Wednesday, December 16, 2020

পৌষের পাঁচালি : হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ‍্য ও সংস্কৃতি

পৌষের পাঁচালি  :  হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ‍্য ও সংস্কৃতি 
                                        
                                                  অশোকানন্দ রায়বর্ধন

'কারো পৌষমাস । কারো সর্বনাশ' । এটি একটি প্রচলিত প্রবাদ । তার অর্থ পরিস্ফুট করলেই এই মাসটির বৈশিষ্ট‍্য প্রকাশ পায় । আমাদের ষড়ঋতুবৈচিত্রের মধ‍্যে শীতঋতুর শুরু পৌষমাস থেকে । অঘ্রাণের শেষেই পৌষমাস আসে । হেমন্তের সাথে শীতের পরশ লাগে সর্বত্র । হেমন্তের শেষভাগে কুয়াশা পড়তে শুরু করে । পৌষমাসে তা আরো গাঢ় হয় । সন্ধ‍্যার পর থেকেই কুয়াশায় ঢেকে যায় চারদিক । রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে চারদিক সাদা আস্তরনে ঢেকে যায় । তা প্রায় পরের
দিন সকাল পর্যন্ত থাকে । সকালে ঘাসের বুকে মুক্তোবিন্দুর মতো শিশির জমে থাকে । প্রভাতী সূর্যের রথআলো তার উপর পড়লে ঘাসের বুকে অজস্র হীরকদ‍্যুতিবিন্দুতে মাঠ-ঘাট উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । শীতও ধীরে ধীরে সংসার গুছিয়ে নিতে থাকে এই সময়ে । ইংরেজি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আসে পৌষমাস ।

     কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে বর্ষাকাল থেকে শুরু হয় খেতখামারের কর্মতৎপরতা । আর এই কর্মযজ্ঞের পরিসমাপ্তি ঘটে হেমন্তের শেষে । অর্থাৎ অঘ্রাণের শেষ নাগাদ । এসময়ে কৃষকের পরিশ্রমের ফসল ঘ‍রে আসে । জীবন-জীবিকা নিয়ে সংবৎস‍রের স্বপ্ন ও পরিশ্রম সার্থকতা লাভ করে । গৃহস্থের মন আনন্দে ভরে ওঠে । পৌষমাসব‍্যাপী চলে ধান মাড়াই , ঝাড়াই-বাছাই এবং শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজ । সারাবছরের রসদ এবং অর্থনীতি নির্ভর করে এইসময়ে সংগৃহীত ফসলের উপর । যার ঘরে ধান আছে তার সুদিন আছে । আর যার ঘরে ধান নেই, ফসল নেই , কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেছে কঠোর পরিশ্রমে ফলানো ফসল । তার দুঃখের অন্ত নেই । পরবর্তী বছরে ফসল আসা পর্যন্ত তাকে কঠিন অভাব অনটনের মধ‍্য দিয়ে দিন কাটাতে হবে । অনিশ্চিত জীবন তার সামনে । একারণেই প্রাগুক্ত প্রবাদটি ব‍্যবহার করা হত কৃষিভিত্তিক জীবনে । পরবর্তী সময়ে কারো সুখদুঃখের বৈপরীত‍্যের তুলনা করতে এই প্রবাদটি ব‍্যবহার করা হয় । কৃষিজীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রবাদের অর্থবিস্তার ঘটে পরবর্তী সময়ে ।

         কৃষিভিত্তিক সাংস্কৃতিক জীবনে পৌষমাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।'ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি' । সেই হাসি পৌষমাসে এসে গৃহস্থের ঘর আলো করে ঝরে পড়ে । উঠোনভর্তি সোনার ধান দেখে গৃহস্থের মনে আনন্দ ধরেনা । আনন্দের আবেশে সারামাস ধরে নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে । যার পরিসমাপ্তি ঘটে মাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন । কিছুটা ব‍্যস্ততাহীন জীবনে নানাভাবে উপভোগ করা হয় এই মাসটিকে । ঘরে ধান আছে মানে ধনও আছে । অর্থনীতি সচল আছে । ধনের সঙ্গে লক্ষ্মীর সম্পর্ক । লক্ষ্মী ধনের দেবী । ধানেরও দেবী । তাই পৌষমাসকে লক্ষ্মীমাসও বলা হয় ।

      একসময় পৌষের কর্মকান্ড শুরু হয়ে যেত গ়হস্থের উঠোন থেকে । ধানের মরাইয়ে ধানের আঁটি গুছানোর পর উঠোনটাকে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ দিয়ে লেপা হত । ধান মাড়াইয়ের পর এই নিকোনো উঠোনেধান শুকোতে দেওয়া হত । ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার পর শূন‍্য উঠোনের বুক আবার ভরে উঠত নানা শিল্পকর্মে । ঊঠোনটাকে লেপার সময় সুপারিগাছের ঝরে যাওয়া পাতার খোলটাকে সংগ্রহ ক‍রে  সেই খোলের একদিকে সুন্দর করে বিশেষ সুঁচালোভাবে কেটে তা দিয়ে ভেজা লেপা উঠোনের মাটির বুকে দাগ টেনে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলা হত । মেটে রঙের এই নকশা উঠোনটাকে একটা আলাদা সৌন্দর্য এনে দিত । এছাড়া নতুন ধান কুটে চাল বের করে সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে উঠোনময় আঁকা হত আলপনা । প্রধানত মহিলারাই এই আলপনা দিয়ে থাকে । ক়ষিজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ের চিত্র থাকত আলপনায় । ধানের ছড়া, ঘট, লক্ষ্মীর পা, ধানের মরাইয়ের চিত্র, পাতা-লতা ইত‍্যাদি ছিল আলপনার বিষয় । এখন আর আগের মতো বড়ো উঠোন নেই । এক পরিবার ভেঙে দশ পরিবার হয়েছে । মাটির বাড়িঘর হয়ে গেছে দালানবাড়ি । ছোট্ট উঠোনেও সিমেন্ট কংক্রিটের ঢালাই ।তাছাড়া এখন বাজারে স্টিকারের মতো আলপনার সিট কিনতে পাওয়া যায় । কাজেই কে আর আলপনার ঝামেলা করতে যাবে ।

       পৌষমাস এলে, ঘরে ধান উঠলে  পিঠে পায়েস পুলির তৈরির ধুম লেগে যেত গ্রামের ঘরে ঘরে । গভীর রাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে চাল কুটে গুঁড়ি তৈরি করা হত । অনেকরাত পর্যন্ত ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিত । 'ও ধান ভানো রে ভানো রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া ।ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া'―এইসব গান গেয়ে মেয়েরা ঢেঁকিতে চালের গুঁড়ি করত । এ নিয়ে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে চলত প্রতিযোগিতাও । ঢেঁকির যে অংশে মেয়েরা পা দিয়ে চাপ দিত  সেখানটায় ঢেঁকির নিচে একটা পিঁড়ি পেতে রাখা হত । পাড় দেওয়ার সময় ঢেঁকিটা পিঁড়িতে লাগলে জোরালো শব্দ হত । এতে করে তারা পাড়াময় জানান দিত যে তারা ঢেঁকিতে চাল কুটছে । আজকের প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি শুধু গল্পকথা । সকাল হতেই গ্রামের প্রতি ঘরে শুরু হয়ে যেত পিঠে বানানো । বাড়ির মেয়েরা চালের গুঁড়ির সঙ্গে নানা উপাদান মিশিয়ে তৈরি করত নানারকমের উপাদেয় পিঠে । ভাঁপা পিঠে, চিতই পিঠে,  মালপোয়া, পাটিসাপটা, পুলি, ঝালপিঠে এবং পায়েস ইত‍্যাদি । পিঠে সুগন্ধযুক্ত ও সুস্বাদু করার জন‍্যে ব‍্যবহার করা হত  গোবিন্দভোগ বা খাসার চাল ।  তার মধ‍্যে কালিখাসা বা তিলককচুরির চাল সর্বোত্তম । ধনেপাতা বাটা, পুদিনাপাতা বাটা, সর্ষে বাটা অথবা সিদলের ঝাল ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠে মুখে দিলে ঝালের চোটে কান গরম হয়ে গা থেকে শীত ছেড়ে যেত । আজকের দিনের তরুণ-তরুণীরা মোমো, বার্গার, পিজা,পকোড়া ইত‍্যাদির মধ‍্যে কসমোপলিটন খাবারের স্বাদ পায় ঠিকই কিন্তু পিঠে, পায়েসের মিস্টি গন্ধযুক্ত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় । আজকের দিনে মা-বোনেরাও তেমন আগ্রহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে এতোসব পিঠেপুলি বানায়না ।

      পৌষ এসেছে আর খেজুরের রস থাকবেনা, 'রাব' বা 'লালি' থাকবেনা তা কখনো হতনা । খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি  এই সময়ের একটা স্বাভাবিক দৃশ‍্য । গ্রামদেশে সকাল হলেই  খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানোর দৃশ‍্য চোখে পড়ে এইসময় । গাছিরা নিপুণভাবে গাছ কেটে এই রস সংগ্রহ করে । সারা রাত খেজুরের রস জমা হয় হাঁড়িতে । সন্ধ‍্যাবেলার রসকে বলা হয় 'সন্ধ‍্যারস' । এই রসের স্বাদ অপূর্ব । সারারাত টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে এই রস ,হাঁড়িতে জমা হয় । মেয়েরা এই রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে পিঠের উপকরণ হিসেবে ব‍্যবহার করে । রসসংগ্রাহক সকালবেলা গ্রামে বেরিয়ে যেত রস বিক্রির জন‍্যে । খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তা থেকে 'রাব' বা 'লালি' এবং 'তক্তিগুড়' অর্থাৎ নলেনগুড় তৈরি হয় । আজ আর পৌষমাসে গ্রামেগঞ্জে খেজুরের রসের সেই রমরমা ও তাকে নিয়ে অর্থনীতি ও কর্মব‍্যস্ততা দেখাই যায়না । খেজুরগাছও তেমন  নেই আর নেই কুশলী গাছ কাটার লোক । যার ফলে আজকের প্রজন্ম সুস্বাদু এই পানীয় এবং তার উপজাত দ্রব‍্যের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত ।

        পৌষের সকালে ঘুম থেকে উঠে খড়কুটো, নাড়া, লতাপাতা, লাকড়ি জ্বালিয়ে উঠোনে গোল হয়ে বসে আগুন পোহানো বা নিজেদের শরীর গরম করার ফাঁকে ফাঁকে প্রভাতী আড্ডা চলত পৌষের ভোরে । আর আজকের দিনে সেই অলস সময়যাপনের ক্ষণটি কোথায় ? ভোর হতেই ছেলেমেয়েরা পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে ছুটছে মাস্টারবাড়ি । আর একদল ছুটছে স্কুলবাস ধরতে প্রভাতী বিদ‍্যালয়ে যাবার জন‍্যে । ব‍্যস্ততম জীবনে ক‍্যারিয়ারের পেছনে দৌড়ুতে হচ্ছে এই প্রজন্মকে । অথবা, লেপকম্বলের নিচে হালকা ওমের মধ‍্যে  অলস সকালটা কাটানোর সৌভাগ‍্য নেই আর তাদের ।

     পৌষ এলেই শুরু হয়ে যায় বনভোজনপর্ব । ধানকাটা ফাঁকা মাঠের মাটিতে উনুন তৈরি করে সেখানে  চড়ুইভাতির আয়োজন । পৌষমাসের বনভোজন তাই নাম পোষলা । চড়ুইভাতি মানে চড়ুইপাখির মতো অল্প অল্প সংগ্রহের সম্মিলিত প্রয়াসে হত এই বনভোজন । প্রত‍্যেকের বাড়ি থেকে চাল, ডাল, সব্জি, কারো পুকুরের মাছ, ঘরে পোষা হাঁস,মুরগি ইত‍্যাদি এনে করা হত এই বনভোজন বা চড়ূইভাতি । এই খাদ‍্যদ্রব‍্যসমূহ সংগ্রহ থেকে শুরু করে রান্নাবান্না ও ভোজন সমাধা পর্যন্ত  শিশুকিশোরদের সে কী উন্মাদনা, সে কী আনন্দ তা আজকের দিনে পার্কে আয়োজিত ক‍্যাটারার পরিবেশিত পিকনিক তার ধারে কাছেও আসেনা ।
 পৌষমাসে ছিল কিছু ধর্মীয়সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও । পৌষমাসের শেষদিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনের উৎসবের জন‍্যে প্রস্তুতি চলে সারামাস । পৌষসংক্রান্তির ভোররাতে কোনো জলাশয়ের ধারে আগেরদিন তৈরি করা কুঁড়ে ঘরে আগুন দিয়ে আগুন পোহাত একসময় ছেলের দল ।  একে বলা হয় 'ভেড়ার ঘর' বা 'মেড়ার ঘর' পোড়ানো । ধানকাটা মাঠের নাড়া বা খড় দিয়ে আগের দিন এই ঘর বানানো , পোড়ানো আর আগুন পোহানোর সেই সম্মিলিত উন্মাদনা এখন আর  নেই । মা-বাবারাও এখন আর তাঁদের ছেলেমেয়েদের শীতের রাতে এজাতীয় অ্যাক্টিভিটিতে ছেড়ে দেননা ।
      সংক্রান্তির দিন প্রতি ঘরে তৈরি হত  নানারকমের পিঠেপুলি ও খাবার । ভোরবেলা স্নানাদি সেরে সূর্যকে পিঠে নিবেদন করার পর চলত নিজেদের খাওয়া দাওয়ার পালা ।  এখনো সেই অনুষ্ঠান কোনো কোনো পরিবারে পালিত হলেও নমো নমো করে সারা হয়  ।আগেকার সেই এলাহি কান্ডকারখানা আর দেখা যায়না এখন আর । পৌষসংক্রান্তির দিন কীর্তনের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীর্তন করে ফল-বাতাসা -কদমা-তিলাইর লুট দিত গৃহস্থের উঠোনে ।  কিঞ্চিৎ নিজেদের ভান্ডে নিয়ে নিত কীর্তনের দল । সন্ধ‍্যার সময় বিশেষ কোনো দৈবী গাছতলায় মিলিত হয়ে কীর্তনের শেষে  সংগৃহীত দ্রব‍্যগুলো প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হত ।  আজকাল আর সেই কীর্তন দেখা যায়না ।

    আর একটি বিরল অনুষ্ঠান করা হত পৌষসংক্রান্তির দিন । গৃহস্থের উঠোনে যে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি দিয়ে গোরু বেঁধে চক্রাকারে ঘুরিয়ে ধান মাড়াইর কাজ করা হত তাকে বলা হয় 'মেহির পালা/খুঁটা' বা 'মেইর পালা/খুঁটা' । এই খুঁটির চারপাশ লেপে পুঁছে  তাকে কেন্দ্র করে আঁকা হত আলপনা । ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে খুঁটির সামনে রাখা হত সারা মরসুমে ব‍্যবহার করা কৃষিযন্ত্রপাতিসমূহ । এই খুঁটি পুজোর পর তাকে তুলে ফেলা হত । পরবর্তী বছরের জন‍্যে । গোলায় তোলা হত সংগৃহীত শুকনো ধান ।  আজ আর তেমন গৃহস্থও নেই । সেই অনুষ্ঠানও আর ,তে দেখা যায়না । 'মেহির পালা বা খুঁটি আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা শব্দ । এখন ধান মাড়াই হয় ট্রাক্টর দিয়ে কিংবা অটোরিক্সাকে উঠোনে বিছানো ধানের উপর চালিয়ে দিয়ে অথবা ধানমাড়াই মেশিনের সাহায‍্যে । গোরু দিয়ে ধান মাড়ানো আজ ইতিহাস ।

এখনও বছর ঘুরে পৌষ আসে পৌষ যায় । পৌষের মাসব‍্যাপী জৌলুস এখন আর নেই । ধান‍্যলক্ষ্মী আজ গৃহস্থঘর থেকে বেরিয়ে কর্পোরেট ধনতেরাসে আশ্রয় নিয়েছে । প্রয়াত সংগীতশিল্পী মান্না দে-র কন্ঠের একটি গানে সে আক্ষেপ আজ ভেসে বেড়ায়―

'পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেইদিন
ফিরে আর আসবেনা কখনো
খুশি আর লজ্জার মাঝামাঝি সেই হাসি
তুমি আর হাসবে কী কখনো.....'

