Friday, December 30, 2022

খেজুরগাছের হাঁড়ি বাঁধো মন

খেজুরগাছে হা‍ঁড়ি বাঁধো মন....


অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছয়ঋতুর লীলাবিলাসের মধ‍্য দিয়েই গড়িয়ে যায় মানবজীবন । এই চক্রেরই একটা ঋতু শীতকাল । শীতকালে দরিদ্র মানুষের জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় । প্রতিটি হিমের রাত তাদের জন‍্যে যন্ত্রণা বয়ে আনে ।  কিন্তু তার বিপরীতে শীতের ইতিবাচক দিকও রয়েছে । শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম সব্জীতে কৃষিক্ষেত্র উপচে পড়ে ।  শীতের আর একটা আকর্ষণ হল খেজুরের রস । গ্রামজীবনে শীতের সঙ্গে খেজুরের রসের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । শীতের মরসুমেই গ্রামে গ্রামে ভোরবেলা গৃহস্থের ঘরে ঘরে বাংলার গৌরবের আর ঐতিহ‍্যের প্রতীক  খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের ধুম পড়ে যায় । এই মধুবৃক্ষের রস দিয়ে তৈরি হয় নানারকমের পায়েস, পিঠেপুলি, নলেনগুড় ইত‍্যাদি ।

একসময় অভিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরা ছিল খেজুর রসের ভান্ডার । সেসময়ে প্রায় প্রত‍্যেক বাড়িতেই দুচারটে খেজুরগাছ তো অবশ‍্যই ছিল । প্রায় বাড়ির সীমানা এলাকায়, খেতের আলের উপর খেজুরগাছ অবশ‍্যই শোভা পেত । আসাম-আগরতলা জাতীয় সড়কের প্রায় সবটাতেই রাস্তার দুপাশের ঢালগুলোতে একসময় খেজুরগাছ দেখতে পাওয়া যেত । বিশেষ করে দক্ষিণ দিক থেকে বাসে করে যাওয়ার সময় মাতাবাড়ি পেরুলে উদয়পুর শহরে প্রবেশের আগে রাস্তার বাঁদিকে শুকসাগর জলা । বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ । এই মাঠে প্রচুর খেজুরগাছ দূর থেকে দেখা যেত । কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজ‍্যের প্রায় সর্বত্রই খেজুরগাছ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেছে ।

  খেজুররসের একটা মিস্টি গন্ধ একসময় সকালসন্ধ‍্যা গ্রামের পরিবেশ মাতিয়ে রাখত । গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই খেজুরের রসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ত । ঘরে তৈরি নানারকম পিঠেপুলি খেজুরের রসে ডুবিয়ে খাওয়া হত মহানন্দে । খেজুরের রস একটি জনপ্রিয় পানীয় । সন্ধ‍্যাবেলা আর ভোরবেলার কাঁচা রস খাওয়ার আগ্রহ ছিল প্রত‍্যেকের । বিশেষ করে 'সন্ধ‍্যারস'র স্বাদ ছিল অনবদ‍্য । খেজুরের রস থেকে ঝোলাগুড়, দানাগুড়, পাটালি বা নলেনগুড় তৈরি হয় । আজ সে আনন্দ হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরগাছের অভাবে এবং খেজুর রস সংগ্রহের দক্ষ শ্রমিক বা গাছির অভাবে ।

খেজুরগাছ প্রায় পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে শুরু করে পঁচিশ ত্রিশ বছর পর্যন্ত রস দিয়ে থাকে । গাছ যত পুরোনো হয় গাছের রস দেওয়ার ক্ষমতা তত কমে আসে । তবে পুরোনো গাছের রস তুলনামূলকভাবে বেশি মিস্টি হয় । সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি থেকে খেজুরগাছ কাটা শুরু হয় এবং এই গাছকাটা পর্ব ফাল্গুনমাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে । বলাবাহুল‍্য শীত যত বাড়ে খেজুরগাছ থেকে রস তত বেশি ঝরে । রসের স্বাদও মিস্টি হয় । এই শীতকালের মধ‍্যে যেদিনের আকাশ মেঘলা থাকে সেদিনের রস ঘোলাটে হয় । রস ঝরেও কম । রসের স্বাদওততটা ভালো হয় না । মূলত পৌষ ও মাঘ মাস খেজুরের রসের ভরা মরসুম ।

খেজুরগাছ থেকে রসসংগ্রহ অত‍্যন্ত দক্ষ শ্রমিকদের কাজ । গ্রামদেশে এই শ্রমিকদের 'গাছি' বলা হয় । কোথাও কোথাও এদের 'শিউলি'ও বলা হয়ে থাকে ।  রস সংগ্রহের মরসুম আসার প্রাকমুহূর্তে এই গাছিরা ছেনি, বাটালি, বাঁশের নলি, কাঠি, হাঁড়ি, দড়ি ইত‍্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । অত‍্যন্ত ধারালো ছেনি-বাটালি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে খেজুরগাছের পাতাযুক্ত ডালাগুলো কেটে ছেঁটে পরিষ্কার করে কান্ডের একটা অংশ রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলেন । এই কাজটাকে বলা হয় 'গাছ ছোলানো' । এই গাছ ছোলার সময় একটা দিক লক্ষ‍্য রাখেন দক্ষ গাছিরা । গাছ এমনভাবে ছোলা হয় যাতে গাছের কাটা অংশে ভালোভাবে রোদ পড়ে । তারজন‍্যে গাছের পূর্ব ও পশ্চিমদিকে পর্যায়ক্রমে কাটা হয় । খেজুরগাছ কেটে তা থেকে রস সংগ্রহ কয়েকটি পর্যায়ের মধ‍্য দিয়ে চলে । গাছ ছোলার পর প্রথম কয়েকদিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় না ।কাটা অংশে রোদ লাগানো হয় । তারপরে কাটা অংশের দুধার ধরে  ইংরেজি 'V' অক্ষরের মতো সরু নালির মতো করে কেটে নিচের দিকে এক জায়গায় মিলিয়ে দেওয়া হয় । সেখানে সরু বাঁশের টুকরো নলের মতো করে গেঁথে দেওয়া হয় । ওপরে গাছের ডগায় কলসিতে বাঁধা দড়ি আটকিয়ে নিচে কলসি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় । সারারাত গাছ থেকে চুয়ানো রস নল বেয়ে হাঁড়ির ভেতর জমা হয় । সকালবেলা সেই রস সংগ্রহ করা হয় । পর্যায়ক্রমে সংগৃহীত এই রসের কয়েকটা নাম রয়েছে । প্রথমদিনের রস 'জিরান্তিরস' বা 'জিরানকাটার রস' , দ্বিতীয়দিনের রস 'দোকাটা' । তৃতীয়দিনের রস 'তেকাটা' । পরপর তিনচারদিন রস সংগ্রহের পর দু-তিনদিনদিন গাছ শুকানোর জন‍্য গাছকাটা বন্ধ রাখা হয় । এই পর্যায়কে 'জিরান্তি' বলা হয় । তারপর আবার কাটা শুরু হয় । 'জিরান্তিরস' বা 'জিরানকাটার রস' খুবই সুস্বাদু হয় ।

খেজুরের রসকে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় গুড় । খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার ফলে এক পর্যায়ে রস ঘন হয়ে পাওয়া যায় ঝোলাগুড় । অঞ্চলভেদে একে 'লালি' বা 'রাব'ও বলা হয় । ঝোলাগুড়কে আরো কিছুসময় জ্বাল দেওয়ার পর পাওয়া যায় 'দানাগুড়' । এই দানাগুড়কে আরো কিছুসময় জ্বাল দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান ঘন করে নেওয়ার পর নানা আকৃতির পাত্রে সংগ্রহ করা হয় বা বিভিন্ন রকম ছাঁচে ঢেলে নেওয়া হয় । একে বলে 'পাটালি' বা 'নলেন গুড়' । একসময় গাঁঘরে এই গুড় তৈরি ক্ষুদ্র শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল । ত্রিপুরার উদয়পুর-বিলোনিয়া-সাব্রুমের প্রায় প্রতি ঘরে খেজুরের গুড় তৈরি হয় শীতকালে । বিশেষ করে উদয়পুরের জামজুরি ও খিলপাড়ার খেজুরগুড় ছিল রাজ‍্যে বিখ‍্যাত । স্থানীয় এটি প্রবাদ রয়েছে–'জামজুরির যশ । খাজুরের রস' ।

খেজুর, খেজুরের রস আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে । লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় খেজুর, খেজুরের রসের উপস্থিতি রয়েছে । খেজুর গাছ কাটা নিয়ে আঞ্চলিক গান রয়েছে― 'ঠিলে ধুয়ে দেরে বউ গাছ কাটতে যাব/সন্ধ‍্যের রস ঝাড়ে আনে জাউ রান্ধে খাব' । বাংলা প্রবাদ-প্রবচনেও আমরা খেজুর বিষয়টি পাই । যেধরনের আলাপ প্রাসঙ্গিক নয় । শ্রোতাদের বিরক্তির উৎপাদন করে, মিথ‍্যা, অবান্তর এবং হাস‍্যরসাত্মক মনে হয় সেজাতীয় আলাপকে 'খেজুরে আলাপ' বা 'খাজুইরগা আলাপ' বলা হয় । চূড়ান্ত অলস বোঝাতে 'গোঁফ-খেজুরে' প্রবচনটি ব‍্যবহার করা হয় । খেজুর গাছের তলায় শুয়ে থাকা ব‍্যক্তিটির গোঁফের উপর পাকা খেজুর পড়েছে, কিন্তু সে এত অলস যে ভাবছে সেটাও মুখে চিবিয়ে খেতে হবে । কত কষ্টকর বিষয় । কতটা পরিশ্রমের ! বাংলা লোকসাহিত‍্যে আর একটা অমূল‍্য সম্পদ ধাঁধায় ও খেজুর গাছের প্রসঙ্গ রয়েছে । 'মাইট্টা গোয়াল কাঠের গাই/বাছুর ছাড়া দুধ পাই' অথবা 'মাটির হাঁড়ি কাঠের গাই/বছর বছর দোয়াইয়া খাই' ।–( খেজুর গাছ ) । এমনি নোয়াখালির একটি ছদ্ম-অশ্লীল ধাঁধায় পাই–'দোম্বাই যাই জাপটাই ধরি/করে টানাটানি/মৈদ্দ আনে খিলি মাইচ্ছে/ভিৎরে হড়ে হানি' ।–( খেজুর গাছ থেকে রস পড়া ) । আমাদের নানা স্থাননামেও খেজুরপ্রসঙ্গ রয়েছে । খেজুরগাছের প্রাচুর্যের কারণে স্থানের নাম রয়েছে―খেজুরি (পশ্চিমবঙ্গ ), খাজুরা (যশোহর, বাংলাদেশ ), খেজুরবাগান ( আগরতলা, ত্রিপুরা ) । বিয়ের গানে রঙ্গরসিকতায় খেজুরকাঁটার উল্লেখ পাওয়া যায়–'বেয়াইরে বইতো দিয়ুম কি/খাজুর কাঁডার মোড়া বানাইয়ের/ বেয়াই বইতে লজ্জা কি ?/এমন মোড়াৎ বেয়াই/ কনদিন বইতা হাইরছনি ?' 

  খেজুরগুড় লোকঔষধরূপেও প্রচলিত । খেজুরগুড় হজমে সাহায‍্য করে । আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে । ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে । সর্দি-কাশি ও ভাইরাল জ্বরের হাত থেকে রক্ষা করে । দেহে হরমোনের সমতা বজায় রাখে । খেজুর গুড় প্রাকৃতিক চিনি বা ন‍্যাচারাল সুগার । আজকাল চিনির ব‍্যবহারের ক্ষতিকর দিক এড়ানোর জন‍্য প্রাকৃতিক চিনি বা স্টেভিয়া ইত‍্যাদির ব‍্যবহার চলছে । সেইক্ষেত্রে খেজুরের গুড়ের এই স্থান নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও  তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে । একসময় কাঁচা খেজুরের বিচি পানের সঙ্গে সুপারির বিকল্প হিসেবে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল । 

এছাড়া খেজূরের বিচি শিশুদের খেলার সামগ্রীও । তেমনি পাতা দিয়ে নানা খেলনা ও শিল্পোপকরণও তৈরি হয় ।  খেজুরগাছ পাখিদের নিরাপদ বাসস্থান । বন‍্য ও গৃহপালিত পশুর হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন‍্য খেজুর পাতা দিয়ে বেড়া দেওয়া হয় ।

খেজুর, খেজুরগাছ, খেজুরের রস কবিদের ও নজর এড়ায়নি । কবির ভাষায় পাই–'খালি কলসি রেখে দিলে ভরে যায় রসে/সেই রসে দিয়ে জ্বাল মন জুড়াই সুবাসে' কিংবা 'এমন শীতল মিস্টি কোথায় আছে নীর/পানমাত্র তৃষিতের জুড়ায় শরীর' । রস সবার আকাঙ্ক্ষার বিষয় । শীতের রস যেমন গ্রামজীবনে সবার মনে রসসঞ্চার করে তেমনি সাহিত‍্য ও সংস্কৃতিতেও 'রস' একটি বিশেষ নান্দনিক বিষয় । বৈষ্ণবশাস্ত্রে আমরা পঞ্চরসের সন্ধান পাই । শান্ত,সখ‍্য, দাস‍্য, বাৎসল‍্য ও মধুর বা উজ্জ্বলরস । তেমনি নাট‍্যশাস্ত্রেও রয়েছে নবরস । শৃঙ্গার, হাস‍্য, করুণ, রুদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্তরস । তেমনি বাংলার বাউলদের গূঢ় সাধনায়ও রয়েছে রসপর্যায় । বাউলদের সাধনা রসের সাধনা । দেহকে কেন্দ্র করে বাউলদের সেই গোপন সাধনা । নারীকে নিয়ে তাঁদের সাধনপদ্ধতি এগিয়ে যায় । বাউলদের মতে রজ, বীর্য ও রসের কারণে এই দেহের সৃষ্টি । এগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেই তার দেহসাধনা ।সেটাকে বাউলরা বলেন 'বস্তুরক্ষা' । বস্তুরক্ষা তাঁদের ধর্ম । বাউলদের হেঁয়ালিপূর্ণ গানেও রস শব্দটি পাওয়া যায় প্রায়শই । 'রস' তাদের পরিভাষা । বাউলদের গান বুঝতে হলে তাদের পরিভাষা বুঝতে হয় । পরিভাষা ব‍্যবহার করে বাউলদের গানের মধ‍্যে তাদের সাধনপদ্ধতির গোপন ইঙ্গিত থাকে । খেজুরগাছ, খেজুররস তাদের গানের মধ‍্যে তাই ব‍্যবহৃত হয় । ভবা পাগলার গানে পাই–
 খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন/ও গাছে জোয়ার আসিলে/ও গাছ কাটো কুশলে/কোনার দড়ি যেন পড়ে না তলে/কত গ‍্যাছো গ‍্যাছে মারা/নীচে পড়ে হয় মরন ।
আর একটি বাউল গানে আছে–
আমার গোঁসাইরে নি দেখছ খাজুর গাছতলায়/গোঁসাই ল‍্যাজ লাড়ে আর খাজুর খায়।
আবার অন‍্যত্র পাই–
যদি রস খাবি মন নলিন দানা/গাছে ভাঁড় বেঁধে দেনা বেঁধে দেনা ।

বাংলা কথাসাহিত‍্যের অসাধারণ রূপকার কথাসাহিত‍্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি অসাধারণ ছোটোগল্প 'রস' । খেজুরের রস ও গুড় তৈরির পেশায় নিযুক্ত গাছি মোতালেবের প্রেম ও দাম্পত‍্যজীবনকে ঘিরে অন্তর্দ্বন্দ্বময় জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে এই গল্পে । একটি সাধারণ ঘটনা সাহিত‍্যিকের কলমের যাদুতে কিভাবে রসোত্তীর্ণ হয়ে উঠতে পারে এ গল্প তার উজ্জ্বল উদাহরণ । এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র  গাছি  মোতালেব । তার নারীভোলানোর অসীম ক্ষমতা । এই গুণের কারণে সে সফল প্রেমিক । তার ছলনায় ধরা দেয় ফুলবানু-মাজু । এই দুই নারীকে ঘিরে তার পেশাগত জীবন ও জৈবিক তাড়না আবর্তিত হয়েছে । লেখক সময়ের প্রবাহে তুলে ধরেছেন খেজুরের রস, মোতালেব-ফুলবানু-মাজুর সংসারযাপন, কল্পনা-কামনা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ইত‍্যাদি । সমাজের এক নিবিড় ও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কলমের ছোঁয়ায় ।

 এই গল্পটিকে হিন্দি চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়েছে । সেখানে অমিতাভ বচ্চন অসাধারণ অভিনয় করেছেন ।

একসময় গ্রামের যত্রতত্র বিনা পরিচর্যায় বেড়ে উঠত এই মূল‍্যবান খেজুরগাছ । বলা হয়ে থাকে, এই খেজুরগাছের জন্ম আরবে । তা সত্ত্বেও কালক্রমে বাংলা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ হয়ে ওঠে এটি । কিনতু বর্তমানে নানাকারণে এই মধুবৃক্ষ দিনদিন কমে আসছে । তার পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ‍্যে প্রধান হল–

ক ) পরিবেশ দূষণ ও নগরায়ণের ফলে ভূমির গঠনগত পরিবর্তন
খ) রাস্তাঘাট প্রশস্ত করতে গিয়ে নির্বিচারে খেজুরগাছ কেটে ফেলা
গ) জ্বালানি হিসাবে খেজুরগাছ কেটে ব‍্যবহার
ঙ ) মানুষের নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মানের ফলে খেজুরগাছ কাটা
চ ) দক্ষ গাছির অভাব ও বর্তমান গাছিদেরও রস সংগ্রহে আগ্রহের অভাব 
ছ) খেজুরের রস সংগ্রহের সময় বাদুড়, চামচিকেজাতীয় প্রাণী খেয়ে যাওয়ার ফলে নিপা ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হবার ভয় ইত‍্যাদি ।

কিন্তু এই বৃক্ষটি বৈজ্ঞানিকভাবে চাষ ও পরিচর্যা করলে তার উৎপাদিত ফসল গ্রামীন অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে । এ ব‍্যাপারে সরকারের বন ও উদ‍্যান দপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প এবং সামাজিক বনায়ণ কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করা যেতে পারে ।

Thursday, November 17, 2022

সংকীর্তন

যেথায় আছে সবার অধম দীনের হতে দীন/ সেইখানেতে চরণ তোমার রাজে' – আপনি অরূপের সন্ধান পেয়েছেন নিশ্চিত । কীর্তনের আসর যে শরীর-মন-আত্মাকে একবিন্দুতে নিয়ে সে অনুভব মহার্ঘ । গাঁয়ের পরিশ্রমী মানুষজনের  কীর্তনের আসরের তন্ময়তা ধ‍্যানেরই সহজিয়া রূপ । দূর অতীতের কাহ্নপা-চন্ডিদাস-ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদ-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল যেন একধারায় এসে মেশে এই আসরে । Soumit Basu সৌমিত বসু তার সর্বাধুনিক সংযোজন । ভালো থাকবেন ।

Monday, November 14, 2022

PROMOTION OF CULTURAL INTEGRITY WITH ASEAN COUNTRIES : TRIPURA AS A GATEWAY

PROMOTION OF CULTURAL INTEGRITY WITH ASEAN COUNTRIES : TRIPURA AS A GATEWAY

Asokananda Raybardhan. ( An eminent writer of Tripura )

Abstruct : The paper analysed India's policy towards its relation with Southeast Asian countries and tries to draw relevant inferences from India's recent afort to build peace in  Southeast Asia.  In this  study India's immediate neighbourhood refers to ASEAN members state and Prime Minister Narendra Modi's foreign policy laid strong Emphasis of 'Act East" and the "Neighbourhood First' policy that priorities strengthening India's relation with its immediate neighbours.

