Tuesday, January 12, 2021

সং। ক্রা। ন্তি

সংক্রান্তি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

তোমার হাত কী মোহনীয় হয়ে উঠবে এই সংক্রান্তির সন্ধ্যায়
নিকোনো উঠোন আলপনায় রাঙানো হয়ে গেলে ক্লান্ত হাত
পড়শির পরশ চাইবে নিভৃতে অন্তত প্রশংসামুখর দুচোখ
যেমন মাহেন্দ্রসূর্য কুসুমশোভন হাসিতে স্বচ্ছ উঠোনে বুলোবে চোখ

পিটুলিগোলার রঙ ভেসে উঠতেই
তোমাকেও মনে হয় সেজে উঠেছ
মাঘসকালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
বুড়ির ঘরের সামনে যেন আগুন আর
উত্তাপের একমাত্র পরিষেবাপুষ্ট
রক্তিম আঁচের স্নেহময় আভায় একমাত্র 
তুমি যেন সুন্দরী হয়ে ওঠো কুয়াশাভোরে 

পৌষের শেষ সকাল এভাবেই প্রাতঃভ্রমণ সারে তোমাকে নিয়ে ৷

Sunday, January 10, 2021

জন্মদিনে

জন্মদিনে কী আর আমি........

' কিবা বার্তা কি আশ্চর্য পথ বলি কারে
কোন্ জন সুখী হয় এই চরাচরে' ৷
মহাভারতের একটি কাহিনিতে আছে বকরূপী ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে কটি প্রশ্ন করেছিলেন ৷ বার্তা কী,  আশ্চর্য কী, পথ কাকে বলে আর এ সংসারে কে সুখী?  যুধিষ্ঠির সব কটি হেঁয়ালিমূলক প্রশ্নের দুর্দান্ত দার্শনিক উত্তর দিয়েছিলেন ৷  কী আশ্চর্য বলতে যুধিষ্ঠিরের জবাব ছিল-প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এত প্রাণীকুল মারা যাচ্ছে এবং এটাই হল নিয়তি, চিরন্তন পরিণতি ৷ মানুষ সর্বক্ষণ এই চিরন্তন ধারাকে দেখে আসছে ৷ তথাপি মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে কী আকুল ৷ এটাই হল আশ্চর্য ৷
     আমাদের এক একটা জন্মদিন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় ইতিদিনের দিকে ৷ আমরাও জানি তার পরিণতি ৷ পরিণতও হই আমরা ৷ আমরা জন্মদিনকে পালন করি ঘটা করে ৷ শুভেচ্ছা,ভালোবাসা, আশীর্বাদে ভরে যায় জন্মদিনের পরিমন্ডল  দীর্ঘায়ুর  চিরপথ ৷ আমরা চাই প্রতিটি মানুষ চিরজীবিত হোক ৷ নির্মল আমাদের বাসনা ৷ 'মলিন মর্ম মুছায়ে' ৷ এক আন্তরিক রেওয়াজ আমাদের জীবন ঘিরে ৷ একের জন্মদিনে আসে অজস্র শুভকামনা ৷ প্রিয়জনের জন্মদিনেও প্রতিবিম্বিত হয় সেই শুভায়ুর বাসনাসুষমা ৷ 
        বর্ষপঞ্জীনির্ধারিত ক্ষণ অনুযায়ী আজ আমার জন্মদিন ৷ সারাদিনব্যাপী অজস্র ফোন, মুখোমুখি শুভেচ্ছা, সামাজিক মাধ্যমে শুভতোষ বার্তার বন্যা বয়ে গেছে ৷ আমি ভেসে গেছি সেই বানে ৷ আরও আরও বহুকাল বেঁচে থাকার, আরও আরও বেশি করে জীবনকে ছুঁয়েছেনে দেখার সুতীব্র কাঙ্ক্ষা জাগছে ৷ চিরসুন্দর জীবন কতো সুন্দর ৷ 
       তবে আনুষ্ঠানিক জন্মদিন পালন আমার কোনোদিন হয়নি ৷ আমার সন্তানদেরও জন্মদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করিনি কোনদিন ৷ কিন্তু আমার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এক অভিনব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম আমি আজ সন্ধ্যায় ৷ আজ সকালের ট্রেনে রওনা হয়ে কুমারঘাট হয়ে সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছি কাঞ্চনপুর 'অণুভাবনায় সাহিত্য উৎসব' এ যোগ দিতে ৷ বনতটের সম্পাদক হারাধন বৈরাগি,রসমালাইর অমলকান্তি চন্দ এবং দোপাতার দিব্যেন্দু নাগের যৌথ উদ্যোগে আগামীকাল কাঞ্চনপুর ডাকবাংলোর কনফারেন্স হলে আয়োজন করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানের ৷   সন্ধ্যায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের একঝাঁক গুণী লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকারদের মধ্যে দেবব্রত দেবরায়, সস্ত্রীক শ্যামলবৈদ্য ও পার্থ ঘোষ, বিমল চক্রবর্তী, অপাংশু দেবনাথ,  জহর দেবনাথ, নিশীথরঞ্জন পাল, অভিককুমার দে, জয় দেবনাথ, বিজন বসু, সাচিরাম মানিক, চন্দনকুমার পাল, বাংলাদেশ থেকে আগত জাকির আহমদ, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত সন্দীপ সাহু ও সুশান্ত নন্দীসহ আরো বেশ কয়েকজন সৃজনকর্মী এই কনফারেন্স হলে রীতিমতো কেক কেটেই পালন করলেন আমার জন্মদিন ৷ এই সন্ধ্যায় যেন আমাদের অতীতের বঙ্গভূমির প্রতিনিধিরাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আন্তরিক আলিঙ্গনে ৷ আজকের অজস্র আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা, শুভকামনায় আমি আপ্লুত,  আমি অভিভূত ৷ আমি সিক্ত হলাম ৷ আমি স্নাত হলাম এক স্বর্গীয় অবগাহনে ৷ সবাইকে আমার অন্তরের গভীর শুভকামনা জানাই ৷ আপনাদের / তোমাদের শুভবার্তাকে কুর্নিশ করি ৷ আমিও চাই সবাই ভালো থাকুন ৷ সুখে থাকুন ৷ শান্তিতে থাকুন ৷ প্রত্যেকের জন্মদিন আরো আরো জন্মদিন বয়ে আনুক প্রত্যেকের জীবনে ৷ ইচ্ছে হয় জীবনকে ডেকে বলি, হে জীবন, আমাদের জন্যে আরও কিছু সময় বরাদ্দ করো ৷ আরো কিছু মহার্ঘ মুহূর্ত দাও আমাদের সবার জন্যে ৷ হে জীবন! জীবন হে!
১১ জানুয়ারি ২০২০

