Wednesday, February 15, 2017

আ ত্ম জী ব নী


অশোকানন্দ রায়বর্ধন 
11 জানুয়ারি অসমের ডিব্রুগড় শহরে জন্ম ৷ বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন এবং মা প্রয়াত ঊষারানি বর্ধন ৷ বাবা চট্টগ্রামের বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে  ইংরেজ শাসকদের চোখে ফাঁকি দিয়ে বার্মা হয়ে অসমের চা বাগানে আত্মগোপন করেন ৷পরে ডিব্রুগড় মেডিক্যাল কলেজে চাকরি নেন৷ বাবার চাকরির সুবাদে অসম থেকে ত্রিপুরার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত জীবনের দীর্ঘসময় কাটিয়ে বর্তমানে ত্রিপুরার প্রান্তিক মহকুমা শহর সাব্রুমে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ৷ ভ্রাম্যমান জীবনের সুবাদে উত্তরপূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জীবন ও সংস্কৃতি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন ৷
  পড়াশুনো শুরু ডিব্রুগড়ের অখন্ডমন্ডলেশ্বর বিদ্যালয়ে ৷ পরে  ত্রিপুরার পেচারথল, বক্সনগর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা এবং কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক  উত্তীর্ণ ৷ বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষাও সাহিত্যের স্নাতকোত্তর এবং ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এড শ্রী রায়বর্ধন দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতার পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকে এবং বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করে এবছর জানুয়ারি মাসে সরকারি দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন ৷
কিশোরকাল থেকে কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা শুরু ৷বিদ্যালয়ের সাহিত্যপত্রেরও সহ-সম্পাদক ছিলেন একসময় ৷ কবিতায় হাতেখড়ি এবং স্বচ্ছন্দ হলেও রাজ্যের আঞ্চলিক ইতিহাস, লোকজীবন ও সংস্কৃতির অনুসন্ধানী গবেষক ও লেখক ৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁ বহু গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে ৷ 2013 সালে তাঁকে 'স্রোত' সাহিত্যসম্মান দেওয়া হয় ৷
বাউলস্বভাবের অনাড়ম্বর ব্যক্তিগত জীবনযাপনের পাশাপাশি সর্বক্ষণ সামাজিক কর্মকান্ডের মধ্যে জীবনের অফুরন্ত রস ও আনন্দের সন্ধান করেন ৷ প্রচারের আলোকের বাইরে নিভৃত সাহিত্যসাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখতে চান ৷ ত্রিপুরার জনজাতিদের বেশ কয়কটি ভাষা তিনি জানেন ৷এই গ্রন্থটিতে ত্রিপুরার মগ জনগোষ্ঠীর উপর দুটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধসহ বেশ কয়েকজন জনজাতিগোষ্ঠীর গবেষকের মূল্যবান গবেষণামূলক লেখার সমাবেশ ঘটিয়েছেন ৷


লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থ
• ত্রিপুরার লোকজীবন ও সংস্কৃতি / ভাষা,আগরতলা ৷
• বিনীত চুম্বন / স্রোত প্রকাশনা, কুমারঘাট ৷
•ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির উৎসসন্ধান ও বিষয়বিন্যাস / স্রোত প্রকাশনা, কুমারঘাট


বসন্তকেদার

বাউলশীত একতারা বাজিয়ে ফিরে যাবার পর হাহাকার করে ওঠে পুরাতন বুক ৷ ফেনিসেতুর স্বপ্ন দেখলে চা বাগানের ভেতর জেগে ওঠে কুয়াশামাদল ৷ প্রবীন শত্রুরা এসে বিষমাখা তির  রেখে যায় শ্মশানশিবিরের ভিটের ওপর ৷ জীবনের শুরুতে সুখ ৷ সঞ্চয় যতো বাড়ে, মনখারাপের তুলোজড়ানো মেঘ ততো কালো হয় ৷ নদীর পাশে ফসলি জমি বিষাদশালিকেরা খুঁটে খায় মায়াদুপুর ৷ অন্ধকার ঠেলে চাঁদের স্তন ভেসে উঠলে মধুবোষ্টম নেচে বেড়ায় গোবিন্দমাঠে ৷ পাখিরা জড়াজড়ি চুমু খায় ৷ কখনো বা কেঁদে যায় পলাশবসন্তের আলোতে ৷

