Wednesday, December 27, 2023

অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব : প্রাঙ্গিক কথা

"অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব  :  প্রাসঙ্গিক কথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

গত ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর তারিখ রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বিসর্জনখ্যাত  ও রাজন্যস্মৃতি বিজড়িত শহর উদয়পুরে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল "অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব" । প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে না পারলেও দ্বিতীয়দিন শুরু থেকে  শেষ পর্যন্ত ঠায় বসে থেকে সমগ্র অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি । ঐতিহ্য ও আধুনিকতার নকশিকাঁথা জড়ানো এই শহরে রাজ্য ও বহির্রাজ্য থেকে  স্বনামধন্য অতিথি কবি সাহিত্যিক যাঁরাই এসেছেন প্রত্যেককেই শুরু থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন উদ্যোক্তারা । দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়বেলায় ফিরে যাবার তাড়া দেখে কবি অশোক দেব মঞ্চে যখন অনুযোগ করছিলেন তখন বিদায়ী অতিথিরা প্রত্যেকেই দুহাত তুলে তাঁদের আতিথেয়তার প্রশংসা করে গেছেন ।  আর দ্বিতীয়দিনটিতে আমি উপস্থিত থেকে উপলব্ধি করেছি এই উচ্ছ্বাস সত্যিই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল । দ্বিতীয়দিন পুরোটা সময় ধাপে ধাপে কবিতাপাঠের আসর ছিল । ফাঁকে ফাঁকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । আলোচনায় উদয়পুরের প্রাচীন ইতিহাস, ভারতবর্ষের নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং কবিতায় স্বদেশভাবনা বিষয়ে মনোগ্রাহী আলোচনায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন যথাক্রমে বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিমান ধর, নাট্যব্যক্তিত্ব পার্থ মজুমদার এবং সন্তকবি মিলনকান্তি দত্ত । সেখানে আমি কবিতাপাঠসহ উত্তপূর্বের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও কার্বি ভাষার পাঁচজন কবিকে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও এই পর্যায়ের কবিতাপাঠে সামান্য সঞ্চালনার দায়িত্বও পালন করে কৃতার্থ হয়েছি । 

অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করার জন্যে কবি অশোক দেব, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, মনোজিৎ ধর, ভাস্করনন্দন সরকার ও খোকন সাহার স্নেহচ্ছায়ায় অনিরুদ্ধ সাহা, মৃদুল দেবরায়, খোকন সাহা প্রমুখদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তরুণ কবিদের পুরো ব্রিগেড বেশ কদিন আগে থেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে  কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়েছিলেন । তারুণ্য ছাড়া এতবড়ো কর্মযজ্ঞ সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে না । এই অনুষ্ঠানকেও তাঁরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন । 

উদ্যোগ সুশৃঙ্খল হলেও যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদেরও বোধ-বিবেচনার প্রয়োজন হয় শৃঙ্খলার গতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে । অপ্রিয় হলেও বলতেই হয়, সঞ্চালকদের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের পাত্তা না দিয়ে কবিদের একাংশের একটার জায়গায় একাধিক কবিতা পাঠ, একটি হলেও দীর্ঘ কবিতা পাঠ, অনর্থক গৌরচন্দ্রিকা দান, কবিতাপাঠের প্রারম্ভিক ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের গতিকে অনেকাংশে শ্লথ করে দিয়েছে । ফলে রাজধানীমুখী কবিদের একাংশের ঘরে ফেরার তাগাদাকে বাড়িয়ে তোলে । অবস্থা বেগতিক দেখে সময়মতো কবি অশোক দেব নিজে সঞ্চালনার দায়িত্ব নিজের হাতে না নিলে অনুষ্ঠান কখন শেষ হত বলা যায় না ।

 কবিরা একটু মগ্নতায় থাকেন, খ্যাপাটে, পাগলাটে হন । তাই তাঁরা প্রশ্রয়ও পেয়ে থাকেন । এই প্রশ্রয়ের সুযোগে বারোজনের  একটা কবিটিম কিসব স্বঘোষিত কবিতা পড়ে গেছেন একফাঁকে । সেগুলো যেমন ছিল দীর্ঘ তেমনি গুগল থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা আধানিবন্ধ আর পাঁচালি ধরনের ছাড়া কিছুই নয় । যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ কবিরা তাদের অত্যাশ্চর্য সব কবিতা পড়ে শ্রোতৃমন্ডলীকে চমকে দিচ্ছিলেন তার মাঝখানে এঁরা ও আরো কয়েকজন এমনই কবিতানামক কিছু পড়ে বেরিয়ে গেলেন । আর এসবের কারণে কবিতা পড়তে না পেরে, মূল্যবান আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে দুঃখ নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে । 

এর পরপরই আবার কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানকে গতিপথে ফিরিয়ে আনতে মঞ্চে উঠে এলেন রাজ্যের বেশ কজন সুখ্যাত বরিষ্ঠ কবি এবং উদয়পুরের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমী বাহিনী । ঠিক সেই পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান যে নান্দনিক মাত্রায় পৌঁছেছিল, স্পষ্টতই বলব, যাঁরা অসময়ে ফিরে গেছেন তাঁরা রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্পদকে চাক্ষুষ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন । উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের পুরো নির্যাস নেওয়ার জন্য টানা দুদিন অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন । সবাই উপস্থিত থাকতে পারলে পারস্পরিক বহু বিষয়ে ভাববিনিময় করা যেত যা এ অঞ্চলের সাহিত্যের সমৃদ্ধির সহায়কও বটে । তবে তরুণরা এবং উত্তরপ্রান্তের ধর্মনগর, কৈলাশহর থেকে আসা কবিরা দেখেছি টানা দুদিন কাটিয়েই ঘরে ফিরেছেন । এটা এই উৎসবে আশার আলো । অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় বাঙালির লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি কবিগানের মাধ্যমে । দক্ষিণের দুই কবিয়াল দিলীপ দে এবং সুভাষ নাথ কৃষ্ণ ও গান্ধারীর ভূমিকা নিয়ে গান করে আসর মাত করে দেন । উদ্যোক্তারা যদি এই কবিগানের মাধ্যমে দ্বিতীয়দিনের অনুষ্ঠান শুরু করতেন তাহলে প্রথমত আমাদের ঐতিহ্য প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত । দ্বিতীয়ত, সকালের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল । তাদের সামনে এই অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা হলে আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে জানতে পারত । আগামীদিনে এজাতীয় অনুষ্ঠান হলে উদ্যোক্তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারেন ।

 আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েতরাজ ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে । শেষদিন রাত বারোটায় সর্বশেষ অতিথি প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়ে ঘুমোতে গেছেন । ঘুম তাঁদের কতটা হয়েছে জানিনা । সকালে আমরা বেরোনোর আগেই প্রতরাশ তৈরি । কথায় কথায় বললেন, বাইরে থেকে অতিথিরা এসেছেন বলেই উদয়পুরের সম্মান রক্ষার্থে তাঁরা নিয়ম ভেঙে রাত দশটার জায়গায় বারোটা পর্যন্ত লজ খোলা রেখেছেন ।

ভোরে বেরোবার আগে রাঙামাটির রাঙারোদ আমাদের গায়ে ইতিহাসের কুয়াশা মাখিয়ে দিচ্ছিল । রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৬ ) ত্রিপুরার রাজদরবার উদয়পুরে রত্নকন্দলী ও অর্জুনদাস বৈরাগি নামে দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন । সেদিন রাজা এই অতিথিদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন । সেই ধারারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল এ দুদিনের অনুষ্ঠানে । দুদিনের 'অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব' এটাই উৎকর্ষতা

ছবি : সম্রাট শীল, অনামিকা লস্কর, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, শ্রীমান দাস ও আরো অনেকে

Sunday, December 17, 2023

ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

 ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


নৃত্য মূলত এক ধরনের শারীরিক প্রকাশভঙ্গিমা । এই প্রকাশভঙ্গিমা সামাজিক, ধর্মীয় এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হতে লক্ষ করা যায় । মানব সমাজের আদিম পর্বের নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যে জাদুবিশ্বাসের একটা পর্যায় ছিল । এই জাদুবিশ্বাসজনিত প্রভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে শুভ ও শুভ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রক্রিয়া হল নৃত্য । শিকার ধরা, দেবতাকে সন্তুষ্ট করা, রোগ নিরাময়, ভূত-প্রেত ইত্যাদি কল্পিত শক্তি ও হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ নৃত্য ভঙ্গিমার ব্যবহার করত । মানবজীবনে নানা পর্যায়কে পালন করতে গিয়েও নৃত্যের বিষয়টা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । শিকারজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির ফলে ক্রমান্বয়ে যখন কৃষি জীবনে পদার্পণ করে তখনও চাষবাসসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে আনন্দমুখর করে তোলার জন্য নাচের মাধ্যমকে গ্রহণ করেছে । কৃষিকর্ম ও কৃষিক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরে নাচের যে প্রচলন রয়েছে তার মধ্যেও জাদুবিশ্বাস অত্যন্ত প্রকট রয়ে গেছে । এককথায় প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নাচের প্রচলন ছিল । প্রাচীন মিশরীয় দেওয়ালচিত্র বা প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গি খোদিত থাকতে দেখা গেছে । সে থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের মানবসংস্কৃতিতেও নৃত্যের সুদূর অতীতের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । সময়ের ক্রমবিবর্তনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচের প্রচলনও বেড়ে গেছে ।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে দুই ধরনের নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । তার একটি হল লোকনৃত্য ও অপরটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । সভ্যতার প্রাকলগ্নে প্রচলিত আদিম নৃত্য গোষ্ঠীজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নৃত্যকলায় পরিণত হয়েছে । তা একটা পর্যায়ে এসে মানুষের সমাজ জীবনচর্যায় সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে । তখন এর মধ্যে কিছু কিছু নান্দনিক ভাবনার সংযোজন ঘটেছে । এইসব নৃত্যের মধ্যে কিছু তাৎপর্যমূলক অনুষ্ঠানাদির সংযোজন ঘটেছে । ফসলের উৎসব, নর-নারীর মিলনোৎসব, শস্য ও সন্তান সংক্রান্ত উর্বরতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নৃত্যানুষ্ঠান সম্পৃক্ত হয়ে গেছে । আদিম নৃত্যের এই পর্যায়ে এসে লোকনৃত্যে উত্তরণ ঘটেছে । বিভিন্ন পর্যায়ের লোকনৃত্যে দেখা গেছে যে, এই নৃত্যসমূহ দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয় । পাশাপাশি এই নৃত্যে সংঘবদ্ধ গান বা কোরাস সংগীত ও বিভিন্ন রকম লোকবাদ্য যেমন–ঢোল, কাঁসি, করতাল, বাঁশি, ধামসা, মাদল ও বিভিন্ন তারযন্ত্রের ব্যবহার করা হয় । এই নৃত্যসমূহ বিশেষ কোনো অঞ্চলের অধিবাসী উপজাতীয় জনগণের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে । ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতীয় জনগণের স্ব স্ব লোকনৃত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । 

কোনো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হলো, তার গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ । এর মাধ্যমে কোনো নৃত্যকে শাস্ত্রীয় বা লোকনৃত্য হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব । লোকনৃত্য ছন্দ বা সংযমের কঠোর নীতিনির্দেশিকা ততটা মান্য করে না । পাঞ্জাবি ভাংরা নৃত্য বা নাগা উপজাতিদের নৃত্যে যেরকম তীব্র গতি থাকে তার তুলনায় শাস্ত্রীয়নৃত্যে যথেষ্ট সংযম ও ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । আমাদের ত্রিপুরারাজ্যেও গড়িয়ানৃত্যেও জোরালো বাদ্যযন্ত্র ও গতি লক্ষ্য করা যায় । পক্ষান্তরে মনিপুরী নৃত্যে ধীর সংযম ও ছন্দের অবতারণা করতে দেখা যায় । এছাড়া লোকনৃত্যে পোশাক কেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । কিন্তু শাস্ত্রীয়নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা আর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । লোকনৃত্যের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর জীবিকার ধরন, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মচর্চার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান । ফলে তাদের জীবনাচরণের বিভিন্ন বিষয়কে গতিময় ও দলবদ্ধ পরিবেশন করতে দেখা যায় লোকনৃত্যে । এই নৃত্য তাদের জীবনঘনিষ্ঠ নৃত্য ।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের জাতি ও জনজাতিদের লোকনৃত্যের মত ত্রিপুরার জনজাতিগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকনৃত্যের ধারা রয়েছে । তারমধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনুসৃত নৃত্যধারাটি বৃহত্তর বাঙালি জাতির নৃত্যের ধারারই অনুসরণ । কিন্তু জনজাতীয়দের যে উনিশটি শাখা রয়েছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব লোকনৃত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা রয়েছে । তাদের মধ্যে একমাত্র রিয়াংদের নৃত্যের মধ্যে কিছুটা ধ্রুপদী আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায় । যদিও তা ভারতীয় স্বীকৃত শাস্ত্রীয়নৃত্যের মধ্যে গণ্য নয় । ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নৃত্য, যা মণিপুরী নৃত্য নামে বিশ্বের সমাধিক পরিচিত তার উৎস মনিপুরে হলেও ত্রিপুরার রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতা লাভের ফলে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অসীম আগ্রহের ফলে তাঁর সৃষ্ট শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বিশাল পরিচিতি পেয়েছে । মনিপুরী নৃত্য আজ ভারতের অন্যতম শাস্ত্রীয় নৃত্য । এই নৃত্য বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত । ত্রিপুরা রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার নিবিড় ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে । যা আজও প্রবহমান ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

 ১৬ই ডিসেম্বর । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস । একাত্তরের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল সেদেশে আজকের দিনে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বস্তরের জনগণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ববর্গ, বিভিন্ন পেশার মানুষজন,  সমাজকর্মী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ । সেই দিনের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক, পত্র-পত্রিকাসমূহেরও বিরাট ভূমিকা ছিল । আগরতলা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমর রাজধানী । সাব্রুমের হরিনা ছিল তাদের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ।

দৈনিক সংবাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সেদিন এদেশের ও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একত্রিত হয়ে কলম ধরে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে । দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরাও এই প্রতিষ্ঠানে এসে তথ্য সংগ্রহ করতেন । যার দরুন খানসেনাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দৈনিক সংবাদ । দৈনিক সংবাদ অফিসকে ধ্বংস করার জন্য তারা গোলাও নিক্ষেপ করেছিল  দৈনিক সংবাদ অফিসের লক্ষ্য করে । কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেদিন ওই গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক, বিপুল মজুমদার, অধ্যাপক মিহির দেব, অধ্যাপক সুখময় ঘোষ, সেদিনের চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত, তরুণ সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী প্রমুখগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষভাবে নাম করতে হয় অনিল ভট্টাচার্য, স্বপন ভট্টাচার্য, ননীগোপাল চক্রবর্তী প্রমুখদের । মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহদানের লক্ষ্যে সৃষ্ট 'রোশেন আরা' মিথ তো বিকচ চৌধুরীর মেধাবী কলমপ্রসূত । আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রত্যক্ষচিত্র দুঃসাহসিকতার সঙ্গে ধারণ করেছিলেন চিত্রসাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত । ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল অরোরার সঙ্গে একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী বিমানে ঢাকা যাওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন । একমাত্র তিনি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেন পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ । ভারতীয় সাংবাদিকরা সেদিন ঢাকা পৌঁছাতে পারেননি । তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর PRO কর্নেল রিখির সঙ্গে ১৮ তারিখ ঢাকায় পৌঁছেছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে রবীন সেনগুপ্ত মৈমনসিংহ হয়ে ঢাকা পৌঁছেছিলেন ।এদিকে ৮ডিসেম্বর রামগড়ের হানাদার মুক্তির দিনে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা আজও তেমনভাবে জানানো হয়নি নতুন প্রজন্মকে । যেকারণেই প্রতিবেশী দেশ হয়েও এই প্রজন্মের একটা অংশ ক্রোধ ও ঘৃণা বর্ষণেই তৃপ্তি পায় । যা আদৌ কাম্য নয় । পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির মাধ্যমে তো বিশ্বসভায় প্রথম সারিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব ।

 আসুন, আজকের দিনে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে মৈত্রীর কথা বলি, সম্প্রীতির কথা বলি, শান্তির কথা বলি । ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক ।

ছবিঋণ : চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ– রবীন সেনগুপ্ত

Wednesday, December 13, 2023

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

টিংকুরঞ্জন দাস। ত্রিপুরার একজন সুপরিচিত কবি । প্রেমপ্রবণতা, নিসর্গচেতনার সঙ্গে সমাজভাবনা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে এক ভিন্নতর মাধুর্য দান করেছে । কবির অপর ভাবনার কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন 'ভিন্নপথের পথিক' ।  কবি তো পথিকই । জীবন ও সমাজ প্রকৃতির আলপথে বিচরণই তাঁর কাজ । এই পথের দুপাশে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় বৈচিত্র্য ফুটে উঠে, আর সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যায় । কবি বাস্তবজীবনে দায়িত্বপূর্ণপদ সামলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত । ফলে জীবনকে ভিন্ন রূপে দেখার সুযোগ রয়েছে তাঁর । রয়েছে দেখার চোখও—

স্কুলছুট কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিত ছেলে মেয়েদের ধরে আনতে 
বেরিয়ে পড়ি প্রায় সকালেই পাড়ার বাড়ি বাড়ি 
দুঃখ হলেও হাসিমুখে সব দোষ করি স্বীকার 
তবুও যেন ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে রেগুলার 
তারপরও শুনি পথে ঘাটে,
 ও, সে তো সাধারণ এক স্কুল টিচার
 কাজকর্ম ফেলে রেখে সারাদিন ঝাড়ে শুধু চক ডাস্টার ।'

চিরায়ত শিক্ষকমননজাত প্রেরণা থেকে জীবনের এক ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মুখ দেখবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর । তাঁর মধ্যে তাই রয়েছে এক তন্ময়তার ভাব। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, জীবনের কঠোর-কর্কশ, সুন্দর-অসুন্দর পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা । মানুষের কল্যাণবোধ ও মঙ্গলভাবনা তাঁর কাব্যের উপজীব্য । সমকালের রাজনীতির সঙ্গে তিনি পরিচিত । দেখছেন রাজনীতির অস্থিরতা, রাজনীতির বাণিজ্য । কিন্তু হৃদয়ের বাণীই তাঁর কাব্যের প্রধান শর্ত । সেখানেই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা—

তাই এবার আর মৌ নয়,
 এসো, একে অন্যের মুখে তুলে দেই এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন 
বিবস্ত্র মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিই সামান্য ভালোবাসার চিহ্ন 
একবার অন্তত বাঁচি 
সেই সব বিবস্ত্র অভুক্ত মানুষের জন্য ।

কবি টিংকুরঞ্জন দাসের কবিতার নিবিড় পাঠের মধ্যে যে কাব্যসূত্র সমূহ প্রকট হয়ে ওঠে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজালে পাই—

ক) কবির হৃদয়ের মধ্যে কল্পনাচারিতা রয়েছে । তবে সেই কল্পনা বাস্তববিচ্যুত নয় । তার মনের মধ্যে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার যে স্বচ্ছতা রয়েছে তা তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেন ।

খ) কবির হৃদয়ে যে চিন্তা বা চেতনার বিস্তার ঘটে তা শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার জগতে নয় । বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তার প্রকাশে বলিষ্ঠতা রয়েছে ।

গ) তাঁর কবিতার বাকভঙ্গিমা আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত না হলেও তাঁর কাব্যরচনার একটা নিজস্ব ক্ষমতা বা স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে ।

ঘ) বাস্তবক্ষেত্রে কবি বা সাহিত্যিকরা স্বাধীনচেতা হন । সে কারণেই নিজেকে কাব্যবেষ্টনীর মধ্যে না রেখে প্রকাশের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন এই কবি ।

কবি তাঁর কাব্যের উপাদান তাঁর পরিচিত নিসর্গ ও সমাজপারিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করেছেন । সেকারণেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয়নিঃসৃত ও স্বচ্ছ । তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না । ভাষা ও ভাবে কৃত্রিমতা থাকলে তা কখনোই প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা । পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতাময় এই সময়ে মানুষ, মানবতা ও সময়ের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত কবির হৃদয়ের ভাষা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় । পাঠকচিত্তকে  অবশ্যই এক অন্যতর ভুবনে নিয়ে যাবে এই কাব্যগ্রন্থটি ।
                        অশোকানন্দ রায়বর্ধন

   দার্জিলিং টিলা, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা
          ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ    ।                    

Thursday, December 7, 2023

শবশকট

শবশকট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শববাহী গাড়িটা মায়াঘাটের শেষ দরোজায়
নির্ধারিত গমন শেষে আচমকা থেমে যায় ।
সারা পথ তার সাথে যায় লৌকিক আচার,
মাইকে বাঁধা বিচ্ছেদী সুরে কীর্তনগান,
নগ্নপদ মানুষের মৃদু শ্বাস, টবে রাখা তুলসি গাছ ।

এই গাড়িতে বসার আসন নেই । এ এক শয়নযান ।
অনন্তের যাত্রী কেবল এ যানের সওয়ার হয় ।
যে শব হয়ে চলে যায় সে জানে না তার
 সাথে কে যায়, কে না যায়, কে, না যায় !

