জীবন অন্বেষণের কথকতা 'ত্যুই'
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরার অরণ্যানীর আদিম সৌন্দর্য, এখানকার সহজ সরল মানুষজনের জীবনকে কথাসাহিত্যিক শঙ্খশুভ্র দেববর্মন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ৷ জন্মসূত্রে তিনি রাজবংশোদ্ভুত হওয়ায় রাজন্য ঐতিহ্য তাঁর মননে ও চিন্তায় ৷ ত্রিপুরার জনজাতি জীবনের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ রয়েছে ৷ তাঁর সৃষ্টিতেও তাই উঠে আসে এই অঞ্চলের জনজীবনচিত্র ও সমকালীন গতিজাড্য ৷
'ত্যুই' উপন্যাসেও শঙ্খশুভ্র ত্রিপুরার চলমান জীবনেরই স্থির অস্থির দোলাচলকেই তুলে ধরেছেন ৷ সমান্তরাল দুটি কাহিনিবয়নের মাধ্যমে ত্রিপুরার এক বিশেষ সময়খন্ডকে তুলে ধরেছেন দক্ষ শৈলীতে ৷ প্রচন্ড সেই ঝোড়ো সময়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে আরণ্যক ত্রিপুরার শান্ত দিনলিপি ৷ এই সময়ের মধ্যে রাজ্যে ঘটে গেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ৷ সমস্যাদীর্ণ জনজাতি সমাজ, স্বাধীনতাস্পৃহার নামে বিচ্ছিন্নতাবাদের হাতছানি, পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ, অপহরণ, হত্যা, রক্তপাতের পাশাপাশি জনপদে ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত্যাদির ফলে ভদ্রাসনচ্যুত মানুষের আশ্রয়ের খোঁজে অনির্দেশ যাত্রা ৷ যেন রাজ্যের চিরন্তন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বাঁকের মুখে দাঁড় করায় ৷ আর একদিকে অসহনীয় তাপপ্রবাহের কারণে জলের উৎস শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দূরবর্তী স্থান থেকে কষ্টকর পানীয় ও ব্যবহার্য জলের সন্ধান নিত্যদিনের জীবনবেদ ৷ শুধু জনজাতি নয় ৷জলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত আবহমান মানবজীবনধারা ৷ জলের উৎস খুঁজে খুঁজেই মানুষ পরিযায়ী হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে ৷ স্থান থেকে স্থানান্তরে সরে গেছে তার বসতি ৷ পার্বত্য জনজীবনও গড়িয়েছে পাহাড়ি স্রোতস্বিনী, জলধারা, ঝরনাকে ঘিরে ৷ জীবনস্বরূপা জল তাই দেখা দিয়েছে দেবীরূপে ৷
ককবরক ভাষায় 'ত্যুই' মানে জল ৷ 'ত্যুইমা' মানে জলদেবী ৷ " ত্যুইমা" তাঁর সন্তানদের শান্তি, সমৃদ্ধি, উর্বরতা দেন" ৷ সেকারণেই বরক জনজাতিগোষ্ঠীর মানুষ জলদেবী ত্যুইমার পুজো করেন আর বর মাগেন, ত্যুইমা আমাদের ত্যুই দাও, জল দাও, আমাদের গাঁয়ে জল দাও ৷ জলকষ্ট অনুভূত শৈশবোত্তীর্ণ মেয়ে চন্দ্রাবতী জলের সন্ধানে প্রতিদিন পাড়ি দেয় বহুদূর পথ ৷ আসতে যেতে তিনঘন্টার পথ পেরুতে হয় ৷ কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্তি আসে না ৷ এই উৎসও অনেকসময় শুকিয়ে যায় ৷ তখন পাড়ি দিতে হয় আরো দূরের পথ ৷ অথবা জলকষ্ট লাঘবের জন্যে বানাতে হয় অস্থায়ী আস্তানা ৷ এই করেই কেটে যায় চন্দ্রবতীর দিন ৷ ত্রিপুরার পার্বত্য জনপদের কোনো কোনোটাতে নিস্তরঙ্গ জীবন এভাবেই বয়ে যায় ৷ ত্রিপুরা শান্ত প্রকৃতির বুকে আরও বেশি শান্ত জীবনযাত্রায় কখনো কখনো ওঠে ঝড় ৷ সে ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় গ্রামজীবনধারা ৷ আগুন জ্বলে ওঠে জনপদে ৷ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জীবনের গতিপথ ৷হঠাৎ করে কোনো উগ্রপন্থী দল হামলা চালায় টহলদারি মিলিটারিদের উপর ৷ ফলে