Friday, January 8, 2021

মা

*#   মা  #*
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

        (এক)
আমাদের সংসারে
মা, প্রাচীন সাঁকো

নড়বড়ে সেতুটা
ভাঙলো বলে

আর সংসারের
শেষ বাঁধনও

        (দুই)
বিছানায় সাদা থান জড়িয়ে
মৌন শয্যায় পবিত্রতা

কাত হয়ে দেখেন
চিলেকোঠার আকাশ

অলীক ক্যানভাসে ভাসে
অতীতের সন্ততিবর্গ

       (তিন)

মেঘলা মনে
অনিকেত ডাকঘরের
খাম হাতড়ে ফিরছেন

আমার মা ক্রমশ
সুদূরে সরে যাচ্ছেন আমাদের নিঃস্ব করে

তাঁর স্মিতমুখে
চরাচরের আলোর আভা

Monday, January 4, 2021

নদীর কথা

নদীর অনেক কথা থাকে তার বুকের ভেতর
অথচ তার কথা বলবার সময় হয়না ।
হয়না সময় কিঞ্চিৎ দাঁড়াবারও ।

তার ঢেউয়ের তালে আমরা উৎফুল্ল হই ।
তুলনা করি নৈসর্গিক গানের সাথে
অথচ নদীর বুকের ভেতর ঢেউয়ের দোলার গর্ভে 
কতো কান্না কতো কান্না
দুঃখে গড়া নদী বয়ে যায় ভাটির দেশে সমুদ্রের কাছে
সমস্ত দুঃখ বিসর্জনের আশায়
 । নীরব নদী একা একাই গড়ায় ।

নীল চাঁদ

নীল চাঁদ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ভোরের আজানের ধ্বনির আগেই 
আকাশের পশ্চিম প্রান্তের সিঁড়ি বেয়ে
নেমে যায় কোজাগরীক্লান্ত নীল চাঁদ ।

