কবিকুল কবিতায় নতুন সুর আনলেন । কবি অরুণ মিত্র, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দীনেশ দাস, মনিন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সমর সেন কবিতায় এক নবীন স্বর আনলেন । এই সময় বাংলাদেশ ফ্যাসিষ্টবিরোধী লেখক সংঘ ( ১৯৪২ ) ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ( ১৯৪৪ ) প্রতিষ্ঠিত হয় । এক অশান্ত রাজনৈতিক আবর্তন এর মধ্যেই এগিয়ে এলেন আরও বেশ কয়েকজন কবি । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, রাম বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন, জগন্নাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গোলাম কুদ্দুস, অসীম রায়, চিত্ত ঘোষ কৃষ্ণ ধর প্রমুখরাই চল্লিশের কবি । এই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিশিষ্ট কবিতার পত্রিকাগুলো হল– কবিতা ( বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ১৯৩৫ ), জীবাণু ( সুশীল রায় সম্পাদিত মাসিক, ( ১৯০৬ ),নিরুক্ত ( প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১৯৪০ ), একক ( শুদ্ধসত্ব বসু সম্পাদিত, ১৯৪১ ), অঙ্গীকার ( শচীন ভট্টাচার্য ও পূর্ণেন্দু পত্রী সম্পাদিত, ( ১৯৪৯ ) প্রভৃতি । এই সময়ের কবিকুলের অগ্রজ  কবিরা বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখগণও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় সময়ের কথা, দুর্ভিক্ষের কথা, গ্রামবাংলার নিরন্ন নরনারী ও সবশেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন তাদের কবিতায় । সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'সংবর্তন'  ( ১৯৪৫ ) বিষ্ণু দের 'সন্দীপের চর' ( ১৯৪৭ ) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে সময়ের চিত্র বর্তমান । ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ও আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছ করেন শহীদ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় । ৮-২-১৯২৫–২১-১১-১৯৪৫ স্মরণে সাংবাদিক কবি অসীম রায় ( ৭-৩-১৯২৭ ৩৪১৯৮৬ ) লেখেন রক্তঝরা কবিতা । বাংলাকাব্যের নতুন ধারার স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ । ( ১৮৯৯-১৯৫৪ ) তাঁর '১৯৪৬-৪৭' কবিতায় সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাস ক্লান্ত কলকাতার চিত্র পাওয়া যায় । হিন্দু মুসলমানের ঐতিহ্যগত সম্প্রীতি বিলুপ্ত হতে দেখে জীবনানন্দ কবিতায় বেদনাক্লিষ্ট উচ্চারণ করেছেন ।
ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে আসে দেশের স্বাধীনতা । এক রাষ্ট্র ভেঙে তিন টুকরো হয় । ভাগ করা হয় দেশের সবচেয়ে সচেতন ভূমি বাংলা ও পাঞ্জাবকে । দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে । ফলে নতুন দেশে দলে দলে উদ্বাস্ত মানুষ নতুন ভূখণ্ডের খোঁজে নিজেদের পূর্বপুরুষের ভদ্রাসন ফেলে অনিশ্চিতের বুকে পাড়ি দেয় । এই চরম রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময় কবিরাও খুঁজে পান তাঁদের স্বতন্ত্র স্বর । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কবিতায় ইতিহাসের এক নির্মম সত্য তুলে ধরেন–'আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে, আমাদের নিজের দেশে, / নতুন দেশে, নতুন দেশের নতুন জিনিস- মানুষ নয়, জিনিস সে, / জিনিসের নাম কি ? নতুন জিনিসের নাম উদ্বাস্তু। ( উদ্বাস্ত ) । বিষ্ণুদে তাঁর 'জল দাও' কবিতায় লেখেন–'এখানে ওখানে দেখ দেশ ছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায় পার্কের ধারে / শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায় ভাবে ওরা কি যে ভাবে !ছেড়ে / খোঁজে দেশ এইখানে কেউ বরিশালে কেউ কেউ বা ঢাকায়.....( জল দাও ) । পরবর্তী সময়ের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায়ও দেশ বিভাগ প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে । 'কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের স্কুলে নিথর দিঘির পারে / বসে আছে বক আমি কি ভুলেছি সব স্মৃতি, তুমি এক প্রতারক ? আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি' ( যদি নির্বাসন দাও ) ।

দেশভাগের যন্ত্রণা ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় ও ছাপ রেখে গেছে । বরিষ্ঠ কবি পীযুষ রাউত তাঁর বাস্তভূমি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার সব হারানো স্মৃতিগুলোকে তুলে ধরেন তাঁর কবিতায় । 'দেশের বাড়ি সেই কুশিয়ারা নদী কিংবা শারদীয় কাশফুল / কিংবা সবুজের পটভূমি জুড়ে হলুদ সরষে ফুল / কিংবা নারকেল বোঝায় নৌকার মিছিল কিংবা / কলকাতার গন্ধ মাখা মালবাহী স্টিমার কিংবা পাঁচিল শাসিত / তিন বিঘা জমির উপর সুবিশাল বাড়ি কিংবা উত্তরকালে / দেশ বিভাগের পর টিলা ও সমতল সমন্বিত চাতলা ভ্যালি.... কিংবা 'আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য / চিরকাল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব যেমন দেশের বাড়িতে /নৌকার জন্য প্রতীক্ষমান মা ও আমি' আমি ও ছোট ভাই / নদীতীরে উদ্দাম হওয়ার মধ্যে আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য....( আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য ) ।এছাড়াও অনিল সরকার, মিহিরদেব, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, দিলীপ দাস, প্রমুখের কবিতায়ও দেশভাগের যন্ত্রণা বিধৃত হয়েছে ।

দেশভাগের যন্ত্রণা শুধু এপারের মানুষকেই আশাহত করেনি । ওপারের অর্থাৎ বাংলাভাগ হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষার কবিদের মনেও চাপ ফেলেছে । 'কুষ্ঠব্যাধি' কবিতায় কবি কায়েস আহমেদ উচ্চারণ করেন– 'তাই তো চন্দ্র মোহন ! রাইতের আন্ধারে / চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছাইড়া নদীর / জলে চক্ষের জল মিশাইয়া নির্বাসনে /যাইতে হয় । ভাইসা যায় গো নদীর / জলে প্রতিমা ভাইস্যা যায় । বড় দুঃখ চন্দ্রমোহন বড় কষ্ট ! তবু মাটির বড় মায়া । রাইত নাই / দিন নাই মাথার ভিতরে বুকের ভিতর / খালি পাড় ভাঙ্গে । নদী /খালি কল কল কল কইরা বইয়া যায় ।' রেডক্লিফের সীমানা বিভাজন মূলত বাঙালির বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে । দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতিতে বাঙালির বুকে যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণার মতো ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা বহুদিন বয়ে নিয়ে যেতে হবে এ জাতিকে । যার ফলশ্রুতিতে বাংলাকবিতায় জন্ম নেয় আরেক নতুন স্বরের । বহু স্বরের । দেশভাগ বাংলা কবিতার বয়নশিল্পে এমন ভাবে মিশে গেছে যে তার অস্তিত্বকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না বরং দেশভাগ ও বাংলা কবিতা সাহিত্যের স্বরূপে এমন এক চিহ্নায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে যা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয় ।

দেশ বিভাগের ফলে বাংলাদেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হয়েছে । ফলে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দু দেশের বাংলাভাষাভাষী জনগণকে ও বাংলাসাহিত্যকে । আর এইসব রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে দেশের কর্তৃত্ব যাদের হাতে থাকে তাদের দ্বারাই সৃষ্ট ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ফলে বাঙালি জাতি ও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে । পূর্ব পাকিস্তান নামে আলাদা ভূখণ্ডের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা প্রথমেই কোপের মুখে পড়ে তাদের ভাষা নিয়ে । সেখানে সরকারী তরফে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলা এতভাষাভাষী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ক্ষোভে গর্জে ওঠে । জন্ম নেয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন । ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্রমে জোরালো হয়ে ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলনের রূপ নেয় । ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সে দেশের মানুষ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালন করে । সেই আন্দোলনে শহীদ হন রফিক, শফিক বরকত সালাম, জব্বরসহ বহু নাম না জানা মানুষ । বাহান্নর একুশের আন্দোলন সে দেশের বাঙালিদের দেশপ্রেমের আবেগ, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই ভাষা আন্দোলন বাংলা কবিতায় নতুন স্বর সংযোজন করে । তাদের কবিতায় মাতৃভাষা প্রেমের পাশাপাশি দেশ সমাজ ও জাতির শোষণ বঞ্চনার কথা ফুটে ওঠে । এই সময়ের প্রধান কবিদের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ শামসুর রহমান বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল গনি হাজারী, আনিস চৌধুরী, হাসান  হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, প্রমুখগণ ভাষাচেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করেছেন । এছাড়াও অন্যান্য কবিদের মধ্যে শহীদ কাদরী, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন আজাদ, মাহমুদ সাদিক, মোঃ নুরুল হুদা, অসীম সাহা প্রমুখৈর কবিতায়ও একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে । সেই একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে এদেশেও কবিতা রচনা করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, অরুণ মিত্র, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, অনিল সরকার প্রমুখ কবিগণ । অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর 'একুশে ফেব্রুয়ারি' কবিতায় লেখেন–'গুলির মুখে দাঁড়ায় রুখে / অকাতরে হারায় জান / রক্তে রাঙা মাটির পরে / ওড়ে ওদের জয় নিশান ।'

অন্যদিকে স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্টেশন চত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এগারোজন । তদানীন্তন অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অসমিয়াকে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবে এই বিক্ষোভ শুরু হয় । সেই আন্দোলন ও পুলিশের গুলিতে নিহত হবার ঘটনায় যে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ায় কবিরাও গর্জে উঠেছিলেন । কবি অতীন দাস 'উনিশের জার্নাল' কবিতায় লিখেছেন–'না, জান দেব, তবুও জবান দেব না ।' আর এক কবি দিলীপকান্তি লস্কর উনিশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছেন, '১৯শে সব চেনার জানার আত্মার দর্পণ / ১৯ ই সংগ্রাম, উনিশই জাগরণ ।' এছাড়া কবি অনুরূপা বিশ্বাস, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য উনিশের ভাষা চেতনায় কবিতার রচনা করেন ।

পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পরপর কয়েকটি রাজনৈতিক আন্দোলন আমাদের দেশে হয়ে গেছে । তার মধ্যে কাকদ্বীপ আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনে আন্দোলন, ইত্যাদি । তার মধ্যে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের স্মরণে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন 'অন্নদেবতা' অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্যই চেতনা / অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা / অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা / অন্ন অগ্নি অন্ন বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা / অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার / অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার, / সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে / ধ্বংস করো ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে । এই সময়ের সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্দোলন হল নকশালবাড়ি আন্দোলন । ১৯৬৭ সালের ২৩ শে ম চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয় এই আন্দোলন এই আন্দোলনের বজ্রনির্ঘোষে দেশব্যাপী প্রচন্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় । এর প্রভাব বাংলা সাহিত্যেও এক স্থায়ী ছাপ ফেলে । বাংলা কবিতায়ও ঘটে যায় অনেক রূপান্তর ও বাঁকবদল । নকশালবাড়ি আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি শহীদ সরোজ দত্ত তাঁর শ্রেণীগত অবস্থানকে জানান দিয়ে লেখেন–'গণ গগনের পথে অগ্নিরথ জনমানবের / যাহারা টানিয়া আনে তাহাদের কবি আমি' ( কোন এক বিপ্লবীর মর্মকথা ) ।সত্তরের আরেক কবি পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে নির্দেশ দাও কবিতায় তুলে ধরেন– 'আমি কোন বসন্ত দিনের ফেলে রাখা রাখি ফেরত চাই না আজ / জানতে চাই না ভবিষ্যতের নিশ্চিন্ত নির্ভরতা / জেগে উঠেছে যে ঘুম ভাঙ্গার গান / হে সময় ! আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো ।' এই সময়ের শক্তিমান কবিদের মধ্যে সৃজনশীল নবারুণ ভট্টাচার্য, মনিভূষণ ভট্টাচার্য, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, সনৎ দাশগুপ্ত বাংলা কবিতায় এক ভিন্নতর স্বরের প্রবর্তন করেন । নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চিত্র । 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না / এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / এই রক্ত স্নাতক কসাইখানা আমার দেশ না / আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব । (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না  ) ।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৭বছরের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বহু রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গেছে । কোনো কোনো প্রাদেশিক রাজনৈতিক অস্থিরতাও সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । তার মধ্যে কারগিলের যুদ্ধ, গুজরাট দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, মনিপুরের আন্দোলন, আসামের এনআরসির আন্দোলনের ঘটনায় বাংলা কবিতার স্বর উচ্চকিত হয়েছে । যেমন মনিপুরের আন্দোলনে মহিলাদের রুখে ধারার দাঁড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবি সুবোধ সরকার একটি অসামান্য কবিতা লেখেন 'মণিপুরের মা' । 'নগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়াল মনিপুরের মা / এই মায়ের দুচোখ থেকে চোখ পেয়েছি / আশিরনখ ভাষা পেয়েছি / পেয়েছি সা রে গা মা /নগ্ন হয়ে দাঁড়াল আমার মনিপুরের মা ।'

এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষভাগে এনআরসিকে কেন্দ্র করে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং আসামে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় এই আন্দোলনে এই অঞ্চলের বাংলাভাষার কবিরাও সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন । তাদের কাব্যোচ্চারণের মাধ্যমে । অসমের বিজিত কুমার ভট্টাচার্য, শংকরজ্যোতি দেব, দিলীপকান্তি লস্কর, শান্তনু গঙ্গারিডি থেকে শুরু করে ত্রিপুরার প্রতিনিধি স্থানীয় কবিদের মধ্যে পীযূষ রাউত, দিলীপ দাস, সেলিম মুস্তাফা, সমর চক্রবর্তী, মিলন কান্তি দত্ত, মানস পাল, জ্যোতির্ময় রায়, বিশ্বজিৎ দেব, কপাংশ দেবনাথ, রাজীব মজুমদার, সুমন পাটারী, আম্রপালি দে প্রমুখরা কলম ধরেছেন । পীযুষ রাউত 'অসুস্থ শব্দ' কবিতায় লেখেন–'লিগেসি ডাটা  এনআরসি /ডি-ভোটার এইসব অসুস্থ শব্দের বিরুদ্ধে / ধবনিত হোক /আমাদের প্রতিবাদ । ( অসুস্থ শব্দ ) । অমিতাভ দেবচৌধুরীর কবিতা–'ভেতরে তো ঘুরেছি অনেক / এবার বাইরে ঘুরব । অন্য গ্রহদের কক্ষপথে / ঘরপোড়া ছাই হাতে নিয়ে / শোনাব কি করে মানুষেরা স্বদেশে বিদেশি হয়ে থাকে । ( আসাম ২০১৯ ) । মানস পাল 'দেশে আজ এত দ্বেষ'  কেন কবিতায় প্রশ্ন তোলেন–'আমার জন্য আজ মাটি নেই কোথাও / দেশ নেই দ্বেষ আছে / দ্বেষ আমাকে ডি-ক্যাম্পে পাঠাবে / ডি ক্যাম্প থেকে কোথায় যাব আমি, কোথায় পাঠাবে আমাকে ? কবি দিলীপ দাস তাঁর কবিতায় প্রত্যয়দৃঢ় ঘোষনা করেন–'যাদের হৃদয়ে এক খন্ড আকাশ নেই / তারা জিজ্ঞেস করছে, তোমার দেশ কোথায় ? / আমি বলেছি, সারা ভারতবর্ষ আমার দেশ । / যাদের ভিতর এক বিঘত সবুজ ঘাস নেই তারা বলছে তুমি যে ভারতীয় তার কাগজ দেখাও ! / আমি বলেছি ভারতবর্ষ যার হৃদয়ের সকল প্রান্তরে তার কাগজের টিপ ছাপ লাগে না । ( তোমার দেশ কোথায় ) । আরেকজন শক্তিমান কবি সন্তোষ রায় 'ডিটেনশন ক্যাম্প' কবিতায় লেখেন–'আমার ফলন্ত গাছ / তোমার সিল ছাপ্পর আমার ইতিহাস / তোমার সিল ছাপ্পর / আমার দলিল পর্চা / তোমার সিল ছাপ্পর / আমার স্কুল কলেজ /চাকুরী বিবাহ- /তোমার সিল ছাপ্পর / আমার সন্তান-সন্ততি /তোমার সিল ছাপ্পর / আমার জীবন স্রোত / বাঁকে বাঁকে সিল-ছাপ্পর / ঢেকে গেছে অবয়ব / চিনলে না তুমি আর । এখন আমার একদিকে ধর্ম / একদিকে ভাষা / দুই দিকে কাঁটা তার । ( ডিটেনশন ক্যাম্প ) ।

অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে । এই সময়ের উৎকণ্ঠার মধ্যে কবিরাও তাদের কলম নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন । ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছেন ধর্ষকদের প্রতি । সমবেদনা জানাচ্ছেন অভয়া নির্ভয়ার প্রতি।  এ রাজ্যের কবিরাও এই চলমান অস্থিরতায় চঞ্চল । রাজ্যের এই সময়ের শক্তিমান কবি মিঠু মল্লিক বৈদ্য লেখেন–'ভারত মায়ের তিলোত্তমা, জীবনের দিচ্ছে দাম / সুরক্ষার মিথ্যা জাল ছছিঁড়ে খুবলে খেলো দেহখান । / সুরক্ষিত সমাজ স্বাধীন দেশের জয়গান, / অথচ নির্ভয়া ও অভয়া প্রিয়াঙ্কা তিলোত্তমা / রক্তে লিখছি ইতিহাস । ( এখন সময় শিকল ভাঙ্গার ) । কবি অরূপ পাটারী তার কবিতায় প্রশ্ন তোলেন আর কতকাল ধরে লিখবে তুমি / আপন দুর্ভাগ্য ও নৃশংসতার উপাখ্যান ? / পাল্টায় যেথায় শিরোনাম শুধু, / কাহিনি বর্বরতার একই প্রায় । / কখনো নির্ভয়া দিল্লির / অথবা প্রিয়াঙ্কা হায়দ্রাবাদের / আবার কখনো বা মৌমিতা কলকাতার । ( নাও তুমি রাতের দখল ) । কবি দীপেন নাথশর্মা লিখেন–'আঁধারে ঢেকে গেছে পৃথিবী / অমাবস্যার কালো হাত, / রাত এখন আরও গভীর / জেগে আছি একা কত রাত । ( নির্ভয়ারা কাঁদে ) । রেহানা বেগম হেনা প্রশ্ন রাখেন তার কবিতায়–'সমাজের চোখে লজ্জিত হয় ধর্ষিতা নারী,/  কেন নয় লজ্জিত ওই ধর্ষক অপরাধী ?

রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজের একটি ঘটমান বাস্তব । রাজনীতি ব্যতীত সমাজ জীবন অচল । কিন্তু রাজনীতি যখন সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে এবং অত্যাচারে বেঁধে রাখে রাখতে চায় তখনই কবির মন সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে । আর সেই সংক্ষোভেরই প্রকাশ ঘটে কবিতায় । রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উচ্চকিত স্বর মননজাত ভাবনার প্রকাশ । এই স্বরে শুধুমাত্র দ্রোহ বা ক্ষোভই প্রকাশ পায় না । বাংলাকবিতার আদিকে নিহিত স্বদেশ চেতনারও এক নবতর প্রকাশ ঘটে । স্বদেশের বিপন্ন পরিস্থিতিতে জনগণের বিবেক ও মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলে এই স্বর । অস্থির সময়ে কবিতার উচ্চকিত স্বরের অবর্তমানে যে জনজাগরণ তা নিষ্ফল হয় । যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি । কবি ছাড়া, কবিতা ছাড়া তাদের এই জয় কতটা সফল হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে ।


সহায়ক তথ্যপঞ্জী 

১. আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা– অশোক কুমার মিশ্র এস ব্যানার্জি কলকাতা 
   ২.আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা– ডক্টর বাসন্তী কুমার মুখোপাধ্যায় প্রকাশ ভবন কলকাতা
৩.  আধুনিক বাংলা কবিতা ।। বিচার ও বিশ্লেষণ–সম্পাদক জীবেন্দ্র সিংহরায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় । 
৪. কবিতায় মানবিক উচ্চারণ-কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, প্রমা প্রকাশনী কলকাতা 
 ৫. কবিতার একাল–সম্পাদনা ও ভূমিকা বার্নিক রায়, রূপা এন্ড কোং, কলকাতা 
৬. ত্রিপুরার বাংলা কবিতা অভিজিৎ চক্রবর্তী 
 ৭.  ১৯ এর কবিতা অতীন দাস ভীতি পাবলিশার্স গুয়াহাটি 
৮. আধুনিক বাংলা কাব্যের ধারা বৈচিত্র্য– কৃতি সোম, প্রমা প্রকাশনী কলকাতা 
৯. কবিতার দ্বীপ ও দীপ্তি–জহর সেনমজুমদার সাহিত্যসঙ্গী কলকাতা 
১০.  দৈনালী, শারদ সংখ্যা ১৪৩১ পঞ্চম বর্ষ- সম্পাদক মিঠু মল্লিক বৈদ্য । ১১. দেবদ্বীপ শারদ অর্ঘ্য অক্টোবর ২০২৪– সম্পাদক অনামিকা লস্কর 
১২. দেশহারা কবিতা–সম্পাদনা কিশোর রঞ্জন দে, সৈকত আগরতলা 
 ১৩. ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ১৪০৭–১৯৯২–সম্পাদনা রূপক দেবনাথ
১৪.  ত্রিপুরার আধুনিক কবিদের স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন শিশির কুমার সিংহ, দে'জ কলকাতা

লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরার সমাজজীবনের প্রেক্ষিতে

লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরার সমাজ জীবনের প্রেক্ষিতে 
                          অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । এই লোকসংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যশালী শাখা লোকনাট্য । নাটক একটি অনন্য ও আকর্ষণীয় শিল্পমাধ্যম যা ভারতীয় লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধিকে প্রতিফলিত করে । ভারতীয় নাটকের প্রায় পাঁচহাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । প্রাচীনকালের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে নাটকের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল । আদিম কৃষি-নির্ভর সমাজে কৃষিদেবতার অলৌকিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হত । এই শ্রদ্ধাপ্রকাশ বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে মানুষ নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত । সেই সব অনুষ্ঠানের আবশ্যিক অঙ্গ ছিল নৃত্য প্রদর্শন । এই নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গীত, মন্ত্র, স্তোত্র ও সংলাপ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় লোকনাট্যের । শুধুমাত্র ভারত উপমহাদেশীয় ভূখণ্ড নয় । পাশ্চাত্য নাট্যের উদ্ভব ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা একই ধরনের তথ্য পাই । পাশ্চাত্যে গ্রিসকে নাটকের জন্মস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়  । 'ডাইনোসিস' ছিলেন উর্বরতা ও মদ্যের দেবতা । গ্রিসিয়য়রা আরাধ্য ঈশ্বর ডাইনোসিসকে সন্তুষ্ট করার জন্য তার ভক্তরা বৃত্তাকারে কোরাস নাচ করতেন ও গান গাইতেন । থেস্পিস কোরাসের একজন পরিচালক ছিলেন । তিনি কোরাসে একজন অভিনেতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং তার সাথে কথোপকথন করেছিলেন । এভাবেই প্রথমবারের মতো পাশ্চাত্য নাটকের সংলাপ ব্যবহার করা হয় । ভারতীয় নৃত্যগীতের মধ্যেও দেখা যায় ধীরে ধীরে তার মধ্যে নাট্যউপাদান সংযোজিত হতে থাকে । বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে লাঙ্গল চষা, খননকার্য, মাছ ধরা ইত্যাদির অনুকরণ নৃত্য ও সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে । এভাবেই নাটকের পরম্পরা শুরু হয় ।

 ভারতীয় নাট্যকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয় । ধ্রুপদী নাট্য, লোকনাট্য ও আধুনিক নাট্য । প্রাচীন ভারতের ধ্রুপদী নাট্য বলতে ভারতীয় নাট্যসাহিত্য এবং অভিনয়কে বোঝানো হয় । প্রাচীন ভারতের ঋকবেদের ( ১২০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) মধ্যে নাটকের উদ্ভবের সূত্র পাওয়া যেতে পারে । সেখানে সংলাপ ও দৃশ্যের আকারে অনেকগুলি স্তোত্র রয়েছে । এছাড়া ভারতীয় ধ্রুপদী নাটক সৃষ্টির মাধ্যমে ধ্রুপদীনাট্যের সূচনা । সংস্কৃতভাষায় এই জাতীয় নাট্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব হয়েছে । বৌদ্ধ নাট্যকার অশ্বঘোষ রচনা করেন বুদ্ধচরিত । সংস্কৃত নাট্যকার ভাস ও অশ্বঘোষ ( খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতাব্দী ) সমসাময়িক বলে মনে করা হয় । এই সময়ের অন্যান্য নাট্যকারগণ শূদ্রক ও বিশাখ দত্ত । খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকে কালিদাস রচনা করেন মালবিকাগ্নিমিত্র, বিক্রমোর্বশী, অভিজ্ঞান শকুন্তলম ইত্যাদি নাটক । নাট্যতত্ত্ব বিষয়ক ধ্রুপদী গ্রন্থ ভরত মুনির নাট্যশাস্ত্রও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দের প্রথম বা দ্বিতীয় শতকের মধ্যে সৃষ্ট হয়েছিল বলে গবেষকগণ মনে করে থাকেন ।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি সমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল যা বাংলার সমস্ত ক্ষেত্রেই বিশেষত সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন হয়েছিল । প্রথমে ইংরেজ পরিচালিত কিছু নাট্যশালায় কিছু কিছু নাটক মঞ্চস্থ হত । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত সাহেবি থিয়েটারের একটা ধারা প্রচলিত ছিল । পরে স্থানীয় বাংলা নাটকের উদ্ভাবনের পর থেকে সেগুলোর গুরুত্ব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে । উনিশ শতকের প্রথমদিকে ইউরোপীয় নাট্যরীতিকে মান্যতা দেওয়া হলেও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রভাবশালী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বেশ কিছু নাট্যশালা । তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বেলগাছিয়া থিয়েটার ( ১৮৫১-৬১ ) পাইকপাড়ার জমিদারগণ তাদের বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । পরবর্তী সময়ে আরো বেশ কিছু সৌখিন নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয় । এসময় নাটক রচনা করেন রামনারায়ণ তর্করত্ন  কুলিনকুলসর্বস্ব ( ১৮৫৪ )  । এছাড়া তাঁর সৃষ্টি নবনাটক ( ১৮৬৬ ), রুক্মিণীহরণ ( ১৮৭১ ) প্রভৃতি । 

