কবিতা কেন লিখি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
কেন লিখি? কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে প্রশ্ন- কবিতা কেন লিখি? এটা একটা বহুচর্চিত পুরোনো প্রশ্ন ৷ এই ঋদ্ধসময়ে তার প্রয়োজন আছে কী? এক সময়ে সমাজের অতি অল্প সংবেদনশীল মানুষ মননচর্চার আঙ্গিক হিসেবে লেখার মাধ্যমকে স্বীকার করতেন ৷ শুরুর কালে একটাই মাত্র মাধ্যম ছিল ৷ কাহ্নপা, লুইপা কিংবা চাটিলপা থেকে ভারতচন্দ্র কিংবা তার পরবর্তীকালে অধুনা অবধি অক্ষরোপজাত যা কিছু নির্মান তার অন্যতম হল কবিতা ৷ যা আজও বর্তমান ৷ ফারাকটা হল একসময় খুব কমজন এই মাধ্যমে চর্চা করতেন ৷ একসময়ে কবিতাই ছিল অক্ষরচর্চার একমাত্র মাধ্যম ৷ অবশ্য সেকালে কাউকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি ৷ সময় যতো গড়িয়েছে অক্ষরইমারতের শৈলীও ততো শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে ৷ আর যখনি এই সৃজনের চৌহুদ্দিটা বেড়েছে তখনই প্রশ্নটা এসেছে ৷ এতো এতো মাধ্যম থাকতে কবিতায় কেন আসা কিংবা 'কবিতা কেন লিখি'? সাধারণ প্রশ্ন হতে পারে ৷ সন্দেহদ্যোতক গোয়েন্দাসুলভ প্রশ্নও হতে পারে ৷ এই পরাপ্রশ্নের মধ্য দিয়ে জেনে নেওয়া এই ধারার লিখিয়ের মননের সরোবরে কোন্ তোলপাড়ের ফলে কবিতার জন্ম হয় ৷ মনোচন্দনবিতানে কোন মকরন্দের প্রকোষ্ঠপূরণ হয় ৷ কেন অন্যান্য মাধ্যমের আকার আয়তনের তুলনায় স্বল্পপরিসরে এই মননচিহ্ন বেশি বেশি মাত্রায় জায়গা করে নেয় পাঠকের হৃদয়ে ৷ বৃহত্তর সমাজের অমরপুরে ৷ বনেদি পুজোর মতো মর্যাদা পায় ৷ মূলত বিভিন্ন কবির কাব্যসৃজনের সৃজনোদ্যমের গভীর উৎখননের মাধ্যমে জেনে নেওয়া—কোন পললভূমিতে উপ্ত তাঁর কাব্যবীজ ৷ তারও আগে কীভাবে তাঁর মনের কোন্ ধর্মনগরে পূজিত অথবা লালিত হয় এই কাব্যবীজ ৷ 'এক সো পাদুম চৌখুটি পাখুড়ি' মেলে যেভাবে বিকশিত হয় ঠিক তেমনি কবিতাও কোন রন্ধনরসায়নে পাঠকের মননেও স্বাদু উপলব্ধির সঞ্চার করে ৷ নিশ্চয়ই কবিরও নিবিষ্ট প্রয়াস থাকে কবির হৃদয়কমলপুরে সৃজ্যমান কবিতাপুষ্পটিকে পাঠকের কাছে নন্দনমন্ডিত করে পরিবেশন করা ৷
জগৎ-জীবনের নানা ভুলভুলাইয়ার গলিঘুঁজির কৃষ্ণনগর থেকে বিমুক্ত করে কবি এগিয়ে আসেন শব্দের বিনির্মানে, অক্ষরের উল্লাসকর বিন্যাসে ৷ সন্ধিৎসু প্রশ্নকর্তার জানার বিষয়টিই হল কবিমনের রম্যআঁধারে সংঘটিত হওয়া নির্মানকলা ৷ এই জিজ্ঞাসা বহুকাল ধরেই চলে আসছে ৷ এই একটি প্রশ্ন বহুজন করেছেন ৷ বহু কবিকে ৷ বহু উত্তর এসেছে ৷ বহুবিধ উত্তর এসেছে ৷ বহুবিচিত্র উত্তরও এসেছে ৷ কোনো কোনো উত্তর কাছাকাছি ৷ কোনো কোনো উত্তর পরস্পর বিপরীত