Friday, November 27, 2020

সে আমার ছোটো বোন

সে আমার ছোটো বোন

কলম চলছেনা কিছুতেই । শব্দ খুঁজে পাচ্ছিনা কিছুতেই । গত সন্ধ‍্যায় সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে যেন স্থবির হয়ে গেছি । আমার শিক্ষকতা জীবনের একেবারে শুরুর দিকের ছাত্রী রীতা । রীতা কর । সাব্রুম উচ্চতর মাধ‍্যমিক বিদ‍্যালয়ে সাতের দশকের শেষ বছর অল্প কয়েকদিনের ব‍্যবধানে শিক্ষকতায় যোগ দিই অগ্রজপ্রতিম দীপক দাস (স্বপন স‍্যর ) ও আমি । তখন রীতা গার্লস স্কুলে পড়ত । সেখান থেকে মাধ‍্যমিক পাশ করার পর আমাদের স্কুলে এসে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় । আমি আর স্বপনদা সেসময়ে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ দেখে তদ্বির করে স্কুলে বাণিজ‍্য বিভাগ চালু করালাম । শ্রীনগর থেকে এসে সদ্য জয়েন করলেন নেপাল সরকার । তিনজন মিলে শুরু করলাম একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বাণিজ্য বিভাগের ক্লাশ । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারির তখন সোনালি দিন । ডাকসাইটে শিক্ষকরা সব আছেন এখানে । সবাই এ স্কুলে পড়তে চায় । তখন কেবল একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে মেয়েরা পড়তে পারত । গার্লস স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় । 

কমার্স খোলায় দুটি মেয়ে এসে ভর্তি হল । একজন রীতা কর । অন‍্যজন পন্ডিতমশাই যশোদাজীবন গোস্বামী স‍্যরের মেয়ে । দুবছর পড়েছিল সে আমাদের স্কুলে । পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলায়ও ভালো ছিল রীতা । থ্রোয়িং ইভেন্টে সে ছিল দক্ষ খেলোয়াড় । মাত্র দুবছরের হলেও গোটা জীবন ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্কে জড়িয়ে রেখেছিল রীতা । কলেজে যাওয়ার পর ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দেয় । সেসময় আগরতলা মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ছিল তার দাপট । সুস্বাস্থ‍্যের অধিকারীণী রীতার ভয়ে মহিলা কলেজের সামনে রোমিওদের ঘুরঘুর করা একদম থেমে গিয়েছিল সেসময়ে । কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেয় রীতা । সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে দলের একেবারে প্রথম সারিতে চলে আসে ।  আমার বহু ছাত্রছাত্রী আজ দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠিত । তাদের অনেকের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয় । যোগাযোগ হয় । একদম কাছ থেকে উঠে আসতে দেখেছি রীতাকে । 
এই মহকুমায় আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী রয়েছে যারা রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার জন‍্যে । রীতা কর, অরুণ ত্রিপুরা, শান্তিপ্রিয় ভৌমিক, তাপস লোধ,দীপক দে, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী  সহ আরো অনেকে বিভিন্ন ফ্রন্টে । সবার সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক । যেকারণে আমি প্রত‍্যক্ষ রাজনীতিতে জড়াইনা । রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দিতা থাকে । থাকে কালি ছেটানোর প্রতিযোগিতা । কিন্তু আমি লক্ষ করেছি রাজনীতিবিদদের একটা বড়ো অংশই কিন্তু ব্যক্তিগত লাভালাভ বা প্রতিষ্ঠার চাইতে সমাজের কল‍্যাণের জন্যে রাজনীতিতে আসে । তাই রাজনীতির মানুষদের আমি শ্রদ্ধা করি । সে যে দলেরই হোক । রীতার ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়ার আমি প্রায় প্রত‍্যক্ষদর্শী । একসময় সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের চেয়ারপার্সন হল । তারপর দুইবার বিধানসভার সদস‍্যা । চাকুরিসূত্রে ভোটগণনার দায়িত্ব পেতাম । দুবারই জেতার পর কাউন্টিং হলের ভেতর সে আমাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়েছে । 

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ছিল ওর ছিল দারুণ আগ্রহ । একবার ত্রিপুরা রবীন্দ্রপরিষদের শাখা খোলার চেষ্টা করা হল । বিলোনিয়া রবীন্দ্রপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল দাশ এলেন । কথাবার্তা হল, সভা হল । কিন্তু একটা অদৃশ‍্য শক্তির সন্দেহের কারণে তা ভেস্তে গেল। কদিন আগেও এক আলাপচারিতায় সে কথাটা তুলেছিল । এ দুঃখটা তার আজীবন রয়ে গিয়েছিল ।
 তার নিজের বাড়িতে সে একটা নার্সারি স্কুল খোলে । তার একটা শাখা আনন্দপাড়াতে খোলা হয় । সেখানে এখন প্রাইমারির ক্লাশ হয় ।
 মেলা,উৎসব , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীদের ডাকা, বাইরের শিল্পীদের আনা, রাত জেগে তাদের তদ্বির করা, বৈশাখিমেলায় সারা রাজ্য থেকে কবিদের আমন্ত্রণ করে এনে কবিসম্মেলন করা রীতার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের বিরল নজির । একবার বাংলাদেশের মহাকাল নাট‍্যদল এসেছিল সাব্রুমে । রীতার আন্তরিক ও মিশুকে স্বভাব এবং প্রটোকলের ধারে কাছেও না থাকায় ওরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি যে সে রাজ্য বিধানসভার সদস‍্য । দুই পিজির বাইকে চড়ে সারা নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়ে জনসংযোগ রক্ষা করা, দুর্যোগে ছুটে যাওয়া রীতাই পারত । একারণেই রীতা রীতাদি, রীতাপিসি, রীতামাসি হয়ে উঠেছিল । সাব্রুমে নির্মীয়মান মৈত্রীসেতুর পরিকল্পনার প্রথমদিকে তা বানচাল করার চক্রান্তকে কীভাবে নস‍্যাৎ করা হয়েছিল সেদিন তা সাব্রুমের কয়েকজন সাংবাদিক আর রীতা ছাড়া বিশেষ কেউ জানেননা । 

    রীতা শুধু আমার ছাত্রী নয় । বোন । নিজে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও আমার শরীরের খোঁজ খবর নিত । পরামর্শ দিত । একবার সীমান্ত হাটে যাওয়ার পথে আমিও সঙ্গী হয়েছিলাম । এই হাটটি চালু করার ক্ষেত্রে তার বিরাট ভূমিকা ছিল সেদিন ।পথে শ্রীনগরের এক কৃষকের সঙ্গে দেখা হয় । তিনি রীতাকে একটা বড়ো তরমুজ দিয়ে আপ‍্যায়ণ করেন। সুগারের রোগি রীতা টপাটপ দুতিন টুকরো তরমুজ খেয়ে আমাকে সাবধান করে, স‍্যর বেশি খাইয়েননা । আন্নের সুগার ।

 গতমাসের শুরুতে আমরা সপরিবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম । কে কার যত্ন করবে । কে কাকে রেঁধে খাওয়াবে । সবাইকে আইসোলেশনে থাকতে হয়েছে । রীতা জানতে পেরে টানা দশদিন দুবেলা খাবার পাঠিয়ে গেছে আমার বাড়িতে ।

  ফুল খুব ভালো বাসত রীতা । বাড়িতে আছে বাহারি ফুলের গাছ । উঠোনের একটা হাস্নুহানার কথা খুব বলত । আমন্ত্রণ করেছিল বৌদিকে নিয়ে জোছনারাতে তার বারান্দায় বসে হাস্নুহানার গন্ধ নেওয়ার জন‍্যে । আমাকে এবছর অনেকগুলো ফুলের চারা দেয় ও । প্ল্যান হত তিমিরদাদের বাড়ি গিয়ে ফুলের চারা আনার । আমার উঠোন থেকে কয়েকরকম  ছোটো ফুলগাছের চারা দেওয়ার কথা ছিল । সে আর হয়ে ওঠেনি । 

এই প্রকৃতির মানুষ, পাখি, ফুল আর প্রিয়জনকে ছেড়ে অসময়ে পাড়ি দিল রীতা অনন্তকাননের পথে । চিরশান্তিতে থাকো আমার স্নেহের ছাত্রী, রীতা বোন আমার ।

Thursday, November 5, 2020

ছাঁ। টা ই

ছাঁটাই

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

এভাবেই মুছে যাই, মুছে যেতে হয়
যারা ভালোবাসে আর কাছে টেনে নেয়
তাদেরই কেউ কেউ মুছে ফেলে আমাকে 
আর অন্য যারা ভাসমান দোনামনায় আছে
তারাও অবসরবিনোদনের কালে পাঁজিপুথি দেখে
খুঁজছে মাহেন্দ্র কিংবা অমৃতযোগ
কখন ছেঁটে ফেলা যায় আমাকে

এইসব মোছামুছি আর ঘষাঘষির ফলে
আমার শরীরে এখন চুম্বনচিহ্নের মতো
শুধু ফ্যাকাশে ইরেজারের ঘষটানো দাগ

Saturday, October 31, 2020

নী ল চাঁ দ

নীল চাঁদ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ভোরের আজানের ধ্বনির আগেই 
আকাশের পশ্চিম প্রান্তের সিঁড়ি বেয়ে
নেমে যায় কোজাগরীক্লান্ত নীল চাঁদ ।

পুরোনো ধাবার পাশে বহুকাল ধরে 
পড়ে থাকা মালিকবিহীন নষ্ট গাড়িটির সারা শরীরে
আগাছা আর জঞ্জালের সাম্রাজ‍্য ।
ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় তার নম্বরপ্লেট,
এই অরণ‍্যসংকুল সময়ে পরিচয় হারিয়ে যায়,
যেমন এই নিরেট গাড়িটির জঞ্জালের আড়ালে
দুর্বল হয়ে পড়ে যেন ব‍্যক্তি ও স্বদেশ।

দুঃসময়ে যার নিবিড় লালনের আশায় থাকে
পরিযায়ী কিংবা প্রতারিত মানুষ।
তারাও যাজকের অদ্ভুত হাসিতে মায়াজাল ছড়ায়,
দুখি ও পেটখোলা মানুষের স্বপ্ন ভাঙে ।
বেতালা কাঁসা ঘন্টার বেয়াড়া আওয়াজে
তাতে কী আর উপোসী পেট ভরে ?

Wednesday, October 28, 2020

কা লো মে য়ে

কালো মেয়ে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আলোরাতের কালো মেয়ে লো  হৈমন্তী ঘ্রাণ তোর গায়ে 
কুয়াশার দীঘল রুমালে তুই  রেখেছিস জড়ায়ে

 লিপিদাগ শীতের আমন্ত্রণের  বিরল টেরাকোটা
লিখেছিস অমোঘ আখরে কালোবরণ ফোঁটা

যতোই জানি তোর ঠিকানা এই যে আঁধারমায়াগলি 
ততোবারই ভুলে যাই আমার কষ্ট গেরস্থালি

  এত কাল অবলীলায় মেখে নিলি তুই অঙ্গে
 তোর আলো বিলিয়ে দিলি তোর রূপটানেরই সঙ্গে ৷
মুগ্ধ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

তুমি সবখানেতেই দেয়াল তোলো
লজ্জাবতী ছোঁয়ার বারণ
বেলা-অবেলায় আমার ভালোবাসা
তুমি চাও অকারণ ।

তোমার বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ
তাও কী আমার দায় ?
তোমার ইঙ্গিতে উঠব আর বসব
আমার এমন মোহ, হায় !

বা তা স

বাতাস

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

নদীরেখা বরাবর যে পর্যটনক্ষেত্রের সংকেত
তার পাশেই থাকে প্রাদেশিক অশ্বশালার ফসিল
নিঃস্ব ধাবার নির্জনতা থেকে যে বাতাস আসে
তা কোনো একান্ত যুগলের পরিতাপ নেভায়না ।

আদিম সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগেই
আগুনে হাত সেঁকে নেওয়ার রীতি রেওয়াজ ছিল
এখন বিজয়ীজন গণরায় শেষ হলেই
দস্তানায় লেগে থাকা সমস্ত প্রতিশ্রুতি ধুয়ে মুছে ফেলেন

আর্ত জনপদ থেকে গুমরে ওঠা হা-হুতাশ
দিনযাপনের ব‍্যস্ত ঘূর্ণনে একঘেয়ে মরসুমি সুতো ।

Sunday, October 18, 2020

কো। জা। গ রী

কোজাগরী

গৃহী বাউল হয়ে ভদ্রাসনের চৌকিদারী 
 সন্ততিরা চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভুবনগঞ্জের মাঠে
ওরা আকাশ দেখে আর ইমারত গড়ে আকাশসমান ৷
 হাতের মশাল নিবিয়ে রেখে বিলীয়মান ধোঁয়ায়
তাৎক্ষণিক চিত্রকথায় ভেসে যায় ভাঙা অতীত

সমস্ত দায়ভার স্বর্ণকুম্ভে তুলে নেওয়ার জন্যে
জীবন বাজি রাখেন সুন্দরী কমলা আজীবন
 তার কোনো নথিবদ্ধ ইতিকথা লেখা হয় না

কে জাগে?  তোমরা জাগো কী আগামীর মহীরুহ যতো সব?
কে জাগে?  জাগে শুধু রক্তের ধারা, ভুলে বিত্ত ভুলে বৈভব

Thursday, July 16, 2020

বাঁ ধ ন

অণুগল্প

বাঁধন

এয়ারপোর্ট ৷সিকিউরিটি জোনে ঢুকে যাবার মুহুর্তে ছোট্ট শিশুটি দাদুর কোল থেকে কিছুতেই নামতে চাইছে না ৷ অনেক কষ্টে শিশুটির মা অর্থাৎ ভদ্রলোকের মেয়ে শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো ৷ পুরোটা জায়গায় ফাইবার গ্লাসের বিভাজন ৷কাজেই একে অন্যকে দেখছে ৷কোলের শিশুটা বারবার দাদুর দিকে তাকাচ্ছে ৷আর মুখে অদ্ভুত শব্দ করে মার কোলে ছটফট করছে ৷ বোর্ডিং পাস নেওয়া এবং প্রথাগত কাজ সারার পর শিশুটির মা শেষবারের মতো বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্যে পার্টিশানের কাছাকাছি এসে দাঁড়লো ৷ ভদ্রলোক পার্টিশানে হাত রেখে নাতিকে ডাকছেন, দাদু,দাদু়়়়়়়়৷ কিন্তু কথা তো ওপারে পৌঁছুচ্ছে না৷ বাচ্চাটা কাঁচের দেয়ালের ওপারের দাদুর হাতটা ধরতে চাইছে ৷ ছুঁতে পারছে না ৷নিষ্ফল আক্রোশে আঘাত শুরু করছে কাঁচের দেয়ালে ৷ ঠাট়়়়়়়ঠাট়়়়়়়়়ঠাট়়়়়়়৷এই শব্দে ভদ্রলোকের বুকের দেয়ালেও যেন আঘাত হচ্ছে থাক়়়়়়়থাক়়়়়়়থাক়় ৷ভদ্রলোক ফাইবারের দেয়াল হাতড়ে নাতিকে ছুঁতে চাইছেন ৷ ওদিকে বিশাল গর্জন করে একটা বিমান রানওয়ে স্পর্শ করলো ৷

