Tuesday, August 30, 2022

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য আমার বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন জীবনভর এতো লাঞ্ছিত হয়েছেন যে, সে কথাগুলো আর বলতে চাইতেননা শেষদিকে । তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না । সর্বোপরি তাঁর কর্মকান্ডের ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে  যাওয়ার একটা প্রধান কারণ তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাম্রপত্র গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ । ভারতের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ‍্যোগ গ্রহণ করেন । সেসময়ে সাব্রুম মহকুমায় বসবাসকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ‍্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক আশুতোষ দে প্রমুখগণ, নিজেদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি বাবাকেও অনুরোধ করেন কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন‍্য । স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত মণীন্দ্র ঢালী সেসময়ে সাব্রুম শহর থেকে হেঁটে ছোটোখিলে গিয়ে বাবকে অনুরোধ করেন তাঁর আবেদন জমা দেওয়ার জন‍্যে । কিন্তু বাবার একই কথা ছিল, আমি কলাপত্রের ( তাম্রপত্রকে বাবা এই শব্দ বলতেন ) জন‍্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করিনি । শেষ মুহূর্তে বিলোনিয়া থেকে সুরেশ চৌধুরী ও হারাণদাদু ( বিপ্লবী শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী– যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে উল্লিখিত আছে ) খবর পাঠান বাবার কাছে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন‍্য । সত্বর দরখাস্ত পাঠাবার জন‍্য । তাঁরা কয়েকদিনের মধ‍্যে সবার কাগজ জমা দিয়ে দেবেন । কিন্তু বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন । যেহেতু আমার প্রয়াত পিতৃদেব এইধরনের অভিমানী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেকারণে আমরাও  স্বাধীনতসংগ্রামীর সন্ততি বলার মতো গর্বিত পরিচয় দেওয়ার সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম । যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যাচ্ছি এই মহকুমায় অবস্থানকারী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সন্তানদের জীবনমানের তেমন কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি । এমন কোনো বিশেষ পরিচিতিও পায়নি । এক প্রজন্ম পরেই পূর্বজদের সব অবদান স্মৃতির অতলে চলে গেছে ।

মাঝে মাঝে কথার ছলে বাবার মুখে যতটুক শুনেছি, স্বর্গীয় অনাদিরঞ্জন সেন , স্বর্গীয় মনোরঞ্জন বর্ধন ( মনাদা ), বিভূতি চক্রবর্তী, স্বর্গীয় রেবতী পাল, স্বর্গীয় সুরেশ চৌধুরী, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী, অমর সরকার প্রমুখ আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন একই বিপ্লবীদলের সদস‍্য । তাঁদের নেতা ছিলেন শচীন্দ্র চন্দ্র পাল । তারাগুজার নবীনচন্দ্র সেনের গোলকানন্দ ঔষধালয় ছিল ফেনীতে । আমাদের দাদু অর্থাৎ আমার বাবার মামা রজনীকান্ত নন্দীর ( যিনি সেকালে আর কে নন্দী নামে সেকালে সমধিক পরিচিত ছিলেন ) 'সাধনা ঔষধালয় ঢাকা'-র বিপণী ছিল ফেনীর পাঁচগাছিয়া রোডে । সেকারণে অনাদিরঞ্জন সেনের সঙ্গে আমার বাবা মনোরঞ্জনের নিবিড়  বন্ধুত্ব ছিল । গোলকানন্দ ঔষধালয় বিপ্লবীদের মিলিত হওয়ার গোপন স্থান ছিল । বাবা বলতেন গোলকানন্দ ঔষধালয়ের 'এন সুধা' নামে কালাজ্বরের ঔষধ এবং সাধনা ঔষধালয়ের 'সাধনা দশন' নামে দাঁতের মাজনের খুব নাম-ডাক ছিল ।

 ৪২ সালের শুরুর দিকে ট্রেন লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন‍্যে ফেনী স্টেশনের অনতিদূরে  বোমা-বারুদ নিয়ে অ্যাম্বুশে বসেছিলেন কয়েকজন বিপ্লবী। তাঁরা দলে এগারো জন ছিলেন । কেউ বোধহয় আগে থেকে পুলিশের কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিয়েছিল । নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা এসে তাঁদের অ্যাম্বুশ নেওয়া জায়গাটার একটু আগে থেমে যায় । একদল সৈন‍্য ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে বিপ্লবীদের ধাওয়া করে । ধরা পড়ে যান  অনাদিরঞ্জন ও মনোরঞ্জন ( মনাদা ) । বাবার মুখে শোনা,  পুলিশ সেদিন অনাদিরঞ্জনের উপর অন‍্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিল । দুজনেই সুপুরুষ ছিলেন । তারা ভেবেছিল নোয়াখালি অঞ্চলের টেররিস্টদের নেতা এই দুজনেই । পুলিশ কথা আদায়ের জন‍্যে বাবার বাঁহাতের তর্জনীতে মোটা সুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল । যার ফলে বাবার সেই আঙুলটা চিরতরে বাঁকা হয়ে যায় । এই কেইসে তাঁদের দুজনকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয় । এইসময়ে যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসারের কথা বাবা প্রায়শই বলতেন তার নাম পূর্ণ নাথ । যেমন নৃশংস তেমনি বিপ্লবীদের কাছে ত্রাস ছিলেন এই পূর্ণ নাথ । দুই পকেটে দুটো পিস্তল নাকি রাখতেন । বিপ্লবীদের প্রচন্ড নির্যাতন করতেন তিনি । নিরীহ তরুণদের ধরে টেররিস্ট বলে জেলে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ আদায় করতেন । এই নিষ্ঠুর দারোগা পূর্ণ নাথের ভয়ে বিপ্লবীরা পালিয়ে বেড়াতেন । বাবা কোলকাতায় পালিয়ে গিয়ে ইলেকশন দপ্তরে সুপারভাইজারের চাকরি নেন । বাবা যখনি দেশের বাড়ি ( তাঁর মামাবাড়ি ) ফেনীর আমিরাবাদে পৌঁছাতেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে সাদা পোষাকে পুলিশ ছেয়ে যেত । তাঁর সঙ্গে কে মেশে, কোথায় যান সব খেয়াল । একবার কোলকাতার মানিকতলার তাঁর মেসে বিপ্লবীদের খোঁজে হানা দেয় । চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আগের রাতেও এখানে ছিল । কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তাঁরা সরে পড়েন । পুলিশ সন্দেহবশত বাবাকে ধরে নিয়ে যান । কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কিছু জানতে পারেননি । তার উপর বাবার অফিসের একজন ই়ংরেজ অফিসারের সরাসরি হস্তক্ষেপে তিনি সেযাত্রা বেঁচে যান । বাবা বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য প্রায়ই বাড়িছাড়া থাকতেন । এজন‍্যে পরবর্তী জীবনে বাবাকে প্রায়ই খোঁচা দিয়ে বলতেন, দেড়সের চাল দি' হপ্তা কাডাইছি আঁই । অনঅ কি কষ্ট কইত্তামনি ?