শবশকটের রং কেউ বুঝে শুনে কালো করেছে
কারণ জীবনেরই থাকে আলোর কারুমশাল,
তারপরেই নেমে আসে কালো রঙের আঁধার ।

জীবন যাকে ছুটি দিয়েছে সেই কালো আঁধারের
কে যায়, কে না যায়, কি এসে যায় তার ।

তাকে ফেরাবার মতো কোনো বেহুলার জন্ম হয় না ।


Tuesday, November 28, 2023

মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা ও অপারেশন জ্যাকপট

মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা ও অপারেশন জ্যাকপট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । এই এক নম্বর সেক্টর থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন । এই সেক্টর থেকে ২২ হাজারের উপর মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা । এখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন । পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী নেমে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ । সমগ্র চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, থেকে ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম । ফলে প্রথমদিকে বেশ কিছুটা সময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাক হানাদাররা তাদের দখলদারী কায়েম করতে পারেনি । এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রথমে রামগড় ও পরে হরিণায় স্যাটেলাইট ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছিল । রামগড় পাক বাহিনীর দখলে চলে গেলে সাব্রুমের হরিণা হয়ে ওঠে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার । এখানে মেজর রফিকুল ইসলামের দায়িত্বে ছিলেন গেরিলা যোদ্ধারা । এবং একসময় তিনি এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন । তাঁকে তখন সাহায্য করতেন ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া । মেজর জিয়ার দায়িত্বে ছিল জেড ফোর্স । এই জেড ফোর্সের নিজস্ব হাইড আউট ছিল পোয়াংবাড়ির কাছে মামাভাগিনা টিলার নিচে ত্রিপুরার কোনো এক রাজার পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে । ১৯৭১ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সেক্টর গঠন করা হলে হরিণাতে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার করা হয় । এক নম্বর সেক্টটরের ছিল পাঁচটি সাবসেক্টর । এগুলো হলো— ঋষ্যমুখ সাবসেক্টর, শ্রীনগর সাবসেক্টর, মনুঘাট সাবসেক্টর, তবলছড়ি সাবসেক্টর ও ডিমাগিরি সাব সেক্টর।

এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার হরিনা থেকে যে সমস্ত স্মরণযোগ্য অপারেশন চালানো হয় তার মধ্যে নৌবাহিনীর প্রথম ও সফল অভিযান হল 'অপারেশন জ্যাকপট' । মুক্তিযুদ্ধের ১০ নম্বর সেক্টর ছিল নৌবাহিনী । এই নৌবাহিনী ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখ এক দুঃসাহসিক ও সফল অভিযান চালিয়েছিল । বিশ্বের সমরশাস্ত্র বিষয়ক পাঠ্যসূচিতে আজও এই অভিযান তথা 'অপারেশন জ্যাকপট' এর কথা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । এই অপারেশনে সেদিন একযোগে চট্টগ্রাম ও মংলা দুটি সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ এই দুটি নদীবন্দরে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান ও আরও কয়েকটি দেশ থেকে আসা অস্ত্র-খাদ্য ও তেলবাহী ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল । চট্টগ্রাম বন্দরের আক্রমণটি সানানো হয়েছিল একনম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তথা হরিনা ক্যাম্প থেকে ।

১৯৭১ সালের ২৩শে মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয় । এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল C2P । জুন মাসের প্রথমদিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা শক্তসমর্থ, সাহসী এবং ভালো সাঁতারু ৩০০ জনের একটি দল C2P ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন । নৌকমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার কমান্ডার এম এন সামানত । ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জি এম মর্টিশ । এঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও ২০জন ভারতীয় প্রশিক্ষক এবং পাকিস্তান নৌ বাহিনীর দলত্যাগী ৮জন বাঙালি সদস্য । ট্রেনিং এর প্রথম অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থলযুদ্ধের কৌশল শেখানো হয় । তার মধ্যে ছিল—গ্রেনেড নিক্ষেপ, বিস্ফোরক ব্যবহার, স্টেনগান, রিভলবার চালানো এবং খালি হাতে যুদ্ধ করা ইত্যাদি । দ্বিতীয় ভাগে জলযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে ছিল—৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাঁতার, জলের উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার, স্রোতের বিপরীতে সাঁতার, শীত ও বর্ষায় একটানা জলে থাকার অভ্যাস, সাঁতরে গিয়ে কিম্বা ডুব সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন বাঁধা ইত্যাদি । প্রায় টানা তিন মাস ট্রেনিং করার পর অগাস্টের প্রথম সপ্তাহের দিকে তাঁদের ট্রেনিং পর্ব শেষ হয় । টানা তিনমাস খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে ট্রেনিং করার পর বিমানে করে তাঁরা আগরতলায় আসেন । 

জুলাই মাসের ২৮ তারিখ ভারতীয় বাহিনীর ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এর সঙ্গে চট্টগ্রামের বন্দরে নৌঅভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের জন্য ৬০ জনের একটি শক্তিশালী দল গঠন করা হয় । এই দলের নেতা ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী । তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিনার হিসেবে ফ্রান্সে থাকা অবস্থায় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন । অপারেশন জ্যাকপটে চট্টগ্রামের অপারেশনে নেতৃত্ব দেন তিনি । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একসঙ্গে বীর উত্তম ও বীর বিক্রম খেতাব দেওয়া হয় তাঁকে । প্রতিজন নৌ কমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন, আর কিছু বিস্ফোরক ও শুকনো খাবার দেওয়া হয় । প্রতি তিনজনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং এই দলের নেতা সাবমেরিনার ওয়াহেদ চৌধুরীর জন্য ছিল একটি রেডিও । চারটি বন্দরে একযোগে আক্রমণের লক্ষ্যে কমান্ডরদের নির্দেশের জন্য রেডিওতে একটি প্রস্তুতি সংগীত বাজানোর কথা জানানো হয় । সংগীতটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান / তার বদলে আমি চাইনি কোন দান ।' এই গানটির অর্থ ছিল আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে । অন্য গানটি ছিল একশন সংগীত । গানটি ছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া 'আমার পুতুল আজকে যাবে প্রথম শ্বশুরবাড়ি' । এই গানটির অর্থ ছিল আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ করুন । এই গানগুলো সম্প্রচারের ওয়েভলেংথ এবং ফ্রিকোয়েন্সি কমান্ডারকে জানিয়ে দেওয়া হয় ।

১৩ই আগস্ট ৬০ জনের এই দলটি আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরীর নেতৃত্বে হরিণা ক্যাম্পে এসে পৌঁছান । হরিনা ক্যাম্প থেকে যাত্রা করার পর তিনি ৬০ জনের এই দলটিকে ২০ জন করে তিনটি ছোট দলে বিভক্ত করেন । প্রশিক্ষিত ২০ জন করে তিনটি ছোট দলের কমান্ডাররা ছিলেন মাজহার উল্লাহ ( বীরোত্তম )  ডা. শাহ আলম ( বীরোত্তম ) এবং আব্দুল রশিদ । তিনটি দলের সার্বিক কমান্ডার ছিলেন আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী । ১৪ আগস্ট রাতে রশিদ গ্রুপ রামগড় এর পথে, শাহ আলম এবং মাজহার উল্লাহ গ্রুপ বিভূঁইয়া ঘাট দিয়ে এগোতে লাগলেন । এদিকে আব্দুর রশিদ গ্রুপের পথের খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদারেরা । রশিদ ভেবেছিলেন হানাদারেরা সংখ্যায় কম । তাই লোহারপুলের কাছাকাছি উঁচু পুকুরপাড় থেকে এলএনজিতে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন । ঘন্টাখানে প্রচন্ড গোলাগুলি চলল । তারপর ফিরে এলেন আবুল কাশেমের বাড়িতে । এতে অপারেশন জ্যাকপট থেকে রশিদের গ্রুপ পিছিয়ে পড়ে । অন্য দুটি দল ভোরে পৌঁছালেন মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারে । তারপর খানিকটা জিরিয়ে সমিতির হাটের দিকে যাত্রা করেন । সমিতির হাটে যখন তারা পৌছালেন তখনই বেজে উঠলো প্রথম গান— 'আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান / তার বদলে আমি চাই না কোন দান ।' তারপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাঁরা । তারপর কৌশলে পাক আর্মিদের চোখ এড়িয়ে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের হাজিপাড়া সেন্টার, নাসিরাবাদ, কাকলি বিল্ডিংসহ কয়েকটি শেল্টারে পৌঁছান ।  মীরসরাই থেকে মাইন ও অস্ত্রের চালান চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন শেল্টারে পৌঁছানো হয় । এ কাজে মুক্তিযোদ্ধা জানে আলমের বিশাল ভূমিকা ছিল । তিনি একটি গাড়িতে তরকারি বোঝাই গাড়ির মতো সাজিয়ে তাতে মাইনসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পরিবহন করেছিলেন । তিনি ও তাঁর সহযোগী পাইকারি বিক্রেতা সাজেন এবং শহরে ঢোকার মুখে পাক সেনার জেরায় নিজেদের তরকারি বিক্রেতা প্রমাণ করতে সক্ষম হন ও পার পেয়ে যান । দুটি দল যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছালেও তৃতীয় দলটি সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি ফলে আক্রমণকারী কমান্ডো সংখ্যা ৪০ এ দাঁড়ায় । ১৪ আগস্ট রাতে প্রথম গানটির সংকেত শোনার পর আব্দুল ওয়াহেদ, মাজহার উল্লাহ, ডা. শাহ  আলমের নেতৃত্বে ৩৯ জনের দলটি কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর আনোয়ারার লাক্ষার চরে অবস্থান নেন । সব প্রস্তুতি সেরে নেওয়া হলেও বৃষ্টির জন্য শেষ পর্যন্ত ১৪ আগস্ট এর অপারেশন বাতিল করা হয় । ১৫ আগস্ট সকালে ২ নম্বর জেটি থেকে ১৬ নম্বর যেটি পর্যন্ত অবস্থানরত টার্গেট গুলোকে তাঁরা পরিদর্শন করেন ।

১৫ আগস্ট রাতে প্রত্যেক যোদ্ধার বুকে সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটি করে লিম পেড মাইন বেঁধে দেওয়া হয় । একটি করে ছুরিও দেওয়া হয় । জাহাজের গায়ের শ্যাওলা পরিষ্কার করার জন্য । সবার পায়ে সাঁতার সহায়ক হিনস পরিয়ে দেওয়া হয় । রাত  বারোটা বাজলো । রেডিওতে বেজে উঠল, 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি ।' অন্ধকার নিস্তব্ধ কর্ণফুলীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল যোদ্ধারা । একে একে সকলে পাকসেনাদের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে যার যার টার্গেট জাহাজে মাইন বসিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে পৌঁছায় । ১৫ই আগস্ট রাত ১টা ৪০মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ।  বিকট শব্দে মাইনগুলো পরপর বিস্ফোরিত হতে শুরু করে । চট্টগ্রাম বন্দরে এই সময় এম. ভি. হরমুজ এবং এম. ভি. আল আব্বাস দুটি জাহাজ নোঙর করা ছিল । এগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র বহন করা হয়েছিল । প্রথমটিতে ৯৯৯০ টন এবং দ্বিতীয়টিতে ১০৪১৮ টন সমরসম্ভার ছিল । এছাড়া বন্দরে ফিস হারবার জেটির সামনে ৬২৭৬ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ওরিয়েন্ট বার্জ নামে আরেকটি জাহাজ অবস্থান করছিল । অন্যান্য জেটিতেও কিছু জাহাজ ও বার্জ নেভাল জেটিতে দুটি গান বোট এবং একটি বার্জ বাঁধা ছিল । অপারেশনের ফলে সরাসরি সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ডুবে যায় । পাশাপাশি ওই একই সময়ে অন্য তিনটি বন্দরে ও বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায় ।

এই অভিযান সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও বহির বিশ্বে ব্যাপক প্রচার লাভ করে ছিল । বিদেশি এতগুলো জাহাজ ধ্বংস হওয়ার ফলে যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয় তখন পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম চলছে না, সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে ্ বলে অপপ্রচারের ফানুসটিও ফুটো হয়ে যায় । সর্বোপরি এই আত্মঘাতী গেরিলা যুদ্ধে একজনও মুক্তিযোদ্ধা আহত বা নিহত হয়নি কিংবা পাক বাহিনীর হাতে বন্দিও হয়নি । মুক্তিযুদ্ধের দামাল নৌকমান্ডো বাহিনীর বিজয়ের সঙ্গে এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনার নামও স্বর্ণাক্ষরে খোদিত থাকবে ।

 সহায়ক বইপত্র :

১. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস–মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২. লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে–রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম
৩. মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান–খলিলুর রহমান

Monday, November 6, 2023

মোষ

মোষ 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মোষেরা ভীষণ ক্ষ্যাপা হয় । শিং দিয়ে সংহার করে । 
সেই বেয়াড়া মোষকে বাগ এনে পিঠে সওয়ার হওয়ার 
গল্পটা সাদামাটা নয় । বাহিনী নিয়ে রীতিমতো 
লড়াই করতে হয় । দুনিয়ার তাবত ভদ্রতাকে 
অলংকার পরিয়ে  নিয়ে
মোষকে ঘিরে ধরার কৌশল ব্যবহার করতে হয় ।

একগুঁয়ে স্বভাবের মোষ প্রায়শই তেড়ে ফুঁড়ে ওঠে, 
বিশাল দেহে তার ক্রোধই সম্বল । একমাত্র রক্ষাকবচ ।
তার মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই, ধারালো শিং ছাড়া ।
এই মোষের পিঠে চড়ার স্বপ্ন যে দেখেছে একবার 
সে তার সমস্ত মেধা ও চাতুরি খরচ করতে থাকে,
খ্যাপা মোষকে বাগে আনার জন্য তাকে শোনায়
 ঘুমপাড়ানি গান আর রাজপাটের শোলোক ।

মোষকে বশ করে যে জন তার পিঠে উঠে বসে
 সে আর নামতেই চায় না এই নাদুস শরীর থেকে ।
 যতক্ষণ না তাকে টেনে হিঁচড়ে নামানো হয়
 ততক্ষণ সে যম রাজার প্রতিরূপ একজন ।

সৌরবিগ্রহ

সৌরবিগ্রহ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

যে সূত্রে জেগে উঠেছিলাম এক আঁধারকালো জঠরভুবনে
 তিনিই আমার মায়ের শরীর । আজীবন এক বিজয়ের অহং
 তিনি লালন করেছেন তাঁর রহস্যময় গর্ভদেয়াল  ঘিরে। 
আমার মনে নেই সেইসব । আমাকে মুক্তমঞ্চে
 একা ফেলে রেখে তিনি চলে গেছেন বলে 
এক বিষন্ন অভিমান আমি হৃদয়ে পুষে বেঁচে আছি ।

মাকে আমি খুঁজে ফিরছি অনন্তসময়ের কোলাহলপথে । 
প্রতিদিনের পথচলা আমাকে দূরের এক
 ছায়াবিগ্রহের কাছে এগিয়ে নিয়ে যায় ক্রমাগত । 
যত এগিয়ে যাই আমি আকুল হয়ে দেখি সেই 
অস্পষ্ট চারুশরীর । দেখি আমার মাকে সেই সৌরবিগ্রহে । 
এক বিস্ময়প্রতিমা ! সমস্ত অন্ধকারের কেন্দ্র তিনি । 
আর তাঁর আলোগোলাঘরের আলোকদানা ছড়িয়ে দেন 
সারা পৃথিবীর শরীরে । আমি দেখি আমার 
হারিয়ে যাওয়া মা সেই আলোর কেন্দ্রে এসে দাঁড়ান । 

আমার তৃষ্ণার্ত নরজীবন গলে গলে মিশে যায় 
সেই প্রতিমারপদ্মময় চরণডোবানো জলাধারে ।

কোজাগরী

কোজাগরী

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 হারানো পরম মুহূর্তগুলো সযত্নে তুলে
 রাখে কোজাগরী রাত ।
 সাঁঝবাতি নিভে গেলেই তার শরীর বেয়ে
 উপচে পড়ে আলো আর আলো । 
সে আলোর আছে মাদক আকর্ষণ ।  
আলোর ভাঁজে ভাঁজে সে তার নগ্ন
 শরীর মেলে ধরে । নগ্নতার মাঝে 
কোনো মিথ্যাচার থাকে না । 
কোনো ছলাকলাও নয় । আলোময়তা 
শরীরকে সুন্দর করে নাকি শরীর
 সুন্দর করে আলোকে ?  লাখ টাকার প্রশ্ন 
বাঁচিয়ে রাখে কোনো অতীতকথা ।
মৃতসঞ্জীবনী  অনুভব মৃদু মন্দিরার শব্দে
 এপাশ ওপাশ হেলে ঢলে পড়ে ।

ভোর না হওয়া পর্যন্ত কোজাগরীর 
দায় থাকে জেগে থাকার । 
ক্ষণিকের বিভ্রমে নষ্ট হয়ে যেতে পারে
 চাঁদের নগ্নতার পোষাক ।

সংকেত

সংকেত

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

চাঁদের উদয় হয় । অস্তগমন তার আছে কিনা 
জানা নেই । মাঝরাতে চুপ হয়ে থাকা জলের ভেতর 
ঘরসংসার পাতে পূর্ণিমা ছেড়ে যাওয়া চাঁদ । কালো জলের শরীরে একাকী গৌরবদন
 চুম্বনের চিহ্ন রাখে । ঢেউ এলে সে পিরিতের পদাবলি 
মুছে যায় । শুধু চাঁদপানা মুখ জলের তালে 
কেঁপে কেঁপে ডিঙা বায় ।

এমনই প্রাচীন শোলোক মিথ হয়ে গিয়েছিল 
যমুনার জলে । আজো তাদের নিয়ে গান হয় । 
হালফিলের তরুণী বৌ-ঝি পালিয়ে যায় 
মোবাইলের সংকেতে । 

এ সবই অস্তগামী চাঁদের গূঢ় ইঙ্গিত ।

সূর্যাস্তকাল

সূর্যাস্তকাল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সূর্যাস্ত নিপুণ হলে সুদর্শন হয় কোন সন্ধ্যাতারা
আকাশের অন্ধকার বিস্তারে তোমার মুখ ভাসে না ।
ভালোবাসব বলে পরিপাটি হৃদয় রেখেছি তাই
তুমি কি ঘোর কাপালিক নাকি অন্য কোনো তন্ত্রে
তোমার বিছানো আঁচলে যানজট গড়ে রেখেছে বলো ?