Tripura is a hilly state in North East India. Tripura as a geographical entity has a unique character.  It is bounded on three side by Bangladesh which is nearest to Myanmar( former Burma ) a member of Asian countries. This can be linked with our state as well as North East India making Bangladesh as a corridor. Tripura has also an ancient history of relation with ASEAN countries.

This paper addresses the evolution of India's neighbourhood policies over the years specially emphasizing on Cultural Relation. The paper puts forth a new prospects of integration and offers a set of recommendation based on cultural approaches for sustained engagement between India and ASEAN in order to build peace, stability, and prosperity in the region making Tripura as a gateway.

Key words :-Southeast Asia, ASEAN, INDO-ASEAN,  North East india, Act East, Neighbour First, Culture.

Introduction

India had a a glorious history of enormous influence of the civilization of south east asia for centuries. Indian influence spread through Southeast Asia by Indian traders and missionaries, about the beginning of common era. Indian merchants may have settled there bringing brahmins and Buddhist monks with them. Today the geographical and globalisation have changed the Dynamics of Indian subcontinent as well as of Southeast Asia with the growing economic aspiration of these countries, India could sink its trade interest with them by taking advantage of the already established firm cultural and Civilization Foundation by our forefathers. To promote Government of India's "Act East" and the "Neighbour first" policies and becoming a sectoral dialogue  partner of Association of Southeast Asian Nation's are a step toward the enhencement of this friendship and impact with member countries with similar culture, artistic tradition, family values and customs.

The association of Southeast Asian nations ( ASEAN)

The association of Southeast Asian nations ( ASEAN ) is an international organisation brings together ten Southeast Asian States Brunei, Cambodia, Indonesia, Laos, Malaysia, Myanmar, the Philippines, Singapore, Thailand and recently added timor Easte into one organisation. ASEAN is an economic  Union comprising 1o+1 members states in Southeast Asia, which promotes intergovernmental cooperation and facilities economic, political, security, military, educational, and socio-cultural integration between its members and other countries in Asia, ASEAN's primary objective was to accelerate economic growth and through the social progress and cultural development and also to keep regional peace and prosperity and its uniquely placed to address critical issues. ASEAN-led architecture provides a framework of a regular dialogue and cooperation that underpin peace and stability in south east asia.

ASEAN-Indian cultural links:

Through the centuries India's civilization and cultural values are spread across the globe but was firmly accepted by the South East Asian countries  (ASEAN ). 

Tamples :  In Cambodia , Thailand and Indonesia or Barma today, many symbolic remnants of India's influence are clearly visible in their art, culture and civilization. Temples of Angkor Wat , Pagan, BoroBudur and Prambanan bear evidence to the deep penetration of Indian art and architecture forms in these famous south east asian monuments. Some of these monuments surpass the grandeur of Indian temples from the same period because of their scale extensive stone based relief carvings and expenses. 

Trade : the marcantilr people in the past used to visit Southeast Asia region for trade. The king of palaces even wore Indian clothes and jewellery etc.some historians argue that during the era of Hindu Buddhist religious establishments of Southeast Asia came to be associated with economic activity and Commerce as petron  entrusted large funds which would later be used to benefit local economy by estate management, craftsmanship and promotion of trading activities. Buddhism, in particular, travelled alongside the maritime trade, promoting coinage, art and literacy.

 Literature : The south east Asia also created many literary works based on Ramayana but with something distinctively their own being discussable in them.

 Almost every country accepted Ramayana because it is easy to retell, understand , modify and apply to contemporary culture. 

Art Forms : Folk lore singers and artist played a very important role in popularising and modifying Indian literary works in South East Asia and it has the most popular and effective way to propagating Indian culture. Through retelling of stories from generation to generation the great epics of Ramayana and Mahabharata could be edited and retold to attract bigger and bigger audiences. The artist who popularized this were called 'Dalangs' and contributed to the process of adaption of these epic works originating outside their country by adding or changing them to make them more contextual and localized. This was the beginning of the formation of new text like *Seri Rama* (Malaysian adaption of Ramayana) and *Ramker* (Ramayana khmer) in Cambodia. These are regarded as some of the highest literary works of south east Asia.

Architecture : Similarly, sculptures and artists copied and combined original Indian motifs with local artistic motifs to arrive at something distinctively south east Asian and produced stylist masterpieces of their own. Modelled after Gupta period icons, the Cambodian (khmer) sculptures of 8th to 13th centuries are very different in appearance and form, yet their beautiful creation representing stylish figures of Gods and Goddesses , Buddha, Apsaras and demons with south east Asian features.

In mediaval times from 6th to 14th century there existed a great maritime empire based in the Indonesian Islands of Java and Sumatra. Many Indian artisans came to work temporarily in the coasts and were from Kalinga (modern day Odisha). They helped in building great temples and monuments. Many of the motifs on the walls of Barabudar and Angkor Wat resemble carrying of Konark and other mediaval temples of eastern India.   

Sanskritisation : Sanskrit scripts are the first form of writing known to have reached south east Asia. Similar alphabets were adopted for local languages as well. The alphabets used today for Burmese , Thai , Laos and Cambodia derive originally from Indian prototype. A large number of ancient inscriptions which have been discovered are in Sanskrit. 

Many ancient writings and inscriptions  have found in anskrit language showing Indian influence. Sanskrit terminology was used in all legal aspects of court procedures and only the factual aspects were described in vernacular. The use of Indian framework of court of law and public administration especially the concept of "God King" was adopted by many kings of south east Asia. They considered themselves to be incarnation or a descendent of one of the Hindu Deities. Later when Buddhism came , this view was modified. The king of Cambodia , Jaya Varman VII ( the founder of Angkor) and his successors were addressed by the people as king of the mountains and they built their palaces and temples on the hill peaks. (Bayon temple. )

Mythical Creation : The syncretic culture of south east Asia is evident in Buddhism being practiced in Hindu Temples in Cambodia , muslim wedding rituals and dress in Malaysia which are based on Hindu ritual and attire, Garuda–the bird-like vehicle of hindu god Vishnu is the name of Indonesian airlines and Naga,the snake-like mythical creature of indonesian mythology and Kuber which were prevalent in both Hindu and Buddhist culture can be seen curved in many places. A Mahabharata monument depicting Krishna and Arjun riding chariot pulled by eleven horses is placed prominently in a park in central Jakarta. South East Asia absorbed and retained it's past Indian influence in a very distinctive manner over the centuries and today it has melded into south east Asian culture.  

Exchange of Culture : In Indonesian shadow play involving leather puppets with movable arms and legs on a screen narrating scenes from Ramayana is very popular even today. It is also a popular art form of Odisha.  
 Reverse exchange is also seen regarding ideas and artistic techniques in the last century when Rabindranath Tagore travelled to south east Asia and brought the art of batik from Indonesia to India and taught it to the students of Shantiniketan. 

Food and Medicine : The influence of India , can also be felt in the food and flavours of south east Asia. There are many spices in common between Indian and south east Asian foods. Nearly, all the people of southeast Asian region eat rice and curry like the people of eastern India with many common ingredients. Indian herbal medicines also reached south east Asia from ancient times and are used even today in many countries.  Closer links with the south east Asian regions is thus a natural outcome for India and it's 'act east' policy.

*India as a dialogue partner of ASEAN*

Keeping in mind the glorious history of ancient India-South East Asia relation since the start of the partnership between India and the association of south east Asia has been developing quite a fast. India became a sectoral dialogue partner of ASEAN in 1992. Mutual interest led ASEAN to invite India to become it's full dialogue partner during the 5th ASEAN summit in Bangkok in 1995. India also became a member of ASEAN regional forum (ARF) in 1996. India and ASEAN have been holding summit level meeting on an annual basis since 2002. 

In August 2009, India signed the Free Trade Agreement (FTA) with the ASEAn members in Thailand. Under the ASEAN India FTA, ASEAN members countries and India will lift Important tariffs on more than 80% of trade products between 2013 to 2016 according to a release by ministry and commerce and industry.
Our commitment to promote the ASEAN-India strategic partnership guided by fundamental principles, shared values and norms that have steared the ASEAN- India dialogue relations since  its establishment in 1992,  including those enshrined in ASEAN charter, the Treaty of Amity and operation in Southeast Asia ( TAC ),The Asian community vision-2025, The Asian outlook on Indo-Pacific (AOIP ) The master plan on ASEAN connectivity ( MPAC ) 2025, The initiative for ASEAN integration ( IAI ) workplans, The declaration of the east Asia Summit ( EAS ) on the principles formutually beneficial relations ( 2011 ) The vision statement o the 20th anniversary ASEAN-india dialogue relation (2012 ) and the Delhi declaration of the ASEAN-India dialogue relation-2018
The 18th ASEAN-India Summit was held on 28th October 2021 virtually with Prime Minister Narendra Modi representing India to exercise the progress of India as on strategic partnership and the direction it needs to take.  Prime Minister Modi remarks at the India-ASEAN Summit were brief and to the point. At the very outset,  he mentioned the challenges posed by Covid-19 and how "this challenging time in a way was also the tast of India-ASEAN friendship.
He also referred to:-
 1). The shared values and history of India and Southeast Asia.
2).  The unity and integrity of ASEAN
3). India's Act East policy ( AEP ) and its security and for all in region ( Sagar ) policy.
4). The convergence between India's Indo-Pacific Ocean initiative and Asian Outlook for the indo-pacific

Importance of Indo-ASEAN Cultural Relation

Celebrating the rich cultural diversity and heritage of Asian remains an important driver of the culture and art sector. Culture and arts cooperation servs as an engine for economic growth and sustainable development, a building block for social Cohesion and transformation, an asset for regional Pride as well as a vehicle for foregoing closer friendship and understanding.
 In a world of prevailing cultural passimism our culture sector continuous to play a leading role to fostering a culture of peace, tolerance and mutual understanding. Longstanding aforts to mainstream the role of culture and arts in achieving peace and progress in the region are  evident with multitude of policy and project initiative put in place yearly. Flagship initiatives included the ASEAN city of culture, and the best of ASEAN performing arts, other activities and cultural showcases, preservation  on conservation of tangible and intangible heritatage, support and promotion of Creative and cultural industry ( SEMECs )arts exhibitions, capacity building for Museum professionals, music, literature, performing arts, Contemporary Arts, food in cultural festivals and cultural Policy dialogues.
 Going forward the culture sector is spearheading the development of the narrative of ASEAN identity, as part of the the continuing efforts to promote awareness and Foster a shared identity.  To further celebrate the cultural dynamism and vibrancy of the region, story are under way to promote and develop our small and medium cultural Enterprises   ( SMCES ) to bolstar regional development of the digital and creative economy. ASEAN culture and arts sector is committed to advancement of culture as in important foundation for building the ASEAN community. The culture sector collaborates with dialogue partners and various stakeholders to raise awareness and celebrate the reach histories, cultures, arts, traditions and values of ASEAN region.

Tripura as a Gateway :

The International border between India and Myanmar ( formerly Burma ) one of the the ASEAN countries i 1,643 kilometre( 912 mile )  in length and  runs from the the tripoint with China in the north to the tripoint with Bangladesh. Arunachal Pradesh, Manipur and Mizoram of lndia share their boundaries with neighbouring country Mayanmar. Geographically close to India Myanmar was a vital link between India and Southeast Asia. Therefore, the region was impacted by Northeast India and Southeast  Asia the most and in terned developed a close rapport with Northeast India. Tripura is a hilly state in northeast India bordered on three sides by Bangladesh which is nearest neighbour to Mayanmar ( Former Burma ).Through the centuries there was a political and cultural relation between Tripura and Mayanmar. Pilak a place of southern part of Tripura was renouned for education and culture. Students from Mayanmar ( former Arakan ) would come Pulak for studies. They would travelled to through Bangladesh. According to oral history, it is said that the two tribal groups of Tripura Chakmas and Mogs are migrated from Myanmar ( former Burma ). So their religious customery,traditional and linguistic commonalities are found with arakanese ( Burmese ). Moreover some groups of Asiatic race of Southeast Asia i.e. Santhals, Mundas, hoes etc. are also have migrated to Tripura from time to time. 

Recommendations :

In this context, I am convinced that the following steps may be taken in Tripura to enhance Cultural Relation between ASEAN and India as a part of "Act East" and  "Neighbour First" policy.

I). To open cultural and study centres by each of the Asian countries and to promote and the nature creative and cultural activities 

Ii). To open Institutions of Higher Education where the students from ASEAN  countries and India may admit and render their studies and research works on Southeast Asian language,literature, history and culture.

Iii). To construct a Trans-Asia highway from Tripura to Myanmar the nearest Southeast Asian country making Bangladesh as a corridor.  It is to be mentioned here that, newly constructed Bridge on Feni river in sabroom town of South Tripura will bring a new era in "Neighbour First"policy.
Iv). As a step of "Neighbourhood First" policy the railway connection may extend from Sa room, the last station of South Tripura to Nazir haat of Bangladesh. This will create a new connection with Tran-Asian Railway.

v)  In reference to the above, there is a scope of Tourism Development through the Highway which will lead to visit our historical places and also to revive the ancient relation of transition of pilgrims and other tourists.

Vi) To  organise food and costume festival and trade fair where the representatives from Asian countries will participate 

Vii) To construct International Standard hospital and medical educational institution to render facilities of international level nursing and treatment as well as encourage institutional and Technical innovation in the provision of Healthcare and study.

Viii) Organise Cultural Summit periodically to share the views of  each other regarding cultural development of Southeast Asia and India.

Ix).  To start the function of ICP at Shabroom of South Tripura district as early as possible and also open to all categories of international travelers with valid documents and Visa as a part of Act East as well as "Neighbourhood First" policy.

Hope that, above mentioned steps will energize our joint effort to deepen the ASEAN-India relation through sharing knowledge, practice and providing valuable inputs and initiatives to strengthening and caltural Heritage, peace, stability and prosperity as well as a Trade and Maritime cooperation between Southeast Asia and India using Tripura as a gateway.

 Wish you all health and happiness   in the new year of 2022.

                  THANK YOU🙏🏼

Saturday, November 12, 2022

নেই কেন সেই গোলা নেই কেন

নেই কেন সেই গোলা নেই কেন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।

বাঙালির জীবনপ্রণালী একসময় মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল । ছয় ঋতুকে ঘিরে কৃষিকর্মের মধ‍্য দিয়েই সংবৎসরের আহার্য সংগ্রহ করা হত । গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার বৃষ্টিজলে ভিজে যে ফসল ফলানো হত , শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের শেষদিকে সে ফসল ঘরে আসত । কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল । হেমন্তের দুটি রূপ । কার্তিক মাসটি ছিল অভাব অনটনের মাস । এইসময় বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ‍্যাভাব দেখা দিত । সারাবছরের অন্নসংস্থান করার জন‍্য যে খাদ‍্যশস‍্য জমিয়ে রাখা হত সেই ধান-চাল কার্তিকে এসে ফুরিয়ে যেত । ধান-চালের ভান্ডার খালি হয়ে যেত । তাই কার্তিকমাসের একটা দুর্নাম ছিল । এই মাসকে বলা হত 'মরা কার্তিক' । রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও মন্দাক্রান্ত কার্তিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায় । আর অগ্রহায়ণমাসে পাওয়া যায় এর বিপরীত চিত্র। এই সময় মাঠে মাঠে সোনালি ফসলে ভরে যায় । শুরু হয় ফসল কাটা । ঘরে ঘরে শুরু হয় ব‍্যস্ততা । চলে নবান্নের আয়োজন । কৃষাণী বধূ উঠোন নিকানোর কাজ শুরু করে । চলে ধান মাড়াই, পাকা ধান শুকানোর কাজ । একসময় পাকা ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে ।

একসময় গ্রামে বর্ধিষ্ণু কৃষকের প্রতীক ছিল ধানের গোলা । ধানের গোলা বাঙালির গ্রামীন শস‍্যগুদাম । বাঙালির সংসার বলতেই একটা কথা প্রচলিত ছিল 'গোয়ালভরা গোরু, পুকুরভরা মাছ আর গোলাভরা ধান' । গ্রাম বাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল এই ধানের গোলা । সম্পন্ন গৃহস্থরা ধান রাখার জন‍্যে এই গোলার ব‍্যবহার করতেন । অতীতদিনে বাড়িতে ধানের গোলা না থাকলে  গৃহস্থরা সেই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতেন না । নোয়াখালি অঞ্চলের একটা প্রবাদে পাই 'হোলা বিয়া করাইবা জাত চাই /  মাইয়া বিয়া দিবা ভাত চাই' । কৃষকের ধানের গোলার সঙ্গে ধনের দেবী লক্ষীর নিবিড় সম্পর্ক । লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় ধানের গোলার চিত্রও অংকন করা হয় আজো । বিয়ের পর নববধূ শ্বশুরবাড়িতে এলে তাকে ধানের গোলা দেখানোর লোকাচার দক্ষিণ ত্রিপুরায় আজো রয়েছে ।

গ্রামদেশে শস‍্য সংরক্ষণের লোকজ প্রযুক্তি এই ধানের গোলা । গোলাঘরে ধান, বীজ রাখলে সেগুলো ভালো থাকে । শোবার ঘরে বা অন‍্যত্র ধান বা শস‍্যাদি রাখলে ইঁদুর ও সাপের প্রকোপ বেড়ে যায় । তাই গোলাঘরে ধান-বীজ সংরক্ষণ নিরাপদ । আগের দিনে বাড়িঘর নির্মানেও বাস্তুশাস্ত্র বা স্বাস্থ‍্যনীতি মেনে চলা হত । বলা হত ' দক্ষিণদুয়ারী ঘরের রাজা / পুবদুয়ারী তার প্রজা / উত্তরদুয়ারীর ভাত নাই / পশ্চিমদুয়ারীর কপালে ছাই' ।  আগেরদিনে বাড়িঘরের দক্ষিণদিক খোলা রাখা হত । সেই দিক দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথ থাকত । গৃহস্থবাড়ির ঐশ্বর্যসূচক এই গোলাঘর দক্ষিণদিকেই একপাশে থাকত । যাতে বহিরাগতরা এই গৃহস্থের ঐশ্বর্যের অনুমান করতে পারতেন । প্রবাদেও তেমনি রয়েছে 'পুবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ / উত্তরে কলা আর দক্ষিণে খোলা / গোলা' ।

