Monday, October 23, 2023

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা'  অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জীবন ও নদী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । জীবনের সঙ্গে নদীর তুলনা, নদী জীবনের উপমা একটি সাধারন আলংকারিক বিষয় । কাব্যেও নদী ও জীবনকে পাশাপাশি চলতে লক্ষ্য করা যায় । নদীর যেমন রয়েছে নাব্যতা তেমনি জীবনের রয়েছে চলিষ্ণুতা । নদীর গতির পক্ষে চলে যে জলযান সে শুধু ভাটির দেশ আর মোহনার গতিপথ চেনে । গন্তব্য তার নির্ধারিত । সে জলযান উজান চেনেনা । পার্বত্য জলঘূর্ণি তার অজানা । সংঘাত সংকুল নদীর বিপরীতের চলনলড়াইয়ের  অভিজ্ঞতা তার থাকে না । জীবন ও তেমনি অভিজ্ঞতাময় ।

"আমার দাদু বলতেন নদীর পাড়ে এই শীতে 
কচ্ছপের মতো হয়ে যারা পড়ে আছে
 তারা একেক জন আহত সৈনিক
 অনেক ঝড় জলে ডোবা ভাষার দুঃসাহসের উপকথা 
তারা জানে
 তাদের কাছে এখনো মানুষের প্রথমদিনের
তরঙ্গলিপির মগ্ন চিরকুট রয়েছে 
তারাই প্রথম কলসি-কাঁখে মেয়েদের গান শুনেছিল 
বৌ-ঝিদের নাইয়র নিয়ে তারাই গিয়েছিল 
বিল পেরিয়ে দূর কোনো গ্রামে
 আকাশের দুরন্ত মেঘ তারাই প্রথম বশ
 মানিয়ে তাদের মাস্তুলে বেঁধেছিল
 ওই যে শঙ্খচিল তাদের ইঙ্গিতেই ঘুরপাক খায় 
আর জলের উপর শুকনো মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়ায়" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

 গড়পড়টা জীবনের মত একঘেয়ে গতিতে চললে জীবনের বৈচিত্র্য আসে না । জন্ম, বেড়ে ওঠা, আহার, নিদ্রা, মৈথুন আর মৃত্যুর গৎ বাঁধা নিয়মেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । জীবনের দুঃসহ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের অভিজ্ঞতায় বাঁচতে চাইলে চলমান প্রবাহের বিপরীতে পা বাড়াতে হবে । সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বিপরীত অভিযাত্রায় গড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবনকে । চেতনার ভেতর জাগিয়ে তুলতে হবে সেই বোধব্রহ্ম । কবির কবিতার শরীরের চিত্রকল্পে আসবে সে অনুষঙ্গ । উপমায় আসবে তেমনি সুদৃঢ় বেস্টনী ।

বিপরীত বহমানতার জন্যে, হাওয়ার পক্ষে চলার জন্যে, সংক্ষুব্ধ স্রোতের প্রতিকূলে চলার জন্য নৌকার থাকে শক্ত খুঁটি । তার নাম মাস্তুল । সেই মাস্তুলে পাল খাটানো হয়ে থাকে স্রোতের অনুকূলে বা প্রতিকূলে হাওয়া প্রবাহিত হলে মাস্তুলে বাঁধা পাল হাওয়ার চাপে নৌকাকে  নির্ধারিত পথেই তরতরিয়ে নিয়ে যায় । অনুকূলের পথ তো ভবিতব্য । তার মধ্যে কোন বৈচিত্র থাকে না । আর স্রোতের বিপরীতে যখন নৌযান চালানো হয় তখন বিপরীতমুখী স্রোতের বেগের সঙ্গে বিপরীত হাওয়া থাকলে মাস্তুলে বাঁধা পাল নৌকার সংঘাতশক্তিকে অনেকটা সহায়তা করে । নৌকাকে বিপরীত প্রবাহমানতার সংঘাতশক্তি যোগায় প্রকৃতিনির্ভর বায়ু প্রবাহ । অনুকূল হলে পালের শক্তি প্রকাশ পায়। মানব যাপনের সংঘাতেও সংহতির চেতনার দ্যোতক হল গতিমান বায়ুপ্রবাহ । বায়ুপ্রবাহ নৌযানের যে কাজটি করে মানবের সংহতিচেতনাও তেমনি গতানুগতিকতার বিপরীতে প্রতিবাদমুখর করে নদীর বুকে পালখাটা নৌকা আর প্রবহমান জীবনের বুকে মানুষের সংহতিচেতনা সমস্ত অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় । সে জায়গায় কবি যখন তাঁর কবিতার বা কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম দেন 'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' তখনই থমকে যেতে হয় পাঠককে ।