পুরোনো ধাবার পাশে বহুকাল ধরে 
পড়ে থাকা মালিকবিহীন নষ্ট গাড়িটির সারা শরীরে
আগাছা আর জঞ্জালের সাম্রাজ‍্য ।
ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় তার নম্বরপ্লেট,
এই অরণ‍্যসংকুল সময়ে পরিচয় হারিয়ে যায়,
যেমন এই নিরেট গাড়িটির জঞ্জালের আড়ালে
দুর্বল হয়ে পড়ে যেন ব‍্যক্তি ও স্বদেশ।

দুঃসময়ে যার নিবিড় লালনের আশায় থাকে
পরিযায়ী কিংবা প্রতারিত মানুষ।
তারাও যাজকের অদ্ভুত হাসিতে মায়াজাল ছড়ায়,
দুখি ও পেটখোলা মানুষের স্বপ্ন ভাঙে ।
বেতালা কাঁসা ঘন্টার বেয়াড়া আওয়াজে
তাতে কী আর উপোসী পেট ভরে ?

অপেক্ষমান

অপেক্ষমান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জেগে থাকা নদীর প্রবাহ আর
অস্থির অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় ৷
আজ যে শীতদিনের অপরাহ্ণে মেদুর চোখে 
ঘোলাটে আকাশের দিগন্ত খোঁজে
বছর পঞ্চাশ আগে সে তেজি ঘোড়া
স্বপ্নরচিত ভূখন্ডের যোদ্ধাদের পাশে থেকে
সমিধ বহন করে গেছে যুদ্ধভূমি পর্যন্ত
দেখেছে ভূখন্ডের জন্ম ৷ আর পেরিয়ে গেছে সময়ের নৌকো করে
 সেই হারানো বাঁধন! লড়াইয়ের মাঠ!
দেখা যদি পাই কোনোদিন মৈত্রী সেতু পেরিয়ে
চলে যাব সরাসরি নগরশেষের উদ্যানে
বুকে নেব চন্দনবনের গন্ধ ৷ আমার পূর্বজের ঘাম 
কিংবা শোনিতের দাগ যেখানে গাঁথা আছে দেয়ালের গায় ৷

ভো। র

ভো  র

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সন্ধ্যে হলেই মনে হয়
আমার একটা ভোর ছিল

সাকিনবিহীন বনপথের আঁধারে
আমার অনুপ্রবেশ অনিবার্য

আতরগন্ধী ঊষাকাল ফিরে আসুক
ভোরের শাঁখআজানের সুরে

কবিতা কেন লিখি

কবিতা কেন লিখি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কেন লিখি? কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে প্রশ্ন- কবিতা কেন লিখি?  এটা একটা বহুচর্চিত পুরোনো প্রশ্ন ৷ এই ঋদ্ধসময়ে তার প্রয়োজন আছে কী? এক সময়ে সমাজের অতি অল্প সংবেদনশীল মানুষ মননচর্চার আঙ্গিক হিসেবে লেখার মাধ্যমকে স্বীকার করতেন ৷ শুরুর কালে একটাই মাত্র মাধ্যম ছিল ৷ কাহ্নপা, লুইপা কিংবা চাটিলপা থেকে ভারতচন্দ্র কিংবা তার পরবর্তীকালে অধুনা অবধি অক্ষরোপজাত যা কিছু নির্মান তার অন্যতম হল কবিতা ৷ যা আজও বর্তমান ৷ ফারাকটা হল একসময় খুব কমজন এই মাধ্যমে চর্চা করতেন ৷ একসময়ে কবিতাই ছিল অক্ষরচর্চার একমাত্র মাধ্যম ৷ অবশ্য সেকালে কাউকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি ৷ সময় যতো গড়িয়েছে অক্ষরইমারতের শৈলীও ততো শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে ৷ আর যখনি এই সৃজনের চৌহুদ্দিটা বেড়েছে তখনই প্রশ্নটা এসেছে ৷ এতো এতো মাধ্যম থাকতে কবিতায় কেন আসা কিংবা 'কবিতা কেন লিখি'? সাধারণ প্রশ্ন হতে পারে ৷ সন্দেহদ্যোতক গোয়েন্দাসুলভ প্রশ্নও হতে পারে ৷ এই পরাপ্রশ্নের মধ্য দিয়ে জেনে নেওয়া এই ধারার লিখিয়ের মননের সরোবরে কোন্ তোলপাড়ের ফলে কবিতার জন্ম হয় ৷ মনোচন্দনবিতানে কোন মকরন্দের প্রকোষ্ঠপূরণ হয় ৷ কেন অন্যান্য মাধ্যমের আকার আয়তনের তুলনায় স্বল্পপরিসরে এই মননচিহ্ন বেশি বেশি মাত্রায় জায়গা করে নেয় পাঠকের হৃদয়ে ৷ বৃহত্তর সমাজের অমরপুরে ৷ বনেদি পুজোর মতো মর্যাদা পায় ৷  মূলত বিভিন্ন কবির কাব্যসৃজনের সৃজনোদ্যমের গভীর উৎখননের মাধ্যমে জেনে নেওয়া—কোন পললভূমিতে উপ্ত তাঁর কাব্যবীজ ৷ তারও আগে কীভাবে তাঁর মনের কোন্ ধর্মনগরে পূজিত অথবা লালিত হয় এই কাব্যবীজ ৷ 'এক সো পাদুম চৌখুটি পাখুড়ি' মেলে যেভাবে বিকশিত হয় ঠিক তেমনি কবিতাও কোন রন্ধনরসায়নে পাঠকের মননেও স্বাদু উপলব্ধির সঞ্চার করে ৷ নিশ্চয়ই কবিরও নিবিষ্ট প্রয়াস থাকে কবির হৃদয়কমলপুরে সৃজ্যমান কবিতাপুষ্পটিকে পাঠকের কাছে  নন্দনমন্ডিত করে পরিবেশন করা ৷

