Tuesday, September 24, 2019

ভেঙে মোর ঘরের চাবি

গতকাল সন্ধ্যায় আগরতলা চেকপোস্টের সর্বশেষ বাধা অতিক্রম করে যখন বাইরে এসে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের সম্মাননীয় অতিথিবর্গ তখন আপনমনেই বলে উঠলেন  এই সময়ের শক্তিমান কথাকার, জলজীবনের নিবিড় উন্মোচক শ্রদ্ধেয় হরিশংকর জলদাস , 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে' ৷ ভাবছিলাম, হঠাৎ করেই কী এই রবীন্দ্রসূক্ত উচ্চারিত হল তাঁর ওষ্ঠদ্বয়ে ? স্বীয় ভূখন্ড পেরিয়ে এসে আর এক ভূমিতে চরণচিহ্ন দিয়েই তিনি যেন অনুভব করলেন বৃহতের আহ্বান ৷ আবহমানকাল ধরে  প্রবাহিত যে রক্তধারা, যে সংস্কৃতির স্রোতস্বী পুরুষানুক্রমে তিনি বহন করে চলেছেন তারই প্রতিফলন যেন এই অমোঘগোধূলির মায়াঅন্ধকারে এই ভূমিভাগেও চিরবিচ্ছুরণ ঘটছে ৷ এখানেই নিজেকে হৃদয় উজাড় করে মেলে ধরা যায় ৷ এখানে তাঁর অন্তর্গত ভদ্রাসন থেকে বেরিয়ে এসে বৃহদালয়ে প্রবেশের কাঙ্ক্ষার তীব্র আর্তি উৎসারিত ৷ মানুষের জীবনের প্রতিমুহূর্তের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে, প্রতিপলের  সুখ আহ্লাদের সঙ্গে ও তার বিপরীতে মানবিতার চরম অসম্মানের দগ্ধক্ষণের সঙ্গে  নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির  বিশাল ভুবনের মকরন্দের আস্বাদটি যাঁরা নেন তাঁদের কাছে আপননিলয়টি অনেক পেছনে পড়ে থাকে ৷ এক তীব্র যন্ত্রণা থাকে অসীমের মহালয়ের সঙ্গে মিলনের ৷ আরো আরো বড়ো জগৎটার সঙ্গে মিলিত হবার ৷ একজন জীবনসন্ধানী নিজেকে ভেঙে আসার আকুতি আজীবন বয়ে চলেন ৷ একজীবনভর খুঁজে ফেরেন সেই সত্যপিরকে যিনি ক্ষুদ্রকায় প্রায়ান্ধকার অলিন্দ থেকে তাঁকে বিশ্বপ্রাসাদের বিরাট আঙিনায় পোঁছে দিতে পারেন ৷ আর সেই মধুঅঙ্গনের সঙ্গে বহুপরিচিত 'মোর ঘরের' সাথে কোনো মিল থাকেনা ৷ সেখানেই তো জীবনের আসল আনন্দযজ্ঞ ৷ অকৃত্রিম প্রতিবেশ ৷ জীবনসন্ধানী সে পথ দিয়েই পায়ে পায়ে এগিয়ে যান ৷ তার জন্যে কম্পাস সেই অন্তর্পুরুষ ৷ যিনি পারেন ঘরছাড়া করাতে প্রতিটি সৃজনকর্মীকে ৷