Sunday, July 12, 2020

জ্ব র

জ্বর 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মাথুরকাঙাল ভাষায় খুলে দেওয়া সব কাঁটাবিষ
ঝরনাপ্রবণ  উচ্ছ্বাসে ঝাঁপ দেবার আদিসূত্র
ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হলে কবিতাও বুঝি থমকে যায়
 
প্রেমের জন্যে জ্বর হলে দেখি কবিতার বাড়বাড়ন্ত

Friday, June 19, 2020

পারভিন ও আমার মাসিপিসি

পারভিন ও আমার মাসিপিসি



সবার মতো আমারও সেই অবোধবেলায়
ঘুম পাড়ানির মাসিপিসি গেয়ে
মা আমাকে ঘুম পাড়াতেন রোজ ৷
আমি শুধু শব্দদুটো জেনেছি
মাসিকেও দেখিনি কোনোদিন পিসিকেও না ৷
অথচ শুনেছি আমার নাকি ছজন পিসি আর সাতজন মাসি ৷
আমার এই তেরোজন মাতৃসমা রমণীকে আমি কোনোকালে দেখিনি ৷
মায়ের মুখে শোনা এতগুলো মাসিপিসিদের সবার নামও আজ মনে নেই ৷
অভাগা তেরো সংখ্যার মতো তেরো মাসিপিসিদের 
শ্বশুরবাড়ির নামও কিছু কিছু শুনেছিলাম ওই মায়ের মুখে ৷
ঢাকার নরসিংদি, কুড়িগ্রাম,কুমিল্লার নবীনগর, সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ,নোয়াখালির মাইজদি, চাটগাঁয় ফটিকছড়ি
আর আমার শহরের  প্রান্তবর্তী নদীটির ওপারে
রামগড় নিয়ে পুববাংলা জুড়ে ছিল আমার মাসিপিসিদের ঘর ৷
মাসিপিসিদের ঘর গুনতে গুনতে আমার জানা হয়েছিল 
আমার পূর্বপুরুষের ভিটে বাংলাদেশের মানচিত্র ৷

সেই বাংলাদেশকে আরো বেশি করে জানলাম কৈশোরে
যেদিন  রফিকুল ইসলাম এসে উঠলেন হরিনার সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ৷
সঙ্গে একদল মুক্তিকামী টগবগে তরুণ ৷
যখন রেডিও খুললেই ভেসে আসত সাত মার্চের রমনা ময়দানের শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বজ্রকন্ঠ ৷
মা বলতেন, তোর মাসিপিসিরা এবার আসবে ৷
আমি তখন ছেলের দলের সাথে,
কৌটো নিয়ে চাঁদা তুলছি ছাত্রবন্ধুদের সাথে ৷
দাদাদের লঙ্গরখানায় বন থেকে কাঠ এনে ফেলেছি রান্নার জন্যে ৷
মনের পর্দায় ভেসে উঠছে অদেখা মাসিপিসির মুখ
তাদের জন্যে খিচুড়ি রাঁধছেন দাদারা ৷
 
বাড়ি এসে দেখলাম একটা পরিবার সামান্য সম্বল নিয়ে আমাদের উঠোনে বসে আছে ৷
মা তাঁর বাটা থেকে পানের খিলি গড়ে দিচ্ছেন এক মহিলার হাতে
দুটো ছেলের হাতে দুটি বিস্কুট ৷
বাবা সারাক্ষণ হাসপাতাল আর শরণার্থী শিবিরে 
রুগী দেখে ঘরে ফিরে মাকে ডেকে বললেন, এই দিদিদের আমাদের রান্নাঘরটা ছেড়ে দাও ৷
মা বললেন—গোরা, তোর বাবা যখন দিদি বলল তুই পিসি ডাকিস তাঁকে ৷
আমার তো ভালোই হল ৷ দুবেলা ঝগড়া করব নতুন ননাসের সাথে ৷
সেই জাহানারা ফুপু বেশ কদিন ছিলেন আমাদের বাড়ি
তাঁর দুই ছেলে রহিম আর তোতনকে নিয়ে ৷
আমাদের গোয়ালঘরটা ভাগাভাগি করে দুটো রান্নাঘর হয়েছিল আমাদের ৷
যে কদিন ওরা ছিল সে কদিন গোরুগুলো বাইরে বাঁধা থাকত ৷ সেসময়ে আমাদের গাঁঘরে তেল আর নুন ছাড়া কিছুই কিনতে হতনা ৷ ওদেরও চলে যেত ৷ মাঝে মাঝে মা নুনের পোটলা আর একশিশি তেল ওদের রান্নাঘরে রেখে আসতেন ৷
মাস দুয়েক পরে বাবা তদ্বির করে তাঁদের শিবিরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন ৷
 ফুপু কাঁদতে কাঁদতে যেন বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরের শিবিরে গেলেন ৷
এছাড়া আর কোনো পিসিমাসিকে আমি দেখিনি ৷
মাঝে মাঝে ফুপু আসতেন বাপের বাড়ি ৷ কারণ আমাকে তিনি আব্বা ডাকতেন ৷ যাওয়ার সময় মা এটা সেটা দিয়ে দিতেন রহিম ও তোতনের নাম করে ৷
একদিন জাহানারা ফুপু এলেন কাঁদতে কাঁদতে ৷ তার রহিম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে ৷ দেশে চলে যাবে যুদ্ধ করতে ৷ শিবিরের আরও অনেক ছেলে গেছে ৷
যুদ্ধশেষে একদিন ফুপু আর তোতন দেশে ফিরে গেছে পটিয়ায় ৷ রহিম সাথে ছিলনা ৷ তার খবর জানা যায়না ৷
আমার পিসি কিংবা মাসি বলতে ওইটুকুই প্রাপ্তি ৷

আজ আবার কুড়িগ্রাম! কুড়িগ্রাম!  আমার পিসির বাড়ি না মাসির বাড়ি ছিল ওখানে?  মনে নেই ৷ মনে পড়েনা ৷ মনে থাকার কথাও নয়? শাহনাজ পারভিন তুই কি আমার মাসিকে চিনিস? কিংবা আমার পিসিকে?  তুই আমার মাসির মেয়ে?  নাকি পিসির মেয়ে?  যে কোনোভাবেই আমার বোন!  

আমরা পরস্পর মৈত্রীর কথা বলি
আমরা পরস্পর ভালোবাসার কথা বলি
আমরা পরস্পর সংহতির কথা বলি 
আমরা পরস্পর সম্প্রীতির কথা বলি
আমরা পরস্পর সংস্কৃতির কথা বলি
আমরা পরস্পর মৈত্রী সেতু গড়ে তুলছি নদীর দুইপার জুড়ে
আর পারভিন বোন তোর ঠিকানা হয় নদীর মাঝজঠরে 

আমাদের বড়ো বড়ো কথা মুহূর্তে বিদ্রুপ করে ৷
এক লহমায় অশ্লীল নগ্ন মনে হয় ৷
কাঁটাতার শুধু সীমান্তে নয়
কাঁটাতার আমাদের বুকে গেঁথে গেছে আমূল ৷
ভুল সুতোয় গেঁথেছি আমরা প্রতিবেশীর রাখি
ভুল নির্মান হচ্ছে নদীর বুকে মৈত্রী সেতু
ভুল স্বপ্ন দেখি আমার পূর্বপুরুষের নদীমাতৃক বাংলাদেশ নিয়ে
সময় চলে গেছে বহুদূর সেসব রক্তধারা এবং জিনগত শেকড় উপড়ে নিয়ে ৷
শুধু থুথু লাগিয়ে লেফাফায় আটকে রেখেছি সব দুষ্টবুদ্ধি
যে কোনোদিন খুলে বেরিয়ে যেতে পারে সেসব ৷
পারভিনকান্ড বুঝিয়ে গেল আমাদের সুখের অতীত বুঝি হারিয়ে গেছে একেবারেই
আর সমস্ত শুভবোধ পরাভূত কাঁটাতারের দংশনে ৷

'বাবা' শব্দে পিতৃতর্পণ

#'বাবা' শব্দে পিতৃতর্পণ#

       'পিতা' একটি দুঅক্ষরের শব্দ ৷ এই শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার সৃষ্টিকথা ৷ আমাকে যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলেছেন ৷ আমাকে যিনি বিশ্বসংসার চিনিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি ঝড়বাদলাদিনে বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক রোষ থেকে রক্ষা করেছেন ৷ আমাকে যিনি সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করার মতো সাহস জুগিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি সফল জনক হিসেবে উত্তরণের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিয়েছেন তিনিই আমার পিতা ৷ ঠিক এমনই কিছু ব্যক্তিগত পরিবর্তন কিংবা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়েই হয়ে
 ওঠেন প্রত্যেক পিতা ৷ প্রত্যেকের কাছেই
 প্রত্যেকের পিতা এক বিশাল মহীরুহ ৷
 এক নির্ভরতার স্থল ৷ নিরাপত্তার জায়গা
 ৷ বিশ্বাসের ভূমি ৷ এক সুবিশাল ছায়াতরু
 ৷ সেকারণেই পিতাকে বসানো হয়েছে
 শ্রেষ্ঠতম সম্মানিত স্থানে ৷ সংস্কৃত শ্লোকে
 আছে—

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতাঃ

   একারণেই জগৎসভার নিয়ন্তাকে, বিশ্বস্রষ্টাকে বলা হয় 'পরমপিতা' ৷ বলা হয় 'এক পিতা হতে সবার উৎপত্তি' ৷ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গুরুকে পিতার আসনে বসানো হয় ৷ তিনিও পিতার সমতুল্য ৷ শিষ্য-শিষ্যাগণ তাঁর সন্তানসম ৷

      একসময় যে অর্থে পিতা শব্দটি ব্যবহৃত হত কালক্রমে তাই পরিবর্তিত হয়ে 'বাবা' শব্দে বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে ৷ সংস্কৃত 'বপ্তা' শব্দের অর্থ হল যে বপন করে ৷ এটি একটি বিশেষণ পদ ৷ এই 'বপ্তা' থেকে ধ্বনিতাত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ( বপ্তা> বপ্পা> বাপা> বাপু> বাবু> বাবা)  'বাবা' শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে ৷ সংস্কৃত ও হিন্দিতে 'বাপু' পিতা, সন্তান, মান্য ও সম্ভ্রান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় বাবু( বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ—রবীন্দ্রনাথ)  ৷ প্রাচীনবাংলায় যখন বৌদ্ধচর্চার প্রাধান্য ছিল তখন 'বপা' শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় ৷ প্রাচীন বৌদ্ধ দোঁহা ও গান, আদি বাংলাভাষার মান্য নিদর্শন চর্যাপদে পাই—'সরহ ভণই বপা উজকট ভইলা' ৷—চর্যা-৩২/৫ ৷ বাংলাদেশে মুসললমান রাজত্বের আগে 'বাপু' শব্দটির প্রচলন ছিল ৷ 'শুন বাপু চাষার বেটা'—খনা ৷ আবার মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে দেখি—'সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিত্তল/ঘষিয়া মাজিয়া বাপা কইরাছ উজ্জ্বল' ৷—কবিকংকন মুকুন্দরামচক্রবর্তী
-চন্ডীমঙ্গল ৷ পরবর্তীসময়ে মুসলমান রাজত্বকাল থেকে ফারসি 'বাবা' শব্দটি বাংলা শব্দভান্ডারে স্থান করে নেয় ৷তখন থেকে পিতা অর্থেই 'বাবা' শব্দটির বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে ৷

   বাংলার উপভাষাগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে অঞ্চলবিশেষে শব্দটি বাবা> বা'> বাবাজি> বা'জি> বাবু> বাউ> বাপ> বাপন ইত্যাদি নানাভাবে উচ্চারিত হয় ৷
ছোটোদের প্রাচীন খেলার ছড়াতে পাওয়া যায়—'আপন বাপন চৌকি চাপন/এই পুলাডা চকি চোর' ( চকি-খাটিয়া) ৷ সংস্কৃত প্রবাদে যেমন বলা হয়—'যৎ বীর্য তৎ পরাক্রম' তেমনি চট্টগ্রামী বাংলায় একটি সুন্দর প্রবাদ আছে—ভুঁইঅর গুণে রোয়া/বাফর গুণে ফুয়া' ৷ আবার কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ হালকা রসিকতায় দিনযাপনের বেদনার কথা প্রকাশ করেন—'বাপে পুতে ডাইক্কা ভাই/কুনুমতে দিন কাডাই' বলে ৷ যশস্বী সন্তানের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়—'বাপের নাম রাখছে' তেমনি কলংকিত সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়—'বাপের নাম ডুবাইছে' ৷ 'বাপ কা বেটা সিপাইকা ঘোড়া/কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া'—এই হিন্দি কহাবৎটি বাংলাতেও সম্পূর্ণ বা আংশিক ব্যবহার করা হয় কিংবা বলা হয়—'বাপের পুত' ৷ বেওয়ারিশ সন্তানের বিশেষণ হয়—'বাপে তাড়ানো মায় খ্যাদানো' ৷ সন্তানের প্রতি যত্ন, স্নেহ ও দায়িত্ববোধের সুন্দর নিদর্শন পাওয়া যায় 
একটি নোয়াখালি প্রবাদে—'হিম্বার লাই মাডিৎ রাখি ন/ উউনের লাই মাথাৎ রাখি ন' ৷( পিঁপড়ে ঘিরে ধরবে বলে মাটিতে রাখিনি ৷ উকুনে কামড়াবে বলে মাথায়ও রাখিনি) ৷ একটি গ্রাম্য শোলোকেও প্রকারান্তরে 'বাপ' শব্দটি এসেছে—'বাপে নাহি জন্ম দিল, জন্ম দিল পরে/ যখন পুতে জন্ম নিল মা ছিলনা ঘরে' ৷ (কুশ-রামায়ণের চরিত্র) ৷

