Monday, February 27, 2023

অন্তরালে চলে যাওয়া রাজ্যের বহুমুখী প্রতিভা

অন্তরালে চলে যাওয়া রাজ্যের বহুমুখী প্রতিভা

 ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী সাব্রুমের কৃতি সন্তান । তিনি ১৯৫০ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি এই মহকুমার ব্রজেন্দ্রনগর গ্রামের রানিবাজারস্থিত বিখ্যাত দামোদর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবা প্রয়াত সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন দামোদরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা । সেকালে এই দামোদরবাড়িকে কেন্দ্র করেই গোটা এলাকায় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রবাহিত হত । সত্যেন্দ্র চক্রবর্তী নিজে হাতে দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতেন । ফলে ড. চক্রবর্তী শৈশব থেকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে নিজেকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠেন । তাঁর বাবা মুখে মুখে তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করতে পারতেন । কখনো কখনো তিনি কবিগানের আসরে কবিয়াল এর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতেন । তিনি একজন দক্ষ যাত্রাশিল্পীও ছিলেন । তাঁর রত্নগর্ভা মা রোহিনী চক্রবর্তী গৃহাভ্যন্তরেই নিভৃতে সাংসারিক কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকতেন ।

বাবার এইসব গুণগুলো তার মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল । ছোটোবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন । পড়াশোনার পাশাপাশি অল্পবয়সেই তিনি গল্প, কবিতা লেখায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন । চিত্রশিল্পেও ছিল তাঁর দক্ষতা । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তাঁর আঁকা শরৎচন্দ্রের একটি পোট্রেট দেখে সে সময়ের  শিক্ষামন্ত্রী কবি অনিল সরকার তাঁকে আগরতলায় নিয়ে গিয়ে শিক্ষাদপ্তরের গবেষণা বিভাগে দায়িত্ব দেন । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারিতে তিনি এনসিসি-র কমিশনড অফিসারেরও দায়িত্ব পালন করতেন । বাংলা বিষয়শিক্ষক হিসাবেও ছিল তাঁর অপরিসীম দক্ষতা । সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি এমবিবি কলেজ থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্ত ডিগ্রি লাভ করেন । তারপর দীর্ঘবছর যাবত টানা গবেষণাকর্মে লিপ্ত থেকে বহু ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে ২০০২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  অধ্যাপক ড. পল্লব সেনগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ও স্নেহসান্নিধ্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন । তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ববঙ্গের লোককাহিনি' । কিন্তু আর্থিক দুর্বলতার কারণে এই বিশাল অভিসন্দর্ভটি গ্রন্থাকারে আজও প্রকাশ করতে পারেননি । 

অল্পবয়স থেকেই ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী রাজ্যের  লেখালেখির জগতে সারা ফেলে দেন । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পিটিআই'র ত্রিপুরার প্রতিনিধি অনিল ভট্টাচার্যের সহযোগী হিসেবে রণাঙ্গনের এক নম্বর সেক্টরে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন । তিনি একজন অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফারও । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে খবর সংগ্রহের সময় তাঁর ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতাও বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে । সে সময়ে তার রিপোর্টিং ও ছবি যুগান্তর সহ দেশ-বিদেশের বহু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় । আজ সেটা বিস্মৃত অধ্যায় ।

 কবিতায় তাঁর নিপুন হাত । বিশেষ করে তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতাগুলো একসময় বাচিক শিল্পীদের মুখে মুখে ফিরত । তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'স্বাধীনতা কিতা' ২০০৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় । শুধু কবিতা নয় । তিনি বহু গল্প, নাটক এবং বিশেষ করে আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত সিরিজ শ্রুতি নাটকগুলোর জন্য প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে লোক আঙ্গিকে তাঁর লেখা নাটক মহুয়া নৈদেরচান আগরতলার মঞ্চে সেদিন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । স্বনামে ও ছদ্মনামে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন । একসময় 'সত্যপীর' নাম নিয়ে দৈনিক সংবাদে 'চেনা মুখ অচেনা মানুষ' নামে অনেকগুলো সিরিজ ফিচার লিখেছিলেন । আজকের ফরিয়াদে দীর্ঘদিন লেখেন 'সিধু জেঠার পাঁচালি' । তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ একমাত্র গল্পের বই 'বসুধা' । তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে 'উজান', 'বাঘের পাঁচালি' ইত্যাদি নাটকগুলো ২০০৪-২০০৫ সালে ভীষণ সাড়া জাগিয়েছিল । তিনি ত্রিপুরার প্রথম টেলিফিল্ম 'ভাঙন' করে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে ভীষণ সাড়া ফেলে দেন । তিনি সপরিবারে ও মহকুমার প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সঙ্গে একেবারে আনকোরা কিছু গ্রামীণ শিল্পীদের নিয়ে সাব্রুম থেকে তৈরি করেন 'ভাঙন' । আগরতলা প্রেসক্লাবে প্রথম প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয় হয় সেদিন । ছবিটি দেখার পর দৈনিক সংবাদের সম্পাদক প্রয়াত ভূপেন দত্তভৌমিকসহ সেসময়ের আগরতলার বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়িয়ে নেন । পরবর্তী সময়ে কিছুদিন তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেন ।

রাজ্যের সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই গুণী সন্তান বার্ধক্যজনিত কারণে আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন । তাঁর বহুমখী প্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন রাজ্যে আজও হয়নি ।
অনুলিখন : অশোকানন্দ রায়বর্ধন

নৃত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার ধারা

নৃত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার ধারা

নৃত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

নৃত্য হল উচ্ছ্বাস ও আনন্দের প্রকাশ ।  নৃত্য হচ্ছে সংগীত ও ভালোবাসার সন্তান  । নৃত্য সর্বজনীন কলা । এর সঙ্গে আছে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধুর সম্পর্ক। আদিম যুগ থেকে মানবজাতি স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে নৃত্য করছে । আদিম যুগের গুহাবাসী মানুষের নৃত্য ছিল শিকারভিত্তিক । পরবর্তী নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষ যখন চাষবাস শিখে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল তখন এল কৃষিভিত্তিক নৃত্য । এরই সাথে তখন ধর্মীয় কার্যকলাপে নৃত্য চর্চার প্রচলন আরো বাড়ল । অথচ এই আদিম মানুষের সংস্কৃতিতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না । সংস্কৃতি অনুশীলনে ছিল অকৃত্রিম আন্তরিকতা যার অভাব আমাদের মধ্যে দেখা যায় । এরপর ক্রমশ হিন্দু বৈদিক যুগ, জৈন, বৌদ্ধ, মৌর্য, শুঙ্গ, কুশান যুগ, যুগ, গুপ্তযুগ, মুসলিম যুগ রাজত্ব করেছে ভারতের বুকে । ফলে সংস্কৃতির ধারায় ঐতিহ্যপূর্ণ ভারতবর্ষের ইতিহাস 


 বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতের ভূমিতে । ফলে ভারতবাসীর ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি কখনো লুণ্ঠিত হয়েছে, কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে মিশ্র সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে । তবে সংস্কৃতির পরিবর্তনের বা পরিবর্তিত রূপের পিছনে রয়েছে মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক কারণ তা অনুস্বীকার্য ।

ভারতবর্ষের প্রতিটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । তা হল নৃত্ত, নৃত্য ও নাট্য । ভরতমুনি তার নাট্যশাস্ত্রে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য বিস্তৃতভাবে আলোচনা না করলেও পরবর্তীকালে পন্ডিত ধনঞ্জয় তার দশরূপক গ্রন্থে এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ।

সাহিত্যগত উপাদানে নৃত্যের উৎস প্রসঙ্গে এক অলৌকিক শক্তিকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন এবং নৃত্যের উৎসে সেই শক্তির প্রভাব স্বীকার করা হয়েছে । একথা অনস্বীকার্য যে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব আর সেই কারণেই তাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক একটি দিক যা অন্য জীবের ক্ষেত্রে নেই । ক্রমে নৃত্যে অলৌকিক শক্তিকে তুষ্ট করা থেকে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এবং ধীরে ধীরে মনোরঞ্জনমুলক পর্যায়ে পর্যবসিত হয় । ফলে তা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সৃজনশীল । দীর্ঘ সময় ধরে এক সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নৃত্য ক্রমে উপজাতীয় নৃত্য, আদিবাসী নৃত্য, লোকনৃত্য  থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যে পরিণত হয়েছে ।

প্রস্তাবিত গবেষণার ভিত্তি হবে ভারতীয় সমস্ত শাস্ত্রীয়নৃত্য এবং এই নৃত্য গুলির প্রাসঙ্গিকতার কথা ভেবেই বিভিন্ন মতবাদের আলোচনার মধ্যে একটি সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে । ভরতনাট্যম, কত্থক, কথাকলি, কুচিপুডি, ওড়িশি মোহিনীআট্টম, মনিপুরী, সত্রিয়া এই আটটি নৃত্য ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্য নামে পরিচিত । ভারতবর্ষের কিছু কিছু রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলি সাধারণত এক একটি রাজ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছে । যদিও আমাদের ভারতবর্ষে সর্বমোট ২৯ টি রাজ্য কিন্তু শাস্ত্রীয় নৃত্যের বা উচ্চাঙ্গ নৃত্যের সংখ্যা আটটি আর এই আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য সাতটি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যের এইসব শাস্ত্রীয় নৃত্য কম বেশি অনুশীলন করা হয়ে থাকে  ।  বর্তমানে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য নিয়ে বিদেশেও অনেক কাজ চলছে পরিবেশিত হচ্ছে এবং গবেষণামূলক কাজও হচ্ছে । বহু বিদেশী ভারতবর্ষে এসে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চা করছেন ।

ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার ধারা

ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলে মোট আটটি রাজ্য রয়েছে এবং তার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য হল ত্রিপুরা । এই ত্রিপুরা রাজ্য এখন শিক্ষা সংস্কৃতি ও খেলাধুলা সবদিক থেকে অনেকটা উন্নত । ত্রিপুরা রাজ্যেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলির কমবেশি চর্চা করা হয় । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই রাজ্যে সাতবার এসেছিলেন ত্রিপুরা সংস্কৃতিচর্চার উপর মুগ্ধ হয়ে । যদিও এই সংস্কৃতির প্রসারন ও অনুশীলন ত্রিপুরার রাজাদের আনুকূল্যে তা বিকাশ লাভ করে ।

