Friday, June 21, 2019

কেন চেয়ে আছো গো মা

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল দীপ্তর ৷ সে কী স্বপ্ন দেখ ছিল ! স্বপ্ন কী এতো স্পষ্ট হয় ৷ বয়স্কা এক আদিবাসী মহিলা যেন  ৷ যাকে বলে লোলচর্ম ৷ ঠিক ততোটা না হলেও সারামুখে স্পষ্ট বলিরেখায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ৷ হলে কী হবে কালো চাদরে প্রায় আধেকঢাকা শরীর দেখে বোঝা যায় এখনও ভেঙে পড়েনি একসময়ের কর্মজীবী দেহ ৷ একদৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মুখে এক ঐশ্বরিক হাসি ৷ কোনোদিন একে দেখেছে বলেও মনে হয়না ৷ এমনিতে এটা পার্বত্য এলাকা ৷ ছোটো ছোটো টিলার উপরে ছড়ানো ছিটানো সব টংঘর ৷ কাল বিকেলে এখানে এসেই কাছাকাছি একটু ঘুরে দেখেছে ৷ রাত্তিরের আশ্রয়টা নিয়েছে এই ফরেস্ট বাংলোতে ৷ কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কিছু কিছু তথ্য ৷ ত্রিপুরি এবং মগ জনগোষ্ঠীর মানুষজন এখানে পাশাপাশি বাস করে ৷ ত্রিপুরিরা সনাতন ধর্মাবলম্বী ৷ মগরা বৌদ্ধ ৷ তবে এই জায়গাটা সম্বন্ধে তার একটা পূর্ব ধারণা ছিল ৷  তার বাবাও সাতের দশকের শেষ দিকে  এখানকার রামরতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে গেছেন ৷ আশি সালের ভয়াবহ দাঙ্গার সময় তাঁকে রাতারাতি এলাকা ছেড়ে আসতে হয় ৷ যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সে বাড়ির লোকেরাই রাতের অন্ধকারে বনের পথ ধরে আসাম-আগরতলা সড়কে উঠিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তিনি আর এগ্রামে আসেননি কোনোদিন ৷ মাঝেমাঝে তিনি গল্প করতেন ৷ এই জায়গার কথা ৷ এখানকার লোকজনের কথা ৷ পাহাড়ের উপরের প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরের কথা ৷ ভাবতে ভাবতে আর ঘুম এলোনা ৷ বাংলোর পাশের গাছগাছালিতে পাখিদের বৃন্দগান শুরু হয়েছে ৷ স্বপ্নটা দেখার পর আর ঘুম আসেনি ৷ উঠে দরজা খুলে বাইরে এসে দেখে দূরে কুয়াশাঢাকা পাহাড়ের মাথায় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে লালচে আভা ছড়াচ্ছে ৷

মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বেরোনোর পরপরই চাকরিটা পেয়ে যায় ৷ পোস্টিংও এই তাকমপাড়াতেই ৷ কদিন আগেই বাবা চলে গেছেন ৷ ক্যান্সারটা থার্ড স্টেজে ধরা পড়ে ৷ দীপ্তদের আর কিছু করার তেমন সুযোগ ছিলনা ৷ মা কিছুটা ভেঙে পড়েছিলেন ৷ ছেলেকে কাছে কোথাও পোস্টিং হয় কিনা চেষ্টা করতে বললেন ৷ কিন্তু দীপ্ত জানে সরকারি সুযোগ নিয়ে এমডি করতে গেলে অন্তত তিনবছর গ্রামীন এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে ৷ তাই সে মাকে রাজি করিয়ে এখানে পোস্টিং নেয় ৷ ধীরে ধীরে এলাকায় একটা পরিচিতিও হয়ে যায় তার ৷ হৃদয়বান চিকিৎসক হিসেবেও ৷ গরীব ও বয়স্ক রোগীদের সঙ্গে মা-মাসি, কাকা-জেঠু বলে ডেকে অসুবিধার কথা জেনে নিত ৷ চিকিৎসা করত ৷