  বাংলা লোকসাহিত্যের মতো প্রাচীন বাংলাসাহিত্যেও 'বাবা' এসেছেন নানাভাবে ৷ এর মধ্যে মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র ও রামায়ণের দশরথ চরিত্রদুটি কাহিনির পটপরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল ৷ মহাভারতের রক্তক্ষয়ী, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধটিও সংঘটিত হয়েছে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রস্নেহের কারণে ৷ তিনি আক্ষেপও করেছেন, 'অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে' ৷ রামায়ণে পিতা দশরথের একটি সিদ্ধান্তের কারণে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে সিংহাসনে আরোহনের পরিবর্তে চোদ্দো বছর বনবাসে কাটাতে হয় ৷ আর পুত্রবিরহাতুর দশরথকেও মৃত্যুশয্যায় শয়ন করতে হয় ৷ এরকম আরও ছোটোখাটো পিতৃচরিত্র দুই মহাকাব্যে রয়েছে ৷ রামায়ণ এবং মহাভারতে তো পিতাপুত্রের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনাও রয়েছে রাম ও লবকুশ এবং অর্জুন ও বভ্রূবাহনের মধ্যে ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তে জানি নৃশংস কংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে ঝড়জলের মধ্যে 'বসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে৷ নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে' ৷ মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে শিবকে দেখি কোনোরকম পিতৃদায়িত্ব তিনি পালন করেননা ৷ গাঁজা ভাং সেবন করেন ৷ শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান ৷ বাবা ভোলানাথ ৷ অন্নদামঙ্গলে দেখি ঈশ্বরী পাটনি বলছেন— আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ৷ কী সহজ সরল প্রার্থনা সন্তানের জন্যে ৷

ঐতিহাসিক কাহিনি অধ্যয়ন করলে আমরা দেখি মুঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন যখন অসুস্থ হন তখন সমস্ত হেকিম-বদ্যিরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলেননা ৷ তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল ৷ তখন পিতা বাবর তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনকে তাঁর জীবনের বিনিময়ে বাঁচানোর জন্যে ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন ৷ তারপর ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন ৷ কিন্তু সম্রাট বাবর আর বেশিদিন বাঁচেননি ৷ 'মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোনো ক্ষয়,/ পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়' ৷ কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর 'জীবন বিনিময়' কবিতায় মর্মস্পর্শী ভাষায় এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৷ আধুনিককালের অর্থাৎ এই সময়ের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবি শঙ্খ ঘোষও তাঁর জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এক আর্ত পিতার অবস্থান থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বাবরের প্রার্থনা' ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটির রচনাকাল ১৯৭৪ সাল ৷ 'কবিতার প্রাকমুহূর্ত' গ্রন্থে কবি উল্লেখ করেছেন—কবিকন্যা কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন ৷ দিন দিন তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ৷ সেসময়ে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি নির্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে পায়চারি করছিলেন ৷ হঠাৎ তার মনে পড়ে ঐতিহাসিক ঘটনাটি ৷ এই ঐতিহাসিক তথ্যকেই কবি এক নবতর তাৎপর্যে মন্ডিত করেন কবিতাটি ৷ এই শিরোনাম ব্যবহার করে আরো কিছু কবিতাসহ একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থটির জন্যে তিনি ১৯৭৭সালে আকাদেমি পুরস্কার পান ৷ ঐতিহাসিক চরিত্র বাবর মানবিক গুণে একজন যথার্থ পিতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান ৷ শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায়ও পরমপিতার কাছে প্রার্থনা করেন—

          আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
          জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?
          ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
          আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক ৷
              (বাবরের প্রার্থনা-শঙ্খ ঘোষ)

    রবীন্দ্রনাথঠাকুরের একটি অসাধারণ ছোটোগল্প 'কাবুলিওয়ালা' ৷ এই গল্পের প্রধান চরিত্র রহমত ৷ রহমত তার দেশের মাটিতে রেখে আসা শিশুকন্যাটির স্মৃতিচিহ্নকে বুকের মধ্যে ধারণ করে কোলকাতা শহরের পথে পথে পণ্য ফিরি করে ৷ রবীন্দ্রনাথ রহমতের পিতৃহৃদয়ের বেদনাকে উন্মোচিত করেছেন এই গল্পে—' কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ ৷ ফটোগ্রাফ নহে ৷ খানিকটা ভুষা মাখাইয়া কাগজের উপর তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে ৷ কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে—যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশু হস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধা সঞ্চয় করিয়া রাখে' ৷ এছাড়া একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় মনিবের শিশুসন্তানটি জলে ডুবে যাওয়ার প্রেক্ষিতে অপরাধবোধ থেকে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়ার পেছনে আপন সন্তানের সুখৈশ্বর্যের ছদ্ম আকাঙ্ক্ষাটিই রয়ে গিয়েছিল এক দরিদ্র পিতার মনে ৷ তারই নিদর্শন পাই রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটোগল্প 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা'য় ৷ আসলে বাবা শুধুমাত্র একটি শব্দ নয় ৷ মানবিকতার, মনুষ্যত্বের এক প্রতীক বাবা ৷ বাবার ভূমিকাই মুখ্য থাকে সন্তানের জীবনগঠনে ৷ বাবার মানবিক গুণগুলো সন্তান অনুকরণ করে ৷ শ্রেষ্ঠ বাবাই গড়ে তুলতে পারেন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান ৷

আমরা এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি ৷ কঠিন পরীক্ষারও ৷  আজকের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূষিত বাতাস ঢুকে গেছে ৷ হিংসা, স্বার্থপরতা, লোভ, হানাহানি বেড়ে গেছে সমাজে ৷ মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার বৃত্তিগুলো আজ অন্তর্হিত ৷ মায়া, মমতা, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা যেন আজ সুদূর আকাশের নীহারিকা ৷ মানুষের মানবিক গুণগুলো আজ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে ৷ বহু পিতার মধ্যে আজ পিতৃত্বের গুণগুলি খুঁজে পাওয়া দুস্কর ৷ ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্ষুদ্র মোহ আর ক্ষণিক সুখের হাতছানিতে আজ তারা নিমেষেই ভুলে যাচ্ছে পিতৃকর্তব্য ৷ বিশ্বায়নের ফলে পণ্যসংস্কৃতির আগ্রাসনে ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, শৃঙ্খলা ৷ পিতার পাশাপাশি সন্তানেরও যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বাবা মায়ের জন্যে ৷ কিন্তু তাও আজ অবহেলিত ৷ বার্ধক্যে এসে সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসহায় বাবা ৷ ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সন্তান নিতে পারছেনা বাবার শেষের দিনগুলোর দায়িত্ব ৷ সর্বোপরি এই করোনাক্লিষ্ট সময়ে দূরপ্রান্তে জীবিকার দাগিদে ব্যস্ত হয়ে এবং লকডাউনে আটকা পড়া সন্তান যেমন নিতে পারছেনা প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তেমনি আবার কোনো কুলাঙ্গার ও পাষন্ড সন্তান এই লকডাউনের মধ্যেই বৃদ্ধ বাবাকে গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসছে ৷ আমরা জানিনা এই অমানিশা থেকে পরিত্রাণ কবে ঘটবে আবার ৷ এই সময়ে সন্তানের লালনবঞ্চিত অসহায় পিতার হাহাকার ধ্বনিত হয় নচিকেতার জনপ্রিয় একটি গানে—

   ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
    মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার ওপার
    নানানরকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
    সবচাইতে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি
    ছেলে আমার-আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
    আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম ৷
—একেবারে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে সমকালের অসহায় পিতার যন্ত্রণার দিনলিপি ৷ সারাজীবন দায়িত্ব পালন করে শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয় বাবার ৷
   এই অসহায়তা এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাবা কিন্তু বাবাই ৷ সন্তানের কল্যাণই প্রতিটি পিতার একমাত্র কাম্য ৷ মুঘল সম্রাট শাহজাহান এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু হল পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ ৷ পিতার জীবদ্দশায় এর চেয়ে বিড়ম্বনা আর কিছু হয়না ৷ আর কিছু নয় ৷ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও প্রতিটি বাবা উচ্চারণ করেন—

    এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
    চাঁদ ডাকে  :  আয় আয় আয়
    এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
    চিতাকাঠ ডাকে  :  আয় আয়

    যেতে পারি
    যে-কোনো দিকে চলে যেতে পারি
    কিন্তু কেন যাবো?

    সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
     ( যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো—শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

Wednesday, June 17, 2020

মা য়া ব র ণ

মায়াবরণ
--------------
         - 

জমানো পাতাগুলো উল্টে যেতেই হয় সামনের দিকে 
ট্রাফিক নিয়মে দাঁড়ালেও থেমে থাকা যায় না 
পেছনে নিঃশ্বাস ফেলে অগুণতি দ্রুত আরোহী 
ফেলে আসা পথের ধুলো কখন হাওয়ায় উড়েছে 
মুছে যায় সমস্ত মায়াচিহ্ন ফেরা তো যায় না । 

পেছনে মুছে আমার পায়ের কোমল দাগ 
সমানে সামনে পা ফেলা আমি নিজেকেই হারাব 
একদিন। যেদিনের সংকেত জানা নেই আদৌ।

Sunday, June 14, 2020

ক ল হ

কলহ

কাল রাত থেকে চন্দ্রাবলি মেঘ পালিয়ে
আঁধারে তমালকুঞজে কালিয়াবিলাস
জেনে গেছে গোপযৌবনা কলহআঁচে

তাই ঘন ঘন বাজ পড়ার গর্জন,
 বিজলির ছোবল মেঘের কলজে বরাবর

Saturday, June 13, 2020

জী ব ন জ ল

জীবনজল

মহলে জল নেই কিংবা জলনির্মিত মহলও নয়
তবুও এ নির্জনমহল নীরমহল,জলপ্রাসাদ ৷

মাণিক্যরাজ বুঝেছেন  জলের অবদান
জীবন জাগিয়ে রাখার জলপিরিত আর জলার্ত যাত্রা

তাই অনিদ্র জলের ঢেউ মহলের গায় চাঁটি মেরে গায় জীবনের ভাওয়াইয়া

Tuesday, June 9, 2020

মৌ সু মি

*** মৌসুমি ***
    

দক্ষিণে যাওয়া বারণ
বালাইর দোহাই পাড়ে সবাই
অথচ দক্ষিণ থেকে তুমি উড়ে এলে
চরাচর শীতল হয়ে যায়
নির্বিষ সাপের মতো মাথা নোয়ায়
খরশান দহনকাল

ও কালো মেয়ে, তুমিই মৌসুমি

কোথাকার বাঙালি কোথায় দাঁড়ায়

কোথাকার বাঙালি কোথায় দাঁড়ায়
********************************
এটা আমার বাবার পরিচয়পত্র ৷ 1948 এ কোলকাতা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা প্রস্তুতিতে সুপারভাইজারের দায়িত্ব সামলেছিলেন ৷ গতকাল বিরাটি সংলগ্ন বিষরপাড়ার আমাদের পিসতুতো দাদা আমার ছেলের হাতে তুলে দিলেন তার ঠাকুরদাদার আইডেন্টিটি কার্ডটি ৷ অশ্রুসজল চোখে দাদা বললেন আমি আর কদিন আছি ৷ তোমাদের সম্পদ তোমরা বুঝে নাও ৷ দেশভাগ আমাদের যে কতোটা ছন্নছাড়া করেছে এই ভিটেতে পা রেখে অনুভব করলাম ৷ যিনি আমাদের ভদ্রাসনকে এতোদিন আগলে রেখেছেন, কী দৈন্যদশা এই আবাসের  ? অথচ আমরা শুধু চিঠি চাপাটিতেই সম্পর্কটা জিইয়ে রেখেছি এতোদিন ৷  এসে না দেখলেই বোধহয় ভালো ছিল ৷ উনি খুবই আগ্রহের সঙ্গে বলছেন, তোমরা এসো ৷ ঘর-টর একটা করো ৷ আমিও এক কোনায় শেষ কটা দিন কাটিয়ে দিই ৷ ঝড়বৃষ্টিতে তো বহুদিন কাটালাম ৷ আমি শুনছি আর ভাবছি অন্য কথা ৷ শেষ বয়সে আমি কী আর মিলিয়ে নিতে পারব নিজেকে ৷প্রয়োজনীয় পরিচিতি আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে ৷ তার চেয়ে ত্রিপুরায় আমার একটা নিজস্ব পরিমন্ডল রয়েছে ৷ আমার কাতরতা সেদিকেই ৷ সবচেয়ে গুরুতর যে বিষয়টা লক্ষ্য করছি ৷ আমাদের দুভাইয়ের কথোপকথনে কোনো আগ্রহই নেই আমাদের উত্তর প্রজন্মের ৷ তার কাছে আমার বাবার ছবি 'কেবলই ছবি' ৷ তাদের ভদ্রাসন হয়তো রাজারহাটের এগারো তলা ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ কুঠুরি আর তার বনসাই বাগিচার লন ৷ নাড়ির টান এভাবেই ছিন্ন হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ৷ আমার সন্ততি, বাঙালির আগামী প্রতিনিধি কোথায় থিতু হবে কে জানে ! আমি কী বলব?  দাও বর মোরে হেন, আমার সন্তান যেন, চিরদিন থাকে ..?..?..?

স্নি গ্ধ সং লা প

স্নিগ্ধসংলাপ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সন্ধ্যাকুসুম আতর বিলোবার আগেই 
পাঁচনি ফেলে পালাতে হবে মাঠচাতালের শেষ গন্ডিতে

আঁধারের ঝাপটায় ডানা ঝেড়ে উড়ে যাবে নিশিপাখি

রাসের মন্ডপে রাখা আড়বাঁশি লম্পট ঠোঁটের আশায়
বাসরের ঘিয়ের বাতির সলতে উসকে যাবে ভৌমতেলে

যে কথা কতোকাল উসখুস করেছে ওষ্ঠের গুহায়
আজ তার জন্মদিন পালনের সাইরেন বেজে উঠেছে

এসো,প্রিলিউডের মূর্ছনায়  সমস্বরে বলে উঠি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি ৷

Tuesday, May 26, 2020

আ মা র নাম দু র্ না ম

Asoke Deb আমি তোমাকে তুই তো অপরাধী বলিনি বাক্যটা আবার পড়ার অনুরোধ রইল ৷ পাঠক তোমার অষ্টপয়েন্ট পড়ে আমাকেই এমন ভাববেন বলেছি ৷ লক্ষ করে থাকবে হয়তো তোমার পোস্টে যাঁরা কমেন্ট করেছেন তাঁদের অনেকেই আমার পোস্টেও করেছেন তো ৷
তোমাদের সন্ধ্যার সেই শান্ত উপহার সাব্রুম থেকে গিয়ে উপভোগ করেছি ৷ অবশ্যই তোমার ইনবক্সীয় নিমন্ত্রণে ৷ আর সেই সিরিজ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের একজন আমাকে ছাগদুগ্ধ পানের পরামর্শ দিয়েছিলেন ৷ গায়ে মাখিনি কোনোদিন ৷ তারপরেও নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্যে প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছি ৷ শারীরিক অসুস্থ সেই উদ্যোক্তার কুশলসংবাদও জেনেছি ৷
   দলগোত্র নাই আমার ৷ যে কয় রাম ৷ তার লগেই যাম ৷ যদি সৃজনশীল হয় ৷
একবার একটা আলোচনাচক্রে আলোচনাকালে দর্শকাসনে উপবিষ্ট ভারি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করিনি বলে  মঞ্চ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তাদের একজন আমাকে তুলোধুনো করলেন আমার আলোচনায় নাকি তাদের কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেছেন ৷ কারা কারা নাকি দর্শকাসনে মুখিয়ে ছিলেন কখন তাঁদের নামটা উচ্চারণ করি ৷ অথচ আলোচনার চারদিন আগে আমি আমার স্ক্রিপ্ট জমা দিয়েছিলাম ৷
 একজন বিশিষ্ট কবির জন্ম শতবর্ষ উদযাপনে আমাকে সভাপতি করা হয় ৷ মঞ্চের পেছনে বিরাট ব্যানার ৷ কমিটির সবার নাম আছে ৷ সভাপতির নাম নেই ৷
সর্বশেষ কদিন আগে একটা প্যারোডি পোস্ট দিয়েছিলাম 'লকডাউনে অনেকেই বন্ধু বটে হয়/ সুসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয় ৷' সেখানেও দুঃখজনক বিষয় আছে ৷ আমার দীর্ঘদিনের কবিবন্ধু ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন ৷ আহ্লাদে আঠেরো দুগুণে ছত্রিশখানা হয়ে রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে উনার কখানা কবিতা স্বকন্ঠে পাঠের ভিডিও পোস্ট করলাম ৷ অনেকেই দেখলেন, শুনলেন ৷ মন্তব্য করলেন ৷ হা, হতোস্মি ৷ সেই বন্ধু কবি আমার পোস্টের ছায়াও মাড়ালেননা ৷ 
 প্রায় সবাই নিজের যে কোনো কাজ দেখা শোনার জন্যে আমাকে ইনবক্স করেন ৷ আজও আছে ৷ আর আমার কোনোকিছুতে ' আরে ফালাইয়া থ'  ভাবে এড়িয়ে যান ৷ আর আমি সব নেমনতন্ন রক্ষা করি ৷ আর অপছন্দের কিছু বললে কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য, ভাববাচ্য কিছুই বাদ যায়না ৷ 
 ভালো থাকো ৷ আনন্দে থাকো সবাইকে নিয়ে ৷  আরো একবার অনন্ত শুভেচ্ছা ৷