হঠাৎ কুয়াশাভোর এলে শরতকালের কথা মনে পড়ে
যে ভোরে আমার মা নক্সিকরা চটের ব্যাগ হাতে নিয়ে
বাপের বাড়ি নাইওর যাবেন বলে ঘাটে বসে থাকতেন
সম্পর্কিত দেওর মাঝির অপেক্ষায় ।  জারুল গাছের ছায়ায় শীতল হয়ে পানের খিলি বানাতেন ।

এখন তোমার আকাশে সেসব আলপনা ভাসে না আর
এখন চন্দ্রকথা আর চন্দ্রাবলি ছেড়ে চলে গেছে 
শোলোকের মামাবাড়ির চেনা সেইসব চিত্রকথা ।
ঘাট পেরুবার সেই মাতৃমঙ্গল শাঁখাভরা হাত নেই আর
তুমি আমি এখন অনেক অনেক বড়ো হয়ে গেছি

Monday, October 23, 2023

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা'  অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জীবন ও নদী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । জীবনের সঙ্গে নদীর তুলনা, নদী জীবনের উপমা একটি সাধারন আলংকারিক বিষয় । কাব্যেও নদী ও জীবনকে পাশাপাশি চলতে লক্ষ্য করা যায় । নদীর যেমন রয়েছে নাব্যতা তেমনি জীবনের রয়েছে চলিষ্ণুতা । নদীর গতির পক্ষে চলে যে জলযান সে শুধু ভাটির দেশ আর মোহনার গতিপথ চেনে । গন্তব্য তার নির্ধারিত । সে জলযান উজান চেনেনা । পার্বত্য জলঘূর্ণি তার অজানা । সংঘাত সংকুল নদীর বিপরীতের চলনলড়াইয়ের  অভিজ্ঞতা তার থাকে না । জীবন ও তেমনি অভিজ্ঞতাময় ।

"আমার দাদু বলতেন নদীর পাড়ে এই শীতে 
কচ্ছপের মতো হয়ে যারা পড়ে আছে
 তারা একেক জন আহত সৈনিক
 অনেক ঝড় জলে ডোবা ভাষার দুঃসাহসের উপকথা 
তারা জানে
 তাদের কাছে এখনো মানুষের প্রথমদিনের
তরঙ্গলিপির মগ্ন চিরকুট রয়েছে 
তারাই প্রথম কলসি-কাঁখে মেয়েদের গান শুনেছিল 
বৌ-ঝিদের নাইয়র নিয়ে তারাই গিয়েছিল 
বিল পেরিয়ে দূর কোনো গ্রামে
 আকাশের দুরন্ত মেঘ তারাই প্রথম বশ
 মানিয়ে তাদের মাস্তুলে বেঁধেছিল
 ওই যে শঙ্খচিল তাদের ইঙ্গিতেই ঘুরপাক খায় 
আর জলের উপর শুকনো মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়ায়" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

 গড়পড়টা জীবনের মত একঘেয়ে গতিতে চললে জীবনের বৈচিত্র্য আসে না । জন্ম, বেড়ে ওঠা, আহার, নিদ্রা, মৈথুন আর মৃত্যুর গৎ বাঁধা নিয়মেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । জীবনের দুঃসহ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের অভিজ্ঞতায় বাঁচতে চাইলে চলমান প্রবাহের বিপরীতে পা বাড়াতে হবে । সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বিপরীত অভিযাত্রায় গড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবনকে । চেতনার ভেতর জাগিয়ে তুলতে হবে সেই বোধব্রহ্ম । কবির কবিতার শরীরের চিত্রকল্পে আসবে সে অনুষঙ্গ । উপমায় আসবে তেমনি সুদৃঢ় বেস্টনী ।

বিপরীত বহমানতার জন্যে, হাওয়ার পক্ষে চলার জন্যে, সংক্ষুব্ধ স্রোতের প্রতিকূলে চলার জন্য নৌকার থাকে শক্ত খুঁটি । তার নাম মাস্তুল । সেই মাস্তুলে পাল খাটানো হয়ে থাকে স্রোতের অনুকূলে বা প্রতিকূলে হাওয়া প্রবাহিত হলে মাস্তুলে বাঁধা পাল হাওয়ার চাপে নৌকাকে  নির্ধারিত পথেই তরতরিয়ে নিয়ে যায় । অনুকূলের পথ তো ভবিতব্য । তার মধ্যে কোন বৈচিত্র থাকে না । আর স্রোতের বিপরীতে যখন নৌযান চালানো হয় তখন বিপরীতমুখী স্রোতের বেগের সঙ্গে বিপরীত হাওয়া থাকলে মাস্তুলে বাঁধা পাল নৌকার সংঘাতশক্তিকে অনেকটা সহায়তা করে । নৌকাকে বিপরীত প্রবাহমানতার সংঘাতশক্তি যোগায় প্রকৃতিনির্ভর বায়ু প্রবাহ । অনুকূল হলে পালের শক্তি প্রকাশ পায়। মানব যাপনের সংঘাতেও সংহতির চেতনার দ্যোতক হল গতিমান বায়ুপ্রবাহ । বায়ুপ্রবাহ নৌযানের যে কাজটি করে মানবের সংহতিচেতনাও তেমনি গতানুগতিকতার বিপরীতে প্রতিবাদমুখর করে নদীর বুকে পালখাটা নৌকা আর প্রবহমান জীবনের বুকে মানুষের সংহতিচেতনা সমস্ত অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় । সে জায়গায় কবি যখন তাঁর কবিতার বা কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম দেন 'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' তখনই থমকে যেতে হয় পাঠককে ।

''আকাশের ওই সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে
 আমি চেয়েছিলাম গোলুইয়ের ঢেউয়ের শব্দ শুনি
 ঢেউগুলো নৌকার তলপেট ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে 
আর নৌকা সেই ঢেউ ভেঙে ভেঙে
 ঢেউয়ের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে 
কাঞ্চন মালার দেশে পাড়ি জমাচ্ছে" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

যে কাজ করবে মাস্তুলের মাথায় বাঁধা পতাকার মতো পাল সে জায়গায় নিশ্চিন্ত পালের বদলে মেঘকে বেঁধে দিলে কি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে ? কাব্যনাম কেমন যেন এক বিরোধাভাসের সৃষ্টি করে এখানে । মেঘ তো পালের মতো দৃঢ় দৃশ্যমান নয় । এক ধোঁয়াশার উপর তার কাল্পনিক উপস্থিতি তাছাড়া মেঘকে বেঁধে রাখা যায় না । তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও নিশ্চিন্ত নয় । কবি নিজেও তার এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই এই অনিশ্চয়তার কথা পরপর দুবার উল্লেখ করেছেন—
ক) কেন জানি কাল রাতে 
      একটিও মেঘ আসেনি । এবং
খ) সারারাত জেগে ছিল সে 
    তবু একটি ও মেঘ নামেনি । ( মেঘ শিকার ) ।
আবার কবি বলছেন–
 "আমার পূর্বপুরুষের বিয়ে হয়েছিল কোন এক নদীর সাথে 
সেই নদীর সন্তানেরাই মাস্তুলে মেঘের পতাকা উড়িয়েছিল 
তারাই দূর দ্বীপের ঘাটে ঋতুমতী মেয়েদের 
আয়ত চোখের কোলে প্রেমের কাজল এঁকেছিল
 নদীর জলে তাদের গান আজও 
মনসার করণ্ডি মতো ভাসে 
নদীর ভিজে বাতাস এখনও তাদের
 গায়ের ঘাম মুছিয়ে দেয়"

কবি দিলীপ দাসের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে "মাস্তুলে মেঘের পতাকা"র অভ্যন্তরবাসী চব্বিশটি কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে এই অনিশ্চয়তার চেতনা দ্বন্দ্বমুখর হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে । অনিশ্চিত জীবনকে বয়ে বয়ে কবির চেতনায় জন্ম নিয়েছে অতৃপ্তির অসহায়তা—
"আমি শ্যাওলার জীবন চাইনি কখনো
 ঝড়ের মুখে হাল ভাঙা নৌকা হলে
 অনুতাপ হতো না কোন পাথরে ছোবল মেরে 
বিচূর্ণ হবার সাধ সারা জীবন অপূর্ণ রয়ে গেল—"( ভুল করে বড়ো আগে চলে এসেছি ) । 
তিনি লক্ষ্য করেছেন–
 "সৃজন ও ধ্বংসের সময়টুকু উন্মাদ
 নদীর মতো । আর তালডোঙার মধ্যবর্তী ছায়ার
নির্জীব কাল শুধু হিজড়ের জীবনযাপন
 শুধু পত্রহীন ডালে বসে কামার্ত কূজন" ( ওই ) ।

কবির মানসদ্বন্দ্বের বীজ নিহিত রয়েছে পূর্বপুরুষের চিরকালীন নদীসংসার ছেড়ে, ভদ্রাসন ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দেওয়া জীবনের যন্ত্রণায়, দেশভাগের যন্ত্রণায় । দেশভাগ, বঙ্গবিভাজন বহু মানুষের জীবনকে উথাল-পাতাল করে দিয়েছে । উৎখাত করে দিয়েছে চিরায়ত শেকড় থেকে । এই বেদনা তিনি জানান আরেক বিখ্যাত জীবনকে, অগ্রজ কবি অনিল সরকারকে—
বিক্ষুব্ধ বেদনায় তার বুক 
ভাঙা নৌকার মতো উপুড়
 হয়ে আছে । হৃদয় ভরে আছে দ্রব
 অভিমানে । তবু এই অভিমানের গভীরে
 এক টলটলে জলের পুকুর 
নিজের দুঃখের দরজায় কড়া নাড়ে
 অমাবস্যার ভোর— ( অমাবস্যার ভোর )  ।
দেশভাগ নিয়ে কবির অনুভব–
" তুমি আমায় দিয়েছ
 শ্যাওলার ভাসমান জল 
উদ্বাস্তু জীবন 
আর প্রত্যহের শেকড়হীনতার 
জীর্ণ রামধনু ।
তুমি দিয়েছ এক খঞ্জ পিঞ্জরের
 আকাশ ঝরোকা 
কাঁটাতারে ঝরে যাওয়া দ্বিখন্ড দুপুর ( স্বাধীনতা–৫০ ) ।
দেশভাগের পরিস্থিতিতে কবি সংক্ষুব্ধ । ক্ষোভ ও অভিমানে কবি এই পরিণতিকে ইঙ্গিত করে বলেন—
" তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই
 তুই নিয়েছিস তুই 

তুই নিয়েছিস কলমি দাম বিলের পানকৌড়ি 
শুশুকভাসা বিকেল আর ভাটিয়ালি সারী 

তুই নিয়েছিস মেঘনা তিতাস দত্তখলার চর 
সহজ সুখ সহজ জীবন গান শালিখের ঘর 

তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই ( তুই নিয়েছিস ) ।
ভিটেছাড়া, ছন্নছাড়া কবি অনেক প্রত্যাশা নিয়েএক নতুন স্বাধীন দেশে এসে প্রতারিতই হয়েছেন শুধু । যে স্বপ্ন জন্মেছিল স্বাধীন দেশকে নিয়ে তাঁর বুকের ভেতর, সেটা তাঁর কাছে ' মনে হয় এ শুধু কথার খেলাপ' । যে—
 "কথা ছিল ল্যাম্পপোস্টগুলো হবে হাওলার ফাঁসির খুঁটি 
গডম্যানরা সব যাবে জেলখানায় 
ইঁদুরের গর্তে আর জমবে না বেনামী ফসল 
কথা ছিল সব চাষা ভুমি পাবে সব জেলে জাল
 মজুরের হাতে রবে কারখানার রশি
 ভিখারি উধাও হবে রাজপথ থেকে,
 কোনদিন আসবেনা গেস্টাপোর সকাল
 মসজিদের আযান হবে মন্দিরের ঝকঝকে চূড়ো" (প্রতারণার পঞ্চাশ বছর ) । "সব কথা আজ নেড়ি কুকুরের মত রাস্তায় গড়ায়" । আর স্বাধীনোত্তর দেশে–
"বিখ্যাত খুনিদের জন্য সবাই জানে
 ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় না । এ অহিংসার দেশে তাদের জন্য রাজকীয় উপঢৌকন— অশোক চক্রের মেহগনি চেয়ার —
 তাদের জন্য বাতাসে উড়ে নিলামবালা ছ'আনা ভোটের টিকিট 
পত্রিকার পাতায় উছলে উঠে কামাতুর উচ্ছ্বাস
 স্বাধীনতা দিবসে তাদের জন্যই মখমল তাকিয়া" ( খুনীর হাত ) ।

দেশজুড়ে ধান্দাবাজ সুযোগসন্ধানীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে দখল নিতে চায় সমস্ত সম্পদের । এরা শামুকের মতো ।
"শামুকেরা সব খায় 
আইনস্টাইনের মজ্জা খায় 
ইতিহাসের পাতা খায়,
 মানুষের উত্থান খায়, মেধার উজ্জ্বল খায় 
রঁদার ভাস্কর্যে কাদামাখা হাত বাড়ায়
 ব্রেখটের বই পোড়ায় 

শামুকেরা যেদিকে যায় পেছনে পুরাণ-শাণিত দাঁতের অন্ধ চিহ্ন 
ঘাসের পোড়া বুকে একে যায় ( শামুক ) ।
আর এদের হাতে নিহত হয় আমাদের অন্নদাতা, সভ্যতার সঞ্চালক কৃষকেরা ।
 "পাঁচ হাজার বছর ধরে আমাদের অন্নের রক্ষক
 যাদের রক্তের ফোঁটায় ভরে ওঠে শস্যের গোলা 
নিখিল মানব শিশু যার স্নেহের কাঙাল
 তাকে কাল খুন করা হয়েছে—

সসাগরা পৃথিবীর মুখে যিনি ভাত তুলে দেন 
সেই অন্নের রক্ষক 
হাজার আলোয় উদ্ভাসিত এ দেশের এক করুণ অন্ধকারে 
কাল একগাছা দড়িতে নিজেকেই খুন করেছেন" ( অন্নের রক্ষক ) । জীবনানন্দীয় শব্দবন্ধে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেন কবি এই অসহায়তায় । 
এখন শুধু ক্ষমতাধর এর দাপাদাপি বীরভোগ্যা বসুন্ধরার মত ক্ষমতার কাছাকাছি যারা পৌঁছতে পারে তারাই জীবনের সব সুখ এবং সম্পদের অধিকারী । আজ 'ক্ষমতার প্রকাশ আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে' । কবির দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অন্তরাত্মা তাই আওয়াজ তোলেন—
"বৎস শোনো, ক্ষমতা মানুষের শুভ্র হৃদয়ে 
দুরারোগ্য ক্ষতির মতো । ক্ষমতা
 সেই দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম 
যার কাছে কোন নিরীহ মনুষ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারে না । কিন্তু এই 
ঘামের কাছে লেপ্টে থাকে উন্নাসিক,
 ক্ষমতা এবং অ-ক্ষমতার মাঝে নির্জীব থাকে অতি সাধারণ,
 আর ক্ষমতাহীন কিন্তু ক্ষমতার লুব্ধরা হয় রাজনীতিক । 
ক্ষমতা অর্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী 
কিন্তু ক্ষমতা লিপ্সু অর্থ-দাস ( ক্ষমতা বিষয়ে দু চার পংক্তি ) । এই যে ক্ষমতার লোভ ও তার পরিণতিতে অস্ত্রের ঝংকার ও নিরীহ মানুষের নির্যাতন অসহায়তা শুধু এদেশেই নয় সারা পৃথিবী জুড়েই এই অবস্থা চলছে । ক্ষমতার কারণে যুদ্ধ ও সংঘাত এবং তার ফলশ্রুতিতে নিরীহ মানুষের বাস্তুচ্যুত পরিযায়ণ, উদ্বাস্ত জীবন কবি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন । উদ্বাস্তুযন্ত্রণা সে কারণেই তাঁর অন্তরের অনুভূতি। এই অনিশ্চিত জীবন সম্বন্ধে তাঁর সংক্ষোভবিধুর আর্তি । সে কারণেই কখনো নির্ভরতার পাল হয়ে যায় ধোঁয়াশাময় মেঘের মতন । নিশ্চয়তা থেকে অনিশ্চিত জীবনের পটপরিবর্তনের সংশয়াকুল যাত্রা । সে কারণেই অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন পেরিয়ে নিশ্চিন্তে অবস্থানের আর্তি—
আমি আর কোথাও যাবো না ।
বনের আলু খেয়ে যারা এখানে বাঁচে
 তারা তো আমাকে যেতে বলে না 
ব্যাধের ভয়ে আমি কেন পালাবো ?

আমি এখানেই থাকবো ।
এই টিলা-লুঙ্গা-ছড়ার কিনারে 
বয়ে যাওয়া ছোট নদীটির মত তিরতির
 যদি পারি খরার দিনগুলোতে 
এক অঞ্জলি তৃষ্ণার জল দিয়ে যাবো—
 সেইসব ভূমিপুত্রদের বলে দাও 
সেইসব ব্যাধ আর খোঁয়াড় ব্যবসায়ীদের বলে দাও 
আমি এখানেই থাকবো—
 এই ছড়া–এই টিলা–এই লুঙ্গা–এই বাঁশবন 
আমায় যতদিন না ছাড়ে 

যারা যেতে চায় তারা চলে যাক ।
আমি আর কোথাও যাবো না ( উদ্বাস্তু সংলাপ ) ।

নতুন দেশে নতুন জীবনকে অতি আপনার করে নিতে চান কবি ।তার পরেও অতিবাহিত জীবনের মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকের মত হাজির হয় অতীত জীবনের কথা । অতীত ভূখণ্ডের কথা । যে ভূমিতে কবি বেড়ে উঠেছেন । কবির আলোকদর্শন ঘটেছে সেই বাংলাদেশের কথা ।
 "দরগারঘাট পেরোলেই মাশাউড়ার মঠ
 আদিগন্ত জলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্ন স্বদেশ
 তার পাশে দূরদর্শী এক তালগাছ
 সারাদিন নিজের ছায়ায় 
খুঁজে মরে স্মৃতির অতল প্রদেশ ।

 এইখানে একদিন বিলের চিকন রোদে
 পুটি মাছের পাখনা ঝিকমিক রুপো ছড়াত
 তখনও চালের কেজি কুড়ি টাকা নয়
 জীবন শাঁসহীন শামুকের 
খোলের মতো তখন ভাসমান ছিল না
 তখনও শুয়োরের বুনো চিতকার এমন উৎকট ছিল না, যুবতী রোদ্দুর গিলে খায়নি রাতের শামুক 

সেই সব অপাংশু দিনের কথা
 আমি যখন বলি আমার তরুণ বন্ধুরা, যাদের বয়স খুব বেশি নয় 
চোখে নিষ্পৃহ উদাসীন রেখে 
আমাকে দ্যাখে 
যেন নস্টালজিক এক বুড়ো বটগাছ । এমনতো 
ছিল না আমার জন্মভূমি ? 'উদ্ভট উটের পিঠে' কোথায় চলেছ তুমি ?" ( বাংলাদেশ- ৯৫ ) ।
 অতীতের স্মৃতিভরা প্রিয় দেশের অস্থিরতায় তিনি চঞ্চল হয়ে ওঠেন । প্রশ্ন তোলেন —"
একটা যুদ্ধ যদি তিরিশ লাখ মানুষের
 রক্ত ও শেষ না হয় তাহলে আরো 
কত লাখ মানুষের রক্ত চাই 
বলতে পারেন শামসুর ভাই ?" ( ঐ ) ।

আসলে জীবনের পরতে পরতে ঘাত প্রতিঘাত সংঘাত পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কারণে কবির বোধের ভেতর গভীর আলোড়ন তোলে । আর সে আলোড়ন থেকেই সৃষ্টি হয় মননদ্বন্দ্বের । দ্বান্দ্বিক জীবনে তাই দৃঢ় সংহত পাল হয়ে যায় পলকা, অস্থায়ী আর অস্পষ্ট মেঘের প্রতীকে । এই অস্পষ্টতার মধ্যেও কবির মনে আশার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়—
"আকাশে যারা সাদা পাল তুলেছে 
আমি তাদের কথা আর কতটুকু জানি
 আমি এক নদীহীন মানুষ—
 পরম্পরাহীন এক অপটু নাবিক 
তবুও আমি চেয়েছিলাম 
আকাশের সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে 
গলিয়ে ঢেউয়ের শব্দ শুনি— ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) । এই ঢেউয়ের শব্দ আসলে জীবনের শব্দ । জীবনের বৃন্দগান । মাস্তুলের মেঘ সেই সঙ্গীতকেই বয়ে নিয়ে যাবে বলে কবি বিশ্বাস করেন ।

Friday, October 20, 2023

স্বীকার্য

স্বীকার্য

উত্তরের কথা যদি বলো তুমি আমি যাবো দক্ষিণে  
জল যদি সামান্য গড়ায় আমি বসতে পারি না 
জল যদি উঠোনে গড়ায় আমি দাঁড়াতে পারি না
জল যদি পথে গড়ায় পারি না আমি এগোতে
আর জল যদি ভূখন্ড ভাসায় আর 
হৃদয়ে যদি নতুন বাঁক আনে গড়ানো জল
তখন কোথায় যাবো, বলো ফুলসই? 