এই ধানের গোলা নির্মানে লৌকিক প্রযুক্তির ব‍্যবহার ও ছিল সেইসময় । ধানের গোলা তৈরির জন‍্যে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন । তখনকার দিনে দশগ্রামে হয়তো দুচারজন গোলা তৈরির দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যেত । তাদের খবর দেওয়া হলে তারা এসে স্থান নির্বাচন করত । তারপর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যোগাড় হলে গোলা তৈরির কাজ শুরু হত ।  অপেক্ষাকৃত ধনাঢ‍্যরা বেশ শক্তপোক্ত গোলাঘর তৈরি করতেন । তারা পুরোটা বাঁশবেতের সাহায‍্যে করতেন । বাঁশ, বাঁশের পিঠের অংশের বেত,বাঁশ কেটে শক্ত কঞ্চি, বেত ইত‍্যাদি দিয়ে গোলাকার কাঠামো তৈরি করা হত । এরপর তার গায়ে ভেতরে ও বাইরে বেশ পুরু করে এঁটেল মাটির আস্তরণ লাগানো হত । চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচবার জন‍্যে গোলার মুখ রাখা হত অনেক উপরে । বন‍্যা ও ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন‍্যে ধানের গোলা অনেক উঁচুতে বসানো হত । নির্মিত গোলার মাথায় বাঁশ, ছন বা খড়ের ছাউনি থাকত । ধনী গৃহস্থরা কেউ কেউ টিনের ছানিও দিতেন ।

সাধারণ গৃহস্থরা অল্প খরচে ধানের গোলা তৈরি করতেন । এই গোলা তৈরির প্রধান উপকরণ হল ধান মাড়াই শেষে উদ্বৃত্ত খড় । ধানের খড় দিয়ে দড়ির মতো লম্বা বিনুনি পাকানো হত ।  খড়ের গাদা থেকে খড় টেনে একজন বিনুনি পাকানো শুরু করতেন ।আরেকজন সহযোগী পাকের সঙ্গে সঙ্গে খড় সরবরাহ করে যেতেন । এভাবে খড়ের সাথে খড় জুড়ে জুড়ে দীর্ঘ বিনুনি তৈরি করা হয় । এই লম্বা দড়িকে  গোলার জন‍্য নির্মিত বাঁশে কাঠামোর মধ‍্যে বৃত্তাকারে স্তরে সাজিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঘিরে ফেলা হত । এরপর এটার বাইরে ভেতরে গোবর-মাটি-তুষের মিশ্রণ পুরু করে লেপে দেওয়া হলেই শক্তপোক্ত মড়াই তৈরি হয়ে যায় ।

কালক্রমে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে একসময় গোলাঘরে ব‍্যবহার কমে আসে । গোলাঘর নির্মানের অভাবে কৃষকরা বাঁশের তৈরি ছোটো আকারের জালাতে ধান রাখতে শুরু করেন । এগুলোকে 'ডোল' বলে । উত্তর ত্রিপুরার সিলেটিরা বলেন 'টাইল' । একসময় বাঁশের তৈরি ডোল বা টাইল  সারা পূর্ববাংলায় ও ত্রিপুরার সর্বত্র ব‍্যবহার হত । চট্টগ্রাম, পার্বত‍্য চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা বনে প্রাপ্ত 'ডলুবাঁশ' নামে এক প্রজাতির বাঁশ দিয়ে বাঙালি ও উপজাতি কামলারা এই ডোল বানাতেন । ত্রিপুরার বাঙালি ও উপজাতিদের অনেকেই এই ডোল নির্মানে দক্ষ ছিলেন । তাঁদের নির্মিত ডোল কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে গ্রাম‍্য বাজারগুলিতে বিক্রির জন‍্য তোলা হত ।  বাজারের বিরাট অংশ জুড়ে থাকা সারি সারি ডোলের এ দৃশ‍্য এখন আর দেখা যায় না । সেই কামলারাও নেই । বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় ডলুবাঁশ ও এখন দুর্লভ ।  বাঁশবেতের এই লৌকিক শিল্পটি এখন বিলুপ্তপ্রায় । প্রসঙ্গত উল্লেখ‍্য, ত্রিপুরার মগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় যে আকাশবাতি ওড়ান তার গঠন ডোলের আকৃতির হওয়ায় দক্ষিণ ত্রিপুরার বাঙালিরা এই আকাশবাতিকে 'ডোলবাত্তি'ও বলেন । এই ধানের ডোল নিয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরার একটি প্রচলিত ধাঁধা হল 'রাজার বাড়ির মেনা গাই মেনমেনাইয়া চায় / হাজার টাকার ধান খাইয়া আরো খাইতো চায়' । লৌকিক ছড়াতে যেমন রয়েছে 'ছেলে ঘুমিওনা পাড়া জুড়াবেনা / বর্গী আছে দেশে / ধানের গোলা শেষ হয়ে যাবে / খড় কুড়াবে শেষে' । তেমনি আধুনিক কবির কবিতায়ও রয়েছে ধানের গোলার প্রসঙ্গ– 'ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা / ভাঙছ ঘর বাড়ি / পাটের আড়ত ধানের গোলা / কারখানা আর রেলগাড়ি ( তেলের শিশি-অন্নদাশংকর রায় ) । রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেছেন, 'রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা মন্দির করি পাছে / তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু শেষে আমার বাড়ির কাছে  ( দুই বিঘা জমি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) ।

সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা আজ হারিয়ে গেছে । বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা রূপকথার মতো শোনাবে আজ । বর্তমানে ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি গুদামঘরে ধান রাখা হয় । বাড়িঘরে পাট প্লাস্টিক ইত‍্যাদির বস্তায়ই আজকাল ধান মজুত করা হয় । এখন আর সেই বর্ধিষ্ণু পরিবার নেই । গ্রামীন চাষপদ্ধতিতেও এসেছে আধুনিকতা । ছোটো ছোটো পরিবার হয়ে ভেঙে গেছে বাঙালির একান্নবর্তী পরিবার । স্থান সংকুলানের অভাবেও গোলাঘরকে বিদায় জানাতে হয়েছে । যেমন বিদায় জানিয়েছে বাঙালি তার বহুবিধ লৌকিক সংস্কৃতিকে ।

Tuesday, November 8, 2022

অভিরামের দ্বীপচালান

অভিরামের দ্বীপচালান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আমি একজন দৃঢ়চেতা স্বাধীনতা সংগ্রামীর সন্তান । যিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের বিনিময়ে কোনো সাম্মানিক কোনো স্বীকৃতি গ্রহণ করেননি । তাঁর আদর্শেই আমি বেড়ে উঠেছি । প্রতিবাদী মানসিকতা নিয়েই চলি । ফলে এই স্বাধীন দেশের শাসক গোষ্ঠীর রাজনীতির সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারিনি । সারাটা জীবন ভুগতে হয়েছে তার জন‍্যে ।   কর্মজীবনে প্রাপ‍্য সুযোগ থেকে । দোরগোড়ায় এসে ফিরে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সম্মান । সে অনেক কথা ।

স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দল মুখ‍্য ভূমিকা গ্রহণ করার ইতিহাস তৈরি করেছে । ক্ষমতায় এসে তারা বিরুদ্ধ মতাদর্শের মানুষগুলোকে পদে পদে লাঞ্ছিত করেছেন । বিপ্লবীদের অনেকেই স্বাধীনোত্তরপর্বে রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হয়েছেন বার বার । তাঁদের অতীতের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড, তাঁদের অবদান বেমালুম ভুলে গেছে স্বাধীন দেশের কান্ডারীরা । ইংরেজ আমলের চর ও পুলিশ অফিসারেরা একসময় রাষ্ট্রের হাল ধরে ফেলে । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে বিপ্লবীদের নাজেহাল করতে ছাড়ে না । নানাভাবে নানা দুর্নীতিতে তারা জড়িয়ে পড়ে । চলমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে একসময় বিক্ষোভও হয় । গণতান্ত্রিক নিয়মে পরিবর্তনও আসে । বিক্ষুব্ধ দল ক্ষমতায় এসে শাসকেরই রূপ নেয় । নৃশংসতায় পূর্বসূরীদেরকে পেরিয়ে যায় । হয়তো আবারও বদল হয় । পতন ঘটে এক একটি স্বৈরতান্ত্রিক অধ‍্যায়ের । এই বিষয়গুলো ঘুরে ঘুরে আসতে দেখছি এ দেশে, এ রাজ‍্যে ।

পতনের পর প্রতিটি দলই নবীন সন্ন‍্যাসী হয়ে যায় । ভুলে যায় তাদের পূর্ব কীর্তির কথা । চলমান শাসকের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণ হয়ে কুৎসা  করে আর নতুন করে স্বপ্ন দেখায় মানুষকে । চলমান শাসকেরাও পূর্বতন শাসকের কুশাসনের ক‍্যাসেট বাজিয়ে পূর্বের প্রতিশ্রুতি কবরে পাঠিয়ে নতুন ঠাকুমার ঝুলি নিয়ে আসে । সুযোগসন্ধানীরা দলবদল করে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে । দলবদলের কারণে ফেলে আসা সহযোদ্ধাকে ল‍্যাং মারে । দলে যোগ দেওয়ায় পূর্বশত্রুকে গঙ্গাজলে ধুয়ে গলায় জড়িয়ে নেয় । সবগুলো দলই ক্ষমতায় থাকলে বিরুদ্ধ মতাদর্শের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে যায় । সাধারণ মানুষকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে । নানাভাবে নির্যাতন করে । দুবেলা পার্টি অফিসে হাজিরা না দিলে, মিছিলে না গেলে, তেলের বাটি নিয়ে নেতাদের বাড়ি না ঘুরলে সে নাগরিকদের রক্ষা নেই ।  

সুযোগসন্ধানীরা সুদিনে যে দলের ব‍্যানারবাহক হয় দিন ফুরোলে রাতারাতি অন‍্যদলের ঝান্ডাবাহিনীর সামনের সৈনিক হয় । যে নাগরিক বিরুদ্ধাচরণ করে তার বিরুদ্ধে মানুষ লেলিয়ে দেওয়া হয় । সে নাগরিকের কোনো নিকটাত্মীয় সরকারী চাকুরে হলে তার উপরেও কোপ আসে রাজনীতির । নিরীহ হলেও রেহাই থাকে না তার । আর কোনো সরকারি কর্মচারী অপছন্দের হলে তো তাকে সাতঘাটের জল খাইয়ে দেওয়া হয় । তাকে সাতবার গাড়ি পাল্টানো জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয় । অনেকটা পরাধীন ভারতবর্ষের দ্বীপান্তরের মতো । আবার দলীয় সূত্রে নতুন জায়গায়ও তার পরিচিতি পৌঁছে দেওয়া হয় । সেখানেও তার উপর থাকে শ‍্যেনদৃষ্টি । বৃটিশ আমলে পুলিশের নজরে যেমনটা ছিলেন বিপ্লবীরা । অসুস্থ মা-বাবা, সন্তান প্রিয়জন বিচ্ছিন্ন হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হয় যাওয়া ছাড়া , পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর গত‍্যন্তর থাকে না ।

 রাজনীতির এই নোংরামিগুলোর কথা বলে লাভ নেই । নামে রাজনীতি । রাজার নীতি । নীতির রাজা । কিন্তু এটাকে পেশাগতভাবে কব্জা করে নিয়েছে অর্ধশিক্ষিত ও নোংরা মনের মানুষেরা ও তাদের পোঁধরা সুযোগসন্ধানী মানুষেরা । আমার পেশাগত জীবনে আমি পদে পদে এইসব দুর্ভোগ পেরিয়েছি । আমি বলতে পারিনি সন্তানের মুখ চেয়ে । ছেলেদুটোকে আমার দাঁড় করাতেই হবে । আমার রক্ত তো তাদের শরীরে । তারাও চাকরির জন‍্যে নবরত্ন তেল নিয়ে নেতা-মন্ত্রীর দুয়ারে ঘুরতে পারবে না । বলতে পারিনি পরিজনের ভাবনায় । অন্নচিন্তায় । সেই ফিরিস্তি তুলে ধরলে লেখাটা আত্মকথনে ক্লিষ্ট হয়ে যাবে । আর কারো নাম করে তাঁকে বা তাঁদেরকে সমাজে হেয় করা আমার উচিত হবে না । আমার প্রতি বিরাগভাজন হলেও অন‍্যের হয়তো উপকার করেছেন । তাই দুঃখটা অন্তরেই পুষে রাখলাম । কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা দিন দিন অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি বলে বড়াই করছি । কিন্তু ঈর্ষা, প্রতিহিংসায় আমরা সেই আগের যায়গাতেই রয়ে গেছি । সাধারণ ছাপোষা কর্মজীবীদের নিয়ে আজও সেই নোংরামি সমানে  চলছে ।

Tuesday, November 1, 2022

সব পথ শেষে......

সব পথ শেষে.....

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম । চাকুরির শেষের কদিন আধিকারিক পদেও ছিলাম । ফলে অনেক ছাত্রের সান্নিধ্যে এসেছি তেমনি বহু গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্যেও এসেছি ।আর তেমনি এসেছি  শিক্ষাবিভাগীয় কিছু আপদ ঊর্ধতন কর্মকর্তাদেরও । যারা দলগুণে ওই পদগুলোতে বসে সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে অবিরাম অভব‍্য ব‍্যবহার করতেই অভ‍্যস্ত । কোনোরকম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেই আনন্দিত । চাকরিজীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রাপ্ত সেইসব লাঞ্ছনাগুলো ভুলে থেকেছি শুধু এই মহান ঈশ্বর পেশায় শিক্ষক হতে আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন বলে । আর অগণিত ছাত্র-শিক্ষকের,অভিভাবকদের ও সমাজের দেওয়া সম্মানকে মাথায় রেখেছি বলে । নইলে নাম করে বলে দিতে পারি, কোন আপদের কাছ থেকে কখন কি ব‍্যবহার পেয়েছিলাম এই আমি । বেশ কবছর হল, এই মহান পেশা থেকে অবসরে চলে এসেছি । এখনও শিক্ষক বলে সম্মান পাই । ছাত্রের কাছ থেকে । ছাত্রের বন্ধুজনের কাছ থেকেও শিক্ষকের মর্যাদা পাই । পূর্বপেশার পরিচয় পেয়েও অনেকে শিক্ষকের মর্যাদা দেন । এই প্রাপ্তিই আমার শেষ পারানির কড়ি । এ নিয়েই ওপারের ডাক এলেই পেরিয়ে যাব বুক ফুলিয়ে ।

শিক্ষক শব্দটাকে আমি মনেপ্রাণে নামাবলির মতো জড়িয়ে নিয়েছি আমার চেতনায় । তাই শিক্ষকের অমর্যাদা, শিক্ষকের লাঞ্ছনায়, শিক্ষকের গ্লানিতে আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে সবসময় । আজ কয়েকবছর হয়ে গেল আমাদের রাজ‍্যের এক বিরাট সংখ‍্যক শিক্ষক নিত‍্যদিন দারিদ্র‍্য, বুভুক্ষা, অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ছেন । একটা বিশাল অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকা হতাশায়, অনাহারে, রোগজর্জরিত হয়ে চিকিৎসার অভাবে চিরবিদায় নিয়ে গেছেন । তাদের নিয়ে শুধু দলবাজি হয়েছে । ভোটবাণিজ‍্য হয়েছে । কিছুদিন ভুল তথ‍্য দিয়ে একদল অবুঝকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে । বলা হয়েছে এরা শিক্ষকের যোগ‍্য নয় । যখন এই বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ‍্যে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত একজন আত্মহননের পথ বেছে নেন তখনই সবার সম্বিত ফেরে । এখনও যাঁরা লড়ে যাচ্ছেন তাঁদের মধ‍্যে এমন যোগ‍্যতার অধিকারী বেশ কজন আছেন । বেশ কজন আছেন প্রশাসনের অন‍্য যোগ‍্য পদে না গিয়ে শিক্ষকতার পেশায় এসেছেন । বেশ কজন কর্পোরেট সেক্টরের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের রাজ‍্যে এসে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন শুধু এই মহান ব্রতটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন‍্যে । আর এখানে এসে তাঁরা আজ পদে পদে লাঞ্ছিত হয়েছেন, আজও হচ্ছেন ।

 ১০৩২৩শিক্ষকদের সমস‍্যা আজ রাজ‍্যের জ্বলন্ত সমস‍্যা । চাকরি হারিয়ে আজ তাঁরা পরিবার পরিজন নিয়ে দিশাহারা । আমার চাকুরিকালীন সময়েই তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন । কাজেই তাঁদের নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে কর্মচ‍্যুতি সবটা সম্বন্ধেই আমার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে । চাকুরির সুবাদে এই শিক্ষকদের একটা বড়ো অংশের সঙ্গে আমার প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচয় রয়েছে । এঁদের অনেকে আমার ছাত্র, আমার একসময়ের সহকর্মী, অনেককে শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মশালা, প্রোগ্রামে পেয়েছি, অনেককে ডি এল এড-এ পড়িয়েছি । কাজেই তাদের যোগ‍্যতা, মেধা ও মনন সম্বন্ধে আমার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে । সেকারণেই তাদের দুঃখে ও লাঞ্ছনায় আমার কলম আমাকে তাড়িত করে তাদের জন‍্যে লিখতে । আমার আর কি এমন যোগ‍্যতা রয়েছে । আমাদের রাজ‍্যে তো কত শিক্ষকই তো জাতীয় স্তরে, রাজ‍্যস্তরে সম্মানিত হয়েছেন । রাষ্ট্রপতির হাত থেকে রাজ‍্যপালের হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন । অনেকেই শিক্ষাবিভাগীয় অনেক পদ সামলেছেন । তাঁরা সম্মানের সব সর ননী খেয়ে মোহন্ত হয়ে বসে আছেন । এই অবহেলিত শিক্ষকদের জন‍্যে একটা কাশিও দেননা তাঁরা । এই শিক্ষকরা যখন রুটি রুজি ফিরে পাওয়ার জন‍্যে রাজপথে নেমে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নির্যাতিত হন তখনই আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে কিছু লেখার জন‍্যে । আমার সেইসব লেখা সোস‍্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় । লিখে যে শুধু বাহবা পাই তা না । আমার কোনো বক্তব‍্য যদি  একাধিক গ্রুপে বিভক্ত এই শিক্ষকদের কোনো গ্রুপের সামান‍্য মনঃপূতও না হয় তাহলে আমার চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগাল করতে ছাড়েন না । তুই-তোকারি থেকে শুরু করে ভাষাব‍্যবহারে তাঁরা যে শিক্ষক সেই চিহ্নটুকুও মুছে ফেলেন । আমি নীরবে হজম করি । প্রথমত ভাবি, তাদের বিষয়ে নাক গলানোর তো আমার অধিকার নেই । দ্বিতীয়ত, তাদের মতো অবস্থায় থাকলে আমারও হয়তো হিতাহিত জ্ঞান থাকত না । তাঁদের অস্তিত্বের সংকটই তাঁদের ক্ষুব্ধ করে তোলে । কমেন্টগুলোর স্ক্রিনশট রেখে মাঝে মাঝে দেখি আর চোখের জলে ভাসি । তবুও কেন জানি বেহায়ার মতো লিখে ফেলি ।

 এই শিক্ষকরা বড়ো বেশি আবেগপ্রবণ ।  তাই তাঁদেরকে সবাই খেলার পুতুল ভাবে । রাজনীতির দাবার বোড়ে করে । সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ফুঁক করে । ওদের উপদলে ভাগ করে আন্দোলনকে দুর্বল করে । ওরাও একদল অবস্থান করলে আর একদল যায় না । একদল লাঠিপেটা জলকামানে বিধ্বস্ত হলে আর একদল টুঁ শব্দটি করে না । ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে একদল আর একদলকে লুকিয়ে যায় । একদল ক-এর ছত্রচ্ছায়ায় থাকে তো আর একদল ব-এর তোষামোদে কার্যোদ্ধারের স্বপ্ন দেখে । তারপরেও একসময় মোহভঙ্গ হয় কারো কারো । যাদুকরের মায়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় কেউ কেউ ।