Tuesday, May 19, 2020

বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় ও আমার সময়

বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় ও আমার সময়

Dibakar Debnath আপনার লেখাটি পড়ে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি ৷ আপনাদের কাল আর আমাদের কালে বোধহয় খুব বেশি ফারাক ছিলনা ৷ তাই দৃশ্যপট মিলে গেছে অনেকটা ৷ একটা তিক্তকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমি সেদিন কলেজে প্রথম প্রবেশ করেছিলাম ৷ ভর্তি হয়ে যেদিন প্রথম ক্লাস করার জন্যে দূরের চাম্পাকাম্পা হাফওয়াল ঘরটাতে ঢুকি তার কিছুক্ষণ পরেই হৈ হৈ করে আমাদের বের করে নিয়ে আসা হল প্রিন্সিপাল রুমের সামনে ৷ তাঁকে নাকি ঘেরাও করা হবে ৷ সে বছর বিলোনিয়া কলেজ সরকার অধিগ্রহণ করে ৷ অথচ পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে পাঠরত এবং নবীন সব ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে উন্নয়ন তহবিলের নামে কুড়ি টাকা করে নেওয়া হয়েছে ৷ এটাকা ফেরত দিতে হবে ৷ দাবি জানাতে গিয়ে একসময় ছেলেরা প্রিন্সিপাল বি এন ঘোষালকে শারীরিক নিগ্রহও ৷ ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা লম্বা ফর্সা বীরেন্দ্রনাথ ঘোষাল মহোদয় জোড়হাত করে কেঁদে ফেলেন ৷ পরে জেনেছে তিনি যাঁকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন এবং বাবা বলে সম্বোধন করতেন সেই ছাত্রনেতাটিই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ৷ প্রিন্সিপাল স্যর ডেভেলপমেন্ট কমিটির সঙ্গে কথা বলে টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেন ৷ তার পরদিন থেকে তাঁকে আর কলেজে দেখিনি ৷ শোনা যায় অপমানে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান ৷ আমাদের টাকাগুলো আর কেউ ফেরত পায়নি ৷ প্রচার হয় এ টাকা উনি মেরে দিয়েছেন ৷ কেউ কেউ বলেন সে টাকা বেড়ালের পিঠে ভাগের মতো অন্য একপক্ষ গায়েব করে দিয়েছেন ৷
 মহাবিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমি রবাহুত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম ৷ সে অনুষ্ঠানের বিলোনিয়ার এক ওজনদার জনপ্রতিনিধি ভাষণ দিতে উঠে কলেজ সৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে এই মহাবিদ্যালয়ের জনক মহেন্দ্র মুহুরীর কথা একবারও উচ্চারণ করেননি ৷ এই মহাবিদ্যালয়ে আমি ১৯৭৩—৭৬ পড়েছিলাম ৷ বহু গুণী অধ্যাপকদের মধ্যে অরূপরতন স্যরের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ নিবিড় রয়েছে ৷ দুবছর আগে গেছিও তাঁর বাড়িতে ৷ পরিতোষ স্যরেরও খবর পাই ভাষাচার্য ড. পবিত্র সরকার মারফত ৷ আর যদি আত্মশ্লাঘা না হয় ইতিহাসের প্রয়োজনে লিখি ৷ আপনি যে শান্তিনিকেতন কম্প্লেক্সটার কথা উল্লেখ করলেন সেখানে সিঁড়িতে পা দিয়ে করিডরে ঢুকলে ডানদিকে দুটো রুম ছিল আর বাঁদিকে পরপর কয়েকটা ক্লাসরুম ছিল ৷ সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে ডানদিকের রুমের চুনকামহীন দেওয়ালের গায়ে একদিন দুস্টুমি করতে গিয়েই চক দিয়ে লিখে  ফেলেছিলাম শান্তিনিকেতন ৷ আসলেই সেদিন গোটা মহাবিদ্যালয় চত্বর শান্তিনিকেতন ছিল ৷❤️💝

Wednesday, May 13, 2020

কো য়া রে ন্টা ই নে র ক বি তা



এখন আমরা প্রত্যেকে মহান হয়ে উঠছি,
এখন আমরা প্রত্যেকে মানব হয়ে উঠছি,
সমূহ যন্ত্রণার ভেতর আমাদের বিশুদ্ধ পর্যটন ৷
ঘরের ভেতর বন্দী থেকেও আমরা আন্তর্জাতিক যেন—
পৃথিবীর আর সব প্রান্তের বেদনা আমাদের
ঘরের ভেতরেও শোকপরিবেশ গড়েছে ৷
আমরা প্রতিবেশীর মুখ দেখিনি অনেকদিন
অথচ আজ মুখোমুখি জানলায় চেয়ে থাকি ৷
আমাদের সদর দরজা বন্ধ থাকত ভিখিরির ভয়ে
আজ ছুটছি আমরা ত্রাণ নিয়ে বস্তির গলিতে ৷
দেশের বাড়ির কথা বারবার মনে পড়ে ৷ ফেলে আসা গ্রাম, উঠোনের সিঁদুরে আম
ছেলেবেলার সাথী খোঁড়া ভজন আর তার বাঁশির সুর ৷
কেমন আছে সুভদ্রা ধাইমা
মা চলে যাবার পর যে অঝোরে কেঁদেছিল আমাদের উঠোনে ৷

আবার ওড়াতে ইচ্ছে করে ভোমরা ঘুড়ি পাড়ার আকাশে,
বেলাশেষে কদবেলগাছটার ভেসে ওঠা শেকড়ে বেঁধে রাখলে
সারারাত অন্ধকারে অদ্ভুত গুঞ্জন তুললে
বাদুড়েরা পালিয়ে যেত ঘোষেদের আমবাগান থেকে ৷

এখন প্রতিদিন মনে হয় আগামী দিন ভোর হবে কিনা,
আজকের রাতটাও শেষ হবে কিনা তাও জানা নেই বলে
বেশি বেশি করে বন্ধুদের সুপ্রভাত আর শুভরাত্রি
জানাবার কথা একবারও ভুল করিনা ৷
সময় ভালো হলে এসে বেড়িয়ে যাবার দাওয়াত দিয়ে রাখি—
বন্ধুরাও আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখে ৷
এখন সবাই মনের কথা উজাড় করে লেখে, 
এক একটা শাস্ত্রবাক্য হয়ে ওঠে আমাদের প্রতিটি পংক্তি ৷ আমরা এখন পূর্বজর লেখার গভীরে গিয়ে মুগ্ধ হই ৷
এতোদিন পাতে তুলিনি সতীর্থের যে সৃষ্টিকে
আজ যেন মহার্ঘ মনে হয় ৷ ছড়িয়ে দিই স্বকণ্ঠে ৷
যে অনুজের দিয়ে যাওয়া সংকলনগ্রন্থ এতদিন
পড়েছিল অনাদরে, আজ ধুলো ঝেড়ে খুলে দেখি পরম মমতায় ৷

আজ ঘরবন্দী জীবনে বারান্দায় চাটাই পেতে
 হাতে নিচ্ছি দেশজ পুরাণ  আর মঙ্গলকাব্য ৷
সেইসব সৃজনের মূল্য যেন নতুন করে জীবনকেই
মেলে ধরে পৌরাণিক সহজিয়ায় ৷
হারানো দিনের চিরায়ত পদাবলি উঠে আসে কন্ঠে ৷
বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ায়
শান্ত ও সরল জীবনের ঘরোয়া বিন্যাস
মুর্শিদের কাছে আকুল প্রার্থনার মদত করে ৷
আর হৃদয়ে ডোবানো অশ্রু নিবেদিত হয় মানুষের অসুখ সারাবার জন্যে ৷

এই বৈরী সময়ে, এই ত্রস্তকালে আমাদের ভেতর জেগে উঠেছে পশু ও প্রকৃতিপ্রেম ৷
আকাশের অগণিত নক্ষত্রকে,চাঁদ ও সূর্যকে আপন আত্মীয় মনে হয়
বনভূমি আর পাহাড়ের মাঝে খুঁজে পাই পরম প্রতিবেশীকে
নদী ও ঝরনা কিংবা বৃষ্টিপতনের শব্দ
বুকের ভেতরের কোনো অলৌকিক দেহতত্ত্ব আজ ৷
বনের যত নিরীহ স্বাধীন পশু ও পক্ষীকূল
কেবল নিঃস্বার্থ ভালোবেসে যেতে ইচ্ছে হয় তাদের
কাছে টেনে নিতে মন চায় ভীষণ ৷
আর আমরা কেবল পরস্পরের থেকে সাড়ে তিনহাত দূরে
সরে যাচ্ছি ক্রমাগত ৷
 
আমরা আজ কাতর, আমাদের অন্তঃস্তলে চাপা পড়া সমস্ত মহত্ব ও মমতা আজ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে ৷
দানে ও পুনর্বাসনে আমাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা
আমরা চাইছি আমাদের সন্ততির সাথে
প্রতিবেশীর ঘরেও উনুন জ্বলুক
যে যার সাধ্যমতো বাড়িয়ে দিচ্ছি ইন্ধন ৷
আমাদের সমস্ত কৃতকর্মের জন্যে মার্জনার বিনিময়ে
দারুণ দারুণভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের ৷
সমস্ত উৎসবের জৌলুষ এবং অর্থের অহংকারের
দীপাবলি বর্জন করে ডাকের সাজ নিয়েই আমরা পার্বনে মেতে উঠতে চাই ৷

তার জন্যে সমস্ত অনৈতিক ও অশালীন অঙ্গবস্ত্র পরিত্যাগ করে
ক্রমাগত আমরা মানুষই হয়ে  উঠছি আর একবার ৷ মানুষ হয়ে উঠছি যেন ৷

ত্রিপুরার বাংলা কবিতার হাজার বছর

ত্রিপুরার বাংলা কবিতার ইতিহাস সংক্রান্ত এ পর্যন্ত যে সমস্ত মান্য কাজ হয়েছে সেগুলোতে প্রাচীনতার ক্ষেত্রে রাজমালাকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে ৷ আমাদের কবিতার ইতিহাস যে হাজার বছর অতিক্রান্ত সেই বিষয়ে আমার একটা দুর্বল প্রবন্ধ আছে ৷ রাজ্যের বিশিষ্ট কবি দিলীপ দাসের অনুরোধে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার 'বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব ১৪২২র স্মারকগ্রন্থেরজন্য প্রবন্ধটি লিখেছিলাম ৷ "ত্রিপুরার বাংলা কাব্যের হাজার বছর" শিরোনামে সেটি ওই গ্রন্থে প্রকাশিতও হয়েছিল ৷ প্রবন্ধটি সেদেশে প্রশংসিত হয়েছিল ৷ আমাদের রাজ্যেও কবি দীলিপ দাসসহ অনেকেই পড়েছেন ৷ মুখে প্রশংসাও করেছেন ৷ পরবর্তীতে সেটি বর্ধিত আকারে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কবি মধুমঙ্গল বিশ্বাসের দৌড় সাহিত্য পত্রিকার ৩৩ বর্ষ • জানুয়ারি ২০১৭ এর বিশেষ ক্রোড়পত্র  : ত্রিপুরা সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ৷ সেখানেও পাঠক ও গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রবন্ধটি ৷ একজন তো তাঁর ত্রিপুরার সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থে এক জায়গায় ছোট্ট দুটো ঊর্ধ্ব কমার মধ্যে রেখে আমার পুরো প্রবন্ধটাই ঢুকিয়ে দিয়েছেন ৷ আজকের দিনেও ত্রিপুরার কবিতার আলোচনার সময় কথাটা  ক্ষীণভাবে কেউ কেউ তোলেন ৷ কিন্তু কে প্রথম বিষয়টা তুলেছেন সেটা ভাসুরের নামের মতো ট্যাবুতে অনুচ্চারিত রয়ে গেছে ৷ আমার তোলা প্রসঙ্গটা ভুল হলে আলোচনা সমালোচনা করা হোকনা ৷ আমি সমৃদ্ধ হই ৷ এই প্রবন্ধ প্রকাশের পরে ত্রিপুরার বাংলাকবিতা বিষয়ে অত্যন্ত সুন্দর ও পরিশ্রমী একটি বিশাল গবেষণা অভিসন্দর্ভও প্রকাশিত হয়েছে ৷ বহু খোঁজখবর করে দুষ্প্রাপ্য তথ্যউপাত্ত সংযোজিত হলেও অধীনের লেখাটা আলোচনায় আসেনি ৷ এই সমস্ত দুঃখজনক কারণে আমার আর পরিশ্রম করে কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছে হয়না ৷  সমালোচনা এরাজ্যে দূর অস্ত ৷ নস্যাৎও করেননা ৷ স্রেফ এড়িয়ে যান ৷ অথবা নকল করে নিজের মহল্লায় বাহাদুরি নেন ৷ আমি যাঁর সৃষ্টির নিবিড় আলোচনা করলাম তাঁকে আমার কোনো গ্রন্থের আলোচনা করতে বললে হেসেই উড়িয়ে দেন ৷ ভাবি কী ছাই পাঁশ লিখেছি এতদিন ৷