ফাগুনমোহিত কপোতেরা উত্তরপুরুষের ডিম রেখে যায় বাসাঘরে ৷ ছানাদের উড়ালপুল দেখাবে বলে শহরের অ্যান্টেনায় বসে মায়াশিস দেয় ৷ পিতাপাখি সাদা ডানা ঝেড়ে মেঘের আড়াল ৷ ভ্রমণমুখরা পাখিমা উড়ে ফেরে নাকাশিটিলার ওপর ৷ অনন্তবালক আপন পায়ে বেড়ি পড়ে সাঁতরে পেরিয়ে যায় গোমতী নদী ৷ তার চরণদুটি পাবার জন্যে ত্রিভুবন দেওয়ানা ৷

মানুষ ছাড়া সমস্ত শ্মশাচত্বর যেন শূন্যাকার,
হাবেলির খামারবাড়িতে বাজে বসন্তকেদার ৷

Monday, February 6, 2017

গুরু, তোমার চরণ পাবো বলে


গত 27 জানুয়ারি 2017 গিয়েছিলাম আমার স্যরের বাড়ি ৷ অধ্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায় ৷ রবীন্দ্র মনোদর্শন ও আরো অনেক ধ্রুপদী গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক অমিয়রতন মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য সন্তান ৷ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূক্ত ভাষাশিক্ষাদানের পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তাঁর গভীর মননের নির্যাসে আমাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন প্রতিনিয়ত ৷ পড়াশুনোর পরেও নিবিড় যোগাযোগ ছিল আমাদের ৷ গত আঠাশ তারিখ গিয়েছিলাম তাঁর বাড়ি ৷ প্রিটোরিয়া স্ট্রিট থেকে কীভাবে যাব তোতাপাখিকে শেখানোর মতো করে শিখিয়ে দিয়েছেন ৷ বেহালা পেরিয়ে চারটে স্টপেজ পেরিয়ে পরাশরতলা ৷ নতুন বাড়ি করে ওখানে আছেন ৷ আদি বনেদি বাড়ি বড়িশায় ৷ ট্যাক্সিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন ৷আমার সঙ্গে এই সময়ের শক্তিমান দুই কবি অভিককুমার দে এবং সুমন পাটারি ৷ আমরা তিনজনই দক্ষিণ ত্রিপুরার ৷ ওরা দুজন বাইখোরা ও আমি সাব্রুম ৷ গাড়ি থেকে নেমে পাল ফার্মেসির সামনে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে ৷ আজো সুদর্শন গৌরকান্তি আমার স্যর ৷ যেন চৈতন্য মহাপ্রভুর হৃদয়ে ঠাঁই নিলাম এক দীন অনুসারী ৷ আমাকে জড়িয়ে স্যর অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলেন ৷ আমিও বুকের মধ্যে, গলার মধ্যে এক চাপ অনুভব করছি ৷তীব্র শিহরণ হচ্ছিল আমার ৷ চোখে জল এসে গেল আমার ৷' দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া' ৷ যতোক্ষণ ছিলাম স্যরের বাড়িতে স্নানের সময় ছাড়া মুহূর্তের জন্যে কাছছাড়া হন নি আমাদের ৷ কবিতা শুনলেন, কুশল জানলেন, সাহিত্য আলোচনা হল ৷ একে একে খোঁজ নিলেন তাঁর কর্মস্থল বিলোনিয়ার পরিচিতজনদের ৷দুঃখ পেলেন আমার মায়ের দেহান্তের কথা জেনে ৷ যেন একজন দূরদেশবাসীর সন্দেশসংগ্রহ ৷ হ্যাঁ ভুরিভোজনটি না করিয়েও ছাড়লেন না ৷ তাঁর ছেলে বাপ্পা তার দাদাভাইকে বার বার ফোন করছে, দাদা তোমরা যেও না ৷ আমি আসছি ৷সেদিনই তার ট্রেনিং শেষ হয়েছে ৷ মাঝে একদিন ৷ তারপরই জয়েন করবে মেট্রো রেলে ৷ পড়িমরি করে ও এলো ৷ হাতমুখ ধুয়ে বসে পড়ল আমার পাশে ৷ শিশুর সারল্যে ভরা মুখশ্রী নিয়ে এক নবীন যুবক ৷ আগামীকাল থেকে যার কাঁধে সংসারের গুরুদায়িত্ব পড়বে ৷ গুরুপত্নী কাকিমাও সারাদিন আমাদের জন্যে খাটাখাটনি করে থিতু হয়ে বসলেন আমাদের পাশে ৷ আর একপ্রস্থ চা সিঙাড়াসহ জমাটি আড্ডার পর আমরা উঠলাম ৷ যতোক্ষণ ছিলাম ছাত্রদিনের মতো জ্ঞানভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন আমাদের ৷আমার সঙ্গী তরুণদ্বয়ও আপ্লুত তাঁর সান্নিধ্যে ৷ যখন মিলনমেলা ভাঙলো পশ্চিমমুখো হয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি ৷ আকাশলগ্ন অট্টালিকার আড়ালে থাকায় সূর্যদেবকে খুঁজে পেলাম না এই বিচ্ছেদের সাক্ষী থাকার জন্যে ৷ প্রাসাদসারির ছায়ার আঁধারে আর একবার প্রণাম করলাম আমার স্যরকে, আমার আত্মার অভিভাবককে ৷