সেপ্টেম্বর একুশ, দুহাজার আঠারো

Sunday, September 22, 2019

শব্দব্যবহার

Sankha Sengupta  আগে আগামতর্পন:
আগে একটা পরিচিত চুটকি মনে করিয়ে দিই ৷ একযুবক একটা সেলুনে ঢুকেছে দাড়ি কাটানোর জন্যে ৷ ক্ষৌরকার তার একগাল কামিয়ে দিয়ে যুবকের গায়ে দেওয়া এ্যাপ্রনটা খুলে ফেলল ৷ যুবক বলল, কী ব্যাপার?  আমার আর একগাল? ক্ষৌরকার উল্টোদিকের আর একটা সেলুন দেখিয়ে দিল ৷ ওটা ওই দোকানে হবে ৷ কেন?  এখানে নয় কেন?  তরুণ ক্ষৌরকর্মী উত্তর দিল, আমি যে বছর এই কোর্সটা করি সেবছরের পরীক্ষায় ডান গালটা কমন ছিল ৷
গতসন্ধ্যায় আমার শহর সাব্রুমের বাজারে একটা ঘোষণা হয় ৷ তার সংক্ষিপ্ত বয়ানটা তুলে ধরছি ৷ 'বিগত কিছুদিন আগে সাব্রুম বাজারের ব্যবসায়ী.......... প্রয়াত হয়েছেন ৷ তাঁর আত্মার সদ্গতি কামনার্থে আগামীকাল সন্ধ্যায় এক শোকসভার  আয়োজন করা হয়েছে ৷ উক্ত সভায় বাজারের সমস্ত ব্যবসায়ীদের উপস্থিত
থাকার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে ৷ ধন্যবাদান্তে সাব্রুম বাজার ব্যবসায়ী কমিটি ৷
এর কিছুক্ষণ পরে আমি যখন সান্ধ্য আড্ডার উদ্দেশ্যে বাজারে আসি তখন আমার কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র ও পরিচিত যুবক আমাকে বিনয়ে প্রশ্ন করল, স্যার এনাউন্সটা কি ঠিক হয়েছে?  আমি জিজ্ঞাসা করলাম,  কী হয়েছে?  তখনও ঘোষণাটা চলছিল ৷ একজন বলল, ওই যে বলছে, 'বিগত কিছুদিন আগে' আর 'ধন্যবাদান্তে' ৷ 'কিছুদিন আগে' বলল, আবার 'বিগত'ও বলল ৷ আর শোকসভার জন্যে কী ধন্যবাদ জানিয়ে আমন্ত্রণ করা ঠিক হল?  আমিও মজা করে বললাম, তোমাদের যখন পড়াই তখন কী এরকম কিছু সিলেবাসে ছিল?  ওরা সন্তুষ্ট হলনা আমার কথায় ৷ না স্যর ৷ মজা করবেননা ৷ সিরিয়াসলি বলছি ৷ কেউ যাতে মনে কষ্ট না নেয় তারজন্যে একটু মোলায়েম করেই আমাকে ব্যাখ্যা করতে হল যে, মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাবশত আহ্বানটা ধন্যবাদান্তে না হয়ে শোকাহত বা শোকসন্তপ্ত হওয়াই কাম্য ৷ এরকম নিতান্ত নগণ্য সহবতগুলো আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী থেকে শিখতে হয়না ৷ অন্তরের শিক্ষকই শিখিয়ে দেন ৷ সেই মুর্শিদের নূর না পেলেই যতই বিদ্যার বড়াই করি না কেন জীবিত মানুষটিরও অমরত্ব কামনা করে ধ্বনি দেব আমরা ৷ আর পরিবেশিত বিষয়কে পোক্ত করার জন্যেই পাশাপাশি সমার্থক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায় ৷
নামবিকৃতিপ্রসঙ্গ:  এই যে প্রসঙ্গটা উঠল আমি এটাকে বিকৃতি বলবনা ৷ এই পরিবর্তন যেমন পূর্ববঙ্গীয় বাংলা উচ্চারণে রয়েছে তেমনি পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায়ও রয়েছে ৷ আমরা যেমন দুলাইল্লা/ দুলাইল্যা তেমনি পশ্চমবঙ্গেও দুলালে ৷ মনে করোনা শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত সংলাপ—  রাখালে, গিরীশ আমাকে দেড়খানা নুচি খাইয়ে এমন গালাগাল দিলে রা ! রাখাল এখানে 'রাখালে' ৷ আমরা পূর্ববঙ্গীয়রা বলতাম 'রাখাইল্লা' বা 'রাখাইল্যা' ৷ সবটাই কিন্তু ব্যাকরণের নিয়ম মেনে হচ্ছে ৷ বেশি লম্বাচওড়া রাস্তায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলি ৷ মূল নামপদ রাখাল থেকে পরিবর্তিত দুটো রূপ পেলাম ৷ রাখাল>রাখালে>রাখাইল্লা/রাখাইল্যা ৷ প্ৰথম পরিবর্তনটাকে বলা হয় অভিশ্রুতি ৷ আর দ্বিতীয় রূপটি হল অপনিহিতি ৷ এরকম পরিবর্তন ক্রিয়াপদেও লক্ষ করা যায় ৷ অভিশ্রুতির উদাহরণ রাঢ়ী অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলায় পাই ৷ এবং অপিনিহিতির লক্ষণ বঙ্গালী অর্থাৎ পূর্ববঙ্গীয় বাংলায় পাই ৷ এইধরনের লক্ষণ চাকমা ভাষায়ও আছে ৷ যেমন বিমইল্লা কিংবা বরপেদা ইত্যাদি ৷ নামের সঙ্গে এই বাংলা প্রত্যয়ের যোগ করে উচ্চারণে দুটো মানসিক প্রভাব পড়তে পারে ৷ এক-আন্তরিকতা বা সম্পর্কের নৈকট্য ৷ দুই- বিরোধ বা অশ্রদ্ধা ৷ তবে ব্যবহার ব্যাকরণসম্মত ৷
* দীর্ঘ লেখাটায় একটাও বানান ভুল থাকলে মার্জনা চাই ৷ বিস্তৃত না লেখায় ব্যাখ্যা অস্পষ্ট থাকতে পারে ৷ সাক্ষাতে পরিশ্রুত হব ৷