এই দুখি শিক্ষকদের একাংশ সবশেষে তাদের আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন সম্প্রতি । তাঁরা তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেবার দাবিতে আমরণ অনশনের পথ বেছে নিয়েছেন । এযাবত নেওয়া তাঁদের সমস্ত প্রয়াস ব‍্যর্থ হয়েছে ভেবেই তাঁরা এই দুঃখজনক পথ বেছে নিয়েছেন । না খেয়ে খেয়ে একদল মানুষ প্রকাশ‍্যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, মৃত‍্যুর কোলে ঢলে পড়বেন একি কাম‍্য ! একজন সাধারণ নাগরিক কি এদৃশ‍্য সহ‍্য করতে পারবেন ?।আজ তাদের আন্দোলন ত্রয়োদশ দিনে পড়ল । প্রতিদিন অনশনকারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন । যে কোনো সময় দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যেতে পারে । এদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন‍্যে, প্রবোধ দেওয়ার জন‍্যে কেউ কাছে ভিড়ছেন না । সমাধানের ক্ষেত্রেও অহেতুক বহু কালহরণ হয়ে গেছে । পাষন্ড শিক্ষাবিভাগীয় অফিসারদের কথা শুরুতেই বলেছি ।ওদের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করা সোনার পাথরবাটি । যদি বোধোদয় হয় তো তা সুস্বাগত । রাজনৈতিক দলগুলো এখন জল মাপবে । কারণ সামনে নির্বাচন । এই সংকটময় সময়ে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই । এই অসহায় শিক্ষকদের সামনে সত‍্যিই আর দ্বিতীয় পথ নেই । নেই আর ।

Sunday, October 30, 2022

কার্তিকের কাব‍্যকথা

কার্তিকের কাব‍্যকথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
 হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে
 ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– দীপালিকায় জ্বালাও আলো 
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে ।                                                                ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

 বাঙালি জীবনের বারোমাস‍্যায় কার্তিকেরও ভূমিকা রয়েছে ।আশ্বিনের সংক্রান্তির সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় কার্তিকের আবাহন । হেমন্তের ঋতুর শুরুও এই সময় । প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কার্তিকমাসব‍্যাপী রাত্রিবেলা প্রতি গৃহস্থের উঠোনে জ্বালানো হয় আকাশপ্রদীপ ।  ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সারা কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয় । শাস্ত্রে আছে ভগবান বিষ্ণু দীর্ঘ চারমাস যোগনিদ্রায় অভিভূত থেকে এই মাসেই জেগে ওঠেন । তিনি পৃথিবীকে পালন করেন । তাই তাকে সন্তুষ্ট রাখতে ধর্মপ্রাণ হিন্দু জনগণ সারা কার্তিক মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঘি বা তেল দিয়ে  প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে । বাড়ির সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পূর্ব বা উত্তরমুখী করে প্রদীপ জ্বালানো হয় ।

 এই মাটির প্রদীপ আসলে মানবদেহেরই  প্রতীক । ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব‍্যোম এই পঞ্চভূতে যেমন নশ্বর দেহ তৈরি হয় মাটির প্রদীপ ঠিক তেমনি । ক্ষিতি বা মাটি দিয়ে প্রদীপের শরীর তৈরি হয় । অপ বা জল দিয়ে তার আকৃতি গঠন করা হয় । তেজ বা আগুন আত্মার মতো স্থিত হয় প্রদীপের অন্তরে । বাতাস সেই আগুনকে দহনে সহায়তা করে । আর ব‍্যোম বা অনন্ত শূন‍্য জেগে থাকে তার গর্ভে । জীবন্ত কর্মময় মানুষের প্রতীক প্রদীপ নির্বাপিত হওয়া জীবনেরই পরিসমাপ্তি । লোকবিশ্বাস মানুষ মৃত্যুর পরে বিষ্ণুলোকে গমন করে । কাজেই মৃত্যুর পরে মানুষের উপর বিষ্ণুরই অধিকার রয়েছে । সেকারণেই পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির লক্ষ্যেই ভগবান বিষ্ণুকে প্রসন্ন রাখার উদ্দেশ্যে এই সময়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন । 

এছাড়া এইসময়ে শীতের শুরু হয়ে যেত একসময় । বর্তমানে পরিবেশে বিশাল পরিবর্তন হওয়ার ফলে মূল শীত ঋতুতেও ততটা শীত থাকে না । প্রাচীন মানুষ শীতনিবারণের জন্য অগ্নির ব্যবহার করত । শীত ঋতুতে অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাসের কারণেও এই প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা । আবার এইসময়ে নতুন ধান পাকতে শুরু করে । এই সুযোগে সুপুষ্ট ধানকে পোকায় কেটেও নষ্ট করতে থাকে । এই মাসে আকাশ প্রদীপের আলো দেখে ধানের পোকাগুলো আলোর দিকে উড়ে আসে । খেতের ফসল পোকার হাত থেকে রক্ষা করার লৌকিক পদ্ধতিও ছিল এই প্রদীপ প্রজ্জলন । এক কথায় কার্তিকমাসের এই প্রদীপ জ্বালানোর  সঙ্গে বেশ কয়েকটা ধর্মীয় লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার এবং লোকবিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে ।

কার্তিক মাস এলেই প্রকৃতি অপরূপ রূপ নিতে থাকে । গাছে গাছে সাদা শিউলি ফুটে থাকে । ভোরের দিকে ঝরে পড়া এই ফুল কুয়াশায় মিশে খইয়ের মত গাছ তলায় পড়ে থাকে । শিউলির মৃদুগন্ধ ভোরের পরিবেশকে মধুর করে তোলে ।  বিস্তীর্ণ ক্ষেতের ধান ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ধরতে থাকে । কুয়াশামাখা সোনালি ধান মাঠের বুকে যখন ছড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় সোনার বসন পরে যেন এক অপরূপা রমণী মাঠময় শুয়ে আছে ।  একদিন ঘরে নতুন ধান উঠে । কৃষকের প্রাণে নতুন বার্তা সঞ্চারিত হয় । আয়োজন চলে নবান্নের । কার্তিকের প্রকৃতির অপরূপ রূপ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে–

 আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায় 
হয়তো মানুষ নয়– হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
 হয়তো ভোরের কাক হয়ে কার্তিকের নবান্নের দেশে 
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় 
                                                           ( রূপসী বাংলা )

কার্তিক মাস এলেই নতুন ধানের সৌরভের প্রত্যাশায় প্রকৃতি আর মাঠের সোনালি ধানের সোনারঙের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয় আবহমান বাঙালি । তার ভরসার মাস এই কার্তিক ।

Saturday, October 29, 2022

তিতাভাত

তিতাভাত

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

প্রথমে পাতে থানকুনি পাতা ও আদা । ভাতের মধ‍্যে নিমপাতা । ডালের মধ‍্যে উচ্ছে বা করলার টুকরো । অথবা হেলেঞ্চার ডাঁটাকুচি দিয়ে মুগ ডাল । গিমে শাক, সর্ষে দিয়ে পেপের সুক্তো । শেষপাতে গ্রাইন্ডারে নিমপাতা চটকে সরবত । যাতে এগুলো খেলে যমে না ছোঁয় । নরমাংস তেতো লাগে তার কাছে । তাই পরিবারের গুরুজন মারা গেলে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর পরবর্তী প্রজন্মকে যমের হাত থেকে রক্ষা করতে অন‍্য আত্মীয়স্বজনরা তিতাভাতের আয়োজন করেন ।

Friday, October 28, 2022

কালো মেয়ে

কালো মেয়ে
---------------------------------
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
**********************
আলোরাতের কালো মেয়ে লো  হৈমন্তী ঘ্রাণ তোর গায়ে 
কুয়াশার দীঘল রুমালে তুই  রেখেছিস জড়ায়ে

 লিপিদাগ শীতের আমন্ত্রণের  বিরল টেরাকোটা
লিখেছিস অমোঘ আখরে কালোবরণ ফোঁটা

যতোই জানি তোর ঠিকানা এই যে আঁধারমায়াগলি 
ততোবারই ভুলে যাই আমার কষ্ট গেরস্থালি

  এত কাল অবলীলায় মেখে নিলি তুই অঙ্গে
 তোর আলো বিলিয়ে দিলি তোর রূপটানেরই সঙ্গে ৷

সারিন্দার ধুন

সারিন্দার ধুন 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

যাত্রার আসরে সারিন্দার সুর বেজে উঠলেই,
 ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখের প্রথম বউ হয়ে ওঠা
 নারীটাও বুঝে যেত এবার বিষাদের দৃশ্য  ।

 বাজনদারের হাতের ছড়ের ঘায়ে কেঁপে যায় তারযন্ত্র–
নবীন বউয়ের বুকের ভেতর ফেলে আসা প্রেমিকের সংলাপ 
সুরের স্রোতে কেঁদে কেঁদে ভেসে যায় ।

কুয়াশা ঘেরা মাঠে হেমন্তের জোছনা ঠেলে 
বেরিয়ে যায় রাসমঞ্চের দিকে ।গোপিদের ঘোমটার ছায়া বিষন্নতা মাখে শেষরাতে
বউটা নিজেও একেকজন রাসরমণীর মতো
 পাক খায় স্মৃতি প্রেমিকের চারধারে ।

 নিজে কান্নার সুর তুলে রাতের মৌনতা বিপন্ন করলেও 
সারিন্দা জানেনা সে কাকে কাঁদিয়ে যায় ।
 বউটা একাকী উঠে যায় আসর ছেড়ে
 সামনেই তার আলোকিত চিকচিকে নীল যমুনার জল ।

ঘরোয়া মানুষ

ঘরোয়া মানুষ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ঘাড় ফেরালেই একটা মুখও দেখা যায় না 
যে মুখে আছে প্রশান্তির আলো 
শুধু ভ্রষ্ট কথার রঙিন ফুলছড়ির তীব্র আলোয় 
ঝলসে যায় মানুষের মুখগুলো 

এই ঝলসানো মুখের মানুষগুলো স্বপ্ন ছুঁতে গিয়ে 
রাস্তায় দাঁড়ায় । রাস্তায় হাটে দল বেঁধে
 আশায় থাকে একদিন তারা পৌঁছে যাবে
 আকাশ গঙ্গার মৃদু আলোর শিবিরে ।

 আরো অনেকেই সাথী হয় স্বপ্নের খোঁজে
 দগ্ধ মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের পথ করে নেয়। 

মন্থন শেষে বিশেষ ভন্ড ফেলে অমৃত কলস নিয়ে 
দৌড়ে পালায় বাহুজীবীরা ।
 বারবার স্বপ্ন ভেঙে যায় মাটির মানুষদের ।

আঘাতের পর আঘাত পেয়ে আবার জড়ো হয় 
ঘরোয়া মানুষগুলো । আবার গড়ে মানববন্ধন ।
তালুর বাঁধনে বাঁধনে হয়ে যায় অলৌকিক আত্মীয়তা‌ ।
 ভাঙতে ভাঙতে বারবার ওঠে বন্ধনের গান ।

Monday, October 24, 2022

সুলেখা কালি ও আমার কাকা ।

আমার বাবার মুখে শোনা আমার এক কাকা ( নামটা মনে নেই, অমরেশ কিংবা কিরণ হতে পারে । উপাধি বর্ধন ) সুলেখা কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন । পুরোনো তথ‍্য ঘাঁটলে হয়তো পাবেন । দেশভাগ আমাদের সম্পর্ক নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ।

Saturday, October 15, 2022

ছাতা

ছাতা

ছাতা হারালে আর পাওয়া যায় না । 
ছাতা যে হারাবে অনেকেই জানে । 
তবুও ছাতা হারায় । 
তারপর একদিন নিজেরাও ছাতা হয়ে ওঠে । 
পুরোনো ছাতার কথা ভুলে যায় তারা । 
নতুন ছাতারা জানে না যে তারাও একদিন হা্রিয়ে যাবে । যথারীতি তারাও হারায় । 
ছাতা, ছাতা হারানো, আবার ছাতা । 
এটাই নিয়ম ।

Wednesday, October 12, 2022

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বড় রহস্যময় শব্দের শিল্প । কবিতা তো শব্দের চারুরাগ । চেতনার অন্তর্লীন বিস্ময়ভুবন । হৃদয়ের মসলিন শিল্প। হাজার আলোকবর্ষ থেকে ভেসে আসা শব্দের নিজস্ব স্রোত ।অসীম অনন্ত লোক থেকে সুরেলা আওয়াজ তুলে আসে শব্দ । আসে ঢেউ তুলে তুলে । ভেসে এসে বসে যায় জীবনের আখড়ায় । বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সব জোট বাঁধে । অশরীরী কে একজন অলক্ষ‍্যে থেকে এগিয়ে দেন শব্দমালাকে ।

 পারিজাত গন্ধ নিয়ে শব্দের পরিব্রাজন । শব্দ বসে বসে কথা হয় । সে কথায় থাকে অদ্ভুত মোহময়তা । সম্মোহনজালিকা । শব্দের গাঁথুনিতে যে কথার নির্মাণ তা হয়ে ওঠে নশ্বরতাহীন দৈবী টংকার । জীবনের মৃদঙ্গে আওয়াজ তুলে শব্দ জেগে ওঠে মুগ্ধ নয়নে । কুয়াশার বলিরেখা ভেদ করে জেগে ওঠে আলোর নির্ঝর । এক একটা চিত্র ভাষ্য স্পষ্ট হয় কাগজের বুকে কালো অক্ষরের স্বপ্নসন্ধানে । অন্তরেখ মায়া নদী বাঁক নেয় অবচেতনের পলিতে । 

আত্মউৎস খুঁজে নেবার জন্য আধিপথের দিকে ধায় মাধুকরী । পথের শুরুরও খোঁজ করতে হয় । সেখানে আলো জ্বলে । অতীতের দূমহলে ঘর তার । মাঠ পেরুলে পাথার । পাথারের নাম তেপান্তর । তেপান্তরের পরে আসে রূপকথার নদী ও সমুদ্র । সেসব অতিক্রমণের সাথে সাথে হারিয়ে যায় চেনা পথ । পুরনো দিগন্তের পরিচয় । আদ্যরশ্মির রেখা । 

পরিচয় এর জন্যই উল্টোসাধন । আলোদলিলের সন্ধান কর্ম তুলে দেয় শৈশবের শিস । ক্রমাগত অন্ধকারের মধ্যে পর্যটন শেষে আদিবীজ ভেসে ওঠে ফসিল স্তুপের ভেতর ।  সে বীজ হাতে নিলে দেখা যায় উজ্জ্বল সূর্যোদয় । ফিনকি দিয়ে ছোটা রশ্মিরেখার আকাশ আলোকিত । সে আকাশ থেকে পরিচিত নির্যাস ভাসে বাতাসে । আকাশমুক্ত বলেই তার গায়ে মৃগগন্ধ লেগে থাকে ‌ আকাশ স্বাধীন হতে শেখায় । ডানার কৌশল জানে আকাশ । নির্মিত ডানার বুনন আকাশের গোপন বিদ্যা । নির্মাণ শেষে বীজমন্ত্র দিয়ে দেয় মুক্তির । কুয়াশার চাদর থাকে না । থাকে ভ্রমণকথা । আলোর বিম্বে স্পষ্ট হয় ডানার ভেতরের রক্তের চলাচল ।  হাওয়ায় ভাসমান ডানায় সচল হয় শোণিতের কার্যক্রম।

শোণিতেরর তৎপরতার ভেতর নির্মাণ হয় দৃশ্যের মানচিত্র । সত্তার আনন্দবোধ কিংবা বেদনাবেহাগ ।শোণিতের চলমান বিন্দুও শব্দ হয় । জীবনের প্রহেলিকাকে যন্ত্রণার রূপ দেয় । যন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি নেয় বিষাদবিগ্রহ । সে বিষাদের অর্চনা করতে করতে জীবনের সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় হয় । সৌন্দর্য বিস্মিত করে স্রষ্টাকে । সৌন্দর্যের অপার আলোর বিভার ভেতর দেখা যায় কাব্যপ্রতিমাকে । তাকে ঘিরে জ্যোতির বলয় । কবি তার আত্মাকে নিয়ে বসায় সে বলয়ে । কবি তখন হাসে আপন মনে । আপন নির্মাণখেয়ালে । কবিতার দীপান্বিতায় কবির স্নান হয়।

Tuesday, October 11, 2022

শুভকথা

শুভকথা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
এই ভোরেই বেজে উঠেছে জলঘুঙুর
হাতের কলাপ ভিজিয়ে নিয়ে শীতল করেছ 
তোমার শরীর হে নওলকালের বাদলামেয়ে
ইচ্ছাপত্রে শুভকথা লিখে রেখেছ জলের আখরে
ভেজা কলাপাতার জলচিহ্ন সারা গায়ে মেখে
ভোরাই আহ্বানে যেন এক অচিন মায়াডাক
অপরকালের অতল ইসারায় যে পুরাণগান
ঘরে ঘরে ভালোবাসার সগন্ধী ধূপধোঁয়া 
ছড়িয়ে দিয়ে গেছ সুরের আবেশের মতো
আজো হে জাগতিক বর্ষণবেলায় তোমার
অশ্রুত প্রণয়ের গান বড়ো বেশি জরুরি যে
ছড়িয়ে দিয়ে যাও সে গান লোকালয়ে 
মানুষের হৃদয় এখন ফুল আর প্রেমের প্রত্যাশায়
বৃষ্টির কাতরতার মতো কাঙাল হয়ে আছে

নিপাট সজ্জনের গল্প

নিপাট সজ্জনের গল্প

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মহামারীর কালে শান্তিপল্লীর মানুষেরা কত ই না কষ্ট করেছে । দুবেলা খাবার জোটেনি । প্রতিবেশীরাও কাছে আসে না কেউ কারো । অসুখে ঘরে পড়ে মরে যায় । চিকিৎসা হয় না । মৃতের সৎকারের লোক আসে না ।

এই দুঃসময়ে এক নিপাট সজ্জন মানুষ আসে পল্লীতে । তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ভদ্র সভ্য মানুষ । সজ্জনের কথাবার্তায়, চলনে বলনে মার্জিত রুচির ছাপ আছে । মুখের ভাষায় যেন মধু ঝরে । এই দুর্দিনে তার কথায় সব দুঃখ ভুলে যেতে হয় ।  মানুষটি কি জাদু জানে ! দুঃখী মানুষগুলোর খোঁজখবর নেয় । পাশে এসে দাঁড়ায় । তার সঙ্গীরাও এগিয়ে আসে । তারা একেক সময় একেক রঙের মোমবাতি নিয়ে আসে । ওদের হাতের নানারঙের মোমবাতি জ্বলে ওঠে আর নানা রঙ ছড়ায় । ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ।

 সেই নিপাট সজ্জন মানুষটি আর তার সঙ্গীরা তাদের সামনে মোমের রঙিন আলো মেলে ধরে । তাদের আলোর গল্প শোনায় । তাদের গাঁয়ের কথা বলে । সে এক স্বপ্নের গাঁ । স্বপনপুর যার নাম । শান্তিপল্লীর অভাবী মানুষদের নিয়ে যেতে চায় সেখানে । সুখ আর সুখ ! তাদের সুখের দেশে পৌঁছে দেবার হাজারো প্রতিশ্রুতি দেয় । তাদের রহস্যময় ভাষায় সম্মোহিত হয় শান্তিপল্লীর মানুষ । 

শহরতলী থেকে উঠে আসা প্রান্তিক মানুষেরা অচিন গন্তব্যের পথে পা বাড়ায় । রঙিন মোমের আলো ঝলমল করে তাদের পথ । গ্রাম ছাড়িয়ে অরণ্যের অভ্যন্তরে আঁকাবাঁকা পথের দু'ধারে অলৌকিক সব ব্যানার সাজানো । স্বপনপুরের তোরণের ছবি তাতে সাঁটা । দুধারে এত সজ্জা । অথচ সারাটা পথ কাঁটা ঝোপে ঘেরা । শ্বাপদ-সরীসৃপস সংকুল ।  সরল মানুষ হাঁটতে থাকে কন্টকময় পথেই । পা থেকে রক্ত ঝরে । গা থেকে ঘাম ঝরে । তবুও সামনে আরো আলো আছে । এই ভেবেই ।

 সেই সজ্জন মানুষটির আরেক দল অনুগামী তাদের পেছন পেছন চলে । তাদের দ্বিচক্রযানের শব্দে বনভূমি কম্পিত হয় । তারা এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন মুছে ফেলে । তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেইসব স্বপ্নকাম মানুষদের । আর ক্লান্ত মানুষদের সরিয়ে ফেলে পথ থেকে । চলতে চলতে একসময় এক শূন্যতার সামনে মানুষগুলো এসে দাঁড়ালে সজ্জন মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে, হে গণদেবতাগণ ! আমরা সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ফেলেছি । সামনে দেখো বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর । খোলা আকাশ । মুক্ত বায়ু । স্বপ্নকাতর পথচলা মানুষের দল গুঞ্জন তোলে, কোথায় স্বপনপুর ! দেখছি নাতো কিছুই ! এ যে মরুভূমি  সামনে ! 