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য এই রাজ্যের আয়তন ১০৪৯১'৬৯ বর্গ কিলোমিটার এবং সর্বমোট লোকসংখ্যা ২০১১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী ৩৬ লক্ষ ৭১ হাজার ৩২ জন । এই রাজ্যের মধ্যে মিশ্র জাতির বসবাস । তাই এই রাজ্যে মিশ্রসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । এ রাজ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ লোক বাঙালি এবং ৩০% লোক উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত ।  ত্রিপুরার আদিম উপজাতিরা প্রাচীন মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত । ত্রিপুরায় সর্বমোট ১৯ টি উপজাতি নিয়ে ত্রিপুরার উপজাতি জনসমষ্টি  গঠিত । এরা সবাই সংবিধান স্বীকৃত তপশিলি ভুক্ত উপজাতি । এই ১৯ টি উপজাতির মধ্যে ১২ টি স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায় এবং ৭টি বহিরাগত উপজাতি সম্প্রদায় ।  স্থানীয় উপজাতিরা হল :- ত্রিপুরী, রিয়াং, জমাতিয়া, নোয়াতিয়া, মগ, চাকমা, হালাম,কুকি, গারো, লুসাই, উসই । আর সাতটি বহিরাগত উপজাতিরদের মধ্যে হল–খাসিয়া ভুটিয়া লেপচা সাঁওতাল মুন্ডা ভিড় ওঁরাও ।

নৃত্যকলা ও উপজাতীয় সংস্কৃতি :-

নৃত্যকলা উপজাতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । উপজাতীয় সমাজের নৃত্যকলার চর্চা শুরু হয়েছিল সংগীত চর্চারও বহু পূর্বে । সঙ্গীত ও নৃত্যের চর্চা নিছক অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত না হয়ে জীবনে প্রয়োজনের তাগিদেই এই দুই ধরনের কলাবিদ্যার জন্ম হয়েছিল। সঙ্গীত ও নৃত্যকলা জীবনের স্পন্দন ও জাদুকরী শক্তির উৎস । এই শক্তি সঞ্চয় করে উপজাতিদের প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃত শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হয় । বলতে গেলে সঙ্গীত-নৃত্যের মাধ্যমে অতিপ্রাকৃত দেবতাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার মানসিক শক্তি অর্জিত হয়, নৃত্যকলার মাধ্যমে দেবতাদের রোষবহ্নি নির্বাপিত হয় ।‌দেবতারা খুশি হয়ে ক্ষণজীবী ভক্ত মানুষদের সাহস ও শক্তি দান করেন । দেবতাদের অনুকম্পা লাভ করে উপজাতীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জীবনের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ বর্ষিত হয় । আদিবাসী নৃত্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রখ্যাত নৃত্যগবেষক শ্রীমতি গায়ত্রী চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, 
'
আদিবাসীদের নৃত্য ও সংস্কৃতির মূল্য যাচাই করতে গেলে তাদের জীবনের গুণগতমান সামাজিক গঠন ও মানসিক শক্তির বিষয়ে বোধগম্য হতে হবে । আদিবাসীরা জীবনের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায় ।ঋ কর্মময় জীবন এবং অবসর বিনোদন এ দুটোকে আলাদাভাবে দেখতে তারা নারাজ । নৃত্যকলাকে জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে হিসেবে তারা গণ্য করে । জীবন ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো । নৃত্য আদিম যুগের নৃত্যকলা জীবন ধারণের সহায়ক বলে পরিকল্পিত হত । সে যুগে নৃত্যকলা জীবন সংগ্রাম ও উন্নতি সাধনের মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । সেই আদিম যুগে নৃত্য পরিবেশনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত এবং উৎসাহব্যঞ্জক । তাদের নৃত্যভঙ্গিমা প্রায়শই পশুপাখির স্বাভাবিক চলন ভঙ্গি থেকে অনুকৃত । দেবদেবীকে সন্তুষ্ট করতে মহামারী রোধ করতে বৃষ্টিপাত ঘটাতে অথবা শিকার ধরার প্রেরণার মুখ্য মাধ্যম হিসেবে নৃত্য পরিবেশনা অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হত । আদিবাসী নৃত্যের মুদ্রা রচিত হয় অনেক সময় পশু পাখির চলনভঙ্গির অনুকরণে ।
সুপ্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের ভাষা, সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা । কিন্তু একসাথে মিলেমিশে বসবাস করাতে এখানে মিশ্রসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে । এখানে সমস্ত সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা লোকনৃত্য রয়েছে । সেই লোকনৃত্য গুলি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেমন, বিবাহ, জন্ম ইত্যাদিতে এবং ভৌতিক বা ধর্মশ্রিত নৃত্য যেমন, দেবতা অপদেবতাদের পূজা, মৃত আত্মার আবাহন, সম্মোহন, নবান্ন, শিকার প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলিতে পরিবেশন করে থাকেন ।

ত্রিপুরার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপজাতীয় লোকনৃত্য হল :-

                                 উপজাতি                                    নৃত্য :-
                                   ত্রিপুরি                                  মামিতা, লেবাং বুমানি, গড়িয়া
  
                                   রিয়াং                                      হজাগিরি
                                   চাকমা                                      বিজু
                                   গারো                                     রাংসুগালা, ওয়ানগালা
                                   বাঙালি                                  ধামাইল
                                   মগ                                      ক্যামুং, সইং, ছিমুইং
                                   হালাম                                  হৈ-হক
                                   লুসাই                                   চেরো / বাঁশ নৃত্য
                                   সাঁওতাল                              বাহা             ইত্যাদি ।    

ত্রিপুরা রাজ্যের এই সমস্ত উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আচরিত ধর্ম, পূজিত দেবদেবী, অনুষ্ঠিত নৃত্যকলা এবং পালিত পূজা পার্বণ উৎসব অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্যময় ইতিহাস রয়েছে । এদের আদি ধর্ম ছিল নিছক সর্বপ্রাণবাদ বা জড়বাদ । কিন্তু কালের স্রোতে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বিবর্তনে,  সংমিশ্রনের ও পরিবর্তনের ধারায় মিলেমিশে তা একাকার হয়ে গেছে । তাই আজকের যুগে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্ম সংস্কৃতির অবয়বে পুরোপুরি আদি ধর্মের চিহ্ন খোঁজা বৃথা । নিম্নে ত্রিপুরারাজ্যে প্রচলিত কয়েকটি বিশিষ্ট লোকনৃত্যের উপর আলোকপাত করছি ।     

বরক/ত্রিপুরীসমাজের লোকনৃত্য :-

লেবাং বুমানি নৃত্য– ত্রিপুরী সমাজের পরিবেশিত অন্যতম ও অন্যতম জনপ্রিয় নৃত্য । ত্রিপুরীরা মূলত জুমচাষী । তারা জুমখেতে ধানসহ নানাবিধ কৃষিজ ফসল ফলায় । জমি ক্ষেত্রে যখন  ধান গাছে শিস আসে তখন লেবাং ( পঙ্গপালের মতো ) নামে জাতীয় কীট এই শিসের নরম অংশ খাওয়ার জন্য আক্রমণ করে ।জুমখেত লেবাং দ্বারা আক্রান্ত হলে ত্রিপুরার জুমিয়ারা এই কীট তাড়ানোর জন্য দলবদ্ধভাবে উদ্যোগ নেয় । এই লেবান নামক কীটকে নৃত্যের মাধ্যমে বিতাড়নের তাগিদ থেকেই দলবদ্ধ এই নৃত্যের নামকরণ হয়েছে লেবাং বুমানি । 'বুমানি' ককবরক শব্দ । যার অর্থ তাড়ানো । মূলত প্রয়োজনের তাগিতেই এই লেবানবো মানে নৃত্যের উদ্ভব ।
লেবাং তাড়াবার এই নৃত্যে নৃত্য পরিবেশন কারীরা শুধুমাত্র লেবাং বিতাড়নের মুদ্রাই নৃত্যে পরিবেশন পরিবেশন করে না । তারা ফাঁকে ফাঁকে লেবাং কীটগুলো হাতের মুঠোয় আটকে রেখে মজাও করে । লেবাং নৃত্য পরিবেশিত হয় এক টুকরো আস্ত বাঁশের তৈরি শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্রের তালে তালে । তারা দুই হাতে দুটো বাঁশ নিয়ে নিতে তালে তালে ঐক্যবাদন সৃষ্টি করে । তালবদ্ধ জোর শব্দের আকর্ষণে লেবাং ঝাকে ঝাকে জুমখেতে নামতে থাকে । এবং তখন মৃত্যুকারীদের জুমক্ষেতের উঁচু-নিচু অংশে লেবাং ধরার বা মারার ভঙ্গি করতে হয় । এই অনুকৃত মুদ্রাই লেবাং বুমানি নৃত্য ।

গড়িয়া নৃত্য– বরক বা ত্রিপুরী উপজাতিদের আর একটি বিশিষ্ট নৃত্য হল গড়িয়া নৃত্য । গড়িয়া নৃত্য ত্রিপুরার জনপ্রিয় লৌকিক নৃত্য । গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গড়িয়া নৃত্যের উদ্ভব । ত্রিপুরার গড়িয়া পূজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, জুম ক্ষেতকে শস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য গড়িয়া বা শস্য দেবতাকে আরাধনা করা ।‌ ত্রিপুরী ও অন্যান্য সমাজেও গড়িয়া দেবতাকে সম্পদ ও সমৃদ্ধির ( God of wealth and prosperity ) দেবতা রুপে কল্পনা করা হয় । গড়িয়া পূজাকে কেন্দ্র করে গড়িয়া নৃত্যের উদ্ভব । সেজন্য গড়িয়া নৃত্যে দেবভক্তির ভাবনারসের সঙ্গে অনুষ্ঠানগত চিত্তবিনোদনের আনন্দরসের মিশ্রণ ঘটেছে । গড়িয়ানৃত্যে বিভিন্ন ধর্মীয় আচারগত মিশ্রণ ও ঘটেছে । কিন্তু গড়িয়ানৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রার ভঙ্গি প্রত্যক্ষ করলে ধর্ম ও আচার নিরপেক্ষ শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রমোদনৃত্যই বলে প্রতিমান হবে । বলাবাহুল্য গড়িয়ানৃত্যের অনুকৃত মুদ্রা বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা ও পশুপাখির নানা অঙ্গভঙ্গিকে অনুকরণ করে গড়িয়া নৃত্যের মুদ্রার সৃষ্টি । শোনা যায়, প্রাচীনকালে গড়িয়ানৃত্যের মুদ্রার সংখ্যা ছিল ২২টি । এক একটি মুদ্রা বা ঢঙের জন্য একেকটি বোল । ঢোল ( ত্রিপুরী ভাষায় খাম ) বাজিয়ে বা বোল বাজিয়ে নৃত্যের ঢং বলে দেওয়া হয়। বোলের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাচের ভঙ্গিও যায় পাল্টে । নাচের মুদ্রার মধ্যে কোনটা স্নানের, কোনটা কাপড় কাচার, কোনোটা আয়না দেখে কেশবিন্যাস, কোনটা শিশুকে স্তন্যপান করানো ইত্যাদি থাকে । গড়িয়ানৃত্যে ঐন্দ্রজালিক অথবা রহস্যময়তার ভাব নেই । শুধু এই নৃত্যধারাকে বৈচিত্র্যময় ও রমনীয় করার জন্য পশু পাখির বিচিত্র চলন ভঙ্গিমার অনুকরণ করে নাচের মাধ্যমে তা ফুটিয়ে তোলা হয় ।