  বেশ কবছর আগে একজন বয়স্ক লোক আমার সাব্রুমের বাসায় এসেছিলেন বিপ্লবী মনাদার ছেলে ( আমি ) এখানে থাকে জেনে দেখা করতে । তাঁর মুখে বাবার দুঃসাহসিকতার দুএকটা কাহিনি শুনেছিলাম । তিনি বলেছিলেন বাবা গ্রামে এলেই ছেলেরা যেন সাহস পেত । বাবা তাদের ক্লাস নিতেন ।  গ্রামের যে গোপন জায়গায় তাঁরা আড্ডা দিতেন সেখানে একটা বড়ো শিমুলের গাছ ছিল । কান্ডটা বেশ মোটা । তাঁরা তার গায়ে হেলান দিয়ে মিটিং করতেন । ফলে গাছটার গুঁড়িটা তেলতেলে হয়ে গিয়েছিল । একসময় বিচক্ষণ ইংরেজ পুলিশের চোখে তাধরা পড়ে যায় এবং বিপ্লবীদের আড্ডাটা ভেঙে যায় ।

যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসার পূর্ণ নাথের জন‍্য বিপ্লবীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর সেই পূর্ণ নাথকে কোলকাতার লালবাজারে স্বমহিমায় দেখা যায় । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে পূর্ণ নাথ এখানেও বিপ্লবীদের নানাবিধ মিথ‍্যা মামলায় জড়িয়ে দিতে থাকে । বাবা একদিন পূর্ণ নাথের নজরে পড়ে যান । পূর্বপরিচিত হিসাবে সম্মান না দেওয়ায় বাবা তাঁর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান । বাবাকে কোলকাতার চাকরি ছেড়ে আসামের চাবাগানে নানাসময় নানা নামে আত্মগোপন করে থাকতে হয় । শেষে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজে চাকরি পান । সেই সুবাদেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমদিকে রাজ‍্যের দুজন বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. রথীন দত্ত ও ড. রবি চৌধুরী এমবিবিএস পড়ার জন‍্য ডিব্রুগড় গিয়ে আমাদের কোয়ার্টার্সে প্রথম উঠেছিলেন । তারপর তাঁরা হোস্টেলে চলে যান । একটা কোয়ার্টার্সে জায়গা । আজীবন স্বাধীনতাসংগ্রামী খদ্দরের ধুতি-জামা পরা আমার স্বাধীনচেতা বাবাকে আসাম থেকেও পালিয়ে ত্রিপুরায় চলে আসতে হয় । বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হতে হতে বাবা একসময় স্বাধীনতা শব্দের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতেন । 

বাবা যেহেতু তাঁর বিপ্লবীজীবন সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন, আমরা তাঁর সন্ততিরাও আর সেবিষয়ের উন্মোচন করতে চাইনা । উনিশ শো ছিয়াত্তরে তাঁর আকস্মিক মৃত‍্যুর সাথে সাথে সব কিছু হারিয়ে গেছে । তবুও সত‍্য ইতিহাস কখনো চাপা থাকেনা । কিছুদিন আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দেশভাগের বিভীষিকা সম্বন্ধে কথা বলার জন‍্য । তাঁরা বোধহয় কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন । আমি একজন উত্তরপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অনুভবটা জানিয়েছিলাম । এমন শুধু আমার বাবা নয় । বহু বিপ্লবী চলে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে । 'হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে' ।

Wednesday, August 24, 2022

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল পালক

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল সাদা পালক

সুমন পাটারি ত্রিপুরার সন্তান । আমার গর্বের দক্ষিণ জেলার । রাজ‍্যের জন‍্যে দিয়েছে গর্বের পুরস্কার । যুব সাহিত‍্য একাডেমি সম্মান - ২০২২  ।  তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাইখোরাতে একটি সাহিত‍্যানুষ্ঠানে । আমাকে বাইখোরা বাজার থেকে বাইকে তুলে সোজা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায় । তরুণ সৈনিকের মতো একহারা দৃপ্ত চেহারা । সুমনের কবিতায়ও সেইরকমের তীব্র ঋজুতার ছাপ । তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ভদ্র, নম্র ও চলাফেরায় একদম সাদাসিধে । কিন্ত জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অত‍্যন্ত সংবেদনশীল । একবার আমরা একসঙ্গে রাজ‍্যের বাইরেও গেছি । একদম কাছে থেকে দেখেছি সুমনকে । এই যাত্রাপথে সুমন আমাকে সন্তানসুলভ দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিল । আমার খাওয়া দাওয়া সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুতেই ওর লক্ষ‍্য ছিল । আমার কষ্ট হলেই সুমন তৎপর হয়ে উঠত আমার অসুবিধা দূর করার জন‍্য ।

 নিষ্পাপ শিশুর মতো সুমনকে নাগরিক জটিলতায় আচ্ছন্ন করেনি । সুমন একদিন সকালবেলায়  এসে আমাকে বলল তার সদ‍্য লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা । সে ময়দানের সামনের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল । তার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ এসে আব্দার যে, লোকটার টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছে । সুমন যদি কিছু টাকা দেয় তাহলে লোকটা বাড়ি যেতে পারবে । সুমন তাকে পঞ্চাশ টাকা দেয় । লোকটা তখনকার মতো চলে যায় । কিছুক্ষণ পরে সুমন লক্ষ করে লোকটা আবার এসে পাশের লোকটার কাছ থেকে একই কায়দায় টাকা চাইছে । শহুরে তঞ্চকতায় বেকুফ হয়ে যায় সুমন । সুমনের ভাষায় তার 'বাবার বয়সী' লোকটার আচরণে সে বিস্মিত । এতোটাই স্বচ্ছ সুমন ।

কর্ম বা ভাগ‍্য বিষয়টাকে বিশ্বাস না করলেও জীবনের উত্থান ও বিপর্যয়কে গতিমুখের নির্ণায়ক বলে মেনে নিতেই হয় । সুমনের বাবা সংসারের কর্তা । তাঁর পরিশ্রমের আয়ের উপরই চলছিল তার পড়াশুনা । ত্রিপুরা রাজ‍্যের ইকফাই ইউনিভার্সিটি থেকে বিসিএতে দুর্দান্ত ফল করে রাজ‍্যের বাইরে পড়তে যায় এমসিএ । কিন্তু বিধি যে সুমনের দিকে অলক্ষ‍্যে চেয়ে হাসছিল কে জানে ! বাইখোরা বাজারে সুমনের বাবার  ধান চালের ব‍্যবসা । হঠাৎ একদিন স্তুপ করে রাখা বস্তার সারি থেকে একটা এক কুইন্টাল ওজনের ধানের বস্তা পেছন থেকে ছিটকে পড়ে গদিতে বসে থাকা সুমনের বাবার পিঠে । ঘাড়ে ও মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর । উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা ছেড়ে সুমনকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে । বাবার চিকিৎসা ও সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে সুমনের কাঁধেই । বাবার চিকিৎসার জন‍্যে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করেও বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি আর । এরপর নানারকম ছুটকো পেশা, প্রাইভেট পড়ানো ইত‍্যাদি করে চলতে থাকে সুমনের জীবনযুদ্ধ । বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের পাঠ নিতে থাকে সুমন । সেইসঙ্গে কবিতাযাপনও সমানে চলে । সেকারণেই সুমনের কবিতাও প্রাত‍্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার স্পষ্টতায় উজ্জ্বল । আমি সুমন পাটারির প্রথম কাব‍্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করার ও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন । একদম জোরালো কব্জিতে তোলা ভাষাই সুমনের কবিতা ।

 কার্যকারণে অনেকদিন দেখা হয়না । কিছুদিন আগে সেলিমদা ধর্মনগর থেকে 'পাখি সব করে রব'-র বিশেষ সংখ‍্যা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে । দক্ষিণ ত্রিপূরার কয়েকজন কবির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন‍্যে । সুমনের কপিও ছিল । কিন্তু আমি যেদিন বাইখোরা যাই সেদিন ও বিশেষ কাজে ব‍্যস্ত থাকায় আর দেখা হয়নি । ওর কপিটা কবি তারাপ্রসাদ বনিকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম ।

নোয়াখালি অ্যাকসেন্ট থাকে সুমনের কথাবার্তায় । মনে হবে আনস্মার্ট এক গ্রাম‍্য যুবক । সুমনের ইংরেজি উচ্চারণ ও অনর্গল কনভার্সেশন শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন । বাহ‍্যিক দর্শনে রাজ‍্যের মেধাবী ও গুণী এই তরুণকে চিনতে অনেকেই ভুল করবেন । সুমন যদি তার উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারত তবে আজ সে একজন নামজাদা আইটিয়ান হতে পারত । অথবা বড়ো কোনো মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন থাকত ।

যাই হোক, লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতরের রজতকাঞ্চনের ভান্ডার হাতে না এলেও সরস্বতীর বীণাতন্ত্রীতে ঝংকার তুলে তার শব্দকথা  বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, আমার সন্তানপ্রতিম রাজ‍্যের গর্ব সুমন পাটারি । তোমাকে স্নেহ ও আদর হে কবি !

অশোকানন্দ
২৫. ৮. ২০২২.