নিপাট সজ্জনের চোখ লাল হয়ে ওঠে । কে বলে এই কথা ? আমাদের একশো শতাংশ কাজ শেষ । এবার মরুভূমিকে নিয়ে প্রকল্প হবে । দূর্বিনীত সব ! 

হে দ্বিচক্রযানারোহীগণ ! চালাও চাবুক ! হিসফিসিয়ে উঠে একশ চাবুক ।গর্জে উঠে একশো দ্বিচক্রযান ।

'ঘুরে দাঁড়াও'...'

 সবাই মুহূর্তে হাজারো কন্ঠে প্রতিধ্বনি করে ঘুরে দাঁড়ায় । শূন‍্যভূমি কেঁপে ওঠে জনগর্জনে ।

Monday, October 10, 2022

ধ্বংসের মুখে ফেনী নদী

ধ্বংসের মুখে ফেনী

দক্ষিণের সীমান্তনদী ফেনীকে বাঁচাতে হলে একেবারে উজানের দিক থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে । ফেনীর উৎস থেকে আমলিঘাট পর্যন্ত দুপারে দুদেশের সীমা নির্দেশ করে । এই অংশটাতে এখন নাব‍্যতাই নেই । অথচ একসময় শিলাছড়ি-ঘোড়াকাপা, অযোধ‍্যা-দেওয়ানবাজার, সাব্রুম-রামগড়, রানিগঞ্জবাজার-বাগানবাজার, আমলিঘাট ইত‍্যাদি দুপারের গঞ্জ ও ব‍্যবসাকেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো নৌকা ভিড়ত । কিন্তু এখন আর নদীতে বর্ষাকালেও তেমন জল থাকে না । নৌকা চলাচল তো দুরস্ত । উভয়তীরেরই পাহাড়ে যথেচ্ছ মাটি কেটে নেওয়া, বৃক্ষছেদন ও বনধ্বংসের ফলে পাহাড় জলধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে । বছরের বেশির ভাগ সময় নদীতে জল থাকে না । নদীর বুকে চড়া পড়ে গেছে । এই সমস‍্যা নিরসনের ক্ষেত্রে দূই রাষ্ট্রের তরফ থেকে যৌথভাবে কর্মসূচি নিতে হবে । মুহুরী প্রকল্পের ফলে ভাটির দিক উন্নত হয়েছে সত‍্য কিন্তু উজানের মানুষের কাছে ফেনী নদীর মাছ কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে । অথচ ফেনীনদী একসময় রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউস, বাইলা, চিড়িং, চেলস, কাঁডা ইচা, ইলিশ ইত‍্যাদি নানারকম মাছের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল । হালদা নদীর মতো ফেনীনদীও ছিল নানা প্রজাতির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র । আজ সব ধ্বংস হয়ে গেছে । এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। নদীর দুইতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মনমুগ্ধকর । নাব‍্যতার উপযোগী করা গেলে এই নৌকাভ্রমণের মাধ‍্যমে পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটানো যেত । নৌপরিবহনের মাধ‍্যমে দুদেশের মধ‍্যে স্বল্পব‍্যয়ের বাণিজ‍্যসম্ভাবনাও সৃষ্টি করা যেত ।

Thursday, October 6, 2022

এবারের পুজো

এবারের পুজোর মরসুমে প্রকৃতিও বৈরী । এই উৎসবের  সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু প্রান্তিক মানুষের জীবিকাও । পুজোর তিনদিন সময়ের আয় দিয়েই পুজোর পরেই পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবার স্বপ্ন দেখেছেন । লিখতে গেলে তা বিশাল হয়ে যাবে । এত এত মানুষের শ্রমে ও শিল্পে সৃষ্ট মন্ডপের নান্দনিক আয়োজন । সব মিলিয়েই তো পুজোর আনন্দ মা ! এবারের আনন্দ কি জলে ভেসে যাবে আনন্দময়ী !

গত কবছর ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে যে, পুজোর সময়েতেই যেন আসল বর্ষাটা নামে । আর শারদোৎসবের সমস্ত আয়োজন মাঠে মারা যায় । বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আমাদের খন্ডের ঋতুচক্র তছনছ হয়ে গেছে । প্রকৃতি ক্রমশ রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে । এটা ক্রমশ বাড়বেই । মূলত ভারতীয় কৃষিজীবন এই এবারের পুজো

এবারের পুজো

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ঋতুচক্র মেনেই অতিবাহিত হত । বর্ষাবিদায়ের কালে শরতের আগমণে প্রকৃতি ক্রমশ শান্ত হয়ে এলেই হত দেবীর বোধনের আয়োজন । মাঠের ফসল তখন পূর্ণগর্ভা । তার দিকে তাকিয়ে আশায় বুক বাঁধে কৃষক । আর এই কৃষকদের ঘিরেই রয়েছে নানা পেশার মানুষ । যাদের জমি নেই, জিরেত নেই । বীজ বোনা আর ফসল তোলার মাঝখানে তাদের কোনো কাজ থাকে না । একটা টানা অভাবের মধ‍্য দিয়ে তাদের দিনাতিপাত করতে হয় । গ্রামীন অর্থনীতিতে এইসময়টা বন্ধ্যা সময় । আর এই সময়টাতেই হয় দেবীর বোধনের আয়োজন । অকালবোধন । মানে অসময়ের বোধন । দুঃসময়ের বোধন । এসময়ে এই অসময়ে সমাজের নানা প্রান্তিক পেশার মানুষকে যুক্ত করে কাজের বিনিময়ে খাদ‍্যের ব‍্যবস্থা করে দেয়া এই বোধনের আর এক উদ্দেশ‍্য । ভূস্বামীর দয়ায় নয় । অনুদানে নয় । কর্মের মাধ‍্যমে দুঃসময়ের রসদ সংগ্রহ করবেন প্রান্তিক মানুষ । শ্রদ্ধার শ্রমলব্ধ আয় তার জীবিকার দানাপানি । কৃষিভিত্তিক আর্থসামাজিক জীবনে এও ছিল দেবীবোধনের অন্তর্রহস‍্য । সেই ধারা আজও চলে আসছে ।
 
কিন্তু ক্রমশ প্রকৃতি  বৈরী হয়ে উঠছে । আমরা প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব‍্যবহার করেছি এতদিন । প্রকৃতিকে আমরা নিংড়ে নিয়েছি শুধু । লুঠ করেছি তার সব সম্পদ । প্রকৃতিকে দিইনি কিছুই। তাই তার এত ক্ষোভ । এত রুদ্ররোষ । কেড়ে নিচ্ছে আমাদের লোভার্জিত সম্পদ । আমাদের হর্ষ, আনন্দ । উৎসব । আর তাতেই দেবীবোধনের এই সময়টা হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে । প্রকৃতির কাছে আমরা অসহায় । অথচ বছরের এই সময়টার দিকে মুখ চেয়ে অপেক্ষায় কত শত শান্ত শুষ্ক অসহায় মুখ ! পরের চাঁদায় গড়ে তোলা লাখোয়ারি পুজো জলে ভেসে গেলে বারো ইয়ারের কি আর ক্ষতি । কিন্তু এতে যে একদল অসহায় মানুষের রুটিতে টান পড়ে ।তাদের চোখের জলে বানভাসি হয় ।এভাবে চলতে থাকলে আগামীদিনে কি সম্ভব হবে দেবীর অকালবোধন ? শক্তিরূপা,শক্তিময়ীর কাছে আর্জি রাখা ছাড়া আর কোনো গত‍্যন্তর নেই আমাদের ।

Tuesday, September 27, 2022

MY PENSION FROM DEC 2022

FOR FEB21 : BP=40500 DA=00 COMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 : DA (8% )=3240 REC=00
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=37940
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=40500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 00 COMM = 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NET = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

Monday, September 26, 2022

মহালয়া

মহালয়া এক বিশেষ তিথি ৷ মহালয়া বলতে বোঝায় পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু ৷ পিতৃপক্ষ সূচিত হয় প্রধানত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরের পূর্ণিমা তিথিতে ৷ শেষ হয় অমাবস্যা তিথিতে ৷অপরদিকে উত্তরভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয় ৷ সংস্কার অনুযায়ী ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা পঞ্চদশী অর্থাৎ অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়কে বলা হয় পিতৃপক্ষ বা প্রেতপক্ষ বা অমরপক্ষ ৷ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, এই সময় প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষবর্গের আত্মারা মর্ত্যলোকে নেমে আসেন নিজেদের ফেলে যাওয়া গৃহ ও পরিজনের প্রতি মায়াবশত ৷ মহালয়ায় তাঁরা সকলে মরজীবনের পরিবেশে ফিরে আসেন বলে অর্থাৎ তাঁদের বিদেহী আ়ত্মারা ফিরে আসেন বলেই তাঁদের জীবিত উত্তরপুরুষেরা সেই দিনটিতে তর্পনের দ্বারা তাঁদের বিদেহী আত্মার পরিতৃপ্তি বিধান করে প্রতিটি গৃহেই আনন্দোৎসব পালন করে থাকেন ৷ ' আলয় ' যেদিন 'মহ' অর্থাৎ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে সেই দিনটাকেই বলাহয় 'মহালয়া' ৷ 
এতে বোঝা যায় যে মহালয়া হলো পূর্বপুরুষের পুজো বা প্রেতপুজোর এক বিশেষ তিথি ৷ এই পূর্বপুরুষ পুজো বা প্রেতপুজো মানবসংস্কৃতির ইতিহাসে মানুষের আদিম বিশ্বাসের সঙ্গে বহু প্রাচীনকাল থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ৷
পুরাণকাহিনিতে আছে, মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন তাঁর আত্মাকে খাদ্য হিসেবে গহনা নিবেদন করা হয় ৷ কর্ণ বিস্মিত হয়ে এর কারণ অনুসন্ধানের জন্যে দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন ৷ ইন্দ্র জানান যে, কর্ণ তাঁর জীবদ্দশায় কখনো পূর্বপুরুষের প্রতি খাবার, জল ইত্যাদি উৎসর্গ করেন নি ৷ উপরন্তু দাতাকর্ণ শুধুমাত্র সোনাই দান করে গেছেন আজীবন ৷ আর তাঁর সেই কর্মফলের কারণেই তাঁর ক্ষেত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৷ কর্ণ এই বিষয়টা জানতেন না বলে তাঁকে পনেরো দিনের জন্যে মর্ত্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো যাতে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের জল ও খাবার উৎসর্গ করতে পারেন ৷ হিন্দু পুরাণ মতে, এই পিতৃপক্ষ সময়কালে তিন পূর্ববর্তী প্রজন্মের আত্মা পিতৃলোকে ( স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি) অবস্থান করেন ৷ পরবর্তী প্রজন্মের কারও মৃত্যুর পর যমরাজা আত্মাকে পিতৃলোকে নিয়ে যান এবং প্রথম প্রজন্ম স্বর্গলোকে উন্নীত হয় ৷
পুরাণ মতে এদিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে ৷ অশুভ অসুরশক্তির কাছে পরাভূত দেবতারা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হন ৷ চারদিকে অশুভ শক্তির আস্ফালন ৷ এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার লক্ষ্যে দেবতারা সমবেত হন ৷ অসুরশক্তির বিনাসে তাঁরা এক মহাশক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ৷ দেবতাদের তেজোরশ্মি থেকে আবির্ভূত হলেন অসুরদলনী দেবী দুর্গা ৷ মহালয়ার কাল হলো ঘোর অমাবস্যা ৷ দেবী দুর্গার আবির্ভাবে তাঁর মহাতেজের জ্যোতিতে সেই অমাবস্যা দূরীভূত হয় ৷ প্রতিষ্ঠিত হয় শুভ শক্তির ৷ অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তথা ব্রহ্মান্ডের অর্থাৎ 'মহানিকেতন'র অধিশ্বরী ৷ তাঁরই আগমনী তিথির নাম 'মহালয়া'

Monday, September 19, 2022

'মৃগ' শব্দ

সংস্কৃত মৃগ্ শব্দের অর্থ অন্বেষণ । মৃগয়া মানে পশু অন্বেষণ বা পশু শিকার । মৃগ শব্দের আদি অর্থ পশু । ক্রমে অর্থসংকোচের ফলে মৃগ অর্থে হরিণ বোঝায় । কখনও বা বিশেষণ পদ সহযোগে অন‍্য প্রাণীকেও বোঝায় । সেইরূপ– শাখামৃগ > বানর । মহামৃগ > হাতি । মৃগেন্দ্রকেশরী > সিংহ ইত‍্যাদি ।

Tuesday, September 13, 2022

ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর ( ননী মামু ) কোলকাতার ঠিকানা

দমদম নাগেরজলা থেকে অটোতে ছাতাকল নামতে হবে । সেখান থেকে লিচুবাগান বাজার মনসা মন্দিরের কাছে ( একটা পুকুর আছে ) গৌরাঙ্গ আবাসন/ অ্যাপার্টমেন্ট ) ।

Wednesday, September 7, 2022

দেশভাগের বিভীষিকা : বাঙালি জাতিসত্তার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা

দেশভাগের বিভীষিকা : বাঙালি জাতিসত্তার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ত্রিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীন হলেও তার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়ে গেছিল । তার মধ‍্যে দেশের ভেতর দীর্ঘকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে । এই অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফলে উপনিবেশিক শাসনে আর্থসামাজিক কাঠামোয় গ্রাম বাংলার অধিকাংশ হিন্দু ও মুসলমান জনগণ বিশেষভাবে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিল । অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত এই সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ  জমা হয়ে উঠেছিল । সেই  ধূমায়িত বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগ এর কাজটি করেছিলেন দুই ধর্মের মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ । তার ফলেই সারা দেশব্যাপী ৪০ এর দশকে ছড়িয়ে পড়েছিল হিংসার রাজনীতি এবং এই অবস্থায়ই চল্লিশের দশকের ধর্মীয় হিংসার উত্তাল তরঙ্গমালা দেশভাগের অবস্থা সৃষ্টি করেছিল ।

আপাতদৃষ্টিতে ভারত বিভাগের পশ্চাৎপট হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা-কলহকে দায়ী করা হলেও Transfer of Power Documents এর ভিত্তিতে মনে করা হয়, "ভারত সাম্রাজ্য বিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবিভাগও ব্রিটিশ নীতির অচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল । ক্রিপস মিশনে আমরা দেখি এই ব্রিটিশনীতির অকালবোধন, ক‍্যাবিনেট মিশনে তার পূজারতি ও মাউন্টব্যাটেন মিশনে তার পূর্ণাভিষেক ( সুকুমার সেন / ভারত বিভাগ : ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা- উনিশ ) । 

মাউন্টব্যাটেন মূলত ভারতবর্ষকে ভাগ করার জন্যই এদেশে এসেছিলেন । এটলি মন্ত্রীসভা ১৯৪৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন । তখনও হস্তান্তরের দিনক্ষণ ধার্য হয়নি । ২৪শে মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন এবং দেশভাগের কথা ঘোষণা করেন । এভাবে 15 আগস্ট ১৯৪৭ ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনক্ষণ স্থির হয়ে যায় । ৮ই জুলাই ইংল্যান্ড থেকে প্রাক্তন ইংরেজ বিচারক সিরিল র‍্যাডক্লিফ ভারতে আসেন সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে । তিনি এর আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে আসেননি । মানচিত্র পাঠ করার ( cartographic knowledge )  প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতাও তাঁর ছিলনা । ভারতবর্ষের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধেও কিছুই জানেন না ।তিনি এলেন  ভারতবর্ষকে ভাগ করার দায়িত্ব নিয়ে । তিনি সরেজমিনে তদন্তেও গেলেন না । টেবিলে বসেই মানচিত্রের উপর কলম চালালেন । তিনি মাউন্টব‍্যাটেনের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন । এদিকে জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ দেশটাকে যতটা সম্ভব দ্রুত ভাগ করার জন্য চাপাচাপি শুরু করেন । ( দেশ ভাগ- দেশত‍্যাগ, অনুষ্টুপ, প্রথম প্রকাশ-১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, বর্তমান সংস্করণ- ২০০৭ পৃষ্ঠা-২২ ; লিওনার্দো মোসলে 'দি লাস্ট দেজ অফ দি ব্রিটিশ রাজ'– পৃষ্ঠা ২২১) । এই তাড়াহুড়োর ফল ভয়াবহ হল । দেশের দুইটা অঞ্চলের বুকে নেমে এলো অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় । দুইটা প্রদেশের মানুষের নতুন পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু'। তাদের ছেড়ে যেতে হলো পূর্বপুরুষের বসতি, নদী, মাঠ , প্রান্তর । আশৈশব হেঁটে যাওয়া পরিচিত বনবাদাড় । পেছনে পড়ে রইল স্বজনের  শ্মশান ও কবর । অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হল রিফিউজি ক্যাম্প, ফুটপাত আর রেলস্টেশন ‌কিংবা খোলা আকাশ । কারো কারো স্থান হল আন্দামানে কিংবা দণ্ডকারণ্যে ।

মাউন্টব্যাটেন, জওহরলাল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তৎপরতায় ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় । বাংলা ও পাঞ্জাবের উপর দিয়ে এই কয়দিন রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল । এই কয়দিন শুধু মৃতদেহ নিয়ে ট্রেনগুলি পারাপার করেছিল । বাংলা সীমান্ত দিয়ে লক্ষ লক্ষ হিন্দু।নর-নারী, বৃদ্ধ ও শিশু উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় প্রবেশ করে । অন‍্যদিকে সামান্য সংখ্যক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানের চলে যায় । ব্রিটিশ নীতির দূরভিসন্ধি ও কংগ্রেস-লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দেশের দু প্রান্তের দুটি জাতি তাদের জাতিসত্তা চিরতরে হারিয়ে খন্ডিত ও রক্তাক্ত স্বাধীনতা লাভ করে ।

 ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে অখন্ড বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষের ভাগ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ নেমে এসেছিল । মান-সম্মান ও ধর্মনাশের ভয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নবসৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গে, সংলগ্ন আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় । পাকিস্তানের অন্তর্গত মানুষ ভারতে অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিতে আশ্রয় নেয় । ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তের  দুটি জাতির নিজস্ব সত্তা ও দ্বিখন্ডিত হয়। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে সেদিন রক্তাক্ত স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিল । আর পূর্ব প্রান্তের বাঙালির জাতিসত্তা চিরতরে দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল । এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের নাম দেওয়া হয় 'মোহাজের' । আর পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সমস্ত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বলা হলো 'উদ্বাস্তু' বা 'বাস্তুহারা' । আবার কোথাও কোথাও এদের নাম দেওয়া হলো 'পাকিস্তানি' কোথাও বা 'ভাটিয়া' বা 'বাঙাল' নামে  স্থানীয় জনগণের তাচ্ছিল্যের শিকার হয় । 

পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় মানুষের কাছে এক নতুন মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল । যেন তারা মানুষ নয় । যে নামে তারা পরিচিতি পাক না কেন এদের সবার ভাগ্যে উপেক্ষা, অবহেলা,অনাদর ছাড়া যেন আর কোন প্রাপ্তি থাকার কথা ছিলনা । তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল তারা ততটা উপেক্ষা অবহেলা বা অনটনের শিকার হয়নি । পূর্ব পাঞ্জাব থেকে যারা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের ভাগ্যেও বেশি দুর্দশা ঘটেনি। ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গে যারা ধর্ম হারাবার ভয়ে বা প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের পরিচয় দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে, 'সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার ভূখন্ডে ঢুকল ওরা চোরের মতো । ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষ পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটার মায়া কাটিয়ে ছুটেছিল এপার বাংলায় । সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা, পৈশাচিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আর সামনে ছিল অনুষ্ঠিত ভবিষ্যৎ । যে মাটি ছিল মায়ের মতো, যার ফসলে ওদের জন্মগত অধিকার, সেখানে ওরা পরবাসী । এপারে ঝোপেঝাড়ে, বিলে, অনাবাদি ভূখণ্ডে গড়ে উঠলো নতুন বসতি । যেসব জমি আগাছা ভরা, পরিত্যক্ত, যেখানে কোনদিন ভুল করেও যায়নি মানুষ, বর্ষা ডেকে আনে প্রাণঘাতী বন্যা, সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বসতি । সরকারি অনুদানের ছিটে ফোঁটা জুটল কপালে । কিন্তু বেঁচে থাকতে, মাটির উপর শক্ত দুপায়ে দাঁড়াতে তার ভূমিকা ছিল নগণ্য । যারা এল দান হাতে, ভাগ্য ফিরল তাদেরই, মানুষকে মানুষ বঞ্চিত করে, না খাইয়ে হাত-পা বেঁধে ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তার ইতিহাস রক্তাক্ত না হলেও মর্মান্তিক । একটি জাতিকে নিষ্ঠুরভাবে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র কত যে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল তার প্রমাণ সেদিনের অন্ধকারময় ইতিহাস । বাঙালিকে সেদিন ছিঁড়ে খেয়েছে বাঙালি-অবাঙালি সবাই । তাদের পরিণত করা হয় একটি জড়পিন্ডে । অক্ষম অপদার্থ অলস এক জেনারেশনে ! যাদের কোনো ভূমিকা নেই ! মানুষের যাবতীয় সদগুণকে পিষে মারা হল ‌। ওদের পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু' ( কমল চৌধুরী : বাংলায় গণ আন্দোলনের ছয় দশক ( দ্বিতীয় খন্ড ), পত্র ভারতী, এপ্রিল ২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৫ ) । এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আগত উদ্বাস্তু সম্বন্ধে যা যা বলা হয়েছে সন্নিহিত রাজ‍্যগুলির ক্ষেত্রেও  তা বিন্দুমাত্র অতিকথন নয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং সংলগ্ন আসাম, ত্রিপুরায় কিভাবে কত দুঃখ লাঞ্ছনা আর উপেক্ষা সহ্য করে কোনক্রমে প্রাণধারণ করেছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে তার তুলনা বাঙালির ইতিহাসে সম্ভবত অনুল্লেখিত থেকে যাবে ।

দেশভাগের পরের প্রথম নয় বছরেই পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ২১ লক্ষেরও বেশি মানুষ । ডিসেম্বর ১৯৪৯ এ খুলনা এবং ১৯৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বরিশাল ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার পর এক লাখের কাছাকাছি মানুষ ভারতে চলে আসেন ১৯৫০ সালের ১৮ই এপ্রিল 'নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি: বা :দিল্লি চুক্তি: সম্পাদিত হয় । দেশভাগের পরে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে কতজন উদ্বাস্তু এপারে এসেছিলেন সে বিষয়ে সঠিকভাবে বলা যায় না । তবে একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলা এসেছিলেন ২১ লক্ষ ৪ হাজার ২৪২জন । ১৯৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৩০ লক্ষ ৬৮ হাজার ৭৫০ জন । ১৯৭১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে ছিল ৪২ লক্ষ ৯৩ হাজার জন । ফলে এই বিরাট সংখ্যার জনগণ একপ্রকার নিঃস্বভাবেই ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন । 'নেহেরু লিয়াকত চুক্তি' বা দিল্লি চুক্তি' ১৮ এপ্রিল ১৯৫০ উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেনি । শরণার্থী আগমনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ৪৭ এর পর পঞ্চাশে, ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে হযরত বাল মসজিদের দাঙ্গার সময়, ৬৫ তে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রাক্কালে, এবং একাত্তরের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত অনবরত শরণার্থীরা ভারতে আসতে থাকে । এরা পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মানুষ । চোরাগোপ্তাভাবে সেই স্রোত আজও অব‍্যাহত রয়েছে ।

দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অনেক বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল । কিন্তু বাস্তবে উদ্বাস্ত আগমনের চাপ পাঞ্জাব অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গ ও সন্নিহিত রাজ্যসমূহে অনেক বেশি ছিল। এর কারণগুলি প্রথমত, পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আয়তনে অনেক ছোট প্রদেশ । দ্বিতীয়ত, লোক বিনিময়ের ফলে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের উদ্বাস্তুরা লাভবান হয়েছিল । দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে যে সংখ্যক উদ্বাস্তু পূর্ব পাঞ্জাবে এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি মানুষ পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। হলে তাদের ফেলে আসা সম্পত্তি বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে ব্যবহৃত হয়েছিল । 

দাঙ্গা ও দেশভাগ নামক বিপর্যয়ের ফলে যেসব মানুষ তাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের  বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছিল তারা সরকারি সাহায্য ততটা পায়নি, যতটা পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা । পশ্চিমবঙ্গের  সরকারের আমলা থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ সবার কাছে শুধু প্রতারণা আর ঘৃণায় পেয়েছিল । উপরন্তু তাদের ভাগ্যে জুটেছিল অলস ও নিষ্কর্মা অপবাদ । পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা নানাভাবে প্রত্যাখ‍্যাত ও প্রতারিত হয়ে ক্যাম্প গুলিতে মনুষ‍্যেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল । জন্ম, মৃত্যু তথা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কোন প্রকার আব্রু ছিল না । কিন্তু তারপরও এসব মানুষ এদেশের মাটিতে এদেশে জন সমাজে শেকড়ের সন্ধানে  নিরন্তর নিয়োজিত ছিল । উদ্বাস্তুদের ক্রমাগত আগমনে স্থানীয় সরকার গুলো যেমন অসহায় তেমনি কেন্দ্রীয় সরকার ও উদাসীন ফলে এদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা মিটে গিয়েছিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে । কিন্তু ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা আজও মেটেনি । পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যে স্থান সংকুলনের অভাবে উদ্বাস্তুরা কখনো আন্দামানে, কখনো দণ্ডকারণ্যে নির্বাসনের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে । নদী-নালা দেশের মানুষ এইসব উদ্বাস্তুদের পক্ষে আন্দামান বা দণ্ডকারণ্য নির্বাসনে তুলল শাস্তি । আন্দামান বা দণ্ডকারণ্যে এই অসহায় মানুষগুলি স্বেচ্ছায় যায়নি তাদের একরকম জোর করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল । সেখানেও পরিকাঠামোর অভাবে সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতার কারণে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন আরেকপ্রস্থ প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছিল । শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিম্নতম জীবন যাপন করতে বাধ‍্য হয় । শরনার্থী শিবিরের দিনযাপনে নিদারুণ যন্ত্রণা ও গ্লানি থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই স্বেচ্ছায় শিবিরগুলো ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, শহরাঞ্চল ও শহরতলিগুলিতে নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে । আর একেবারে নিরুপায় যারা তারা রয়ে যায় । কিন্তু সেই সংখ্যাটি নেহাত কম নয় ।

 প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছরে উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উপর জোর দেন । তাই ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী পাঁচ বছর 'পুনর্বাসনের যুগ' নামে অভিহিত হয় । ভাষাগত সমস্যা না থাকায় পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি ও সিন্ধ্রি উদ্বাস্তুরা, দিল্লি, হরিয়ানা হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিয়ে সেখানে তারা তাদের বাসস্থান গড়ে তোলে । কিন্তু বাঙালি উদ্বাস্তুরা ভাষাগত সমস্যা ও অন্যান্য কারণে পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা ও আসামে আশ্রয় নিতে বাধ‍্য হয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নেহরু সরকার উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ‍্যোগে যথেষ্ট তৎপরতা দেখা গিয়েছিল । এই প্রয়াস শুরু থেকেই  সুপরিকল্পিত ও সুসংহতভাবে পরিচালিত হয় । কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন‍্য সেই আন্তরিকতা ছিল না । পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের সেদেশে তাদের সম্পত্তির অধিকার রয়েছে বলে অজুহাত খাড়া করে তাদের সমপরিমান ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় । অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের তাদের ক্য়ক্ষতির সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় । এই বৈষম‍্যমূলক আচরণের ফলে বাঙালি উদ্বাস্তুরা একদল কায়িক শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হয় । নবসৃষ্ট এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আজও ঘুচেনি । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই দরিদ্র মানুষগুলো আজও বিদেশী, বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত।  তাদেরকে আজ 'সন্দেহজনক বিদেশী' বলে সনাক্ত করে, আটক করে 'নো ম‍্যানস ল‍্যান্ডে নির্বাসনে কাটাতে হচ্ছে । পূর্ববাংলা থেকে আগত এই মানুষগুলো ও তাদের উত্তরপ্রজন্মের উপর অমানবিক আচরণ ও  নির্যাতন ও অবিচার চলতে দেওয়া যায় না । পূর্বসূরিদের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে তাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটানোর সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার । তাদের জন‍্যে সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করার জন‍্যে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ নেওয়াও দরকার।

দেশভাগের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষ ও তার উত্তরপ্রজন্ম হয়তো স্বপ্ন দেখেন জাতিসত্তার পুনর্মিলনের । কিন্তু এ আর তো হবার নয় । বরং এই উপমহাদেশের মধ‍্যে কোনো ঐক‍্যবদ্ধ সংগঠন সৃষ্টির মাধ‍্যমে একদিকে যেমন পারস্পরিক প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ‍্যমে শান্তি-সম্প্রীতি নিবিড় বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় তেমনি পিতৃ-পিতামহের দেশটার স্মৃতিকেও বুকের গভীরে আঁকড়ে ধরে রাখা যায় ।

Tuesday, August 30, 2022

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য আমার বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন জীবনভর এতো লাঞ্ছিত হয়েছেন যে, সে কথাগুলো আর বলতে চাইতেননা শেষদিকে । তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না । সর্বোপরি তাঁর কর্মকান্ডের ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে  যাওয়ার একটা প্রধান কারণ তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাম্রপত্র গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ । ভারতের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ‍্যোগ গ্রহণ করেন । সেসময়ে সাব্রুম মহকুমায় বসবাসকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ‍্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক আশুতোষ দে প্রমুখগণ, নিজেদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি বাবাকেও অনুরোধ করেন কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন‍্য । স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত মণীন্দ্র ঢালী সেসময়ে সাব্রুম শহর থেকে হেঁটে ছোটোখিলে গিয়ে বাবকে অনুরোধ করেন তাঁর আবেদন জমা দেওয়ার জন‍্যে । কিন্তু বাবার একই কথা ছিল, আমি কলাপত্রের ( তাম্রপত্রকে বাবা এই শব্দ বলতেন ) জন‍্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করিনি । শেষ মুহূর্তে বিলোনিয়া থেকে সুরেশ চৌধুরী ও হারাণদাদু ( বিপ্লবী শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী– যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে উল্লিখিত আছে ) খবর পাঠান বাবার কাছে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন‍্য । সত্বর দরখাস্ত পাঠাবার জন‍্য । তাঁরা কয়েকদিনের মধ‍্যে সবার কাগজ জমা দিয়ে দেবেন । কিন্তু বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন । যেহেতু আমার প্রয়াত পিতৃদেব এইধরনের অভিমানী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেকারণে আমরাও  স্বাধীনতসংগ্রামীর সন্ততি বলার মতো গর্বিত পরিচয় দেওয়ার সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম । যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যাচ্ছি এই মহকুমায় অবস্থানকারী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সন্তানদের জীবনমানের তেমন কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি । এমন কোনো বিশেষ পরিচিতিও পায়নি । এক প্রজন্ম পরেই পূর্বজদের সব অবদান স্মৃতির অতলে চলে গেছে ।

মাঝে মাঝে কথার ছলে বাবার মুখে যতটুক শুনেছি, স্বর্গীয় অনাদিরঞ্জন সেন , স্বর্গীয় মনোরঞ্জন বর্ধন ( মনাদা ), বিভূতি চক্রবর্তী, স্বর্গীয় রেবতী পাল, স্বর্গীয় সুরেশ চৌধুরী, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী, অমর সরকার প্রমুখ আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন একই বিপ্লবীদলের সদস‍্য । তাঁদের নেতা ছিলেন শচীন্দ্র চন্দ্র পাল । তারাগুজার নবীনচন্দ্র সেনের গোলকানন্দ ঔষধালয় ছিল ফেনীতে । আমাদের দাদু অর্থাৎ আমার বাবার মামা রজনীকান্ত নন্দীর ( যিনি সেকালে আর কে নন্দী নামে সেকালে সমধিক পরিচিত ছিলেন ) 'সাধনা ঔষধালয় ঢাকা'-র বিপণী ছিল ফেনীর পাঁচগাছিয়া রোডে । সেকারণে অনাদিরঞ্জন সেনের সঙ্গে আমার বাবা মনোরঞ্জনের নিবিড়  বন্ধুত্ব ছিল । গোলকানন্দ ঔষধালয় বিপ্লবীদের মিলিত হওয়ার গোপন স্থান ছিল । বাবা বলতেন গোলকানন্দ ঔষধালয়ের 'এন সুধা' নামে কালাজ্বরের ঔষধ এবং সাধনা ঔষধালয়ের 'সাধনা দশন' নামে দাঁতের মাজনের খুব নাম-ডাক ছিল ।

 ৪২ সালের শুরুর দিকে ট্রেন লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন‍্যে ফেনী স্টেশনের অনতিদূরে  বোমা-বারুদ নিয়ে অ্যাম্বুশে বসেছিলেন কয়েকজন বিপ্লবী। তাঁরা দলে এগারো জন ছিলেন । কেউ বোধহয় আগে থেকে পুলিশের কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিয়েছিল । নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা এসে তাঁদের অ্যাম্বুশ নেওয়া জায়গাটার একটু আগে থেমে যায় । একদল সৈন‍্য ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে বিপ্লবীদের ধাওয়া করে । ধরা পড়ে যান  অনাদিরঞ্জন ও মনোরঞ্জন ( মনাদা ) । বাবার মুখে শোনা,  পুলিশ সেদিন অনাদিরঞ্জনের উপর অন‍্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিল । দুজনেই সুপুরুষ ছিলেন । তারা ভেবেছিল নোয়াখালি অঞ্চলের টেররিস্টদের নেতা এই দুজনেই । পুলিশ কথা আদায়ের জন‍্যে বাবার বাঁহাতের তর্জনীতে মোটা সুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল । যার ফলে বাবার সেই আঙুলটা চিরতরে বাঁকা হয়ে যায় । এই কেইসে তাঁদের দুজনকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয় । এইসময়ে যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসারের কথা বাবা প্রায়শই বলতেন তার নাম পূর্ণ নাথ । যেমন নৃশংস তেমনি বিপ্লবীদের কাছে ত্রাস ছিলেন এই পূর্ণ নাথ । দুই পকেটে দুটো পিস্তল নাকি রাখতেন । বিপ্লবীদের প্রচন্ড নির্যাতন করতেন তিনি । নিরীহ তরুণদের ধরে টেররিস্ট বলে জেলে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ আদায় করতেন । এই নিষ্ঠুর দারোগা পূর্ণ নাথের ভয়ে বিপ্লবীরা পালিয়ে বেড়াতেন । বাবা কোলকাতায় পালিয়ে গিয়ে ইলেকশন দপ্তরে সুপারভাইজারের চাকরি নেন । বাবা যখনি দেশের বাড়ি ( তাঁর মামাবাড়ি ) ফেনীর আমিরাবাদে পৌঁছাতেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে সাদা পোষাকে পুলিশ ছেয়ে যেত । তাঁর সঙ্গে কে মেশে, কোথায় যান সব খেয়াল । একবার কোলকাতার মানিকতলার তাঁর মেসে বিপ্লবীদের খোঁজে হানা দেয় । চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আগের রাতেও এখানে ছিল । কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তাঁরা সরে পড়েন । পুলিশ সন্দেহবশত বাবাকে ধরে নিয়ে যান । কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কিছু জানতে পারেননি । তার উপর বাবার অফিসের একজন ই়ংরেজ অফিসারের সরাসরি হস্তক্ষেপে তিনি সেযাত্রা বেঁচে যান । বাবা বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য প্রায়ই বাড়িছাড়া থাকতেন । এজন‍্যে পরবর্তী জীবনে বাবাকে প্রায়ই খোঁচা দিয়ে বলতেন, দেড়সের চাল দি' হপ্তা কাডাইছি আঁই । অনঅ কি কষ্ট কইত্তামনি ?