          জগৎ-জীবনের নানা ভুলভুলাইয়ার গলিঘুঁজির কৃষ্ণনগর থেকে বিমুক্ত করে কবি এগিয়ে আসেন শব্দের বিনির্মানে, অক্ষরের উল্লাসকর বিন্যাসে ৷ সন্ধিৎসু প্রশ্নকর্তার জানার বিষয়টিই হল কবিমনের রম্যআঁধারে সংঘটিত হওয়া নির্মানকলা ৷ এই জিজ্ঞাসা বহুকাল ধরেই চলে আসছে ৷ এই একটি প্রশ্ন বহুজন করেছেন ৷ বহু কবিকে ৷ বহু উত্তর এসেছে ৷ বহুবিধ উত্তর এসেছে ৷ বহুবিচিত্র উত্তরও এসেছে ৷ কোনো কোনো উত্তর কাছাকাছি ৷ কোনো কোনো উত্তর পরস্পর বিপরীত মেরুর ৷ কোনো কোনো উত্তর আবার কবিতার মতোই মেধার অতলান্তিক কেন্দ্র থেকে আগত ৷ কোনো কোনো উত্তর হাতের তালুতে নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রশ্নকর্তার সময় চলে যায় আর এক কবিতার ডানা মেলে ৷ নতুন করে প্রশ্ন করা হলে সেই একই গোত্রের উত্তরই হয়তো বেরিয়ে আসবে কালের কোনো কবির কাছে ৷  আবার দ্রুত ধাবমান সময়ে ব্যস্ততম জীবনের দৌড়বিদ কবির কাছে হয়তো অন্যতর কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে কবিতা লেখার তাগিদ ৷ সমস্ত প্রবহমান ভাবনাকে ভেঙেচুরে নতুন সৃজনসংকেতের ইঙ্গিত দিতে পারে ৷ এইভাবে কবিতার বাক-পরিবর্তন, বাঁক-পরিবর্তন,ভাষাব্যবধান, আধুনিকাভরণও আসে কালক্রমান্বয়ে ৷ কোনো কবির নির্মানে যদি এই পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়ভাবে না আসে, তিনি যদি নিজের বৃত্তের মধ্যেই থাকেন সময়কে সাথে না নিয়ে, সময়ের সঙ্গী না হয়ে তাহলে তাঁর উত্তরটি কালপ্রবাহকে পরিবহন করবেনা ৷ বর্তমানে বসে লিখলেও তাঁ উত্তরে নিকট অতীতের চিত্রই প্রকট হবে ৷