Thursday, April 30, 2020

কো য়া রে ন্টা ই নে র ক বি তা



এখন আমরা প্রত্যেকে মহান হয়ে উঠছি,
এখন আমরা প্রত্যেকে মানব হয়ে উঠছি,
সমূহ যন্ত্রণার ভেতর আমাদের বিশুদ্ধ পর্যটন ৷
ঘরের ভেতর বন্দী থেকেও আমরা আন্তর্জাতিক যেন—
পৃথিবীর আর সব প্রান্তের বেদনা আমাদের
ঘরের ভেতরেও শোকপরিবেশ গড়েছে ৷
আমরা প্রতিবেশীর মুখ দেখিনি অনেকদিন
অথচ আজ মুখোমুখি জানলায় চেয়ে থাকি ৷
আমাদের সদর দরজা বন্ধ থাকত ভিখিরির ভয়ে
আজ ছুটছি আমরা ত্রাণ নিয়ে বস্তির গলিতে ৷
দেশের বাড়ির কথা বারবার মনে পড়ে ৷ ফেলে আসা গ্রাম, উঠোনের সিঁদুরে আম
ছেলেবেলার সাথী খোঁড়া ভজন আর তার বাঁশির সুর ৷
কেমন আছে সুভদ্রা ধাইমা
মা চলে যাবার পর যে অঝোরে কেঁদেছিল আমাদের উঠোনে ৷

আবার ওড়াতে ইচ্ছে করে ভোমরা ঘুড়ি পাড়ার আকাশে,
বেলাশেষে কদবেলগাছটার ভেসে ওঠা শেকড়ে বেঁধে রাখলে
সারারাত অন্ধকারে অদ্ভুত গুঞ্জন তুললে
বাদুড়েরা পালিয়ে যেত ঘোষেদের আমবাগান থেকে ৷

এখন প্রতিদিন মনে হয় আগামী দিন ভোর হবে কিনা,
আজকের রাতটাও শেষ হবে কিনা তাও জানা নেই বলে
বেশি বেশি করে বন্ধুদের সুপ্রভাত আর শুভরাত্রি
জানাবার কথা একবারও ভুল করিনা ৷
সময় ভালো হলে এসে বেড়িয়ে যাবার দাওয়াত দিয়ে রাখি—
বন্ধুরাও আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখে ৷
এখন সবাই মনের কথা উজাড় করে লেখে, 
এক একটা শাস্ত্রবাক্য হয়ে ওঠে আমাদের প্রতিটি পংক্তি ৷ আমরা এখন পূর্বজর লেখার গভীরে গিয়ে মুগ্ধ হই ৷
এতোদিন পাতে তুলিনি সতীর্থের যে সৃষ্টিকে
আজ যেন মহার্ঘ মনে হয় ৷ ছড়িয়ে দিই স্বকণ্ঠে ৷
যে অনুজের দিয়ে যাওয়া সংকলনগ্রন্থ এতদিন
পড়েছিল অনাদরে, আজ ধুলো ঝেড়ে খুলে দেখি পরম মমতায় ৷

আজ ঘরবন্দী জীবনে বারান্দায় চাটাই পেতে
 হাতে নিচ্ছি দেশজ পুরাণ  আর মঙ্গলকাব্য ৷
সেইসব সৃজনের মূল্য যেন নতুন করে জীবনকেই
মেলে ধরে পৌরাণিক সহজিয়ায় ৷
হারানো দিনের চিরায়ত পদাবলি উঠে আসে কন্ঠে ৷
বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ায়
শান্ত ও সরল জীবনের ঘরোয়া বিন্যাস
মুর্শিদের কাছে আকুল প্রার্থনার মদত করে ৷
আর হৃদয়ে ডোবানো অশ্রু নিবেদিত হয় মানুষের অসুখ সারাবার জন্যে ৷

এই বৈরী সময়ে, এই ত্রস্তকালে আমাদের ভেতর জেগে উঠেছে পশু ও প্রকৃতিপ্রেম ৷
আকাশের অগণিত নক্ষত্রকে,চাঁদ ও সূর্যকে আপন আত্মীয় মনে হয়
বনভূমি আর পাহাড়ের মাঝে খুঁজে পাই পরম প্রতিবেশীকে
নদী ও ঝরনা কিংবা বৃষ্টিপতনের শব্দ
বুকের ভেতরের কোনো অলৌকিক দেহতত্ত্ব আজ ৷
বনের যত নিরীহ স্বাধীন পশু ও পক্ষীকূল
কেবল নিঃস্বার্থ ভালোবেসে যেতে ইচ্ছে হয় তাদের
কাছে টেনে নিতে মন চায় ভীষণ ৷
আর আমরা কেবল পরস্পরের থেকে সাড়ে তিনহাত দূরে
সরে যাচ্ছি ক্রমাগত ৷
 
আমরা আজ কাতর, আমাদের অন্তঃস্তলে চাপা পড়া সমস্ত মহত্ব ও মমতা আজ দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছে ৷
দানে ও পুনর্বাসনে আমাদের নতুন নতুন পরিকল্পনা
আমরা চাইছি আমাদের সন্ততির সাথে
প্রতিবেশীর ঘরেও উনুন জ্বলুক
যে যার সাধ্যমতো বাড়িয়ে দিচ্ছি ইন্ধন ৷
আমাদের সমস্ত কৃতকর্মের জন্যে মার্জনার বিনিময়ে
দারুণ দারুণভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে আমাদের ৷
সমস্ত উৎসবের জৌলুষ এবং অর্থের অহংকারের
দীপাবলি বর্জন করে ডাকের সাজ নিয়েই আমরা পার্বনে মেতে উঠতে চাই ৷

তার জন্যে সমস্ত অনৈতিক ও অশালীন অঙ্গবস্ত্র পরিত্যাগ করে
ক্রমাগত আমরা মানুষই হয়ে  উঠছি আর একবার ৷ মানুষ হয়ে উঠছি যেন ৷

Saturday, April 25, 2020

ডিটান

Dibyendu Nath  এমন কিছু বাক্যাংশ বাশব্দগুচ্ছ যা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয় ৷ অর্থাৎ যিনি কথা বলছেন তাঁর কথার প্রতি শ্রোতার নজর কাড়ার জন্যে, কথাটার গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে এই বিশেষ বাক্যাংশ বা শব্দগুচ্ছ কথার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় ৷ সেই অনুযায়ী 'দৃষ্টিআনয়ন' শব্দ থেকে 'দিঠি আনা',  দৃষ্টির 'দিঠি' রূপটি পদাবলি সাহিত্যে আছে 'এক  দিঠ করি ময়ূর ময়ূরী কন্ঠ করয়ে নিরীক্ষণ' ৷ তা 'দিটান'>ডিটান শব্দটি রূপান্তরিত হয়েছে ৷ 'ডিট' শব্দটি যে সিলেটিতে দৃষ্টি বোঝায় তার উদাহরণ হল, সংস্কারবশত আমরা বলি,'অবায় চাইছনা ৷ 'ডিট' লাগবো ৷ এই 'ডিট লাগা' মানে নজর লাগা ৷

Tuesday, March 31, 2020

মেইলবক্স খুলে দেখতে চাইছি কে আজ বোকা বানাল এদিনেতেমন কোনো হাস্যকর প্রয়াসের কোনো ছাপ নেইকেবল পাতার পর পাতা জুড়ে কান্নার মাতমঅশ্রুসিক্ত ইমোজি সব উঠে আসছে ওস্তাদজির সানাই হয়েআর টাইমলাইনের পাতা জুড়ে ঘন ঘন ট্যাগভয়ংকর উল্লাসে ফেটে পড়া সব হিংসাময় সব বসন্তকথাআমার চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে আছেপঞ্চাশ হাজার মুখের করুণ বৃত্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দুলছেএ ভূখন্ড সীমিত হওয়ায় কেউই অপরিচিত নয়,সবারই হাল হকিকৎ জানা ৷ উনিশ বিশ সবাই সমান বিত্তবান ৷আমার জনপদে এখন মন্বন্তরের নীরবতা নেমেছেআশাহত কুপিবাতি হাওয়ায় কাঁপছে, কখন বুঝি নিভে যায় ৷এই অন্ধকারেই দেখি একদল মর্ষমান শরীর ডঙ্কা বাজিয়ে মশালনাচে নেমেছে ৷ কী তীব্র তাদের হল্লাবোল! ক্রমশ পাথর হয়ে খসে পড়ে যাচ্ছে অজস্র কান্নামুখ আর উল্লসিত হিংস্র অবয়বগুলো শ্বাপদ হয়ে বেরিয়ে পড়ছে ৷প্রতিবেশী বলে আর কেউ নেই মানুষের শরীর নিয়েলক্ষ্মণরেখার দুইপাশে অসহিষ্ণু খাদক এবং অসহায় খাদ্যআজ বসন্তপুষ্পের দিনে এভাবেই সাজানো আমার প্রোফাইল ৷

Tuesday, March 17, 2020

#আত্মবিলাপ



আজ যাদের উপর আঘাত হানা হল ওরা আমার সন্তান ৷ আমার পরমজন ৷ আমার আত্মীয় ৷ আমার স্বজন ৷ আমার প্রতিবেশী ৷ আমার সতীর্থ ৷ আমার ছাত্র ৷
আমিও আহত ৷ আঘাত আমার বুকেও লেগেছে ৷

 সাঁইত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছি ৷ একবছর আধিকারিকতা ৷ বহু ছাত্রের সান্নিধ্যে এসেছি ৷ বহু ছাত্র সতীর্থ হয়েছেন ৷ প্রশিক্ষণ কর্ম সম্পাদনের সুবাদে বহু সতীর্থ ছাত্র হয়েছেন ৷ কাজকর্ম দেখার সুযোগ পেয়েছি একদম পাশে থেকে ৷ হাতে গোনা ব্যতিক্রমী দুচারজন ছাড়া কাউকে দেখিনি পেশায় গাফিলতি করতে ৷ দশহাজার তিনশো তেইশও তার ব্যতিক্রম নয় ৷ দীৰ্ঘদিন তাঁরা ছিলেন শিক্ষক ৷ আজকের মতো সংখ্যায় চিহ্নিত নন ৷ এঁদের চাকুরির শুরুতে পাঁচদিনের একটা প্রশিক্ষণ হয়েছিল ৷ সেই প্রশিক্ষণে আমারও কিছু দায়িত্ব ছিল ৷ সেদিন তাদের উজ্জ্বল জোড়া জোড়া চোখে দেখেছিলাম প্রত্যয় ৷ একদিকে নিজেদের অভাবী সংসারে হাসি ফোটানো, বাবামায়ের স্বপ্নকে সফল করা আর রাজ্যের দুর্বল শিক্ষাপ্রবাহকে চাঙ্গা করা ৷ আমাদের উদ্দীপক বাক্যে তাঁরা তৈরি হয়ে গেছেন শিক্ষকতার জন্যে ৷ যার ফলশ্রুতিতে তাঁদের শিক্ষাদানকর্মে, পেশাগতক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতার উদাহরণ কেউ তুলতে পারেনি আজও ৷ আর্থিক দৈন্য ও প্রতিকূলতার মধ্যেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন ৷ ছাত্রদরদী হয়েছেন ৷ অনেকে প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে ৷অনেকসময় নিজের গোনাগুনতি আয়ের অর্থ ব্যয় করে ৷ প্রশিক্ষণ শেষের সন্ধ্যায় হাজারো মশাল জ্বালিয়ে যে পবিত্র শপথ তাঁরা সেদিন নিয়েছিলেন তার অন্যথা হয়নি আজও ৷ আজ যখন তাঁদের রোজগারের নিরাপত্তায় টান পড়েছে ৷ তাঁরা যখন ক্রমশ অসহায়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলেছেন পরিবার পরিজনদের নিয়ে, যখন তাঁদের জীবনের মোড় ঘোরানোর দিন পেরিয়ে গেছে , অনিশ্চয়তা যখন প্রতিটা মুহূর্তকে রাহুর মতো গ্রাস করে চলেছে  সেসময়ে তাঁরা উচ্চকিত হয়েছেন ৷ 'বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান' নিয়ে তাঁরা  পথে নেমেছেন ৷ শিক্ষক তো তাঁরা ৷ তাই অহিংস আবেদনের পথে হেঁটেছেন তাঁরা ৷ তাঁদের এই পথহাঁটা একদিনের নয় ৷ আকস্মিকও নয় ৷ কিন্তু  রাজা আসে ৷ রাজা যায় ৷  ডিজিটাল যুগে সংখ্যাভুক্ত শিক্ষকদের দিন বদলায়না ৷ সময়ে পার্শ্বচর ৷ অসময়ে পশ্চাদাঘাত ৷ এই তাঁদের পরিণতি ৷ 

আর আজ যা ঘটে গেল এই নিরীহদের উপর তার জন্যে বোধহয় নিন্দাকেও মুখ লুকোতে হবে লজ্জায় ৷

 ভাবছি ৷ কীভাবে বাঁচবেন এই মানুষগুলো ৷এই শিক্ষকগণ ৷ এই ক্রমাঙ্কচিহ্নিত নুয়েপড়া প্রাণ ৷ আরো সহস্র উৎকণ্ঠিত প্রাণ নিয়ে ৷ কোন্ পথে?

কী  স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম আমি সেদিন এই মানুষগুলোকে ৷ 'সে যে মিথ্যা কতদূর'!  আমার সেই সন্ধ্যায় মোমবাতিধরা আঙুলগুলো তখনি পুড়ে যায়নি কেন?

Saturday, March 14, 2020

রি পু দ ল ন



    ছুটছে ৷ছুটছে ৷ একটি শিশু ছুটছে ৷ একটি কিশোরী ছুটছে ৷ একটি যুবতী ছুটছে ৷ এক প্রৌঢ়া ছুটছে ৷ এক বিগত জরতী  ছুটছে ৷ আফটার অল একটি নারী ছুটছে ৷ 

'অপনা মাসে হরিণা বৈরী', 
আপন যোনিতে নারী ৷

একবিংশ শতাব্দীতে একদল শ্বাপদ পথে বেরিয়ে পড়েছে ৷
তারা সব বিপরীত লিঙ্গের ৷ বিকৃত লিঙ্গেরও ৷ তাদের বাড়বাড়ন্ত মহল্লায় ও মলে ৷ তাদের রাজত্ব আসমভূমিপর্বত ৷ তাদের লিঙ্গের উল্লাসে আকাশ ফাটে বাতাসে কাঁপন ধরে ৷ পশুরা লজ্জা পায় ৷ পুরুষরা দেখেও দেখেনা ৷ ধার্মিক চোখ বুঁজে ইষ্টনাম জপে ৷ জননায়ক স্বগোত্রের গন্ধ খোঁজে ৷ রমণীকুল ফুঁপিয়ে কাঁদে ৷ চিৎকার করে কেঁদেও থই পায়না ৷ দ্রৌপদীর শাড়ি খুলতেই থাকে খুলতেই থাকে ৷ পুরুষোত্তম লুকিয়ে পড়ে নিকুঞ্জবনে ৷

গবেষণাগার ৷ আসে শিশুটি ৷ আসে কিশোরী ৷ আসে যুবতী ৷ আসে প্রৌঢ়া ৷ আসে জরতী ৷ মূলত আসে নারী ৷ অষ্টাদশ দিবসরজনী অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী দ্বিতীয় লিঙ্গের প্রাণপাত চলে ৷ রিরংসাদমনের প্রতিষেধক পেয়ে যায় গোপন গবেষণায় ৷

ছুটছে ৷ছুটছে ৷ একটি শিশু ছুটছে ৷ একটি কিশোরী ছুটছে ৷ একটি যুবতী ছুটছে ৷ এক প্রৌঢ়া ছুটছে ৷ এক  জরতী  ছুটছে ৷ আফটার অল একটি নারী ছুটছে ৷
 
এবারে আর প্রাণভয়ে নয় ৷ সুর্পনখার মতো ইন্দ্রজালে ৷ নকল প্রাণভয়ে ৷ গোপন লুকোচুরি খেলায় ৷ রিরংসুকদলের আগে আগে ৷ ধরা পড়ে যায় ওরা ৷ শুয়ে পড়ে তারা ৷ হাজারো নখরের আঁচড় শরীরে ৷ চরমক্ষণের অপেক্ষা ৷ উত্তেজনা চরমে ৷ হাজারো উচ্ছৃত লিঙ্গ ও অন্ডকোষ এগোতে থাকে ৷ গুপ্তধনের দিকে ৷ কোষাগারের দরজায় আঘাত হানার সঙ্গে সঙ্গে......৷ গগনভেদী চিৎকার ৷ কুরুক্ষেত্রের কোলাহল ৷ ছিটকে যায় হাজারো লিঙ্গ আর অন্ডকোশের কার্তুজ ৷ ইতিউতি ছড়ানো লিঙ্গহীন পুরুষের লাশ ৷ শিশুকিশোরীযুবতীপ্রৌঢ়াজরতী একসঙ্গে উঠে আসে ৷ গলা মিলিয়ে হাসে ৷ প্রাণ খুলে ৷ লাশপ্রান্তরে ৷ বলির বাজনা বাজনা বেজে ওঠে আকাশমন্ডপে ৷

কোথায় যেন গুমরে কাঁদে তেমন একটা দিন! !