  বেশ কবছর আগে একজন বয়স্ক লোক আমার সাব্রুমের বাসায় এসেছিলেন বিপ্লবী মনাদার ছেলে ( আমি ) এখানে থাকে জেনে দেখা করতে । তাঁর মুখে বাবার দুঃসাহসিকতার দুএকটা কাহিনি শুনেছিলাম । তিনি বলেছিলেন বাবা গ্রামে এলেই ছেলেরা যেন সাহস পেত । বাবা তাদের ক্লাস নিতেন ।  গ্রামের যে গোপন জায়গায় তাঁরা আড্ডা দিতেন সেখানে একটা বড়ো শিমুলের গাছ ছিল । কান্ডটা বেশ মোটা । তাঁরা তার গায়ে হেলান দিয়ে মিটিং করতেন । ফলে গাছটার গুঁড়িটা তেলতেলে হয়ে গিয়েছিল । একসময় বিচক্ষণ ইংরেজ পুলিশের চোখে তাধরা পড়ে যায় এবং বিপ্লবীদের আড্ডাটা ভেঙে যায় ।

যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসার পূর্ণ নাথের জন‍্য বিপ্লবীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর সেই পূর্ণ নাথকে কোলকাতার লালবাজারে স্বমহিমায় দেখা যায় । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে পূর্ণ নাথ এখানেও বিপ্লবীদের নানাবিধ মিথ‍্যা মামলায় জড়িয়ে দিতে থাকে । বাবা একদিন পূর্ণ নাথের নজরে পড়ে যান । পূর্বপরিচিত হিসাবে সম্মান না দেওয়ায় বাবা তাঁর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান । বাবাকে কোলকাতার চাকরি ছেড়ে আসামের চাবাগানে নানাসময় নানা নামে আত্মগোপন করে থাকতে হয় । শেষে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজে চাকরি পান । সেই সুবাদেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমদিকে রাজ‍্যের দুজন বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. রথীন দত্ত ও ড. রবি চৌধুরী এমবিবিএস পড়ার জন‍্য ডিব্রুগড় গিয়ে আমাদের কোয়ার্টার্সে প্রথম উঠেছিলেন । তারপর তাঁরা হোস্টেলে চলে যান । একটা কোয়ার্টার্সে জায়গা । আজীবন স্বাধীনতাসংগ্রামী খদ্দরের ধুতি-জামা পরা আমার স্বাধীনচেতা বাবাকে আসাম থেকেও পালিয়ে ত্রিপুরায় চলে আসতে হয় । বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হতে হতে বাবা একসময় স্বাধীনতা শব্দের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতেন । 

বাবা যেহেতু তাঁর বিপ্লবীজীবন সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন, আমরা তাঁর সন্ততিরাও আর সেবিষয়ের উন্মোচন করতে চাইনা । উনিশ শো ছিয়াত্তরে তাঁর আকস্মিক মৃত‍্যুর সাথে সাথে সব কিছু হারিয়ে গেছে । তবুও সত‍্য ইতিহাস কখনো চাপা থাকেনা । কিছুদিন আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দেশভাগের বিভীষিকা সম্বন্ধে কথা বলার জন‍্য । তাঁরা বোধহয় কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন । আমি একজন উত্তরপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অনুভবটা জানিয়েছিলাম । এমন শুধু আমার বাবা নয় । বহু বিপ্লবী চলে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে । 'হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে' ।

Wednesday, August 24, 2022

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল পালক

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল সাদা পালক

সুমন পাটারি ত্রিপুরার সন্তান । আমার গর্বের দক্ষিণ জেলার । রাজ‍্যের জন‍্যে দিয়েছে গর্বের পুরস্কার । যুব সাহিত‍্য একাডেমি সম্মান - ২০২২  ।  তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাইখোরাতে একটি সাহিত‍্যানুষ্ঠানে । আমাকে বাইখোরা বাজার থেকে বাইকে তুলে সোজা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায় । তরুণ সৈনিকের মতো একহারা দৃপ্ত চেহারা । সুমনের কবিতায়ও সেইরকমের তীব্র ঋজুতার ছাপ । তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ভদ্র, নম্র ও চলাফেরায় একদম সাদাসিধে । কিন্ত জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অত‍্যন্ত সংবেদনশীল । একবার আমরা একসঙ্গে রাজ‍্যের বাইরেও গেছি । একদম কাছে থেকে দেখেছি সুমনকে । এই যাত্রাপথে সুমন আমাকে সন্তানসুলভ দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিল । আমার খাওয়া দাওয়া সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুতেই ওর লক্ষ‍্য ছিল । আমার কষ্ট হলেই সুমন তৎপর হয়ে উঠত আমার অসুবিধা দূর করার জন‍্য ।

 নিষ্পাপ শিশুর মতো সুমনকে নাগরিক জটিলতায় আচ্ছন্ন করেনি । সুমন একদিন সকালবেলায়  এসে আমাকে বলল তার সদ‍্য লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা । সে ময়দানের সামনের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল । তার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ এসে আব্দার যে, লোকটার টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছে । সুমন যদি কিছু টাকা দেয় তাহলে লোকটা বাড়ি যেতে পারবে । সুমন তাকে পঞ্চাশ টাকা দেয় । লোকটা তখনকার মতো চলে যায় । কিছুক্ষণ পরে সুমন লক্ষ করে লোকটা আবার এসে পাশের লোকটার কাছ থেকে একই কায়দায় টাকা চাইছে । শহুরে তঞ্চকতায় বেকুফ হয়ে যায় সুমন । সুমনের ভাষায় তার 'বাবার বয়সী' লোকটার আচরণে সে বিস্মিত । এতোটাই স্বচ্ছ সুমন ।

কর্ম বা ভাগ‍্য বিষয়টাকে বিশ্বাস না করলেও জীবনের উত্থান ও বিপর্যয়কে গতিমুখের নির্ণায়ক বলে মেনে নিতেই হয় । সুমনের বাবা সংসারের কর্তা । তাঁর পরিশ্রমের আয়ের উপরই চলছিল তার পড়াশুনা । ত্রিপুরা রাজ‍্যের ইকফাই ইউনিভার্সিটি থেকে বিসিএতে দুর্দান্ত ফল করে রাজ‍্যের বাইরে পড়তে যায় এমসিএ । কিন্তু বিধি যে সুমনের দিকে অলক্ষ‍্যে চেয়ে হাসছিল কে জানে ! বাইখোরা বাজারে সুমনের বাবার  ধান চালের ব‍্যবসা । হঠাৎ একদিন স্তুপ করে রাখা বস্তার সারি থেকে একটা এক কুইন্টাল ওজনের ধানের বস্তা পেছন থেকে ছিটকে পড়ে গদিতে বসে থাকা সুমনের বাবার পিঠে । ঘাড়ে ও মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর । উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা ছেড়ে সুমনকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে । বাবার চিকিৎসা ও সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে সুমনের কাঁধেই । বাবার চিকিৎসার জন‍্যে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করেও বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি আর । এরপর নানারকম ছুটকো পেশা, প্রাইভেট পড়ানো ইত‍্যাদি করে চলতে থাকে সুমনের জীবনযুদ্ধ । বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের পাঠ নিতে থাকে সুমন । সেইসঙ্গে কবিতাযাপনও সমানে চলে । সেকারণেই সুমনের কবিতাও প্রাত‍্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার স্পষ্টতায় উজ্জ্বল । আমি সুমন পাটারির প্রথম কাব‍্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করার ও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন । একদম জোরালো কব্জিতে তোলা ভাষাই সুমনের কবিতা ।

 কার্যকারণে অনেকদিন দেখা হয়না । কিছুদিন আগে সেলিমদা ধর্মনগর থেকে 'পাখি সব করে রব'-র বিশেষ সংখ‍্যা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে । দক্ষিণ ত্রিপূরার কয়েকজন কবির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন‍্যে । সুমনের কপিও ছিল । কিন্তু আমি যেদিন বাইখোরা যাই সেদিন ও বিশেষ কাজে ব‍্যস্ত থাকায় আর দেখা হয়নি । ওর কপিটা কবি তারাপ্রসাদ বনিকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম ।

নোয়াখালি অ্যাকসেন্ট থাকে সুমনের কথাবার্তায় । মনে হবে আনস্মার্ট এক গ্রাম‍্য যুবক । সুমনের ইংরেজি উচ্চারণ ও অনর্গল কনভার্সেশন শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন । বাহ‍্যিক দর্শনে রাজ‍্যের মেধাবী ও গুণী এই তরুণকে চিনতে অনেকেই ভুল করবেন । সুমন যদি তার উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারত তবে আজ সে একজন নামজাদা আইটিয়ান হতে পারত । অথবা বড়ো কোনো মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন থাকত ।

যাই হোক, লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতরের রজতকাঞ্চনের ভান্ডার হাতে না এলেও সরস্বতীর বীণাতন্ত্রীতে ঝংকার তুলে তার শব্দকথা  বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, আমার সন্তানপ্রতিম রাজ‍্যের গর্ব সুমন পাটারি । তোমাকে স্নেহ ও আদর হে কবি !

অশোকানন্দ
২৫. ৮. ২০২২.

ত্রিপুরারাজ‍্যে বাংলাভাষা ও সাহিত‍্যে উচ্চশিক্ষা

ত্রিপুরা রাজ‍্যে প্রধান দুটি ভাষা প্রচলিত । বাংলা ও ককবরক । রাজ‍্যের বৃহদংশের জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা এটি । কিন্তু এই দুই ভাষায় উচ্চশিক্ষা গ্লহণের সুযোগটি ক্ষীণ । রাজ‍্যের একটি উচ্মচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এম বি বি বিশ্ববিদ‍্যালয় শুরু থেকেই শিক্ষাপ্রসারের চেয়ে পেটোয়া বিদ‍্যাজীবীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।  যার ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সযোগ না থাকার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত এখানে অস্বাভাবিক নয় । শিক্ষাবিস্তার নয় । কিছু বশংবদ বিদ‍্যাব্রতীই এখানকার আসল নির্মান । এখানে কেন্দ্রীয় স্তরে একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে । সেখানেও বাংলা ব্রাত‍্য ।  মানোপযোগী না হওয়ার ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের  দূরশিক্ষণের মাধ‍্যমে বাংলা স্নাতকোত্তর পড়ার ক্ষীণ সুযোগটিও আজ বন্ধ । যার ফলে, প্রতি বছর ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ‍্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়ার জন‍্যে প্রচন্ড ভিড় হয় । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগের সুনামও দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ‍্যালয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন‍্যে  প্রতিবছর  দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও দেশের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় করে থাকেন । ফলে সবাই সুযোগ পান না । যাঁদের মধ‍্যে রাজ‍্যের উচ্চশিক্ষার্থীরাও প্রচুর রয়েছেন । সুযোগবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা যদি প্রাগুক্ত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেতেন তবে তাঁরাও রাজ‍্যের মুখ উজ্জ্বল করার সুযোগ পেতেন । 

Wednesday, August 17, 2022

বাংলা বর্ণমালায় শ ষ স এর উচ্চারণ ও ব‍্যবহার

বাংলা বর্ণমালায় শ ষ ও স এর উচ্চারণ ও ব‍্যবহার

বাংলা বর্ণমালা মূলত সংস্কৃতের অনুসারী । সংস্কৃত মুলে তিনটি  শ ষ স তিন প্রকার বর্ণের সাথে যুক্ত । শ ষ স হ এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় মুখ থেকে বাতাস বের হয় । এজন‍্য এই বর্ণগুলোকে 'উষ্মবর্ণ' বলা হয় । 'উষ্ম' শব্দের অর্থ বাতাস । অনেকে ভুল করে উষ্ণ বলে থাকেন ।  উষ্ণ বা গরম নয় । কন্ঠ থেকে খানিকটা বাতাস অর্থাৎ 'উষ্ম'বের করলেই  এই বর্ণগুলো উচ্চারিত হয় । আবার শ ষ স এই তিনটি ধ্বনিকে 'শিস'ধ্বনিও বলা।হয় । 

এই বর্ণগুলো উচ্চারণের সময় শিস দেওয়ার মতো শব্দ হয় । উচ্চারণস্থান অনুযায়ী তালব‍্য-শকে তালব‍্য বর্ণ, মূর্ধণ‍্য-ষকে মূর্ধণ‍্য বর্ণ এবং দন্ত‍্য-সকে দন্ত‍্য বর্ণ বলা হয় । সংস্কৃতে উচ্চারণগত দিক থেকে এই তিন বর্ণের তিনরকম উচ্চারণ হয় । 'স' ইংরেজি S অক্ষরের মতো । 'শ' ইংরেজি  SH অক্ষরের মতো এবং 'ষ' ইংরেজি  SH এর মতো তবে আরো তীব্র । বাংলায় তিনটি শ/ষ/স থাকলেও সব শ/ষ/স-ই  S বা SH এর মতো উচ্চারিত হয় । স্বতন্ত্র ধ্বনি হিসেবে কেবল 'শ' ধ্বনিরই ব‍্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । যেমন-বিশ/বিষ, সব/শব, শোনা/সোনা, ভাষা/ভাসা।  বানানে ভিন্নতা থাকলেও উচ্চারণ সর্বত্র 'শ'-এর মতো হচ্ছে ।যুক্তবর্ণের ক্ষেত্রে ব‍্যতিক্রম দেখা যায় । শব্দের গোড়ায় 'স' থাকলে 'স'-S এর মতো উচ্চারিত হয় । যেমন-অস্ত, স্পর্শ, স্ফটিক ইত‍্যাদি । এখানে 'স'-  S এর মতো উচ্চারিত হচ্ছে । আর শব্দের যধ‍্যে থাকলে 'শ'-SH এর মতো উচ্চারিত হয় ।  যেমন বিস্ফারিত, আস্পর্ধা, প্রভৃতি শব্দের প্রমিত উচ্চারণে 'শ'(SH) পাওয়া যায় । যেমন- বিশফারিত, আসপর্ধা ইত‍্যাদি । আবার 'শ'-এর সাথে 'ন'-ফলা, 'র'-ফলা, 'ল'-ফলা যুক্ত হলে 'স'(S) উচ্চারিত হয় । যেমন- প্রশ্ন, বিশ্রাম, অশ্লীল ইত‍্যাদি । এই শব্দগুলো উচ্চারণের সময় প্রোসনো,বিসরাম, অসস্লিল হয়ে যাচ্ছে ।

এককভাবে 'ষ'-র উচ্চারণ স্পষ্ট হয় । যেমন- ষষ্ঠী, ষড়ভুজ, ষড়ানন, ষন্ডা ইত‍্যাদি । আবার যুক্তবর্ণে 'বিষ্ময়কর, বিষ্ফোরণ ইত‍্যাদি 'শ(S)-এর মতো উচ্চারিত হয় । 'ট'-বর্গীয় বর্ণের আগে 'ষ' যুক্ত হয় । যেযন- অষ্ষ্টট, , নষ্ট, যষ্ঠি, কুষ্ঠ ইত‍্যাদি ।

যুক্তাক্ষর হলে কোন শ/ষ/স হবে তা এভাবে ঠিক হয় । তালব্য বর্ণ অর্থাৎ 'চ'- বর্গের বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে তালব্য-শ । মূর্ধণ‍্য বর্ণ অর্থাৎ 'ট'- বর্গের বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে মূর্ধণ‍্য-ষ এবং দন্ত‍্যবর্ণ অর্থাৎ 'ত'-বর্গের সঙ্গে যুক্ত হলে দন্ত‍্য-স হয় ।

যাই হোক, এই কয়েকটা উদাহরণে বিষয়টা স্পষ্ট হবার নয় । শ/ষ/স-এর কোনটা কোন সময় ব‍্যবহার হবে বা লিখতে হবে তার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে । 

বাংলা বর্ণমালার 'ব' ও 'ব'

সংস্কৃত বর্ণমালায় দুটি 'ব' । এই দুটির উচ্চারণ ও আকৃতিগত পার্থক‍্য রয়েছে । বাংলা বর্ণমালি সংস্কৃত বর্ণমালা দ্বারা অনুপ্রাণিত । ঈশ্বরচন্দ‍্র বিদ‍্যাসাগর সংস্কৃত বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা বর্ণমালা রচনা করেন । 
বাঙলা বর্ণমালা যথেষ্ট ফোনেটিক বা ধ্বনি-অনুসারী।  'ব'-ব্যঞ্জনটি যাকে ইংরেজিতে বলে bilabial plossive অর্থাৎ দুটি ঠোঁট একজায়গায় লাগে এবং আবার ছেড়ে দেয়, ও মাঝখান দিয়ে খানিকটা বিস্ফোরণের মত হাওয়া বেরিয়ে 'ব' উচ্চারণ হয়। প ফ ব ভ, 'প'-বর্গের ব্যঞ্জনগুলি এভাবেই উচ্চারিত হয়। 'ম'-এও ঠোঁট জড়ো হয় তবে ধ্বণিটি বিস্ফোরক নয় বরং নাসিক্য। এই বর্গভূক্ত বলে একে বর্গীয় ব বলে। ব্যঞ্জনগুলিকে এভাবেই তাদের উচ্চারণ স্থান ও বৈশিষ্টতা অনুযায়ী বিভিন্ন বর্গে ভাগ করা হয়েছে। 
বাংলা বর্ণমালায় 'ব'-এর আকৃতিগত কোনো পার্থক‍্য নেই । বর্ণমালায় একটি 'ব' বর্গীয়-ব । প-বর্গের অন্তর্গত । প ফ 'ব' ভ ম  ( এগুলি পঞ্চম বর্গীয় বর্ণ ) । শব্দের শুরুতে, মধ‍্যে বা শেষে অবস্থিত একক 'ব' হল বর্গীয়-ব । যেমন-দেবালয়, বাড়ি, বাহির, বাবা ইত‍্যাদি । এটি স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হয় । কিন্তু ব এর আরেকরকম উচ্চারণ চলে আসে যখন এই দুটির যেটির ক্ষেত্রে ঠোঁট জোড়া লাগতে চায় না বা লাগানো আয়াসসাধ্য। সে ক্ষেত্রে ওয়া গোছের উচ্চারণ হয়ে হাওয়া বেরিয়ে যায়। যেমন দুটি স্বরের মধ্যবর্তী বা অন্তঃস্থ বা intervocalic 'ব'-এর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায়। 
এটা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। এই 'ব'-কে বর্গীয় 'ব'-এর থেকে পৃথক করে অন্যত্র রাখা হয়েছে। এটি অন্তস্থ-'ব' । য র ল এর পরে আসে এই 'ব' ( য র ল 'ব'- এগুলো অন্তস্থ বর্ণ ) । যুক্তবর্ণে, বা যুক্তব‍্যঞ্জনে, বা যুক্তক্ষরে যা ব‍্যবহৃত হয় । অর্থাৎ 'ব'-ফলা হিসাবে যা ব‍্যবহৃত হয় । যেমন-জিহ্বা ( জিওহা ), স্বদেশ ( সদেশ ), স্বাধীনতা ( সাধীনতা ), আহ্বান ( আওহান ), স্বামী ( সামী )  ইত‍্যাদি । এই ফলা-র 'ব'টি 'ও' বা 'ওয়' উচ্চারিত হয় ।  বর্ণদ্বিত্বও হয় । যেমন- বিশ্ব ( বিশশো ), আশ্বাস ( আশশাস ) । অথবা যে বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয় তার সঙ্গে মিশে যায় । এই 'ব'কে অর্ধস্বরও বলা হয় । 
হিন্দি ও উর্দুতে এই 'ব'(ওয়)এর ব‍্যবহার দেখতে পাওয়া যায় । যেমন- ওয়াক্ত, ওয়াজির, ওয়তন, দেওকীনন্দন, দেওধর, দেওনাথ ইত‍্যাদি ।
অধুনা বাংলায়, অন্তস্থ ব বর্ণটি তুলে নেওয়া হয়েছে, তাই এখন বাংলায় সব ব-ই বর্গীয়-ব । এর উচ্চারণ ইংরেজী B- এর মতো। বাংলায় এখন আর 'উঅ' উচ্চারণ-যুক্ত ব নেই, যদিও এই উচ্চারণ সেই অর্থে বাংলা ভাষায় কোনোদিনই ব্যবহার করা হয়নি।
অধুনা বাংলা বর্ণমালায়, য, র, ল, শ, ষ....এই ক্রম পাবেন। ল-এর পরে ব পাবেন না। ফলে বর্তমান প্রজন্মের যারা তারা বর্ণমালায় একটি 'ব'-ই দেখতে বা পড়তে পাবে । ফলে তাদের কাছে আর বর্ণমালায় দুই 'ব' নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবেনা । আমরা যারা পুরোনো বর্ণমালা অনুসরণ করে এসেছি তাদের কাছেই এই দুই 'ব' নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় । এবং এটা হওয়া স্বাভাবিক । এর মধ‍্যেই বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে ।