ইউরোপিয় নাট্যনির্মাণ কৌশলকে সাফল্যের সঙ্গে আয়ত্ব করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ( ১৮২৪-১৮৭৩ ) মৌলিক নাটক রচনা করতে শুরু করেন । তাঁর রচিত নাটক গুলির মধ্যে শর্মিষ্ঠা ( মঞ্চায়ন ১৮৫৯ ), পদ্মাবতী ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০, প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৫ ), ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি  কৃষ্ণকুমারী ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬১ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৭ ) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রহসনগুলির মধ্যে একেই কি বলে সভ্যতা ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৫ ), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬৭ ) উল্লেখযোগ্য । মধুসূদনের সমসাময়িক দীনবন্ধু মিত্র ( ১৮৩০-১৮৭৩ ) নীলদর্পণ ( প্রথম প্রকাশ ১৮৬০ প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৬১ ) নাটকে সমকালীন নীলকরদের অত্যাচারের চিত্র ফুটে ওঠে । উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কলকাতার বাঙালি সমাজে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সময় অসংখ্য নাটক রচনা করেন দক্ষ অভিনেতা ও পরিচালক গিরিশচন্দ্র ঘোষ ( ১৮৪৪-১৯১১ )। তাঁর জনা, প্রফুল্ল ও সিরাজউদ্দৌলা বিখ্যাত নাটক । বিশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে কাহিনিনির্ভর দেশপ্রেমের বক্তব্য সম্বলিত নাটক রচনায় হাত দেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ( ১৮৬৩- ১৯১৩ )। এই সময় অপর দুজন নাট্যকার হলেন অমৃতলাল বসু ( ১৮৫২-১৯২৯ ) ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৪৯-১৯২৫ ) । তাঁদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ ) দেশজ ও ইউরোপিয় নাট্যরীতির মিশ্রণে কিছু নাটক রচনা করেন । পাশাপাশি রূপক সাংকেতিক নাট্যlরীতির  উদ্ভাবকও তিনি । বিশ শতকের শুরু থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ি ( ১৮৮৯-১৯৫৯ ) মন্মথ রায় ( ১৮৯৯-১৯৮৮ ) শচীন্দ্র সেনগুপ্ত ( ১৮৯২-১৯৬১ ) বিধায়ক ভট্টাচার্য ( ১৯০৭-১৯৮৬ ) এবং আরও কয়েকজন বাংলা নাটকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন । এই সময়ের নেতৃস্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ লেখক শিল্পীবৃন্দ প্রগতিশীল লেখক সংঘ ( ১৯৩৬ ) ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ ( ১৯৪২ ) ও পরবর্তীতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ( ১৯৪৩২ ) প্রতিষ্ঠা করে সমকালীন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ও মানবিক দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন তাঁদের নাটকে । স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও বাংলা নাটকশচর্চার ধারা অব্যাহত রয়েছে । শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র প্রমুখগণ ইতিহাসচেতনা, রাজনীতি, উদ্বাস্তুসমস্যা ও জীবনবাস্তবতা নিয়ে নিরন্তর নাটক রচনা করে গেছেন ।

ভারতীয় নাটকের আরেকটি পর্যায় হল লোকনাট্য । ভরতমুণি তার নাট্যশাস্ত্রে লোকনাট্য বিষয়ে আলাদা করে কিছু না বললেও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, লোকজীবনচিত্রই হল নাটকের মূল প্রেরণার উৎস । তিনি বলেছেন যে, নাটকের সৃষ্টি বেদ থেকে হলেও তা তখনই উৎকৃষ্ট হবে যখন তার মুখ্য উপাদান 'লোক' হবে । ভরত মুনি বলেছেন, 'লোকধর্ম ভবেত্ত্বন্যা নাট্যধর্মী তথা পরা । স্বভাবো লোকধর্মী তু বিভাবো নাট্যমেব হি ।' অর্থাৎ স্বাভাবিক অভিনয় হল লোকধর্মী অভিনয় আর সভা বাতির রিক্ত অভিনয় হলো নাট্যধর্মী অভিনয় । প্রসঙ্গত ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী ব্রহ্মার দ্বারা নাটকের জ্ঞান তৈরি হয়েছিল । ব্রহ্মা তার চার হাতে চার বেদ নিয়ে ঋগ্বেদ থেকে নিয়েছিলেন সংলাপ,  সামবেদ থেকে সংগীত, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ থেকে রস নিয়ে সৃষ্টি করেছেন নাট্যবেদ । একে পঞ্চমবেদও বলা হয় ।

লোকনাট্যের সঙ্গে 'লোক' ও 'নাট্য' শব্দ দুইটি জড়িত । লোকসংস্কৃতির নানা শাখার মত লোকনাট্যেরও কেন্দ্রভূমি হল লোকসমাজ। লোকসমাজের লোক  শব্দটি লোকসংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ অর্থ বহন করে । লোকসমাজ বলতে গ্রামীণ সমাজকেই বোঝানো হয় । ইংরেজি Folk শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'লোক' ব্যবহার করা হয় ।‌ 'লোক' শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ড. অজিতকুমার ঘোষ বলেন, "'লোক' শব্দটির আভিধানিক অর্থ 'মানুষ' বা 'ব্যক্তি' হলেও বর্তমানে বিশেষ অর্থে নাগরিক মানব সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ঐতিহ্যধারাবাহী গ্রামীণ মানব সম্প্রদায়কে বোঝায় ।" আবার ডক্টর দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় 'লোক' শব্দটির অর্থপ্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন সেটি হল–'.লোকনাট্যের অন্তর্গত লোক শব্দটির বিশেষ অর্থ আছে । এর অর্থ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে লোকনাট্যকেও ঠিক বোঝা যাবেনা । একটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী গ্রামীণ যে মানবগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে জাতিগত একটি প্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে সেই মানবগোষ্ঠী হল 'লোক'গোষ্ঠী । লোকসংস্কৃতির এই জনপ্রিয় শাখাটি লোকজ জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত । এক কথায় 'লোক' অর্থাৎ সাধারণ মানুষজন ও অন্যদিকে 'নাট্য' অর্থাৎ অভিনয় করা । এই দুইয়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট লোকনাট্য ।

স্বরূপ :
ভারতীয় নৃত্য ও সংস্কৃতিকলারই অংশ হল লোকনাট্য  ঐতিহ্যবাহিত গ্রামীণ প্রয়োগশিল্পকে নির্দেশ করে স্থানিকতার চিহ্ন ও পরিচয়বাহী দেশীয় সংস্কৃতি প্রথাসমূহ, সামাজিক অনুশাসন, জীবনশৈলী ও বিশিষ্টতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রদেশে আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ পায় । লোকনাট্য নৃত্য, সংগীত, সংলাপ, অভিনয়, সাজ ও পোশাকের সমন্বিত মিশ্রশিল্প যা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর দর্শানো হয় । লিখিত স্ক্রিপ্ট এর পরিবর্তে লোকনাট্য অভিনেতার স্মৃতিশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার উপর নির্ভর করে । তার জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না । সংলাপের চেয়ে সংগীত প্রাধান্য পায় । সাধারণ মানুষের কথাবার্তা রীতিনীতি প্রতিফলিত হয় ।

ভারতীয় লোকনাট্য লোকসাধারণের মধ্যে মনোরঞ্জনের বা বিনোদনের পাশাপাশি লোকশিক্ষা ও গণসংযোগ এর ভূমিকাও পালন করে । সমাজে ধার্মিকতা, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক মান্যতা প্রদানের জন্য লোকনাট্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করে । যে কাজটি বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে করা হয় । তা সেকালে করা হত লোকনাট্যের মাধ্যমে । লোকনাট্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় । প্রাচীন মাধ্যম হলেও এর দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করতে সরাসরি আবেদন জানানো হয় ।

বিশেষত্ব :
১. লোকনাটকে সাধারণ লোকমানসের প্রতিভার সামগ্রিক বিকাশ ঘটে । এতে সম্পূর্ণ লোকমানসের প্রতিনিধিত্ব ঘটে ।
    ২.লোকরুচি লোকবিশ্বাস ও লোকপরম্পরা লোকনাটকের মূল আধার । লোকজীবনের প্রেম, বিরহ, বিরোধ, সহযোগ ও ধর্মীয় সংস্কৃতিক উপলব্ধির পাশাপাশি মনোরঞ্জনের ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয় ।
      ৩.সামাজিক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও পৌরাণিক ধর্মীয় কাহিনির বিষয়বস্তু নিহিত বার্তা অভিনয়ের মাধ্যমে লোকসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয় ।
      ৪. খোলা রঙ্গ মঞ্চ 
      ৫. কোন অংক থাকে না 
      ৬. পুরুষ প্রধান ( চরিত্রের রূপায়নে পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে । )
      ৭. বিদুষক বা কৌতুক অভিনেতা 
       ৮. বিবেক ও নিয়তি চরিত্র 
       ৯. স্থানীয় ভাষা 

লোক নাটকের আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিশেষত্ব হল সময়ের সাথে এর বিকাশ ঘটে । যা আজও ঘটে চলেছে । আধুনিক লোকনাট্যকারগণ নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রূপের প্রয়োগ করছেন যাতে এই শিল্পে কোনরকম স্থবিরতা না আসে এবং আগামী প্রজন্ম এর দ্বারা উপকৃত হয় ।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে লোকনাট্যের সূত্রপাত হয় । নাটকে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার ব্যবহারের সূত্রপাতও এই সময় থেকেই শুরু হয় । প্রথমদিকের লোকনাট্যসমূহে কঠোরভাবে ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দেওয়া হত । নাটকের উপাদান সংগ্রহ করা হত ধর্মীয় কাহিনি, মিথ এবং স্থানীয় উপকথা থেকে । পরবর্তী সময়ে প্রাদেশিক লোকনাট্যগুলোর মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয় এবং ধর্মীয় বিষয়ের বাইরে স্থানীয় বীরদের বীরত্বমূলক কাহিনি এবং শৌর্য ও প্রণয়মূলক কাহিনি ও স্থান করে নিতে থাকে । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কিছু লোকনাট্যের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের নৌটঙ্কি, সাং, রামলীলা, কাশ্মীরের ভন্ড পথের, গুজরাট ও রাজস্থানের ভাওয়াই, মধ্যপ্রদেশের মাচ, মহারাষ্ট্রের তামাশা পোয়াদা, গোয়ার দশাবতার, আসামের ভাবনা, অঙ্কিয়ানাট, ওজাপালি, কেরালার পুডিয়াট্টম, কৃষ্ণাট্টম, মুডিয়েট্টু, কর্ণাটকের যক্ষগানা তামিলনাডুর থেরুকুথু এবং বাংলার গম্ভীরা, আলকাপ, খন বিখ্যাত । লোকনাট্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সত্বেও মূল অখন্ডতা কিন্তু স্পষ্টই ছিল । এই অখণ্ডতার মূল কারণ, লোকনাট্যের উপাদান এসেছে ইতিহাস, কাব্য, পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় দেবদেবীর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার ঐতিহ্যধারা থেকে ।  বিভিন্ন অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবী থাকলেও পরবর্তী সময়ে তার আর্যীকরণ ঘটে গেছে । ফলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একটা সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে । 

আধুনিক নাট্যশিল্পের আদিরূপ হল লোকনাট্য । গ্রামীণ লোকসমাজের মধ্যেই এই লোকনাট্যের উদ্ভব । যে যুগে সংস্কৃত নাটক প্রচলিত ছিল সে সময়ে সংস্কৃত নাটকের পাশাপাশি প্রাকৃত, অপভ্রংশের মাধ্যমে যে অভিনয়ধারা প্রবহমান ছিল তাই লোকনাট্যের উৎস । সে সময়ের সাধারণ মানুষের ভাষাও সংস্কৃত নাটকের অপ্রধান চরিত্রসমূহে ব্যবহার করা হত । খোলা আকাশের নীচে নৃত্য, গীত, বাদ্যের সঙ্গে এই নাটক গুলির অভিনয় চলত । সেকারণে এই নাটকগুলিতে লোকনাট্যের লক্ষণ যুক্ত ছিল । খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগে গৌড়ের রাজা ছিলেন লক্ষণ সেন ( ১১৭৮-১২০৬ ) । তাঁর রাজসভায় পঞ্চরত্নের মধ্যে জয়দেব একজন ছিলেন । তাঁর রচিত কাব্য গীতগোবিন্দম  রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন প্রেমলীলাকে নিয়ে রচিত । এই কাব্যে ১২টি সর্গ ৮০টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমাবেশ রয়েছে । বৈষ্ণব সাধকদের কাছে কাব্যটি দার্শনিক মহাকাব্যরূপে সমাদৃত । শ্রীরাধার কৃষ্ণবিরহ ব্যাকুলতা ও রাধাকৃষ্ণের মিলন বিলাস বর্ণনা এই দ্বাদশ সর্গবিশিষ্ট কাব্যের কাহিনিসার । গীতগোবিন্দম মিলনান্তক ভক্তিমূলক গীতিকাব্য । জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাট্যগীতের আকারে লেখা । এই কাব্যের পাত্র-পাত্রী তিনজন । কৃষ্ণ রাধা ও সখি । এই কাব্যটি সংস্কৃতে রচিত হলেও তার ভাবধর্মে লৌকিক নাট্যধর্মিতার প্রকাশ পায়। সুকুমার সেন এই কাব্যগ্রন্থটিকে পালাগান বলেছেন এবং একে বাংলা লোকনাটকের এক বিশিষ্ট আঙ্গিক যাত্রা আদিরূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ।

গোবর্ধন আচার্যের আর্য সপ্তশতীতে নৃত্য, গীত, অভিনয়ের উল্লেখ আছে । এটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত । এখানে নিতম্বিনীর 'মনোহরণ' নৃত্যের কথাও রয়েছে । আরেক জায়গায় তুলনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যবনিকা অপসারিত হলে নটী এখানে প্রবেশ করে ।

প্রাচীন বাংলাসাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদে আমরা বুদ্ধনাটকের উল্লেখ পাই । প্রাচীন বুদ্ধনাটকে গান-বাজনার সাথে নাট্যাভিনয়ের প্রচলন ছিল ।

        জবে করহা করহকলে চাপিউ । 
        বতিশ  তান্তি ধনি সএল বিআপিউ  ।।—এই চর্যার শেষ চরণদুটিতে দেখি–

      নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী 
     বুদ্ধ নাটক বিষমা হোই । ( চর্যা ১৭ বীণাপাদ )
যখন হাতে চেপে সুর তোলা হয় তখন বত্রিশতন্ত্রী ধ্বনিতে সমস্ত ব্যক্ত হয় । নাচেন বজ্রধর । দেবী গান করেন । বুদ্ধ নাটক এইরকম বিষম হয়। এখানে বুদ্ধনাটক কথাটি লক্ষণীয় । হয়তো সেকালে নাচ গানের মধ্য দিয়ে কোনো ঘটনা বা বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনি তুলে ধরা হত । তার প্রমাণ আমরা আরেকটি পদে পাই—

          এক সো পদুমা চৌখুটি পাখুড়ি
          তঁহি হচড়ি নাচঅ  ডোম্বী বাপুড়ি
          **************************
         তোহোরো অন্তরে ছাড়ি নড়াএড়া ( নটসজ্জা )

চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে অথবা পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চন্ডীদাসের লেখা  মধ্যযুগের একটি বাংলাকাব্য । এই কাব্যটিকে প্রাক চৈতন্য যুগের একমাত্র বাংলা আখ্যানকাব্য হিসেবে ধরা হয় । এই কাব্যেরও উপজীব্য রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি । সমগ্র কাব্যটির ১৩ খন্ডে বিভক্ত । যথা জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখণ্ড, ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত কালীয় দমনখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত বস্ত্রহরণখন্ড, যমুনার্ন্তর্গত হারখণ্ড, বানখন্ড, বংশীখন্ড ও রাধাবিরহ । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তিন চরিত্র । রাধা কৃষ্ণ ও বড়ায়ি । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও অনেক অভিনয় উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেও রাধা কৃষ্ণ ও বড়ায়ি চরিত্রের সংলাপ রয়েছে । তাদের উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে নিহিত রয়েছে পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যসাহিত্যের বীজ । ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একে লোকনাট্যের আদি অবস্থা বলে মন্তব্য করেছেন । বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, চতুর্থ খন্ডে তিনি বলেছেন, 'বেশধারী যাত্রা চরিত্রের ঈষৎ পূর্বাভাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মিলবে । এতে কিঞ্চিৎ পরিমাণে নৃত্যগীতাত্মক লোকনাট্যের পূর্ব রূপ ফুটে উঠেছিল এরকম অনুমান নিতান্ত অসম্ভব নয়। পরে যে সমস্ত কৃষ্ণযাত্রা অনুষ্ঠিত হত তাতে এ ধরনের লোকনাট্য পালাই অনুসৃত হয়েছিল ।' তাছাড়া বাংলা মঙ্গলকাব্যের গানের মধ্যে, বর্ণনার মধ্যে, রামায়ণে এমন কি বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্বকথার মধ্যে, শাক্ত পদাবলীর মধ্যে নাট্যগুণের উপস্থিতি রয়েছে । মা মেনকার যে আর্তি তার মধ্যে আমরা লোকনাট্যের স্বরূপ সন্ধান করতে পারি।

পঞ্চদশ শতকের শেষ অংশ থেকে ষোড়শ শতকের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজজীবনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ( ১৪৮৬-১৫৩৩ ) ব্যাপক অবদান রয়েছে । তিনি নিজে যাত্রা অভিনয় করতেন বলে তার জীবনী পাঠে জানা যায় । মহাপ্রভু চৈতন্যদেব কৃষ্ণভক্তি প্রসারের কালে তাঁর যাত্রাপথে অনেক স্থানে ভজন কীর্তন এর আয়োজন করেন । এর মধ্যে লোকনাট্যের ব্যবহার করেন তিনি । তাঁর যাত্রাপথের উৎসব বা শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান বলে এর নাম যাত্রা হয়েছে বলে অনেকে অনুমান করেন । অনেকে আবার একে যাত্রা না বলে নাটকগীত বা লীলানাট্য বলে থাকেন । চন্দ্রশেখরের গৃহে চৈতন্যদেবের অভিনয়ের বিবরণ পাওয়া যায় কবি কর্ণপুর পরমানন্দ সেনের 'চৈতন্য চন্দ্রোদয়' নাটকে । ষোড়শ শতাব্দীতে প্রথম অভিনয় অর্থে 'যাত্রা' শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অসমের শংকরদেওর অঙ্কিয়ানাটে । চৈতন্য মহাপ্রভুর সময় থেকে যে যাত্রার শুরু হয় তা পরবর্তী সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের সময়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শত পুষ্পে বিকশিত হয়ে ওঠে । বাংলার রঙ্গালয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আলো ঝলমল হয়ে উঠত । সে ধারাকে অনুসরণ করেই বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়কে নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা লোকনাট্য ।

ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা । পুরাণ কাহিনিতে একে কিরাতভূমি বা পান্ডবর্জিত বলে আখ্যা দেওয়া হলেও এর প্রাচীনতার স্বীকৃতি অবশ্যই আছে । অতি প্রাচীনকালের কোন তথ্য না থাকলেও ১৮৪ জনের মত রাজাদের এই রাজ্যটিকে শাসন করেছেন তার ইতিহাস রয়ে গেছে । স্বাধীনতাপূর্বকালে ত্রিপুরা মুখ্যত রাজন্যশাসনাধীন ছিল । রাজন্য আমলের ত্রিপুরা রাজ্য সাংস্কৃতিক চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল । মহারাজা ধন্যমানিক্য ( ১৪৯০-১৫২৯ ) সংগীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ত্রিহুত ( মিথিলা ) ও বঙ্গদেশ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে এনে তৎকালীন রাজপ্রাসাদ সংগীতমুখর করে তুলেছিলেন । তাদের স্থায়ীভাবে ত্রিপুরায় বসবাসের ব্যবস্থাও করেছিলেন । ত্রিপুরার প্রাচীন গ্রন্থ রাজমালায় তার প্রামাণ্য তথ্য পাই—

            ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্য গীত আনি
           রাজাতে শেখায় গীত নৃত্য নৃপমনি 
          ত্রিপুর সকলে ক্রমে সেই গীত গায় 
         ছাগ অন্ত্রে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।

এ থেকে বোঝা যায় যে, রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতায় নৃত্যগীতের চর্চা থেকে থাকলে এই রাজ্যে নাট্যচর্চা অবশ্যই ছিল । বীরচন্দ্র মানিক্য ও তাঁর পরবর্তী সময়ে রাজপরিবারকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় ।

অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির কাল পর্যন্ত নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঝড়-ঝঞ্ঝা ও উত্থান পতনের ফলে এর সীমানা কখনো বিস্তৃত হয়েছে আবার কখনো সংকীর্ণ হয়েছে । ফলে নানা জাতি, উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের বৈচিত্র্যময় নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করে এসেছে এখানে যুগের পর যুগ ধরে । এখানকার সংস্কৃতি প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত । ১)  সমভূমির জনগণের সংস্কৃতি ও ২)  পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের সংস্কৃতি । রাজন্য আমলে পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে পরিচিত তা সে সময়ে সমতল ত্রিপুরা, জেলা ত্রিপুরা বা চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিত ছিল । এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পরে বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যে এসে বসতি স্থাপন করে । ফলে ত্রিপুরা রাজ্যের উনিশটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন যাবত পাশাপাশি বসবাস করে আসছে । ফলে সারা ত্রিপুরা রাজ্যেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিন যাবত নিজস্ব সংস্কৃতি লালন করে এলেও দীর্ঘকালের পারস্পরিক সংমিশ্রণ বিমিশ্রণের ফলে মিশ্রসংস্কৃতির একটা ধরন এখানে লক্ষ্য করা যায় । বাঙালিরা তাদের চিরাচরিত লোকসংস্কৃতি সমূহ নিয়ে বেঁচে যেমন রয়েছে তেমনি ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও সৃষ্টি নিয়ে বেঁচে আছে । ফলে সারা রাজ্যে প্রায় একই ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন পরিলক্ষিত হয় শুধুমাত্র জনবিন্যাসগত কারণে তার কিছু কিছু তারতম্য লক্ষ্য করা যায় । ত্রিপুরার তিনদিকেই বাংলাদেশের সীমানা থাকায় সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশীয় জনগণের কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । যেমন উত্তরে শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতি, আগরতলা বিশালগড় সিপাহীজলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের সংস্কৃতি, সোনামুড়া অমরপুর উদয়পুরে কুমিল্লার সংস্কৃতি, বিলোনিয়া শান্তিরবাজার সাবরুমে নোয়াখালী চট্টগ্রামের সাংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ।

ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক বিলোনিয়া শান্তিরবাজার এবং সাব্রুম মহকুমাকে নিয়ে গঠিত হয়েছে রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা । ২০১১ সালে পূর্বতন দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করে গোমতী ও দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার নাম দেওয়া হয়েছে । উদয়পুর অমরপুর ও করবুক মহকুমাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে গোমতী জেলা । বলাবাহুল্য এই দুই জেলাতেই জনবিন্যাস ও তাদের সংস্কৃতি প্রায় একই রকম । দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা কৃষিপ্রধান অঞ্চল । এখানকার অধিকাংশ মানুষজনের জীবিকাই কৃষিকাজ । বর্তমানে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রাবারের চাষ হয় । এই জেলায় বাঙালি ত্রিপুরি মগ ও চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন । তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতির পাশাপাশি সুদীর্ঘকালের লোকনাট্য চর্চার ধারাও প্রবাহমান রয়েছে । দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসমাজের প্রচলিত লোকনাট্যসমূহকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় । সেগুলো হল ধর্মীয় লোকনাট্য, বিনোদনমূলক লোকনাট্য ও কৃষিকেন্দ্রিক লোকনাট্য । প্রাচীন লোকনাট্যের আঙ্গিকই এই সমস্ত লোকনাট্যে পরিলক্ষিত । আদিতে লক্ষ্য করা নৃত্য, গীত, বাদ্য, সংলাপ, অভিনয়, মূকাভিনয়, মেকআপ ও পোশাক ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায় । এখানে আবার কোনরকম উপকরণবিহীন লোকনাট্য ও দেখা যায়। লোকনাট্যের প্রধান বিষয় সংলাপ ও অভিনয়। সেক্ষেত্রে আমরা দেখি একক, দ্বৈত বা যৌথ অংশগ্রহণ । কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগীতের ভাগ বেশি থাকে । সে অনুযায়ী দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিককে আমরা লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি ।

ধর্মীয় লোকনাট্য : লীলা কীর্তন, ঢপযাত্রা, হটিকীর্তন, বুদ্ধকীর্তন, মনসা পুঁথি পাঠ, মঙ্গলচন্ডী ব্রত, সত্যনারায়ণব্রত, শিবের গাজন ইত্যাদি ।
বিনোদনমূলক লোকনাট্য : কবিগান, যাত্রা, পাল্টাকীর্তন, রাধামন ধনপুদি পালা, কুচুক হা সিকাম কামানি, লেবাং বুমানি ইত্যাদি ।
কৃষি কেন্দ্রিক লোকনাট্য : আশ্বিনের ব্রত, ধান্যপূর্ণিমার ব্রত,কার্তিকের ব্রত, মাঘস্নান ইত্যাদি ।

ধর্মীয় লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরায় লীলাকীর্তন নামে যে লোকনাট্য পরিবেশিত হয় তা ত্রিপুরার অন্যান্য অঞ্চলে পালাগান বা পালা কীর্তন নামেও প্রচলিত । লীলাকীর্তন মুখ্যত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা, গৌরাঙ্গলীলা, রামায়ণকাহিনি থেকে নিয়ে দর্শকের আসরে পরিবেশন করা হয় । এখানে একজন থাকে মুখ্য চরিত্র । তিনিই অভিনেতা, তিনিই কথক এবং তিনি গায়ক । তাঁকে সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রের সহায়তা করার জন্য একদল বাইন ও দোহার থাকেন । হিন্দু বাঙালিদের শ্রাদ্ধবাসরে হটিকীর্তন নামে একই ধারায় লোকনাট্যের পরিবেশনা হয় । তবে সেখানে বিয়োগান্ত ও আবেগধর্মী ধর্মীয় ও পুরাণকাহিনি পরিবেশন করা হয় । বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় নিমাই সন্ন্যাস বা হরিশচন্দ্র পালা । কীর্তনের শেষভাগে কথক-অভিনেতা এমন আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যে মৃতের সন্তানাদি ও পরিজন কান্নাকাটি করে ধুলায় গড়াগড়ি যান । এভাবে শোক সংবরণ করে আবার সংসার জীবনে যোগ দেওয়ার জন্য তারা স্ফটিক স্বচ্ছ হয়ে ওঠেন । স্ফটিক শব্দ থেকে 'হটি' শব্দটির উদ্ভব । এছাড়া সংগীত, সংলাপ, কথকতার সাথে গীতাকীর্তন নামে একই ধরনের লোকনাট্যও এ জেলায় দেখা যায় ।

ঢপযাত্রার বিষয়বস্তু ও হিন্দুধর্মীয় কাহিনি থেকে নেওয়া হয় । তবে মুখ্যত সঙ্গীতধর্মী এই ধরনের লোকনাট্যে পাত্র-পাত্রী থাকে । তারা সংগীতের মাধ্যমেই একে অন্যের উত্তর প্রত্যুত্তর দিয়ে থাকে । সংগীতের একটা অংশ পাত্র বা পাত্রী গাওওয়ার পর আসরে উপস্থিত দোহাররা সেখানে কণ্ঠদান করে থাকে । এখানে মাঝে মাঝে সংলাপ থাকে । নৌকাবিলাস, রাধার মানভঞ্জন, সীতাহরণ, রাবণবধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঢপযাত্রা পরিচালিত পরিচালনা করা হয় ।

বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সারা শ্রাবণ মাসব্যাপী পদ্মাপুরাণ পাঠের রেওয়াজ রয়েছে । দক্ষিণ ত্রিপুরার বাঙালিদের ঘরেও সারা মাসব্যাপী পদ্মাপুরান বা মনসাপুথি পাঠ হয়ে থাকে । বিশেষত বাইশকবি মনসামঙ্গলের বিভিন্ন অধ্যায়ের পয়ার লাচাড়ি এবং ত্রিপদী অংশ সুর করে পাঠ করা হয় । মূল পাঠক এখানে একজনই থাকেন তিনি বেশ মুন্সীয়ানার সঙ্গে বিভিন্ন প্রচলিত লোকসঙ্গীতের সুরে পদ্মপুরাণ থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করেন । তার সহযোগীরা মূল সুরটি ধরে রেখে ধুয়া তোলেন । এভাবে ক্রমান্বয়ে পাঠকের বদল করে মূল শিল্পীরা বিশ্রামের অবকাশ পান । মাঝে মাঝে এই পুথিপাঠের আসরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কোন শাস্ত্রীয় বিষয় নিয়ে সংগীতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক তর্কেও অবতীর্ণ হন । চাকমাদের মধ্যে লীলা কীর্তন এর ধারায় বুদ্ধ কীর্তন করতে দেখা যায় । এছাড়া বাঙালি মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত কিছু ব্রতাচারমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লোকনাট্যের লক্ষণ পাওয়া যায় । এগুলোর মধ্যে মঙ্গলচন্ডীর ব্রত, ও সত্যনারায়ণব্রত লৌকিক দেবদেবীর পূজামূলক অনুষ্ঠান । ব্রতে অংশগ্রহণ করেন অনেক মহিলা । কিন্তু ব্রতকথা পরিবেশন করেন একজন কথক । মহিলা তার বাচিকশিল্পের মাধ্যমে সম্মিলিত মহিলাদের মধ্যে তা পরিবেশন করেন । ব্রত শেষে শ্রোতারা উলুধ্বনি দেন ।

দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকনাট্যের একটি বৈচিত্রপূর্ণ আঙ্গিক হল শিবের গাজন । মনসা পূজার মতো বর্ষশেষের লোকপার্বণ শিবের গাজনও ত্রিপুরার সর্বত্রই পালিত হয় । এই অঞ্চলে চড়ক পূজাকে বলা হয় 'গাছ ঘুরানি' । আর গাজনের দলকে বলা হয় 'ঢাকির দল' । তাদের গ্রামপরিক্রমাকে বলা হয় 'ঢাকি ফিরা' । সারা চৈত্রমাসব্যাপী একজন সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে ভক্তের দল ঢাকি ফিরা করে বেড়ায় । গৃহস্থ বাড়িতে নৃত্য, গীত,লোকনাট্য পরিবেশন করে ধান, চাল, অর্থ সংগ্রহ করে । বছরের শেষ দিন চড়ক গাছ ঘুরানির মাধ্যমে তাদের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে । এই দলের প্রধান চরিত্র শিব দুর্গা ও গঙ্গা । দুর্গা ও গঙ্গাকে একসঙ্গে এখানে 'গৈরা গঙ্গা' বলা হয় । শিব দুর্গা ও গঙ্গা গৃহস্থের উঠোনে ঢাকের তালে প্রথমে নাচ করে । তারপর আরো কিছু কিছু পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে লোকনাট্য পরিবেশন করা হয় । তার মধ্যে মহিষাসুর বধ, সীতাহরণ, সিন্ধুমুনির পুত্রহত্যা ইত্যাদি থাকে । পাত্র-পাত্রীগণ চরিত্র অনুযায়ী পোশাক পরেন । এই লোকনাট্যে প্রয়োজন অনুযায়ী মুখোশের ব্যবহারও থাকে । দক্ষিণ ত্রিপুরার গাজনের দলের এক বিশেষ চরিত্র পাগলী । এই চরিত্র আর কোথাও গাজনের দলে দেখা যায় না । পাগলীর পোশাক স্বতচ্ছিন্ন । ছেঁড়া জাল তার বস্ত্র । মুখে ঝূলকালি মাখা । একহাতে ঝাঁটা, অন্য হাতে পয়সার কৌটো । নাকি সুরে কথা বলে । গাজনের দলের সঙ্গে গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে নানা রকম পাগলামো করে, ঝাঁটা দিয়ে মৃদু আঘাত করে, টাকা পয়সার আবদার করে । বিদুষক ধরনের এই চরিত্রের কান্ডকারখানা গৃহস্থ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করে । গাজনের দলে নারী চরিত্রগুলিতে পুরুষরাই অভিনয় করে । এককথায় পুরো গাজনের দলের নাট্যায়নে লোকনাট্যের সমস্ত লক্ষণই বিদ্যমান ।

বিনোদনমূলক লোকনাট্য : বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির ধারা কবিগান দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতিক চর্চার এক বিশেষ অঙ্গ । ধর্মীয় ও পৌরাণিক পালার বিশিষ্ট চরিত্রের ভূমিকায় উঅবতীর্ণ হয়ে দুজন শিল্পী আসরে তাৎক্ষণিক কবিতা ও সংগীত রচনার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন । প্রথমে একজন আসরে কিছু প্রশ্ন রেখে যান । পরে দ্বিতীয়জন আসরে এসে প্রশ্নের উত্তর দেন ও নতুন প্রশ্ন রাখেন । প্রশ্ন-উত্তর কালে তাঁরা চরিত্র অনুযায়ী নাটকীয়তাও প্রদর্শন করেন । দক্ষিণ ত্রিপুরার বিভিন্ন পূজাপ্যান্ডেলে প্রায়ই কবিগানের আসরের ব্যবস্থা করা হয় । কবি গান দীর্ঘ সময় ধরে চলে । এর মধ্যে কবির  সরকারগণ সঙ্গীত, কথা, শাস্ত্রালোচনা, প্রশ্ন উত্তর পর্ব চালিয়ে যান । আর এক ধরনের লোকনাট্যমাধ্যম রয়েছে তার নাম পাল্টাকীর্তন । এটা কবিগানেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ । অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পীরা সংগীত ও কথার মাধ্যমে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় প্রশ্নোত্তর পর্ব চালিয়ে যান । অল্প সময়ে এটা খুব ভালো জমে । চাকমাদের এজাতীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান রাধামন ধনপুদি পালা ত্রিপুরীদের কুচক হা  সিকাম কামানি, পুনদা তাইন্নাই, লেবাং বুমানি ইত্যাদি । লেবাং বুমানির নৃত্যে শস্যক্ষেত্রে লেবাং পোকা তাড়ানোর অভিনয় করা হয় বিনোদনমূলক লোকনাট্যের আরেকটি উদাহরণ হল যাত্রা । এবিষয়ে আগেই আলোচনা করেছি । 

দক্ষিণ ত্রিপুরায় লোকনাট্য যাত্রার সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এক সময় শীতকালে বা পূজা পার্বনের সময় প্রায় প্রতিটি গ্রামে যাত্রা অনুষ্ঠান হত । বর্তমানে বিশ্বায়নের কারণে এই মাধ্যমটিতে কিছুটা ভাঁটা পড়েছে । তারপরও এই জেলার জোলাইবাড়ি, বাইখোরা অঞ্চলে এখনো নিয়মিত যাত্রার চর্চা হয় । নটী বিনোদিনী, কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ, অর্জুন গান্ডীব ধরো ইত্যাদি পৌরাণিক পালা এখনো খুবই জনপ্রিয় ।

কৃষিকেন্দ্রিক লোকনাট্য : দক্ষিণ ত্রিপুরার লোকজীবনে বিশেষ কিছু লোকিক ব্রত কৃষিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় । তার মধ্যে আশ্বিনের ব্রত, ধান্যপূর্ণিমার ব্রত, কার্তিকের ব্রত, ইত্যাদিতে কৃষিজ পণ্যের ব্যবহার করা হয় । এখানেও ব্রতের কথক থাকেন । কার্তিক ব্রতে উঠোনে একটা জায়গায় ধানচারা রোপণ করা হয় । তা ব্রতের কাজে লাগে । ধান্যপূর্ণিমা ব্রতে ধানের ছড়া প্রধান উপকরণ । সেরকম মাঘস্নান ব্রতে পুকুরপাড়ে ছোট্ট একটা পুকুরের অনুকৃতি করে তার পাড়ে বসে গীত গাওয়া হয় ।

অভিনয়ের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুকরণ । লোকজীবনের এই ব্রতগুলোতে তাদের যাপনেরই বিভিন্ন বিষয়ের অনুকরণ করা হয় । আদিম শিকারজীবী মানুষ তাদের দৈনন্দিন শিকারের বর্ণনা অনুকরণের মাধ্যমে একে অন্যের কাছে ব্যক্ত করত । ত্রিপুরি উপজাতীয়দের গড়িয়া নৃত্যে তাদের জমি চাষের সমস্ত পর্যায়ে গুলি অনুকরণ করে এক একটি মুদ্রায় পরিবেশন করা হয় । সেরকম মগদের ওয়া নৃত্যে তাঁরা বৌদ্ধমন্দিরে প্রদীপ হাতে যেভাবে প্রদক্ষিণ করেন বা আরতি করেন তারই অনুকৃতি পরিবেশন করা হয় । 

কিছু কিছু লোকসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে যার মধ্যেও লোকনাটকের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । গ্রীষ্মকালে প্রবল খরায় চারদিক শুকিয়ে গেলে, বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে । সেখানেও দুটি ব্যাঙকে পাত্র-পাত্রী হিসেবে হাজির করা হয় । তাদের সাজিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় । তাও লোকনাট্য লক্ষণ যুক্ত । এই জাতীয় লোকনাটকের উৎসে জাদু বিশ্বাসমূলক অনুষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে । ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর 'লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ' গ্রন্থে লিখেছেন —'নাচ গান চিত্রকলা প্রকৃতির আড়ালে শুরুতে যেমন জাদুর সংস্কার এবং তারপর ধর্মীয় প্রতিটির অস্তিত্ব অবিসংবাদিতভাবে দেখা গেছে ঠিক তেমনি ভাবেই নাটকের উদ্ভবের প্রেক্ষিতেও ওই ব্যাপার দুটি লুকিয়ে ছিল ক্রমান্বয়ে । ( পৃষ্ঠা ২২২ ) এরকম কোনো কীর্তনের আসরে, ভোজের অনুষ্ঠানে বা মৃতদেহ দাহকার্যের সময় ধ্বনি দিয়ে নাট্যমুহূর্ত  সৃষ্টি করা হয় । তাও জাদুবিশ্বাসের ফল ।

লোকনাট্যের দ্বারা সমাজজীবনে আসে আনন্দের স্পন্দন । জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময় । তখনই বলা হয়, আনন্দেন ও জাতানি জীবস্তি । আজ অবশ্য লোকনাট্যের ঐতিহ্য ও চর্চা হারিয়ে যেতে বসেছে । আধুনিক বিনোদন ও নগরায়নের ফলে এই লোকশিল্প ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে । জীবন ও গতিশীল হয়ে যাওয়ার ফলে  জীবিকার সন্ধানে মানুষকে ছুটতে হচ্ছে । যার ফলে শিল্পচর্চার মধ্যে সময় দেওয়ার ফুরসত আজকের লোকসমাজের নেই । তরুণ প্রজন্মও স্থিতিশীল পেশার তাগিদে গ্রাম থেকে বেরিয়ে শহরে ছুটছে । এই জাতীয় লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা ও সামাজিক সমর্থন অনেক কমে যাওয়ায় গ্রাম জীবনের এই সমৃদ্ধ কারুশিল্প আজ বিলুপ্তি ও ঝুঁকির সম্মুখীন ।

এত কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আজও এই ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি তার সৃজনশীলতার গুণে এখনো বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ক্ষীণ ধারায় হলেও টিকে আছে ।

**********************************

সহায়ক তথ্য :–

১. বাংলা লোকসাহিত্য ( প্রথম খন্ড ) –আশুতোষ ভট্টাচার্য
 ২. লোকসংস্কৃতির পাঠের ভূমিকা– তুষার চট্টোপাধ্যায়, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 
৩. লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ– ডঃ পল্লব ভট্টাচার্য 
   ৪. বাংলার লোকসাহিত্যচর্চার ইতিহাস– বরুণ কুমার চক্রবর্তী 
   ৫. লোকঐতিহ্যের দর্পণে– মানস মজুমদার 
   ৬. ভারতের লোকনাট্য– ডঃ ধ্রুব দাস
   ৭. ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি– অশোকানন্দ রায়বর্ধন
   ৮. ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির উৎসসন্ধান ও বিষয়বিন্যাস– অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।
  ৯. চর্যাপদ–অতীন্দ্র মজুমদার
  ১০.  বড়ুচন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন– অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য 
  ১১. যাত্রাগানের যাত্রাকথা ( প্রবন্ধ )–তপন বাগচী 
  ১২.  গ্রামীণ লোকনাটক– পুষ্পজিত রায় 
  ১৩. বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ– বরুণকুমার চক্রবর্তী

বঙ্কিমের একটি রাতের উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা–বাঁধন চক্রবর্তী

বাঁধন চক্রবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের একজন বিশিষ্ট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । তাঁর আরেকটি পরিচয় তিনি রাজ্যের বিশিষ্ট তবলাশিল্পী ও শিক্ষক । সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর কর্মময় জীবন । তাঁর নিজেরই প্রকাশনা সংস্থা জয়ন্তী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে 'বঙ্কিমের একটি রাতের উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা' । ছোট্ট অবয়বের এই গ্রন্থটিতে বঙ্কিম বিষয়ক চারটি ছোটো বড়ো লেখাসহ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রবিষয়ক মিলিয়ে আরও নয়টি লেখা রয়েছে । 'বঙ্কিমচন্দ্রকে পেতাম না যদি–' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা যাদবচন্দ্রের জীবনের এক অত্যাশ্চর্য ঘটনার উল্লেখ করেছেন । যার ফলশ্রুতিতেই বঙ্কিমচন্দ্রের পৃথিবীর আলো দেখা । বাংলাসাহিত্যও এমন একজন শক্তিধর লেখককে পেল । পরবর্তী প্রবন্ধ 'প্রথম গ্রেজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্র'–তে তাঁর উচ্চশিক্ষালাভের অর্থাৎ বি এ পাশের কথা আছে । সেবারে বঙ্কিমচন্দ্র ও স্যার যদুনাথ বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বিয়ে পাস করেন । 'বাংলাসাহিত্যে প্রথম' লেখাটি বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি উপন্যাসের উল্লেখ করেছেন, যেগুলো বিষয়ের দিক থেকে বাংলাসাহিত্যে প্রথম রচিত হয়েছে । তেমনি বঙ্কিমের 'একটি রাতের উপন্যাস' লেখায় বঙ্কিমের উপন্যাসে রাত্রিকালীন দৃশ্যের বাহুল্য সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে 'দুর্গেশনন্দিনী'কে বিশেষভাবে আলোচনায় টেনে এনেছেন । উপন্যাসটির বিভিন্ন পরিচ্ছেদ থেকে এই চিত্রকল্পের উদাহরণ লেখক এখানে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন । শরৎচন্দ্রের সংগীত প্রতিভার কথা উল্লেখ করেছেন 'গায়ক শরৎচন্দ্র' লেখাটিতে ।

