ভর সন্ধ্যেবেলা কে ডাকছে ৷ উঠোনে বেরিয়ে দেখল সাদা থান পরা বয়স্কা এক মহিলা ৷ অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না ৷
-দিদি আঁরে চিনছেন নি?
-না তো? তুঁই কন?
- সুমনের বাপের কথ মনে আছে নি?
-সু ম নে র....বা প...?
কতো দিন হয়ে গেল ৷ মানুষটার মুখটাও মনে আসে না ত্রিবেণীর ৷ মনে করেই বা কী হবে? সুমন তখন তিনমাস কী চারমাস বয়সী হবে ৷ মনে মনে ভাবছে যতোটা সম্ভব খরচা করেই অন্নপ্রাশনটা সারবে ৷ বাপের বাড়ির তেমন কাউকে না বললেও চলবে ৷ তারা কিছু মনে করবে না ৷ জামাইর অবস্থা তারা জানে ৷ সুদিনে সারা রাজ্যের আসরে ঘুরে ঘুরে হরিসংকীর্তন করে বেড়ায় ৷ তার আয় দিয়েই বছরের বাকি সময়টা চালিয়ে নিতে হয় ৷ সুধন নামকীর্তনের দলে খোল বাজাত ৷ তার খোলের আওয়াজে মাতোয়ারা হয়ে ভক্তরা তার জামার হাতায়,বুকে সেফটিপিনে গেঁথে দশ, বিশ, পঞ্চাশ টাকার নোট গেঁথে দিয়ে যেত পুরস্কার স্বরূপ ৷ মাঝে মাঝে দু একটা একশো টাকার নোটও ঝুলত ৷আর গানে গলাটাও ছিল অপূর্ব ৷ মাঝরাতের আসর হলে সে পদাবলি গাইত ৷ রাধাকৃষ্ণ লীলার পদ ৷ তাই দলে তার আলাদা একটা কদর ছিল ৷ পুরস্কারের টাকাটা তার উপরি পাওনা ৷ কাজেই এই আয় দিয়ে বুড়ো মা আর ত্রিবেণীকে নিয়ে তিনজনের সংসার টেনে খিঁচে চলে যেত ৷
বায়নার দিনগুলোতে বেশির ভাগ বাড়ির বাইরে কাটাতে হত সুধনকে ৷ ত্রিবেণীর যখন দিনমাস রাত্তিরে সে শাশুড়ির সঙ্গেই শুত ৷ সেদিক থেকে সে নিশ্চিন্ত ৷ তার শাশুড়ি গ্রামের পুরোনো ধাই ৷ অসুবিধে হলে সামলে নেবে সব ৷ কিন্তু ওর পরান পোড়ে মানুষটার জন্যে ৷ কী অবস্থায় না জানি আছে ৷ রাত জেগে কীর্তনের পর একটু ঘুমুতে পারছে তো ৷ একবার গিয়েছিল সে মনুবাজারের কীর্তনের আসরে ৷ বিয়ের পরটাতেই ৷ দলের সবাই বৌদি বৌদি করে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিল তাদের ডেরায় ৷ উদ্যোক্তাদের দেওয়া একটা আধভাঙা বেড়ার ঘর ৷ মাটির মেঝে ৷ তার উপর একগাদা খড় বিছানো ৷ তার উপর বিছানার চাদর ফেলে রাত কাটায় কীর্তনিয়ারা ৷ ত্রিবেণীর মনের উসখুস অবস্থা দেখে দলের তিনটে মেয়ের মধ্যে যেটা ফর্সামতো এবং বয়সে বড়ো সে বলে উঠল, বুইজজি ব'দি ৷ আন্নে কী চিন্তা করেনের ৷ দাদার কথা নি? আন্ডা হেতেনেরে কনঅ কষ্ট দি না ৷ হেতেনের লাই আলগা বিছনা করি দি ৷ আন্নের মতন অয় না আরি ৷ বলে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ নাচায় ৷ ত্রিবেণীও বৌদিসুলভ বাণ ছাড়ে তুণীর থেকে, আঁই রইছি কন্ডে ৷ আঁই দেখিয়ের নি, তোন্ডা কীঅরঅ ৷ মেয়েটা মাঝে মধ্যে ওর সঙ্গে বাড়িতেও এসেছে ৷ নাম বিশাখা ৷ বৌদির সঙ্গে খুনসুটি করত চঞ্চলা ননদের মতো ৷ বেশি রাতে এলে হাতে হাত ধরে রান্নার কাজে সাহায্যও করেছে ৷ কে জানত ওই কপাল ভাঙবে ত্রিবেণীর ৷ সুমনের অন্নপ্রাসনের মুখে পাড়ায় রটে গেল সুধন কীর্তনিয়া দলের এক মেয়েকে বিয়ে করেছে ৷ পড়ি মরি করে ছেলে কোলে নিয়ে খোঁজ নিতে নিতে আমবাসা কীর্তনের আসরে পায় ৷ সুধন কোনো কথা বলে নি ৷ তার সামনেই বিশাখা যা তা গালমন্দ করে বিদায় দিয়েছে ৷ বাড়ি ফিরে এলে শাশুড়ি নাতির মুখ দেখে ঠাঁই দিয়েছে ৷ প্রবোধ দিয়েছে, চিন্তা ন করিও মা ৷ আঁর হ্যাটে দোষ কইরছে ৷ আঁই তো করি ন ৷ ঠাকুরে চালাই লই যাইবো গই ৷ এর পর শাশুরি মানুষের বাড়ি কাজ করে দিন গুজরিয়েছে ৷ শাশুড়ী কর্মক্ষমতা হারানোর পর সংসারের হাল ধরেছে ত্রিবেণী ৷ ছেলে সুধনের আশায় পথ চেয়ে চেয়ে বুড়িও একদিন চোখ বুজেছে ৷ সংসারে আবার নিঃসঙ্গ ত্রিবেণী ৷ ছেলেও এখন কাছে নেই ৷ গাড়ি চালানো শিখে আসাম আগরতলা সড়কে দশচাকার ট্রাক চালায় ৷ মালিকের বাড়ি গৌহাটি ৷ তাই এদিকে তার আসার সুযোগ কম ৷ তবুও আসে ৷ মাঝে সাঝে ৷
কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কে জানে ৷
দিদি আঁরে চিনেন ন? আঁই বিশাখা ৷ আঁই .....
এতোদিন পর বিশাখা নামটা শুনে চমকে উঠে ৷ কী কইলা? বিশাখা? সু ম নে র বা...প ......! এক তীব্র চিৎকারে সন্ধ্যার আঁধার ফালাফালা করে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দুয়ার দিল ৷
আজ একেবারেই নিঃসঙ্গ হল ত্রিবেণী #
Friday, October 27, 2017
ছা ড়ি য়া না যা স
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment