Friday, June 19, 2020

পারভিন ও আমার মাসিপিসি

পারভিন ও আমার মাসিপিসি



সবার মতো আমারও সেই অবোধবেলায়
ঘুম পাড়ানির মাসিপিসি গেয়ে
মা আমাকে ঘুম পাড়াতেন রোজ ৷
আমি শুধু শব্দদুটো জেনেছি
মাসিকেও দেখিনি কোনোদিন পিসিকেও না ৷
অথচ শুনেছি আমার নাকি ছজন পিসি আর সাতজন মাসি ৷
আমার এই তেরোজন মাতৃসমা রমণীকে আমি কোনোকালে দেখিনি ৷
মায়ের মুখে শোনা এতগুলো মাসিপিসিদের সবার নামও আজ মনে নেই ৷
অভাগা তেরো সংখ্যার মতো তেরো মাসিপিসিদের 
শ্বশুরবাড়ির নামও কিছু কিছু শুনেছিলাম ওই মায়ের মুখে ৷
ঢাকার নরসিংদি, কুড়িগ্রাম,কুমিল্লার নবীনগর, সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ,নোয়াখালির মাইজদি, চাটগাঁয় ফটিকছড়ি
আর আমার শহরের  প্রান্তবর্তী নদীটির ওপারে
রামগড় নিয়ে পুববাংলা জুড়ে ছিল আমার মাসিপিসিদের ঘর ৷
মাসিপিসিদের ঘর গুনতে গুনতে আমার জানা হয়েছিল 
আমার পূর্বপুরুষের ভিটে বাংলাদেশের মানচিত্র ৷

সেই বাংলাদেশকে আরো বেশি করে জানলাম কৈশোরে
যেদিন  রফিকুল ইসলাম এসে উঠলেন হরিনার সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ৷
সঙ্গে একদল মুক্তিকামী টগবগে তরুণ ৷
যখন রেডিও খুললেই ভেসে আসত সাত মার্চের রমনা ময়দানের শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বজ্রকন্ঠ ৷
মা বলতেন, তোর মাসিপিসিরা এবার আসবে ৷
আমি তখন ছেলের দলের সাথে,
কৌটো নিয়ে চাঁদা তুলছি ছাত্রবন্ধুদের সাথে ৷
দাদাদের লঙ্গরখানায় বন থেকে কাঠ এনে ফেলেছি রান্নার জন্যে ৷
মনের পর্দায় ভেসে উঠছে অদেখা মাসিপিসির মুখ
তাদের জন্যে খিচুড়ি রাঁধছেন দাদারা ৷
 
বাড়ি এসে দেখলাম একটা পরিবার সামান্য সম্বল নিয়ে আমাদের উঠোনে বসে আছে ৷
মা তাঁর বাটা থেকে পানের খিলি গড়ে দিচ্ছেন এক মহিলার হাতে
দুটো ছেলের হাতে দুটি বিস্কুট ৷
বাবা সারাক্ষণ হাসপাতাল আর শরণার্থী শিবিরে 
রুগী দেখে ঘরে ফিরে মাকে ডেকে বললেন, এই দিদিদের আমাদের রান্নাঘরটা ছেড়ে দাও ৷
মা বললেন—গোরা, তোর বাবা যখন দিদি বলল তুই পিসি ডাকিস তাঁকে ৷
আমার তো ভালোই হল ৷ দুবেলা ঝগড়া করব নতুন ননাসের সাথে ৷
সেই জাহানারা ফুপু বেশ কদিন ছিলেন আমাদের বাড়ি
তাঁর দুই ছেলে রহিম আর তোতনকে নিয়ে ৷
আমাদের গোয়ালঘরটা ভাগাভাগি করে দুটো রান্নাঘর হয়েছিল আমাদের ৷
যে কদিন ওরা ছিল সে কদিন গোরুগুলো বাইরে বাঁধা থাকত ৷ সেসময়ে আমাদের গাঁঘরে তেল আর নুন ছাড়া কিছুই কিনতে হতনা ৷ ওদেরও চলে যেত ৷ মাঝে মাঝে মা নুনের পোটলা আর একশিশি তেল ওদের রান্নাঘরে রেখে আসতেন ৷
মাস দুয়েক পরে বাবা তদ্বির করে তাঁদের শিবিরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন ৷
 ফুপু কাঁদতে কাঁদতে যেন বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরের শিবিরে গেলেন ৷
এছাড়া আর কোনো পিসিমাসিকে আমি দেখিনি ৷
মাঝে মাঝে ফুপু আসতেন বাপের বাড়ি ৷ কারণ আমাকে তিনি আব্বা ডাকতেন ৷ যাওয়ার সময় মা এটা সেটা দিয়ে দিতেন রহিম ও তোতনের নাম করে ৷
একদিন জাহানারা ফুপু এলেন কাঁদতে কাঁদতে ৷ তার রহিম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে ৷ দেশে চলে যাবে যুদ্ধ করতে ৷ শিবিরের আরও অনেক ছেলে গেছে ৷
যুদ্ধশেষে একদিন ফুপু আর তোতন দেশে ফিরে গেছে পটিয়ায় ৷ রহিম সাথে ছিলনা ৷ তার খবর জানা যায়না ৷
আমার পিসি কিংবা মাসি বলতে ওইটুকুই প্রাপ্তি ৷