জনজাতির পুরাকথা

খুমপুই থেকে সিকামনুকতাই
হারাধন বৈরাগী
একটি অন্যপাঠ:অশোকানন্দ রায় বর্ধন
এক নতুন ধারায় জীবনকে ছুঁয়ে দেখা ৷ কথাসাহিত্যোর বুননে নতুন বাকশৈলী ৷ হারাধন বৈরাগীর নতুন গদ্যগ্রন্থ 'খুমপুই থেকে সিকামননুকতাই' তার সারা শরীরে আদিবাসীর কোমরতাঁতে সযত্নে বোনা গাত্রবস্ত্রের মতো মিথের অলঙ্কারে ভরে দিয়েছেন ৷ ত্রিপুরা রাজ্যের ছোট্ট একটা পার্বত্য এলাকা পরিদর্শন করতে বেরিয়ে সেখানকার পাহাড়-নদী-জনপদকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় জনগণের মধ্যে প্রচলিত রূপকথা লোককথাগুলোকে তুলে এনেছেন একেবারে ধুলো ঝেড়ে ৷ কোনরকম গবেষণাধর্মী ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে কেতাবি পরিবেশনা এড়িয়ে একেবারে জৌলুসহীন ঘরোয়া ঢঙে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর ভাষ্য ৷ সেইসঙ্গে জনজাতীয় জীবনচিত্রটি অনুপুঙ্খ তুলে ধরেছেন ৷ খুব ঘনিষ্ঠ অবলোকন না হলে, এ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে না মিশে গেলে এভাবে মাটির কথা তুলে আনা সম্ভব নয় ৷ এই জীবনধারাকে ভালোবেসেই লেখক হারাধন বৈরাগী এই মরমি সৃজনের সফল রূপকার ৷ লেখার মুন্সিয়ানায় পাঠক পৌঁছে যাবেন কখনো আধিভৌতিক জগতে, কখনো পরাবাস্তবের সংসারে কিংবা কখনো ঐন্দ্রজালিক আলোছায়ার জগতে ৷
কথা ও উপকথার এক অপূর্ব যুগলবন্দী এই সৃষ্টি অনুরাগী পাঠকের মননে নতুন ও স্বাদু সংযোজন ঘটাবে নিঃসন্দেহে ৷
শ্রোত প্রকাশনা।
----------------------------------
পাওয়া যাবে স্রোত প্রকাশনার স্টলে