সৃষ্টি হয় অবিশ্বাসের পটভূমি ৷ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয় সংশ্লিষ্ট জনপদ ৷ গুলি, আগুন, মৃত্যুর হাহাকারে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় পার্বত্য পল্লী ৷ দিশাহারা মানুষ ছোটে আশ্রয়ের সন্ধানে, প্রাণের তাগিদে ৷ নিরীহ গ্রামবাসী দুদিক থেকেই চাপে পড়ে ৷ উগ্রবাদীরা যুবকদের দলে টানার চেষ্টা করে ৷ সম্মত না হলে হয় অত্যাচারের, বুলেটের শিকার ৷ অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও তাদের উগ্রপন্থী বা তাদের দোসর বলে সন্দেহ করে ৷ মৃত্যু তাদের জীবনের দুপ্রান্তে ওঁৎ পেতে থাকে ৷ সেকারণেই কোনো অঘটন ঘটলেই তাদের বাস্তুভূমি ছাড়তে হয় ৷ এভাবেই স্কুল চলাকালীন সময়েই আকস্মিক ঘটনায় মুহূর্তে স্কুল ছাড়তে হয় শিশু সাতুঙ্গকে ৷ বাড়িতে ফিরে গিয়ে মা বাবার সন্ধান নেবারও সুযোগ থাকে না ৷ যে মানুষজনের সঙ্গে সে পালায় তারা অপরিচিত ৷ তবে স্বজাতীয় রিয়াং জনগোষ্ঠীরই সদস্য তারা ৷ অন্য কোনো জনপদ থেকে তাড়া খেয়ে ছুটছে ৷ আসলে তারা সন্ত্রাবাদীদের কব্জায় পড়ে তাদের নির্দিষ্ট পথে ছুটতে থাকে ৷ সাতুঙ্গ লক্ষ করে এখানেও অত্যাচার ৷ উগ্রপন্থীদের নির্দেশ না মানলে, ফাই ফরমাস না খাটলে চলে নির্যাতন ৷ আবার থাকে সামরিক দলের সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা ৷ সাধারণ মানুষকে ওরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ৷ দুদলের সংঘর্ষে মারা পড়ে নিরীহ মানুষ ৷ একসময় সেদল থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সে ৷ ক্ষণিকের জন্যে আশ্রয় পায় বৃদ্ধ দম্পতির পরিবারে ৷ মা বাবাকে হারানোর ব্যথাতে কিছুটা যেন শান্তির প্রলেপ ৷ সেখানেও একদিন অশান্তির কালো ছায়া নামে ৷ সাতুঙ্গকে ছেড়ে যেতে হয় বৃদ্ধ দম্পতির আশ্রয় ৷ আবার নতুন দল ৷ নতুন যাত্রা ৷ একই জনজাতির ৷ এ দলে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় সমবয়সী মুরিয়ার সঙ্গে ৷ তার কাছে সে জানতে পারে যে তারা যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য মিজোরামের দিকে ৷ সরকারি শরণার্থী শিবিরে ৷ এ পথেই দেখা হয় সারভিস রিভলবারসহ ডিউটি থেকে পালিয়ে আসা তার কাকা জিতেনের সঙ্গে ৷ জিতেন দিতে পারে নি তার মা বাবার সন্ধান ৷ একসময় সাতুঙ্গের দল আশ্রয় নেয় মিজোরাম সরকারের শরণার্থী শিবিরে ৷ তার আগে পথে চিতাবাঘ তুলে নিয়ে যায় বন্ধু মুরিয়াকে ৷ টহলরত মিলিটারিরা আটক করে সঙ্গে রিভলবার পাওয়ায় সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে এবং পুরস্কার পাওয়ার লোভে গুলি করে হত্যা করে কাকা জিতেনকে ৷ নিঃসঙ্গ সাতুঙ্গের দিন কাটে শরণার্থী শিবিরে সরকারী রেশনের অনুগ্রহে ৷ শিবিরের মানুষজনের মাঝে খোঁজে মায়ের মুখ ৷