''আকাশের ওই সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে
 আমি চেয়েছিলাম গোলুইয়ের ঢেউয়ের শব্দ শুনি
 ঢেউগুলো নৌকার তলপেট ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে 
আর নৌকা সেই ঢেউ ভেঙে ভেঙে
 ঢেউয়ের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে 
কাঞ্চন মালার দেশে পাড়ি জমাচ্ছে" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

যে কাজ করবে মাস্তুলের মাথায় বাঁধা পতাকার মতো পাল সে জায়গায় নিশ্চিন্ত পালের বদলে মেঘকে বেঁধে দিলে কি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে ? কাব্যনাম কেমন যেন এক বিরোধাভাসের সৃষ্টি করে এখানে । মেঘ তো পালের মতো দৃঢ় দৃশ্যমান নয় । এক ধোঁয়াশার উপর তার কাল্পনিক উপস্থিতি তাছাড়া মেঘকে বেঁধে রাখা যায় না । তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও নিশ্চিন্ত নয় । কবি নিজেও তার এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই এই অনিশ্চয়তার কথা পরপর দুবার উল্লেখ করেছেন—
ক) কেন জানি কাল রাতে 
      একটিও মেঘ আসেনি । এবং
খ) সারারাত জেগে ছিল সে 
    তবু একটি ও মেঘ নামেনি । ( মেঘ শিকার ) ।
আবার কবি বলছেন–
 "আমার পূর্বপুরুষের বিয়ে হয়েছিল কোন এক নদীর সাথে 
সেই নদীর সন্তানেরাই মাস্তুলে মেঘের পতাকা উড়িয়েছিল 
তারাই দূর দ্বীপের ঘাটে ঋতুমতী মেয়েদের 
আয়ত চোখের কোলে প্রেমের কাজল এঁকেছিল
 নদীর জলে তাদের গান আজও 
মনসার করণ্ডি মতো ভাসে 
নদীর ভিজে বাতাস এখনও তাদের
 গায়ের ঘাম মুছিয়ে দেয়"

কবি দিলীপ দাসের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে "মাস্তুলে মেঘের পতাকা"র অভ্যন্তরবাসী চব্বিশটি কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে এই অনিশ্চয়তার চেতনা দ্বন্দ্বমুখর হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে । অনিশ্চিত জীবনকে বয়ে বয়ে কবির চেতনায় জন্ম নিয়েছে অতৃপ্তির অসহায়তা—
"আমি শ্যাওলার জীবন চাইনি কখনো
 ঝড়ের মুখে হাল ভাঙা নৌকা হলে
 অনুতাপ হতো না কোন পাথরে ছোবল মেরে 
বিচূর্ণ হবার সাধ সারা জীবন অপূর্ণ রয়ে গেল—"( ভুল করে বড়ো আগে চলে এসেছি ) । 
তিনি লক্ষ্য করেছেন–
 "সৃজন ও ধ্বংসের সময়টুকু উন্মাদ
 নদীর মতো । আর তালডোঙার মধ্যবর্তী ছায়ার
নির্জীব কাল শুধু হিজড়ের জীবনযাপন
 শুধু পত্রহীন ডালে বসে কামার্ত কূজন" ( ওই ) ।

কবির মানসদ্বন্দ্বের বীজ নিহিত রয়েছে পূর্বপুরুষের চিরকালীন নদীসংসার ছেড়ে, ভদ্রাসন ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দেওয়া জীবনের যন্ত্রণায়, দেশভাগের যন্ত্রণায় । দেশভাগ, বঙ্গবিভাজন বহু মানুষের জীবনকে উথাল-পাতাল করে দিয়েছে । উৎখাত করে দিয়েছে চিরায়ত শেকড় থেকে । এই বেদনা তিনি জানান আরেক বিখ্যাত জীবনকে, অগ্রজ কবি অনিল সরকারকে—
বিক্ষুব্ধ বেদনায় তার বুক 
ভাঙা নৌকার মতো উপুড়
 হয়ে আছে । হৃদয় ভরে আছে দ্রব
 অভিমানে । তবু এই অভিমানের গভীরে
 এক টলটলে জলের পুকুর 
নিজের দুঃখের দরজায় কড়া নাড়ে
 অমাবস্যার ভোর— ( অমাবস্যার ভোর )  ।
দেশভাগ নিয়ে কবির অনুভব–
" তুমি আমায় দিয়েছ
 শ্যাওলার ভাসমান জল 
উদ্বাস্তু জীবন 
আর প্রত্যহের শেকড়হীনতার 
জীর্ণ রামধনু ।
তুমি দিয়েছ এক খঞ্জ পিঞ্জরের
 আকাশ ঝরোকা 
কাঁটাতারে ঝরে যাওয়া দ্বিখন্ড দুপুর ( স্বাধীনতা–৫০ ) ।
দেশভাগের পরিস্থিতিতে কবি সংক্ষুব্ধ । ক্ষোভ ও অভিমানে কবি এই পরিণতিকে ইঙ্গিত করে বলেন—
" তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই
 তুই নিয়েছিস তুই 