ত্রিপুরারাজ‍্যে বাংলাভাষা ও সাহিত‍্যে উচ্চশিক্ষা

ত্রিপুরা রাজ‍্যে প্রধান দুটি ভাষা প্রচলিত । বাংলা ও ককবরক । রাজ‍্যের বৃহদংশের জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা এটি । কিন্তু এই দুই ভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্লহণের সুযোগটি ক্ষীণ । রাজ‍্যের একটি উচ্মচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এম বি বি বিশ্ববিদ‍্যালয় শুরু থেকেই শিক্ষাপ্রসারের চেয়ে পেটোয়া বিদ‍্যাজীবীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।  যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সযোগ না থাকার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত এখানে অস্বাভাবিক নয় । শিক্ষাবিস্তার নয় । কিছু বশংবদ বিদ‍্যাব্রতীই এখানকার আসল নির্মান । এখানে কেন্দ্রীয় স্তরে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে । সেখানেও বাংলা ব্রাত‍্য ।  মানোপযোগী না হওয়ার ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের  দূরশিক্ষণের মাধ‍্যমে বাংলা স্নাতকোত্তর পড়ার ক্ষীণ সুযোগটিও আজ বন্ধ । যার ফলে, প্রতি বছর ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়ার জন‍্যে প্রচন্ড ভিড় হয় । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের সুনামও দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন‍্যে  প্রতিবছর  দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও দেশের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করে থাকেন । ফলে সবাই সুযোগ পান না । যাঁদের মধ‍্যে রাজ‍্যের উচ্চশিক্ষার্থীরাও প্রচুর রয়েছেন । সুযোগবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা যদি প্রাগুক্ত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেতেন তবে তাঁরাও রাজ‍্যের মুখ উজ্জ্বল করার সুযোগ পেতেন । 

Wednesday, August 17, 2022

বাংলা বর্ণমালায় শ ষ স এর উচ্চারণ ও ব‍্যবহার

বাংলা বর্ণমালায় শ ষ ও স এর উচ্চারণ ও ব‍্যবহার

বাংলা বর্ণমালা মূলত সংস্কৃতের অনুসারী । সংস্কৃত মুলে তিনটি  শ ষ স তিন প্রকার বর্ণের সাথে যুক্ত । শ ষ স হ এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় মুখ থেকে বাতাস বের হয় । এজন‍্য এই বর্ণগুলোকে 'উষ্মবর্ণ' বলা হয় । 'উষ্ম' শব্দের অর্থ বাতাস । অনেকে ভুল করে উষ্ণ বলে থাকেন ।  উষ্ণ বা গরম নয় । কন্ঠ থেকে খানিকটা বাতাস অর্থাৎ 'উষ্ম'বের করলেই  এই বর্ণগুলো উচ্চারিত হয় । আবার শ ষ স এই তিনটি ধ্বনিকে 'শিস'ধ্বনিও বলা।হয় । 

এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় শিস দেওয়ার মতো শব্দ হয় । উচ্চারণস্থান অনুযায়ী তালব‍্য-শকে তালব‍্য বর্ণ, মূর্ধণ‍্য-ষকে মূর্ধণ‍্য বর্ণ এবং দন্ত‍্য-সকে দন্ত‍্য বর্ণ বলা হয় । সংস্কৃতে উচ্চারণগত দিক থেকে এই তিন বর্ণের তিনরকম উচ্চারণ হয় । 'স' ইংরেজি S অক্ষরের মতো । 'শ' ইংরেজি  SH অক্ষরের মতো এবং 'ষ' ইংরেজি  SH এর মতো তবে আরো তীব্র । বাংলায় তিনটি শ/ষ/স থাকলেও সব শ/ষ/স-ই  S বা SH এর মতো উচ্চারিত হয় । স্বতন্ত্র ধ্বনি হিসেবে কেবল 'শ' ধ্বনিরই ব‍্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । যেমন-বিশ/বিষ, সব/শব, শোনা/সোনা, ভাষা/ভাসা।  বানানে ভিন্নতা থাকলেও উচ্চারণ সর্বত্র 'শ'-এর মতো হচ্ছে ।যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে ব‍্যতিক্রম দেখা যায় । শব্দের গোড়ায় 'স' থাকলে 'স'-S এর মতো উচ্চারিত হয় । যেমন-অস্ত, স্পর্শ, স্ফটিক ইত‍্যাদি । এখানে 'স'-  S এর মতো উচ্চারিত হচ্ছে । আর শব্দের যধ‍্যে থাকলে 'শ'-SH এর মতো উচ্চারিত হয় ।  যেমন বিস্ফারিত, আস্পর্ধা, প্রভৃতি শব্দের প্রমিত উচ্চারণে 'শ'(SH) পাওয়া যায় । যেমন- বিশফারিত, আসপর্ধা ইত‍্যাদি । আবার 'শ'-এর সাথে 'ন'-ফলা, 'র'-ফলা, 'ল'-ফলা যুক্ত হলে 'স'(S) উচ্চারিত হয় । যেমন- প্রশ্ন, বিশ্রাম, অশ্লীল ইত‍্যাদি । এই শব্দগুলো উচ্চারণের সময় প্রোসনো,বিসরাম, অসস্লিল হয়ে যাচ্ছে ।

এককভাবে 'ষ'-র উচ্চারণ স্পষ্ট হয় । যেমন- ষষ্ঠী, ষড়ভুজ, ষড়ানন, ষন্ডা ইত‍্যাদি । আবার যুক্তবর্ণে 'বিষ্ময়কর, বিষ্ফোরণ ইত‍্যাদি 'শ(S)-এর মতো উচ্চারিত হয় । 'ট'-বর্গীয় বর্ণের আগে 'ষ' যুক্ত হয় । যেযন- অষ্ষ্টট, , নষ্ট, যষ্ঠি, কুষ্ঠ ইত‍্যাদি ।

যুক্তাক্ষর হলে কোন শ/ষ/স হবে তা এভাবে ঠিক হয় । তালব্য বর্ণ অর্থাৎ 'চ'- বর্গের বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে তালব্য-শ । মূর্ধণ‍্য বর্ণ অর্থাৎ 'ট'- বর্গের বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে মূর্ধণ‍্য-ষ এবং দন্ত‍্যবর্ণ অর্থাৎ 'ত'-বর্গের সঙ্গে যুক্ত হলে দন্ত‍্য-স হয় ।

যাই হোক, এই কয়েকটা উদাহরণে বিষয়টা স্পষ্ট হবার নয় । শ/ষ/স-এর কোনটা কোন সময় ব‍্যবহার হবে বা লিখতে হবে তার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে । 

বাংলা বর্ণমালার 'ব' ও 'ব'