ধীরে বহে বেত্রবতী

সন্মাত্রানন্দ আমার প্রিয় কথাকার৷ তাঁর কথাভুবন আমাকে প্রবল আকর্ষণ করে ৷ তাঁর জ্ঞানের গভীরতা যে কোন অনুসন্ধিৎসুর ঈর্ষা জাগাায় ৷ তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যেও থাকে জ্ঞান ও মননের ছাপ ৷ কদিন আগে তরুণ প্রকাশক তীর্থংকর দাশ আমাকে পড়ার জন্যে দিয়েছেন সন্মাত্রানন্দের ' ধীরে বহে বেত্রবতী ' গল্প সংকলন গ্রন্থটি ৷ এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই তিনি রেখেছেন তাঁর প্রজ্ঞার স্বাক্ষর ৷এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে যেমন রয়েছে রহস্যময় বয়ন শৈলী, তেমনি গভীর জীবনভাবনা ও দর্শনবীক্ষণ ৷মানবিকতার জন্যেও উচ্চকিত গল্পকার ৷
প্রথমটায় একটু রহস্যগন্ধী বয়ন শুরু করলেও গল্পের আঁচল ছাড়িয়ে যখন মননভূমির দিকে এগিয়েছেন, এক মায়াবি লোকঘ্রাণময় ভাষাশৈলী যেন ছড়িয়ে রয়েছে প্রথম গল্প 'উত্তরা বোষ্টমির কড়চা'তে ৷ প্রেমের টানে ঘরছাড়া উত্তরার কুসুমাকরের সঙ্গে নিবিড় প্রণয়সম্পর্ক,সমাজপ্রতিক্রিয়া ও চরিত্রকে মেলে ধরে এক ধ্রুপদী প্রেমের আখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
'নিঝুমঘর' নামের মধ্যেই লুকিয়ে যেন এক অশরীরী রহস্যময়তা ৷গল্পের বুননের মুন্সিয়ানায় পাঠক পৌঁছে যান অধিজাগতিক এক পরিবেশের মধ্যে ৷ ছোট্ট দুটি উপকরণ মশা তাড়ানোর ধূপ আর টিপয়ের উপর সাপের নকশা গল্প কথকের জীবনের দুই ঘটনাকে জুড়ে ভৌতিক জাল সৃষ্টি করে গল্পে ৷
একটা সম্পর্কের টানাপোড়োনোর গল্প 'জে' ৷ দাম্পত্যজীবন থেকে বঞ্চিত দুজন ৷ ভাসুর ও ভাদ্রবৌ ৷ দিগন্ত আর অনমিতা ৷ সমাজের শ্যেনদৃষ্টি আর তীর্যক সন্দেহপ্রবণতা একটা বাধা হয়ে তাদের মনের অভ্যন্তরের কোন নিভৃত অভীপ্সাকে রূপ দিতে ৷ দিগন্ত সিদ্ধান্ত নেয় স্থায়ীভাবে পন্ডিচেরি চলে যাবার৷ এই অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানায় বাবাই ৷ 'জে'কে যেতে দিতে চায় না সে ৷ আর এখান থেকেই শুরু হয় গল্পের নতুন অভিমুখ ৷মানবসম্পর্কের অনন্য উন্মোচন ৷ কমপিউটার গেমসের অনুষঙ্গ এনে বাবাইর মানসঝড়ে বিস্ফোরণের এক নন্দন এনেছেন গল্পকার এখানে ৷ সব পারিপার্শ্বিক নেতিকে জয় করার অর্জনে প্রাণিত হয়েছে সে ৷
অপরাধবোধ থেকে সৃষ্ট মানসপ্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ' মাঝরাতের সেই ফোনকল' গল্পটি ৷ আইন পেশায় যাঁর পশার জমিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তাঁদের বেআইনি জ্ঞানার্জনের বৃত্তান্তকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরেছেন 'সরগরম পেশা' গল্পে ৷ প্রচলিত উচ্চশিক্ষার প্রতি শ্লেষাত্মক ইঙ্গিত ৷' ভ্রষ্টাচারী ইঁদুর' গল্পে ইঁদুরের প্রতীকে ভ্রষ্ট মানবচরিত্রেরই উদ্ঘাটন করেছেন রম্য বর্ণনায় ৷ 'পাঁচজন মানুষ' গল্পে সমাজেরই পাঁচজন মানুষকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, যাঁদের জীবনধারা থেকে উন্মোচন করেছেন সহজিয়া যাপনকথার ৷
'মৃৎপাত্রজাতক' এক গভীর দর্শনের কথা বলে ৷ 'একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর' কিংবা 'মাটির এই পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রই' অথবা 'মানব দেহ মাটির ভান্ড' ইত্যাদি অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে মানবশরীর ও মানবজীবনের যে নশ্বর উপমা তুলে ধরেন লোককবিরা তার ভেতর সৃষ্টি ও লয়ের যো বার্তা রয়ে গেছে সেটাকে মৃৎপাত্রের আত্মকথনে তুলে ধরেছেন গল্পকার ৷ সিদ্ধার্থের প্রসঙ্গ এনে আসলে দেহভান্ড মাটিতে মিশে যাওয়ার সহজিয়া সাধনকথাকেই তুলে ধরেছেন ৷
'ধীরে বহে বেত্রবতী' ভারতপুরাণকথার বিনির্মান ৷ শুধু বিনির্মানই নয় ৷ গল্পের মাধ্যমে লোকচরিত্র উদ্ঘাটনের প্রয়াসও শিল্পিত হয়েছে ৷ বিষ দুক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল ৷ দানের অহংকারে সৃষ্টি হয় আত্মবিষ বা অস্মিতা ৷ আর খললোকের বিষও বিমোচিত হয় না সাধুসান্নিধ্যেও ৷ প্রভু কিংবা সখার ক্ষতিসাধনে এ বিষ সর্বনাশা শুধু নির্মোহ প্রেমানুভবই পারে সব বিষ নিংড়ে জীবনের গতি সচল রাখতে ৷ অসাধারণ প্রতীকী নির্মান এ গল্প ৷ জীবনের জন্যে জাগেন সন্মাত্রানন্দ ৷
............................................
ধীরে বহে বেত্রবতী/সন্মাত্রানন্দ
মূল্য: ১৪০ টাকা
প্রচ্ছদ: Charu Pintu
নীহারিকা পাবলিশার্স