একদিন বিকেলের শিফটে আউটডোরে বসেছে অর্ক ৷ সারিতে রোগী তেমন নেই ৷ মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে বারো থেকে চোদ্দোজন হবে ৷ রোগি দেখতে দেখতে সে সারিবদ্ধ রোগিদের দিকে তাকাচ্ছিল ৷ পরিচিতির সুবাদে দুএকজনের সঙ্গে ঠাট্টা মস্করাসহ কুশলও জেনে নিচ্ছিল ৷ সে লক্ষ করছিল একেবারে শেষের দিকের একজন বয়স্ক মহিলা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই রয়েছে ৷ আর হাসছে মিটিমিটি ৷ শেষসময় যখন সে এগিয়ে এল দীপ্তর মনে হল একে যেন সে কোথাও দেখেছে আগে ৷ কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা ৷ বুড়িকে জিজ্ঞেস করল , তামঅ অংখা নিনি আমা ৷ মা তোমার কী অইছে? ইতোমধ্যে স্থানীয় ভাষাও শিখে নিয়েছে সে ৷
—কী আর আর অইবো ৷ লুমজাক ৷ জ্বর হইছে ৷
দীপ্র গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুড়ির প্রচন্ড জ্বর ৷ এটা ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা ৷ কনফার্ম না হয়ে চিকিৎসা করা ঠিক হবেনা ৷ দুটো পাঁচশো এমজি প্যারাসিটামোল দিয়ে বলল, রাত্রে একটা খাইয়া লাইও খাইবার পরে ৷ জ্বর থাকলে সকালে আর একটা খাইবা  ৷ সকালে এখানে আইয়া রক্ত পরীক্ষা কইরা যাবে ৷ তারপর দরকার অইলে অষুধ দিব ৷
বুড়ি যেন দীপ্রর কথা শুনছেইনা ৷ অপলক তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ৷ হাসিটি লেগে রয়েছে মুখে ৷
—কি অইছে বুঝছেনি?
—ইঁ ৷ সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় বুড়ি ৷ দাক্তর, তুই কী অসিত মাসতর পোলা নি?  আচমকা প্রশ্ন করে বসে বুড়ি ৷ দীপ্রও হতচকিত হয়ে যায় ৷ তার বাবার নাম কী করে জানল বুড়ি? 
দীপ্রও জবাব দেয়, হ ৷ তুমি আমার বাবার নাম কী কইরা জানলা?
—জানে জানে ৷ নিজের মানুর নাম জানতো লাগে ৷ আমার তো ভুল অইছেনা তাইলে ৷ তুমার বাবা ভালা আছেনি?
—না ৷ তাইনে তো মারা গেছে কয়েকমাস আগে ৷
অ..অ.. ৷ লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর দেখা হইলনা ৷ খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল বুড়ি ৷ দীপ্র লক্ষ্য করল যে হাসিমুখ নিয়ে সে এতোক্ষণ দীপ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল সেই মুখশ্রী যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ৷ চোখজোড়া ছলছল ৷ দুটো অশ্রুবিন্দু দুগাল বেয়ে নেমে আসছে ৷ বাইরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে ৷ সে আঁধার যেন জীবনের শেষবেলায় উত্তীর্ণ এই বয়স্ক মহিলার মুখটাকেও ঢেকে ফেলছে ৷
—হক্কলে আমারে থকাইলো ৷ হক্কলে ৷ বলতে বলতে ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধা ৷ দীপ্র হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সেদিকে ৷
ডাকবাংলোর বারান্দায় একাকী বসে রয়েছে দীপ্র ৷ সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ৷ দূরে টিলার উপরে কিছু দূরে দূরে ক্ষীণ আলোর সারি ৷ ওগুলো পার্বত্যপল্লীর টংঘরগুলোর আলো ৷ কতো দূরে অথচ কত উজ্জ্বল ৷  আজ বিকেলের ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা বারবার তার মনে উঁকি দিচ্ছে ৷ ভাবছে কাল বুড়ি রক্তপরীক্ষা করতে এলে ভালো করে জেনে নেবে সব ৷ এরমধ্যেই কেয়ারটেকার কুসুমকুমার কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ৷
—স্যার আপনার কী শরীর খারাপ লাগছে?  বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
—না ৷ ওসব কিছুনা ৷ বসো ৷ বলছি ৷ বৃদ্ধার চেহারা বর্ণনা করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি চেন এই মহিলাকে?  হ্যাঁ বাবু ৷ ওতো আমাদের তিরুপতি আমা ৷ ওই যে  আলো জ্বলছে দূরে ৷ রামরতন পাড়া ৷ ওখানেই থাকে ৷ তিনকুলে কেউ নেই তার ৷ বিয়েও করেনি ৷ গ্রামের মানুষই সাহায্য সহায়তা ৷ সামান্য লেখাপড়া জানে ৷ গ্রামে ট্যুইশানি করে যা পায় তা দিয়ে চালিয়ে নেয় ৷ শুনেছি দাঙ্গার সময় তাদের বাড়িতে এক মাস্টার থাকত ৷ সে তাকে পড়াত ৷ তাদের মধ্যে একটা ভাবও হয়েছিল ৷ কিন্তু সমাজ মেনে নিতে চাইছিলনা ৷ দাঙ্গার সময় একরাতে উগ্রপন্থীরা মাস্টারকে তুলে  নিয়ে যায় ৷ তারপর আর মাস্টারের খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷ তিরুপতি আমা আর বিয়ে থা করেনি ৷ চলুন আপনার খাবার দিই ৷
— হ্যাঁ, চলো ৷