তুই নিয়েছিস কলমি দাম বিলের পানকৌড়ি 
শুশুকভাসা বিকেল আর ভাটিয়ালি সারী 

তুই নিয়েছিস মেঘনা তিতাস দত্তখলার চর 
সহজ সুখ সহজ জীবন গান শালিখের ঘর 

তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই ( তুই নিয়েছিস ) ।
ভিটেছাড়া, ছন্নছাড়া কবি অনেক প্রত্যাশা নিয়েএক নতুন স্বাধীন দেশে এসে প্রতারিতই হয়েছেন শুধু । যে স্বপ্ন জন্মেছিল স্বাধীন দেশকে নিয়ে তাঁর বুকের ভেতর, সেটা তাঁর কাছে ' মনে হয় এ শুধু কথার খেলাপ' । যে—
 "কথা ছিল ল্যাম্পপোস্টগুলো হবে হাওলার ফাঁসির খুঁটি 
গডম্যানরা সব যাবে জেলখানায় 
ইঁদুরের গর্তে আর জমবে না বেনামী ফসল 
কথা ছিল সব চাষা ভুমি পাবে সব জেলে জাল
 মজুরের হাতে রবে কারখানার রশি
 ভিখারি উধাও হবে রাজপথ থেকে,
 কোনদিন আসবেনা গেস্টাপোর সকাল
 মসজিদের আযান হবে মন্দিরের ঝকঝকে চূড়ো" (প্রতারণার পঞ্চাশ বছর ) । "সব কথা আজ নেড়ি কুকুরের মত রাস্তায় গড়ায়" । আর স্বাধীনোত্তর দেশে–
"বিখ্যাত খুনিদের জন্য সবাই জানে
 ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় না । এ অহিংসার দেশে তাদের জন্য রাজকীয় উপঢৌকন— অশোক চক্রের মেহগনি চেয়ার —
 তাদের জন্য বাতাসে উড়ে নিলামবালা ছ'আনা ভোটের টিকিট 
পত্রিকার পাতায় উছলে উঠে কামাতুর উচ্ছ্বাস
 স্বাধীনতা দিবসে তাদের জন্যই মখমল তাকিয়া" ( খুনীর হাত ) ।

দেশজুড়ে ধান্দাবাজ সুযোগসন্ধানীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে দখল নিতে চায় সমস্ত সম্পদের । এরা শামুকের মতো ।
"শামুকেরা সব খায় 
আইনস্টাইনের মজ্জা খায় 
ইতিহাসের পাতা খায়,
 মানুষের উত্থান খায়, মেধার উজ্জ্বল খায় 
রঁদার ভাস্কর্যে কাদামাখা হাত বাড়ায়
 ব্রেখটের বই পোড়ায় 

শামুকেরা যেদিকে যায় পেছনে পুরাণ-শাণিত দাঁতের অন্ধ চিহ্ন 
ঘাসের পোড়া বুকে একে যায় ( শামুক ) ।
আর এদের হাতে নিহত হয় আমাদের অন্নদাতা, সভ্যতার সঞ্চালক কৃষকেরা ।
 "পাঁচ হাজার বছর ধরে আমাদের অন্নের রক্ষক
 যাদের রক্তের ফোঁটায় ভরে ওঠে শস্যের গোলা 
নিখিল মানব শিশু যার স্নেহের কাঙাল
 তাকে কাল খুন করা হয়েছে—