উত্তরের কথা বলো যদি তুমি আমি যাবো রাই দক্ষিণে ৷

Monday, October 16, 2023

বামুটিয়া প্রসঙ্গে

হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

সমতট এবং নবোন্মেষ সাহিত্যপত্রিকার শারদসংখ্যার আবরণ উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা, কবিতা পাঠ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গতকাল গিয়েছিলাম বামুটিয়ার জঙ্গলমহল পাতার বাজারে । আসন্ন শারদোৎসব উপলক্ষে নির্মিত দুর্গামন্ডপে আয়োজন করা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানের । শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে গাছগাছালিতে ঘেরা এক নিভৃত আরণ্যক ভূমিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম । চারিদিকে সবুজে ঘেরা এক নিঃশব্দ নিধুবন এই জায়গাটি । মনে হয় যেন বৈষ্ণবীয় বনবিহারের এক উপযুক্ত স্থল । এই পরিবেশে গিয়ে উপস্থিত হলে নিমেষে মন এবং প্রাণ উদাস হয়ে ওঠে । আবছা অন্ধকার উপরে ছায়া ঘেরা আকাশ একেবারে তাপদগ্ধ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির, অভিভূত হওয়ার মতো স্থল এটি ।

রাজন্য ত্রিপুরার প্রাচীন জনপদ এই বামুটিয়া । এই জনপদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লোহর নদী অনেক ঘটনার সাক্ষী । বড়মুড়া পাহাড় থেকে নেমে এসে এই নদী বয়ে চলে গেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিতাসের বুকে মিলনের জন্য । যে তিতাসকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে গেছেন তিতাসপাড়েরই গোকর্ণঘাটের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম'র মাধ্যমে । এই নদীর একদিন ভরা যৌবন ছিল । ছিল তার নাব্যতা । নদী বেয়ে আসত পালতোলা নৌকা কিংবা বড়ো গহনা নৌকা । ছোটখাটো নৌবন্দরের মত এই নদীঘাট সব সময় কর্মব্যস্ত থাকত । পণ্য উঠানামা চলত । মুটে-মজুর ও পরিশ্রমী মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ ছিল এই ভূখণ্ড । বামুটিয়া নামের সঙ্গে যে মিথ জড়িত তার সঙ্গে এই পরিশ্রমী মানুষদের নাম জড়িয়ে আছে । মুটেদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'মুইট্যা' । কথিত আছে ত্রিপুরার জনৈক রাজা এখানকার মানুষজনের পেশার কথা জানতে পেরে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠেছিলেন 'বাহ ! মুইট্যা' । তাদের পেশাকে সোল্লাসে সম্মান জানিয়ে ছিলেন তিনি । তাদের অবস্থানের জন্য জনবসতি গড়ে দেন রাজা । শোনা যায় সেই থেকে এই মুইট্যাদের জনপদ বামুইট্যা বা বামুটিয়া নামে পরিচিত । বলাবাহুল্য এই বামুটিয়াতে মণিপুরিদেরও প্রাচীন জনবসতি রয়েছে  ।

রাজন্য আমলে ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারি ছিল চাকলা রোশনাবাদ পরগনা । শ্রীহট্টের দক্ষিণাঞ্চল থেকে শুরু করে নোয়াখালির ফেনী তীরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছিল এই চাকলা রোশনাবাদের বিস্তৃতি । চাকলা রোশনাবাদের ছিল অনেকগুলি পরগনা । আজকের বামুটিয়াও ছিল সেরকম একটি পরগনা । দেশভাগের ফলে ভারত ভূখণ্ডে পড়েছে এই বামুটিয়া পরগনার বৃহৎ অংশ । এই পরগনার কিছু অংশ বর্তমানে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত ।  চাকলা রোশনাবাদের এই সমভূমি অঞ্চল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল কখনো এটি কমলাঙ্ক,  কখনো হরিকেল, কখনো বা সমতট । এ কারণেই পুরনো ইতিহাসকে স্মরণ করার লক্ষ্যেই আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজক একটি সাহিত্যপত্রের নাম 'সমতট' । 

এমন ইতিহাস বিজড়িত প্রাচীন জনপদের আজকের আয়োজিত স্থানটিতে এক সময় ছিল রাজ্যের বিখ্যাত বিড়িপাতার বাজার । এই বিড়িপাতাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'কুম্ভিরা' বা 'কুমিরা' পাতা । ত্রিপুরার অরণ্যে এক সময় এই পাতা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত । রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের বাজার থেকে এই বিড়ির পাতা সংগ্রহ করে বামুটিয়ার এই পাতার বাজারে মজুদ করা হত ভাটির দেশে রপ্তানির জন্য । এছাড়া বাঁশ ছন ইত্যাদি বনজ সম্পদ ও তিল, কার্পাস, সরিষা, ধান ইত্যাদি কৃষিজ সম্পদও নদীপথে পরিবহন করা হত । হান্টারের সার্ভে রিপোর্টেও সেসময়ের চাকলা রোশনাবাদের বাজারের তালিকায় বামুটিয়া বাজারেরও উল্লেখ রয়েছে । একসময় বনদপ্তরের কড়াকড়িতে ও ক্রমাগত বন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে এই বিড়ির পাতা ও তাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় গরিব মানুষের জীবিকাটি হারিয়ে যায় । এখান থেকে লৌহর নদী বেয়ে এই পাতা চলে যেত ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও দেশের নানা প্রান্তে । আজ সেসব ইতিহাস ।

ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানে গতকাল আয়োজন করা হয়েছিল দীর্ঘদিন মনে রাখার মত সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠান । রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে দুই পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার এবং ডাক্তার খোকন রায়ের আন্তরিক আমন্ত্রণে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন এখানে । রাজ্যের অন্যতম বলিষ্ঠ কবি নকুল রায়ের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানমঞ্চে ছিলেন পশ্চিম জেলাধিপতি ও সুকবি হরিদুলাল আচার্য । ছিলেন অধ্যাপক ড. নির্মল ভদ্র, ড. সৌভিক বাগচী, কবি সঙ্গীতা দেওয়ানজি, স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ড. উত্তম সাহাসহ আরো অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব । প্রত্যেক বক্তা তাঁদের আলোচনাতেই সাহিত্য-সমকাল-সৃজনচর্চা বিষয়ে মনোজ্ঞ অনুভব ব্যক্ত করেছেন । আকস্মিক আহুত হয়ে দর্শক আসন থেকে উঠে গিয়ে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমিও সামান্য কিছু উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলেছিলাম এদিন । আমাকে মঞ্চে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন রাজ্যের এই প্রজন্মের একজন সুঅভিনেতা, বাচিকশিল্পী এবং প্রাণচঞ্চল সংস্কৃতিপ্রেমী শিশির অধিকারী Sisir Adhikari  ও এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা নবোন্মেষ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ সরকার Gouranga Sarkar  । আপ্যায়ণ, আলোচনা, নাচ, গান, কবিতাপাঠ, ভালো খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে একটা প্রাণের ছোঁয়া ছিল গোটা অনুষ্ঠানটাকে ঘিরে ।

Sunday, October 8, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীভাবনা ও দুর্গাপূজার প্রাচীনতা : লোকপুরাণ ও প্রামাণ্য তথ্য

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীভাবনা ও দুর্গাপূজার প্রাচীনতা  :  লোকপুরাণ ও প্রামাণ্য তথ্য

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক  ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে  অম্ভৃণি ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷
প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । এমনকি ত্রিপুরার রাজাগণ একসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগেও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন । খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজা ছেংথুমফা বা নামান্তরে কীর্তিধর মেহেরকুল ( প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটিকারা রাজ্য ) জয় করেছিলেন । তিনি ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী কোনো এক রাজাকে পরাজিত করে মেঘনানদ পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন । মহারাজা বিজয়মানিক্য বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তী  সমগ্র সুহ্মদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল ও বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমসাময়িক বাংলায় যে ধর্মধারার প্রচলন ছিল তার প্রভাব ত্রিপুরার উপরও পড়ে । প্রাচীন বাংলাদেশের মানচিত্রে ত্রিপুরা কখনও বঙ্গ, কখনও সমতট, কখনও হরিকেল প্রভৃতি নামের ভূখন্ডের সঙ্গে মিশে ছিল । ফলে এই বিস্তীর্ণ প্রাচীন অঞ্চলের সঙ্গে ত্রিপুরার নিবিড় যোগাযোগ ছিল । মানুষজনের আসা-যাওয়া ছিল । রাজসভাসদদের মধ্যেও বাংলাদেশের মানুষেরই প্রাধান্য ছিল । তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে ত্রিপুরার সেই সময়ের শাসকবৃন্দ ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীপূজার প্রচলন করেন ।

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস অনুধাবন করলে জানা যায় যে, ডাঙ্গরফার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নফা গৌড়ের নবাবের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করেন । কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি গৌড়ের নবাবকে  একশ হাতিসহ একটি মণি উপহার দেন । গৌড়েশ্বর তাঁকে মানিক্য উপাধি প্রদান করেন । সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা মানিক্য উপাধি ব্যবহার শুরু করেন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে রত্নমানিক্য ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা সিংহাসন দখল করলেও আগরতলার মিউজিয়ামের রক্ষিত রত্নমানিক্যের যে মুদ্রা দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের ও অন্যটি ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী রত্নমানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয় । কারণ, পরবর্তীকালে রাজা মুকুট মানিক্যের ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া যায় । রত্নমানিক্যই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার অন্যান্য রাজারাও মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । এইসব মুদ্রা ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি । ভাষা সংস্কৃত হলেও হরফ ছিল বাংলা । ব্যবহৃত অব্দ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শকাব্দ ও পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরাব্দ । এই মুদ্রাগুলিতে পুরুষদেবতার সঙ্গে স্ত্রীদেবতার প্রতীকও অঙ্কিত থাকত । শিবদুর্গা, হরপার্বতী, লক্ষীনারায়ন ইত্যাদি দেবদেবী ও প্রতীক হিসাবে দেবীবাহন সিংহ, ত্রিশূলও মুদ্রাতে উৎকীর্ণ থাকত । 

দ্বিতীয় রত্নমানিক্যের ( ১৬৮৫–১৭৭২ ) কীর্তি হলো প্রাচীন কৈলাগড় বা কসবা দুর্গে মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা, ভগবতীর মূর্তি স্থাপন । এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিকগণের মতে কল্যাণ মানিক্য কসবায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন রত্নমানিক্য । এই সম্পর্কে প্রাচীন রাজমালায় আছে—

" কসবাতে কালী মূর্তি করিল স্থাপন
 দশভূজা ভগবতীর পতিত তারণ ।"

 দশভুজা দেবীমূর্তি হলেও এটি সাধারণ্যে জয়কালী মন্দির বা কসবা কালীবাড়ি নামে পরিচিত । ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এই মূর্তিটির ব্যতিক্রমী রূপ বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । এই রত্নমানিক্য বারানসী থেকে মূর্তি এনে কুমিল্লায় রাজরাজেশ্বরী বিগ্রহকে স্থাপন করেন । এই প্রসঙ্গে ত্রিপুর বংশাবলিতে আছে—

"মহারাজ রত্ন মানিক্য বাহাদুর 
কাশীধাম হইতে কালী আনিল সত্ত্বর
 সেই কালি কুমিল্লা নগরের স্থাপিল
 রাজরাজেশ্বরী বলি নামকরণ দিল ।"

ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মানিক্যের কীর্তি ত্রিপুরার আরেকটি মন্দির উদয়পুরের মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির । এটি ৫১ পীঠের একপীঠ বলা হয় । এখানে দেবীর দক্ষিণপদ পড়েছিল । পীঠমালা তন্ত্রে উল্লেখ আছে–

ত্রিপুরায়াং দক্ষিণপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বভিষ্ট ফলপ্রদঃ ।

কথিত আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া অমরপুরে অমরসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে মঙ্গলচন্ডীর মন্দির । অমরপুরের গভীর অরণ্যে গোমতী নদীর তীরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা দেবীমূর্তি রয়েছে । স্থানটিকে ছবিমুড়া বলা হয় । পিলাকের প্রত্নক্ষেত্রেও দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে । আগরতলা শহরে রয়েছে লক্ষীনারায়ণ মন্দির । দিঘির পূর্ব পাড়ে উমামহেশ্বর মন্দির অবস্থিত । ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মহকুমা সদরে কিম্বা মহকুমার মধ্যে বহু দেবীমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । তার মধ্যে সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়াকালী বাড়ি, মুহুরীপুরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, কমলপুরে কমলেশ্বরী, কুমারঘাটে ভুবনেশ্বরী মন্দির, ধর্মনগরের কালিবাড়ি বিখ্যাত । একদিকে বাংলার শক্তিপীঠসমূহ অন্যদিকে আসামের শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দিরের প্রভাবে ত্রিপুরাও শক্তি আরাধনার একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সুবাদে ত্রিপুরা রাজ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে কালিকাপূজা ও দুর্গাপূজা প্রচলন রয়েছে । রাজন্য প্রতিষ্ঠিত দুর্গাবাড়ি ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায় প্রাণকেন্দ্রে  রয়েছে । এখানে নিয়মিত দেবীর পূজার্চনা হয় । এখানে দেবীবিগ্রহের হাত দশটি নয় । দুটি । এপ্রসঙ্গে একটি প্রচলিত মিথ রয়েছে । ত্রিপুরারাজের জনৈক মহারানি নাকি দেবীর দশহাত দেখে মূর্ছিতা হয়ে পড়েছিলেন । তাই রাজাদেশে এখানে দেবীর দশহাতের পরিবর্তে দুহাতের প্রচলন করা হয় । 

ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন প্রামাণ্য তথ্য এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব । 

রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৪ ) ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি ১৬৩২ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( জুন-জুলাই ১৭১০ ) খ্রিস্টাব্দ রত্নমানিক্যের আমলে রত্নকন্দলি ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূতকে ত্রিপুরার রাজধানী রাঙামাটিতে ( বর্তমান উদয়পুর ) পাঠিয়েছিলেন । সেই ভ্রমণকাহিনির উপর ভিত্তি করে অহমিয়া ভাষায় লেখা হয়েছিল "ত্রিপুরা দেশের কথা" । এটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরচন্দ্র সেন । এই ভ্রমণ বিবরণীতে সেকালের ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে । এই বিবরণীটির সপ্তম অধ্যায়ে ত্রিপুরার দূতগণের দুর্গোৎসব দর্শনের বর্ণনা রয়েছে–

"ত্রিপুরার দুতগণের বিদায় দেওয়া হইয়া গেলে পর দুর্গোৎসবের কাল আসিল । তখন মহারাজা বড়বড়ুয়াকে দিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তাহারা সেখানের দুর্গাপূজা দেখিতে ইচ্ছা করে কিনা ।' এই কথা শুনিয়া ত্রিপুরার দূতগণ বলিলেন, 'বড়বড়ুয়া, নবাবের অনুগ্রহে যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করিতে পাই ; ঠাকুরানীর দর্শন করিতে পাই  তবে আমাদের পরম ভাগ্য বলিতে হইবে ।" এরপর মহারাজের আদেশে এই দূতদ্বয়কে অষ্টমীর দিন সূর্য, গণেশ, নারায়ণসহ দুর্গাপূজার জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেবী দুর্গাকে দর্শন করানো হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুপ্রাচীনকালেও ত্রিপুরারাজ্যে দেবীদুর্গা পূজার প্রচলন ছিল । এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীভাবনা ও দেবীপূজার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে স্থানাভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. শ্রী রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
২. ত্রিপুরা রাজমালা–পুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী
 ৪. ত্রিপুরার ইতিহাস–ডক্টর জগদীশ পণ চৌধুরী 
৫.ত্রিপুরার ইতিহাস–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. শতাব্দীর ত্রিপুরা–সম্পা.  নির্মল দাস     রামপ্রসাদ দত্ত
 ৭. ত্রিপুরার স্মৃতি–শ্রী সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন
 ৮. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৯. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

Monday, October 2, 2023

রমাপ্রসাদ গবেষণাগার

রমাপ্রসাদ গবেষণাগার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আটের দশকে আমি নিয়মিত যেতাম রমাপ্রসাদ গবেষণাগারে । পল্টুদার সঙ্গে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতাম তাঁর গবেষণাগার ঘেঁটে, বই পড়ে । আমি, পল্লব ভট্টাচার্য, হরিসূদন বসাক, পল্টুদা ক্যারাম খেলতাম সামনের খোলা জায়গাটায় । তিন আমাকে গবেষণাগারের সদস্যও করেছিলেন । যক্ষের মতো আগলে রাখতেন তাঁর ধন । কোনো কিছু জেরক্স করার দরকার হলে হাতছাড়া করতেন না । সঙ্গে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে পাঠিয়ে জেরক্সের পর আবার তাঁর হেফাজতে নিয়ে নিতেন । সেদিন যেসব দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্র দেখেছিলাম তিনি সুশৃঙ্খলভাবে ফাইলবন্দী করে রেখেছেন তার পুরোটাই গায়েব হয়ে গেছে । তাঁর নিজস্ব রচনাগুলোরও ফাইল ছিল দেখেছি । ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট দিতে পারত সেদিন । এখন অনেক লুটেরাই ডক্টরেট হবে তাঁর সম্পদ গিলে ।