মশক নৃত্য– ককবরক ভাষায় 'মশক'  শব্দের অর্থ 'হরিণ' । হরিণ শিকারকে কেন্দ্র করে এই নৃত্য ত্রিপুরীদের প্রাচীন শিকারজীবনের কথা মনে করিয়ে দেয় ।  হরিণ শিকার করে ক্লান্ত হয়ে সঙ্গীসাথীদের সাথে  বাড়ি ফেরার পথে তারা আনন্দের সঙ্গে গান এবং নৃত্য করতে করতে থাকে । নাচের তালে তালে বাড়ি ফেরার এই ভঙ্গি হল মশক নৃত্য ।

মামিতাং নৃত্য– জুমের পাকা ফসল ঘরে তোলার পরেই ত্রিপুরীদের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের আয়োজনের সাড়া পড়ে যায় । এ নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে  ত্রিপুরীদের মধ্যে নৃত্য পরিবেশনের রীতি রয়েছে । ফসল তোলার পরে একটা নির্দিষ্ট দিনে এই উৎসব পালন করা হয় । উৎসবের সময় শস্য আধারের বেদীতে মুরগি বলি দেওয়া হয় । পূজার শেষে আত্মীয়-স্বজন মিলে পানভোজনে মিলিত হয় । উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য নর-নারীরা মিলিতভাবে নৃত্য পরিবেশন করে । নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে এই নৃত্য বলে তাকে 'মামিতা নৃত্য' বলা হয় ।

রিয়াংদের নৃত্য :-
বিভিন্ন ধর্মীয় অসামাজিক অনুষ্ঠানে রিয়াংরা নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন ত্রিপুরীদের মতিয়াংরাও গড়িয়া উৎসব ও নৃত্য পালন করে রিয়ানরা সাধারণত দল বেঁধে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে এতে যে কোন বয়সের নর নারী যোগ দেন তারা নৃত্য পরিবেশন করার সময় তাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাক কণ্ঠ যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগের নৃত্য পরিবেশন করেন

হজাগিরি নৃত্য:- রিয়াং নৃত্যের এক বিশেষ রূপ আজকাল ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । এমনকি প্রজাতন্ত্র দিবসে নতুন দিল্লিতে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় । এই নৃত্যের প্রধান বিষয় হলো  দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে নৃত্য প্রদর্শন । এই নৃত্যে বিশেষ দক্ষতা ও শিল্প নৈপুণ্যের প্রয়োজন হয় । কলসির মাথার উপর দাঁড়িয়ে রিয়াং রমনিরা জ্বলন্ত প্রদীপ সহযোগে মাথার উপর বোতল দাঁড় করিয়ে নানারকম দেহ ভঙ্গিমা করে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে । এই নৃত্য 'হজাগিরি' নামে প্রসিদ্ধ । হজাগিরি বাংলা 'কোজাগরী' শব্দের সমার্থক । লক্ষ্মী পূজার সময় এই হজাগিরি নৃত্য পরিবেশিত হয় বলে কেউ কেউ এর সঙ্গে কোজাগরী নৃত্যের সাদৃশ্য পান । এই নৃত্যে আর্থ-সামাজিক কার্যকলাপ এবং জন্তু-জানোয়ারের আচার-আচরণ,  ভঙ্গিমাও ফুটিয়ে তোলা হয় । পশু শিকার, মৎস্য শিকার, বনের শাকসবজি আহরণ, জুম সাফাই, দেহের আঘাত জনিত ব্যথা, ফসল তোলা, ধান ভানা, ও দেবদেবীর প্রতি বলিদান ইত্যাদি কার্যকলাপকে নৃত্যের বৈচিত্র্যময় ভঙ্গিমা বা মুদ্রায় ফুটিয়ে তোলা হয় । উপযুক্ত চর্চা ও সংস্কারের মাধ্যমে এই নৃত্যকে লোকনৃত্য পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব ।

চাকমাদের নৃত্য :-
ত্রিপুরা রাজ্যের বিশিষ্ট উপজাতীয় জনগোষ্ঠী চাকমাদেরও নিজস্ব লোকনৃত্য রয়েছে । চাকমারা ধর্মের দিক থেকে বৌদ্ধ । তাদের  ধর্মবিশ্বাসে জগতের উৎপত্তি মূলে রয়েছে ত্রিশক্তির ক্রিয়া । বসুমতি, চুমুলাং ও পরমেশ্বরী । ত্রিপুরীদের  মতো তারাও চৌদ্দ দেবতায় বিশ্বাসী । আসামে যেমন বিহু, ত্রিপুরায় বুইসু, বাংলায় বিষুব বা চৈত্র সংক্রান্তি, তেমনি চাকমাদের বর্ষশেষের উৎসব বিজু । বর্ষবিদায়কে কেন্দ্র করে জাতিউপজাতিদের এই উৎসব পালন দীর্ঘকাল থেকেই চলে আসছে ।চাকমাদের মধ্যে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে পালন করা হয় বিজু উৎসব এবং বিজু উৎসবকে যে নৃত্য অনুষ্ঠিত হয় তাকেও 'বিজু নৃত্য' বলা হয় । বর্ষবরণ উৎসবের সময় চাকমা যুবকযুবতীরা দলবদ্ধভাবে বিজু নৃত্য পরিবেশন করে । বিজু নৃত্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে বিজুর তালে তালে পরিবেষণ করা হয় ।

গারোদের নৃত্য :-
গারোদের সমাজে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে । প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে ।সামাজিক অনুষ্ঠানের শেষে পানভোজন, সংগীত ও নৃত্য পরিবেশিত হয় ।গারো সমাজে প্রচলিত নৃত্যগুলির মধ্যে লোকনৃত্য, রণনৃত্য এবং নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম নৃত্য পরিবেশিত হয় । তাছাড়া গৃহপ্রবেশ উপলক্ষেও নৃত্য পরিবেশিত হয় । গারোদের  প্রচলিত নৃত্যগুলি সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল :-

গানানৃত্য ( নেতার অভিষেক নৃত্য )–গারো সমাজে নেতা বা প্রধান আনন্দময় নৃত্যের পরিবেশনার মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন । প্রথমে নেতাকে আংটি পরানো হয়ে থাকে । আংটি হচ্ছে নেতৃত্বের প্রতীক । এই অভিষেক মিত্তে পুরোহিতের নির্দেশে সমাজের গণ্যমান্য সবাই যোগদান করে থাকে । আংটি পরার পর নেতা তাঁর স্ত্রীকে  নিয়ে নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন ।
রণ নৃত্য– রণনৃত্য দলবদ্ধ নৃত্য বিশেষ । একসঙ্গে ২০-২৫ জন লোক একে অপরের পেছনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কোমরে ধরে গোল হয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে গান করতে থাকে । রণনৃত্যে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করার জন্য মাদল ও পিতল নির্মিত ঘন্টা বাজানো হয় । স্ত্রীলোকেরাও এই নৃত্যে যোগদান করে থাকে । তবে পুরুষের কাছ থেকে অনতি দূরে সারিবদ্ধ হয়ে এক পায়ের উপর ভর দিয়ে দুবাহু প্রসারিত করে বা পরপর বাহু দুটি ঊর্ধ্বে প্রসারিত করে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে । সাধারণত প্রতিটি দলে একজন দল উপস্থিত থাকে দলপতি । তরবারি ও বর্ম হাতে সুর তুলতে থাকে । গারো ভাষায় দলপতিকে গ্রিকা বলা হয় । দলপতিকে গ্রিকগিপা বলা হয় । এই নৃত্য প্রাচীন যুগের যুদ্ধবিগ্রহের স্মৃতির রেশ ফিরিয়ে আনে ।

মগদের নৃত্য :-
মগরা খুব উৎসবপ্রিয় । ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতিদের মতো মগরা ও নানা উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য করে থাকে মুখ সমাজে সংগীতের যেমন শ্রেণীবিভাগ রয়েছে তেমনি নৃত্যকলার ও মোটামুটি পাঁচটি বিভাগ রয়েছে ।

ক্যমুং–ক্যমুং নৃত্য মগদের আদিম নৃত্যকলা বলে পরিগণিত হয় । আদিকালের নৃত্যকলা সৃষ্টির পূর্বে মগরা ধান ভাঙার ঢেঁকির শব্দ ও তালের ছন্দ ও গতির মধ্যে সংগীত ও নৃত্যের রূপ আবিষ্কার করে । অতীতে এই নৃত্য পরিবেশন কালে অনেকগুলো ঢেঁকির শব্দের সঙ্গে পরিবেশন করার রীতি ছিল । পরবর্তীকালে ঢেঁকির পরিবর্তে বাঁশের মাধ্যমে শব্দ ও তাল সৃষ্টি করে অধিকতর চিত্রাকর্ষক ও গতিময় করে তোলা হয় ।
সইং–সইং নৃত্য পরিবেশিত হয় কোন বিখ্যাত ধর্মীয় বা রাজার মৃত্যু উৎসবে । মৃত ব্যক্তির কফিন বহন করে নিয়ে যাবার সময়, শবযাত্রীরা বিভিন্ন নৃত্যদলে কাঠি হাতে নিয়ে সইং নৃত্য পরিবেশনার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে । এই নৃত্যে বত্রিশ প্রকার মুদ্রা ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