আজ আবার কুড়িগ্রাম! কুড়িগ্রাম!  আমার পিসির বাড়ি না মাসির বাড়ি ছিল ওখানে?  মনে নেই ৷ মনে পড়েনা ৷ মনে থাকার কথাও নয়? শাহনাজ পারভিন তুই কি আমার মাসিকে চিনিস? কিংবা আমার পিসিকে?  তুই আমার মাসির মেয়ে?  নাকি পিসির মেয়ে?  যে কোনোভাবেই আমার বোন!  

আমরা পরস্পর মৈত্রীর কথা বলি
আমরা পরস্পর ভালোবাসার কথা বলি
আমরা পরস্পর সংহতির কথা বলি 
আমরা পরস্পর সম্প্রীতির কথা বলি
আমরা পরস্পর সংস্কৃতির কথা বলি
আমরা পরস্পর মৈত্রী সেতু গড়ে তুলছি নদীর দুইপার জুড়ে
আর পারভিন বোন তোর ঠিকানা হয় নদীর মাঝজঠরে 

আমাদের বড়ো বড়ো কথা মুহূর্তে বিদ্রুপ করে ৷
এক লহমায় অশ্লীল নগ্ন মনে হয় ৷
কাঁটাতার শুধু সীমান্তে নয়
কাঁটাতার আমাদের বুকে গেঁথে গেছে আমূল ৷
ভুল সুতোয় গেঁথেছি আমরা প্রতিবেশীর রাখি
ভুল নির্মান হচ্ছে নদীর বুকে মৈত্রী সেতু
ভুল স্বপ্ন দেখি আমার পূর্বপুরুষের নদীমাতৃক বাংলাদেশ নিয়ে
সময় চলে গেছে বহুদূর সেসব রক্তধারা এবং জিনগত শেকড় উপড়ে নিয়ে ৷
শুধু থুথু লাগিয়ে লেফাফায় আটকে রেখেছি সব দুষ্টবুদ্ধি
যে কোনোদিন খুলে বেরিয়ে যেতে পারে সেসব ৷
পারভিনকান্ড বুঝিয়ে গেল আমাদের সুখের অতীত বুঝি হারিয়ে গেছে একেবারেই
আর সমস্ত শুভবোধ পরাভূত কাঁটাতারের দংশনে ৷