সমস্ত মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত এক সত্তা রয়েছে । এই সত্তা মানুষকে অসীমের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় । রবীন্দ্রনাথ এই সত্তাকে পরমসত্তা বলেছেন । এই সত্তা আনন্দময় । এই সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জ্ঞাপন করাই হলো ধর্মবোধ । আর এই ধর্মবোধ অর্থাৎ পরমসত্তাকে ব্যক্তিরূপে কল্পনা করে যে ভক্তিবোধের প্রকাশ তাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতা'তত্ত্ব । তিনি এক জায়গায় বলেছেন, 'এই যে কবি, যিনি আমার সমস্ত ভালো মন্দ আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকে আমার কাব্যে আমি 'জীবনদেবতা' নাম দিয়েছি ।' ( আত্মপরিচয়, রবীন্দ্ররচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, বিশ্বভারতী, পৃষ্ঠা, ২৩১ ) । রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরে এবং তাঁর 'জীবনদেবতা'তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন লেখক 'বহুমুখী প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ ও জীবনদেবতা' প্রবন্ধে । এছাড়া 'সালাম একুশে ফেব্রুয়ারি', 'সন্ন্যাসী রাজা', 'জত্তো-সব', 'শিল্পী যখন চোর ধরেন', 'তালের দেশ' ইত্যাদি শিরোনামে চমকপ্রদ কয়েকটি এক প্যারার লেখা রয়েছে । ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির শিল্পীজীবনের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে 'প্রথম পুরুষ' লেখাটিতে । শেষ লেখাটি একটি সংক্ষিপ্ত ভ্রমণবৃত্তান্ত । ছত্তিশগড়ের ডোঙরগড় এর বিমলাশ্বরী দেবীর মন্দির ও ভূতনাথ গুহা ভ্রমণের পাশাপাশি ডোঙরগড়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ বিবরণ দিয়েছেন  লেখক 'হাজার এক সিঁড়ি বেয়ে'-তে । পড়ে ভালই লাগে ।

ষাটপৃষ্ঠার এই ছোট্ট বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই খুব সুন্দর । সম্পাদনার সময় বানানের প্রতি যত্নের দুর্বলতার ছাপ রয়েছে । অন্যথায় বইটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের তথ্যের ভান্ডার হিসেবে কার্যকরী হবে ।

'বঙ্কিমের একটি রাতের উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা'-বাঁধন চক্রবর্তী, জয়ন্তী প্রকাশনী, আগরতলা, মূল্য ৩৫ টাকা মাত্র ।

Wednesday, October 30, 2024

My Pension from Nov.24

FOR FEB21 : BP=40500 DA=00 COMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 : DA (8% )=3240 REC=00
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=37940
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=40500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 00 COMM = 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NET = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

FROM JAN24 : BP=40500 : DA ( 25% )= 10125 REC =<00 COMM = 6300 DID=00 IR = 00 OLD = 00 FMA= 500 TDS = 00 NET = 44825

FROM NOV24 : BP = 40500 : DS ( 30% ) = 12150 REV = 00 COMM : 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 NET = 46950

Thursday, October 10, 2024

প্রগাঢ় বিশ্বাস

প্রগাঢ় বিশ্বাস


আসলে সাপলুডো নয়, চরাচরে ঝরছে কালো হলাহল 
ঘরেও বাইরে ঝরা পাতার মত উড়ে আসছে বিষ ।

যেখানেই বসতঘড়ি উপরের ছানি উড়ে যায় বারবার 
তীব্র রোদ, বৃষ্টির জল, ঝড়ের হাওয়ায় নড়ে বিশ্বাসবোধ ।
বুকে জড়ানো বর্মে জং ধরে । নিমেষে ভেঙে পড়ে যায় 
রাতের আঁধারের মতো সময় । ঋতুহীন কাটে বিষন্ন কাল ।

অনাথ বাতাস করুণ দোলায় কাঁপিয়ে দেয়
কোথা যায় নদী একাকী ? শ্মশান বন্ধু  নেই তার ।অক
 ক্রমশ শরীরে প্রস্থ কমে কমে অদৃশ্য হতে বাকি নেই ।
অচিন মাঝি সন্ধ্যার আঁধারে নৌকা নিয়ে পথ ভুলে যায়
 পলকা জলের ভেতর চাঁদ ঢুকে গেলে ঢেউ দুলে ওঠে ।

নোনাজল, পলি আর নুড়িবালি সব ইতিহাস জানে ।
তাদের ছোটো ছোটো বুকে লেখা আছে সব দিনলিপি 
এই গ্রামদেশেও বেদনায় আহত কবি লেখেন রক্তকবিতা 
সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে ভাবেন, কখন আদিগন্ত 
সোনালি গালিচাতে একাকার হবে সারাদেশ

 দুচোখে এক প্রগাঢ় শ্বাস নিয়ে জাগে মায়ার পলক ।

Tuesday, September 24, 2024

কোভিড পরবর্তী শরীরের যত্ন

কোভিড পরবর্তী শরীরের যত্ন

 নিয়মিত শরীরচর্চা, ধ্যান, নির্মেদ শরীর, নেশামুক্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন, সামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে থাকা, ক্রোধ সংবরণ, শরীর সম্পর্কে উদাসীন না থেকে নিয়মিত চেক আপ করিয়ে বিধিবদ্ধভাবে জীবনযাপন ও মনের প্রশান্তি শরীরকে অনেক সুস্থ রাখবে । অতিরিক্ত মাংসভক্ষণের ও পানীয়সেবনের অভ্যাস দূর করতে হবে । পাশাপাশি মোবাইল ফোনের ব্যবহার কম করতে হবে । এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড ভ্যাকসিন গ্রহণকারী তরুণদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় দুর্ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে । দায় এড়াবার উদ্যেশ্যে তাৎক্ষণিক আবিস্কৃত কৌভিড ভ্যাকসিনের কুফল প্রকাশ্যে আসছে না । একটু ভারিক্কি শরীরের তরুণদের এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে ।

Monday, August 26, 2024

ধরগো তোরা, হাতে হাতে ধরো...

ধরগো তোরা, হাতে হাতে ধরগো...

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

হড়পা বানের নাম শুনেছিলাম। এবার চাক্ষুষ করলাম আমরা । দেখলাম গোটা রাজ্য কিভাবে তছনচ হয়ে যায় তার ভয়াল তান্ডবে । প্রকৃতির এই উদ্দাম মত্ততায় আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশও উপদ্রুত । কাঁটাতারের ওপার থেকেও ভেসে এসেছে হাহাকার । আমরা জল আর পানিতে ভাগ করি । কিন্তু তার তো কোনো সীমানা নেই । খেপে গেলে সে সসাগরার দখল নিতে চায় । আমরা প্রকৃতিকে চিনি না । প্রকৃতির রুদ্ররোষের খবর জানি না । যে প্রকৃতি আমাদের সবকিছু দেন তাঁকে আমরা ধ্বংস করি । তাঁর বুক টেনে চিরে ফেলি । প্রকৃতি সহ্য করতে করতে একদিন ফুঁসে ওঠেন ক্রোধে । প্রতিশোধের হাতিয়ার নামিয়ে দেন জনপদে । 

পৃথিবীতে যখন মানবতার সংকট দেখা দেয়, যখন মানুষের লোভ গগনচুম্বী হয়ে ওঠে, মনুষ্যত্ব বিপন্ন হয় তখনই প্রকৃতি জেগে ওঠে মানুষকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন । মানষের ঘুমিয়ে পড়া বিবেককে জাগানোর জন্য প্রকৃতি মাঝে মাঝে তার আয়ুধ প্রয়োগ করেন । আর তাতে মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । প্রতিবেশিকে আপন মনে হয় । দুঃখে, দুর্দৈবে, দুর্দিনে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ লাগাতে ইচ্ছে হয় । একে অন্যকে সাহস জাগাতে ইচ্ছা হয় । প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াতে সাধ জাগে । আবার এসময়ে আসল বান্ধবকেও চেনায় । পরিচয় হয় সৎ প্রিয়জনের সঙ্গে । এবারের বন্যায় প্রকৃতি আমাদের সে পাঠ দিয়ে গেছেন । কিভাবে আর্ত মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়িয়ে পড়ে তা আমরা দেখেছি । আর্ত মানুষ এবারে দেখেছেন সাংসদ না থাকুক সজ্জন, সৎ জন, প্রিয়জন তাঁদের পাশে আছেন । একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় থেকে আমরা অন্যপ্রদেশের দুর্যোগে আমাদের সাধ্যমতো সম্বল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি । আর আমাদের দুর্দিনে সেই প্রিয় প্রতিবেশিদের দেখলাম হিমশীতল প্রতিক্রিয়ায়, মধ্যরাতের নীরবতায় । আবার এমন প্রতিবেশীও দেখলাম যারা অকারণ অন্ধ অজ্ঞ দোষারোপ করে শুধু চিলচিৎকার করে গেছে এই দুঃসময়ে । এরা নিজেদের দুর্দিনেও ত্রাতা হবার যোগ্যতা অর্জন করেনি । একদিন বোধ হবে এদের । এরা নিজের দেশের বিপন্নদের সেবায়ও লাগেনি । শুধু কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে ফাঁকা আওয়াজ করে গেছে । কারো প্রতি ক্ষোভ নেই আমাদের ।  বরং এইসময়ে আমরা নিজেরা পরস্পর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি । নিজেরা নিজেদের চিনতে পেরেছি । শুধু একরাশ নীরব অভিমান আর ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে আমরা আবার আমাদের সংসার গড়ব ।

জল কমে গেছে অনেকটা। পলিবিছানো প্রলয়ভূমির উপর নিথর হয়ে থাকা বাস্তুভূমিতে কপর্দকহীন অশ্রুসম্বল বন্যার্তরা ফিরছেন । যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত বিষাদভূখন্ডে ফিরছে সর্বহারা ভূমিপুত্রকন্যারা । এবারে সংকট দেখা দেবে খাদ্য ও পানীয় জলের । ঘরে রাখা খাদ্যশস্যসহ সব ফসল মাঠে মারা গেছে । কৃষকের ঘরের আয়ের উৎস শেষ । অপেক্ষা করতে হবে নতুন ফসল আসা পর্যন্ত । 

এই আর্তসময়ে সরকারের নিকট আমার বিনীত আবেদন, আগামী ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি আর্ত পরিবারে বিনামূল্যে রেশনসামগ্রী বিলির ব্যবস্থা করা হোক । ধান ও অন্যান্য শস্যবীজ ও সার-ঔষধের ব্যবস্থা করা হোক বিনামূল্যে। ততদিন পর্যন্ত হাতখরচা হিসেবে নিয়মিত কিছু আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক । শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় ও অসুস্থদের তালিকাভুক্ত করে তাদের যথাযথ পরিষেবার আওতায় আনা হোক । একা সরকারের পক্ষে সবদিক রক্ষা করা সম্ভব নয় । হৃদয়বানগণ ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরাও আর কটাদিন পাশে থাকুন । বিশ্বাস আমরা আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবই ।

শিল্পী তাঁর কল্পনা, মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে তাঁর শিল্পকে নান্দনিক করে তোলেন । তাঁর সৃজন বিপর্যস্ত হলে ক্ষুব্ধ হন তিনি । পরিত্যক্ত শিল্পের উপর আবার বোলান তাঁর চারুতুলি । প্রকৃতিও তেমনি । তাঁর এই বিধ্বংসী তান্ডবের অন্তরালেই রয়েছে সৃজনের বীজ । যা তিনি নিয়েছেন দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবেন আমাদের । কারণ আমরা প্রকৃতির সন্তান । তিনি শুধু শাসন নয় । সোহাগও আমাদের করবেন ।

Saturday, August 10, 2024

আমাদের অমৃতকাল অতিক্রম ও কবিতায় স্বদেশভাবনা

আমাদের অমৃতকাল অতিক্রম ও কবিতায় স্বদেশভাবনা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

স্বদেশপ্রেম মনুষ্যচরিত্রের একটি স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য । মানুষ পৃথিবীর অধিবাসী হলেও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং সেখানে বেড়ে ওঠে । তার পরিচয় হয় একটা বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে । সেটাই তার জন্মভূমি তার মাতৃভূমি এবং তার স্বদেশ । সে দেশের মাটি আলো বাতাস জলে তার জীবন বিকশিত হয় । তার ফলে সেই ভূখণ্ডের প্রতি মানুষের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ তৈরি হয় । এই আজন্ম আকর্ষণ থেকে সেই ভূমির প্রতি মানুষের অনুরাগের যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় বা তার প্রতি একটা প্রেম ভালোবাসা তৈরি হয় তাকেই স্বদেশপ্রেম বলা হয় । নিজের দেশ জাতি এবং মাতৃভাষার প্রতি তীব্র মমত্ববোধ ও আনুগত্যই দেশপ্রেম । যার দেশের প্রতি গভীর উপলব্ধি এবং ভালোবাসা থাকে তিনিই দেশপ্রেমিক । দেশপ্রেমিক দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ । একজন দেশপ্রেমিক মানুষ নিজের কথা না ভেবে পরের মঙ্গলের জন্য বা দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য আত্মোৎসর্গ করে থাকেন । মহৎ মানুষের চিন্তা কর্ম সবসময় সমাজকেন্দ্রিক ও দেশকেন্দ্রিক । তাঁরা সবসময় দেশ ও জাতি ও সমাজকে নিয়ে দেশের কল্যাণ সাধনা সম্পর্কে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন । সমাজের মানুষের মধ্যে সব ধরনের মানবিক গুণাবলি জাগিয়ে তোলার স্পৃহা থাকে দেশপ্রেমিকের মনে । একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক যেমন দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তেমনি সাহিত্য শিল্পকলা ও অন্যান্য নন্দনচর্চার মাধ্যমেও দেশপ্রেমিকের পক্ষে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব । সাহিত্যসৃজনের ক্ষেত্রে স্বদেশপ্রেম সঞ্চার করে সাহস শক্তি সৌন্দর্য ও মহিমা । সাহিত্যস্রষ্টা ও শিল্পী তার সৃজনের মাধ্যমে নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিপন্ন করেন এবং দেশের মানুষের মধ্যে উদার মানবপ্রেমিক মানবিক গুণাবলিসহ দেশপ্রেমের ভাবধারা সঞ্চারিত করেন । স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরও একটি অংশ । স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমের এক মহৎ উপলব্ধি ও মানবিক জাগরণ ঘটে থাকে । পৃথিবীতে বহু বীর বিপ্লবী ত্যাগী এবং মহৎ দেশপ্রেমিক এসেছেন । সেই সঙ্গে এসেছেন বহু দেশপ্রেমিক কবি ও সাহিত্যিক । প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার দেশ সকল দেশের সেরা এবং সব দেশের রানি ।