মাঝরাতে আবার স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল ৷ সেই প্রথম রাতে দেখা সেই মুখ সেই পোষাক ৷ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেই স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ আজ মনে করতে পারল তিরুপতি আমাকে কেন চেনা চেনা লাগছিল ৷ সেই তো স্বপ্নে দেখা দ্য়েছিল সেদিন ৷ আজও আবার ৷ চমকে উঠল সে একই স্বপ্ন আবার দেখে ৷
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল ৷ রাত গভীর ৷ চারদিক সুনসান ৷ গাঢ় রাতের দরজা ভেঙে একটা করুণ পাহাড়ি বিলাপ রামরতনপাড়ার অন্ধকার আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে ৷

Wednesday, June 19, 2019

চরণ ধরিতে দিয়ো গো

   দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন  বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷

সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷

একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আননোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা  অনুকূলবাবু ৷

খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
   অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷

অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন?  মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷

অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়াল ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷

চরণ ধরিতে দিয়ো গো



   দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন  বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷

সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷

একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আমনোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা বললেন অনুকূলবাবু ৷

খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
   অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷

অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন?  মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷

অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়ালো ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷

Tuesday, June 18, 2019

ডা অ র

ডাঅর লাইগজে, ডাঅর
আষাঢ় মাসের এই অঝোর বর্ষণকে লক্ষ্য করে আমার মা একটা প্রবাদ বলতেন-দশরথের  দশদিন/দেবতা করে রাইত দিন । আষাঢ় মাসের এই লাগাতর বর্ষণদিনগুলোর কয়েকটা নাম আছে । এগুলোর এক একটাকে ' ডঅর' বা 'ডাঅর' বলা হয় নোয়াখালি ভাষায় । এভাবে আষাঢ়ের প্রথম দশদিন 'দশরথের ডাঅর' ,রথযাত্রায় তিনদিনের 'রথের ডাঅর', 'অম্বুবাচীর ডাঅর' ইত্যাদি । এখনকার বৌ ঝিরা এসব লোকসাংস্কৃতিক বিষয় জানে কী ? না জানারই কথা ৷ কারণ এখন বর্ষাকালের সেই মেজাজ এবং চরিত্র হারিয়ে যেতে বসেছে ৷ এখন আর সেই 'ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিন' আর দেখাই যায়না ৷ সেতার বা সরোদবাদকের নিমগ্ন দীর্ঘবাদনের মতো লাগাতর বর্ষণ তো বিলোপের পথে ৷ জলে ভেজা শরীরে লেপ্টে থাকা ততোধিক ভেজা কাপড় নিয়ে পুকুরঘাট থেকে উঠে আসা তরুণীর মতো মনে হত চারধারের গাছগাছালিকে ৷ মনে হত পবিত্র অবগাহনের শেষে প্রকৃতির বন্দনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সমস্ত চরাচর ৷