মেরুর ৷ কোনো কোনো উত্তর আবার কবিতার মতোই মেধার অতলান্তিক কেন্দ্র থেকে আগত ৷ কোনো কোনো উত্তর হাতের তালুতে নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রশ্নকর্তার সময় চলে যায় আর এক কবিতার ডানা মেলে ৷ নতুন করে প্রশ্ন করা হলে সেই একই গোত্রের উত্তরই হয়তো বেরিয়ে আসবে কালের কোনো কবির কাছে ৷ আবার দ্রুত ধাবমান সময়ে ব্যস্ততম জীবনের দৌড়বিদ কবির কাছে হয়তো অন্যতর কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে কবিতা লেখার তাগিদ ৷ সমস্ত প্রবহমান ভাবনাকে ভেঙেচুরে নতুন সৃজনসংকেতের ইঙ্গিত দিতে পারে ৷ এইভাবে কবিতার বাক-পরিবর্তন, বাঁক-পরিবর্তন,ভাষাব্যবধান, আধুনিকাভরণও আসে কালক্রমান্বয়ে ৷ কোনো কবির নির্মানে যদি এই পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়ভাবে না আসে, তিনি যদি নিজের বৃত্তের মধ্যেই থাকেন সময়কে সাথে না নিয়ে, সময়ের সঙ্গী না হয়ে তাহলে তাঁর উত্তরটি কালপ্রবাহকে পরিবহন করবেনা ৷ বর্তমানে বসে লিখলেও তাঁ উত্তরে নিকট অতীতের চিত্রই প্রকট হবে ৷
কবিতানির্মান হল একপ্রকার সৃজনস্পৃহা ৷ অন্তস্তলের বোধবল্লরীতে টোকা দিতে থাকে শব্দ ৷ বিচ্ছিন্নভাবে ৷ প্রকাশোন্মুখ এই শব্দকে সুন্দর ও সুচারুরূপে সাজিয়ে ছন্দের রশারশি দিয়ে বেঁধে সময়ের বুকে বেঁচে থাকার মতো ঋতুসহকরণ করে সৃষ্টি হয় কবিতার ৷ মা যশোদা যেমন গোপালকে পরমযত্নে সাজিয়ে তোলেন গোষ্ঠে যাবার জন্যে ৷ রাখালরাজা সাজবার জন্যে যেমন ধড়াচুড়ো দরকার তেমনি গোপীজনের মনোহরণের জন্যে মোহনবাঁশিটিও যে দরকার তা উপলব্ধি করেন যশোমতী ৷ সৃজনস্পৃহার পরের পর্যায়ে যশস্পৃহাই প্রকাশমুখী করে কবিতাকে ৷ প্রকাশের নন্দনই হল কবিতার কর্মশালার সক্রিয়তা ৷ সৃজনভূমি থেকে প্রকাশপ্রান্তর ৷ এর মধ্যবর্তী কর্মোপত্যকার তৎপরতাই হল কবিতা লেখা ৷ শব্দের সোনালিমাঠের এইসব কর্মকান্ডই হল 'কবিতা কেন লিখি'র সম্ভাব্য জবাব ৷
এই সাম্প্রতপ্রহরে সারা পৃথিবীকে শাসন করছে সামাজিক মাধ্যম ৷ এমনকি কবিতাকেও ৷ ফলে প্রত্যেকেরই প্রকাশকাঙ্ক্ষার দূরগামী মাধ্যমও হাতের নাগালে আজ ৷ ফলে কেউ কেউ নয়, সকলেই কবি হয়ে উঠতে চায় ৷ তারা নিজেই যা খুশি লিখছে ৷ নিজেই তাকে কবিতা বলে ঘোষণা দিচ্ছে ৷ অর্থাৎ যা লিখছে তাই কবিতা বলে চিহ্নিত হচ্ছে ৷ সামাজিক মাধ্যমে হাততালি পেয়ে অত্যুৎসাহী কবি কদিন পরেই আত্মপ্রকাশ করছে মুদ্রণমাধ্যমে ৷ আকাশের যতো তারা তার চেয়েও বেশি টাকা তাদের হাতে ৷ ফলে তাদের সৃষ্ট জঞ্জাল কবিতার নন্দনকাননে স্তুপীকৃত হচ্ছে ৷ চলমান হুজুগে এইসব কবির সামনে যদি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের লোগোলাগানো বুম ধরে প্রশ্ন করা হয় 'কবিতা কেন লিখি' বিষয়ে দুচার কথা বলুন ৷ তাহলে এই অগণিত কবির স্রোতের মধ্যে কজনের কাছ থেকে যে একটা আলোকস্পর্শী উত্তর পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে ৷ তবে উত্তর অবশ্যই আসবে ৷ আর উত্তর হবে—কবিতা লেখার একটা বড়ো প্ল্যাটফরম পাচ্ছি তাই কবিতা লিখছি, কবিতা লিখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি তাই কবিতা লিখছি ৷ দ্রুতগামী সময়ের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সৃজনপ্রকাশ ঘটাতে পারছি কবিতা লিখে ৷ ব্যস্তজীবনের একঘেয়েমি তো কাটানো যাচ্ছে ৷ কিন্তু উত্তর আসছেনা তাতে কবিতার পরিমন্ডলে কী পরিবর্তন হবে ৷ এই কবিতাবলির চিরজীবী হওয়ার মতো কোনো আশা আছে কী নেই ৷ শব্দের শিলাগুহার সুড়ঙ্গপথের অন্ধকারে এগিয়ে যেতে যেতে এই কবিরা জানেননা সামনে কী গুহাপথ শেষ নাকি চেনাপৃথিবীর বাইরে এক অলৌকিক বিশ্ব রয়েছে ৷ তবুও তাঁরা কবিতা লেখেন ৷
এতো পথ পেরিয়ে আমিও কবিতা লিখি ৷ কিন্তু কেন লিখি আমি কবিতা? এছাড়া আমার কী কিছু করার নেই? কেন নেই? একজন মুদি দোকানদারকে যদি প্রশ্ন করা হয়-কেন ব্যবসা করেন? উত্তর আসবে তার মতো করে ৷ কিন্তু আমি কী উত্তর দেব! আমি তো একান্তে নিজেকে কোনোদিন প্রশ্ন করিনি ৷ করা হয়ে ওঠেনি ৷ আসলে আমি কবিতা লিখি, না আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নেয়! কারণ কবিতা লেখার পর সৃষ্ট শব্দবন্ধ আমার কাছেই অপরিচিত মনে হয় ৷কে যেন বসিয়ে গেছে আমার কলমে ৷ এভাবে তো আমি প্রতিদিন ভাবিনা ৷ কোন্ আত্মম্ভর ভাবনা আমাকে দিয়ে কবিতা লেখায় ৷ আমি কবিতা লিখি ৷ 'কবিতা কেন লিখি' এ প্রশ্নের একাল-সেকাল একাকার করেও আমি জানতে পারিনা কেন কবিতা লিখি ৷ তবু আমি কবিতা লিখি ৷ হয়তোবা আমাকে দিয়ে কেউ কবিতা লেখায় ৷ আজীবন ভাতের দলা রাবারের বলের মতো আমার আগে আগে লাফিয়ে চলেছে ৷ আর আমি তার গোবিন্দভোগ গন্ধের পেছনে পেছনে ছুটে চলেছি তাকে ধরার জন্যে ৷ কবি হওয়ার বাসনা তো দূরের ৷ অন্নের উজ্জ্বল মোহময় আলো হয়ে ওঠে আমার কবিতা ৷ সেখানেই আমার যাবতীয় দাড়িয়াবান্ধা ৷ কবিতার জন্যে যে লালনস্পর্শ কাম্য সে লালন জোটেনি আমার আখরে ৷ আমার আখেরে ৷ ব্রাত্যবাস্তুর নির্জনতার মাঝেই আমার নির্মান ৷ আমার দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-প্রেম-অপ্রেম-হতাশা-বিষাদ-আশায় আমাকে শব্দ জুগিয়ে যায় কে যেন অবিরাম ৷ সে আমার সৃজনের সহচর ৷এক অন্য আমি ৷ মনে হয় ভেতরের সেই আমিও একজন স্রষ্টা ৷ এক অপরভুবনের জন্মদাতা ৷ তার কারণেই কবিতা লিখি ৷
No comments:
Post a Comment