য়ইং–এই নৃত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য নানা রকম দেহ ভঙ্গিমা প্রদর্শন । য়ইং নৃত্যে হেলে দুলে  নৃত্য কৌশল দর্শকদের মুগ্ধ করে বলে এর নাম য়ইং । এই নৃত্য একক, দ্বৈত কিংবা দলীয়ভাবে পরিবেশিত হতে পারে ।

ছিমুইং–ছিমুইং আকা বাংলাদেশের প্রদীপ নৃত্য বলে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে মূলত এই নৃত্য বিবাহ পার্বনে বর-কনে উভয় পক্ষের পিতা-মাতা ও গুরুজনদের সম্মানার্থে পরিবেশিত হয়ে থাকে । পরবর্তীকালে ধর্মীয় পূজা পার্বণেও এই নৃত্য পরিবেশিত হয় ।

বাইং–আধুনিক সমাজের নৃত্যকলার অনুকরণে এই নৃত্যের উদ্ভব । এই নাচকে মারমাদের মুখোশনৃত্য বলা হয় । কেননা অনেক সময় বানর, বাঘ কিংবা অন্যান্য জন্তুর মুখোশ ধারণ করে এই নৃত্য পরিবেশিত হয় ।

হালামদের নৃত্য :–
ত্রিপুরার অন্যান্য উপজাতিদের মত আলেমদের মধ্যেও নাচ গানের প্রবণতা দেখা যায় ।  জুম ফসল ঘরে তোলার পর হালামরা লক্ষ্মী পূজা করে থাকে । ত্রিপুরীরা লক্ষ্মীকে ধনের দেবী হিসেবে পূজা করেন । ত্রিপুরী সমাজে এই পূজাকে বলা হয় 'মাইলুংমা' পূজা । হালামরাও তেমনি লক্ষ্মী পূজা করে থাকে । তবে তাদের পূজাপদ্ধতি আলাদা । 
হৈ-হক নৃত্য- লক্ষ্মীপূজা উদযাপনের সময় দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য হালাম নারী-পুরুষ গোল হয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে নৃত্য করে । এই নৃত্য হৈ-হক নৃত্য নামে তাদের সমাজে প্রচলিত । এই নাচ তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও নৃত্যের বিচিত্র তাল নয় প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে তাদের জাতিগত পরিচয় ।

লুসাইদের নৃত্য :–

অন্যান্য অধিবাসীদের মত লুসাইদেরও মূল ধর্মকে সর্বপ্রাণবাদ বা অ্যানিজম বলা হয় । লুসাইরা ভীষণ আমোদপ্রিয় । নৃত্য সংগীতের মাধ্যমে এরা জীবনকে উপভোগ করে । এদের জীবনবৃত্ত নৃত্য ও সঙ্গীতের সুরে সুরে গাঁথা ।‌লুসাইদের নৃত্যের ধারা বিচিত্র । ভিন্ন ভিন্ন নৃত্যের মধ্যে তাদের মনের ও চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে । তাদের উল্লেখযোগ্য নৃত্য—

চেরো নৃত্য বা বাঁশ নৃত্য-চেরো বা বাঁশ নিয়ে লুসাইদের প্রসিদ্ধ লোকনৃত্য ।কারো অকালমৃত্যু ঘটলে সে মৃতব্যক্তির আত্মাকে অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা করে তাকে কল্পিত স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য এই নৃত্যের আয়োজন হয় । বাঁশ নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,  দুজন বা চারজন লোক দুই প্রান্তে মুখোমুখি বসে উভয় হাতে লম্বা দুটো বাঁশ ধরে একবার বন্ধ একবার ফাঁক করতে থাকে । যখন বন্ধ করা হয় তখন দুটো বাসে ঠোকাঠুকি লেগে অদ্ভুত ছন্দ ও তাল ঝংকৃত হয় । সেই তালে তালে নৃত্যরত যুবক-যুবতীরা দুটো বাঁশের মাঝখানে একবার পা ফেলে একবার বের করে । বাঁশ দুটোকে যে মুহূর্তে ফাঁক করা হয় সেই মুহূর্তে পা ফেলে দিয়ে বন্ধ করার পূর্ব মুহূর্তে পা বের করে দেবার যে কৌশল তার ছন্দের তালে তালেই সম্পন্ন হয় । এটি অত্যন্ত উপভোগ্য নৃত্য । বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকির শব্দ ওতার তালে পা ফেলা ও পা তোলার মধ্যে এক শিহরণ জাগানো আবহের সৃষ্টি করে ।

সোলকিয়া নৃত্য-মূলত এই নৃত্য বিজয় সূচক নৃত্য । শিকারিদল বন্য পশু-পাখি শীকার করে বাড়ি ফিরলে বিজয় উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শোলাকিয়া নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে ।  এই নৃত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয় সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ডানপাটিকে নাড়া দিয়ে বাঁপাটিকে ঝুঁকিয়ে তালে তালে হাঁটু গাড়ার ভঙ্গিমা করে । এই নৃত্যের সঙ্গে ঢাক ও ভেরি বাজানো হয় । বাজনার তালে তালে নাচে ছন্দ বেশ জমে ওঠে ।

পয়ান্তু নৃত্য– পয়ান্তু নৃত্যটি বাচ্চাদের ক্রীড়ানৃত্য । এরা গান বাজনা ও খেলার ছলে এই নৃত্য পরিবেশন করে । বর্তমানে এর প্রচলন নেই ।


ত্রিপুরায় লোকনৃত্য গুলির পাশাপাশি ভারতীয় শাস্ত্রীয় বা মার্গীয় নৃত্যগুলিরও চর্চা  হয়ে থাকে । ভারতের মোট আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্য গুলির উৎপত্তি এবং ত্রিপুরায় কিভাবে নৃত্যগুলির প্রসারণ ঘটেছে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল :-

ভরতনাট্যম :-

ভারতবর্ষের মার্গ নৃত্যধারার মধ্যে অন্যতম হল ভরতনাট্যম । বর্তমানে এই পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্রীয় বা মার্গীয় নৃত্য পদ্ধতি দক্ষিণভারতের তামিলনাডুতে বেশি চর্চা করা হয় । ভরতনাট্যম দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর তাঞ্জোর প্রদেশের নাচ ।  ত্রিপুরাতে ভরতনাটম শিক্ষা শুরু হয়  বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে । তখনকার সময়ে শ্রীমতি হীরা দে বলে একজন নৃত্যশিল্পী কলকাতায় এসে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে স্নাতকোত্তর হন । এবং তারপর ত্রিপুরায় গিয়ে ভরতনাট্যম শিক্ষা দিতে থাকেন । এখন যদিও আরও অনেক নৃত্যশিল্পীরা ভারতের আরো অন্যান্য জায়গা থেকে অনুশীলন করছেন এবং বিভিন্ন জায়গায় নৃত্য প্রদর্শনও করছেন ।

কত্থক :-

বর্তমানকালে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নৃত্যধারা কত্থক । প্রাচীনকালে দেবতাদের লীলা ও পৌরাণিক উপকথার বর্ণনা করার জন্য কত্থক গ্রন্থিক, গাথাকার প্রভৃতি সম্প্রদায় ছিল । তারা সংগীত ও নৃত্যের মাধ্যমে কাহিনি প্রচার করতেন । কত্থককে আগে বলা হতো নটোবরী নৃত্য । কত্থক সাধারণত উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয়নৃত্য বলে আমরা জানি অর্থাৎ উত্তর ভারতের লখনউ জয়পুর ও বেনারস অঞ্চলের নাচ কত্থক । কত্থকনৃত্য সর্বপ্রথম ত্রিপুরাতে প্রদর্শন করেন গহরজান । তখনকার সময় ওনার নৃত্য প্রদর্শন ও গজল ঠুমরির উপর রচিত শিল্পীরা আকৃষ্ট হয় । এবং তখন থেকেই কত্থক নৃত্যশিল্প শিক্ষা শুরু হতে থাকে ত্রিপুরা রাজ্যে । বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যে আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি নৃত্যচর্চা হয় কত্থক নৃত্য । অর্থাৎ নিরীপ্ত শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের বেশি আকর্ষণ কত্থক নৃত্যের প্রতি আজকাল  ত্রিপুরা রাজ্যের বহু কত্থক নৃত্যশিল্পী ভারতবর্ষ এবং অনেক জায়গায় সুনাম অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে চিন্ময়ী দাস, দেবজ্যোতি লস্কর প্রমূখ শিল্পীরা উল্লেখযোগ্য ।

কথাকলি :-

কথাকলি নৃত্য কেরল রাজ্যের অন্যতম নৃত্যকলা । কথাকলি নৃত্য পরম বৈষ্ণব কালিকটের জামুরিন বংশীয় মানব রাজ কর্তৃক প্রবর্তিত কৃষ্ণনাট্যম নৃত্যনাট্যের অন্যতম রূপ । পরবর্তীকালে কথাকলি রূপে পরিচিত । পরবর্তীকালে কোট্টারার রাজা নিজ দেশে গণেশ মন্দির প্রাঙ্গণে নতুন নৃত্যনাট্যের প্রবর্তন করেন যা রামনাট্যম নামে পরিচিত । এবং রামনাট্যমকে কথাকলি নৃত্যের উৎস ও প্রাথমিক স্তর বলে মনে করা হয় । কথাকলি নৃত্যটি ত্রিপুরা রাজ্যে তেমন প্রচলন নেই । শুধু পরিবেশিত হয় ত্রিপুরার বহিরাগত শিল্পী দ্বারা । কারণ এখানে উপযুক্ত নৃত্যশিক্ষকের অভাব । শ্রীযুক্ত অনন্তবিজয় দেববর্মা নামে একজন নৃত্যশিল্পী শান্তিনিকেতনে বাইশ বছর কথাকলি নৃত্য শিক্ষা গ্রহণ করেন তারপর উনি ত্রিপুরায় এসে যখন নৃত্য শিক্ষা দিতে শুরু করেন  তখন দুর্ভাগ্যবশত  মারণব্যাধি কর্কট রোগ শিল্পীর জীবন কেড়ে নেয় । তারপর আর কেউ এই কথাকলি নৃত্যশিক্ষা নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি ।