Tuesday, August 16, 2022

কয়েকজন চিত্রশিল্পী, আমি ও মৈত্রীসেতু

গতকাল ( ২৭.৭. ২০২২ ) সকাল নটা নাগাদ আগরতলা থেকে ফোন পাই আমার প্রিয়জন রাজ‍্যের বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী ও সঞ্চালক উদয়শংকর ভট্টাচার্যের কাছ থেকে । তিনজন প্রখ‍্যাত চিত্রশিল্পী সাব্রুম আসছেন । সকালের ট্রেনটা মিস হওয়ার তাঁরা বাসে রওনা হয়েছেন । সাব্রুম শহরটা ঘুরে দেখবে । আমি যেন একটু তাঁদের পাশে থাকি । আমার শরীরটা ভালো না থাকায় বেশ কদিন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলামনা । পায়ের সমস‍্যাটা কমছেনা । তবুও একে তো নাচনী বুড়ি, তার উপরে ঢোলের বাড়ি । বাইরে বেরুনোর প্রস্তাবে আমার ভেতরটা লাফিয়ে উঠল । বার্ধক‍্যে গুণীজনসঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো যাবে । বাসটা কটার মধ‍্যে সাব্রুম পৌঁছুবে আন্দাজ করে আমি ধীরে সুস্থে তৈরি হতে থাকি । আমি উদয়শংকরদাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তাঁরা বাস থেকে কোথায় নামবেন তারপর কোথায় অবস্থান করবেন । সাব্রুমের সঙ্গে যাঁদের সামান‍্য যোগাযোগও আছে তাঁরা সবাই জানেন যে, সাব্রুমের শিক্ষক-কর্মচারী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়াবিদ ও মননশীল মানুষজনের মরুদ্যান হল আমাদের অগ্রজপ্রতিম অশোকদার অর্থাৎ অশোক বসাকের চায়ের দোকান । সংক্ষেপে আমরা বলি এবিসিডি । সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে  শুধুমাত্র এককাপ চা সেবন করলেও দোকানের মালিকরা বিরক্ত হন না । অশোকদাও মজাদার মানুষ । উদয়শংকরদাকে এই ঠিকানা দিলাম । যথারীতি দশটার সময়ে তাঁরা ওখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং আমাকে ফোন করলেন । আমি একটু সময় নিয়ে হালকা খাবার ও ঔষধ খেয়ে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম । 

তারপর সৌজন‍্যমূলক কিছু কথাবার্তা বলার পর একটা টোটো নিয়ে বেরুলাম সাব্রুম শহর পরিক্রমায় । শহরের লোকনাথ মন্দির থেকে শুরু করে রামঠাকুর মন্দির, দৈত‍্যেশ্বরী কালিবাড়ি ইত‍্যাদি দেখার ফাঁকে ঢুকলাম গার্লস স্কুলে । এই স্কুলে ঢুকলেই সামনে পড়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ । এই সাবেক দালানটাই রাজন‍্য আমলে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । এখানেই ছিল বিচারশালা ।বড়ো হাকিম বসতেন । তাঁর মাথার উপর ছিল টানা পাখা । বছর কুড়ি আগেও কার্নিশের উপর পাখার ভারি কাপড় ও দড়ি গুটানো ছিল । ভারতভুক্তির পরেও প্রায় দুদশক এখানে অফিসটি ছিল । যার দরুণ এখনও এই নাতিউচ্চ টিলাভূমি ও জনবসতিটার নাম পুরাতন অফিস টিলা । স্কুলে বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন আমার ছাত্র সুশীল দে । খবর পেয়ে ছুটে এলেন । সবাইকে অতিথির মতো নিয়ে ক‍্যানটিনে বসিয়ে আপ‍্যায়ণ করলেন । সুশীলবাবুর আতিথেয়তায় মুগ্ধ তাঁরা । শিক্ষক হিসাবে আমি গর্বিত । আমাদের তো এটাই প্রাপ্তি ।

কালীমন্দিরটাও বহু প্রাচীন। পাশেই তহশিল কাছারি । রাজন‍্য আমলে এখানে খাজনা আদায় হত । পুণ‍্যাহ হত । আমি চলতে চলতে সংক্ষেপে তাঁদের এই প্রতিষ্ঠান গুলোর ইতিহাস বলে গেলাম । তাঁরা নদীটা দেখতে চাইছিলেন । তাই টোটোকে বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়ার কথা বললাম । নদীটা দেখালাম । ওপারের পার্বত‍্য চট্টগ্রামের রামগড় শহরের বাড়িঘর দেখালাম । তাঁদের দর্শনের মূল আগ্রহ মৈত্রীসেতু । তাই টোটো ঘুরিয়ে ছোটোখিল রোড হয়ে চললাম মৈত্রীসেতুর দিকে । 

সকালের চড়া রোদ থাকায় বেশ গরম লাগছিল । অনেকক্ষণ কথা হল ফেনীনদীর গতিপথ, দুপারের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত‍্যাদি নিয়ে । দুদিকেই জোর নির্মানকাজ চলছে । পণ‍্য আদানপ্রদান না হলেও মানুষজন আসাযাওয়ার কাজ একদুমাসের মধ‍্যে শুরু হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ।

ফিরে আসার সময় আমি স্বগতোক্তি করলাম, দেখবেন আগামী একবছর পরে এই জায়গা জমজমাট হয়ে যাবে । তাঁরা সমস্বরে জবাব দিলেন । জমজমাট না হলেই ভালো । আমাদের আর ভিড়ঘিঞ্জি ভালো লাগেনা । আমরা এগুলো ছাড়াতে চাইছি । বোঝা গেল সাব্রুমের সৌম‍্য শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশটা তাঁদের আকৃষ্ট করেছে ।

ফেরার পথে আমার এক ছাত্র বিভাস বসাক তাদের সাংগঠনিক প্রয়োজনে টোটোটার সাহায‍্য চাইছিল । আর কাউকে বোধহয় পাচ্ছিলনা । আমি বিষয়টা বুঝে ড্রাইভারকে বললাম আমাদের সাব্রুম বয়েজ স্কুলের সামনে নামিয়ে দিতে । স্কুল কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা হরি চৌমুহুনীতে হেঁটে চলে যাব । সে যেন এইফাঁকে ওদের কাজটা সেরে ফিরে আসে ।

এরপর সাব্রুম স্কুলে প্রধান শিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয়ের কক্ষে কিছুক্ষণ কাটিয়ে কথাবার্তা বলে আমাদের ছাত্র বর্তমানে এই বিদ‍্যালয়ের শিক্ষক রতন চক্রবর্তীসহ ছবি তোলা হল । হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম চুমকি হোটেলের সামনে । মিছিল শেষ হওয়ার পর টোটোটা ফিরে এল । 

সেখান থেকে স্টেশনে যাওয়ার পথে তাঁদের কয়েকমিনিট সময় নষ্ট করে আমার বাসাটা দেখিয়ে নিলাম । আমার ঘরে বসে একটু কথা হল । এতক্ষণ আমি কারো নাম ধাম জেনে নিইনি । এখন আমার আর মনে থাকেনা । তাই ডায়েরিতে লিখে নিলাম । যাঁদের নিবিড় সান্নিধ‍্যে কালকের দিনের প্রথমার্ধ স্বর্গপুরীর নন্দনভ্রমণের অনুভব হল, সেই স্বনামধন‍্য চিত্রশিল্পীরা  হলেন–
১. ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ‍্যায়, অধ‍্যাপক- কল‍্যাণী বিশ্ববিদ‍্যালয় ।
২. দেবজিৎ পাল, শিক্ষক- জাশেদপুর পাবলিক স্কুল, জামশেদপুর, ঝাড়খন্ড ।
৩. বিরাজকুমার পাল, অধ‍্যাপক- রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ‍্যালয় ।

অল্পসময়ের জন‍্যে হলেও তাঁদের সান্নিধ্য আমার সুখস্মৃতি হয়ে থাকবে । খুবই খারাপ লাগছিল আমার বাড়ির সামনে থেকে তাঁদের বিদায় জানাতে গিয়ে । আর কবে দেখা হবে, আদৌ দেখা হবে কিনা জানিনা ‌। ভালো থাকুন, আমার শহরের এই ক্ষণিকের অতিথিরা ।

২৮. ৭. ২০২২.

Friday, August 12, 2022

আমার ননীমামু

এবারের কোলকাতা ভ্রমণ যেমন আনন্দদায়ক হয়েছে তেমনি বিষন্নতায় গ্রস্ত হয়েছি প্রবল । আনন্দের বিষয়টা ব‍্যক্তিগত । 
পাশাপাশি একটা দুঃসংবাদ আমার একার এবং নিজস্ব । এতকিছু নিয়ম মেনে চলার পরও ডায়াবেটিসে আমার পদযুগল বৈরী হয়ে গেছে । পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর 'হাই রিস্ক' বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে । সেইসঙ্গে কিছু ঔষধপত্র ও সাবধান বাণী । আঞ্চলিক প্রবাদে আমরা বলি, চরণে জানে মরণের খবর । গুলি মারো 'হাই রিস্ক' ।

দ্বিতীয় বেদনার জন‍্যে আমি প্রস্তুত ছিলামনা । এটা জানলে পাঠকেরও মন নরম হয়ে যাবে । রাজ‍্যের সাহিত‍্যসংস্কৃতিবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর নাম অবশ‍্যই জানেন । আর এই অধমকে নিয়ে ছিল দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে উঠে আসা মামা-ভাগ্নে জুটি । সাব্রুমের ছোটোখিলের সেকালের সংস্কৃতিমনস্ক দামোদরবাড়ির সন্তান ননী । এ গ্রাম রত্নগর্ভা । এ গ্রামের সন্তান কৃষ্ণধন নাথ । এ গ্রামের সন্তান ড. রঞ্জিত দে প্রমুখ । রাজ‍্যের সাহিত‍্যক্ষেত্রের দিকপাল তাঁরা । আরো অনেকে  অনেকভাবে প্রতিষ্ঠিত । একসময়ের রাজ‍্যের বিখ‍্যাত জাদুকর ডিএন গোপাল এ গ্রামের ভারত আমিনের ছেলে । পরে তাঁরা আগরতলা অভয়নগরে চলে যান । গ্রামের মধ‍্যে প্রত‍্যেকে প্রত‍্যেকের আত্মীয় । সেই সুবাদে ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী আর আমি মামা-ভাগ্নে । গ্রামে বলে, ধর্ম কুডুম তুন জর্ম কুডুম বড়ো । আমার চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই রঞ্জিতদা ও ননীমামুকে বরিষ্ঠ সতীর্থ হিসাবে পেয়েছি । ৯৩-৯৪ সালের দিকে শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার সাব্রুম স্কুলে এসে হেডমাস্টাররুমে শরৎচন্দ্রের একটা ছবি দেখে এটি কে এঁকেছেন জানতে চান । তখনই ননীমামুকে সামনে এনে হাজির করা হয় । মামুকে কবি আগে থেকেই চিনতেন । অনিল সরকার সাব্রুম এলে দামোদরবাড়িতে উঠতেন । সেসময়ের তরুণ কমরেডদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন । জহুরি জহর চেনে । কবি ও সংস্কৃতিপ্রেমী অনিল সরকার সেসময়ে বহু গুণীজনকে প্রত‍্যন্ত গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে । তাঁর প্রিয় ননীকে তুলে নিয়ে গেলেন আগরতলায় । রাজ‍্যে সাহিত‍্যসংস্কৃতিক্ষেত্রে মফঃস্বল থেকে উঠে এসে আগরতলায় দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি । রাজ‍্যের হাতে গোনা কয়েকজন লোকসংস্কৃতি গবেষকের অন‍্যতম তিনি । ইতোমধ‍্যে তাঁর টেলিফিল্ম 'ভাঙন' প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর লেখা কবিতা মুখে মুখে দেশের পরিমন্ডল পেরিয়ে বাংলাদেশের আবৃত্তিকারদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে । দৈনিক সংবাদের সাহিত‍্যের পাতায় ধারাবাহিক বেরিয়েছে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ' । অসাধারণ গল্পের হাত । বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ 'বসুধা' । অসাধারণ কয়েকটি মঞ্চসফল নাটক লিখেছেন তিনি । ত্রিপুরায় নাট‍্যচর্চায় লোক আঙ্গিকের ব‍্যবহারে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী । আকাশবাণীর জন‍্যে লিখেছেন সিরিজ নাটক । তাঁর নেতৃত্বে আমরা দক্ষিণের প্রান্তিক মহকুমা সাব্রুম থেকে ভারত জনবিজ্ঞান জাঠায় অংশগ্রহণ করেছিলাম চলার পথে প্রতিটি জনপদে তাৎক্ষণিক সৃষ্ট পথনাটক ও গানবাজনায় মাতিয়ে দিয়ে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রখ‍্যাত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যুদ্ধের রিপোর্টিং করেছেন এক নম্বর সেক্টর থেকে ।  সেই সুবাদে পরবর্তী সময়ে আগরতলায় গিয়ে দৈনিক সংবাদ, আজকের ফরিয়াদ, আরোহন এবং ত্রিপুরা দর্পণে ডেস্কে কাজ করেছেন । 

মনে পড়ে উচ্চ মাধ‍্যমিকের খাতা কাটার সময় বাংলার শিক্ষকদের তরফে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে তাঁর ভূমিকা । খাতা কাটার ফাঁকে ফাঁকে প্রত‍্যেকের হাতে হাতে চিরকুট ঘুরে ছড়ার মালা তৈরি । সবশেষে প্রধান পরীক্ষক পর্যন্ত পৌঁছে যেত তা । মফঃস্বল থেকে যে সব পরীক্ষকরা খাতা কাটতে আসতেন তাদের থাকতে দেওয়া হত বিভিন্ন স্কুলের হোস্টেলের ফ্লোরে । চূড়ান্ত অব‍্যবস্থার মধ‍্যে । একবার উমাকান্ত স্কুলের অস্থায়ী শিবিরের পরিবেশের ছবি তুলে মামা-ভাগ্নে মিলে তখনকার ভাবী ভারত পত্রিকার প্রথম পাতায় বিশাল লিড নিউজ করে দিয়েছিলাম । পরদিন সকালে পত্রিকা বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরা মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদের ভিত কেঁপে উঠেছিল সেদিন । অন‍্যদিকে উদয়পুরের বর্তমান পুরপিতা শীতলচন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল উত্তরপত্র মূল‍্যায়নের সাম্মানিক বৃদ্ধির আন্দোলন । আমরা পত্রিকায় সংবাদ করি । কর্তৃপক্ষ মাথা নোয়ায় সেবার । আরো বহু বহু ভাবনার ফসল বেরিয়েছে আমাদের দুজনের মাথা থেকে সেদিন । আগরতলায় চলে যাওয়ার পরও আমার যোগাযোগ ছিল তাঁর সঙ্গে । আগরতলায় গেলে যত রাত হোক আমার ঠিকানা ছিল তাঁর সরকারি আবাস । কি ছিল না সেখানে ।পুরো খেতকৃষিতে ভরে রেখেছিলেন সামনের উঠোনটা । চাকরির পর জগৎপুরে একটা ছোটো ছিমছাম বাড়ি করেন ।

কোভিডের সময়কাল থেকে আর তাঁর যোগাযোগ রাখা যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজখবর করে নাট‍্যজন সুভাষ দাসের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম তিনি ভীষণ অসুস্থ । ছেলে রানা এসে কোলকাতা নিয়ে  গেছে । ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মধ‍্যে কথা বলেছি । মামি ফোন ধরতেন । কুশল সংবাদ জানাতেন । এবারে কোলকাতা যাওয়ার সুযোগে ভাবলাম দেখা করে আসব । সেইভাবে মামির সঙ্গে কথাও বলে নিয়েছি । বাড়ির লোকেশানটাও জেনে নিয়েছি । কিন্তু আমার হঠাৎ অসুস্থতা, ডাক্তার দেখানো, নতুনমা, নতুন কুটুম্বদের আতিথেয়তা সব মিলিয়ে সময় করে উঠতে পারছিলামনা । এর মধ‍্যে গত শুক্রবার রাতে মামি ফোন করলেন । ভাইগনা, আইবা কইছিলা । আইলানা দেহি । কন্ঠে অভিমানের সুর । বুঝতে পেরে প‍রদিন সকালে যাব মন স্থির করলাম  । কিন্তু ছেলের কাজ পড়ে যাওয়ায় দুপুরের খাওয়ার পর রওনা হলাম দমদম ছাতাকলের ঠিকানায় । রানা এসে এগিয়ে নিয়ে গেল । সিঁড়িতে আমার গলা শুনেই অতি কষ্টে দরজার চৌকাঠে চলে এলেন । কথাবার্তায় সেই আগের মতোই উইট আছে । নিজের অসুস্থতা নিয়ে নিয়ে নিজেই মজা করছেন । আমি নির্বিকার চেয়ে দেখছি তাঁর দিকে । কাকে দেখছি আমি ! এই কি অসম্ভব ঈর্ষনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী ননী চক্রবর্তী ? চিত্রাঙ্গদা নাটকের অর্জুন ? ডাকসাইটে এনসিসি কমিশনড অফিসার ননীগোপাল চক্রবর্তী? বাংলাসাহিত‍্যের শিক্ষক ননীস‍্যর ? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ফ্ল‍্যাশব‍্যাকের ধামাকায় । পা ফুলে আছে হাঁটু অব্দি । স্ট্রোকে মুখটা বেঁকে গেছে । মুখে জড়তা এসে গেছে । অনেকক্ষণ না শুনলে কি বলছেন বোঝা যায়না । তবু আমার শ্রীমান নাতির সঙ্গে মজা করছেন শরীরের কষ্ট ভুলে । মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন । আমি মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে অতীতের স্বর্ণালী দিনগুলোর কথা টেনে আনন্দ নিতে চাইলাম । রানা বলল, তাঁর বাড়ির প্রতি বড়ো টান । মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তে চান বাড়ি ফেরার জন‍্যে । আমি আশ্বাস দিই, বাড়ি তো যাবেনই । আগরতলায় এসে আবার নাটক করবেন, লিখবেন । কে জানত, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমার জন‍্যে অপেক্ষা করছে । কথায় কথায় মামি বললেন তাঁর নিজের কেমো চলছে । ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে এই ছোট্ট আবাসে তাঁদের সামলাতে । কিন্ত তাঁর নাকি শরীরের কোনো কষ্ট হচ্ছেনা । মামার জন‍্যে, সন্ততির জন‍্যে তিনি ভাবছেন । আহা ! সর্বংসহা মামি আমার !

একসময় উজ্জ্বল ইতিহাসকে ফেলে আমায় উঠতেই হল আমার সন্তানকে নিয়ে । আমার চোখে দেখা বাস্তবের নায়ক আজ বিধ্বস্ত কিং লিয়রের মতো । এদিকে একপশলা বৃষ্টি আমার হয়ে কেঁদে নিয়েছে । আমি চাইছি আমার ননীমামু-মামি ফিরে আসুন সুস্থ হয়ে ।

২০ জুলাই, ২০২২.