      সেসময়ে লাগাতর বর্ষা হলে ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে  সকল পরিবারে অন্নাভাব দেখা দিত ৷ মাঠেঘাটে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষিশ্রমিকের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হত ৷ গৃহস্থের গোলায় ধান থাকলেও 'কোথা হা হন্ত'! একদিন দুদিনের বেশি তৈরি চাল ঘরে থাকতনা ৷ কারণ তখনকার সময়ে চালকল ছিলনা ৷ কাজেই মিলে ভাঙানো চালের প্রশ্নই ওঠেনা ৷ প্রায় গৃহস্থবাড়িতে ছিল ঢেঁকির প্রচলন ৷ 'বুদ্ধির ঢেঁকি' বলে প্রবাদে রসিকতা করা হলেও গৃহস্থের ধানভানার মুশকিল আসান ছিল এই ঢেঁকি ৷ 'ধান ভানো রে ভানো রে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া' গাইতে গাইতে তরুণী বৌ-ঝিরা ওক্তের চাল ওক্তে তৈরি করে নিত আর দশটা কাজের ফাঁকে ৷ ঢেঁকিতে চাল কুটার আগে ধান ভেজানো, ধান সেদ্ধ করা, রৌদ্রে শুকানো ইত্যাদি অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ঢেঁকির পর্যায়ে আসত ৷ দীর্ঘবর্ষা হলে এইসব ধারাবাহিক পর্যায়ে ছন্দপতন ঘটত ৷ ফলে বর্ধিষ্ণু কৃষকের ঘরেও অন্ন থেকেও নেই অবস্থা হত ৷ পটু গৃহিনী আবার আবার গ্রামীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্নপূর্ণার দায়িত্ব পালন করতেন ৷ কষ্ট করে পরিবারের সবার মুখে অন্ন তুলে দিতেন ৷ জলে ভিজিয়ে সেদ্ধকরা ধান রৌদ্রে দেওয়া যাচ্ছেনা লাগাতর বৃষ্টির জন্যে ৷ গিন্নি বসে গেলেন ঢেঁকির পাশে করে স্থায়ী মাটির উনুনে আগুন দিয়ে কড়াই বসিয়ে ৷ উনুনে আঁচে কড়াইতে ধান গরম করে জল শুকিয়ে নিয়ে ঢেঁকিতে ফেলে কুটে নিচ্ছেন ৷ তাঁর পরিশ্রমের অন্নে পরিবারের দশজনের উদরপূর্তি ঘটছে ৷ শুধু তাই নয় ৷ এই পদ্ধতিতে ধার-উধার, সাহায্য-সহায়তার মাধ্যমে প্রতিবেশীর মুখেও হাসি ফুটতে দেখা গেছে বর্ষণসিক্ত বনবাদাড়ের নাম জানা-অজানা ফুলগুলোর মতো ৷ অভাবের মধ্যেও বর্ষাদেবী দুখিমানুষদের কেমন সম্প্রীতির বাঁধনে ও মমতায় পরস্পরকে কাছে টানত ৷
আজ বর্ষার সেই অপরূপ রূপমাধুরীও নেই ৷ সেই কান্নাঝরা মায়া কিংবা করুণাও নেই ৷ প্রকৃতির নির্মম রোষে আজ সব হারিয়ে যাচ্ছে ৷ ইট-কাঠ-পাথরের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির কোমল সুষমা ৷ প্রকৃতি যেমন কোমল মাধুর্য হারিয়ে বিধ্বংসী হয়ে উঠছে তেমনি প্রকৃতির সন্তান মানুষের অন্তরও হয়ে উঠছে নির্মম ও নিষ্ঠুর ৷ প্রকৃতিকে হারিয়ে আমরাও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠছি ক্রমশ ৷ এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব ৷

Thursday, June 13, 2019

জী ব ন জ ল

মহলে জল নেই কিংবা জলনির্মিত মহলও নয়
তবুও এ নির্জনমহল নীরমহল,জলপ্রাসাদ ৷

মাণিক্যরাজ বুঝেছেন  জলের অবদান
জীবন জাগিয়ে রাখার জলপিরিত আর জলার্ত যাত্রা

তাই অনিদ্র জলের ঢেউ মহলের গায় চাঁটি মেরে গায় জীবনের ভাওয়াইয়া