কবিতানির্মান হল একপ্রকার সৃজনস্পৃহা ৷ অন্তস্তলের বোধবল্লরীতে টোকা দিতে থাকে শব্দ ৷ বিচ্ছিন্নভাবে ৷ প্রকাশোন্মুখ এই শব্দকে সুন্দর ও সুচারুরূপে সাজিয়ে ছন্দের রশারশি দিয়ে বেঁধে সময়ের বুকে বেঁচে থাকার মতো ঋতুসহকরণ করে সৃষ্টি হয় কবিতার ৷ মা যশোদা যেমন গোপালকে পরমযত্নে  সাজিয়ে তোলেন গোষ্ঠে যাবার জন্যে ৷ রাখালরাজা সাজবার জন্যে যেমন ধড়াচুড়ো দরকার তেমনি গোপীজনের মনোহরণের জন্যে মোহনবাঁশিটিও যে দরকার তা উপলব্ধি করেন যশোমতী ৷ সৃজনস্পৃহার পরের পর্যায়ে যশস্পৃহাই প্রকাশমুখী করে কবিতাকে ৷ প্রকাশের নন্দনই হল কবিতার কর্মশালার সক্রিয়তা ৷ সৃজনভূমি থেকে প্রকাশপ্রান্তর ৷ এর মধ্যবর্তী কর্মোপত্যকার তৎপরতাই হল কবিতা লেখা ৷ শব্দের সোনালিমাঠের এইসব কর্মকান্ডই হল 'কবিতা কেন লিখি'র সম্ভাব্য জবাব ৷

এই সাম্প্রতপ্রহরে সারা পৃথিবীকে শাসন করছে সামাজিক মাধ্যম ৷ এমনকি কবিতাকেও ৷ ফলে প্রত্যেকেরই প্রকাশকাঙ্ক্ষার দূরগামী মাধ্যমও হাতের নাগালে আজ ৷ ফলে কেউ কেউ নয়, সকলেই কবি হয়ে উঠতে চায় ৷ তারা নিজেই যা খুশি লিখছে ৷ নিজেই তাকে কবিতা বলে ঘোষণা দিচ্ছে ৷ অর্থাৎ যা লিখছে তাই কবিতা বলে চিহ্নিত হচ্ছে ৷ সামাজিক মাধ্যমে হাততালি পেয়ে অত্যুৎসাহী কবি কদিন পরেই আত্মপ্রকাশ করছে মুদ্রণমাধ্যমে ৷ আকাশের যতো তারা তার চেয়েও বেশি টাকা তাদের হাতে ৷ ফলে তাদের সৃষ্ট জঞ্জাল কবিতার নন্দনকাননে স্তুপীকৃত হচ্ছে ৷ চলমান হুজুগে এইসব কবির সামনে যদি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের লোগোলাগানো বুম ধরে প্রশ্ন করা হয় 'কবিতা কেন লিখি' বিষয়ে দুচার কথা বলুন ৷ তাহলে এই অগণিত কবির স্রোতের মধ্যে কজনের কাছ থেকে যে একটা আলোকস্পর্শী উত্তর পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে ৷ তবে উত্তর অবশ্যই আসবে ৷ আর উত্তর হবে—কবিতা লেখার একটা বড়ো প্ল্যাটফরম পাচ্ছি তাই কবিতা লিখছি,  কবিতা লিখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি তাই কবিতা লিখছি ৷ দ্রুতগামী সময়ের ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সৃজনপ্রকাশ ঘটাতে পারছি কবিতা লিখে ৷ ব্যস্তজীবনের একঘেয়েমি তো কাটানো যাচ্ছে ৷ কিন্তু উত্তর আসছেনা তাতে কবিতার পরিমন্ডলে কী পরিবর্তন হবে ৷ এই কবিতাবলির চিরজীবী হওয়ার মতো কোনো আশা আছে কী নেই ৷ শব্দের শিলাগুহার সুড়ঙ্গপথের অন্ধকারে এগিয়ে যেতে যেতে এই কবিরা জানেননা সামনে কী গুহাপথ শেষ নাকি চেনাপৃথিবীর বাইরে এক অলৌকিক বিশ্ব রয়েছে ৷ তবুও তাঁরা কবিতা লেখেন ৷