সসাগরা পৃথিবীর মুখে যিনি ভাত তুলে দেন 
সেই অন্নের রক্ষক 
হাজার আলোয় উদ্ভাসিত এ দেশের এক করুণ অন্ধকারে 
কাল একগাছা দড়িতে নিজেকেই খুন করেছেন" ( অন্নের রক্ষক ) । জীবনানন্দীয় শব্দবন্ধে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেন কবি এই অসহায়তায় । 
এখন শুধু ক্ষমতাধর এর দাপাদাপি বীরভোগ্যা বসুন্ধরার মত ক্ষমতার কাছাকাছি যারা পৌঁছতে পারে তারাই জীবনের সব সুখ এবং সম্পদের অধিকারী । আজ 'ক্ষমতার প্রকাশ আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে' । কবির দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অন্তরাত্মা তাই আওয়াজ তোলেন—
"বৎস শোনো, ক্ষমতা মানুষের শুভ্র হৃদয়ে 
দুরারোগ্য ক্ষতির মতো । ক্ষমতা
 সেই দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম 
যার কাছে কোন নিরীহ মনুষ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারে না । কিন্তু এই 
ঘামের কাছে লেপ্টে থাকে উন্নাসিক,
 ক্ষমতা এবং অ-ক্ষমতার মাঝে নির্জীব থাকে অতি সাধারণ,
 আর ক্ষমতাহীন কিন্তু ক্ষমতার লুব্ধরা হয় রাজনীতিক । 
ক্ষমতা অর্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী 
কিন্তু ক্ষমতা লিপ্সু অর্থ-দাস ( ক্ষমতা বিষয়ে দু চার পংক্তি ) । এই যে ক্ষমতার লোভ ও তার পরিণতিতে অস্ত্রের ঝংকার ও নিরীহ মানুষের নির্যাতন অসহায়তা শুধু এদেশেই নয় সারা পৃথিবী জুড়েই এই অবস্থা চলছে । ক্ষমতার কারণে যুদ্ধ ও সংঘাত এবং তার ফলশ্রুতিতে নিরীহ মানুষের বাস্তুচ্যুত পরিযায়ণ, উদ্বাস্ত জীবন কবি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন । উদ্বাস্তুযন্ত্রণা সে কারণেই তাঁর অন্তরের অনুভূতি। এই অনিশ্চিত জীবন সম্বন্ধে তাঁর সংক্ষোভবিধুর আর্তি । সে কারণেই কখনো নির্ভরতার পাল হয়ে যায় ধোঁয়াশাময় মেঘের মতন । নিশ্চয়তা থেকে অনিশ্চিত জীবনের পটপরিবর্তনের সংশয়াকুল যাত্রা । সে কারণেই অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন পেরিয়ে নিশ্চিন্তে অবস্থানের আর্তি—
আমি আর কোথাও যাবো না ।
বনের আলু খেয়ে যারা এখানে বাঁচে
 তারা তো আমাকে যেতে বলে না 
ব্যাধের ভয়ে আমি কেন পালাবো ?

আমি এখানেই থাকবো ।
এই টিলা-লুঙ্গা-ছড়ার কিনারে 
বয়ে যাওয়া ছোট নদীটির মত তিরতির
 যদি পারি খরার দিনগুলোতে 
এক অঞ্জলি তৃষ্ণার জল দিয়ে যাবো—
 সেইসব ভূমিপুত্রদের বলে দাও 
সেইসব ব্যাধ আর খোঁয়াড় ব্যবসায়ীদের বলে দাও 
আমি এখানেই থাকবো—
 এই ছড়া–এই টিলা–এই লুঙ্গা–এই বাঁশবন 
আমায় যতদিন না ছাড়ে 

যারা যেতে চায় তারা চলে যাক ।
আমি আর কোথাও যাবো না ( উদ্বাস্তু সংলাপ ) ।

নতুন দেশে নতুন জীবনকে অতি আপনার করে নিতে চান কবি ।তার পরেও অতিবাহিত জীবনের মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকের মত হাজির হয় অতীত জীবনের কথা । অতীত ভূখণ্ডের কথা । যে ভূমিতে কবি বেড়ে উঠেছেন । কবির আলোকদর্শন ঘটেছে সেই বাংলাদেশের কথা ।
 "দরগারঘাট পেরোলেই মাশাউড়ার মঠ
 আদিগন্ত জলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্ন স্বদেশ
 তার পাশে দূরদর্শী এক তালগাছ
 সারাদিন নিজের ছায়ায় 
খুঁজে মরে স্মৃতির অতল প্রদেশ ।

 এইখানে একদিন বিলের চিকন রোদে
 পুটি মাছের পাখনা ঝিকমিক রুপো ছড়াত
 তখনও চালের কেজি কুড়ি টাকা নয়
 জীবন শাঁসহীন শামুকের 
খোলের মতো তখন ভাসমান ছিল না
 তখনও শুয়োরের বুনো চিতকার এমন উৎকট ছিল না, যুবতী রোদ্দুর গিলে খায়নি রাতের শামুক 

সেই সব অপাংশু দিনের কথা
 আমি যখন বলি আমার তরুণ বন্ধুরা, যাদের বয়স খুব বেশি নয় 
চোখে নিষ্পৃহ উদাসীন রেখে 
আমাকে দ্যাখে 
যেন নস্টালজিক এক বুড়ো বটগাছ । এমনতো 
ছিল না আমার জন্মভূমি ? 'উদ্ভট উটের পিঠে' কোথায় চলেছ তুমি ?" ( বাংলাদেশ- ৯৫ ) ।
 অতীতের স্মৃতিভরা প্রিয় দেশের অস্থিরতায় তিনি চঞ্চল হয়ে ওঠেন । প্রশ্ন তোলেন —"
একটা যুদ্ধ যদি তিরিশ লাখ মানুষের
 রক্ত ও শেষ না হয় তাহলে আরো 
কত লাখ মানুষের রক্ত চাই 
বলতে পারেন শামসুর ভাই ?" ( ঐ ) ।