সংস্কৃত বর্ণমালায় দুটি 'ব' । এই দুটির উচ্চারণ ও আকৃতিগত পার্থক‍্য রয়েছে । বাংলা বর্ণমালি সংস্কৃত বর্ণমালা দ্বারা অনুপ্রাণিত । ঈশ্বরচন্দ‍্র বিদ‍্যাসাগর সংস্কৃত বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা বর্ণমালা রচনা করেন । 
বাঙলা বর্ণমালা যথেষ্ট ফোনেটিক বা ধ্বনি-অনুসারী।  'ব'-ব্যঞ্জনটি যাকে ইংরেজিতে বলে bilabial plossive অর্থাৎ দুটি ঠোঁট একজায়গায় লাগে এবং আবার ছেড়ে দেয়, ও মাঝখান দিয়ে খানিকটা বিস্ফোরণের মত হাওয়া বেরিয়ে 'ব' উচ্চারণ হয়। প ফ ব ভ, 'প'-বর্গের ব্যঞ্জনগুলি এভাবেই উচ্চারিত হয়। 'ম'-এও ঠোঁট জড়ো হয় তবে ধ্বণিটি বিস্ফোরক নয় বরং নাসিক্য। এই বর্গভূক্ত বলে একে বর্গীয় ব বলে। ব্যঞ্জনগুলিকে এভাবেই তাদের উচ্চারণ স্থান ও বৈশিষ্টতা অনুযায়ী বিভিন্ন বর্গে ভাগ করা হয়েছে। 
বাংলা বর্ণমালায় 'ব'-এর আকৃতিগত কোনো পার্থক‍্য নেই । বর্ণমালায় একটি 'ব' বর্গীয়-ব । প-বর্গের অন্তর্গত । প ফ 'ব' ভ ম  ( এগুলি পঞ্চম বর্গীয় বর্ণ ) । শব্দের শুরুতে, মধ‍্যে বা শেষে অবস্থিত একক 'ব' হল বর্গীয়-ব । যেমন-দেবালয়, বাড়ি, বাহির, বাবা ইত‍্যাদি । এটি স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হয় । কিন্তু ব এর আরেকরকম উচ্চারণ চলে আসে যখন এই দুটির যেটির ক্ষেত্রে ঠোঁট জোড়া লাগতে চায় না বা লাগানো আয়াসসাধ্য। সে ক্ষেত্রে ওয়া গোছের উচ্চারণ হয়ে হাওয়া বেরিয়ে যায়। যেমন দুটি স্বরের মধ্যবর্তী বা অন্তঃস্থ বা intervocalic 'ব'-এর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায়। 
এটা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। এই 'ব'-কে বর্গীয় 'ব'-এর থেকে পৃথক করে অন্যত্র রাখা হয়েছে। এটি অন্তস্থ-'ব' । য র ল এর পরে আসে এই 'ব' ( য র ল 'ব'- এগুলো অন্তস্থ বর্ণ ) । যুক্তবর্ণে, বা যুক্তব‍্যঞ্জনে, বা যুক্তক্ষরে যা ব‍্যবহৃত হয় । অর্থাৎ 'ব'-ফলা হিসাবে যা ব‍্যবহৃত হয় । যেমন-জিহ্বা ( জিওহা ), স্বদেশ ( সদেশ ), স্বাধীনতা ( সাধীনতা ), আহ্বান ( আওহান ), স্বামী ( সামী )  ইত‍্যাদি । এই ফলা-র 'ব'টি 'ও' বা 'ওয়' উচ্চারিত হয় ।  বর্ণদ্বিত্বও হয় । যেমন- বিশ্ব ( বিশশো ), আশ্বাস ( আশশাস ) । অথবা যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় তার সঙ্গে মিশে যায় । এই 'ব'কে অর্ধস্বরও বলা হয় । 
হিন্দি ও উর্দুতে এই 'ব'(ওয়)এর ব‍্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । যেমন- ওয়াক্ত, ওয়াজির, ওয়তন, দেওকীনন্দন, দেওধর, দেওনাথ ইত‍্যাদি ।
অধুনা বাংলায়, অন্তস্থ ব বর্ণটি তুলে নেওয়া হয়েছে, তাই এখন বাংলায় সব ব-ই বর্গীয়-ব । এর উচ্চারণ ইংরেজী B- এর মতো। বাংলায় এখন আর 'উঅ' উচ্চারণ-যুক্ত ব নেই, যদিও এই উচ্চারণ সেই অর্থে বাংলা ভাষায় কোনোদিনই ব্যবহার করা হয়নি।
অধুনা বাংলা বর্ণমালায়, য, র, ল, শ, ষ....এই ক্রম পাবেন। ল-এর পরে ব পাবেন না। ফলে বর্তমান প্রজন্মের যারা তারা বর্ণমালায় একটি 'ব'-ই দেখতে বা পড়তে পাবে । ফলে তাদের কাছে আর বর্ণমালায় দুই 'ব' নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবেনা । আমরা যারা পুরোনো বর্ণমালা অনুসরণ করে এসেছি তাদের কাছেই এই দুই 'ব' নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় । এবং এটা হওয়া স্বাভাবিক । এর মধ‍্যেই বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে ।

Tuesday, August 16, 2022

কয়েকজন চিত্রশিল্পী, আমি ও মৈত্রীসেতু

গতকাল ( ২৭.৭. ২০২২ ) সকাল নটা নাগাদ আগরতলা থেকে ফোন পাই আমার প্রিয়জন রাজ‍্যের বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী ও সঞ্চালক উদয়শংকর ভট্টাচার্যের কাছ থেকে । তিনজন প্রখ‍্যাত চিত্রশিল্পী সাব্রুম আসছেন । সকালের ট্রেনটা মিস হওয়ার তাঁরা বাসে রওনা হয়েছেন । সাব্রুম শহরটা ঘুরে দেখবে । আমি যেন একটু তাঁদের পাশে থাকি । আমার শরীরটা ভালো না থাকায় বেশ কদিন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলামনা । পায়ের সমস‍্যাটা কমছেনা । তবুও একে তো নাচনী বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি । বাইরে বেরুনোর প্রস্তাবে আমার ভেতরটা লাফিয়ে উঠল । বার্ধক‍্যে গুণীজনসঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো যাবে । বাসটা কটার মধ‍্যে সাব্রুম পৌঁছুবে আন্দাজ করে আমি ধীরে সুস্থে তৈরি হতে থাকি । আমি উদয়শংকরদাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তাঁরা বাস থেকে কোথায় নামবেন তারপর কোথায় অবস্থান করবেন । সাব্রুমের সঙ্গে যাঁদের সামান‍্য যোগাযোগও আছে তাঁরা সবাই জানেন যে, সাব্রুমের শিক্ষক-কর্মচারী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়াবিদ ও মননশীল মানুষজনের মরুদ্যান হল আমাদের অগ্রজপ্রতিম অশোকদার অর্থাৎ অশোক বসাকের চায়ের দোকান । সংক্ষেপে আমরা বলি এবিসিডি । সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে  শুধুমাত্র এককাপ চা সেবন করলেও দোকানের মালিকরা বিরক্ত হন না । অশোকদাও মজাদার মানুষ । উদয়শংকরদাকে এই ঠিকানা দিলাম । যথারীতি দশটার সময়ে তাঁরা ওখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমাকে ফোন করলেন । আমি একটু সময় নিয়ে হালকা খাবার ও ঔষধ খেয়ে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম । 

তারপর সৌজন‍্যমূলক কিছু কথাবার্তা বলার পর একটা টোটো নিয়ে বেরুলাম সাব্রুম শহর পরিক্রমায় । শহরের লোকনাথ মন্দির থেকে শুরু করে রামঠাকুর মন্দির, দৈত‍্যেশ্বরী কালিবাড়ি ইত‍্যাদি দেখার ফাঁকে ঢুকলাম গার্লস স্কুলে । এই স্কুলে ঢুকলেই সামনে পড়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ । এই সাবেক দালানটাই রাজন‍্য আমলে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । এখানেই ছিল বিচারশালা ।বড়ো হাকিম বসতেন । তাঁর মাথার উপর ছিল টানা পাখা । বছর কুড়ি আগেও কার্নিশের উপর পাখার ভারি কাপড় ও দড়ি গুটানো ছিল । ভারতভুক্তির পরেও প্রায় দুদশক এখানে অফিসটি ছিল । যার দরুণ এখনও এই নাতিউচ্চ টিলাভূমি ও জনবসতিটার নাম পুরাতন অফিস টিলা । স্কুলে বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন আমার ছাত্র সুশীল দে । খবর পেয়ে ছুটে এলেন । সবাইকে অতিথির মতো নিয়ে ক‍্যানটিনে বসিয়ে আপ‍্যায়ণ করলেন । সুশীলবাবুর আতিথেয়তায় মুগ্ধ তাঁরা । শিক্ষক হিসাবে আমি গর্বিত । আমাদের তো এটাই প্রাপ্তি ।

কালীমন্দিরটাও বহু প্রাচীন। পাশেই তহশিল কাছারি । রাজন‍্য আমলে এখানে খাজনা আদায় হত । পুণ‍্যাহ হত । আমি চলতে চলতে সংক্ষেপে তাঁদের এই প্রতিষ্ঠান গুলোর ইতিহাস বলে গেলাম । তাঁরা নদীটা দেখতে চাইছিলেন । তাই টোটোকে বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়ার কথা বললাম । নদীটা দেখালাম । ওপারের পার্বত‍্য চট্টগ্রামের রামগড় শহরের বাড়িঘর দেখালাম । তাঁদের দর্শনের মূল আগ্রহ মৈত্রীসেতু । তাই টোটো ঘুরিয়ে ছোটোখিল রোড হয়ে চললাম মৈত্রীসেতুর দিকে । 