Saturday, September 30, 2023

ত্রিপুরার বাংলাভাষা

ত্রিপুরার বাংলাভাষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

ত্রিপুরায় প্রচলিত বাংলাভাষার মধ্যে সম্প্রতি একটা নিজস্বতা তৈরি হচ্ছে । এখানকার বাংলাভাষাটাকে জানতে হলে এই অঞ্চলের ভূগোল ও ইতিহাসকে একটু জানতে হবে । বর্তমান যে ত্রিপুরা তা একসময়ের রাজন্য ত্রিপুরা বা পার্বত্য ত্রিপুরা নামে পরিচিত ছিল  । ১৯৪৮ সালের ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরার রাজ্য ভারতভূক্ত হয় । রাজন্য আমলে ত্রিপুরার সন্নিহিত পূর্ববঙ্গের  কুমিল্লা, নোয়াখালি ও শ্রীহট্টে কিয়দংশ ছিল ত্রিপুরার রাজাদের জমিদারী যা চাকলা রোশনাবাদ বা জিলা ত্রিপুরা নামে খ্যাত । ভারতভাগের পর চাকলা রোশনাবাদের মানুষ তাদের রাজার তালুক ত্রিপুরারাজ্যে আশ্রয় নেন । ফলে ত্রিপুরারাজ্যের বিভিন্ন অংশে তৎসীমান্তবর্তী পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের মানুষের ভাষাটাই বেশি প্রচলিত । ফলে ত্রিপুরার উত্তরাংশে সিলেটি প্রভাব রয়েছে । আগরতলা ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রভাব, উদয়পুর, অমরপুর, সোনামুড়া কুমিলা ও কিয়দংশ নোয়াখালি প্রভাবিত । বিলোনিয়া, শান্তিরবাজার নোয়াখালি, সাব্রুম নোয়াখালি ও চট্টগ্রাম প্রভাবিত । মোটামুটি এরকম হলেও রিহ্যাবিলিটেশনের কারণে কোথাও কোথাও এই সূত্রটি মেলে না । রিফিউজি পুনর্বাসনের কারণে কুমারঘাটে 'চিটাগাং বস্তি' আছে । আবার দক্ষিণের সাতচাঁদে তিতাস পারের মানুষ আছেন । এছাড়া সামাজিক সম্পর্কজনিত কারণে এক অঞ্চলের ভাষাভাষী পরিবারের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা মিশে গেছে । এছাড়া অল্পস্বল্প বাংলাদেশের অন্য জেলার মানুষও রয়েছেন । এককথায় ত্রিপুরা একটা মিনি বাংলাদেশ বলা যায় ।‌ আরো কিছু সুক্ষ্ম বিভাজন করা যায়, তবে এই জাতীয় মিশ্রণের ফলে এখানে একটা নতুন ভাষাধারা রূপ নিচ্ছে ভাষাতাত্ত্বিক নিয়মেই ।

Monday, September 18, 2023

ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি

ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হলেও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র । এখানে সরকার কর্তৃক ছয়টি স্বীকৃত ধর্ম হল– ইসলাম, খ্রিস্টানদের দুটি গ্রুপ, হিন্দু, বৌদ্ধ ও কনফুসিয় । জনসংখ্যার ৮৬.১শতাংশ মুসলমান, ৮.৭ শতাংশ খ্রিষ্টান, এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৩ শতাংশ । ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়াতে ৪৬,৪৬,৩৫৭ জন হিন্দু আছে । ইন্দোনেশিয়া মিশ্র সংস্কৃতির দেশ । ইন্দোনেশিয়া আগে কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের ( দ্বীপপুঞ্জের ) সমষ্টি ছিল । তাদের নাম ছিল জাভা, সুমাত্রা, বোর্ণিও, বালি ইত্যাদি । খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করে । খ্রিস্টীয় পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় এক হাজার বছর ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছিল । সে হিসেবে তারা হিন্দু ধর্মকে অনুসরণ করেছিল । রাজারা হিন্দু দেবতাদের উপাসনা করতেন এবং বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ।

ভারতবর্ষ ও  ইন্দোনেশিয়ার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে রামায়ণের কাল থেকে । যবদ্বীপ বা জাভা-র কথা ভারতের প্রাচীনতম মহাকাব্য রামায়ণের উল্লেখ আছে । সুগ্রীব সীতার খোঁজে তাঁর সৈন্যদের জগতে পাঠিয়েছিলেন । ইন্দোনেশিয়া নামটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) থেকে এসেছে যার অর্থ ভারত এবং গ্রিক 'মেসোস' থেকে যার অর্থ দ্বীপ । এখানে সিন্ধু নদ বা সিন্ধু সভ্যতা না থাকলেও উভয় অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্যের কারণে এই নামকরণ হয়েছে ।  ইন্দোনেশিয়ান সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । জাভাতে প্রম্বানানের খোলা থিয়েটারে জাপানিজ মুসলমানরা পূর্ণিমার রাতে রামায়ণ নৃত্য পরিবেশন করে । ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে গভীর হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবের উদাহরণ নবম শতাব্দীর বোরোবুদুর এবং প্রম্বানান মন্দির । শৈলেন্দ্র রাজবংশের দ্বারা নির্মিত বোরোবুদুর মন্দিরের নকশা ভারতীয় গুপ্ত স্থাপত্যের প্রভাব রয়েছে । মধ্য দফার প্রম্বানান মন্দিরে হিন্দু স্থাপত্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । ইন্দোনেশিয়া মৌখিক ঐতিহ্য ও সাহিত্যের পান্ডুলিপি সংরক্ষণের লিপি ছিল সংস্কৃত । ইন্দোনেশিয়ায় আবিষ্কৃত অষ্টম শতাব্দীর প্রাচীন শিলালিপি গুলো যেমন 'কাংগল' শিলালিপি, তেমনি প্রথম সহস্রাবদের মুর্তিকল্পে শিবলিঙ্গ ও তার সঙ্গী দেবী পার্বতী, গণেশ, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, অর্জুন ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর ব্যাপক গ্রহণ নিশ্চিত করে । বালি, সুমাত্রা ও অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে হিন্দু সংস্কৃতির পুরোমাত্রায় বহমান এবং ইন্দোনেশিয়ায় ভারতের এই সংস্কৃতি যথেষ্ট সমাদর করা হয়ে থাকে । ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের গৌরবজ্জ্বল অতীত তারা বিসর্জন দেয়নি । বরং উত্তরোত্তর তার পরিচর্যা পরিবর্ধন করে দেশটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে । 

মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও হিন্দু ধর্মের অনেক দেবদেবীকেই ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে হিন্দু পুরাণে বর্ণিত পবিত্র পাখি গরুড়েএর নামেই ইন্দোনেশিয়ার সরকারি বিমান সংস্থা 'গরুড়' এয়ারলাইন্স নামকরণ করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার মিলিটারি গোয়েন্দা সংস্থার সরকারি ম্যাস্কট হল 'হনুমান' । তাদের লোকো কাহিনীতে 'নাগ' নামে সর্পপ্রতিম চরিত্র পাওয়া যায় । অনেক জায়গায় দেওয়ালে কুবেরের চিত্র অঙ্কিত হতে দেখা যায় । জাকার্তার সেন্ট্রাল পার্কে একাদশ ও বাহিত রথে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণকে সওয়ার হওয়ার স্থাপত্য ও দেখা যায় ।

Sunday, September 17, 2023

গণেশের বাহন ইঁদুর কেন ?

গণেশের বাহন ইঁদুর কেন ?

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

প্রশ্ন উঠতেই পারে এত এত প্রাণী থাকতে এই খুদে ইঁদুরকে কেন বিশাল বপু গণেশের বাহন করা হলো ? এ নিয়ে একটা পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে । দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় ক্রঞ্চ  নামে এক গন্ধর্ব ছিল । সে দেবসভায় গান পরিবেশন করে দেবতাদের মনোরঞ্জন করত । এভাবে সুখেই তার দিন চলছিল । একদিন সেই দেবসভায় বামদেব নামে এক মুনি এসে উপস্থিত হলেন । মুনি দেবসভায়  উপস্থিত হয়েই দেবতাদের কাছে গান গাওয়ার বায়না ধরলেন । মুনি এমন নাছোড়বান্দা যে দেবতারা মুনিকে অনুমতি দিতে বাধ্য হলেন । মুনি অনুমতি পাওয়া মাত্র বেসুরো গলায় গান গাইতে আরম্ভ করলেন । মুনির এই উদ্ভট গান শুনে ক্রঞ্চ আর হাসি চেপে রাখতে পারল না । সে ফিক্ করে হেসে ফেলল । তার হাসি মুনির দৃষ্টিগোচর হল । উপহাস করার অপরাধে মুনি তাকে অভিশাপ দিলেন যে, সে মর্তে ইঁদুর হয়ে জন্মগ্রহণ করবে । ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে ক্রঞ্চ কান্নাকাটি শুরু করল । সে মুনির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল । কিন্তু মুনি তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিলেন না । দেবতাদের অনুরোধে শেষে মুনি বললেন, গণেশ যদি তাকে তাঁর বাহন করে তবে সে ইঁদুর জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করবে ।

ক্রঞ্চ ইঁদুর হয়ে মর্ত্যে একটি মাঠের মধ্যে তার বাসা বাঁধল । সেই মাঠের কাছেই ছিল পরাশর মুনির আশ্রম । ইঁদুর প্রতিদিন আশ্রমের ফসল নষ্ট করত ও নানা রকম ক্ষতিসাধন করত । ফলে মুনিরা ও আশ্রমবাসীরা তার উপর ভীষণ বিরক্ত হয় । তারা অতিষ্ঠ হয়ে দেবতা গণেশের শরণাপন্ন হন । দেবতা গণেশ পরাশর মুনির আশ্রমে এসে ইঁদুরকে পাকড়াও করার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেন । একসময় ইঁদুর গণেশের হাতে ধরাও পড়ে । গণেশ যখন তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হন তখন ক্রঞ্চ গণেশের কাছে তার নিজের পরিচয় দেয় এবং পূর্ব অভিশাপের কথা জানায় । সে আরো জানায় যে, গণেশ যদি তাকে তাঁর বাহন করে নেন তাহলে সে মুক্তি পাবে । তখন গণেশ এই ইঁদুরকে তাঁর বাহন করে নেন । সেই থেকে গণেশের বাহন ইঁদুর ।

আজ আজ গণেশ চতুর্থী । সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রসঙ্গক্রমে গণেশের বাহন ইঁদুরের পৌরাণিক কাহিনিটি এখানে তুলে ধরলাম ।

Tuesday, September 12, 2023

নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান

নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 


 ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যময় দেশ । সুদূর অতীত থেকে বহু জনধারা এখানে এসে মিশেছে । সেইসঙ্গে মিশেছে নানাজাতির নানা সংস্কৃতি এখানকার মানুষের যাপনভুবনে । সহস্রস্রোতধারা মিলে মিশে হয়েছে নবীন ভারত । যার বৈশ্বিক নাম ইন্ডিয়া ।  সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের (  article- 1 ) ভাষায় দুটি নামই স্বীকৃত । এই দুই নামের সৃষ্টিতে কত প্রাচীন তথ্য, কত প্রাচীন ইতিহাস । আর সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক উপাদানকে ভুলে গিয়ে স্মরণকালের তথ্য নিয়ে চলছে মাতামাতি ।

 ভারতবর্ষের প্রাচীন নাম ছিল জম্বুদ্বীপ । যারা আক্ষরিক অর্থ 'জাম গাছে ভরা দ্বীপ' । সনাতন সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী জম্বুদ্বীপ শব্দের প্রকৃত অর্থ 'সাধারণ মানুষের বাসভূমি' । সূর্যসিদ্ধান্তসহ বিভিন্ন লিপিতে ও ধর্মগ্রন্থে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ আছে । প্রাচীনকালে ভারতকে 'আর্যাবর্ত'ও বলা হত । চন্দ্রবংশীয় রাজা ভরতের নামে এ দেশের নাম হয় ভারতবর্ষ । আমরা এখন শুধু ভারত বলি । 'ভারত' নামটি বিভিন্ন প্রাচীন সংস্কৃত পুরাণ থেকে এসেছে । ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মার মতে, 'ভরত' নামে এক প্রাচীন উপজাতির নাম অনুসারে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ হয়েছে । ঋকবেদে এই 'ভরত' নামক প্রাচীন উপজাতির উল্লেখ আছে । অনেক ঐতিহাসিকের মতে কলিঙ্গরাজ খারবেল-এর হস্তিগুম্ফার শিলালিপিতে 'ভারধবস' শব্দের ব্যবহার দেখা যায় এবং এই নাম গুপ্তযুগে ভারতবর্ষ নামে খ্যাতি লাভ করে । তেমনি 'ইন্ডিয়া' নামের পিছনেও বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে । খ্রিস্টপূর্ব তিনশো দুই অব্দে মেগাস্থিনিস ভারতে এসেছিলেন । তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তের নাম 'ইন্ডিকা' অর্থাৎ ভারত সম্পর্কিত । ক্লডিয়াস টলেমির ( ৯০–১৬৮খ্রি. পূ. ) ভূগোল গ্রন্থটিও এপ্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ । খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চমশতকে হেরোডোটাস এর সময়ে গ্রীক শব্দ 'ইন্দ' থেকে তার উৎপত্তি । প্রাচীন গ্রীকরা ভারতীয়দের বলত 'ইন্দোই' বা ইন্দাস/ইন্দুজ ( সিন্ধু ) নদী অববাহিকার অধিবাসী । সিন্ধুনদের আদি ফার্সি নাম হিন্দু থেকে ইংরেজিতে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি এসেছে । অ্যাংলো-স্যাকশনদের কাছে 'ইন্ডিয়া' শব্দটি পরিচিত ছিল এবং রাজা আলফ্রেডের Orosius অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায় । Middle English-এ  ফরাসি প্রভাবে শব্দটি Ynde বা Inde-তে পরিণত হয় । এটিই Early modern English-এ India হিসাবে পরিচিত হয় ।বর্তমান India নামটি ১৭শতক থেকে প্রচলিত । কাজেই আজকের দিনে India নামের উৎস নিয়ে যে বিতর্ক তা কতটা সঠিক সে নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে  । মোটকথা দেশের নাম পরিবর্তনের এই বিতর্কের ফলে ভারতবর্ষের কয়েকহাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে  ।  এত কিছু করেও এই দেশের মহাকালের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভারতবর্ষের সংস্কৃতির যে নান্দনিক সৌন্দর্য মানুষের অন্তরে গেঁথে গেছে তা কিছুতে এড়ানো যাবে না । 

আমাদের এক প্রান্তের সংস্কৃতি আর এক প্রান্তের জনগণের মধ্যে অজান্তেই প্রবাহিত হয়ে চলেছে । বহু প্রাচীনকাল থেকে বহু মানবের ধারা এ দেশে মেশার ফলে আজকের ভারতীয় সংস্কৃতি রূপ পেয়েছে । আর্যদের আগমনের পূর্বে এ দেশে অনার্যদের বসবাস ছিল । এদেশের আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক্ট, দ্রাবিড় ও ভোটচিনিয়, এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল । অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ইন্দোচিন থেকে আসাম হয়ে অস্ট্রিক জাতি বাংলাদেশের প্রবেশ করে অন্তত পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে । আর্যরা অস্ট্রিকদের 'নিষাদ' বলত । ভারতবর্ষে মূলত বিহার ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গ ও বিভিন্ন প্রদেশে এই অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, বিরহোর, কুরকু,সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি অস্ট্রিক জাতির অংশ । তাদের ভাষা ও অস্ট্রিক ভাষাবংশের অন্তর্গত । এদেশে কৃষিকাজের প্রচলন অস্ট্রিকদের উত্তরাধিকার । অস্ট্রিকদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল কৃষি নির্ভর । তারা কলা, লাউ, বেগুন, নারকোল, পান, সুপারি হলুদ, আদা প্রভৃতি ফসলের চাষ করত । হাতিকে তারা পোষ মানিয়েছিল । অস্ট্রিকরা সুতিবয়ন ও আখের রস থেকে চিনি তৈরি করত । তাদের মধ্যে পঞ্চায়েত প্রথার প্রচলন ছিল । বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিতেও তাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । কার্পাস, তাম্বুল মরিচ, নারিকেল, কদলী, গুবাক প্রভৃতি ফল অস্ট্রিক শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে পরবর্তী সময়ে বাংলা শব্দভান্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । বাখারি, খড়, খামার, খোকা, খুকি, ডাঙা, ডিঙা, চোয়াল, চোঙা, ঝাউ, ঝিঙা, ঝাঁটা প্রকৃতির শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারের স্থান করে নিয়েছে । বাঙালির অনেক প্রচলিত সংস্কার ও আচার অনুষ্ঠানে অস্ট্রিক জাতির প্রভাব রয়েছে যেমন কৃষি সম্পর্কিত পৌষপার্বন, নবান্ন ইত্যাদি উৎসব চড়ক ও গাজন, পূজায় ঘটের ব্যবহার, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাল, দুর্বা, পান সুপারি, সিঁদুর, কলার ব্যবহার ও নানামুখী মেয়েলি ব্রত, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি অস্ট্রিক প্রভাবিত । তান্ত্রিক বৌদ্ধ, নাথপন্থ, ধর্মঠাকুর, লিঙ্গরূপী শিবপূজা, বৃক্ষপূজা, মাতৃপূজা ইত্যাদির মধ্যে অস্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাবনা বিদ্যমান ।আমাদের শাক্ত, বৈষ্ণবরা মাতৃকা ( রাধারানি ) উপাসক । সাঁওতাল গ্রামে গেলে সারিবদ্ধ মাটির বাড়ির সমস্ত দেওয়াল জুড়ে তাদের স্বকীয় চিত্রে ভরে উঠতে দেখা যায় । যেখানে অন্যান্য জাতির চিত্রকলায় ধর্মীয় ভাবাবেগ ও আস্থা ফুটে ওঠে সেখানে সাঁওতালি চিত্রকলায় প্রকৃতি এবং তাদের জীবন যাপনের চিত্রই হয়ে ওঠে প্রধান উপজীব্য । সে কারণেই সাঁওতালি চিত্রকলার এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে । 