আসলে জীবনের পরতে পরতে ঘাত প্রতিঘাত সংঘাত পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কারণে কবির বোধের ভেতর গভীর আলোড়ন তোলে । আর সে আলোড়ন থেকেই সৃষ্টি হয় মননদ্বন্দ্বের । দ্বান্দ্বিক জীবনে তাই দৃঢ় সংহত পাল হয়ে যায় পলকা, অস্থায়ী আর অস্পষ্ট মেঘের প্রতীকে । এই অস্পষ্টতার মধ্যেও কবির মনে আশার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়—
"আকাশে যারা সাদা পাল তুলেছে 
আমি তাদের কথা আর কতটুকু জানি
 আমি এক নদীহীন মানুষ—
 পরম্পরাহীন এক অপটু নাবিক 
তবুও আমি চেয়েছিলাম 
আকাশের সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে 
গলিয়ে ঢেউয়ের শব্দ শুনি— ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) । এই ঢেউয়ের শব্দ আসলে জীবনের শব্দ । জীবনের বৃন্দগান । মাস্তুলের মেঘ সেই সঙ্গীতকেই বয়ে নিয়ে যাবে বলে কবি বিশ্বাস করেন ।

Friday, October 20, 2023

স্বীকার্য

স্বীকার্য

উত্তরের কথা যদি বলো তুমি আমি যাবো দক্ষিণে  
জল যদি সামান্য গড়ায় আমি বসতে পারি না 
জল যদি উঠোনে গড়ায় আমি দাঁড়াতে পারি না
জল যদি পথে গড়ায় পারি না আমি এগোতে
আর জল যদি ভূখন্ড ভাসায় আর 
হৃদয়ে যদি নতুন বাঁক আনে গড়ানো জল
তখন কোথায় যাবো, বলো ফুলসই? 

উত্তরের কথা বলো যদি তুমি আমি যাবো রাই দক্ষিণে ৷

Monday, October 16, 2023

বামুটিয়া প্রসঙ্গে

হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

সমতট এবং নবোন্মেষ সাহিত্যপত্রিকার শারদসংখ্যার আবরণ উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা, কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গতকাল গিয়েছিলাম বামুটিয়ার জঙ্গলমহল পাতার বাজারে । আসন্ন শারদোৎসব উপলক্ষে নির্মিত দুর্গামন্ডপে আয়োজন করা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানের । শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা এক নিভৃত আরণ্যক ভূমিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম । চারিদিকে সবুজে ঘেরা এক নিঃশব্দ নিধুবন এই জায়গাটি । মনে হয় যেন বৈষ্ণবীয় বনবিহারের এক উপযুক্ত স্থল । এই পরিবেশে গিয়ে উপস্থিত হলে নিমেষে মন এবং প্রাণ উদাস হয়ে ওঠে । আবছা অন্ধকার উপরে ছায়া ঘেরা আকাশ একেবারে তাপদগ্ধ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির, অভিভূত হওয়ার মতো স্থল এটি ।

রাজন্য ত্রিপুরার প্রাচীন জনপদ এই বামুটিয়া । এই জনপদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লোহর নদী অনেক ঘটনার সাক্ষী । বড়মুড়া পাহাড় থেকে নেমে এসে এই নদী বয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিতাসের বুকে মিলনের জন্য । যে তিতাসকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে গেছেন তিতাসপাড়েরই গোকর্ণঘাটের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম'র মাধ্যমে । এই নদীর একদিন ভরা যৌবন ছিল । ছিল তার নাব্যতা । নদী বেয়ে আসত পালতোলা নৌকা কিংবা বড়ো গহনা নৌকা । ছোটখাটো নৌবন্দরের মত এই নদীঘাট সব সময় কর্মব্যস্ত থাকত । পণ্য উঠানামা চলত । মুটে-মজুর ও পরিশ্রমী মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিল এই ভূখণ্ড । বামুটিয়া নামের সঙ্গে যে মিথ জড়িত তার সঙ্গে এই পরিশ্রমী মানুষদের নাম জড়িয়ে আছে । মুটেদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'মুইট্যা' । কথিত আছে ত্রিপুরার জনৈক রাজা এখানকার মানুষজনের পেশার কথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠেছিলেন 'বাহ ! মুইট্যা' । তাদের পেশাকে সোল্লাসে সম্মান জানিয়ে ছিলেন তিনি । তাদের অবস্থানের জন্য জনবসতি গড়ে দেন রাজা । শোনা যায় সেই থেকে এই মুইট্যাদের জনপদ বামুইট্যা বা বামুটিয়া নামে পরিচিত । বলাবাহুল্য এই বামুটিয়াতে মণিপুরিদেরও প্রাচীন জনবসতি রয়েছে  ।