একদিন এ শিবিরও ছাড়তে হয় ৷রিয়াংদের জন্য জেলা পরিষদ দাবি করায় মিজোরাম সরকার বন্ধ করে দেয় শিবির মিলিটারি দিয়ে তাড়িয়ে দেয় তাদের ৷ তাড়া খেয়ে কর্ণফুলি নদী পেরিয়ে আবার আশ্রয় নেয় চট্টগ্রামের চাকমা শরণার্থী শিবিরে ৷ সেখানে বিদেশি ত্রাণকর্মী দাইচির সান্নিধ্যে ইংরেজি শেখে ৷ ভাগ্যক্রমে জাপানে অভিবাসনের সুযোগ পায় ৷ জাপানি যে পরিবার তাকে দত্তক নেয় তাদের সান্নিধ্যে এসে লেখাপড়া শিখে ইঞ্জিনিয়ার হয় সে ৷ সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুত্বের সুযোগে তার দিল্লিবাসী এক আত্মীয়ের কাছ থেকে তার অসুস্থ মায়ের সন্ধান পায় ৷ তার দত্তক মা বাবা তাকাহিরো ও কাজুমোর প্রচেষ্টায় সে দেশে পৌঁছায় ৷ মায়ের সান্নিধ্য পায় ৷ একসময় মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় আবার ফিরে আসার কথা দিয়ে ৷তার ভেতরে বোধ জেগে ওঠে ৷ তার স্বভূমির উন্নয়নের প্রচেষ্টার তাগিদ ৷অশান্তি, অনুন্নয়ন, বিচ্ছিন্নতাবাদ দূর করার আর্তি ৷ জাপানে ফিরে গিয়ে শুরু করে যোগাযোগ ৷ পরিকল্পনা বাস্তবায়ণের জন্যে শুরু করে অর্থসংগ্রহও ৷
শুরু হয় কাঞ্চনপুরের রিয়াং জনপদে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের জন্যে গভীর নলকূপ বসানোর কাজ ৷ নেতৃত্বে সাতুঙ্গ ৷ এটা চন্দ্রাবতীদের জনপদ ৷ চন্দ্রাবতীসহ এ গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা সাতুঙ্গকে 'বোরোকাহাম' বা সুদর্শন বলে ডাকে ৷ একসময় জল উঠে আসে পাতাল ফুঁড়ে ৷ আনন্দে আত্মহারা জনগণ উৎসবে মেতে ওঠে ৷ হোজাগিরি নাচের মাধ্যমে সংবর্ধনা জানায় সাতুঙ্গ ও তার দলের সদস্যদের ৷ ঘোষণা হয় এখানে স্কুল স্থাপনের ৷ উৎসব শেষে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয় চন্দ্রাবতী ও সাতুঙ্গের ৷
কথাসাহিত্যিক শঙ্খশুভ্র দেববর্মন তাঁর 'ত্যুই' উপন্যাসে যে দুটি কাহিনিক্রম তুলে ধরেছেন তা জীবনেরই অন্বেষণের পরিপূর্ণতা ৷ একটি কাহিনি আবর্তিত হয়েছে জলের সন্ধানে তো অপরটি বাসভূমির ৷ জল ও বসতি জীবনেরই অনুষঙ্গ ৷ সে কারণেই দুই কাহিনি এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে ৷ জলই তো জীবন ৷ বাস্তুও জীবনের জন্যে ৷ জীবনে জীবন যোগ করা এ উপন্যাসের মরমি বার্তা ৷ চন্দ্রাবতীদের জীবনে অপরিহার্য জলের সহজলভ্যতা আর ' বোরোকাহাম' সাতুঙ্গের অনিশ্চিত বাস্তুসন্ধান থেকে জীবনের মূল স্রোতের সান্নিধ্য এখানে প্রতীকী অর্থে এক হয়ে গেছে ৷
ত্যুই - শঙ্খশুভ্র দেববর্মন ৷ নীহারিকা, আগরতলা ৷প্রথম প্রকাশ | আগরতলা বইমেলা-2017, মূল্য - 225 টাকা ৷
No comments:
Post a Comment