'বাবা' শব্দে পিতৃতর্পণ

#'বাবা' শব্দে পিতৃতর্পণ#

       'পিতা' একটি দুঅক্ষরের শব্দ ৷ এই শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার সৃষ্টিকথা ৷ আমাকে যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি প্রতিনিয়ত তৈরি করে চলেছেন ৷ আমাকে যিনি বিশ্বসংসার চিনিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি ঝড়বাদলাদিনে বিপর্যয়ে প্রাকৃতিক রোষ থেকে রক্ষা করেছেন ৷ আমাকে যিনি সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করার মতো সাহস জুগিয়েছেন ৷ আমাকে যিনি সফল জনক হিসেবে উত্তরণের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিয়েছেন তিনিই আমার পিতা ৷ ঠিক এমনই কিছু ব্যক্তিগত পরিবর্তন কিংবা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়েই হয়ে
 ওঠেন প্রত্যেক পিতা ৷ প্রত্যেকের কাছেই
 প্রত্যেকের পিতা এক বিশাল মহীরুহ ৷
 এক নির্ভরতার স্থল ৷ নিরাপত্তার জায়গা
 ৷ বিশ্বাসের ভূমি ৷ এক সুবিশাল ছায়াতরু
 ৷ সেকারণেই পিতাকে বসানো হয়েছে
 শ্রেষ্ঠতম সম্মানিত স্থানে ৷ সংস্কৃত শ্লোকে
 আছে—

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্বদেবতাঃ

   একারণেই জগৎসভার নিয়ন্তাকে, বিশ্বস্রষ্টাকে বলা হয় 'পরমপিতা' ৷ বলা হয় 'এক পিতা হতে সবার উৎপত্তি' ৷ ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গুরুকে পিতার আসনে বসানো হয় ৷ তিনিও পিতার সমতুল্য ৷ শিষ্য-শিষ্যাগণ তাঁর সন্তানসম ৷

      একসময় যে অর্থে পিতা শব্দটি ব্যবহৃত হত কালক্রমে তাই পরিবর্তিত হয়ে 'বাবা' শব্দে বাংলাভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে ৷ সংস্কৃত 'বপ্তা' শব্দের অর্থ হল যে বপন করে ৷ এটি একটি বিশেষণ পদ ৷ এই 'বপ্তা' থেকে ধ্বনিতাত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ( বপ্তা> বপ্পা> বাপা> বাপু> বাবু> বাবা)  'বাবা' শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে ৷ সংস্কৃত ও হিন্দিতে 'বাপু' পিতা, সন্তান, মান্য ও সম্ভ্রান্ত অর্থে ব্যবহৃত হয় বাবু( বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ—রবীন্দ্রনাথ)  ৷ প্রাচীনবাংলায় যখন বৌদ্ধচর্চার প্রাধান্য ছিল তখন 'বপা' শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় ৷ প্রাচীন বৌদ্ধ দোঁহা ও গান, আদি বাংলাভাষার মান্য নিদর্শন চর্যাপদে পাই—'সরহ ভণই বপা উজকট ভইলা' ৷—চর্যা-৩২/৫ ৷ বাংলাদেশে মুসললমান রাজত্বের আগে 'বাপু' শব্দটির প্রচলন ছিল ৷ 'শুন বাপু চাষার বেটা'—খনা ৷ আবার মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে দেখি—'সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিত্তল/ঘষিয়া মাজিয়া বাপা কইরাছ উজ্জ্বল' ৷—কবিকংকন মুকুন্দরামচক্রবর্তী
-চন্ডীমঙ্গল ৷ পরবর্তীসময়ে মুসলমান রাজত্বকাল থেকে ফারসি 'বাবা' শব্দটি বাংলা শব্দভান্ডারে স্থান করে নেয় ৷তখন থেকে পিতা অর্থেই 'বাবা' শব্দটির বহুল ব্যবহার হয়ে আসছে ৷