রাজন্য আমলে ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারি ছিল চাকলা রোশনাবাদ পরগনা । শ্রীহট্টের দক্ষিণাঞ্চল থেকে শুরু করে নোয়াখালির ফেনী তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছিল এই চাকলা রোশনাবাদের বিস্তৃতি । চাকলা রোশনাবাদের ছিল অনেকগুলি পরগনা । আজকের বামুটিয়াও ছিল সেরকম একটি পরগনা । দেশভাগের ফলে ভারত ভূখণ্ডে পড়েছে এই বামুটিয়া পরগনার বৃহৎ অংশ । এই পরগনার কিছু অংশ বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত ।  চাকলা রোশনাবাদের এই সমভূমি অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল কখনো এটি কমলাঙ্ক,  কখনো হরিকেল, কখনো বা সমতট । এ কারণেই পুরনো ইতিহাসকে স্মরণ করার লক্ষ্যেই আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক একটি সাহিত্যপত্রের নাম 'সমতট' । 

এমন ইতিহাস বিজড়িত প্রাচীন জনপদের আজকের আয়োজিত স্থানটিতে এক সময় ছিল রাজ্যের বিখ্যাত বিড়িপাতার বাজার । এই বিড়িপাতাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'কুম্ভিরা' বা 'কুমিরা' পাতা । ত্রিপুরার অরণ্যে এক সময় এই পাতা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত । রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের বাজার থেকে এই বিড়ির পাতা সংগ্রহ করে বামুটিয়ার এই পাতার বাজারে মজুদ করা হত ভাটির দেশে রপ্তানির জন্য । এছাড়া বাঁশ ছন ইত্যাদি বনজ সম্পদ ও তিল, কার্পাস, সরিষা, ধান ইত্যাদি কৃষিজ সম্পদও নদীপথে পরিবহন করা হত । হান্টারের সার্ভে রিপোর্টেও সেসময়ের চাকলা রোশনাবাদের বাজারের তালিকায় বামুটিয়া বাজারেরও উল্লেখ রয়েছে । একসময় বনদপ্তরের কড়াকড়িতে ও ক্রমাগত বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এই বিড়ির পাতা ও তাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় গরিব মানুষের জীবিকাটি হারিয়ে যায় । এখান থেকে লৌহর নদী বেয়ে এই পাতা চলে যেত ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও দেশের নানা প্রান্তে । আজ সেসব ইতিহাস ।

ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে গতকাল আয়োজন করা হয়েছিল দীর্ঘদিন মনে রাখার মত সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠান । রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে দুই পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার এবং ডাক্তার খোকন রায়ের আন্তরিক আমন্ত্রণে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন এখানে । রাজ্যের অন্যতম বলিষ্ঠ কবি নকুল রায়ের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানমঞ্চে ছিলেন পশ্চিম জেলাধিপতি ও সুকবি হরিদুলাল আচার্য । ছিলেন অধ্যাপক ড. নির্মল ভদ্র, ড. সৌভিক বাগচী, কবি সঙ্গীতা দেওয়ানজি, স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ড. উত্তম সাহাসহ আরো অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব । প্রত্যেক বক্তা তাঁদের আলোচনাতেই সাহিত্য-সমকাল-সৃজনচর্চা বিষয়ে মনোজ্ঞ অনুভব ব্যক্ত করেছেন । আকস্মিক আহুত হয়ে দর্শক আসন থেকে উঠে গিয়ে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমিও সামান্য কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম এদিন । আমাকে মঞ্চে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন রাজ্যের এই প্রজন্মের একজন সুঅভিনেতা, বাচিকশিল্পী এবং প্রাণচঞ্চল সংস্কৃতিপ্রেমী শিশির অধিকারী Sisir Adhikari  ও এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নবোন্মেষ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার Gouranga Sarkar  । আপ্যায়ণ, আলোচনা, নাচ, গান, কবিতাপাঠ, ভালো খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে একটা প্রাণের ছোঁয়া ছিল গোটা অনুষ্ঠানটাকে ঘিরে ।

Sunday, October 8, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীভাবনা ও দুর্গাপূজার প্রাচীনতা : লোকপুরাণ ও প্রামাণ্য তথ্য

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীভাবনা ও দুর্গাপূজার প্রাচীনতা  :  লোকপুরাণ ও প্রামাণ্য তথ্য