সকালের চড়া রোদ থাকায় বেশ গরম লাগছিল । অনেকক্ষণ কথা হল ফেনীনদীর গতিপথ, দুপারের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত‍্যাদি নিয়ে । দুদিকেই জোর নির্মানকাজ চলছে । পণ‍্য আদানপ্রদান না হলেও মানুষজন আসাযাওয়ার কাজ একদুমাসের মধ‍্যে শুরু হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ।

ফিরে আসার সময় আমি স্বগতোক্তি করলাম, দেখবেন আগামী একবছর পরে এই জায়গা জমজমাট হয়ে যাবে । তাঁরা সমস্বরে জবাব দিলেন । জমজমাট না হলেই ভালো । আমাদের আর ভিড়ঘিঞ্জি ভালো লাগেনা । আমরা এগুলো ছাড়াতে চাইছি । বোঝা গেল সাব্রুমের সৌম‍্য শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশটা তাঁদের আকৃষ্ট করেছে ।

ফেরার পথে আমার এক ছাত্র বিভাস বসাক তাদের সাংগঠনিক প্রয়োজনে টোটোটার সাহায‍্য চাইছিল । আর কাউকে বোধহয় পাচ্ছিলনা । আমি বিষয়টা বুঝে ড্রাইভারকে বললাম আমাদের সাব্রুম বয়েজ স্কুলের সামনে নামিয়ে দিতে । স্কুল কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা হরি চৌমুহুনীতে হেঁটে চলে যাব । সে যেন এইফাঁকে ওদের কাজটা সেরে ফিরে আসে ।

এরপর সাব্রুম স্কুলে প্রধান শিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয়ের কক্ষে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কথাবার্তা বলে আমাদের ছাত্র বর্তমানে এই বিদ‍্যালয়ের শিক্ষক রতন চক্রবর্তীসহ ছবি তোলা হল । হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চুমকি হোটেলের সামনে । মিছিল শেষ হওয়ার পর টোটোটা ফিরে এল । 

সেখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার পথে তাঁদের কয়েকমিনিট সময় নষ্ট করে আমার বাসাটা দেখিয়ে নিলাম । আমার ঘরে বসে একটু কথা হল । এতক্ষণ আমি কারো নাম ধাম জেনে নিইনি । এখন আমার আর মনে থাকেনা । তাই ডায়েরিতে লিখে নিলাম । যাঁদের নিবিড় সান্নিধ‍্যে কালকের দিনের প্রথমার্ধ স্বর্গপুরীর নন্দনভ্রমণের অনুভব হল, সেই স্বনামধন‍্য চিত্রশিল্পীরা  হলেন–
১. ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ‍্যায়, অধ‍্যাপক- কল‍্যাণী বিশ্ববিদ‍্যালয় ।
২. দেবজিৎ পাল, শিক্ষক- জাশেদপুর পাবলিক স্কুল, জামশেদপুর, ঝাড়খন্ড ।
৩. বিরাজকুমার পাল, অধ‍্যাপক- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয় ।

অল্পসময়ের জন‍্যে হলেও তাঁদের সান্নিধ্য আমার সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে । খুবই খারাপ লাগছিল আমার বাড়ির সামনে থেকে তাঁদের বিদায় জানাতে গিয়ে । আর কবে দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা ‌। ভালো থাকুন, আমার শহরের এই ক্ষণিকের অতিথিরা ।

২৮. ৭. ২০২২.

Friday, August 12, 2022

আমার ননীমামু

এবারের কোলকাতা ভ্রমণ যেমন আনন্দদায়ক হয়েছে তেমনি বিষন্নতায় গ্রস্ত হয়েছি প্রবল । আনন্দের বিষয়টা ব‍্যক্তিগত । 
পাশাপাশি একটা দুঃসংবাদ আমার একার এবং নিজস্ব । এতকিছু নিয়ম মেনে চলার পরও ডায়াবেটিসে আমার পদযুগল বৈরী হয়ে গেছে । পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর 'হাই রিস্ক' বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । সেইসঙ্গে কিছু ঔষধপত্র ও সাবধান বাণী । আঞ্চলিক প্রবাদে আমরা বলি, চরণে জানে মরণের খবর । গুলি মারো 'হাই রিস্ক' ।

দ্বিতীয় বেদনার জন‍্যে আমি প্রস্তুত ছিলামনা । এটা জানলে পাঠকেরও মন নরম হয়ে যাবে । রাজ‍্যের সাহিত‍্যসংস্কৃতিবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর নাম অবশ‍্যই জানেন । আর এই অধমকে নিয়ে ছিল দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে উঠে আসা মামা-ভাগ্নে জুটি । সাব্রুমের ছোটোখিলের সেকালের সংস্কৃতিমনস্ক দামোদরবাড়ির সন্তান ননী । এ গ্রাম রত্নগর্ভা । এ গ্রামের সন্তান কৃষ্ণধন নাথ । এ গ্রামের সন্তান ড. রঞ্জিত দে প্রমুখ । রাজ‍্যের সাহিত‍্যক্ষেত্রের দিকপাল তাঁরা । আরো অনেকে  অনেকভাবে প্রতিষ্ঠিত । একসময়ের রাজ‍্যের বিখ‍্যাত জাদুকর ডিএন গোপাল এ গ্রামের ভারত আমিনের ছেলে । পরে তাঁরা আগরতলা অভয়নগরে চলে যান । গ্রামের মধ‍্যে প্রত‍্যেকে প্রত‍্যেকের আত্মীয় । সেই সুবাদে ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী আর আমি মামা-ভাগ্নে । গ্রামে বলে, ধর্ম কুডুম তুন জর্ম কুডুম বড়ো । আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই রঞ্জিতদা ও ননীমামুকে বরিষ্ঠ সতীর্থ হিসাবে পেয়েছি । ৯৩-৯৪ সালের দিকে শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার সাব্রুম স্কুলে এসে হেডমাস্টাররুমে শরৎচন্দ্রের একটা ছবি দেখে এটি কে এঁকেছেন জানতে চান । তখনই ননীমামুকে সামনে এনে হাজির করা হয় । মামুকে কবি আগে থেকেই চিনতেন । অনিল সরকার সাব্রুম এলে দামোদরবাড়িতে উঠতেন । সেসময়ের তরুণ কমরেডদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন । জহুরি জহর চেনে । কবি ও সংস্কৃতিপ্রেমী অনিল সরকার সেসময়ে বহু গুণীজনকে প্রত‍্যন্ত গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে । তাঁর প্রিয় ননীকে তুলে নিয়ে গেলেন আগরতলায় । রাজ‍্যে সাহিত‍্যসংস্কৃতিক্ষেত্রে মফঃস্বল থেকে উঠে এসে আগরতলায় দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি । রাজ‍্যের হাতে গোনা কয়েকজন লোকসংস্কৃতি গবেষকের অন‍্যতম তিনি । ইতোমধ‍্যে তাঁর টেলিফিল্ম 'ভাঙন' প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর লেখা কবিতা মুখে মুখে দেশের পরিমন্ডল পেরিয়ে বাংলাদেশের আবৃত্তিকারদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে । দৈনিক সংবাদের সাহিত‍্যের পাতায় ধারাবাহিক বেরিয়েছে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ' । অসাধারণ গল্পের হাত । বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ 'বসুধা' । অসাধারণ কয়েকটি মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন তিনি । ত্রিপুরায় নাট‍্যচর্চায় লোক আঙ্গিকের ব‍্যবহারে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী । আকাশবাণীর জন‍্যে লিখেছেন সিরিজ নাটক । তাঁর নেতৃত্বে আমরা দক্ষিণের প্রান্তিক মহকুমা সাব্রুম থেকে ভারত জনবিজ্ঞান জাঠায় অংশগ্রহণ করেছিলাম চলার পথে প্রতিটি জনপদে তাৎক্ষণিক সৃষ্ট পথনাটক ও গানবাজনায় মাতিয়ে দিয়ে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রখ‍্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধের রিপোর্টিং করেছেন এক নম্বর সেক্টর থেকে ।  সেই সুবাদে পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে দৈনিক সংবাদ, আজকের ফরিয়াদ, আরোহন এবং ত্রিপুরা দর্পণে ডেস্কে কাজ করেছেন । 