কুচিপুডি :-

কুচিপুডি দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । ত্রয়োদশ শতকে সিদ্ধান্ত যোগী কুচিপুডি নৃত্য নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন । কৃষ্ণা নদীর তীরে অন্ধ্রের কুচলাপুরম গ্রাম থেকে এই কুচিপুডি নৃত্যের উদ্ভব হয় । পূর্বে কোন কুচিপুডি নৃত্যশিল্পী ত্রিপুরায় ছিলেন না । কিন্তু বর্তমানে ববি চক্রবর্তী নামে একজন মহিলা নৃত্যশিল্পী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যশিক্ষার গ্রহণ করে এবং ত্রিপুরারাজ্যে ছাত্রছাত্রীদের কুচিপুডি নৃত্যশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন । এবং নিজে কুচিপুডি নৃত্য প্রদর্শন করে সবাইকে এই নৃত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলছেন ।

ওড়িশি :-

উড়িষ্যার নৃত্যধারা ওড়িশি সারা পৃথিবী বিখ্যাত । দ্বাদশ শতাব্দীতে মহেশ্বর মহাপাত্র রচিত অভিনয়চন্দ্রিকা গ্রন্থে ওড়িশি নৃত্যের উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা যায় । আচার্য অট্টহাস ওড়িশার দেবদাসীদের মধ্যে এই নৃত্যের প্রচলন করেন । ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতো নৃত্যকলা ধর্মকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিল । ওড়িশি নৃত্যের কোন নৃত্যশিক্ষক ত্রিপুরায় পূর্বে ছিলেন না । কিন্তু বর্তমানে সর্বপ্রথম দেবব্রত দেববর্মা নামে একজন নৃত্যশিল্পী উড়িষ্যা থেকে এই নৃত্যশৈলী শিক্ষা গ্রহণ করে ত্রিপুরায় এসে শিক্ষার্থীদেরকে যথাযথ শিক্ষাদান করছেন এবং ওড়িশি নৃত্যের প্রতি আকর্ষিত করে তুলছেন । এই নৃত্যশিল্পী নিজেও ত্রিপুরা রাজ্য এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই নৃত্য প্রদর্শন করছেন । সর্বানি নন্দী নামে আরেকজন নিরীক্ষা শিল্পী ও বর্তমানে ওড়িশি নৃত্যে ত্রিপুরা রাজ্যে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন ।

মোহিনীআট্টম :-

ভারতের কেরালা প্রদেশ ধ্রুপদী নাচের জন্য বিখ্যাত । ধ্রুপদী নৃত্য কথাকলি এবং তার বিশিষ্ট তিনটি উপধারা রয়েছে । কৃষ্ণনাট্যম, রামনাট্যম ও মোহিনীঅট্টম । যদিও মোহিনীঅট্টমে ভরতনাট্যমের কিছু মিশ্রণ রয়েছে । কথাকলির গাম্ভীর্য ও ভরতনাট্যমের সৌন্দর্য দুইই পাওয়া যায় মোহিনীঅট্টমে । ত্রিপুরা রাজ্যের কোন নৃত্যশিল্পী আজ পর্যন্ত মোহিনীঅট্টম নৃত্যশিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেননি । তাছাড়া কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলেও যথাযথ নৃত্যশিক্ষকের অভাবে এই নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ।

সত্রিয়া :-

আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে সত্রীয়া নৃত্যধারাটি আপন ঐতিহ্য ও শৈলীতে অন্যতম স্থানের অধিকারী । এই নৃত্যধারার প্রবর্তক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মহৎ সন্ন্যাসী শ্রী শ্রী শংকরদেও । পঞ্চদশ শতকে তিনি এই নৃত্য ধারার প্রবর্তন করেন যা অংকিয়া নট নামক নাট্য থেকে অনুপ প্রেরিত ক্রমে চর্চা ও উন্নত সৃজনশীলতার মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়ে এই নৃত্য ধারা এক অন্যতম স্থান লাভ করেছে । মূলত কৃষ্ণ রাধা সম্পর্কিত কাহিনি এর মূল উপজীব্য বিষয় । তবে তাছাড়াও বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার, রাম-সীতার কাহিনিও এতে পরিবেশিত হয়ে থাকে । অতীতে মূলত এই নৃত্য ধারা শুধুমাত্র পুরুষ সন্ন্যাসীদের দ্বারা চর্চিত হলেও নৃত্যশৈলী ও পরিবেশনগত ক্রম ও বিবর্তনের দ্বারা বর্তমানে বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ভিন্ন মহিলা ও পুরুষ উভয় জনধারায় এই নৃত্য পরিবেশিত হয়ে থাকে । সত্রিয়া ত্রিপুরা রাজ্যের পার্শ্ববর্তী রাজ্য অসমের নৃত্যধারা অর্থাৎ অসম রাজ্য এই নৃত্যের উৎপত্তিস্থল । ত্রিপুরারাজ্যে এখনো কেউ তেমনভাবে এই নৃত্য চর্চা করতে শুরু করেনি ।

মণিপুরী:-

ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলের আরেকটি ছোট রাজ্য মনিপুর । মনিপুরের নৃত্য হচ্ছে মনিপুরী নৃত্য । মনিপুরের নৃত্যের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় না । তবে যেটুকু পাওয়া গেছে,  তাকে ভিত্তি করে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বলা যায় তেত্রিশ খ্রিস্টাব্দে পেরিতাম নামে এক ব্যক্তি পশ্চিম ভারত থেকে মনিপুরে গিয়ে আর্য সভ্যতা প্রচার করেন । ১৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা খোয়াইতুম্পক জন্মবাদের প্রচলন করেন । মণিপুরীরা হিন্দু নিষ্ঠাবান গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । মণিপুরী নাচ চার ভাগে বিভক্ত । অস্ত্রবিদ্যা, চলন, গঠন ও রাজনৃত্য । খোল, করতাল, মন্দিরা সহযোগে এই নৃত্য হয় । মনিপুরী নাচে কীর্তন গান ব্যবহৃত হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে রাজন্য আমল থেকেই মনিপুরী নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরায় এসে মণিপুরী নৃত্য দর্শন করে অভিভূত হয়ে তা শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় সংযোজন করেন এবং বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন ।

এভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, বহু প্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুররাজ্যে নৃত্যচর্চার একটি ধারা প্রবহমান রয়েছে । রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সেখানে শাস্ত্রীয় নৃত্যের ধারাটি প্রবাহিত হয় । ত্রিপুরারাজ্যের ভারতভুক্তির পর সেই ধারাবাহিকতা আরও বেগবান হয়ে উঠে যা আজও গতিশীল ।

ত্রিপুরারাজ্যের পুরাকাহিনি, রাজনৈতিক ইতিহাহ, ধর্ম, সংসকৃতি ও নৃত্যচর্চার ইতিহাস



ত্রিপুরা রাজ্যের পুরাকাহিনি, ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি নৃত্যচর্চার ইতিহাস

ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য হল ত্রিপুরা। এই রাজ্যের বর্তমান আযতন হল১০৪৯১'৬৯ বর্গ কিলোমিটার । ২০১১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী ছিল মোট ৩৬ লক্ষ ৭১ হাজার ৩২ জন  । তারপর রাজ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে । লোকসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । ত্রিপুরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর আদিভূমি । প্রাচীনকাল থেকেই এরা এখানে বসবাস করে আসছে ১৯৪৯ সালে স্বাধীনোত্তরকালে ত্রিপুরা ভারতভুক্তির পরে এটি পৃথক প্রদেশরূপে স্বীকৃত হয় ত্রিপুরার মূল আদিবাসীদের ত্রিপুরী বা 'বরক' বলা হয় । ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সন্নিহিত অঞ্চল বা দেশ থেকে এরাজ্যে প্রবেশ করেছে দলে দলে অউপজাতীয় মানুষ । এর ফলে এখানে পরবর্তীকালে মিশ্র সংস্কৃতি বা কৃষ্টির সৃষ্টি হয় । ত্রিপুরা নামকরণের পশ্চাতে সত্যিই মিথ্যে মিলিয়ে নানা পৌরাণিক উপাখ্যান ও জনশ্রুতি রয়েছে । 

এ রাজ্যের ইতিবৃত্ত রাজমালায় উল্লেখিত হয়েছে যে, মহাভারতে বর্ণিত চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি ছিলেন প্রচণ্ড প্রতাপশালী শাসক । তার বংশে জন্ম নেয় দ্রুহ্য নামে এক মহাশক্তিশালী রাজা । তিনি রাজা হলেন কিরাত দেশের । দ্রুহ্য তার রাজ্যপাট আসামের ত্রিবেগ নামক স্থানে স্থাপন করেন । রাজমালায় আছে–

'ত্রিবেগস্থলেতে রুদ্র নগর করিল 
কপিল নদীর তীরে রাজ্যপাট ছিল' ।

ভারতের মানচিত্রে প্রাচীন ত্রিবেগ রাজ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । প্রাচীনকালের ত্রিবেগ বর্তমান যুগে কি নাম ধারণ করেছে সে নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনো মতভেদ আছে । সে যুগে ত্রিবেগের সীমানা ছিল পূর্বে মেখলি, পশ্চিমে কোচবঙ্গ, উত্তরে তৈরঙ্গ নদী এবং দক্ষিণে আচরঙ্গ । সংস্কৃত রাজমালায় আছে–
'যস্য  রাজস্য পূর্ব্বাস্যাং মেখলিঃ সীমতাং গতঃ ।
 পশ্চিমস্যাং কোচবঙ্গোদেশঃ সীমতি সুন্দরঃ । 
উত্তরে তৈরঙ্গ নদী সীমতাং যস্য সঙ্গতা ।
 আচরঙ্গ নাম রাজ্যে যস্য দক্ষিণ সীমতি । 
এতন্মধ্যে ত্রিবেকাখ্যাং দ্রুহ্য সুশাসিত ।

ত্রিবেগ রাজ্য আজ আর নেই । বহুকাল পূর্বেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে । সে সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ 'শ্রীহট্টের ইতিহাসে' লিখেছেন– "রুদ্র বংশের ত্রিপুর নামে এক নৃপতি কিরাত  ভূমে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেন । পার্শ্ববর্তী রাজাদের অপেক্ষা তিনি ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন । তাহার রাজধানী পূর্বকালে কামরূপের সন্নিকটে 'কোপিল' নদীর তীরে অবস্থিত ছিল । সে প্রাচীন রাজ্যের রাজধানীর নাম ত্রিবেগ । পরে কালের ক্ষয়ে এই নগরী বিলুপ্তি প্রাপ্ত হয়ে যায় । এবং কালক্রমে বর্তমান কাছাড় ও শ্রীহট্টের ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাজধানী স্থাপিত হয় "