দেশপ্রেম একটি আবেগ । আবেগ সাহিত্যের বিভিন্ন ধারাকেও পুষ্ট করে । কবিতায় দেশপ্রেমের আবেগ থেকে সৃষ্টি হয় দেশপ্রেমের কবিতা । সেই সব কবিতায় দেশপ্রেমের প্রতি গভীর মর্মবোধের পরিচয় পাওয়া যায় । দেশপ্রেম জাগানিয়া কবিতা বাংলাকবিতাকেও সমৃদ্ধ করেছে । ভারতবর্ষের অন্তরে মাতৃভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ বৃদ্ধি করে স্বদেশপ্রেম সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে রামায়ণ, মহাভারত মহাকাব্য ছাড়াও গীতা, উপনিষদ, পুরাণ-উপপুরাণ ইত্যাদির বাণী আর দর্শনের প্রভাব অতি প্রাচীন । 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী' ( রামায়ণ, লঙ্কাকাণ্ড ) অর্থাৎ জননী জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও শ্রেষ্ঠ । রামায়ণের এই মহতবাণীর আবেদন প্রতিটি ভারতবাসীর প্রাণে প্রাণে প্রাচীন শাস্ত্রে ভারত ভূমি প্রশস্তি করা হয়েছে পূণ্যভূমি ও কর্মভূমি রূপে গীতার কর্মযোগে উল্লিখিত 'মরিলে স্বর্গ তরিলে দেশ' বাণী স্বদেশপ্রেমেরই অমল উৎস । তদুপরি বিভিন্ন পুরাণ উপ-পুরাণে বর্ণিত কাহিনি ও প্রতিষ্ঠিত দর্শনে ভারতীয়দের প্রাণে জুগিয়ে আসছে জন্মভূমির যশ, মান বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য আত্মোৎসর্গের প্রেরণা । 

বাংলা কবিতায়ও বিভিন্ন সময়ে কবিরা দেশপ্রেমের আবেগসংবেদী কবিতা রচনা করে গেছেন ।  দেশপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ তাঁদের কবিতা আমাদের বাংলাকাব্যের সম্পদ হয়ে রয়েছে । প্রাচীন বাংলাকাব্যের উদাহরণ পর্যালোচনা করলে আমরা সেখানেও স্বদেশভাবনার কিছু কিছু প্রমাণ পাই । বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ বা চর্যাগীতিকায় বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যরা সেসময়ে যে পদগুলি রচনা করেন তার মধ্যে স্বদেশভাবনা এখনকার মত এতটা স্পষ্ট ছিল না । তাই আজকের দিনের মত দেশভাবনার উজ্জ্বল প্রকাশ তখনকার কবিতায় এতটা প্রতিফলিত হয়ে ওঠেনি । তাঁদের কবিতায় তাঁরা তাঁদের বসতভূমি ও ভূখণ্ডের প্রকৃতির কথা কিছু কিছু তুলে ধরেছেন । সেটা দেশপ্রেম না হলেও দেশ পরিচিতি হিসেবে  কিছুটা  আভাস পাওয়া যায়– উঁচা উঁচা পাব তহি বসই শবরী বালী । / মৌরঙ্গী পিচ্ছ পিরিহিন শবরী গীবত গুঞ্জরী মালী । এখানে তাদের বাসভূমির অর্থাৎ স্বভূমির পরিচয় পাওয়া যায় । 'নৌবাহী নৌকা টান অ গুণে'– সরহপাদের এই পদটিসহ বিভিন্ন পদে তৎকালীন নদীমাতৃক বাংলার ভূপ্রকৃতি, জলপথে যাতায়াত বা যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে ওঠেছে ।

চর্যার কবিদের মতো মধ্যযুগের কবিদের কাব্যেও স্বদেশের ধারণা আধুনিক কালের কবিদের মতো ততটা স্বচ্ছতা নিয়ে আসেনি । তা কখনো নিসর্গের মধ্যে ব্যস্ত আবার কখনো প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে স্বদেশকে । কখনো বা মাতৃভাষাকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে স্বদেশ প্রীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগের অন্যতম কবি আব্দুল হাকিমের নূরনামা কাব্যের ' বঙ্গবাণী' কাব্যাংশে দেখা যায়– 'যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী । / সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি ।। / দেশী ভাষা বিদ্যা যায় মন ন জুয়ায় । /  নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় ।। /  মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি । / দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি । আব্দুল হাকিম ছাড়াও মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় সরাসরি না হল প্রচ্ছন্নভাবে স্বদেশপ্রেম স্থান লাভ করেছে । মধ্যযুগের সর্বশেষ বড় কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বাংলাদেশের বর্ণনা ও গুণগান করেছেন । তাঁর আগে আলাওল এবং পরে রামনিধি গুপ্তের কবিতায় স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় । মধ্যযুগের শেষে ও আধুনিক যুগের প্রথমদিকে অর্থাৎ যুগ ও সন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বর গুপ্ত জন্মভূমিকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন তার স্বদেশ প্রীতি ও জন্মভূমি কবিতায়ই সর্বপ্রথম স্বদেশপ্রেম অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে । ' জানো না কিন্নর তুমি / জননী জন্মভূমি / যে তোমার হৃদয়ে রেখেছে ।।/  থাকিয়া মায়ের কোলে / সন্তানের জননী ভুলে / কে কোথায় এমন দেখেছে?

উনবিংশ শতাব্দীতে সমগ্র ভারতে জাতীয়তাবাদের ভাবনার বিস্তার ঘটেছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী কালে উপনিবেশিকবাদের অবসান সমগ্র পৃথিবীতে এক অপরিহার্য পরিণতি হিসেবে জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছিল । পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই সময় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার আস্বাদ গ্রহণ করে । ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছর ধরে ইংরেজ উপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল । এদেশে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লব ইংরেজ শাসককে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছিল । সে সময়ে সাহিত্যে, সঙ্গীতে, নাটকে, কবিতায় ইংরেজ শাসকের স্বৈরাচারী দিকটি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । সেই সাথে সাধারণ জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনা জাগ্রত হয়েছিল । ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের সংস্কৃত-বাংলা মিশ্রভাষায় রচিত একটি বন্দনাগীতি একদিকে জাতীয়তাবাদকে উদ্বুদ্ধ করতে যেমন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল পাশাপাশি ইংরেজ উপনিবেশিকতাবাদের ভিতকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল । পৃথিবীর সব দেশে সর্বযুগে প্রকৃত লেখকরা তাঁদের সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশচেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকেন । মধুসূদনও ( ১৮২৪– ১৮৭৩ ) দক্ষতার সাথে এটিকে ধারণ করে নিপুণ হাতে অনবদ্য সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করেছিলেন । তাঁর রচনায় স্বদেশভাবনা ঐকান্তিক রূপে বিকশিত হয়েছিল । স্বদেশের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ সুদূর ভার্সাই নগরীতে বসে লেখা 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি উজ্জ্বল নিদর্শন । তাঁর সৃষ্টিতে পৌরাণিক ভাবনার মধ্যে যুগচেতনার সুচিত্রিত প্রকাশে স্বদেশভাবনা পূর্ণতা লাভ করেছে । এই সময়ের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৩৮–১৯০৩ ) রচনা করেন বৃত্রসংহার ( ১৮৭৫–৭৭ ) । তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না একজন একনিষ্ঠ দেশপ্রেমিকও ছিলেন ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তার রচনা 'বীরবাহু' কাব্যে তিনি প্রকাশ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন । ১৮৭৫ সালে 'পলাশীর যুদ্ধ' মহাকাব্য প্রকাশিত হলে কবি নবীনচন্দ্র সেন ( ১৮৪৭–১৯০৯ ) ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন স্বজাতিবোধ ও স্বদেশানুরাগ ছিল তাঁর কাব্যের মূল সুর যা তাঁর কবিত্ব শক্তিকে উদ্দীপিত করেছিল । নবীনচন্দ্রের চিন্তাভাবনা অনেক পরিমানে বঙ্কিমচন্দ্রের দ্বারা প্রভাবিত ছিল ।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানটি রচনা করেন । তাঁর অকৃত্রিম মানবতাবোধ থেকে উঠে এসেছে দেশপ্রেম । জগতের আনন্দযজ্ঞে ভারতীয়ত্বের শুভ সূচনার বিশ্বায়ন ঘটেছে রবীন্দ্রনাথেরই হাত ধরে । আধুনিক দুনিয়ার বিশ্বায়নের স্থায়ী ছাপ রেখেছে তার স্বদেশভাবনা। তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় দেশের মানুষ জাতীয় সংগীত গেয়ে ওঠে–'জনগণমন অধিনায়ক জয় হে / ভারত ভাগ্য বিধাতা । তিনি উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেন– হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে / এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে' ।

বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম ( ১৮৯৯–১৯৭৩ ) এক বিস্ময়কর প্রতিভা । তাঁর কাব্যভুবন নানা রঙে, নানা বর্ণে রঞ্জিত । বহু ভাবনা তাঁর কাব্যের অঙ্গনের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে । তাঁর শক্তিশালী কাব্যভাবনার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য স্বদেশপ্রেম । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ কবিতাসমূহ দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেম উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিল । তাঁর অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফনিমনসা ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তার উজ্জ্বল উদাহরণ । তাঁর বিদ্রোহী, কান্ডারী হুঁশিয়ার, আমার কৈফিয়ত, আগমনী ইত্যাদি কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ পেয়েছে । কবি নজরুলের কবিতায় দেশাত্মবোধের পাশাপাশি মানবপ্রেম ও প্রকাশ পেয়েছে । পরাধীন ভারতবর্ষে সংগঠিত স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুল দেশবাসীকে সশস্ত্র বিপ্লবের মন্ত্র দীক্ষিত করেন । আসন্ন স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন গভীর আশাবাদী । দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি উচ্চারণ করেন–'ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর / উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে রাঙিয়া পুনর্বার'  ( কান্ডারী হুশিয়ার ) ।

দেশভাগের যন্ত্রণা এবং উদ্বাস্তুজীবন বাংলাকবিতায় এক নতুন ধারার জন্ম দেয় । ইতিহাসের চেতনার সঙ্গে দেশবিভাজনের ট্রমাতাড়িত মানুষের জীবনের তীব্র ট্রাজেডিকে ঘিরে গভীর অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে সেইসময়ের কবিতায় । দ্বিজাতিতত্ত্বের খাঁড়ার ঘায়ে ভাগ হওয়া রাষ্ট্রের যে যন্ত্রণা আমাদের দেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে শুরু হয়েছিল তা যেন আজও এই ভূখণ্ডের মানুষের পিছু ছাড়ছে না । সেই যে স্বাধীনতার তাৎক্ষণিক ঘোষণায় 'বাংলার লক্ষ্য গ্রাম নিরাশার আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল ( ১৯৪৬–৪৭ / জীবনানন্দ দাশ ) তা অতি সম্প্রতিক মুহূর্তেও কুটিল দংশন করতে ছাড়ছে না । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত 'পূর্ব-পশ্চিম', 'উদ্বাস্তু' কবিতায় দেশভাগের যে যন্ত্রনা ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপমহাদেশের ভূখণ্ডে তা কিছুদিন পরপরই যেন ঘুরে ফিরে আসে ।স্বাধীনতার কালের সময় থেকে বাংলাকবিতা দেশভাগ ও দেশত্যাগ স্মৃতিকাতর হয়ে উচ্চারিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় । ঘুরে ফিরে এসেছে দেশভাগ তার 'যদি নির্বাসন দাও', ,জনমদুখিনী, 'দুঃখের গল্প' 'সাঁকোটা দুলছে' কবিতাগুলোতে । স্মৃতিকাতরতায় কবিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে । শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ও দেশভাগ,জন্মভূমি, উদ্বাস্ত জীবন এক বিশেষ অনুষঙ্গ । দ্বিখন্ডিত দেশের বেদনায় রয়েছে দেশপ্রেমের নিহিত পাতাল ছায়া । খন্ডিত ভূখণ্ডকে নিয়ে নতুন ভাবে বাঁচার ভাবনা এসেছে সেই সব কবির চেতনায় যাঁরা দেশবিভাগ দেখেছেন কাছে থেকে । যাঁরা তার শিকার হয়েছেন । তাঁদের কবিতায় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাত প্রভাব পড়েছে । নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, তারাপদ রায়, মিহির দেব, স্বপন সেনগুপ্ত, দিলীপ দাস প্রমুখের কবিতায় দেশভাগ এবং নতুন দেশের অনুভূতি নতুন দেশকে ঘিরে স্বপ্ন,  প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বেদনা ইত্যাদি ফুটে উঠেছে নতুন ধারার কবিতায় ।

নতুন জন্ম নেওয়া দেশ, নতুন ভূখণ্ড, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো প্রাদেশিক চেতনাকে নিয়ে সম্মিলিত দেশাত্মবোধ, স্বদেশপ্রেম নতুন মাত্রায় দেখা দিয়েছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে । তাঁদের পূর্বসূরী দেখিয়ে দেন সেই পথ । নতুন দেশভাবনার পাঠ দেন উত্তর-পূর্বের শ্রেষ্ঠ কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী– 'যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সেই করেছে ভয় / আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয় / হিংসাজয়ী যুদ্ধে যাব আর হবেনা ভুল / মেখলা পরা বোন দিয়েছে একখানা তাম্বুল ! / এবার আমি পাঠ নিয়েছি আর কিছুতে নয় /  ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় / বাংলা আমার আই ভাষা গো বিশ্ব আমার ঠাঁই, / প্রফুল্ল ও ভৃগু আমার খুল্লতাত ভাই ।' এখানেই রয়েছে নতুন স্বদেশচেতনার বোধ । বহভাষাভাষী মানুষের বহুত্ববোধের ভাবনা । বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সহানুভূতি ভ্রাতৃত্ববোধ ও বোঝাপড়া গড়ে তোলার এবং তাদের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা থাকে স্বাধীন ভারতবর্ষে । 