ম্যান্ডেলার সন্ততি

মৃণালকান্তি দেবনাথ এই সময়ের শক্তিমান কবি ৷ তুলসী পাবলিশিং হাউস থেকে সদ্য বেরুলো তাঁর প্রথম কবিতার বই ম্যান্ডেলের সন্ততি ৷ এই প্রজন্মের এই কবির কাব্যভাষায় যেমন সময়ের ছাপ রয়েছে তেমনি বাংলাকাব্যের দীর্ঘপরিক্রমণের মানচিত্রটিও উঠে এসেছে নির্মানে ৷ 'ডোমনির ঘরফেরত পুরুষ হৃদয় জানে/ললিতা-বিশাখা ছিল ৷ ষোলশত গোপিনীও সত্য/ব্যালেন্স রাখতে পারলে সংসার সমৃদ্ধ হয় '৷ ( কৃষ্ণকথা) কিংবা 'নিমাই সন্ন্যাসেতে চলে গেলে/দল বেঁধে হা-হুতাশ, কান্নাকাটি হল খুব/ ফুল ফোটার সময়ে ফুলস্টপ দিয়ে রাতি পোহাইল' (ভোরবেলার কবিতা) অথবা 'সব অঙ্কে ভাগফল শূন্য জেনেও যাপনে চেয়েছি শান্তি/আর একবার লিখে যাই এই সত্য, আমি ছিলাম গোপীচন্দ্র/ আমি মৃণালকান্তি ৷(গোপীচন্দ্রের গান) এই রূপকাত্মক ভাষ্যেই অনুভব হয় কবির চলন বাংলাকাব্যের আব্রহ্মস্তম্ভপর্যন্ত ৷ আর সমুদ্যতসত্যের কাছেও কবি স্বচ্ছ ৷তিনি মূল্যায়ন করেন তাঁর যাপনের দ্বন্দ্বও ৷'যে সব আন্দোলনে নাম লিখিয়ে/মিছিলের সামনে হেঁটে একদা/যা কিছু নিপাত যাবার জন্যে/গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিয়েছি/ সে সব আসলে ছিল আমার নিজের বিরুদ্ধেই' ( শিরোনামহীন) ৷এতো সব ভুল গমন নয়, কবি কবিতাকে নিয়ে সংসার পাততে চান ৷ 'তুমি যদি রেখে থাকো নির্ধারিত টব/আমিকিন্তু হতে পারি মাথুর- যুবক!/ছেঁড়া জিন্স যুবকেরা অনুরাগী জানি, /তবু তোমাকে নিয়ে লিখেছি পাগলামি (বাস্তবিক) ৷ প্রচ্ছদেও সম্ভবত কবির হার্দ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাঙ্কযুবকের ছেঁড়া জিন্স

গীতগোবিন্দম

বাইরের সংকেত জানানোর জন্যে দরোজায় রাখা কলিং বেল নিয়ম মেনেই কথা বলে যায় ৷ সারারাত ঘাসের ডগায় অপেক্ষা করে শিশির ভোরের সূর্যমুখের আশায় ৷ লাল আভায় নিজেকেও রাঙিয়ে নেওয়ার সুখস্নান ৷ নিকটকথা দিয়ে মুড়ে দেওয়া মনমতো জানালা পর্দাআঁটা সহবৎ শিখে নেয় ৷ অনবরত ডোরবেল বেজে গেলেও যদি দরোজার ওপার থেকে সাড়া না আসে তবে নিবেদনের জন্যে পদাবলি জেগে থাকবে কী সদরঘাটে? রাধার নামে বাধারঘাটে যখন হুইসিল বাজিয়ে ছেড়ে যায় রাজধানীর ট্রেন আনন্দবিহারের উদ্দেশ্যে ৷ বিরহের মীড় যেখানে প্রবল গেঁথে যায় ধুলিজমিন ছুঁয়ে, ভেজা বালিতে কী লেখা যাবে পদপল্লবমের গোপন বাসনার কথা ৷ তাহলে তো আর একটা গীতগোবিন্দের জন্যে তুলট কাগজ কেঁদে যাবে ৷ তোমার তাতে কী সায় আছে রাই, সই?