মনে পড়ে উচ্চ মাধ‍্যমিকের খাতা কাটার সময় বাংলার শিক্ষকদের তরফে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে তাঁর ভূমিকা । খাতা কাটার ফাঁকে ফাঁকে প্রত‍্যেকের হাতে হাতে চিরকুট ঘুরে ছড়ার মালা তৈরি । সবশেষে প্রধান পরীক্ষক পর্যন্ত পৌঁছে যেত তা । মফঃস্বল থেকে যে সব পরীক্ষকরা খাতা কাটতে আসতেন তাদের থাকতে দেওয়া হত বিভিন্ন স্কুলের হোস্টেলের ফ্লোরে । চূড়ান্ত অব‍্যবস্থার মধ‍্যে । একবার উমাকান্ত স্কুলের অস্থায়ী শিবিরের পরিবেশের ছবি তুলে মামা-ভাগ্নে মিলে তখনকার ভাবী ভারত পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল লিড নিউজ করে দিয়েছিলাম । পরদিন সকালে পত্রিকা বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরা মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদের ভিত কেঁপে উঠেছিল সেদিন । অন‍্যদিকে উদয়পুরের বর্তমান পুরপিতা শীতলচন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল উত্তরপত্র মূল‍্যায়নের সাম্মানিক বৃদ্ধির আন্দোলন । আমরা পত্রিকায় সংবাদ করি । কর্তৃপক্ষ মাথা নোয়ায় সেবার । আরো বহু বহু ভাবনার ফসল বেরিয়েছে আমাদের দুজনের মাথা থেকে সেদিন । আগরতলায় চলে যাওয়ার পরও আমার যোগাযোগ ছিল তাঁর সঙ্গে । আগরতলায় গেলে যত রাত হোক আমার ঠিকানা ছিল তাঁর সরকারি আবাস । কি ছিল না সেখানে ।পুরো খেতকৃষিতে ভরে রেখেছিলেন সামনের উঠোনটা । চাকরির পর জগৎপুরে একটা ছোটো ছিমছাম বাড়ি করেন ।

কোভিডের সময়কাল থেকে আর তাঁর যোগাযোগ রাখা যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজখবর করে নাট‍্যজন সুভাষ দাসের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম তিনি ভীষণ অসুস্থ । ছেলে রানা এসে কোলকাতা নিয়ে  গেছে । ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মধ‍্যে কথা বলেছি । মামি ফোন ধরতেন । কুশল সংবাদ জানাতেন । এবারে কোলকাতা যাওয়ার সুযোগে ভাবলাম দেখা করে আসব । সেইভাবে মামির সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছি । বাড়ির লোকেশানটাও জেনে নিয়েছি । কিন্তু আমার হঠাৎ অসুস্থতা, ডাক্তার দেখানো, নতুনমা, নতুন কুটুম্বদের আতিথেয়তা সব মিলিয়ে সময় করে উঠতে পারছিলামনা । এর মধ‍্যে গত শুক্রবার রাতে মামি ফোন করলেন । ভাইগনা, আইবা কইছিলা । আইলানা দেহি । কন্ঠে অভিমানের সুর । বুঝতে পেরে প‍রদিন সকালে যাব মন স্থির করলাম  । কিন্তু ছেলের কাজ পড়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়ার পর রওনা হলাম দমদম ছাতাকলের ঠিকানায় । রানা এসে এগিয়ে নিয়ে গেল । সিঁড়িতে আমার গলা শুনেই অতি কষ্টে দরজার চৌকাঠে চলে এলেন । কথাবার্তায় সেই আগের মতোই উইট আছে । নিজের অসুস্থতা নিয়ে নিয়ে নিজেই মজা করছেন । আমি নির্বিকার চেয়ে দেখছি তাঁর দিকে । কাকে দেখছি আমি ! এই কি অসম্ভব ঈর্ষনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ননী চক্রবর্তী ? চিত্রাঙ্গদা নাটকের অর্জুন ? ডাকসাইটে এনসিসি কমিশনড অফিসার ননীগোপাল চক্রবর্তী? বাংলাসাহিত‍্যের শিক্ষক ননীস‍্যর ? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ফ্ল‍্যাশব‍্যাকের ধামাকায় । পা ফুলে আছে হাঁটু অব্দি । স্ট্রোকে মুখটা বেঁকে গেছে । মুখে জড়তা এসে গেছে । অনেকক্ষণ না শুনলে কি বলছেন বোঝা যায়না । তবু আমার শ্রীমান নাতির সঙ্গে মজা করছেন শরীরের কষ্ট ভুলে । মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন । আমি মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা টেনে আনন্দ নিতে চাইলাম । রানা বলল, তাঁর বাড়ির প্রতি বড়ো টান । মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তে চান বাড়ি ফেরার জন‍্যে । আমি আশ্বাস দিই, বাড়ি তো যাবেনই । আগরতলায় এসে আবার নাটক করবেন, লিখবেন । কে জানত, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমার জন‍্যে অপেক্ষা করছে । কথায় কথায় মামি বললেন তাঁর নিজের কেমো চলছে । ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে এই ছোট্ট আবাসে তাঁদের সামলাতে । কিন্ত তাঁর নাকি শরীরের কোনো কষ্ট হচ্ছেনা । মামার জন‍্যে, সন্ততির জন‍্যে তিনি ভাবছেন । আহা ! সর্বংসহা মামি আমার !

একসময় উজ্জ্বল ইতিহাসকে ফেলে আমায় উঠতেই হল আমার সন্তানকে নিয়ে । আমার চোখে দেখা বাস্তবের নায়ক আজ বিধ্বস্ত কিং লিয়রের মতো । এদিকে একপশলা বৃষ্টি আমার হয়ে কেঁদে নিয়েছে । আমি চাইছি আমার ননীমামু-মামি ফিরে আসুন সুস্থ হয়ে ।

২০ জুলাই, ২০২২.

আজ আবার নতুন করে....

আজ আবার নতুন করে....

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আজ সারাদিন উৎকন্ঠায় ছিলাম । কি জানি কি হয় । ১০৩২৩ শিক্ষকরা আজ বিদ্যালয়ে গেছেন । এ ব্যাপারে তারা আগেই ঘোষণা দিয়েছেন । যেহেতু এই বঞ্চিত শিক্ষকগোষ্ঠীর উপর নানাভাবে দীর্ঘদিন যাবত আক্রমণ চলে আসছিল, আজ না জানি কি ঘটে । কিন্তু না সব উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে আজ শিক্ষক-শিক্ষিকারা পূর্বতন বিদ্যালয়ে গেছেন পুনরায় যোগদানের জন্য । যতটুকু জানা গেছে, দু একটা জায়গায় অতি উৎসাহী ও উটকো উজবুকদের আক্রমণ আর অতি চালাক কিছু প্রধান শিক্ষক বা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি ছাড়া এইসব শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কোথাও খুব একটা বাধা পেতে হয়নি । 

মধ্যাহ্নের আকাশে নেমে আসা কালো মেঘ তুমুল বর্ষণের পর যখন সরে যায়, তখন চারদিক অনেক বেশি উজ্জ্বল হতে দেখা যায় । দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলন করেও যখন দপ্তর বা মন্ত্রিসভাকে টলানো যাচ্ছিল না কিছুতেই, সেই সময়ে খড়কুটো ধরে অথৈ সমুদ্রে বেঁচে থাকার শেষ আশায় শিক্ষক মহাশয়দের তথ্য জানার অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট যে উত্তর দিয়েছেন তা জগদ্দল পাথর টাকে মনে হয় কিছুটা নাড়া দিতে পেরেছে । শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পুনরায় কাজে যোগদানের ব্যাপারটায় তাদের ভূমিকা অনেকটা নমনীয় মনে হয়েছে আজ । যারা কাজে যোগ দিয়েছেন, সবাইকে যথাযথ মর্যাদায় সুযোগ করে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধানগণ। এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পূর্বনির্দেশ অনুযায়ী অতি দ্রুত তার রিপোর্ট দপ্তরের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন । 