   বাংলার উপভাষাগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে অঞ্চলবিশেষে শব্দটি বাবা> বা'> বাবাজি> বা'জি> বাবু> বাউ> বাপ> বাপন ইত্যাদি নানাভাবে উচ্চারিত হয় ৷
ছোটোদের প্রাচীন খেলার ছড়াতে পাওয়া যায়—'আপন বাপন চৌকি চাপন/এই পুলাডা চকি চোর' ( চকি-খাটিয়া) ৷ সংস্কৃত প্রবাদে যেমন বলা হয়—'যৎ বীর্য তৎ পরাক্রম' তেমনি চট্টগ্রামী বাংলায় একটি সুন্দর প্রবাদ আছে—ভুঁইঅর গুণে রোয়া/বাফর গুণে ফুয়া' ৷ আবার কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ হালকা রসিকতায় দিনযাপনের বেদনার কথা প্রকাশ করেন—'বাপে পুতে ডাইক্কা ভাই/কুনুমতে দিন কাডাই' বলে ৷ যশস্বী সন্তানের ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়—'বাপের নাম রাখছে' তেমনি কলংকিত সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়—'বাপের নাম ডুবাইছে' ৷ 'বাপ কা বেটা সিপাইকা ঘোড়া/কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া'—এই হিন্দি কহাবৎটি বাংলাতেও সম্পূর্ণ বা আংশিক ব্যবহার করা হয় কিংবা বলা হয়—'বাপের পুত' ৷ বেওয়ারিশ সন্তানের বিশেষণ হয়—'বাপে তাড়ানো মায় খ্যাদানো' ৷ সন্তানের প্রতি যত্ন, স্নেহ ও দায়িত্ববোধের সুন্দর নিদর্শন পাওয়া যায় 
একটি নোয়াখালি প্রবাদে—'হিম্বার লাই মাডিৎ রাখি ন/ উউনের লাই মাথাৎ রাখি ন' ৷( পিঁপড়ে ঘিরে ধরবে বলে মাটিতে রাখিনি ৷ উকুনে কামড়াবে বলে মাথায়ও রাখিনি) ৷ একটি গ্রাম্য শোলোকেও প্রকারান্তরে 'বাপ' শব্দটি এসেছে—'বাপে নাহি জন্ম দিল, জন্ম দিল পরে/ যখন পুতে জন্ম নিল মা ছিলনা ঘরে' ৷ (কুশ-রামায়ণের চরিত্র) ৷

  বাংলা লোকসাহিত্যের মতো প্রাচীন বাংলাসাহিত্যেও 'বাবা' এসেছেন নানাভাবে ৷ এর মধ্যে মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র ও রামায়ণের দশরথ চরিত্রদুটি কাহিনির পটপরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল ৷ মহাভারতের রক্তক্ষয়ী, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধটিও সংঘটিত হয়েছে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রস্নেহের কারণে ৷ তিনি আক্ষেপও করেছেন, 'অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে' ৷ রামায়ণে পিতা দশরথের একটি সিদ্ধান্তের কারণে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রকে সিংহাসনে আরোহনের পরিবর্তে চোদ্দো বছর বনবাসে কাটাতে হয় ৷ আর পুত্রবিরহাতুর দশরথকেও মৃত্যুশয্যায় শয়ন করতে হয় ৷ এরকম আরও ছোটোখাটো পিতৃচরিত্র দুই মহাকাব্যে রয়েছে ৷ রামায়ণ এবং মহাভারতে তো পিতাপুত্রের মধ্যে যুদ্ধের ঘটনাও রয়েছে রাম ও লবকুশ এবং অর্জুন ও বভ্রূবাহনের মধ্যে ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তে জানি নৃশংস কংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে সদ্যোজাত কৃষ্ণকে ঝড়জলের মধ্যে 'বসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে৷ নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে' ৷ মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যে শিবকে দেখি কোনোরকম পিতৃদায়িত্ব তিনি পালন করেননা ৷ গাঁজা ভাং সেবন করেন ৷ শ্মশানে মশানে ঘুরে বেড়ান ৷ বাবা ভোলানাথ ৷ অন্নদামঙ্গলে দেখি ঈশ্বরী পাটনি বলছেন— আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে ৷ কী সহজ সরল প্রার্থনা সন্তানের জন্যে ৷