অস্ট্রিক জাতির সমসাময়িক বা কিছু পরে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড়জাতি এদেশে আসে এবং দ্রাবিড় সভ্যতা বিস্তার লাভ করে । দ্রাবিড়রা সর্বপ্রথম বাংলাঅঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে । বাংলাদেশের মানুষ নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে অধিকাংশই দ্রাবিড় জাতির বংশধর । বাংলার ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর গভীর প্রভাব রয়েছে ।
বাংলার লোকধর্মে অধিদেবতার পূজা, পবিত্র বৃক্ষ ও প্রাণীর ধারণাগুলিকেও প্রাক্ বৈদিক দ্রাবিড় ধর্মের উদ্বর্তন হিসেবে মেনে নেওয়া হয় । আর্যদের আগমনের পর হতেই দ্রাবিড়দের সঙ্গে আর্যদের সংঘাত শুরু হয় । আর্যরা দ্দেরাবিড়র 'অসুর' বলে নিন্দা করত । বাংলার স্থাননামে এখনো দ্রাবিড় প্রভাব রয়ে গেছে । পূর্বভারতের পাঁচটি আদি জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, সুহ্ম সম্ভবত দ্রাবিড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল । এই পাঁচজন ছিলেন অসুররাজ বলির পুত্র । বলি অবশ্যই দ্রাবিড় সভ্যতার প্রাচীনতম কিংবদন্তির একজন । অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালিজাতি । এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান । আর্যদের সঙ্গে সংঘাতের  ফলে দ্রাবিড়রা ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে যায় । আর্যজাতি উত্তরভারতে, দ্রাবিড়রা দক্ষিণভারতে মোটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ৷  দ্রাবিড়জাতির ভাষার নামও দ্রাবিড় ৷ দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় গোত্রের প্রধান চারটি ভাষা হলো - কন্নড়, মালয়ালি, তামিল ও তেলেগু ৷ এই ভাষাভাষী অঞ্চল তাই দ্রাবিড়ভূমি ।
বাংলাভাষায় অস্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দও বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে ৷ একসময় সারা উপমহাদেশে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর প্রাধান্যের ফলেই বাংলাভাষায় দ্রাবিড় শব্দের প্রবেশ ঘটে ৷ দ্রাবিড় ভাষার কাল (সময়), কলা, পুষ্প, মুকুল, পূজা, গণ, কোণ, নীল, ফল, উলু, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, কুন্ড, খড়্গ, দন্ড, বিল, ময়ূর, কাক কাজল, কোদাল, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘুণ, কুটুম্ব, ডালিম্ব, নীল, মীন ইত্যাদি ৷ বাংলার বগুড়া, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ইত্যাদি ড়া, গুড়ি-যুক্ত স্থাননামে দ্রাবিড় প্রভাব রয়েছে ৷ এছাড়া উর, পুর, খিল তালক, পাঠক এগুলোও দ্রাবিড় শব্দ প্রভাবিত ৷ বাংলা ব্যাকরণের অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ভিতের উপর গড়ে উঠেছে ৷
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বাংলার উপরে দ্রাবিড় প্রভাব অত্যন্ত গভীরভাবে রয়েছে ৷ বাংলার দেবাদিদেব মহাদেব তো দ্রাবিড় পশুপতিনাথ শিব ৷ আর শৈবসাধনা হলো যোগসাধনা ৷ দ্রাবিড়দের এই সাধনপদ্ধতি বাংলার আধ্যাত্মিক জীবনের গভীরে প্রোথিত ৷ এভাবেই দ্রাবিড় অনার্য দেবদেবীদের মধ্যে চান্ডী(চন্ডী), মঞ্চাম্মা (মনসা) প্রভৃতি এবং উমা, বিষ্ণু, জগন্নাথ,বাসুদেব, শক্তি, শীতলা, বৃক্ষপূজা, যুগলমূর্তি পূজার প্রচলন এসেছে ৷ কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন হরপ্পা সভ্যতা থেকেই বাঙালির মাতৃকা উপাসনার দ্রাবিড় উত্তরাধিকার ।
দ্রাবিড়রা নগরজীবনের পাশাপাশি কৃষিজীবনেও পারদর্শী ছিলেন ৷ সংষ্কৃত ব্রীহি ও তন্ডুল অর্থে ধান্য বোঝায় ৷ এদুটিই দ্রাবিড় ভাষা ৷ এতেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে দ্রাবিড়রা প্রাচীন ধান চাষও করতেন ৷ এককথায় দ্রাবিড়রা বহুভাবেই প্রাচীন বাংলার জনজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ৷

ইতিহাসের বিবর্তনে এক সময়ে পাশাপাশি থাকা একাধিক জনগোষ্ঠী যে কালক্রমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন তা হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানেই না । কিন্তু বহু বহু শতাব্দী প্রাচীনকালে পারস্পরিক সহাবস্থানের ফলে তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আত্মীকরণ ঘটে গেছে এবং তার রেশ যে বহু দীর্ঘ সময় পরেও জীবনের গভীরে বেঁচে আছে, তা দেখে চমকে উঠতে হয় । তার একটি নিদর্শন গতকাল হঠাৎ চোখে পড়ায় এই লেখার অবতারণা ।

গত পরশু এসেছি ব্যাঙ্গালুরুতে বড়ো শ্রীমানের কাছে । মানবেতিহাসের ধারা বেয়ে বাঙালির আদিরক্তের সন্ধানে এক খোঁজ মনে হল এই পরিক্রমণ । গতকাল বিকেলে এই মেট্রো শহরের এ ই সি এস লে-আউটে ঘুরতে ঘুরতে একটা কাফেটোরিয়াতে সপরিবারে ঢুকেছিলাম কিঞ্চিৎ জলযোগের জন্যে । ভেতরে ঢুকে বসতেই চোখ পড়ল সুদৃশ্য শোকেসের উপরের দিকে । ওপরের কার্নিশ জুড়ে টানা অস্ট্রিক চিত্রশিল্প, সাঁওতালি চিত্রের অলংকরণ । শান্তিনিকেতনে দেখেছি এ জাতীয় চিত্র । আমার সারা শরীর শিউরে উঠল । অতীত ইতিহাসের এক আবছা সময়ে এখানকার দ্রাবিড় জাতির পূর্বপুরুষেরা আর্যবিতাড়িত হয়ে প্রতিবেশী অস্ট্রিকদের সান্নিধ্য ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেও প্রতিবাসীসংস্কৃতি অজান্তেই রক্তে মিশে গেছে এবং তা বয়ে চলেছে আজও । এ যে তারই প্রতিফলন । ক্যাফেটোরিয়ার মালিক নিজেও জানেন না এই সৃজন তাঁরই পূর্বপুরুষের রক্তধারায় বয়ে আনা উত্তরাধিকার । সেই অধিকারেই অস্ট্রিকশিল্প স্থান পেয়েছে দ্রাবিড়ভুবনে । এই নির্মানই ভারতশিল্প । ভারতকথা । মহান ভারতের কথা । 'ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান' ।

এইসিটিএস লে-আউট, ব্যাঙ্গালুরু,
১২. ৯. ২০২৩.

Friday, September 8, 2023

ম'ানিকে মাগে হিতে'—অনুবাদ

সুপ্রভাত

আমি দক্ষিণ ভারতে বেড়াতে গেলে অনেকে আমার নাম শুনে জিজ্ঞাসা করেন , রায়ওয়ার্ডেনে ? আপনি কী শ্রীলংকার ? জানিনা আমার পূর্বপুরুষ সিংহলী কিনা । সমুদ্রপথে দক্ষিণবঙ্গে এসে বসতি গড়েছেন কিনা । সেটা গবেষণার বিষয় ।জিনগত সংযোগ  আমরা বাংলায় যাকে বলে নাড়ির টান থাকার ফলেই আমরা এখন শ্রীলংকার গানও বুঝতে পারি । সাম্প্রতিক ভাইরাল হয়ে যাওয়া 'মানিকে মাগে হিথে' গানটির কথা বলছিলাম । বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ তো হেলায় লংকা জয় করেছিলেন । তাহলে আমরা তাদের ভাষা বুঝবনা কেন । পড়ুন গানটির বঙ্গানুবাদ । ভালো লাগবে অবশ‍্যই ।

'মানিকে মাগে হিথে'–র বাংলা অনুবাদ

মানিকে মাগে হিথে মুদলে নুরা হেগুময়াইবি অ্যায়িলেয়ি

আমার মনের সমস্ত ভাবনা তোমাকে নিয়েই চলে, এ যেন এক আগুনের শিখা, জ্বলছেই

নেরিয়ে নুম্বে নাগে, মাগে নেত্তেরা মেহা ইয়ায়ি শিয়েয়ি

তোমার শরীরী আদল আমি চোখে হারাই, আমি সারাক্ষণ তোমাকেই দেখে চলি

মা, হিথা লাগামা দেওয়াতেনা, হুরু পেমাকা পাতেলেনা

তুমি আমার হৃদয়ের অনেক কাছে, যেন অনেককাল ধরেই তোমাকে চিনি

রুয়া নারি মানামালি সুকুমালি নুম্বাথামা

তুমি পরীর মতো, তুমি আমার প্রিয়তম

ইথিন এপা মাতানামাঙ্গু গাথা হিথা নুম্বা মাগেমা হ্যাঙ্গু

তুমি আমার লুকোনো মন খুঁজে বের করেছো, আর জটিল হয়ো না

আলে নুম্বাতামা ওয়ালাঙ্গু মানিকে ওয়েন্নেপা থাওয়া সুন্যাঙ্গু

আমার এই প্রেম শুধু তোমারই জন্য

গামে কাটাকারামা কেল্লা হিথা ওয়েলা নুম্ব রুয়াতা বিল্লা

এই গ্রামে তুমি সবচেয়ে বেশি বকবক করো, আমার মন তাতেই মজেছে

নাথিন্নেথা গাথামা আল্লা মাগে হিথাথ না মাটামা মেল্লা

তোমার চোখে যখন আমার চোখ পড়ল, আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি

কেল্পে কেক্সে ওয়েলা মাগে হিথা পাথথু ওয়েনাওয়াদা থাওয়া টিকাক

ওরে মেয়ে, আমার পরাণ জ্বলছে, আরও একটু কাছে আয়

কিতু মাতা পিসসু থাদাওয়েনা উইদিহাতা গাসসু

তোমার জাদু আমায় পাগল করে দেয়

ওয়া দুমু ইঙ্গিয়াতা মাথ্যু বাম্বারেকি মামা থাতু ইসসু, ওয়া ওয়াতাকারাগেনা রাসসু

তুমিই আমায় ডাকছো, আমি মৌমাছি, মধুর খোঁজে আছি

রথেন হিথা আরাগাথু বাম্বারা

একমাত্র আমার সঙ্গেই তোমার থাকা উচিত

মা, হিথা লাগামা দেওয়াতেনা, হুরু পেমাকা পাতেলেনা

তুমি আমার হৃদয়ের অনেক কাছে যেন অনেককাল ধরেই তোমাকে চিনি

রুয়া নারি মানামালি সুকুমালি নুম্বাথামা

তুমি পরীর মতো, তুমি আমার প্রিয়তম

মানিকে মাগে হিথে মুদলে নুরা হেগুময়াইবি অ্যায়িলেয়ি

আমার মনের মধ্যে সমস্ত ভাবনা তোমাকে নিয়েই চলে, এ যেন এক আগুনের শিখা জ্বলছে

নেরিয়ে নুম্বে নাগে, মাগে নেত্তেরা মেহা ইয়ায়ি শিয়েয়ি

তোমার শরীরী আদল আমি চোখে হারাই, আমি সারাক্ষণ তোমাকেই দেখে চলি

*** মাফ করবেন । অনুবাদ আমার নয় । নেট থেকে সংগৃহীত ।

Tuesday, September 5, 2023

সমুখে শান্তি পারাবার

সমুখে শান্তি পারাবার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শিক্ষকতা কখনই পেশা নয় । ব্রত । আর এই  ব্রতের সিদ্ধি আসে জীবনের শেষ প্রান্তে । ব্রতফল দিয়ে যায় গর্বিত অনুভব । অনর্বচনীয় প্রশান্তি । আজ শিক্ষক দিবসে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম সাব্রুমের দৌলবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে । আমার সঙ্গে মঞ্চে যাঁরা ছিলেন, বিদ্যালয় পরিদর্শক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, রাজ্যপাল পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক, এস এম সি কমিটির কর্মকর্তগণ প্রত্যেকেই আমার একসময়ের ছাত্র । বিদ্যালয়ের একটা বড়ো অংশের শিক্ষক আমার ছাত্র, কাউকে আবার ডিএল এড ও অন্যান্য ট্রেনিং প্রোগ্রামে পেয়েছি । বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে উচ্চশ্রেণিতে পাঠরত  কয়েকজনকে আমি পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ে আমার চাকুরির শেষলগ্নে একেবারে নিচের ক্লাসে পেয়েছিলাম । বেশ কয়েকঘন্টা আমার  জীবনের বিভিন্নসময়ের শিক্ষার্থীপরিবৃত হয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকটা গর্বে ভরে গিয়েছিল । দেখছিলাম স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিভাবে দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁরা । মনে মনে খুঁজছিলাম, তাঁদের কর্মতৎপরতার মধ্যে আমার অতীতের কর্মচঞ্চলতার কোনো অনুকৃতি আছে কিনা । আমি বিদ্যালয় পরিদর্শক ছিলাম । বর্তমানে বিদ্যালয় পরিদর্শক আমার ছাত্র জানাং মগ । জানাং শব্দটি পালি । সংস্কৃত জ্ঞানং থেকে পরিবর্তিত । মগ জনজাতিরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । সেকারণেই মগভাষায় ত্রিপিটকসূত্রে বহু পালি শব্দ রয়েছে । গত শতাব্দীর আট-নয়ের দশকে আমি ছাত্র হিসাবে পেয়েছি জানাংকে । বর্তমানে কঠিন দায়িত্ব সামলাচ্ছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষক দিলীপ দাস ও দিলীপ দেবনাথও আমার ছাত্র । দিলীপ দাস বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত । দিলীপ দেবনাথ রাজ্যপাল পুরস্কার প্রাপ্ত । শারীরিক সমস্যাকে সরিয়ে রেখে তাঁরা দুজনেই স্কুল, ছাত্র-ছাত্রী ও সহকর্মীদের নিয়ে মেতে আছেন । শিক্ষকদের মধ্যে যদুগোপাল দেবনাথ, শক্তিম দাস নিজ নিজ গুণ বিস্তার করে ছাত্রছাত্রীদের মনে স্থান করে নিয়েছেন । রামকৃষ্ণানুসারী যদুগোপাল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও গুছানো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন । গুণী শিক্ষক শক্তিম দাস চিত্রে চিত্রে ভরিয়ে দিয়েছেন স্কুলের দেয়াল । প্রতিবছর শিক্ষক দিবসে প্রকিশিত হয় বিদ্যালয়ের দেওয়ালপত্রিকা 'নতুন কুঁড়ি' । শিক্ষার্থীদের লেখালেখিতে পূর্ণ এই পত্রিকার সামগ্রিক অলংকরণ রক্তিমের । ২০০৭ সালে এই বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক অর্জুন শর্মা ছাত্রছাত্রীদের মননচর্চা বিকাশের লক্ষ্যে এই দেওয়াল পত্রিকার সূত্রপাত করেছিলেন । আজও তাঁর ও আমার সুযোগ্য ছাত্র শক্তিম দাস ফলেফুলে ভরিয়ে তুলছেন । বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণ এইসব শিক্ষকদের প্রচেষ্টারই সুবর্ণফসল । আরও যাঁরা শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন প্রত্যেকেই অত্যন্ত আন্তরিক ও অমায়িক । শিক্ষকতার ব্রতফল আমার জীবনসায়াহ্নে এই অনির্বচনীয় তৃপ্তি এনে দিয়েছে । দিয়েছে শান্তির বারি ।

Sunday, September 3, 2023

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি নিয়েই সংসার । জন্মগ্রহণ করলেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । মৃত্যুর হাত থেকে কারো পরিত্রাণ নেই । রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে পথের পাশের সহায় সম্পদহীন ভিখারি পর্যন্ত  সকলকেই একদিন মৃত্যুর কাছে পরাজয় মানতে হয় । মৃত্যু ধন, মান, গৌরবের তোয়াক্কা করেনা । এতটাই নির্দয় সে । কার্য, কারণ, জন্ম, মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের বৃত্তাকার পরম্পরাকে নিয়েই এই জগত সংসার চলছে । হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে, অনেকগুলি জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মধ্য দিয়েই জীবাত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে অর্থাৎ ব্রহ্মাত্মার সঙ্গে মিলিত হয় । জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাকুলতা ও তার পুর্ণতালাভের মাধ্যমেই আসে মোক্ষ বা মুক্তি । পরমাত্মায় বিলীন হয়ে গেলে জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে চলে যায় মানবাত্মা । যুগ যুগ ধরে  মোক্ষ ও মুক্তির জন্য, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য জীবাত্মা ক্রমাগত দেহান্তর ঘটাতে থাকে । কাজেই এই মৃত্যু বা দেহান্তর শোকের নয় । পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পথে এক একটি ধাপ পেরিয়ে যাওয়া মাত্র । আক্রান্ত বা জীর্ণ দেহকে পরিত্যাগ করে জীবাত্মা নতুন সুন্দর সুস্থ দেহ গ্রহণ করে আবার জীবন শুরু করে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে । মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কোন শোকের বিষয় নয় । প্রিয়জনকে হারিয়েও নির্মোহ নিলিপ্ত থাকা এই এক অদ্ভুত দার্শনিক উপলব্ধি । আর এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া এক প্রতীকী অনুভব ।

মানব জীবনচক্রের চারটি স্তর জন্ম, বয়সন্ধি, বিবাহ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমাজজীবনে নানাধরনের আচার অনুষ্ঠান চলতে থাকে । আচার দুই প্রকার । শাস্ত্রীয় ও লোকাচার । শাস্ত্রীয় আচার পালনের মধ্য দিয়ে ঐন্দ্রজালিক শক্তি বা বিভিন্ন দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রয়াস থাকে । লৌকিক আচারের মূল উদ্দেশ্য হল ইহজগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও মঙ্গললাভ । এতে শুধুমাত্র ব্যক্তিমঙ্গল নয়, সামাজিক মঙ্গল ও কামনা করা হয় । লৌকিক আচারের দুটি দিক । ক্রিয়া ও অনুষ্ঠান । মানব জীবনব্যাপী আচার বা ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানসমূহের মূলে রয়েছে আদিম মানুষের সর্বপ্রাণবাদী চেতনা । সর্বপ্রাণবাদের যে বিশ্বাসগুলো প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তা হল–ক) জীবিত বা মৃত মানুষের আত্মায় বিশ্বাস বা তার পূজা করা, খ) বস্তু বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস; এবং গ) বস্তুর মধ্যে অবস্থানরত কোন আত্মায় বিশ্বাস ও তার পূজা । এই বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট দৈবীভাবনার মূলে দুটি বিষয় রয়েছে । তার একটি হল ভয় বা ভীতিবোধ । অপরটি হল কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধাবোধ । পূজাপার্বণ আচার অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে এই দুই ভাবনা । ভয় বা ভীতিবোধের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক জড়িত । আত্মাকে সন্তুষ্ট করার প্রক্রিয়া রয়েছে কিছু কিছু শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান ও লৌকিক আচারে । ভয়ের সৃষ্টি হয় সৎকারহীন আত্মা, অপঘাতে বা দুর্ঘটনায় মৃতের অতৃপ্ত আত্মা, প্রভৃতি থেকে । আর স্বাভাবিকভাবে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে থাকে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ । এই শ্রদ্ধাবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে পিতৃপূজা বা পূর্বপুরুষপূজার ।

 বাঙালি বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষপূজারই ক্রমোত্তরণ । গবেষকদের মতে, বাঙালির প্রায় সমস্ত লৌকিক আচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এদেশের কোল, ভিল, মুন্ডা হো, শবর, খেরিয়া প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পরবর্তী সময়ে বাঙালিরা পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে । ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন–'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ পরলোক সম্পর্কে ধারণা প্রেরিত তথ্য পিতৃতর্পণ পিণ্ডদান শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান আভ্যুদায়িক ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা-৬০৭ ) ।

বাঙালি হিন্দুর পারলৌকিক ক্রিয়ার দুটি ধারা রয়েছে । একটি শাস্ত্রীয় ও অন্যটি লোকাচার । শাস্ত্রীয় ধারায় রয়েছে ক) অন্তেষ্টিক্রিয়া খ) অশৌচ এবং গ)  শ্রাদ্ধ । মৃতের সৎকারসাধন অর্থাৎ শবদাহকে বলা হয় অন্তেষ্টিক্রিয়া । মৃত্যুহেতু মনের অশুচিতাকে বলা হয় মরণাশৌচ । সেরূপ জন্মকালীন অশৌচ অর্থাৎ জন্মাশৌচও রয়েছে । 'শ্রদ্ধা' শব্দ থেকে এসেছে 'শ্রাদ্ধ' ।  'শ্রদ্ধা' শব্দের সঙ্গে 'অন' প্রত্যয় যোগে 'শ্রাদ্ধ' শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে । মৃত পুরুষের আত্মার তৃপ্তির জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশেষভাবে তৈরি অন্ন, ব্যঞ্জন, জল, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত ইত্যাদি প্রদান করাকে শ্রাদ্ধ বলে । পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দু ধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান ।