এতো পথ পেরিয়ে আমিও কবিতা লিখি ৷ কিন্তু কেন লিখি আমি কবিতা? এছাড়া আমার কী কিছু করার নেই? কেন নেই? একজন মুদি দোকানদারকে যদি প্রশ্ন করা হয়-কেন ব্যবসা করেন? উত্তর আসবে তার মতো করে ৷ কিন্তু আমি কী উত্তর দেব! আমি তো একান্তে নিজেকে কোনোদিন প্রশ্ন করিনি ৷ করা হয়ে ওঠেনি ৷ আসলে আমি কবিতা লিখি, না আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নেয়! কারণ কবিতা লেখার পর সৃষ্ট শব্দবন্ধ আমার কাছেই অপরিচিত মনে হয় ৷কে যেন বসিয়ে গেছে আমার কলমে ৷ এভাবে তো আমি প্রতিদিন ভাবিনা ৷ কোন্ আত্মম্ভর ভাবনা আমাকে দিয়ে কবিতা লেখায় ৷ আমি কবিতা লিখি ৷ 'কবিতা কেন লিখি' এ প্রশ্নের একাল-সেকাল একাকার করেও আমি জানতে পারিনা কেন কবিতা লিখি ৷ তবু আমি কবিতা লিখি ৷ হয়তোবা আমাকে দিয়ে কেউ কবিতা লেখায় ৷ আজীবন ভাতের দলা রাবারের বলের মতো আমার আগে আগে লাফিয়ে চলেছে ৷ আর আমি তার গোবিন্দভোগ গন্ধের পেছনে পেছনে ছুটে চলেছি তাকে ধরার জন্যে ৷ কবি হওয়ার বাসনা তো দূরের ৷ অন্নের উজ্জ্বল মোহময় আলো হয়ে ওঠে আমার কবিতা ৷ সেখানেই আমার যাবতীয় দাড়িয়াবান্ধা ৷ কবিতার জন্যে যে লালনস্পর্শ কাম্য সে লালন জোটেনি আমার আখরে ৷ আমার আখেরে ৷ ব্রাত্যবাস্তুর নির্জনতার মাঝেই আমার নির্মান ৷ আমার দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-প্রেম-অপ্রেম-হতাশা-বিষাদ-আশায় আমাকে শব্দ জুগিয়ে যায় কে যেন অবিরাম ৷ সে আমার সৃজনের সহচর ৷এক অন্য আমি ৷ মনে হয় ভেতরের সেই আমিও একজন স্রষ্টা ৷ এক অপরভুবনের জন্মদাতা ৷ তার কারণেই কবিতা লিখি ৷

শি কা র

শিকার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

পাখির ঠোঁটে যে খড়কুটো থাকে
তাতে অনেকগুলো আবাসনের মালমশলা
পাখির ঠোঁটে যে শস্যবীজ বন্দী থাকে
তারসঙ্গে অনেক অনেক প্রাণের মহিমা বসত করে ৷

সমস্ত পাখিদের সংসারে কিছু মানব লুকিয়ে থাকে
সে মানব সহিংস হতে জানেনা ৷
ব্যথা ও বেদনায় কেবল অনশনে উপশম খোঁজে৷

 শিকারীর তুণীরে তবুও কোনো সৎ পুঁথি রাখেনা ৷

বালিয়াড়ি

বালিয়াড়ি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সপ্তপদী হলেও হাজার কদম বাড়াতেই হয় ৷ 
জীবনরচিত সংলাপ গুণে ও গুনে আবদারের মালা
আফসোস হতে বেশি বাকি থাকেনা ৷
 যতিচিহ্ন যখন তোমার আশেপাশে ওঁৎ পেতে থাকে
কতক বৈভবলোলুপ সিদ্ধান্ত সংবিধানের মতো বুনে নিয়ে কারো কারো
হেঁসেলে ঢুকে পড়ে ৷

তোমার রক্তস্রোতের আচরণে হঠাৎ করে
নতুন শিক্ষানবিশ তোলপাড় করে ৷ ঘর ভাঙে ৷
নদীর ভঙ্গুর বালিয়াড়ি ঝরে যায় ৷

জ ল তি ল ক

#জলতিলক
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বিলুপ্ত শাবকের কাছে শূন্যপুরাণ খুলে ধরে
মিহি অতীতের আঁচলের খুট শক্তপোক্ত গিঁটে
পোষাকের বাহাদুরি ৷ গোপন কাঁথার প্রতিটি
ফোঁড়ে ফুটে ওঠা লোককলায় বিলুপ্ত ধামাইল
লাফিয়ে ওঠে ৷ ইতিহাসের পাঠ না শিখিয়ে শুধু
বীজমন্ত্র বিতরণ ৷ একে মারো, তাকে ধরো আর
শেষ করে দাও ঝাড়ে বংশে ৷ আমরা ছাড়া তো
যোগ্য কেউ নেই এ তল্লাটে ৷ দেখোনা,  মিডিয়াও
 আমাদের নামেই জয়নাদ করে ৷ গণতন্ত্রের চৌঠা 
কলাম তরতরিয়ে উড়ে যায় পানসির জলতিলকে ৷ 
সেই সত্যের ইজারাদার ৷ সত্যকে বানায় ৷