স্বদেশ প্রেমের স্বরূপ হল নিজের দেশের জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রেম সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেম ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার মাধ্যমে মাতৃভূমির বিভিন্ন বিষয়ে সুরক্ষার প্রচেষ্টা । সেই চেতনায় আজকের কবি লেখেন– 'একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে জেগে উঠছে অন্য পৃথিবী । / মাঠের ভেতর সাধারণ একটা কুয়ো, কিভাবে আজও আমাদের হাতে ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে । ( জালিয়ান ওয়ালাবাগ/ সৌমিত বসু ) । আমাদের স্বাধীনতা ইতিহাসের এক নৃশংস ঘটনাকে প্রতিটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে কবি দেশের স্বাধীনতাকে জেগে ওঠার কথা ব্যক্ত করছেন, 'একটা কুয়োর ভেতর যদি ঢুকে পড়ে গোটা পাঞ্জাব কিংবা গ্যালন / গ্যালন রক্ত,/  ঠিক তখনই জেগে উঠে ফিনিক্স পাখিরা, / আশ্চর্যভাবে ডানা মেলে জন্ম নেয় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী / হাজার হাজার মানুষের বুকে এঁটে থাকা ঘৃণ্য বুলেট, সমস্ত গা বেয়ে / গড়িয়ে পড়া গরম কুমকুম । / আজও আমি অবাক হয়ে দেখি একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসছে উন্মুক্ত কৃপাণ / একটা কুয়োর ভেতর থেকে কিভাবে জেগে উঠছে ভারতের স্বাধীনতা । । ( জালিয়ানওয়ালাবাগ সৌমিত বসু ত্রিধারা আগস্ট ২০২২ ) । দেশ ভাবনায় স্নাত হওয়া আরেক কবি লেখেন– 'শোনো লোলিতা, যার মা নেই সে পরাধীন–তার আগুনে / আলো নেই / তার চোখের জলে আগুন নেই / কেবল আলো ডাক পাওয়ার জন্য অনেক অযুত নিযুত / অন্ধকার তাকিয়ে আছে । / আগামী বলে দেবে কবিতার ভিতরে কতটা নক্ষত্র ছুঁয়ে / মাকে জড়িয়ে আছে মূলে / হে ভারত হে ভার্গব গীতবিতান আমার ! ( আলোগান / সুনীল মাজি, জলপাই দ্বীপের আলো, ব্লগজিন, আশ্বিন, ১৪২৮ ) । এই সময়ের কবির কাছে 'দেশ আসলে তোরণের মতো যেখানে লেখা থাকে / ওয়েলকাম / পতাকার ছায়ায় খুব নিবিড় হয়ে দেশ ঘুমোয় । / নির্জন সাঁকোতে বাঁশি বাজতে থাকে । / জাতীয় পশু ও জাতীয় পাখি থাকা মানে একটা / দেশ থাকা / দেশজুড়ে হাওয়া গানের সুরে ডুবে যেতে যেতে / আমি কেবল দেশ আঁকি, মানচিত্র আঁকি । (দেশ / সুবীর সরকার,ত্রিধারা, আগস্ট ২০২২ ) ।

ধীরে ধীরে স্বাধীন ভারতবর্ষ ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেছে । ১২ মার্চ ২০২৩ থেকে দেশ জুড়ে পালিত হয়েছে আজাদী কা অমৃত মহোৎসব । স্বাধীনতাযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করা, উপলব্ধি করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের ভার তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের পাঠ নেওয়া এই উৎসবের নিহিত বার্তা । নতুন প্রজন্ম আজ দেশের প্রধান মুখ । সাহিত্যে তাদের দেশভাবনা কিভাবে কতটা প্রকাশিত হচ্ছে তাও আজ আলোচনার বিষয় । অনেকে বলছেন, আজকের প্রজন্ম শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটছে । নিজস্ব উন্নতি, প্রতিষ্ঠার পেছনে তারা নিজেকে নিয়োজিত রাখছে । দেশ ও জাতির প্রতি কর্তব্যে তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে । আসলে কিন্তু তা নয় । নতুন প্রজন্মের সৃজনে, কবিতায় প্রতিফলন ঘটছে স্বদেশপ্রেমের । পূর্বজদের ভাবনা, তাদের দেশভাগের যন্ত্রণা, ইতিহাস চেতনাকে আধার করে এই প্রজন্মের কবিরা তাদের সৃষ্টিকে তুলে ধরেছেন । তারা স্পষ্টই জানেন আমাদের দেশের স্বাধীনতা কিভাবে এসেছে । তাঁদের বোধে রয়েছে 'শীততাপ বিছানা ছেড়ে বনবাদাড়কে করেছিলে বালিশ /কাবুলি, কাগজ-ওয়ালার কষ্টরূপ নিয়ে খুঁজেছ মুক্তির পথ–/  সয়েছ বুটের ঘা, গারদের কামড়, সহযোগীর কষ্ট করুণ চোখের ভাষা / জানি / পঁচাত্তর বছর মানে সাড়ে সাতষট্টি হাজার দিন আমাদের বোধোদয়ে / নেহাত কম নয়; ( অধিনায়ক, দুই / চন্দন পাল, ত্রিধারা ২০২১ ) । আর এক কবি উচ্চারণ করেন, 'আশ্বিনের প্রতীক্ষার শেষে সোনাঝরা সকাল / বেড়িয়ে আসি পাখিদের সাথে ধান শির শিস দেখে /  বুনো পাখি জানে এ ধান তার, আমি জানি আমার / এক মুঠো ধান হতে শত মুঠো ধানে খুঁজি আমি-/  অমিয় মাতৃদুগ্ধ, পাখি খোঁজে জীবন বেনামী । / আর গেয়ে উঠি পাখিদের সাথে মনের কথা / ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা ( অমিয় মাতৃদুগ্ধ / রাজীব পাল, ত্রিধারা, আগস্ট ২০২১ ) । এই সময়ের শক্তিমান মেধাবী ও অগ্রজ কবি লেখেন, ১. ঋত্বিক ঘটকের / বঙ্গবালার মুখের মতো চাঁদ /  লিখেছি প্রেমের পত্রে, / স্বাধীনতা, তুমি / বলেছিলে, যেন / গান্ধীর হাতে ভাঙা বাংলা অক্ষরের / ছাঁচ ! ২.  ভালবাসা পেলে সব /লন্ডভন্ড করে যাব না, বরং লণ্ডভণ্ডকে দেব / বিদগ্ধ সৃজন । / যেদিকে চোখ যায়, যাব না / যাব না বরং সৃষ্টিকে পায়সান্ন করে খাব / সম্পন্নের মতো ( দুটো মন্ত্র / মিলন কান্তি দত্ত, জলপাই দ্বীপের আলো, ব্লগজিন, আশ্বিন ১৪২৮ ) । কবির বার্তা এখানে ধ্বংসাত্মক নয় । বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদের মতো তিনি মানচিত্র ছিঁড়ে খাবার আগ্রাসী ক্ষুধা প্রদর্শন করেন না । তিনি বরং বিদগ্ধ সৃজনের কথা বলেন । কবি সত্যজিৎ দত্তের উচ্চারণেও এরকম স্বাধীন ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে । 'পতাকা উড়ছে দিব্যি এখন / দিনে এবং রাতে / ঘর চাইলাম, কাপড় দেহে /ভাত চাইলাম পাতে / হাত রয়েছে জোড়া জোড়া / কাজ চাইলাম হাতে / পতাকা উড়ছে দিব্যি এখন / দিনে এবং রাতে ( পতাকা / সত্যজিৎ দত্ত, ত্রিধারা, আগস্ট, ২০২২ ) । চলমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের প্রারম্ভেই শুরু হয়েছে স্বিধীনতার অমৃতকাল । এই সময়ের নবীন কবিদের কবিতায় কালের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সময়ের গমনকে তাঁরা অনুসরণ করেন তাঁদের কবিতায় । এই প্রজন্মের কবিদের কাছে 'দেশ বলতে কেবল মানচিত্র নয় / শুধুই দেশের মাটি নয় / ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটিয়ে যাদের রোজগার / বরফের চাদরে যারা সীমান্ত রক্ষা করে / বর্শা নিক্ষেপ করে শত কোটি মানুষের / লজ্জাকে সম্মানে বদলে দেয় / এরাই তো গর্বের দেশ, দেশের প্রকৃত কান্ডারী ।' ( দেশপ্রেম / রঞ্জিত রায়, ত্রিধারা, আগস্ট ২০২১ ) । এই সময়ের কবি স্পষ্টভাবেই বলেন– 'পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত রক্তে এখনো কিছু বিন্দু বেঁচে / আছে দেশপ্রেম, /  টগবগে করা স্নায়ু, চোখে জল গড়াতেই চোখ খুলে দেখি / পতাকার মাঝে ভারত মা বিশ্বাসের চোখে আহবান করছে/ যাকে আমি সেদিন ছত্রিশগড়ের দন্তে বাড়ায় দেখেছি মোমবাতি হাতে / বলছে– / এসো আমার অমৃতপুত্র, সূর্যসন্তান, আমি জানি আমার অস্তিত্ব বাঁচাতে / প্রাণ দিতে এবং নিতে তোমরা পিছপা হবে না কখনো । ( সেই দিন পুলবামাতে / অমিত সরকার / । অতি সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকজন প্রতিনিধিস্থানীয় কবীদের কবিতায় দেখছি দেশপ্রেম বা দেশ ভাবনা নানা আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে—

১. বিপ্লবীদের স্বপ্ন সত্যি হোক, /  আমাদের হাত ধরে । / স্বাধীন গান গাইব তখন / স্বাধীনতার তরে । ( স্বাধীনতা কাগজের বুকে / সম্রাট শীল ) ।
  ২. শতাব্দীর জনরোলে নন্দিত হয় বীর শহীদদের আত্মা, / বেজে ওঠে নম্র শপথ, তোমাদের রক্তঋণ ভোলার নয় । / আমাদের প্রতিটি রোম কুপিয়ে ভালোবাসার পরশ / সূর্যস্নাত ভোরের পুণ্য আলোয় বেঁচে থাকুক শহীদেরা ( বীর শহীদ / গোপাল বণিক ) ।

৩. দেশ মানে শহীদের রক্তরাঙা /  স্বাধীনতার সূর্য / দেশ মানে একতার মন্ত্র গাথা / আমার ভারতবর্ষ ( দেশ মানে / পিংকু চন্দ ) ।

৪. বয়স্ক কাঁটাতারে তর্জনী ছোঁয়ালেই /  কোথা থেকে যেন ভেসে আসে বিপ্লবের গর্জন, / আমার বন্য সুখের নির্জনতায় /  কফিন ভর্তি স্বদেশীদের যুদ্ধের সূত্র লুকিয়ে... / আর আমার মানচিত্রে ইতিহাস গড়তে / ঘর দখল করেছে আগামীর সুভাষ ( ঘর দখল পলাশ পাল ) ।
    ৫. তেরঙার মাথায় আগুন বরণ বাঁধা / সে আগুন বুকে নিয়ে জাগো / যজ্ঞের ভারতের উজ্জ্বলতা পুনর্জাগরণে  । /  যতই হোক জমাট বাধা দুর্গন্ধবেদীমূলে / উত্তরে তেরঙ্গা উজ্জ্বলতায় সাহস ও স্বপ্ন পাই ( তেরঙার বেদীমূলে / পঙ্কজ কান্তি মালাকার / ।

৭. স্বর্গের দেশ ঘুমিয়ে আছে বুকের উপর / নিশ্চিন্তে শ্বাস নিচ্ছি শান্তিপুরে / ভেতরে আমি অহংকারী ভাবি / ভারতের রক্ত গোটা শরীরজুড়ে ( জীবননদী / রাহুল শীল ) ।
৮. দেশপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে; / আজীবন থাকতে চাই দেশে । /  ভালবাসতে চাই এই দেশকে । / মৃত্যুর পরেও যেন ফিরতে চাই নানারূপে ( ফিরতে চাই দেশে / সুরমা আকতার ) ।

দেশাত্মবোধক কবিতার মধ্য দিয়ে যে আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের দৃঢ় অনুভূতি প্রকাশ পায় তা বর্তমান প্রজন্মের কবিদের মধ্যেও সমানভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে । কবিতায় দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশভাবনা ও দেশপ্রেম প্রদর্শনের মাধ্যমে কবি মিশে যেতে পারেন দেশের প্রকৃতি ও মাটির অফুরন্ত গুণ ও সৌন্দর্য আহরণে । প্রকৃত দেশপ্রেমের কবিতা শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের থাকে না । তা হয়ে ওঠে সত্যিকারের বিশ্বমাত্রার কবিতা । কবি ও পান বিশ্বমাতৃক পরিচিতি । এই প্রজন্মের কবিদের কবিতায় আমাদের দেশের স্বাধীনতাযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, দেশরক্ষায় অতন্দ্র সৈনিকের লড়াইকে ঘিরে দেশাত্মবোধক কাব্যসৃজন এদেশের মাটি ও নিসর্গ সৌন্দর্যকে আবর্তন করে মুখর হয়ে ওঠে । অতি সাম্প্রতিক কবিদের সৃজনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার স্বপ্ন যা তাদের আজন্ম অর্জন । সময়ের প্রতিঘাতে বাংলাকবিতায় বহু বাঁকবদল ঘটেছে । আমাদের কয়েক দশকের হতাশাদীর্ণ কবিতা অতিক্রম করে সমকালের কবিরা আবার তাঁদের শব্দ কুশলতা ও ভাষা ব্যবহারের দক্ষতায় দেশপ্রেম প্রকাশের বৈচিত্র অনুভব করছেন । এও এক আশার সৃজন ।