ঐতিহাসিক কাহিনি অধ্যয়ন করলে আমরা দেখি মুঘল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন যখন অসুস্থ হন তখন সমস্ত হেকিম-বদ্যিরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাঁকে সুস্থ করে তুলতে পারছিলেননা ৷ তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল ৷ তখন পিতা বাবর তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনকে তাঁর জীবনের বিনিময়ে বাঁচানোর জন্যে ঈশ্বরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন ৷ তারপর ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন ৷ কিন্তু সম্রাট বাবর আর বেশিদিন বাঁচেননি ৷ 'মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোনো ক্ষয়,/ পিতৃস্নেহের কাছে হয়েছে মরণের পরাজয়' ৷ কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর 'জীবন বিনিময়' কবিতায় মর্মস্পর্শী ভাষায় এই ঘটনা বর্ণনা করেছেন ৷ আধুনিককালের অর্থাৎ এই সময়ের শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবি শঙ্খ ঘোষও তাঁর জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এক আর্ত পিতার অবস্থান থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমকে কেন্দ্র করে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'বাবরের প্রার্থনা' ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কবিতাটির রচনাকাল ১৯৭৪ সাল ৷ 'কবিতার প্রাকমুহূর্ত' গ্রন্থে কবি উল্লেখ করেছেন—কবিকন্যা কিছুদিন যাবত অসুস্থ ছিলেন ৷ দিন দিন তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল ৷ সেসময়ে একদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তিনি নির্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে পায়চারি করছিলেন ৷ হঠাৎ তার মনে পড়ে ঐতিহাসিক ঘটনাটি ৷ এই ঐতিহাসিক তথ্যকেই কবি এক নবতর তাৎপর্যে মন্ডিত করেন কবিতাটি ৷ এই শিরোনাম ব্যবহার করে আরো কিছু কবিতাসহ একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন ৷ 'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থটির জন্যে তিনি ১৯৭৭সালে আকাদেমি পুরস্কার পান ৷ ঐতিহাসিক চরিত্র বাবর মানবিক গুণে একজন যথার্থ পিতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান ৷ শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিতায়ও পরমপিতার কাছে প্রার্থনা করেন—

          আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার
          জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?
          ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
          আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক ৷
              (বাবরের প্রার্থনা-শঙ্খ ঘোষ)

    রবীন্দ্রনাথঠাকুরের একটি অসাধারণ ছোটোগল্প 'কাবুলিওয়ালা' ৷ এই গল্পের প্রধান চরিত্র রহমত ৷ রহমত তার দেশের মাটিতে রেখে আসা শিশুকন্যাটির স্মৃতিচিহ্নকে বুকের মধ্যে ধারণ করে কোলকাতা শহরের পথে পথে পণ্য ফিরি করে ৷ রবীন্দ্রনাথ রহমতের পিতৃহৃদয়ের বেদনাকে উন্মোচিত করেছেন এই গল্পে—' কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ ৷ ফটোগ্রাফ নহে ৷ খানিকটা ভুষা মাখাইয়া কাগজের উপর তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে ৷ কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে—যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশু হস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধা সঞ্চয় করিয়া রাখে' ৷ এছাড়া একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় মনিবের শিশুসন্তানটি জলে ডুবে যাওয়ার প্রেক্ষিতে অপরাধবোধ থেকে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়ার পেছনে আপন সন্তানের সুখৈশ্বর্যের ছদ্ম আকাঙ্ক্ষাটিই রয়ে গিয়েছিল এক দরিদ্র পিতার মনে ৷ তারই নিদর্শন পাই রবীন্দ্রনাথের আর একটি ছোটোগল্প 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা'য় ৷ আসলে বাবা শুধুমাত্র একটি শব্দ নয় ৷ মানবিকতার, মনুষ্যত্বের এক প্রতীক বাবা ৷ বাবার ভূমিকাই মুখ্য থাকে সন্তানের জীবনগঠনে ৷ বাবার মানবিক গুণগুলো সন্তান অনুকরণ করে ৷ শ্রেষ্ঠ বাবাই গড়ে তুলতে পারেন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান ৷