শুভমঙ্গল ভোররাতে পাখির পালকের আড়াল থেকে দেখে পাটভাঙা সূর্যোদয়ের পোষাক ৷

গা। ন

গান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বেদনাআসমান থেকে বিষন্ন তারারা আঁধাররাতের শিউলি হয়ে গেল ৷ ঝরাবেলার গান সন্ধ্যাসিঁদুরের স্বপ্নওমের জন্যে ডুকরে ওঠে ৷ ফুরন্ত সূর্যাস্তচরাচর দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে দেয় ব্যর্থচুমুর শেষদাগের আদলে ৷

যেখানে রেখেছ হৃদয় সে যেন প্রশ্রয়ে থাকে
চিরপদাবলি পুরাণপ্রত্যাশায় একা জেগে থাকে ৷

বারুদ

বারুদ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বারুদের গন্ধ ভালো লাগে বলে অনেকেষ
শখে আহ্লাদে বাজি পোড়ায় ৷ বাজির গন্ধ
শুধুই মাদকতা আনে ৷ আর দূষণ ছড়ায়
বহুদূর পর্যন্ত ৷ সৃজনশীল কোনো গন্ধ নেই ৷

বারুদ অনেকে বুকে পুষে রাখে ৷ অনেকে
স্বপ্নে দেখে মোমছাল আর নতুন ভোরাই ৷
বারুদকে ভালোবেসে অনেকে জীবন বাজি
রাখে ৷ ইতিহাসে আশ্রয় নেয় ৷ কালের পুথিতেও ৷
আধুনিক মানুষেরা জানেনা বারুদের বিক্ষোভ
ওরা শুধু মাদকগন্ধে বাজি পোড়ায় ৷ পোড়ায় ৷
বিলাসী নাগরিক নোটবন্দী জানেনা ৷ আগুনে
উড়ে যায় কাগজি বাজি ছেঁড়া তাসের গুচ্ছ ৷

যেজন বুকে বারুদ গুঁজে রেখে সুদিনের স্বপ্ন
দেখে সে বেচারা একদিন মানববোমার মতো
বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৷ কাগজের পাতা
জুড়ে দগ্ধ ছবি ৷ বাতাসে বারুদের নতুন গন্ধ ৷
এ গন্ধ ভার্চুয়াল প্রজন্মের একদমই অচেনা ৷

শারদীয় কথামালা

শারদীয় কথামালা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সুন্দরের সাথে মার্চপাস্টের জন্যে
জমানো সংবৎসরের পারানি
অপত্যের হাসির অপেক্ষায় থাকে ৷
 
দূরের দ্বীপে চলে যাওয়া প্রজন্মের আশায়
কাশফুলের কাঁপন দেখে দেখে
নদীর পারেই শেষ ভদ্রাসনের
গন্ডি কেটে রাখি

শরতের নীল মতো কাজল গোলা আর
হুমকির বর্ষার মাঝেও মাঝরাতের
শেষ ট্রেনের হুইসিলও পেরিয়ে যায় সন্ততির অপেক্ষায় কাটে ৷

ভোর হলেই ঢাকের বাদ্যি বৃদ্ধাশ্রম পেরিয়ে যায়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন ৷

১. গাধাতত্ত্ব ২. কোনো এক

গাধাতত্ত্ব

অশোকানন্দ রায় বর্ধন

গাধাকে মানুষ করা যায় কিনা জানিনা ৷ কিংবা ঘোড়াকে ৷ আমার বাবা প্রায়শই আমাকে মানুষ করার অনন্ত প্রচেষ্টা নিতেন ৷ আর আমাকে ভূষিত করতেন গর্দভ নামে ৷ গাধাকে মানুষ করার জন্যে তাঁর প্রতিদিন কঞ্চিকসরৎ চলত আমার পিঠের উপর ৷ মানুষ না হই নিদেনপক্ষে ঘোড়া করার জন্যে বেত মেরে ব্যতিব্যস্ত করতেন ৷ তাতে গাধাভূষণ আমি আজও মানুষ হতে পারিনি ৷ উপরন্তু প্রতীকী ঘোড়াটাও পিটুনি খেতে খেতে গাধাই হয়ে গেছে ৷