 পরবর্তীকালে এই ত্রিবেগেই ত্রিপুরা নামে পরিচিত হয় । দ্রুহ্যর পরে রাজা হন ত্রিপুর । তিনি ছিলেন এক প্রজাপীড়ক রাজা । কথিত আছে রাজা ত্রিপুরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রজাবর্গ দেবাদিদেব এর কাছে আকুল প্রার্থনা নিবেদন করলে স্বয়ং মহাদেব তার অমোঘ অস্ত্র ত্রিশূলের আঘাতে রাজা ত্রিপুরকে নিধন করে প্রজাগণকে রক্ষা করেন । বলা হয় এই ত্রিপুর রাজার নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় 'ত্রিপুরা' ।  আবার কেউ কেউ মনে করেন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরেশ্বরী বা ত্রিপুরাসুন্দরীর আবাসভূমি বলে এই রাজ্যের নাম 'ত্রিপুরা' । প্রসঙ্গত, হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত ত্রিপুরার পুরাতন রাজধানী উদয়পুরে অবস্থিত ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে বা ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের মন্দির দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ । এই পীঠস্থানে দেবীর ডান পায়ের গোড়ালি পড়েছিল বলে প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে । এটি ভারতের অন্যতম দেবীতীর্থ । 

যাইহোক, ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সংক্রান্ত যে মতবাদ গুলি রয়েছে সেগুলি ঐতিহাসিক যুক্তি নির্ভর নয় বা ঐতিহাসিক সত্যতার অনুকূলে নয়। কেননা প্রাচীন রাজা ত্রিপুরার কাহিনি নিছকই পৌরাণিক ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করার মত কোন উৎস নেই । তাছাড়া অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর নামানুসারে এই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা এর স্বপক্ষে সত্যতা মেনে নেয়া যায় না । কারণ উদয়পুরে দেবী প্রতিষ্ঠিত হন ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে । এর অনেক পূর্বেই এই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা ছিল বলে তথ্য রয়েছে । তাহলে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তির বিষয়ে রাজমালা প্রণেতা প্রয়াত কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয় পূর্ববর্তী মতবাদের প্রতি সাড়া না দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন । তার মতানুসারে 'তুই' এবং 'প্রা' এই দুই শব্দ মিলে তৈরি হয় 'তুইপ্রা' । যার অর্থ–দুই জলধারা বা নদীর মিলনের স্থল । অতীতে কোন এক সময়ে ত্রিপুরার প্রাচীন কোন রাজা হয়তো মেঘনা বা ব্রহ্মপুত্র বা তার শাখা নদীর মোহনার তীরবর্তী জায়গায় রাজ্যপাট স্থাপন করেন । তাই সেই জায়গার নাম হয়েছিল 'তুইপ্রা' । এই 'তুইপ্রা' শব্দটি কালক্রমে রূপান্তরের পথে যথাক্রমে তুইপ্রা > তিপ্রা > ত্রিপুরা নামে পরিণত হয়ে যায় । কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয়ের এই মতবাদকে আজকের ইতিহাসকারগণ স্বীকার করেন । 
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন মহোদয় তাঁর 'বৃহৎ বঙ্গ' গ্রন্থে লিখেছেন– "ভারতবর্ষে বর্তমান কালে যত রাজ্য বিদ্যমান আছে তাহাদের মধ্যে ত্রিপুরার রাজবংশই প্রাচীনতম । আদিকাল হইতে ১৮৪ পুরুষের নাম আর কোন বংশে একাধারে পাই না । এই বংশের আদিপুরুষ দ্রুহ্যু কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগনগরী স্থাপন করেন । লৌকিক বিশ্বাসে এই বংশ কিরাত বলিয়া অখ্যাত হইতেন । ত্রিপুরা রাজ্যের অনাচার ও অনার্য শ্রেণীতে বিবাহাদির জন্য এই বংশে কিরাতও ঢুকিয়া ছিল । এই কপিল আশ্রম 'সাগর' নামক স্থানে অবস্থিত ছিল । সাগর সন্নিহিত বিস্তৃত ভূখণ্ড পাঁচটি সমৃদ্ধ নগরী ও দুই লক্ষ লোকসহ ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে জলপ্লাবনে ডুবিয়া গিয়াছে ।"

ত্রিপুরী সম্প্রদায় ও রাজ্যের মূল আদিবাসী নয় বলে পরিগণিত  হলেও শুধু প্রাচীনকাল থেকে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সন্নিহিত অঞ্চল বা রাজ্যসমূহ থেকে এই রাজ্যের প্রবেশ করেছে । ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব ও  নৃবিজ্ঞানীগণ অভিমত প্রকাশ করে থাকেন যে, রাজ্যের সকল আদিবাসী সম্প্রদায়গোষ্ঠী সহস্রাবদের পূর্বে চীন দেশ পরিত্যাগ করে তীব্বত ও ব্রহ্মদের অতিক্রম করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে । কালক্রমে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করে ত্রিপুরার আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত হয় । 

অতীত ত্রিপুরা আদিবাসীদের বাসভূমি হলেও বর্তমান ত্রিপুরারাজ্য মিশ্র জনগোষ্ঠীর বাসভূমি । দেশ স্বাধীন হওয়ার  আগে ও পরে বছরের পর বছর হিন্দু মুসলমানগণের সম্প্রদায়িক কলহের কারণে পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাতারে কাতারে হিন্দু জনগণ ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করার ফলে এখানকার আদিবাসীরা সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয় । তবে সুদূর ত্রিপুরা প্রাচীনকালেও, যখন এই রাজ্যের অধিবাসীরা সংখ্যাগুরু তদানীন্তন পূর্ববাংলার পূর্ব সীমান্ত সবটাই সবুজ বনানী ঘেরা অরণ্যকুন্তলার ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরা বর্তমানে উত্তর পূর্ব ভারতের সাত বোনের এক বোন । অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের ( আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা ) অন্যতম হচ্ছে ত্রিপুরা । আয়তনের দিক থেকে ছোটো হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সে স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল এবং সারা ভারতেই বিশেষভাবে আলোচিত একটি নাম । 

তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসনকালে ত্রিপুরার অবস্থান ছিল একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ।  ইংরেজের বর্বর শাসন সমাপ্ত হওয়ার পর রাজন্য ত্রিপুরা ভারত ডোমিনিয়ন এ যোগ দেয় । ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে কার্যকরীভাবে যুক্ত হয় ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে । সেইসঙ্গে অবসান ঘটে ৫ শতকের মানিক্য রাজবংশের ধারাবাহিক শাসনক্রম । ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতের নিজস্ব সংবিধান রচিত হয় । এবং ত্রিপুরা সেসময় 'গ' শ্রেনিভুক্ত রাজ্য হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে । ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সংবিধানের সপ্তম সংশোধন করা হয় ।এই সংশোধনীতে ভারতের রাজ্যগুলির পুনর্ববিন্যাস ঘটানো হয় । নতুন পুনর্বিন্যাসে ত্রিপুরা রাজ্যকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় । ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব এলাকাসমূহ পুনর্গঠন আইন প্রবর্তন করা হয় ।এ আইন অনুসারে ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে 1972 সালের একুশে জানুয়ারি ।

রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের পর লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মহাত্মার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ভারত ব্রিটিশের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে । এর ঠিক আগে ত্রিপুরার মহারাজা ছিলেন মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর । মহারাজা পরিকল্পনা করেছিলেন ত্রিপুরাকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্তির । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতের স্বাধীনতার প্রাক লগ্নে ১৯৪৭ সালের ১৭ মে রাত আটটা চল্লিশ মিনিটে মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর পরলোক গমন করেন ।  বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের মৃত্যুর পর যুবরাজ কিরীটবিক্রম রাজ্যের রাজা হবার অধিকারী হলেও নাবালক হেতু রাজা হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি । তখন ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবীকে সভাপতি বানিয়ে কাউন্সিল অফ রিজেন্সি গঠন করা হয় ত্রিপুরার শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ১৯৪৭ সালের ৮ই আগস্ট এই ঘোষণার দ্বারা কাউন্সিল অফ রিজেন্সি ত্রিপুরা শাসনভার গ্রহণ করে । উক্ত কাউন্সিল যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তারা হলেন
১) মহারানী কাঞ্চন প্রভা দেবী–সভাপতি ২) মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মণ–সদস্য
৩) মেজর বঙ্কিম বিহারী দেববর্মন–সদস্য
৪) সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়–সদস্য

ভারতের স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরার রাজতন্ত্রের সূর্য অস্তমিত হয় । ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নতুন দিল্লিতে ত্রিপুরার রিজেন্ট মহারানী কাঞ্চন প্রভা দেবী, তার নাবালক পুত্র কিরীটবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুরের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ত্রিপুরাকে ভারত সরকারের হাতে অর্পণ করে । এই সময় থেকে ত্রিপুরা ভারত সরকারের 'গ' শ্রেণি ভুক্ত রাজ্যের মর্যাদা পায় । মুখ্য প্রশাসক বা চিফ কমিশনার প্রশাসনিক পদে বৃত হন । ত্রিপুরার প্রথম চিফ কমিশনার পদে শ্রী রঞ্জিত কুমার রায় ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবর নিযুক্ত হন । প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর চিফ কমিশনারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, শ্রী সুখময় সেনগুপ্ত এবং জিতেন্দ্র দেববর্মা । ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠিত হয় । ফলে ত্রিপুরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় । ১৯৫৬ সালে নতুন করে আঞ্চলিক পরিষদীয় আইন অনুযায়ী ত্রিপুরায় আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয় । মোট ৩২ জন সদস্যবিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের দুজন সদস্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হয় । বাকি ৩০জন সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয় । ১৯৬৩ সালের মে মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে কেন্দ্রের অধীনস্থ আইন আঞ্চলিক আইন কার্যকরী হয় এবং আইন মোতাবেক সংবিধানের ২৩৯ ধারা বলে কেন্দ্রশাসিত রাজ্যসমূহের জন্য রাষ্ট্রপতি একজন প্রশাসক নিযুক্তির প্রচলন করেন ।