আমরা এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি ৷ কঠিন পরীক্ষারও ৷  আজকের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূষিত বাতাস ঢুকে গেছে ৷ হিংসা, স্বার্থপরতা, লোভ, হানাহানি বেড়ে গেছে সমাজে ৷ মানুষের অন্তর্নিহিত সুকুমার বৃত্তিগুলো আজ অন্তর্হিত ৷ মায়া, মমতা, স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা যেন আজ সুদূর আকাশের নীহারিকা ৷ মানুষের মানবিক গুণগুলো আজ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে ৷ বহু পিতার মধ্যে আজ পিতৃত্বের গুণগুলি খুঁজে পাওয়া দুস্কর ৷ ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্ষুদ্র মোহ আর ক্ষণিক সুখের হাতছানিতে আজ তারা নিমেষেই ভুলে যাচ্ছে পিতৃকর্তব্য ৷ বিশ্বায়নের ফলে পণ্যসংস্কৃতির আগ্রাসনে ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, শৃঙ্খলা ৷ পিতার পাশাপাশি সন্তানেরও যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বাবা মায়ের জন্যে ৷ কিন্তু তাও আজ অবহেলিত ৷ বার্ধক্যে এসে সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অসহায় বাবা ৷ ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক সন্তান নিতে পারছেনা বাবার শেষের দিনগুলোর দায়িত্ব ৷ সর্বোপরি এই করোনাক্লিষ্ট সময়ে দূরপ্রান্তে জীবিকার দাগিদে ব্যস্ত হয়ে এবং লকডাউনে আটকা পড়া সন্তান যেমন নিতে পারছেনা প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তেমনি আবার কোনো কুলাঙ্গার ও পাষন্ড সন্তান এই লকডাউনের মধ্যেই বৃদ্ধ বাবাকে গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসছে ৷ আমরা জানিনা এই অমানিশা থেকে পরিত্রাণ কবে ঘটবে আবার ৷ এই সময়ে সন্তানের লালনবঞ্চিত অসহায় পিতার হাহাকার ধ্বনিত হয় নচিকেতার জনপ্রিয় একটি গানে—

   ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
    মস্ত ফ্ল্যাটে যায়না দেখা এপার ওপার
    নানানরকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
    সবচাইতে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি
    ছেলে আমার-আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
    আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম ৷
—একেবারে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে সমকালের অসহায় পিতার যন্ত্রণার দিনলিপি ৷ সারাজীবন দায়িত্ব পালন করে শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই হয় বাবার ৷
   এই অসহায়তা এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাবা কিন্তু বাবাই ৷ সন্তানের কল্যাণই প্রতিটি পিতার একমাত্র কাম্য ৷ মুঘল সম্রাট শাহজাহান এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু হল পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ ৷ পিতার জীবদ্দশায় এর চেয়ে বিড়ম্বনা আর কিছু হয়না ৷ আর কিছু নয় ৷ জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও প্রতিটি বাবা উচ্চারণ করেন—

    এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
    চাঁদ ডাকে  :  আয় আয় আয়
    এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
    চিতাকাঠ ডাকে  :  আয় আয়

    যেতে পারি
    যে-কোনো দিকে চলে যেতে পারি
    কিন্তু কেন যাবো?

    সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
     ( যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো—শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

Wednesday, June 17, 2020

মা য়া ব র ণ

মায়াবরণ
--------------
         - 

জমানো পাতাগুলো উল্টে যেতেই হয় সামনের দিকে 
ট্রাফিক নিয়মে দাঁড়ালেও থেমে থাকা যায় না 
পেছনে নিঃশ্বাস ফেলে অগুণতি দ্রুত আরোহী 
ফেলে আসা পথের ধুলো কখন হাওয়ায় উড়েছে 
মুছে যায় সমস্ত মায়াচিহ্ন ফেরা তো যায় না । 

পেছনে মুছে আমার পায়ের কোমল দাগ 
সমানে সামনে পা ফেলা আমি নিজেকেই হারাব 
একদিন। যেদিনের সংকেত জানা নেই আদৌ।

Sunday, June 14, 2020

ক ল হ

কলহ

কাল রাত থেকে চন্দ্রাবলি মেঘ পালিয়ে
আঁধারে তমালকুঞজে কালিয়াবিলাস
জেনে গেছে গোপযৌবনা কলহআঁচে

তাই ঘন ঘন বাজ পড়ার গর্জন,
 বিজলির ছোবল মেঘের কলজে বরাবর

Saturday, June 13, 2020

জী ব ন জ ল

জীবনজল

মহলে জল নেই কিংবা জলনির্মিত মহলও নয়
তবুও এ নির্জনমহল নীরমহল,জলপ্রাসাদ ৷

মাণিক্যরাজ বুঝেছেন  জলের অবদান
জীবন জাগিয়ে রাখার জলপিরিত আর জলার্ত যাত্রা

তাই অনিদ্র জলের ঢেউ মহলের গায় চাঁটি মেরে গায় জীবনের ভাওয়াইয়া

Tuesday, June 9, 2020

মৌ সু মি

*** মৌসুমি ***
    

দক্ষিণে যাওয়া বারণ
বালাইর দোহাই পাড়ে সবাই
অথচ দক্ষিণ থেকে তুমি উড়ে এলে
চরাচর শীতল হয়ে যায়
নির্বিষ সাপের মতো মাথা নোয়ায়
খরশান দহনকাল