Wednesday, March 11, 2020

দা ঙ্গা



এত রাতে কাকে পাবে সে ৷ কদিন ধরে চারদিক থেকে যা খবর আসছে ৷ পাড়ার সবাই তটস্থ হয়ে আছে ৷ দিনের বেলাও ঘর থেকে কেউ বেরুচ্ছেনা ৷ রাতে তো অসম্ভব ৷ কেলাব ঘরে বিকেলে একটা মিটিন হয়েছিল পাড়ার সবাইকে নিয়ে ৷ বউয়ের এই অবস্থার কথা জানিয়ে যায়নি মিটিনে ৷ তবে সবার যা মত তাতে সে সহমত পোষণ করে বলে জানিয়েছে ৷ পাড়ার অনেকেই জানে তার সমস্যার কথা ৷ তাই তাকে রেহাই দেওয়া হয়েছে ৷

মিটিনে বয়স্ক দুএকজন সম্প্রীতির কথা বললেও কয়েকটা উটকো বহিরাগতের উস্কানিতে পাড়ার কয়েকটা ছেলে হৈ হল্লা করে সভা পন্ড করে দিয়েছে ৷ ওরা বলেছে মিস্টি কথায় চিরা ভিজনের দিন গেছেগা ৷ ওরা বলছে মারের বদলে মার দিতে হবে ৷
বুড়োরা যেন ঘরে গিয়ে বসে থাকে ৷ এখন জোয়ানদের দিন ৷ ওপর থেকে খবর এসেছে ওগুলোকে ঝাড়ে বংশে শেষ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই ৷ ছেলেগুলোর মিলিত চিৎকারে সন্ধ্যার পাখিগুলো কিচিরমিচির করে উঠল বাসা ছেড়ে দিয়ে ৷ পাড়ার ঘরে ঘরে একটা গুমোট আতঙ্ক ৷

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বউয়ের শরীর আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷ ব্যথায় ককিয়ে উঠছে বউটা ৷ আর অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে তার দিকে ৷ উঠে দাঁড়ায় সে ৷ একটা কিছু করতে হবে ৷

অনেক রাতে হন্যে হয়ে ঘুরে কোনো যানবাহনে দেখা পেলনা ৷ হতাশ যখন ফিরে আসছে তখন একটা একটা ঝুপড়ির পাশে একটা রিক্সা পড়ে রয়েছে দেখতে পেল ৷ কাছে গিয়ে চালক বা সওয়ারি কাউকে দেখতে পেলনা ৷ একটু ভেবে সে নিজেই রিক্সাটা টেনে নিয়ে চলল বাসার দিকে ৷ কাজ সেরে আবার রেখে দেবে সেখানেই ৷ সকালে মালিককে বুঝিয়ে কিছু টাকা দিয়ে দেবে ৷

পাড়ার কাছাকাছি পৌঁছুতেই দেখল পাড়ায় আগুন চারদিকে ৷ লোকজনের চিৎকার ৷ মার ৷ মার ৷ ধর ৷ ধর ৷ কাইট্টা ফালা ৷  আগুনের আলোয় দেখা যাচ্ছে একদল লাঠিসোটা দা কিরিচ নিয়ে ধাওয়া করছে ৷ বাঁচাও ৷ বাঁচাও ৷ আর্তনাদ চিৎকারে একটা থমথমে পরিবেশ ৷ ওর বুকের ভেতর মোচড় দেয় ৷ বউয়ের জন্যে ৷ আর একটা স্বপ্নের জন্যে ৷ দ্রুত পৌঁছে যায় তাদের বাড়ির কাছাকাছি ৷ আর দুএকটা বাসার পরে ওদের ঘরে লাগবে আগুন ৷ দ্রুত ছড়াচ্ছে ৷

—এই....এই....খাড়অ ৷ শালার শালা ৷ কই যাইতাছচ ৷ 
—ধর তারে ৷ ভাগতাছে ৷ 
সে দাঁড়িয়ে পরে ৷ না না ভাই ৷ আমি ভাগতাছিনা ৷
 ভাগতাছৎনা ৷ বাল ফালাইতাছৎ ৷ রিসকা লইয়া কিতা করতাছৎ?
—না দাদা ৷ আমার বউ ৷ ব...অ...উ... ৷
—পুন্দেদা দিমু তর বউ ৷ বান তারে ৷ কাইট্টাঅই লামু আজগা তরে ৷
দাদা ৷ আমারে মাইরেননা ৷ আমি প্রাণভিক্কা চাই আপনেরার কাছে ৷ আমার কথাডা হুনেন ৷
চিৎকার চেঁচামেচিতে শোনা যায়না তার কথা ৷ পিছমোড়া বেঁধে ফেলে তাকে ৷ তার বাসার সামনে ৷ সে অসহায় চেয়ে থাকে বাড়ির দিকে  ৷
দড়িতে টান পড়ে ৷ চল আজগা তোর শেষদিন ৷

ঠিক এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে কান্না ভেসে আসে দুটি মানুষের— মা মা ৷ ওঙা ওঙ্গা ৷ মা..ওঙ্গা...মা...ওঙ্গা ৷ আর আর্ত চিৎকারভরা বীভৎস রাতের আকাশ থেকে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— দাঙ্গা...দাঙ্গা...দাঙ্গা...৷

জীবনদাত্রী







জাতীয় সড়কে গাড়িঘোড়া এখন আর নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করতে পারেনা ৷ নির্দিষ্ট সময় ধরে সিআরপিএফ এর এসকর্ট বেষ্টিত হয়ে চলাফেরা করতে হয় ৷ যখন গাড়িগুলো চলে তখন মনে হয় বিশাল কনভয় চলছে ৷ এভাবেই প্রধান দুটো পাহাড়ই আধা সামরিক বাহিনীর কঠোর অনুশাসনের মধ্যে চলাচল করতে হয় ৷ দিনে দুবার মাত্র এই সুযোগ থাকে গাড়গুলোর এবং  যাত্রীদের ৷

কিন্তু আজ কিছুতেই প্রথম এসকর্টটা ধরতে পারলনা প্রবাল ৷ গতরাতে বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল ৷ ঘুমোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে ৷ উঠতে পারেনি সময়মতো ৷ কাজেই জাতীয় সড়কপথে যাওয়ার আশা ছেড়েই দিল ৷ রাধানগর বাসস্ট্যান্ট থেকে গাড়ি ধরল ৷ এপথে এসকর্ট নেই ৷ নিয়মশৃঙ্খলার ঘেরাটোপ নেই ৷ সময়ও কম লাগে ৷ তবে রিস্কি ৷ কিছু করার নেই প্রবালকে আজ অফিস ধরতেই হবে ৷ নতুন একটা প্রজেক্টে ভিজিটার্স আসবে ৷ ইম্প্লিমেন্টিং অফিসার সে ৷ যেতে বাধ্য সে ৷

গাড়িতে যাত্রীদের যথেষ্ট ভিড় ছিল ৷ সিটের প্যাসেঞ্জার ছাড়াও দাঁড়ানো যাত্রী ছিল অনেক ৷ সারাদিনে এরাস্তায় এখন দুটি গাড়ি চলে ৷ মোহনপুরে পৌঁছানোর পর অধিকাংশ যাত্রীরা নেমে যায় ৷ গাড়িটা ফাঁকা ৷ সাকুল্যে আটজন যাত্রী ৷ প্রবালই একমাত্র বাঙালি ৷ আর সবাই উপজাতি অংশের ৷ ড্রাইভার এসিস্টেন্টও ৷ প্রবালের পাশের সিটে জানলার ধার ঘেঁষে বসেছে এক উপজাতীয় তরুণী ৷ কিছুদূর চলার পরই সহযাত্রী দুজনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হয় ৷ মেয়েটি বিবাহিত ৷ খোয়াই সুভাষপার্ক বাড়ি ৷ ওখানেই ওর বরের বইয়ের দোকান ৷ ও  নিজে স্কুল টিচার ৷ চম্পাবতী নাম ৷ চম্পাবতী দেববর্মা ৷ বেশ মিশুকে ৷ নিজেই কথাবার্তা বলে গেছে অনর্গল ৷ জেনে নিয়েছে প্রবাল কেন কোথায়  যাচ্ছে ইত্যাদি ৷

গাড়িতে কয়েকজন বলাবলি করছিল গতকাল নাকি সুবলসিংএ গাড়ি থামিয়ে  কয়েকজনকে নামিয়ে নিয়ে গেছে ৷ পরিস্থিতি থমথমে ৷ প্রবালের ধূমপানের অভ্যেস আছে ৷ গাড়িটা চড়াই উঠতে শুরু করার পরই প্রবাল বলে উঠল, স্যরি, আমি একটু পেছনে যাচ্ছি ৷ কিছু মনে করবেননা ৷ আমার একটু বদঅভ্যাস আছে ৷

প্রবা গিয়ে পেছনের লম্বা ফাঁকা সিটটায় জানলার ধারে বসে একটা সিগারেট ধরাল ৷ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বাইরে তাকিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তাটা দেখছে ৷ দূরের উঁচু পাহাড় দেখছে ৷

ঢালু পথে নামতে নামতে হঠাৎ গাড়িটা জোরে ব্রেক কষল ৷ বেশ কিছু লোক মুহূর্তে গাড়িটা ঘিরে ধরল ৷ ওদের সবার হাতে ধারাল দা, টাক্কাল ৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চম্পাবতী নিজের সিট ছেড়ে ছুটে ওর কাছে চলে এল একমুহূর্তে ৷
— এই মশাই আপনার সবকিছু জানা হয়ে গেছে ৷ বাঁচতে হলে তাড়াতাড়ি নামটা বলুন ৷
—প্রবাল, প্রবাল মিত্র ৷
—কোথায় থাকেন?
—আগরতলা ৷ জয়নগর ৷ নন্দা অপটিকসের পেছনের বাড়ি ৷
— ঠিক আছে ৷ আপনি কোনো কথা বলবেননা ৷ একদম চুপ থাকবেন ৷
 বলে একদম প্রবালের গা ঘেঁষে বসল ৷
ততক্ষণে বেশ কটা গাট্টাগোট্টা গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল ৷ যাত্রীদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করে সোজা পেছনের সিটে গিয়ে প্রবালের সামনে দাঁড়াল ৷
— এ্যাই ৷ কি নাম তর?
—প্রবাল মিত্র ৷ জবাব দেয় চম্পাবতী ৷
— তুমি উত্তর দিছস ক্যারে?
— হ্যা ত আমার স্বামী লাগে ৷
একটা তরল স্রোত বয়ে যায় প্রবালের শরীর বেয়ে ৷
—বারি কই তার ? নক্ বিয়াং?
—আগরতলাঅ ৷
—বিয়াং থানাই? 
—খোয়াইঅ ৷
ওরা আর প্রশ্ন করেনা ৷ নেমে গিয়ে গাড়িটা ছেড়ে দেয় ৷ 

গাড়ি চলতে থাকে ৷ কৃতজ্ঞতায় প্রবাল চম্পাবতীর দুটো হাত মুঠো করে ধরে ৷

Thursday, March 5, 2020

আঁ চ ল



সকল বাকদান ব্যর্থ হয়
কারো জন্যে শব্দের ইমারত ওঠে না
তবুও কলম নিয়ে নির্বাক বসে থাকা

সময়কে ঠেলে পেরিয়ে যাব বলে
দ্রুত ছুটে চলা এক হঠকারি সিদ্ধান্ত
যতোই স্পন্দন সুস্থির আছে বলে বিশ্বস্ত
কালচত্বর বেয়ে ঘুণের রাজত্ব বেড়েছে গোপনে

শরীরের অনেক প্রত্যঙ্গ বাজিতে হেরে বসে আছি
 দেউলিয়া হবার আগে সব দেনা
শোধ করে যেতে হবে, ফিরে যেতে হবে
সেই নির্ধারিত নদীর প্রস্তাবিত চরের আঁচলে

এতো জল খেলাম সাত ঘাটের, সাত ধারার নামে
তবুও অনন্ত তৃষ্ণা গেল কই?
সুবর্ণ পিপাসাই বুঝি টেনে টেনে রাখে
তুমি কী তারই ভাড়াখাটা জনমজুর
আমার পিপাসু বুকে হাতুড়ি পেটাও অসময়ে ৷

Saturday, February 29, 2020

'কুম'

    'কুম' গভীর খাত অর্থে ৷ 'কুম্ভ' থেকে কুম ৷ কলসি আকৃতির নদীগর্ভ থেকে এই নামের উৎস ৷ পুকুরে বা জলাশয় কলসি ডুবিয়ে যখন জল সংগ্রহ করা হয় সেসময় কলসির মুখ ছোটো থাকায় জল অনেকটা কুন্ডলী পাকিয়ে কলসিতে প্রবেশ করে ৷ প্রবেশমুখ ছোটো থাকায় এবং ভেতরে অনেকটা বিস্তৃত জায়গা থাকায় দ্রুত জল অপসারণের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় ৷ নদীগর্ভেও ভূতলে যদি গভীর কোনো গহ্বরের সষ্টি হয় সেখানেও নদীর জল দ্রুত নিচের দিকে নামার কারণে উপরে জলঘূর্ণির সৃষ্টি হয় ৷ এই জায়গায় নদীর গভীরতা বিশ-ত্রিশ হাত বেশি হয় ৷ এইজাতীয় জায়গাগুলো বিপজ্জনক ৷ জলের পাকে পড়ে মনুষ্য, গবাদি পশু ও নৌকাডুবি ঘটে থাকে ৷ মঙ্গলকাব্যখ্যাত 'কালীদহ' এইধরনের খাতের উদাহরণ ৷

Wednesday, February 26, 2020

বসন্তলাপ



অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছয়টা ঋতু ৷ ছয় রূপে সালংকারা প্রকৃতি ৷ মনমেজাজও তার ছয় রকমের সময়ে সময়ে ৷ আর মর্জির রকমারি প্রমান রাখে বছর জুড়ে ৷ প্রান্তর জুড়ে ৷ অরণ্য-কন্দরে ৷ লোকালয়ে ৷ ভিটেমাটিতে ৷