Saturday, September 21, 2019

শ র ৎ

তোমার চোখ
      শিউলি ফুলের মতো
           আকাশমুখী
##################
           চলো হে সই
        যেখানে পাহাড়ের
           সঙ্গমে মেঘ
###################   
          সহেলির চুমু
       আঁচড় কেটে গেছে
         আঁচলে ঢাকো
###################
           বর্ষার তাড়া
         ঘরছাড়া হয়েছে
            শরৎকাল
#############

Friday, September 20, 2019

সেতু

আমাদের সংসারে
মা, প্রাচীন  সাঁকো

নড়বড়ে সেতুটা
ভাঙলো বলে

আর সংসারের
শেষ বাঁধনও

মা

বিছানায় সাদা থান জড়িয়ে
মৌন শয্যায় পবিত্রতা

কাত হয়ে দেখেন
চিলেকোঠার আকাশ

অলীক ক্যানভাসে ভাসে
অতীতের সন্ততিবর্গ

মেঘলা মনে
অনিকেত ডাকঘরের
খাম হাতড়ে ফিরছেন

আমার মা
ক্রমশ সুদূরে সরে যাচ্ছেন
আমাদের নিঃস্ব করে

Friday, September 13, 2019

ঘু ঙু র লি পি


রাতঘুঙুরের সুরবাহারি শিসে জেগে ওঠে সুপ্ত তারা
মেঘের জমাট জীবাশ্মের শরীর ছুঁয়ে হেঁটে যাই নিঝুম
স্নায়ুর ভেতর বেজে ওঠে বুনো মাদল দুরন্ত আওয়াজে
হরিনীরা ঈশ্বরীর মতো ঘুরে বেড়ায় জোছনার ঘাসবনে

প্রাচীন ঘরের সব দরোজায় শেকল টেনে বেঁধে রেখে
আত্মপ্রসাদে নিশ্চিন্ত হই কাঁটাতারের আড়ালে
বিষাগোধূলির ভদ্রাসন ভুলে পর্ণমোচী সুখের ইসারায়
জমি- জিরেত, পুকুর-কুটুম্ব ফেলে যাই ৷ গ্রস্ত হই নিকষ আঁধারে ৷

শতাব্দীপ্রবীন ভূভাগের বুক জুড়ে যখন কান্নার সুর বাজে
দেখি যতো পিতৃপুরুষেরা গান ধরেন বিচ্ছেদী উঠোনে
আমরা পরস্পর চোখে চোখ রাখতে পারি না কেন যে
চেয়ে থাকি দিগন্তের দিকে কখন ভেসে উঠবে আলোকের গান

মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙে ৷ প্রাগৈতিহাসিক ঘুম টুটে আমাদের ৷
তখন হৃদয়ে আলোড়ন তুলি, আমরা সব কাতর কবিয়াল ৷