কোনো এক

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কোনো এক সময়ে কোনো এক সমাজের মানুষ কোনো একজন মহাপুরুষের পূর্ণাবয়ব মূর্তি কোনো এক মোড়ের মাথায় বসিয়ে কোনো এক বিশেষ দিনে জন্মতিথি আর কোনো এক বিশেষ দিনে মৃত্যুদিন পালন করতে করতে ভুলেই যায় মহাপুরুষটি কে ছিল ৷

তারপর কোনো একদিন সেই মানুষটির পায়ের তলায় পলিথিন ঘেরা সংসার পাতে কোনো এক শহুরে রিক্সাওয়ালা আর তার রাতের রোজগেরে বউ আর অজানাঔরসজাত বালবাচ্চা ৷ অবশেষে কোনো একদিন একদল বিজয়ী মানুষের হল্লামিছিল সেই মহাপুরুষকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করে বুলডজার দিয়ে ভেঙে ফেলে সে মূর্তি ৷ আর বেওয়ারিশ সংসারটাকে নাগরিকত্বহীন ঘুসপেটিয়া বলে বেঁধে নিয়ে যায় ৷

তারপর স্বচ্ছতার অভিযাত্রীরা এসে ছেঁড়া পলিথিন সরিয়ে সেখান দিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কের জন্যে জমি মাপে ৷

সং ক ট

সংকট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

একটা বিলীন হওয়া সভ্যতা ইতিহাসের কবর থেকে উঠে এসেছে আবার ৷
আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারার দিকে তাকিয়ে, 
ফুল কিংবা পাখির দিকে তাকিয়ে
সে দেখে সেই একই কথা বলছে আজ ৷
যেমন বলেছিল তার কবলিত দিনগুলোতে,  তার শেষের ক্ষণের সূর্যাস্তে ৷
আস্তে আস্তে সে সবার কাছে যায় ৷
সবাইকে জিজ্ঞাসা করে সেই প্রাচীন প্রশ্ন, তোমরা কি সতর্ক করোনি?  বলোনি এই বিপন্নতার কথা?

ওরা সমস্বরে বলল, হ্যাঁ আমরা বারবার বলেছি, বারবার কেঁদেছি, পায়ে মাথা কুটে বলেছি আসন্ন সংকটের কথা ৷
তাহলে কেন আবার আমাদেরই মতো ওদের ফিরে যেতে হচ্ছে শূন্যতার দিকে?  অন্ধকারের দিকে?

ওরা একসঙ্গেই বলে উঠল, ওরা শোনেনি আমাদের কথা ৷ ওরা দাম্ভিক ৷ ওরা জ্ঞানপাপী ৷ তাই আজ হেরে যাচ্ছে তারা ৷

মন্বন্তর

মন্বন্তর

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

লেবাং পতঙ্গেরা ছুটে যায় সাংকেতিক কাঠিবাজিতে
অথবা জাটিংগার বুনো আগুনে ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মহননমুখী পাখির দল

মগজের ভেতর ক্লোরোফরম চেপে ধরলে বেহুঁশ মানুষ
এগিয়ে যায় অতলান্ত খাদের দিকে

এক একবার মারী ও মড়ক আসে মানুষের মহল্লায়
মানবতার ফুলের গুচ্ছ তখন অপ্রয়োজনে পড়ে থাকেনা ৷ হৃদয় থেকে বেরুতে থাকে রাজপথে ৷

কোভিড ১৯

# কোভিড—১৯ #

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

দুঃসময়ে পবিত্র উলটপুরাণ মেলে ধরে
বাচাল সেনাপতি শাস্ত্রবাক্য বিতরণের 
পুরুতমশাই  কৃতিত্বের লম্বা হাই তোলেন

বন্দী পুতুলেরা সব সামাজিক দূরত্ব মেনে
প্রতিবাদী নাটুকেপনায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় 

মাস্কের আড়ালে শৈল্পিক চোখ নিয়ে
প্রকৃত বেড়াল মৎস্যগন্ধা মুখে ভাষণ ঝাড়ে

কোভিডকালে এক একটি নিরাময়কেন্দ্রের
লক্ষণরেখার ভেতরে মানবতা লুটোপুটি খায়

নরকগুলজার গোশালায় অগ্রগামী যোদ্ধার ইনাম বিতরণ অব্যাহত