হিন্দুদের দাহকার্য যেখানে করা হয়  সেই স্থানকে শ্মশানভুমি বলা হয় । বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রেও সেই আচার অনুসরণ করা হয় । এক দুটি ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় । 'শ্মশান' শব্দটি সংস্কৃতভাষা থেকে আগত । সরাসরি বাংলায় ব্যবহারের ফলে তা তৎসম শব্দ । 'শ্মশান' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো–'শ্ম' শব্দের অর্থ মৃতদেহ বা শব । 'শন্য' মানে বিছানা । অর্থাৎ মৃতদেহের বিছানা । চলতি কথায় যে স্থানের শব দাহ করা হয় সেই স্থানটির নাম 'শ্মশান' । সাধারণত নদী বা বড়ো জলাশয়ের ধারেই শ্মশানক্ষেত্রের অবস্থান । এই শ্মশানে দেবী কালিকা বিরাজ করেন । শ্মশান ভূমি তান্ত্রিকদের সাধারণ ক্ষেত্র । একে তপস্যাভূমিও বলা হয় । দেবাদিদেব শিবও শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান । ছাইভস্ম গায়ে মাখেন । নির্জন শ্মশানে গেলে জীবনের শেষ পরিণতি উপলব্ধি করে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় । এই জন্য শ্মশানকে 'বৈরাগ্যভূমি'ও বলা হয় ।

মৃতদেহ নিয়ে শবানুগমন থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান পর্যন্ত শাস্ত্রীয় আচারের পাশাপাশি বেশ কিছু লৌকিক আচার ও পালন করা হয় বাঙালি হিন্দু সমাজে । মৃতদেহকে বাঁশের তৈরি মইয়ের মতো খাটিয়ায় ধাড়ার বা চাটাইর উপর শবকে শায়িত করে মৃতেরর পুত্রগণ ও নিকট আত্মীয়গণ কাঁধে করে শববহন করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে ।  প্রাচীন চর্যাপদে ও তার নিদর্শন পাওয়া যায়– 'চারিবাসেঁ গড়িলা রে দিয়া চঞ্চালী /  তঁহি তোলি সবরো ডাহ কএলা কান্দই সগুন শিয়ালী ।। /  মরিল ভবসত্তা রে দহ দিহে দিধলি বলী ।। / হের সে সবরো নিরেবন ভইলা ফিটিলি যবরালি ।। ( চর্যা–৫০ ) । শ্মশানযাত্রার  এই চিত্র বর্তমান বাঙালি হিন্দুসমাজেও প্রচলিত রয়েছে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচণ্ডীর গীতে 'কংস নদীর তটে আছে বড় রম্য স্থল' হিসেবে শ্মশানের চিত্র ফুটে উঠেছে ।

শবদাহের জন্য প্রয়োজন হয় অগ্নিকুণ্ডের । এই অগ্নিকুণ্ডকে বলা হয় চিতা । এই চিতায় মৃতদেহ সৎকারের জন্য তোলার আগে স্নান করিয়ে ঘি চন্দন মাখানো হয় । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে আমরা তার নিদর্শন পাই । রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রয়েছে–'রাবণেরে করাইল স্নান সিন্ধু জলে । /সুগন্ধি চন্দন লেপে কন্ঠে বাহু মূলে ।। তেমনি বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়ে পাই–'দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহু তরে । / করাইয়া স্নান শোয়াইল গঙ্গাধরে ।'  চিতায় শব স্থাপনের আচার হিসেবে মৃতের মস্তক উত্তর দিকে স্থাপন করার কথাও জানা যায় রামায়ণে–'করিলেন চিতা রাজা উত্তর শিয়রে / তিনজনে শোয়াইল চিতার উপরে ।' তবে কোনো কোনো অঞ্চলে দক্ষিণদিকে শবের মস্তক স্থাপনের রীতি প্রচলিত আছে । শব চিতায় তোলার পর মৃতের জ্যেষ্ঠপুত্র, অবর্তমানে কনিষ্ঠপুত্র চিতাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে ও মৃতের মুখাগ্নি করে শব সৎকারের সূচনা করে । দ্বিজমাধবের মঙ্গলচন্ডীর গীতে উল্লেখ আছে–'নানা কাষ্ঠ কুড়াইয়া জ্বালিল অনল ।। /  প্রদক্ষিণে অগ্নি দিল মুখের উপর ।।' বিষ্ণু পালের মনসামঙ্গলে আছে–'সনকা জ্বালিয়া কৈল এ মুখ আগুন ।' এ যুগের কবিদের কাব্যে চিতা শয্যার বর্ণনাটিও পাওয়া যায়–'চন্দন কাঠের চিতা করিল সে তীরে / বলিরাজ শোয়াইল তাহার উপরে ।' ( কৃত্তিবাস  ওঝা ) । এছাড়া বিপ্রদাস পিপিলাই লিখেছেন–'করিল বিচিত্র চিতা ক্ষিরোদের কূলে । / দিলেন চন্দন কাষ্ঠ ঘৃত বহুতরে ।' ঘনরামের রচনায় রয়েছে–'বেদের বিধান কুন্ড করিল রচনা । / পাতিল চন্দন কাষ্ঠ পরিপাটি ধূনা ।। / কলসে কলসে তায় ঢেলে দিল ঘি । /  কর শঙ্খ ত্যজে তবে চারি রাজার ঝি ।।' ( ধর্মমঙ্গল ) দাহকার্য সমাধান হবার পর চিতা ধোয়ানো বা 'চুল্লী শীতল' করার একটি আচারের নিদর্শন পাওয়া যায়  জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে–'আপনার উরু তুলি, তাহাতে বান্ধিয়া চুহ্লি, বাপের করয়ে অগ্নি কাজ । / গঙ্গাসাগরের পানি, আগর চন্দন আনি, ধর্মদেবের শরীর ধোয়ায় । / করিয়া উত্তম খাট, চাপায় আগর কাঠ, তাতে নিয়ে ধর্মকে শোয়ায় । / আগর চন্দন খড়ি, চাপায় অনেক করি, অনল ভেজায় তিন ভাই । / মন্ত্র পড়ে ব্রহ্মাহর, অগ্নি দিল মহেশ্বর, পুড়িয়া হইল ছাই । /  করিয়া অগ্নির কাজ, ধোয়ায় অঙ্গার কাষ্ঠ, তিন ভাই কান্দে উচ্চস্বরে । / করিলেন তর্পণ, পিণ্ড দিলেন তিনজন, তপস্যাতে চলিল সাগরে ।।' ( মনসামঙ্গল–জগজ্জীবন ঘোষাল ) ।দাহকার্য শেষ হওয়ার পর তিতা শীতল করে পিন্ডদান করা হত ।

মৃতের দাহকার্য অবশ্য সম্পাদনীয় বিষয় । সেকালে মৃতদেহ বাসি হতে দেওয়াও একটি গর্হিত কাজ বলে ধরে নেওয়া হত । লক্ষিন্দরের মৃত্যুর পর চাঁদ সদাগর স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন–'কান্দিতে কান্দিতে হইল দশ দন্ড বেলা । / জ্ঞাতি লোকে খোঁটা দিব দ্বারে বাসি মড়া ।। / ( পদ্মাপুরাণ–বিজয়গুপ্ত ) । সর্পাঘাত মৃত্যু হলে দাহকার্য করার বিধি ছিল না । এক্ষেত্রে মৃতদেহকে কলার ভেলায় তুলে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত । 'সর্পাঘাত হইলে অগ্নিতে না পুড়ে' ( পদ্মাপুরাণ  বিজয় গুপ্ত ) ।

মৃতের সৎকারের পর নির্দিষ্ট দিন অশৌচ পালন করার পর হয় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান । শ্রাদ্ধ আবার দুই প্রকারের । তেরাত্রির শ্রাদ্ধ ও অশৌচান্ত শ্রাদ্ধ । দুর্ঘটনা বা অপঘাতে মৃত্যু হলে তেরাত্রির শ্রাদ্ধ করা হয় । 'সোমাই পন্ডিত বলে স্থির কর মন / তেরাত্রি শ্রাদ্ধ হবে বেবস্থার বচন ।।' ( পদ্মাপুরাণ–বিজয় গুপ্ত ) ।‌ অশৌচান্তিক শ্রাদ্ধের উল্লেখ রয়েছে মহাভারতে–'পঞ্চ ভাই দিল পিণ্ড ক্ষত্রিয় বিধান / ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান ।'  শ্রাদ্ধ শেষে পিণ্ড জলে বিসর্জন দেওয়ার প্রথাও রয়েছে । 'শ্রাদ্ধ করি প্রভু পিণ্ড ফেলে সেই জ্বলে / গয়ালি ব্রাহ্মণ সব ধরি ধরি গিলে ।' ( শ্রীচৈতন্য ভাগবত বৃন্দাবন দাস ) । ধনবান ব্যক্তিগণ গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান করেন ও তর্পণ করেন । মৃতের উদ্দেশ্যে জল দানকে বলা হয় তর্পণ । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম গয়াতে গিয়ে পিন্ডদানের কথা উল্লেখ করেছেন–'পড়িয়া শুনিয়া পুত্র হয় সুপুরুষ / পিন্ডদান করে ধরিয়া তিল  কুশ ।' ( চন্ডীমঙ্গল ) । শ্রাদ্ধবাসরে গৃহকর্তার সামাজিক অবস্থান সাপেক্ষে ব্রাহ্মণকে অন্নদান, বস্ত্রদান, গোদান ও কাঞ্চন দান ইত্যাদি করা হত । দ্বিজ বংশীদাসের কাব্যে উল্লেখ আছে যে, চাঁদ সদাগর পিতার মৃত্যুর পর 'দানসাগর' শ্রাদ্ধ করেন–'চন্দ্রধরের মাতা পিতা মৈল কাল পায়্যা । / শত পুত্র কার্য করে এক পুত্র হয়্যা ।। / রজত কাঞ্চন ধেনু জল ভূমি আদি । / দানসাগর শ্রাদ্ধ কইল বৃষোৎসর্গ বিধি ।।' ( পদ্মা পুরাণ ) । বিপ্রদাসে পাই–'বিধি মতো শ্রাদ্ধ কৈল দানযজ্ঞ আদি । / ক্ষিতি পরিতোষ কৈল দিয়া রত্ন নিধি ।। / সুবর্ণের ভান্ডার পুরিয়া লক্ষ লক্ষ । / হেনমতে দ্বিজ দান করিল অসংখ্য' ( মনসা বিজয়–বিপ্রদাস পিপিলাই ) ।। কাশীরাম দাস লেখেন–'ত্রয়োদশ দিবসে করে শ্রাদ্ধ শান্তি দান / স্বর্ণদান ভূমিদান করে গবীদান' ( মহাভারত আদিপর্ব ) ।

বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ও প্রাচীন সাহিত্যে যে সমস্ত মৃত্যুজনিত লোকাচার দেখা যায়, সেগুলোতে সেসময়ের বাঙালি জীবনের চিত্রই কবিদের কাব্যে ফুটে উঠেছে । পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের সমাজ জীবনে পালিত আচারগুলোই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কবিদের বর্ণনায় ফুটে ওঠেছে । ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আচারসমূহের মূলধারা একই থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ব্যতিক্রম দেখা যায় । এই ব্যতিক্রম বা রূপান্তরের কারণেই কোনো আচারকে আঞ্চলিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় । পরবর্তীকালেও বাঙালি হিন্দুদের মধ্য সেই ধারাকেই অনুসরণ করতে দেখা যায় ।

শ্রাদ্ধ থেকে মঠোৎসর্গ : ত্রিপুরায় প্রচলিত লোকাচারে পূর্বপুরুষ পূজা

শ্রাদ্ধ থেকে মঠোৎসর্গ  :  ত্রিপুরায় প্রচলিত লোকাচারে পূর্বপুরুষপূজা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাস । চাকলা রোশনাবাদ নামে পরিচিত এই অঞ্চলটি ত্রিপুরার রাজার জমিদারি ছিল ।ত্রিপুরার রাজন্যআমলের জমিদারিত্বেও বাঙালির বসতি ছিল । রাজনৈতিক কারণে দেশ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেলে এই অঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় । ফলে এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্ত হয়ে তদানিন্তন পার্বত্য ত্রিপুরা তথা বর্তমান ভারতভুক্ত ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন । নিজেদের  ভদ্রাসন, সহায় সম্পদ, সে দেশে ফেলে এলেও পূর্বপুরুষের কাল থেকে নিজেদের রক্তধারায় প্রবাহিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে কিন্তু সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছেন । সে কারণেই  ত্রিপুরার বাঙালি সংস্কৃতি মূলত পূর্ববঙ্গীয় সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার । 

সেভাবেই এখানেও জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পালিত শাস্ত্রীয় ও লোকাচারেও পূর্বপুরুষদের পালিত আচার-আচরণ অনুসরণ করা হয় । মৃতের সৎকার বা দাহকার্য ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময়কালের মধ্যে আরো কিছু ছোটোখাটো অবশ্য পালনীয়  লোকাচার রয়েছে । মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে মৃতের আত্মাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত লোকাচার পালন করা হয় সেগুলো প্রকৃতপক্ষে 'টোটেম পূজা' বা 'পূর্বপুরুষ পূজা'র নামান্তর । এই পূর্বপুরুষ পূজার মধ্যে একটা ঈশ্বর ভাবনা নিহিত থাকে । ঈশ্বর ভাবনার মূলে রয়েছে প্রত্নমানুষের ভয়, বিস্ময় আর অজ্ঞানতা ।  আদিম মানুষ হিংস্র প্রাণী, প্রকৃতির রহস্য, পাহাড়-পর্বত, নদী আকাশ, ঝড়, বজ্রপাত ইত্যাদিকে যেমন ভয় করতে শিখেছিল তেমনি তারা মৃত্যুকেও ভয়ের চোখে দেখত । তারা লক্ষ্য করত যে মানুষটি এতদিন তাদের সঙ্গে কর্মচঞ্চল ছিল সেই মানুষটি হঠাৎ নিথর হয়ে যায় । আকস্মিক ঘটনাটিতে তাদের মনে ভয়ের উদ্রেক হয় এবং এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে  নানারকম অকল্যাণ চিন্তা করতে থাকে । প্রকৃতির বুকে ঘটে যাওয়া নানা বিপর্যয়কে তারা তাদের মৃত আত্মার অসন্তুষ্টির কারণ বলে মনে করতে থাকে ।  আত্মাকে ঘিরেই তাদের জীবনের নানারকম ক্ষতিকর প্রভাবের সম্পর্ক ভাবতে থাকে । ফলে মৃতব্যক্তির আত্মাকে সন্তুষ্ট করার তাগিদ অনুভব করে প্রত্নমানুষ । মৃতব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার আচার অনুষ্ঠানই হল পূর্বপুরুষ পূজা । ভারতের প্রাকবৈদিক যুগের সভ্যতার ধারক ও বাহক বিভিন্ন প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ দেখা যায় । অস্ট্রিক ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মানুষেরা বৃক্ষ পাথর নদী, বজ্র, বিদ্যুৎ  ও বিশেষ স্থানকে পবিত্র জ্ঞান করে তার উপর দেবত্ব আরোপ করে পূজা করত । তাদের অনেকে মূর্তি পূজা না করে কোন বিশেষ বিশেষ গাছের তলায় অথবা বিশেষ কোন স্থানে বড়ো বড়ো পাথর রেখে সেই পাথরকে মঙ্গলকারী দৈবীশক্তি হিসেবে মনে করে পূজা করত ।  

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক ক্রিয়ানুষ্ঠান ও লোকাচার রয়েছে । বাঙালির বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে মৃত্যুকেন্দ্রিক যে সমস্ত লোকাচার রয়েছে তা মূলত পূর্বপুরুষ পূজারই ক্রমউত্তরণ । গবেষকদের মতে বাঙালির প্রায় সমস্ত লোকাচারের মধ্যেই আদিবাসী সমাজের প্রভাব রয়েছে । বাঙালি জাতির উদ্ভবের মূলেও রয়েছে এ দেশের কোল, ভিল, মুন্ডা, হো, শবর, খেড়িয়া, বীরহোড় প্রভৃতি অস্ট্রিক জনজাতির প্রভাব । পূর্বপুরুষ পূজা সেই অস্ট্রিক উত্তরাধিকার । পরবর্তী সময়ে বাঙালি পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েছে ।  ফলে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানে আদিবাসী ও হিন্দু পৌরাণিক আচার-অনুষ্ঠানের বিচিত্র সমাহার ঘটেছে । এ সম্বন্ধে ড. নীহাররঞ্জন রায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন– 'বিশেষভাবে হিন্দুর জন্মান্তরবাদ, পরলোক সম্পর্কে ধারণা, প্রেততত্ত্ব, পিতৃ তর্পণ, পিন্ডদান, শ্রাদ্ধাধি সংক্রান্ত অনেক অনুষ্ঠান, আভ্যুদয়িক ইত্যাদি সমস্ত আমাদের প্রতিবাসীর এবং আমাদের অনেকেরই রক্তস্রোতে বহমান সেই আদিবাসী রক্তের দান ।' ( বাঙালির ইতিহাস, ড. নীহাররঞ্জন রায়, কলিকাতা, ১৯৮০, পৃষ্ঠা, ৬০৭ ) । পূর্বপুরুষগণ বা পিতৃপুরুষগণ ভারত ও চিনে অতি প্রাচীনকাল থেকেই গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মানের পাত্র । বহুকাল আগে থেকেই মৃতব্যক্তির আত্মাকে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হয় এবং নানা আচার-আচরণের মাধ্যমে মৃতের সন্তুষ্টি বিধান ও পরিবারের মধ্যে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়াস নেওয়া হয় ।