মাটি ঘিরে মানুষ ৷ মাটিকে সাজায় মানুষ ৷ মাটির দখলদারি মানুষই করে ৷ মাটি নিয়ে মারামারি করে ৷ মাটিকে ঘিরে সম্পদ গড়ে ৷ বিত্তবৈভব ৷ সেও একান্ত নারীজনের মতো ৷ লালনে ও রমণে ৷ জমির রমণ কর্ষণ ৷ তার লালনফল ফসলের ভার ৷ বাগবাগিচা ৷

যথাকালে বাগিচার বুলবুলি ফুলশাখায় দোল দিয়ে কবিকে জাগায় ৷ কবি বিভোর হয় ফুলের চর্চায় ৷ যেমন বিমুগ্ধ থাকে শব্দচর্চায় ৷ ঋতুকালে বাগানের গাছগাছালি কবিকে ভালোবেসে ফেলে ৷ সবুজ পত্রগুচ্ছ কবির গায়ে শরীর বুলিয়ে দেয় ৷ শিহরণ তোলে ৷ বাহারি ফুলেরা অনিমেষ চেয়ে থাকে কবির দিকে ৷ আলতো করে চুমু খায় কবির গালে ৷ কোমল অঙ্গে ৷

বর্ষার ধারাপতনের মরসুম শেষ হলে গাছেরা অধীর হয়ে ওঠে ৷ শুষ্কদিনে চায় মানুষের আশ্লেষ ৷ নিবিড় কবিতা ৷ লালন ৷ যতন ৷ প্রথম বর্ষণজলের বার্তা আবার যতদিন না আসে ততদিন গাছে-মানুষে চলে গোপন অভিসার ৷ অসম দাম্পত্য ৷

কতদিন হল বর্ষা ফিরে গেছে ৷ বসন্তের নবীন সমাগমে প্রকৃতি চঞ্চলা ৷ চটুলা ৷ দীর্ঘ শুষ্ককালে বনানী কবিকে পেয়েছে কাছে ৷ তার বৃক্ষেরা তার পত্রপল্লব তার পুষ্পসমাহার কবির ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে মোহাবিষ্ট ৷ বসন্তের বনানী হয়ে উঠতে চায় সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী ৷ কবির সঙ্গে ঝাঁপ দিতে চায় ঋতুরমণে ৷

এমন আদিম ঋতুও যেন শত্রু হয় বনানীর ৷ আকাশ ছেয়ে আসে কালোমেঘ ৷ মাটিতে প্রথম জলবিন্দু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে আসবে কবির লালনঋতু ৷ দীর্ঘকালের জন্যে আবার বিরতি ৷ অমৃতজল এবার মাটির শুশ্রূষা করবে ৷ প্রয়োজন হবেনা কবির সিঞ্চনহাতের ৷ বেশ কিছুকালের জন্যে ৷

শিউরে ওঠে বনানী ৷ তার বুকের মধ্যে বিচ্ছেদগান বাজে ৷ হৃদয়ের তারে সুর ওঠে বিরহের ৷ বসন্তে পতিসান্নিধ্য বঞ্চিতা নায়িকার অন্তর্দহনে দগ্ধদিনের আর্তসংলাপ সঙ্গীত হয় ৷ চিরকালীন বিলাপের ৷

 বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে ৷

Thursday, January 30, 2020

সা জ

তোমাকে সাজাবো বলেই সমস্ত উপকরণ সাজিয়ে বসি
গুছিয়ে রাখি হাতের কাজ

তুমি এলেই আমার অভিযাত্রা 
সফল রাস্তা খুঁজে পায়

Saturday, January 18, 2020

গী ত গো বি ন্দ ম


বাইরের সংকেত জানানোর জন্যে দরোজায় রাখা কলিং বেল নিয়ম মেনেই কথা বলে যায় ৷ সারারাত ঘাসের ডগায় অপেক্ষা করে শিশির ভোরের সূর্যমুখের আশায় ৷ লাল আভায় নিজেকেও রাঙিয়ে নেওয়ার সুখস্নান ৷ নিকটকথা দিয়ে মুড়ে দেওয়া মনমতো জানালা পর্দাআঁটা সহবৎ শিখে নেয় ৷ অনবরত ডোরবেল বেজে গেলেও যদি দরোজার ওপার থেকে সাড়া না আসে তবে নিবেদনের জন্যে পদাবলি জেগে থাকবে কী সদরঘাটে?  রাধার নামে বাধারঘাটে যখন হুইসিল বাজিয়ে ছেড়ে যায় রাজধানীর ট্রেন আনন্দবিহারের উদ্দেশ্যে ৷ বিরহের মীড় যেখানে প্রবল গেঁথে যায় ধুলিজমিন ছুঁয়ে, ভেজা বালিতে কী লেখা যাবে পদপল্লবমের গোপন বাসনার কথা ৷ তাহলে তো আর একটা গীতগোবিন্দের জন্যে তুলট কাগজ কেঁদে যাবে ৷ তোমার তাতে কী সায় আছে রাই, সই?

Thursday, January 16, 2020

ব য় ন



গভীর রাতলিপি নিবিড় পাঠের পর
দরোজায় ঘন্টি বেজে যায় বিরতিবিহীন
রাতচরা সরীসৃপের অবোধ্য সংকেতের মাঝে
একটা সুতোবাঁধা  নির্দেশ গোপনে ছড়িয়ে যায় 
ঘুমকাতর জনপদ ও জঞ্জালের অচেতন অবয়বে

আগামী রুটিন ঘুরে ফিরে আশা করে ভাবী বয়ন

Tuesday, January 14, 2020

মা ঘ


কুমারী উষ্ণতা এগিয়ে যায় যৌবনস্তরে
মাঘ এসেছে ভোরের দরোজায় নক করে করে
 খুল্লনার বারোটি মাসের তীব্রতম সময়
প্রবল গরিবানা পারে নি হারাতে ভালোবাসা 

আজো শেষ রাতে কাঁথায় বোনা নকসি সুতোতে
দৈবওম ছড়ায় অকৃপণ উদার ভোরাই গানে 
তুমি এখনো ইমেল করো মেসেজ পাঠাও 
তাই আমার দিনকথা ভরে ওঠে নিত্য দীনকাঁথায়

Sunday, January 12, 2020

ত্রিপুরা রাজ্যে হাতির প্রাচুর্য

ত্রিপুরা রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চল একসময় হাতির জন্য বিখ্যাত ছিল ৷ পার্শ্ববর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছিল হাতির প্রাচুর্য ৷ এই অঞ্চলে ছিল 'হাতির দোয়াল' অর্থাৎ হাতির বাসস্থল ৷ ত্রিপুরা রাজ্যে এমন বেশ কয়েকটি হাতির দোয়াল ছিল ৷ আগরতলা শহরের বড়দোয়ালি একসময় ছিল হাতির বড়সড়ো বিচরণক্ষেত্র ৷ হাতি ধরার জন্যে  বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি করা হত ফাঁদ ৷ হাতির প্রিয় খাদ্য কলাগাছের বাগানে ঘেরা থাকত এই ফাঁদ ৷ বাগানের মাঝে থাকত গভীর পরিখা ৷ যা নরম গাছ লতাপাতা দিয়ে ঢাকা থাকত ৷ কলাগাছের লোভে এসে বুনো হাতির দল এই গভীর পরিখায় পড়ে যেত ৷ তারপর পোষা হাতি দিয়ে এদের ধরা হত ৷ এই ফাঁদকে বলা হত খেদা ৷ এখানে ছিল প্রচুর 'খেদা' ৷ প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকায় 'হাতি খেদার গান' নামে পালাগানে এই অঞ্চলের বর্ণনা আছে ৷ হাতি নিয়ে কিংবদন্তী, লোককাহিনিও রয়েছে ৷  ককবরক লোককথায় নিষেধ না মেনে যাদুপুকুরে  স্নান করায় শরীর ফুলে গিয়ে 'ভাইবোন হাতি হয়ে যাবার গল্প' রয়েছে ৷ লংতরাই পাহাড়ে খোঁড়া হাতি বিচরণের কিংবদন্তী রয়েছে ৷ ত্রিপুরা-চট্টগ্রামের পাহাড়ে যে শ্বেত হস্তী ছিল তারও প্রমান পাওয়া যায় প্রাচীন কাব্যগ্রন্থে ৷ কৃষ্ণমালায় আছে— 'ডাঙ্গর ফা রাজার কালে থানাংচিতে থানা ৷/ থানাংচি না মিলিলেক রাজাতে আপনা ৷৷/ থানাংচিতে এক হস্তি ধবল আছিল ৷/ হেড়ম্ব রাজায় তাকে চাহিয়া পাঠাইল ৷' সেই শ্বেত হস্তি তো আজ লুপ্ত হয়ে গেছেই ৷ যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এই হাতিও অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে ৷

জন্মদিনে কী আর আমি.......



' কিবা বার্তা কি আশ্চর্য পথ বলি কারে
কোন্ জন সুখী হয় এই চরাচরে' ৷
মহাভারতের একটি কাহিনিতে আছে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে কটি প্রশ্ন করেছিলেন ৷ বার্তা কী,  আশ্চর্য কী, পথ কাকে বলে আর এ সংসারে কে সুখী?  যুধিষ্ঠির সব কটি হেঁয়ালিমূলক প্রশ্নের দুর্দান্ত দার্শনিক উত্তর দিয়েছিলেন ৷  কী আশ্চর্য বলতে যুধিষ্ঠিরের জবাব ছিল-প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এত প্রাণীকুল মারা যাচ্ছে এবং এটাই হল নিয়তি, চিরন্তন পরিণতি ৷ মানুষ সর্বক্ষণ এই চিরন্তন ধারাকে দেখে আসছে ৷ তথাপি মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে কী আকুল ৷ এটাই হল আশ্চর্য ৷
     আমাদের এক একটা জন্মদিন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় ইতিদিনের দিকে ৷ আমরাও জানি তার পরিণতি ৷ পরিণতও হই আমরা ৷ আমরা জন্মদিনকে পালন করি ঘটা করে ৷ শুভেচ্ছা,ভালোবাসা, আশীর্বাদে ভরে যায় জন্মদিনের পরিমন্ডল  দীর্ঘায়ুর  চিরপথ ৷ আমরা চাই প্রতিটি মানুষ চিরজীবিত হোক ৷ নির্মল আমাদের বাসনা ৷ 'মলিন মর্ম মুছায়ে' ৷ এক আন্তরিক রেওয়াজ আমাদের জীবন ঘিরে ৷ একের জন্মদিনে আসে অজস্র শুভকামনা ৷ প্রিয়জনের জন্মদিনেও প্রতিবিম্বিত হয় সেই শুভায়ুর বাসনাসুষমা ৷ 
        বর্ষপঞ্জীনির্ধারিত ক্ষণ অনুযায়ী আজ আমার জন্মদিন ৷ সারাদিনব্যাপী অজস্র ফোন, মুখোমুখি শুভেচ্ছা, সামাজিক মাধ্যমে শুভতোষ বার্তার বন্যা বয়ে গেছে ৷ আমি ভেসে গেছি সেই বানে ৷ আরও আরও বহুকাল বেঁচে থাকার, আরও আরও বেশি করে জীবনকে ছুঁয়েছেনে দেখার সুতীব্র কাঙ্ক্ষা জাগছে ৷ চিরসুন্দর জীবন কতো সুন্দর ৷ 
       তবে আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন আমার কোনোদিন হয়নি ৷ আমার সন্তানদেরও জন্মদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করিনি কোনদিন ৷ কিন্তু আমার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এক অভিনব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম আমি আজ সন্ধ্যায় ৷ আজ সকালের ট্রেনে রওনা হয়ে কুমারঘাট হয়ে সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছি কাঞ্চনপুর 'অণুভাবনায় সাহিত্য উৎসব' এ যোগ দিতে ৷ বনতটের সম্পাদক হারাধন বৈরাগি,রসমালাইর অমলকান্তি চন্দ এবং দোপাতার দিব্যেন্দু নাগের যৌথ উদ্যোগে আগামীকাল কাঞ্চনপুর ডাকবাংলোর কনফারেন্স হলে আয়োজন করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানের ৷   সন্ধ্যায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের একঝাঁক গুণী লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকারদের মধ্যে দেবব্রত দেবরায়, সস্ত্রীক শ্যামলবৈদ্য ও পার্থ ঘোষ, বিমল চক্রবর্তী, অপাংশু দেবনাথ,  জহর দেবনাথ, নিশীথরঞ্জন পাল, অভিককুমার দে, জয় দেবনাথ, বিজন বসু, সাচিরাম মানিক, চন্দনকুমার পাল, বাংলাদেশ থেকে আগত জাকির আহমদ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত সন্দীপ সাহু ও সুশান্ত নন্দীসহ আরো বেশ কয়েকজন সৃজনকর্মী এই কনফারেন্স হলে রীতিমতো কেক কেটেই পালন করলেন আমার জন্মদিন ৷ এই সন্ধ্যায় যেন আমাদের অতীতের বঙ্গভূমির প্রতিনিধিরাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আন্তরিক আলিঙ্গনে ৷ আজকের অজস্র আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা, শুভকামনায় আমি আপ্লুত,  আমি অভিভূত ৷ আমি সিক্ত হলাম ৷ আমি স্নাত হলাম এক স্বর্গীয় অবগাহনে ৷ সবাইকে আমার অন্তরের গভীর শুভকামনা জানাই ৷ আপনাদের / তোমাদের শুভবার্তাকে কুর্নিশ করি ৷ আমিও চাই সবাই ভালো থাকুন ৷ সুখে থাকুন ৷ শান্তিতে থাকুন ৷ প্রত্যেকের জন্মদিন আরো আরো জন্মদিন বয়ে আনুক প্রত্যেকের জীবনে ৷ ইচ্ছে হয় জীবনকে ডেকে বলি, হে জীবন, আমাদের জন্যে আরও কিছু সময় বরাদ্দ করো ৷ আরো কিছু মহার্ঘ মুহূর্ত দাও আমাদের সবার জন্যে ৷ হে জীবন! জীবন হে!

সং ক্রা ন্তি

 হাত কী মোহনীয় হয়ে উঠবে এই সংক্রান্তির সন্ধ্যায়
নিকোনো উঠোন আলপনায় রাঙানো হয়ে গেলে ক্লান্ত হাত
পড়শির পরশ চাইবে নিভৃতে অন্তত প্রশংসামুখর দুচোখ
যেমন মাহেন্দ্রসূর্য কুসুমশোভন হাসিতে স্বচ্ছ উঠোনে বুলোবে চোখ

পিটুলিগোলার রঙ ভেসে উঠতেই
তোমাকেও মনে হয় সেজে উঠেছ
মাঘসকালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
বুড়ির ঘরের সামনে যেন আগুন উত্তাপের একমাত্র পরিষেবাপুষ্ট
রক্তিম আঁচের আভায় একমাত্র তুমি যেন সুন্দরী হয়ে ওঠো কুয়াশাভোরে 

পৌষের শেষ সকাল এভাবেই প্রাতঃভ্রমণ সারে তোমাকে নিয়ে ৷

Thursday, January 2, 2020

শব্দব্যবহার

কীর্তন থেকে কেত্তন কিভাবে হল সেটা উল্লেখ করছি—     কীর্তন(তৎসম)>কেত্তন(অর্ধতৎসম), কী>কে,(স্বরসঙ্গতি), র্ত>ত্ত(বর্ণদ্বিত্ব) ৷