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক  ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে  অম্ভৃণি ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । এমনকি ত্রিপুরার রাজাগণ একসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগেও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন । খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজা ছেংথুমফা বা নামান্তরে কীর্তিধর মেহেরকুল ( প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটিকারা রাজ্য ) জয় করেছিলেন । তিনি ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী কোনো এক রাজাকে পরাজিত করে মেঘনানদ পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন । মহারাজা বিজয়মানিক্য বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তী  সমগ্র সুহ্মদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল ও বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমসাময়িক বাংলায় যে ধর্মধারার প্রচলন ছিল তার প্রভাব ত্রিপুরার উপরও পড়ে । প্রাচীন বাংলাদেশের মানচিত্রে ত্রিপুরা কখনও বঙ্গ, কখনও সমতট, কখনও হরিকেল প্রভৃতি নামের ভূখন্ডের সঙ্গে মিশে ছিল । ফলে এই বিস্তীর্ণ প্রাচীন অঞ্চলের সঙ্গে ত্রিপুরার নিবিড় যোগাযোগ ছিল । মানুষজনের আসা-যাওয়া ছিল । রাজসভাসদদের মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষেরই প্রাধান্য ছিল । তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে ত্রিপুরার সেই সময়ের শাসকবৃন্দ ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীপূজার প্রচলন করেন ।

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস অনুধাবন করলে জানা যায় যে, ডাঙ্গরফার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নফা গৌড়ের নবাবের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করেন । কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি গৌড়ের নবাবকে  একশ হাতিসহ একটি মণি উপহার দেন । গৌড়েশ্বর তাঁকে মানিক্য উপাধি প্রদান করেন । সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা মানিক্য উপাধি ব্যবহার শুরু করেন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে রত্নমানিক্য ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা সিংহাসন দখল করলেও আগরতলার মিউজিয়ামের রক্ষিত রত্নমানিক্যের যে মুদ্রা দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের ও অন্যটি ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী রত্নমানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয় । কারণ, পরবর্তীকালে রাজা মুকুট মানিক্যের ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া যায় । রত্নমানিক্যই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার অন্যান্য রাজারাও মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । এইসব মুদ্রা ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি । ভাষা সংস্কৃত হলেও হরফ ছিল বাংলা । ব্যবহৃত অব্দ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শকাব্দ ও পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরাব্দ । এই মুদ্রাগুলিতে পুরুষদেবতার সঙ্গে স্ত্রীদেবতার প্রতীকও অঙ্কিত থাকত । শিবদুর্গা, হরপার্বতী, লক্ষীনারায়ন ইত্যাদি দেবদেবী ও প্রতীক হিসাবে দেবীবাহন সিংহ, ত্রিশূলও মুদ্রাতে উৎকীর্ণ থাকত । 

দ্বিতীয় রত্নমানিক্যের ( ১৬৮৫–১৭৭২ ) কীর্তি হলো প্রাচীন কৈলাগড় বা কসবা দুর্গে মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা, ভগবতীর মূর্তি স্থাপন । এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিকগণের মতে কল্যাণ মানিক্য কসবায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন রত্নমানিক্য । এই সম্পর্কে প্রাচীন রাজমালায় আছে—

" কসবাতে কালী মূর্তি করিল স্থাপন
 দশভূজা ভগবতীর পতিত তারণ ।"

 দশভুজা দেবীমূর্তি হলেও এটি সাধারণ্যে জয়কালী মন্দির বা কসবা কালীবাড়ি নামে পরিচিত । ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এই মূর্তিটির ব্যতিক্রমী রূপ বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । এই রত্নমানিক্য বারানসী থেকে মূর্তি এনে কুমিল্লায় রাজরাজেশ্বরী বিগ্রহকে স্থাপন করেন । এই প্রসঙ্গে ত্রিপুর বংশাবলিতে আছে—

"মহারাজ রত্ন মানিক্য বাহাদুর 
কাশীধাম হইতে কালী আনিল সত্ত্বর
 সেই কালি কুমিল্লা নগরের স্থাপিল
 রাজরাজেশ্বরী বলি নামকরণ দিল ।"

ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মানিক্যের কীর্তি ত্রিপুরার আরেকটি মন্দির উদয়পুরের মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির । এটি ৫১ পীঠের একপীঠ বলা হয় । এখানে দেবীর দক্ষিণপদ পড়েছিল । পীঠমালা তন্ত্রে উল্লেখ আছে–

ত্রিপুরায়াং দক্ষিণপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বভিষ্ট ফলপ্রদঃ ।