দীর্ঘদিন পরে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বিদ‍্যালয়ে বিদ্যালয়ে কাজে যোগদান করার জন্য আজ মার্জিত ও বর্ণাঢ্য পোশাক পরে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন । দেখামাত্র শিক্ষার্থীরা দৌড়ে চলে এসেছে তাদের প্রিয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে । সর্বত্রই সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চিরন্তন আবেগঘন পরিবেশ ।

 ভুক্তভোগী ছাড়া জানবে না এই কবছরে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার হাল কি হয়েছে । তার উপর গেছে কোভিড মহামারী । অভিভাবকরা শিক্ষার্থী সন্তানদের মানুষ করার জন্য কত টাকা ব্যয় করেছেন প্রাইভেট পড়ানোর জন্য । বিষয় শিক্ষকের অভাবে ও শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সন্তানকে নিয়ে ঘুরেছেন এই স্কুল থেকে সেই স্কুল । আর এই ডামাডোলে এবং করোনাকালীন সময়ে দেদার পাশের ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো জায়গায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগও হারিয়েছে । পাশ করা শিক্ষার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না । 'করোনা পাশ' বলে তাদের দেগে দেওয়া হচ্ছে ।

 যাইহোক, এর মধ্যেই আজ ১০৩২৩ শিক্ষক শিক্ষিকাদের স্কুল চত্বরে দেখে শিক্ষার্থীরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে । শিক্ষক সংকটে রাজ্যের শিক্ষার্থীদের যে কি ক্ষতি হয়েছে তা শিক্ষার্থীরা ছাড়া আর কে বেশি বুঝবে ?  'বুঝিবে সে কিসে / কভু আশীবিষে / দংশেনি যারে' ? দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে জুরি-মনু-ধলাই-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনীর স্রোতধারার সঙ্গে । অনেক যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাণ চলে গেছে অনন্তের পাঠশালায় । আর দেরি নয় । দপ্তরের শুভ বোধ জাগুক । মন্ত্রিসভা সজাগ হোন । পড়ে দেখুন এইসব 'হাতে মসি, মুখে মসি, মেঘে ঢাকা শিশুশশীদের চোখ মুখের ভাষা । আর রাজনীতি নয় । এবার চাই সহানুভূতি ।

 'আজ আবার নতুন করে / ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না / হারানো স্বপন চোখে এঁকো না' । ১০৩২৩ নামে তাঁরা যেন আর চিহ্নিত না হন । তাঁদের দুঃস্বপ্নের রাতগুলো যেন আর ফিরে না আসে । তাঁরা যেন আবার মূলস্রোতে মিশে যেতে পারেন । 'আমাদের গেছে যে দিন / একেবারেই কি গেছে / কিছুই কি নেই বাকি' ।  না । না । আছে । 'রাতের সব তারাই আছে / দিনের আলোর গভীরে' । আসুন সবাই মিলে রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে দিনের আলো খুঁজে বেড়াই । শুভস‍্য শীঘ্রম ।

১২.০৮.২০২২.

Wednesday, August 10, 2022

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা । এই ঘটনা একদিকে যেমন আনন্দের । অন্যদিকে অত্যন্ত বেদনার । আনন্দের হল এই যে ১৯ ৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তিলাভ করে । প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজকে ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে হয় । তারা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । ঘোষণা করতে হয় স্বাধীন রাষ্ট্রের । কিন্তু ইংরেজরা তাদের কূটকৌশল ব্যবহার করে দেশটাকে ভাগ করে দিয়ে যায় । শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশটি ভারত ও পাকিস্তান দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

 ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন । কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বঙ্গ ও অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে দুটি নির্ধারণ কমিশন গঠন করেন । উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্যার শেরিল রেডক্লিফ । ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা তার নাম অনুসারে 'রেডক্লিফ লাইন' নামে পরিচিত । তাঁর সৃষ্ট বিভাজন অনুযায়ী সিন্ধু, বেলুচিস্থান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় । ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারত স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে । ভারতের আকাশে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ে । আর বেদনাজনক ঘটনাটি হল, এই দেশভাগকে কেন্দ্র করে তার কিছু আগেও পরে দেশব্যাপী ব‍্যাপক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অত্যাচারে সেখানকার হিন্দু শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয় ও ছিন্নমূল হয়ে দলে দলে ভারতের অন্তর্গত পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্ত হয়ে আশ্রয় নেয় । অন্যদিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখদের অত্যাচারে দলে দলে মুসলমান পশ্চিম পাঞ্জাবে আশ্রয় গ্রহণ করে । অন্যদিকে দেশের পূর্বাঞ্চল বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা  দিতেই সেখানে ব্যাপক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । 

১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংগঠিত হয় ভয়ংকর দাঙ্গা । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে 1946 সালের 29 শে জুলাই বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের অধিবেশনে যেভাবে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে-,"The Muslim Nation to resort to Direct Action to achieve Pakistan and the consequent fixing of August 16th as Direct Day." { Letter of Sir F. Burrows ( bengal ) to Field Marshal Viscount Wavell, Calcutta, 22 August,1946, Letter No. 197 T. P. Vol-VIII } মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শুক্রবারে সারা ভারতবর্ষে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয় । তার প্রস্তুতি হিসেবে প্ররোচনামূলক লক্ষাধিক পুস্তিকা বিতরণ করা হয় । এই ঘোষণার পর থেকেই  দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল । দেশভাগকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল 1946 সালের "The great Calcutta killing" । উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য এবং মুসলমানদের নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবিতে তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ১৬ আগস্ট কে Direct Action Day হিসেবে নির্ধারণ করে  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, "What we have done today ( the day when League Council passed the Direct Action resolution ) is the most heroic act in our history. Never have we...none anything except ...By constitutional methods." ( The Dawn, 30 August 1946 ) ১৬ আগস্ট তারিখ সকাল থেকে কলকাতার বুকে নেমে আসে এক বিভীষিকার কালো রাত । মানিকতলা, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মৌলালী, শোভাবাজার, মেছুয়াবাজার, ট‍্যাংরা, টালিগঞ্জ, টেরেটিবাজার, বেলগাছিয়া এবং অন্যান্য হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়ে যায় । এই সময় তোলা বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, এই দিন ময়দানে মুসলিম লীগের সভায় উপস্থিত জনতা লাঠি তরবারি ছুরি ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয় । এই সভায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেয় এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আহ্বান করে মিছিলফেরত উত্তেজিত জনতা হিন্দু দোকানগুলিতে লুটপাট ও নির্বিচারে হিন্দু নিধন ও নারীর ধর্ষণ চালাতে থাকে । মুখ‍্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন । এর প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে । যদিও ১৭ আগস্ট শান্তি রক্ষার্থে সব দলের নেতাদের সম্মিলিত আবেদন প্রচারিত হয়:–

ভাইসব,

 ভাই ভাইয়ের মধ্যে এই যুদ্ধ অবিলম্বে থামাইবার জন্য আমরা আপনাদের নিকট আবেদন জানাইতেছি । যাহা ঘটিয়াছে তাহা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক । আসুন এই কাহিনী আমরা ভুলে যাই । কে দোষি আর কে নির্দোষ সেই তর্ক করিতে থাকিলে আরও জীবন ও ধনসম্পত্তি নষ্ট হইবে । যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে এখানেই তাহার শেষ হউক । এই মারামারি এখন যেমন করিয়াই হউক বন্ধ করিতেই হইবে ।

 প্রত্যেক ভাইকে আমাদের অনুরোধ, আপনারা আমাদের পরামর্শ শুনুন । ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে । লাঠি বা অস্ত্র লইয়া চলাফেরা করিলে জীবন বিপন্ন বা গ্রেফতার হইবার আশঙ্কা ।

 আপনারা যে যাহার মহল্লায় থাকুন, অপরের মহল্লায় বা পাড়ায় অনধিকার প্রবেশ করিবেন না । সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি লইয়া মহল্লা শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করুন এবং সম্মিলিতভাবে শান্তি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করুন ।