আঞ্চলিক আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরায় আঞ্চলিক পরিষদীয় ব্যবস্থার অবসান হয় এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের পয়লা জুলাই ত্রিপুরায় জনপ্রিয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয় শ্রীশচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে । গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পরিবর্তিত হয় । এবং এই কাঠামো চলতে থাকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । এইভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় ।

ত্রিপুরা রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের গণতান্ত্রিক আশা ও অধিকার কে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের পার্লামেন্ট আইন মোতাবেক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের একুশে জানুয়ারি ত্রিপুরাকে পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয় । ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়ী হয় এবং সেই সুখময় সেনগুপ্তের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের প্রথম রাজ্যপাল নিযুক্ত হন শ্রীযুক্ত ব্রজকুমার নেহেরু, আইএএস । এভাবে প্রাচীন রাজন্যশাসিত ত্রিপুরা একটি গণতান্ত্রিক পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা প্রাপ্ত হয় ।

সীমানা ও আয়তন

ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান একটি নির্জন দ্বীপের মত । প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেন পাকস্থলীর মত ঢুকে রয়েছে । কারণ উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এই তিন দিক দিয়ে বাংলাদেশ ত্রিপুরাকে ঘিরে রেখেছে । উত্তরে আসাম ও পূর্বে মিজোরাম রাজ্যের সামান্য কয়েক কিলোমিটার সীমানা ত্রিপুরাকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে । উত্তর পশ্চিমে আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার সঙ্গে ত্রিপুরার সীমানা মাত্র ৫৩ কিলোমিটার এবং পূর্বে মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে এর সীমানা মাত্র ১০৯ কিলোমিটার । প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এর আন্তর্জাতিক সীমানা ৮৩৯ কিলোমিটার । বাংলাদেশের সিলেট জেলা কুমিল্লা জেলা পূর্ব দিক ঘিরে রেখেছে । ত্রিপুরার বর্তমান আয়তন ১০৪৯১ বর্গ কিলোমিটার । সর্বাধিক বিস্তৃতি ১৮৪ কিলোমিটার । ত্রিপুরা রাজ্য ২৪'৫৬ ও ২৪'৩ ২ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১'১০ ও ৯২'২১ পূর্ব দ্রাঘিমা রেখায় অবস্থিত । প্রসঙ্গত, উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৭ রাজ্যের মধ্যে ক্ষুদ্রতম রাজ্য এই ত্রিপুরা । 

নদ-নদী 

 ত্রিপুরা রাজ্যে অগণিত ছোট ছোট পাহাড়ি নদী দেখা যায় । নদীগুলি প্রধানত উত্তর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত উত্তরবাহিনী নদী গুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে খোয়াই, ধলাই, মনু,দেও,লঙ্গাই ও জুড়ি । দক্ষিণ বাহিনী নদী গুলির মধ্যে আছে মুহুরী ও ফেনী । এছাড়াও রয়েছে গোমতী, হাওড়া ইত্যাদি । পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট বড় ছড়া ত্রিপুরা নদীকে স্রোতস্বিনী করে রেখেছে তবে সবগুলো নদী সারা বছর নৌ চলাচলের উপযোগী নয় । কারণ সব ঋতুতে জলসীমা সমান থাকে না । ত্রিপুরার প্রধান নদীর নাম গোমতী । এর দুটি উপনদী রয়েছে রাইমা ও সরমা । এ দুটির সঙ্গমস্থল হল দুচারিবাড়ি । ওখানে রাইমা ও সরমা এক হয়ে গোমতী নামে আত্মপ্রকাশ করেছে । তীর্থমুখের কাছে ডম্বুর জলপ্রপাত সৃষ্টি করে গোমতী সমভূমিতে নেমে এসেছে । প্রতিবছর মকর সংক্রান্তিতে তীর্থ মুখে বিরাট মেলা বসে । গোমতী ত্রিপুরার পবিত্র নদী । ওইদিন পূণ্যার্থীরা গোমতী নদীর জলে অবগাহন করে গঙ্গাস্নানের তৃপ্তি লাভ করে থাকেন । প্রসঙ্গত,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'বিসর্জন' নাটকে বর্ণিত উদয়পুরের ভুবনেশ্বরী মন্দির এই গোমতীর পাড়ে অবস্থিত । রাজর্ষি উপন্যাসে হাসি ও তাতা যে ঘাটের সোপানে রক্তের দাগ দেখে রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এত রক্ত কেন ?' দুই ভাই বোনের কচি কচি হাত দিয়ে যে ঘাটের রক্তের দাগ মোছার চেষ্টা করেছিল সেই ঘাট বা সোপান এই গোমতীর তীরে অবস্থিত যার চিহ্ন আজও বর্তমান ।

পাহাড়-পর্বত

ত্রিপুরার ভূমিভাগ উঁচু-নিচু অগভীর এবং প্রশস্ত উপত্যকা সংকুল । তরঙ্গায়িত পাহাড়ের অভ্যন্তরে রয়েছে বালি পাথর আর এঁটেল স্তরিভূত মাটি । ত্রিপুরার প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এই তরঙ্গায়িত পাহাড় শ্রেণী । আছে টিলাভূমি এবং অবশিষ্ট অংশে রয়েছে টিলা ভূমির পাদদেশ বা উর্বর নিম্নভূমি বা লুঙ্গাভূমি । আর আছে নদী উপত্যকায় অবস্থিত কিছু সমভূমি ।  ত্রিপুরার পাহাড়গুলি মূলত উত্তর দক্ষিণের প্রসারিত রয়েছে । এই পাহাড়শ্রেণীতে প্রধানত পাঁচটি রেঞ্জ আছে । পাহাড় শ্রেণীর গুলির মধ্যে প্রধান হল বড়মুড়া, আঠারো মুড়া, লংতরাই, জম্পুই এবং শাখানটাং । রাজ্যের উচ্চতম পাহাড় হচ্ছে জম্পুই রেঞ্জ । এর দৈর্ঘ্য ৭৪ কিলোমিটার । উচ্চতা ৯৩৯মিটার  । এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম বেতলিং শিপ । দ্বিতীয় স্থানে আছে আঠারোমুড়া । এর দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার । এর উচ্চতম শৃঙ্গ হল জারিমুড়া এবং এর উচ্চতা ৪৮১মিটার ।

কৃষিজ, ও প্রাকৃতিক সম্পদ :-

উত্তরপূর্ব ভারতের কোলে তার ছোট্ট সন্তান । ত্রিপুরা কৃষিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ । পাহাড় পর্বতময় এই রাজ্যটির অধিকাংশ সবুজ বনানীতে ঘেরা ।এখানে সমতল ও পাহাড়ে জাতি-উপজাতি জনগোষ্ঠীর অনাদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে । ত্রিপুরার সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে জীবিকা নির্বাহের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ । এই সম্পদসমূহ ত্রিপুরার অধিবাসীদের প্রাণধারা কে সমৃদ্ধ করে রেখেছে ।

পার্বত্য ত্রিপুরার প্রায় ৬৯ শতাংশ বনাঞ্চল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ । ত্রিপুরার অধিবাসীরা কৃষি ও অরণ্য নির্ভর জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকেন । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে বন বনানীতে, পাহাড়ে পর্বতে, নদ-নদীতে । বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আধুনিক ত্রিপুরায় গ্যাস ও তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে । মাটির নিচে প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে আছে এই খনিজ সম্পদসমূহ । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । একটি হচ্ছে জৈব ও আন্যটি অজৈব । জৈব প্রাকৃতিক সম্পদ গুলি হল- বাঁশ, কাঠ, বিভিন্ন ধরনের পশু, পাখি ইত্যাদি । অজৈব প্রাকৃতিক সম্পদ হল খনিজতৈল ও প্রাকৃতিক গ্যাস । কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে চা ও রাবার ত্রিপুরার প্রধান শিল্পদ্রব্য । এছাড়া ত্রিপুরার মাটিতে গম, ধান, পাট, তিল, সরিষা, মেস্তা, আলু এবং বিভিন্ন ফল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় । ত্রিপুরার বনাঞ্চলে কড়ই,জাম, শাল, সেগুন, গামাই, জারুল, আউয়াল, কনক, গর্জন,চামল মেহগনি ইত্যাদি মূল্যবান গাছ পাওয়া যায় । এই গাছগুলির গৃহনির্মাণ, আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ, এবং পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করে । ত্রিপুরার অরণ্যে নানারকম ভেষজ গাছগাছালিও রয়েছে । ত্রিপুরার বাঁশ বেতের কুটির শিল্প দেশ-বিদেশে সমাদৃত । ত্রিপুরার বাঁশ বেত দিয়ে তৈরি হয় সৌখিন আসবাবপত্র, আইসক্রিমের কাঠি, টুকরি,ধারী, ধূপকাঠির শলাকা, খেলনা, মোড়া, ঘরের বেড়া, ঘরের খুঁটি ইত্যাদি । এগুলো ত্রিপুরার অর্থকরী ফসল । ত্রিপুরার বন্যপ্রাণীর মধ্যে হাতি, নেকড়ে, হরিণ, শূকর, ভাল্লুক, চিতাবাঘ বনমোষ, শিয়াল, সজারু, বন বিড়াল, রামছাগল, বাইসন, বনরুই, বানর, হনুমান  বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ত্রিপুরার বনাঞ্চলে টিয়া, কাকাতুয়া, ধনেশ, ময়না, ফিঙে, কবুতর, ডাহুক, হাঁস, মোরগ, চিল, শকুন, সারস,বুলবুল, বাবুই,  চড়াই ইত্যাদি নানা রকমের পাখি দেখতে পাওয়া যায় । ত্রিপুরায় প্রচুর দিঘি, নদনদী, জলাশয় ও হ্রদ রয়েছে । এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় ।

Monday, February 20, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে মণিপুরিদের আগমন ও মণিপুরি সংস্কৃতির প্রসার