কথিত আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া অমরপুরে অমরসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে মঙ্গলচন্ডীর মন্দির । অমরপুরের গভীর অরণ্যে গোমতী নদীর তীরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা দেবীমূর্তি রয়েছে । স্থানটিকে ছবিমুড়া বলা হয় । পিলাকের প্রত্নক্ষেত্রেও দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে । আগরতলা শহরে রয়েছে লক্ষীনারায়ণ মন্দির । দিঘির পূর্ব পাড়ে উমামহেশ্বর মন্দির অবস্থিত । ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মহকুমা সদরে কিম্বা মহকুমার মধ্যে বহু দেবীমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । তার মধ্যে সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়াকালী বাড়ি, মুহুরীপুরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, কমলপুরে কমলেশ্বরী, কুমারঘাটে ভুবনেশ্বরী মন্দির, ধর্মনগরের কালিবাড়ি বিখ্যাত । একদিকে বাংলার শক্তিপীঠসমূহ অন্যদিকে আসামের শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দিরের প্রভাবে ত্রিপুরাও শক্তি আরাধনার একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সুবাদে ত্রিপুরা রাজ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে কালিকাপূজা ও দুর্গাপূজা প্রচলন রয়েছে । রাজন্য প্রতিষ্ঠিত দুর্গাবাড়ি ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায় প্রাণকেন্দ্রে  রয়েছে । এখানে নিয়মিত দেবীর পূজার্চনা হয় । এখানে দেবীবিগ্রহের হাত দশটি নয় । দুটি । এপ্রসঙ্গে একটি প্রচলিত মিথ রয়েছে । ত্রিপুরারাজের জনৈক মহারানি নাকি দেবীর দশহাত দেখে মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিলেন । তাই রাজাদেশে এখানে দেবীর দশহাতের পরিবর্তে দুহাতের প্রচলন করা হয় । 

ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন প্রামাণ্য তথ্য এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব । 

রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৪ ) ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি ১৬৩২ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( জুন-জুলাই ১৭১০ ) খ্রিস্টাব্দ রত্নমানিক্যের আমলে রত্নকন্দলি ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূতকে ত্রিপুরার রাজধানী রাঙামাটিতে ( বর্তমান উদয়পুর ) পাঠিয়েছিলেন । সেই ভ্রমণকাহিনির উপর ভিত্তি করে অহমিয়া ভাষায় লেখা হয়েছিল "ত্রিপুরা দেশের কথা" । এটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরচন্দ্র সেন । এই ভ্রমণ বিবরণীতে সেকালের ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে । এই বিবরণীটির সপ্তম অধ্যায়ে ত্রিপুরার দূতগণের দুর্গোৎসব দর্শনের বর্ণনা রয়েছে–

"ত্রিপুরার দুতগণের বিদায় দেওয়া হইয়া গেলে পর দুর্গোৎসবের কাল আসিল । তখন মহারাজা বড়বড়ুয়াকে দিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তাহারা সেখানের দুর্গাপূজা দেখিতে ইচ্ছা করে কিনা ।' এই কথা শুনিয়া ত্রিপুরার দূতগণ বলিলেন, 'বড়বড়ুয়া, নবাবের অনুগ্রহে যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করিতে পাই ; ঠাকুরানীর দর্শন করিতে পাই  তবে আমাদের পরম ভাগ্য বলিতে হইবে ।" এরপর মহারাজের আদেশে এই দূতদ্বয়কে অষ্টমীর দিন সূর্য, গণেশ, নারায়ণসহ দুর্গাপূজার জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেবী দুর্গাকে দর্শন করানো হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুপ্রাচীনকালেও ত্রিপুরারাজ্যে দেবীদুর্গা পূজার প্রচলন ছিল । এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীভাবনা ও দেবীপূজার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে স্থানাভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. শ্রী রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
২. ত্রিপুরা রাজমালা–পুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী
 ৪. ত্রিপুরার ইতিহাস–ডক্টর জগদীশ পণ চৌধুরী 
৫.ত্রিপুরার ইতিহাস–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. শতাব্দীর ত্রিপুরা–সম্পা.  নির্মল দাস     রামপ্রসাদ দত্ত
 ৭. ত্রিপুরার স্মৃতি–শ্রী সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন
 ৮. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৯. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

Monday, October 2, 2023

রমাপ্রসাদ গবেষণাগার

রমাপ্রসাদ গবেষণাগার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আটের দশকে আমি নিয়মিত যেতাম রমাপ্রসাদ গবেষণাগারে । পল্টুদার সঙ্গে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতাম তাঁর গবেষণাগার ঘেঁটে, বই পড়ে । আমি, পল্লব ভট্টাচার্য, হরিসূদন বসাক, পল্টুদা ক্যারাম খেলতাম সামনের খোলা জায়গাটায় । তিন আমাকে গবেষণাগারের সদস্যও করেছিলেন । যক্ষের মতো আগলে রাখতেন তাঁর ধন । কোনো কিছু জেরক্স করার দরকার হলে হাতছাড়া করতেন না । সঙ্গে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে পাঠিয়ে জেরক্সের পর আবার তাঁর হেফাজতে নিয়ে নিতেন । সেদিন যেসব দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্র দেখেছিলাম তিনি সুশৃঙ্খলভাবে ফাইলবন্দী করে রেখেছেন তার পুরোটাই গায়েব হয়ে গেছে । তাঁর নিজস্ব রচনাগুলোরও ফাইল ছিল দেখেছি । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট দিতে পারত সেদিন । এখন অনেক লুটেরাই ডক্টরেট হবে তাঁর সম্পদ গিলে ।