নিবেদক―স্বাক্ষর 

শরৎচন্দ্র বসু,  এইচ এম সোহরাবর্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, দেবীপ্রসাদ খৈতান, কিরণ শঙ্কর রায়, ভূপেশ গুপ্ত, মোহম্মদ আকরাম খাঁ, নিহারেন্দু দত্ত মজুমদার মোহর সিং জ্ঞানী, পাঁচুগোপাল ভাদুড়ী, সামসুদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসিম, ভবানী সেন, খাজা নুরুদ্দিন, হামিদুল হক চৌধুরী
( কলিকাতা ১৭ই আগস্ট ১৯৪৬ ) ( অমলেন্দু সেনগুপ্ত―উত্তাল চল্লিশ : অসমাপ্ত বিপ্লব, পাল পাবলিশার্স, ১৯৯১, কলকাতা, পৃষ্ঠা–১৪৭ ) । ১৮ তারিখ হিন্দুরা মুসলমান অঞ্চল গুলিতে ভয়াবহ আক্রমণ চালায় । ১৮ আগস্ট সকালে বাস ও ট্যাক্সি ভর্তি হিন্দু ও শিখ তরোয়াল, লোহার রড, এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহযোগে প্রতিরোধ আক্রমণ শুরু করে । মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরের চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় । প্রায় এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন । এদিকে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রায় এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল । 

কোলকাতা দাঙ্গার ঠিক সাত সপ্তাহ পরে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় একই রকম ভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মূলত কলকাতার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা জেলায় ছোট বড় দাঙ্গা ঘটে গেলেও ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বকোণে নোয়াখালী ত্রিপুরা কুমিল্লা ও সন্দীপ এলাকায় একতরফা হিন্দু নিধন ও উৎপাদন শুরু হয় । এবং প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় স্থানীয় মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুদের উপর সংগঠিত হয় গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট, হিন্দু মন্দির ধ্বংস বা অপবিত্র করা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা । লিগ সরকার প্রায় এক সপ্তাহ এ খবর প্রকাশ করতে দেননি । এই দাঙ্গায়  কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার হিন্দু হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয় । তাছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দু নারীপুরুষকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় । ব‍্যাপক বাস্তুত‍্যাগেরও ঘটনা ঘটে । এই সময় উপদ্রুত এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৭৫ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্ত্রীপুরুষ শিশুসহ কুমিল্লা চাঁদপুর আগরতলা ইত্যাদি স্থানের ত্রাণ কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শেষ দিকে মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী সফর ও গ্রামে গ্রামে পরিদর্শন হয়তো হিন্দুদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । ফলে উত্তরোত্তর সন্ত্রাসের তাড়নায় আবারো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন । এই দুই নারকীয় ঘটনাই ভারত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে ‌। কবি জীবনানন্দ দাশের ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় রাজনীতির আড়ালে সৃষ্ট এই ধর্মীয় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে–


মানুষ মেরেছি আমি তার রক্তে আমার শরীর / ভরে গেছে পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার / ভাই আমি আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু / হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর / কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে / বধ করে ঘুমাতেছি ..../ যদি ডাকি রক্তের নদী থেকে কল্লোলিত হয়ে / বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি, / হানিফ মোহাম্মদ মকবুল করিম আজিজ / আর তুমি আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে / চোখ তুলে শুধাবে সে, রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে / বলে যাবে গগন বিপিন শশী পাথুরেঘাটার ; / মানিকতলার শ্যামবাজারের গ্যালারি স্ট্রিটের এন্টালির । (১৯৪৬-৪৭ জীবনানন্দ দাশ )

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয় । কলকাতার গণহত্যা ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পর ৩০ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বরের মধ্যে ঘটা এই দাঙ্গার ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে । ২৫ থেকে ২৮ অক্টোবর এর মধ্যে ছাপরা ও সরণ জেলায় মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে । অতি দ্রুত পাটনা মুঙ্গের এবং ভাগলপুর মারাত্মক সহিংসতার জায়গায় পরিণত হয় । ১৯৪৬ এর শেষ দিকে এবং ১৯৪৭ এর গোড়ার দিকে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রদেশেও দাঙ্গা হয়েছিল । দাঙ্গা যেমন দুই বাংলাতেই সংঘটিত হয়েছে তেমনি প্রতিরোধও হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রয়াসে । কোলকাতায় যেমন বহু হিন্দু বাঙালিরা আতংকিত মুসলমানদের লুকিয়ে রেখেছেন, ঠাঁই দিয়েছেন নিজেদের ঘরে তেমনি পুববাংলায়ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানগণ এগিয়ে এসেছিলেন হিন্দুদের জীবন ও ধনসম্পদ রক্ষায় ।  রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন হিন্দু অধ‍্যুষিত পাড়াগুলোতে । অপারগ হয়ে উঠলে গোপনে এগিয়ে দিয়ে এসেছেন সীমান্ত পর্যন্ত । হিংসার বহ্ন‍্যুৎসবের মধ‍্যেও স্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিন মানবিকতা ।

এই দাঙ্গার ফলেই সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ লাভ করে অগণিত উদ্বাস্তুর স্রোত । দেশভাগের ফলে শুধু হিন্দু বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি । তার বলি হয়েছে মুসলমানরাও । তারাও দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে । এই দেশভাগ ও তার যন্ত্রণা আমাদের ইতিহাস চর্চার সামনে বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় । স্বাধীনতা ও দেশভাগ আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সামনে এক অলঙ্ঘনীয় লক্ষণরেখা টেনে আনে । সেই ইতিহাস চর্চা শুধুমাত্র সরকারি তথ্যনির্ভর থাকেনি । আর্কাইভনির্ভর খাতে প্রবাহিত হয়নি । প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতার কথাও উঠে এসেছে । যারা দেশভাগের শিকার হয়েছেন, ধর্মীয় সহিংসতায় সবকিছু থেকে উৎখাত হয়ে ভাসমান জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদের থেকেও তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে । অনেকে সে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন পার করে দিয়েছেন । অনেকে আজও বেঁচে আছেন সেই দগ্ধ অন্ধকার দিনের চিতানলকে বুকে নিয়ে । তাদের স্মৃতিতে ঠাসা হয়ে আছে অনেক যন্ত্রণা । অনেক বেদনা । আর স্মৃতি তো চিরকাল অমলিন থাকে না দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও অব্যক্ত স্মৃতিও একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় । আজও হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক স্মৃতি । স্মরণ ও বিস্মরণ এবং উত্তরপ্রজন্মের অভিজ্ঞতা যা আছে তা তুলে নেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে আবার । 

হয়তো অনেকে বলবেন– 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালবাসে?'  না, এ বেদনা জাগাতে হবে । এই বেদনা একটা জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস । এ বেদনার অভ্যন্তরে রয়েছে দেশভাগের বিষবৃক্ষটি । তাকে চিহ্নিত করতে হবে । তাকে উৎখাত করতে হবে, যাতে এই জাতীয় পরিস্থিতি যেন আর সৃষ্টি না হয় । জানাতে হবে । জাগাতে হবে উত্তর প্রজন্মকে । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার উদ্বাস্তু কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন–

            আমরা সবাই উদ্বাস্তু 
            কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
             কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে । ( উদ্বাস্তু-অচিন্ত‍্যকুমার সেনগুপ্ত )

আদর্শ থেকে উৎখাত হয়ে গেলে একটা জাতির আর কিছু থাকে না । আদর্শের ভিত্তিটাকে দৃঢ় করার জন্য, পারস্পরিক সম্প্রীতির বাতাবরণকে সুদৃঢ় করার জন্য, 'আজাদী কা অমৃত মহোৎসব'-এ দেশভাগের অভ্যন্তরে নিহিত তীব্র ধর্মীয় দ্বেষ নামক গরলটাকে মন্থন করে তুলে ফেলতে হবে । তাতেই রক্ষা হবে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব ।

Friday, August 5, 2022

MY PENSION FROM JULY–2022

Pension up to Jun-23 : BP = 40500 = DA =  1215 ( 5% ) REC = 0 COMM = 0 DIS = 0 IR = 0 OLD = 0 FMA = 500 TDS = 0 NET = 35915

Pension from Jul-23 : BP = 40500 = DA =  3240 ( 8% ) REC = 0 COMM = 0 DIS = 0 IR = 0 OLD = 0 FMA = 500 TDS = 0 NET = 37440