ত্রিপুরারারাজ্যে মণিপুরিদের আগমন ও মণিপুরি সংস্কৃতির প্রসার

একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির ক্ষেত্রে অপর কোন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, ভাষা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধতর হয়ে ওঠে । ফলে এর মধ্যে একটি সমৃদ্ধ একাত্মবোধ গড়ে ওঠে এবং সেখানে সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে এরকম ভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির আগমন আদান-প্রদান এবং মেলবন্ধন ঘটেছে । ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইরূপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে ত্রিপুরারাজ্য হয়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য । ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতেই হয় যে, রত্নফা যখন মানিক্য উপাধি নিয়ে ত্রিপুরায় ফিরে এলেন তখন তার সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের । যাদের সহযোগে সেদিন ত্রিপুরায় গড়ে উঠেছিল এক মিশ্রসংস্কৃতির বাতাবরণ । যেহেতু পণ্ডিতদের দ্বারা আমদানি হয় সংস্কৃত সাহিত্য ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির । সঙ্গে সঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের ত্রিপুরায় সে সময় সীমানা ছিল ব্রহ্মদেশের প্রান্ত সীমা থেকে শ্রেষ্ঠ ঢাকার কিছু অংশ চট্টগ্রাম নোয়াখালী নিয়ে । তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ত্রিপুরাতে হিন্দু বৌদ্ধ শৈব ও শাক্ত সংস্কৃতি নিদর্শন পাওয়া যায় ।  এককথায় ত্রিপুরার সংস্কৃতিতেও 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' পরিবেশ যথেষ্টই রয়েছে ।

ত্রিপুরার রাজারা সংস্কৃতিবান, বিদ্যোৎসাহী, উদার মনোভাবাপন্ন এবং গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় সতত সচেষ্ট হিসেবে সর্বজনবিদিত । নৃত্য ও গীতের সুধাসাগরে মহারাজারা শুধু নিজেরাই নিমজ্জিত ছিলেন না, রাজ অন্দরে পুরনারীদের সংগীত ও অন্যান্য চারুকলার চর্চায় প্রচন্ড উৎসাহ প্রদান করতেন । ত্রিপুরার  রাজাদের ইতিহাস কালিপ্রসন্ন সেন সম্পাদিত 'শ্রীরাজমালা'য় উল্লেখ রয়েছে–
 'ত্রিহুত দেশ হ ইতে নৃত্যগীত আনি ।
 রাজ্যতে শিখায় গীত নিত্য নৃপমণি ।।
 ত্রিপুর সকলে সেই গীত ক্রমে গায় ।
 ছাগ অন্তে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।
অর্থাৎ মহারাজা ধন্যমাণিক্য মিথিলা বা তিরহুত দেশ থেকে শিল্পী এনে রাজ্যে নৃত্যগীতের প্রচলন করেছিলেন ।

ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ হলো মনিপুরী জনগণ রাজ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মনিপুরী গণ রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের ন্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধির পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যা হল ----------- আর তার মধ্যে ----------- মনিপুরী । রাজ্যের ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলপুর, খোয়াই ও সদর মহকুমাতে মনিপুরীগণ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।

 মনিপুরীরা মূলত মনিপুরের অধিবাসী । সাধারণত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক দুরবস্থা সাংস্কৃতিক বিনিময়ে এবং রোগ মহামারীর আক্রমণ কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য স্থানে বা অন্য রাজ্যে অভিবাসনে বাধ্য করে ত্রিপুরা রাজ্যের মনিপুরীতে প্রথম অভিবাসন উপরোক্ত কোন একটি কারণের ফলে হয়েছে । রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মনিপুরিগণ দেশ ত্যাগ করে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮২৪ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীরূপে মনিপুরের এক প্রাক্তন রাজার আমরা সন্ধান পাই । ১৭৬২ সালে কৃষ্ণ মানিকের আমলে চট্টগ্রামের রেসিডেন্ট মি. ভেরেলিস্টের পত্র থেকে জানা যায় যে মনিপুর রাজ বিখ্যাত গরীবনওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র জগত সাই সিংহাসন থেকে  বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে ভেরেলিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুনরায় ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসন দখল করার জন্য । কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের তৎপরতায় তিনি সফল হননি কিন্তু জগৎসাই সম্ভবত কসবা অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন কেননা পরবর্তীকালে ভাগ্যচন্দ্রের আগরতলা আগমন কালে কসবাতে জগৎশাই ভাগ্যচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন বলে জানা যায় । তারপরে অবশ্য জগতসাইয়ের আর কোন সংবাদ জানা যায় না এবং তার বংশধর বা পরিবার-পরিজন এর ত্রিপুরায় পাই না । রোগ মহামারী বা অর্থনৈতিক কারণের জন্য মনিপুরীদের ত্রিপুরার অভিবাসনের কোন সংকেত ইতিহাস আমাদের দেয় না ।

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । ত্রিপুরার অনেক রাজা মণিপুরের রাজকন্যা বিবাহ করেছেন দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য মনিপুরাধিপতি ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিবাহ করেন । কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছেন, ''মণিপুরের রাজবংশের শহীদ ত্রিপুরার রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ ।" এই উক্তি পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না । কেননা আমরা দেখি যে ত্রিপুর বংশধর তইদাক্ষিণের পুত্র দাক্ষিণ মেখলি রাজকন্যা বিবাহ করেন অবশ্যই এই বিবাহ বর্তমান ত্রিপুরার রাজনৈতিক সীমার মধ্যে ঘটেনি । বরঞ্চ বলা চলে ত্রিপুরার মানিক্য রাজাদের সঙ্গে মনিপুর রাজবংশের প্রথম সম্বন্ধ হয় রাজধরমানিক্যের সঙ্গে । এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা । কেহ কেহ মনে করেন কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী মণিপুরের রাজদুহিতা । কৈলাস চন্দ্র জাহ্নবীদেবীর অপর নাম 'রানী তম্পা' বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু কমলজিৎ সিংহ উল্লেখ করেছেন যে জাহ্নবী দেবীর অপর নাম 'সিজা তম্ফা' ।এই নামীয় কোন মহিলা মনিপুরী ভিন্ন অপরকেও হতে পারে না । কৈলাস চন্দ্রের রাজমালা তে সিজাতমফার উল্লেখ নেই । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরাতন রাজমালা শ্রীরাজমালার মুল পাঠে এবং 'দেশীয় রাজা'তে কৃষ্ণমানিক্যের পত্নীর নাম জাহ্নবী দেবী লেখা আছে কিন্তু  আখাউড়া স্টেশনের নিকটে রাধানগর গ্রামে অবস্থিত রাধামাধব মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী কৃষ্ণমানিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী । মুদ্রার সাক্ষ্যেও আমরা তার নাম জাহ্নবী দেবী পাই । কর্নেল দেববর্মা মহাশয় তাকে অসূর্যম্পশ্যা একজন ত্রিপুরী রমনী বলে তার অনেক গুণের উপর আলোকপাত করেছেন । অন্য প্রমাণাভাবে কমলজিৎ সিংহ এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছেন । কৃষ্ণ মানিক্য ( ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩খ্রিস্টাব্দ ) শমসের গাজীর উপদ্রবে সিংহাসন দখল করতে না পেরে অনেকদিন কাছাড় ও মনিপুরের রাজসভায় সাহায্য লাভের আশায়রাজ্যত্যাগ করেছিলেন ।

ইতিহাসের এই সমস্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এভাবেই খুব সম্ভবত রানী হরিশেশ্বরীর স্বজন, সেবক ও সেবিকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের প্রথম মনিপুরী অভিবাসন কেন্দ্র । রাজধানীর পাশে মেখলিপাড়া গ্রামে । কমপক্ষে চারটি বিভিন্ন বংশের মনিপুরিগণ এখানে বসবাস করছেন । এরা হলেন মরুংবম, হনজবম, খুমনথেম, লাইপুবমনা নামক বংশের উত্তরপুরুষ । রাজকীয় বহরের অন্তর্ভুক্ত না হলে একসঙ্গে একই স্থানে চারটি বংশের মানুষ সমবেত হয়ে বসবাস করতে পারত না । রাজমালা পাঠে জানা যায় যে,বৈবাহিক সূত্রে মনিপুর রাজবংশের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কিত হন রাজধর মানিক্য ( ১৬১১ খ্রি.)।  তিনি ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রথম রাজধর মানিক্য । সেই সূত্রে তিনি নিজে ত্রিপুরার নৃপতিদের মধ্যে প্রথম বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি সার্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ নামে পরম বৈষ্ণব পুরোহিত ও ২০০ জন ভট্টাচার্য বৈষ্ণবের সঙ্গে সর্বদা ভাগবত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতেন । 
এভাবেই রাজঅন্তপুরে মণিপুরী মহিলাদের আগমনের ফলে মনিপুরী কৃষ্টি সংস্কৃতি ও মণিপুরি নৃত্যধারার  বিস্তার লাভ করে । ত্রিপুরারাজ্যের রাজ অন্তঃপুরের বাইরেও প্রসারলাভ করে মণিপুরি নৃত্যশৈলী ।  মহারাজগণের উৎসাহে রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা রাজবাড়ির অঙ্গনের মধ্যেই নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করতেন ।  রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে হোলি এবং ঝুলন উপলক্ষে দুইদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত । প্রতিটি নৃত্যই মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হত । মণিপুরি নৃত্যগুরুগণ বিভিন্ন সময়ে  রাজকমারীদের নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন ।বিশেষ করে রাসোৎসব উপলক্ষে রাজপরিবারের মেয়েরা মণিপুরি 'মহারাস' নৃত্য পরিবেশন করতেন । এককথায় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে  সেকালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ও ধ্রুপদী নৃত্যের পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল ।

Friday, February 10, 2023

রাবণরাজা কৌপিন পরে সীতাহরণ করেন
কিল মারবার গোঁসাইজি ভাতের থালা ধরেন
ভোট এলে আজব দেশে গজবের গজল শুনি
টাকলা মাথায় পরচুলা পরে লম্বা বিনুনি

কাঁচা কাঁচা পাকা পাকা রঙ ধরেছে পাকা পাকা
চার্ডার্ড বিমান ভর্তি করে আসছে কোটি টাকা
আলখাল্লা হাওলাত নিয়ে সাজছে ভোটের বাউল
এই বাজারে ল্যাঙ্গি মারলেও হয়নাকো ফাউল

শক্তিশালী যে এই লেখাটা বুকের ভেতর আওয়াজ পাই
সন্ন্যাস নেবার যে বার্তা পেলাম সেও বুঝি আরেক 'থকাই' ।
ধাপে ধাপে ঠকে গেলে একটা জাতি বাঁচে কি ভাই ?
খুড়োর কলের পেছনে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে 'থ' খাই ।