 বাঙালির মৃত্যুবিষয়ক সংস্কারগুলোর মধ্যে সৎকারপরবর্তী ও শ্রাদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালকে বলা হয় 'অশৌচকাল' । এই অশৌচকালীন সময়ে মৃতের পুত্র সন্তানেরা 'মাঠা' ( সাদা থান কাপড় ) পরিধান করতে হয় । সঙ্গে কুশাসন ও যষ্টি ব্যবহার করতে হয় । যষ্টি অর্থাৎ একটি হাত দেড়েক বাঁশের কঞ্চির মাথায় একটা পেরেক গেঁথে তা ব্যবহার করা হয় । গলায় পরিধেয় কাপড় থেকে সংগ্রহ করা সরু ফালি গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয় । সেই ফালিতে লোহা বা সিসের টুকরো ব্যবহার করা হয় । এই ফালি বা ধড়ায় ব্যবহৃত ব্যবহৃত লোহা বা সিসে এবং যষ্টিতে ব্যবহৃত পেরেক মৃতের সন্তানকে আত্মার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে বলে লোকবিশ্বাস রয়েছে । ধড়াটি ব্যবহার করারও বিধি রয়েছে । যদি ধড়াটি ডান বগলের তলায় দিয়ে এনে গলায় ঝুলানো হয় তাহলে ওই ব্যক্তির পিতৃবিয়োগ ঘটেছে বলে ইঙ্গিত করে । অনুরূপভাবে বাঁ বগলের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে গলায় ঝুলালে মাতৃবিয়োগের বিষয়টি চিহ্নিত করে । আসলে বিষয়টির মধ্যে সামাজিক সহমর্মিতার বোধ নিহিত রয়েছে । বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পিতা বা মৃত্যুর কথা উচ্চারণ করে ভাগ্যহীনকে বিষাদাচ্ছন্ন হতে হয় না । প্রিয়জন বা পরিচিতজনেরা বেশভূষা দেখেই বুঝতে পারেন । তাঁরাও বিষয়টির পুনরুদ্রেক ঘটান না ।  অশৌচ পালনের কয়দিন মৃতের পুত্রগণ তৃণশয্যায় শয়ন করেন । হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন । ওই কয়দিন স্নানের পর নির্দিষ্ট একটি স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে পানীয় ও ফলাহার নিবেদন করেন । পানীয় নিবেদনেরও একটি বিশেষ নিয়ম রয়েছে । পাশাপাশি দুটো ছোটো বাঁশের খুঁটিতে আড়াআড়ি একটি বাঁশ বেঁধে তার মধ্যে বাঁশের নলি ঝুলিয়ে সেই নলিতে জল নিবেদন করা হয় । নলির তলায় সুতলি বা কাপড়ের টুকরো জাতীয় কিছু বেঁধে দেওয়া হয় যাতে নলি থেকে জল ছুঁয়ে চুইয়ে পড়ে । যেখানে এই জল পড়ে সেখানে মাটির উপরে এক বিশেষ ধরনের দূর্বা ( ঘোড়া দূর্বা ) বসিয়ে রাখা হয় । লোকবিশ্বাস, এই দূর্বা যদি সতেজ থাকে ও বৃদ্ধি পায় তাহলে মৃতের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখ ও শান্তিময় হবে । মৃতের উদ্দেশ্যে যে ফল জলাদি নিবেদন করা হয় তা সন্তানের জন্য সংগৃহীত আহারাদির প্রথম অংশ । মৃতকে নিবেদন না করে তাঁরা আহার্য গ্রহণ করেন না । এই ফলাহার নিবেদনের সময়  'আয়, আয়' বলে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো হয় । এই আচারটিকে 'কাকবুলি' বলা হয় । লোকবিশ্বাস রয়েছে এই সময়ে মৃতের আত্মা শকুন, কুকুর, কাক প্রভৃতি ইতর প্রাণীর রূপ ধরে ধারণ করে থাকে । ভক্তিপূর্ণ চিত্তে আহ্বান জানালে কাকরূপী আত্মা এসে সেই খাবার খেয়ে যান । অশৌচকালীন সময়ের মধ্যে শনি, মঙ্গলবার অথবা অমাবস্যা ভিন্ন যে কোন তিনটি শুভ দিনে তিনটি মাটির হাঁড়িতে উঠোনের এক কোণে লাকড়ির চুলায় আতপান্ন রান্না করে উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় । মৃতের জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্র এটি প্রস্তুত করেন এবং রান্নার সময় মৌন থাকেন । এটাকে 'পাতিল পোড়া' বলা হয় । এই 'পাতিল' উত্তরপ্রজন্মের কল্যাণকামনায় পোড়ানো হয় বলে লোকবিশ্বাস । রান্নার সময় মাটির হাঁড়িটি যদি তাপে ফেটে যায় তাহলে পরিবারের ভবিষ্যৎ অকল্যাণের আশঙ্কা করা হয় । অশৌচের সমাপ্তিদিনে মস্তকমুন্ডন, স্নানাদি করে শুদ্ধ হয় । অশৌচকালীনসময়ে মৃতের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত জল ও খাবার নিবেদনের জন্য তৈরি করা বাঁশের নলিগুলোও অন্যান্য সামগ্রী সেইসঙ্গে জলে বিসর্জন দেওয়া হয় । পরদিন ব্রাহ্মণবিধিমতো শ্রাদ্ধকার্য করা হয় ।

এছাড়াও, এই অঞ্চলে শ্রাদ্ধোত্তর সময়ে পর পর কয়েকটি লোকাচার পালন করা হয় । এগুলো হলো ১. ভাত বাড়ানি ২. মৎস্যস্পর্শ বা মাছ ছোঁয়া ৩.অস্থিবিসর্জন ও ৪. মঠোৎসর্গ । শ্রাদ্ধের দিন রাত্রিবেলা মৃতের কন্যা পুত্রবধূ ও অন্যান্যরা মিলে মৃতের উদ্দেশ্যে অন্নব্যঞ্জন, পিঠেপায়েস, মিষ্টি খাবার ইত্যাদি প্রস্তুত করেন । মৃত ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় যেসব খাদ্য খেতে ভালোবাসতেন সেগুলোসহ তাঁর পছন্দের পিঠেপুলি ইত্যাদি তৈরি করা হয় । তাঁর জন্য ( জীবদ্দশায় অভ্যাস থাকলে ) পান তামাক ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করা হয় । এ সময় শ্রাদ্ধবাসরে বিশেষ কীর্তন চলতে থাকে । কীর্তনের শেষে মৃতের সন্তানগণও পরিবার-পরিজন মৃতের উদ্দেশ্যে রোদন করেন ও ধুলোয় গড়াগড়ি যান । এই গান যে শিল্পী পরিবেশন করেন তিনি এক বিশেষ ধরনের পোশাক ব্যবহার করেন । দক্ষিণ ত্রিপুরায় এই কীর্তনকে 'হটিকীর্তন' বলা হয় । কীর্তনে নিমাইসন্ন্যাস, হরিশচন্দ্রের শ্মশানমিলন ইত্যাদি বিয়োগান্তক পালাকীর্তন পরিবেশন করা হয় । শ্রীহট্টীয় সংস্কৃতিপুষ্ট অবিভক্ত উত্তর ত্রিপুরার শ্রাদ্ধবাসরেও এই ধরনের কীর্তন পরিবেশনের আচার রয়েছে । তাকে 'যমকীর্তন' বলা হয় । দক্ষিণ ত্রিপুরার হটিকীর্তনের সঙ্গে তার পরিবেশন প্রকরণে তারতম্য থাকলেও কিন্তু একই উদ্দেশ্য ফল্গুধারার মত প্রবাহিত । গোষ্ঠলীলার বিষয়ে যেমন মায়ের সঙ্গে সন্তানের ক্ষণিক বিচ্ছেদ বেদনার আবহাওয়া রয়েছে তেমনি নিমাই এর সন্ন্যাসযাত্রা ও এক বিচ্ছেদ বিধূর কাহিনি, তেমনি ভাগ্যদোষে রাজা হরিশচন্দ্রেরও স্ত্রীপুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্মশানচন্ডালের জীবিকায় দিনযাপন ও বেদনাঘন । শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এই পালাগুলো নির্বাচনের মধ্যেও অনির্দেশের পথে চলে যাওয়া প্রিয়জনের জন্য বেদনার সুরটিই ধ্বনিত । সেই বেদনার প্রকাশের প্রতীকী রূপ এই জাতীয় সংগীত । স্থানভেদে প্রকাশভঙ্গি আলাদা কিন্তু অভিপ্রায় এক ।

এরপর বাড়ির পাশে একটি নির্জন স্থানে মৃতের উদ্দেশ্যে খাদ্য পরিবেশন করা হয় । এই লোকাচারটি 'ভাত বাড়ানি' বলা হয়  পরিবারের সমস্ত সদস্যরাও আত্মীয়-স্বজন রাতের খাবার গ্রহণ করেন । এখানে আর একটি লোকাচার পালিত হয় । এই রাতে খাওয়ার জন্য এমন কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করা হয় যাদের পিতামাতা উভয়ই পরলোকগত । তাদের খাদ্য গ্রহণের এই আচারটিকে বলা হয় 'ভুরিভোজ' । খাওয়া দাওয়ার পর উপস্থিত সবাই মৃতের উদ্দেশ্যে যেখানে খাদ্য নিবেদন করা হয়েছে সেখানে গিয়ে যাচাই করেন সমস্ত খাদ্য গ্রহণ করা হয়েছে কিনা । কোন ইতর প্রাণীও যদি সেই খাবার খেয়ে যায় তাহলে সবাই খুশি হন । কোনো ইতর প্রাণী এসে এই খাবারের স্বাদ নিলে মৃতের আত্মা সন্তুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন । পাশাপাশি তাঁরা আত্মার কাছে প্রার্থনা করেন যে, তিনি যেন তাঁর পরিবারকে ভুলে না যান এবং অলক্ষ্যে থেকে পরিবারটিকে ভালোবাসেন এবং তাদের সুখশান্তির জন্যে আশীর্বাদ করেন । আর অভুক্ত খাবার পড়ে থাকলে কোথাও ত্রুটি হয়েছে মনে করে মৃতের উদ্দেশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করেন এবং আহার গ্রহণের জন্য মৃতের আত্মাকে আমন্ত্রণ জানান । এই আচারটি আবার কোথাও কোথাও বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন করা হয় । লোকবিশ্বাস, মৃতের আত্মা একবছর তাঁর বাড়িঘরের, পরিবারের আশেপাশেই বিচরণ করেন । সেসময় তিনি অভুক্ত থাকেন । বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন খাবার গ্রহণের পর আত্মা প্রেতলোকে চলে যায় ।

শ্রাদ্ধের পর তিন দিনের মধ্যে সেরে নিতে হয়  মৎস্য স্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুষ্ঠান । শনি, মঙ্গলবার, অমাবস্যার ইত্যাদি দিন বাদ দিয়ে অতি দ্রুত এই অনুষ্ঠান সেরে ফেলা হয় । এ দিন মূলত মৃতের পুত্রের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের মাধ্যমে এই আচার পালিত হয় । আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী সবাই এক পংক্তিভোজনে মিলিত হয়ে মৃতের পুত্রগণ মাতুল ও ব্রাহ্মণের নিকট থেকে মৎস্যস্পর্শ বা মাছছোঁয়ার অনুমতি আদায় করে । সেদিন থেকে তাদের আর নিরামিষ আহার করতে হয় না । এরপর সময় সুযোগ করে মৃতের পুত্রদের মধ্যে কেউ কেউ শবদাহের পর সংগৃহীত অস্থি পবিত্র কোন নদীতে বিসর্জন দেন । কেউ কেউ এ সময় গয়াতে গিয়ে  পিন্ডদান করেন  । তারপর অস্থি নিয়ে প্রয়াগে ত্রিবেণীসঙ্গমে মস্তক মুন্ডন করে তা বিসর্জন দেন । হিন্দুসমাজে এ নিয়ে সুন্দর শাস্ত্রীয় আচার রয়েছে । শাস্ত্রকাররা বলে গেছেন, 'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা' এবং 'পুত্র পিন্ড প্রয়োজনম' । পুত্রের জন্য স্ত্রী এবং পিন্ড লাভের জন্যই পুত্র । এই হল পূর্বপুরুষ পূজার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন । পিতৃতর্পণ, শ্রাদ্ধকর্ম ও অন্যান্য পারলৌকিক শাস্ত্রীয় কর্মে পিণ্ডদানের বিশেষ বিধি রয়েছে । সারাদেশেই তা নানাভাবে নানারূপে প্রচলিত । পূর্ববঙ্গের সর্বত্র স্বতন্ত্রভাবে এই আচার পরিলক্ষিত হয় । এই লোকাচারটিকে কেন্দ্র করে একটি প্রবাদ আছে–'প্রয়াগে মুড়াইয়া মাথা পাপী যায় যথা তথা ।' হটিকীর্তনের গানেও পদ রয়েছে–'গয়া গঙ্গা গিয়া পুত্র  ধরে তিল কুশ / একে একে উদ্ধার করে সপ্ত পুরুষ ।'

এভাবে বছর ঘুরে এলে মৃত্যুতিথিতে বাৎসরিক শ্রাদ্ধ করা হয় । এর আগে প্রতিমাসে একটি করে বারো মাসে বারোটি মাসিক শ্রাদ্ধের বিধি থাকে । যদি সম্ভব না হয় তাহলে বাৎসরিক শ্রাদ্ধের দিন সব কয়টি অসম্পূর্ণ  শ্রাদ্ধ একসঙ্গে করতে হয় । এদিন আরেকটি লোকাচার পালিত হয় । সেটির নাম  হচ্ছে মঠোৎসর্গ । মৃতের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পারিবারিক শ্মশানভূমিতে এই মঠ নির্মাণ করা হয় । এই মঠ ব্রাহ্মণের মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উৎসর্গ করা হয় । এখানে লোকাচারটি হল, এই বিশেষ মঠটি নির্মাণের সম্যকব্যয় নির্বাহ করে মৃতের কন্যাপক্ষ । অর্থাৎ, এখানে কন্যাকে পরের ঘরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলেও, তার গোত্রান্তর ঘটলেও তার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনটি যে ছিন্ন হয় না তাই প্রমাণ করে । কন্যাও সাধ্যমত ব্যয়ের মাধ্যমে পিতা-মাতার মঠ নির্মাণ করে দেয় । লোকাচার রয়েছে, পিতামাতার মঠোৎসর্গকালে কন্যাকে 'আড়াই-অ'র ( আড়াই অক্ষর ) কান্নাকাটি করতে হয় । কোন মাপকাঠিতে এই 'আড়াই অক্ষর' নিরূপন করা হয় তা এই প্রতিবেদক সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি । মঠোৎসর্গ উপলক্ষ্যে নামসংকীর্তন ও ভোজের আয়োজনও করা হয় ।

এভাবে  পূর্বপুরুষপূজার মাধ্যমে মৃতমানুষের প্রেতযোনি মোচনের জন্য নানা প্রকার শাস্ত্রবিধি ও আচার-আচরণ পালন করা হয় । তারপরেও মানুষের মনে পূর্বপুরুষের প্রতি আরো কিছু শ্রদ্ধাবোধজনিত কর্ম থেকে যায় । পিতৃপুরুষকে মানুষ দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে । দেবতারা যেমন মন্দিরে অবস্থান করেন সেরকম মৃত আত্মার অবস্থানের জন্য এই মরভূমিতে তাঁদের জন্য মন্দির নির্মাণ করা হয় । পিতৃপুরুষের জন্য নির্মিত এই মন্দিরকে সমাধিসৌধ, সমাধিমন্দির, স্মৃতিমন্দির, স্মৃতিসৌধ বা মঠ বলা হয় মৃত্যুর পর অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং মঠনির্মাণ পিতৃত্বের প্রতি ধার্মিকতার নিদর্শন । পূর্বে আলোচনা করেছি যে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক বিষয় ও বস্তু এবং বিশেষ কোন স্থানের প্রতি আদিম মানুষের একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল । ঠিক সেইরকম পূর্বপুরুষের সৎকারভূমি তথা শ্মশানভূমিও  একটি পবিত্র স্থান । পিতৃপুরুষের শ্মশানভূমির মতো পবিত্র স্থানে মন্দির বা মঠ নির্মাণ সেই চিন্তা থেকেই এসেছে । পবিত্রস্থানের উপর দেবত্ব আরোপের ফলে শ্মশান ও সেখানে নির্মিত মঠ ধর্মীয় শ্রদ্ধার স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে । অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠী যেমন কোন পবিত্র স্থানে পাথর প্রতিষ্ঠিত করে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজা করতেন সেরকম হয়তো একসময় শ্মশানেও বড় পাথর রেখে পূর্বপুরুষ জ্ঞানে পূজা করা হত । পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে শ্মশান ক্ষেত্রে মঠ নির্মাণের বিষয়টি উঠে আসে । পূর্ববাংলা ও তৎসন্নিহিত ত্রিপুরার বাঙালি জনগোষ্ঠীর মঠ নির্মাণের পেছনে গৌড়ীয় বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । মঠ নির্মাণের পর মঠের দেওয়ালে হরিনাম মহামন্ত্রের 'ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষর' লিখিত থাকে । এছাড়া মৃতের নাম, জন্ম তারিখ, ও মৃত্যু তারিখ ও উল্লেখ থাকে মঠের দেয়ালে । মঠের চূড়া শঙ্কু আকৃতির হয় এবং ভিত থেকে দেওয়াল চতুষ্কোণ বা অষ্টভুজাকৃতি হয় । মঠের চূড়ায় কলস ও ত্রিশূল স্থাপিত হয় । ত্রিশূল শৈবধারার প্রতীক । আবার শ্মশান হল দেবী কালিকার স্থান । ফলে শ্মশান মঠকে নিয়ে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবীয় ধর্মধারার একটা মিশ্রণ ঘটার সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না ।

 উত্তরপ্রজন্ম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় এই মঠ তৈরি করেন যাতে মৃত্যুর পরেও পূর্বপুরুষের স্মৃতি উত্তরপুরুষের অন্তরে জাগ্রত থাকে । কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতায় আমরা পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের ভালোবাসার নিদর্শন পাই– 'আমাদের কালিদহ–গাঙুড়–গাঙের চিল তবুও ভালোবাসা / চায় যে তোমার কাছে–চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে / এই দহে–এই চূর্ণ মঠে–মঠে–এই জীর্ণ বটে বাঁধো বাসা । ( শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ–জীবনানন্দ দাশ ) । স্মৃতি মানুষকে পিছু টানে । পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে উঠে আসা মানুষের মনের মধ্যেও বাসা বাঁধে পূর্বপুরুষের স্মৃতি এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মঠের দৃশ্য । কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ও এমন স্মৃতিচিত্র 'চতুর্দশীর অন্ধকারের' মত জেগে থাকে–'সবাই আমার মুখ দেখে না আমি সবার মুখ দেখি না / তবু তোমার মঠ ছেড়ে যাই না / চতুর্দশীর অন্ধকারে তোমার বুকে আগুন দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি / একা  / এইখানে চুপ করে এইখানে ডোবা পেরিয়ে ঝুমকাফুলের মাঝখানে / ঠাকুরদার মঠ ।' আদিম লতাগুল্মময় ( ১৯৭২ ) কাব্যগ্রন্থে সংকলিত এই কবিতাটির নাম 'ঠাকুরদার মঠ' । প্রতিদিনের চলমান বৃত্ত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এই মঠের মধ্য দিয়েই প্রিয় মানুষগুলোর স্মৃতি আমৃত্যু বুকের ভেতর বেঁচে থাকে । অনেকদিন পরে লেখা কবির  'বড় হওয়া খুব ভুল' (২০০২ ) ছড়ার বইটিতেও 'ঠাকুর দাদার মঠ' নামে একটি ছড়া আছে । সেখানেও আছে অন্ধকারের কথা । যে অন্ধকারে কবি জ্বালাতে চান একটি প্রদীপ । এই পৃথিবীতে বহু দিন, মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি বাইরে থেকে না ঘটলেও তার পূর্ণতা এসেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে । ছড়াটির শেষে কবি–'বাইরে যতই কুজ্ঝটিকা / দুই চোখে হোক দিব্য শিখা,/ বুকের মধ্যে   ঠাকুরদাদার মঠ' বলে একটা প্রত্যয়ের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এ অঞ্চলের মঠসংস্কৃতি পূর্বপুরুষের উজ্জ্বল স্মৃতিবাহক ।  বিশেষ বিশেষ তিথি ও পূজা-পার্বনের সন্ধ্যায় জ্বালানো দীপমালার শিখায় পূর্বপুরুষের প্রতি আত্মনিবেদনের অনুভবটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. বাঙালির ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, আদিপর্ব, কলকাতা, ১৩৮২.  
২. ধর্ম ও সংস্কৃতি–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৩. বাংলার লোকশ্রুতি–আশুতোষ ভট্টাচার্য, কলকাতা,১৩৯২ 
৩. সংস্কৃতির রূপান্তর–গোপাল হালদার, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৭৪
৪.  টোটেম ও ট্যাবু–সিগমুন্ড ফ্রয়েড,১৯১৩
৫.  রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা– ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, ভোলানাথ প্রকাশনী, কলকাতা 
৬. আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি–দিব্যজ্যোতি মজুমদার, লোকসংস্কৃতি ও অধিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা ২০০৪
৭.  বাংলার লোকসংস্কৃতি–ওয়াকিল আহমেদ, ঢাকা, ১৩৮১