ও কালো মেয়ে, তুমিই মৌসুমি

কোথাকার বাঙালি কোথায় দাঁড়ায়

কোথাকার বাঙালি কোথায় দাঁড়ায়
********************************
এটা আমার বাবার পরিচয়পত্র ৷ 1948 এ কোলকাতা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা প্রস্তুতিতে সুপারভাইজারের দায়িত্ব সামলেছিলেন ৷ গতকাল বিরাটি সংলগ্ন বিষরপাড়ার আমাদের পিসতুতো দাদা আমার ছেলের হাতে তুলে দিলেন তার ঠাকুরদাদার আইডেন্টিটি কার্ডটি ৷ অশ্রুসজল চোখে দাদা বললেন আমি আর কদিন আছি ৷ তোমাদের সম্পদ তোমরা বুঝে নাও ৷ দেশভাগ আমাদের যে কতোটা ছন্নছাড়া করেছে এই ভিটেতে পা রেখে অনুভব করলাম ৷ যিনি আমাদের ভদ্রাসনকে এতোদিন আগলে রেখেছেন, কী দৈন্যদশা এই আবাসের  ? অথচ আমরা শুধু চিঠি চাপাটিতেই সম্পর্কটা জিইয়ে রেখেছি এতোদিন ৷  এসে না দেখলেই বোধহয় ভালো ছিল ৷ উনি খুবই আগ্রহের সঙ্গে বলছেন, তোমরা এসো ৷ ঘর-টর একটা করো ৷ আমিও এক কোনায় শেষ কটা দিন কাটিয়ে দিই ৷ ঝড়বৃষ্টিতে তো বহুদিন কাটালাম ৷ আমি শুনছি আর ভাবছি অন্য কথা ৷ শেষ বয়সে আমি কী আর মিলিয়ে নিতে পারব নিজেকে ৷প্রয়োজনীয় পরিচিতি আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে ৷ তার চেয়ে ত্রিপুরায় আমার একটা নিজস্ব পরিমন্ডল রয়েছে ৷ আমার কাতরতা সেদিকেই ৷ সবচেয়ে গুরুতর যে বিষয়টা লক্ষ্য করছি ৷ আমাদের দুভাইয়ের কথোপকথনে কোনো আগ্রহই নেই আমাদের উত্তর প্রজন্মের ৷ তার কাছে আমার বাবার ছবি 'কেবলই ছবি' ৷ তাদের ভদ্রাসন হয়তো রাজারহাটের এগারো তলা ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ কুঠুরি আর তার বনসাই বাগিচার লন ৷ নাড়ির টান এভাবেই ছিন্ন হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ৷ আমার সন্ততি, বাঙালির আগামী প্রতিনিধি কোথায় থিতু হবে কে জানে ! আমি কী বলব?  দাও বর মোরে হেন, আমার সন্তান যেন, চিরদিন থাকে ..?..?..?

স্নি গ্ধ সং লা প

স্নিগ্ধসংলাপ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সন্ধ্যাকুসুম আতর বিলোবার আগেই 
পাঁচনি ফেলে পালাতে হবে মাঠচাতালের শেষ গন্ডিতে

আঁধারের ঝাপটায় ডানা ঝেড়ে উড়ে যাবে নিশিপাখি

রাসের মন্ডপে রাখা আড়বাঁশি লম্পট ঠোঁটের আশায়
বাসরের ঘিয়ের বাতির সলতে উসকে যাবে ভৌমতেলে

যে কথা কতোকাল উসখুস করেছে ওষ্ঠের গুহায়
আজ তার জন্মদিন পালনের সাইরেন বেজে উঠেছে

এসো,প্রিলিউডের মূর্ছনায়  সমস্বরে বলে উঠি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি ৷