Thursday, December 30, 2021

সনন্ধিমুহূর্ত

সন্ধিমুহূর্ত
             
           তীব্র হুল্লোড়, পটকা আর বাদ্যগর্জনে ভেঙে যাচ্ছে নৈশনিরবতা ৷ ক্রমান্বয়ে সন্ধিক্ষণের দিকে এগোচ্ছে রাত ৷ শেষ নির্যাস নেবার জন্যে নোঙর খুলে দেওয়া হয়েছে ৷ কালের জাবেদা খাতায় এই বিভাজনের কোনো বুকমার্ক নেই ৷ তবুও ক্ষণজীবী মানুষেরা অপসৃয়মান সময়ের সিঁড়িতে দাগ রেখে দেবার জন্যেই করে এত আয়োজন,  এই বোধন ৷ সুখের অতীত আর আশার আগামীর মাঝে একটু আনন্দ আস্বাদনের নিষ্কলুষ প্রয়াস ৷ পেছনের ছায়াপথে চুম্বনচিহ্ন রেখে সামনের নীহারিকার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় যেন চলমান মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করে তুলতে উৎসুক ৷

এক একটি অনাগত পল তাই আগামী আনন্দরাগের প্রাকবয়ন ৷ সন্ধিপুজোর দিকেই যেন আমাদের মার্চ-পাস্ট ৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া একাত্ম এলাকায় ৷

Monday, December 27, 2021

দুটি কবিতা

১.

হে শীতের হিম, তুমি অসফল হবে জেনেও সারারাত শিশিরে ভিজিয়ে দাও ঘাসের শরীর বিনিদ্র সেবিকার মতো ৷

তোমার উদার পারানির আশায় সারারাত 
জেগে কাটায় সমবেত  ঘাসপরিজন ৷


২.
আঙুল কেটে কলম বানিয়ে যে রক্তের আখর লিখেছো প্রান্তিক কবি
তার পাঠ হবে কোন পাঠশালায়
কবে আর সেই পাঠ নিয়ে ভূমধ্যরেখার দুই পাশে বানাবো বিনম্র বাগান ৷ যেখান থেকে ফোটা ফুলের সৌরভ ছড়াবে দশদিগন্তের 
পাতার কুটির থেকে আকাশমিনারে

কবির আঙুল কবে যে নির্দেশক হয়ে উঠবে প্রেমের পদাবলিতে

Thursday, December 9, 2021

একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর রামগড় পাক হানাদালমুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুম

একাত্তরের ৮ডিসেম্শেবর রামগড় পাক হানাদারমুক্ত  হওয়ার পর সাব্রুম

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে । এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড়ের সুলতান আহমেদ, বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি তদানিন্তন মুখ‍্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সেতু দিয়ে এপারথেকে ভারতীয় সৈন‍্যের যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশের অভ‍্যন্তরে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ।

 ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । সেদিন দুপুর থেকেই সারা সাব্রুমে প্রচন্ড উল্লাসের বাতাবরণ বয়ে যায় । মুহূর্তে স্কুল-অফিস-কাছারি ছুটি হয়ে যায় । বাজি পটকা ফুটতে শুরু করে । তখন সাব্রুম বাজার ছিল ছোটো । দোকানপাট কম ছিল । যে কয়টা বাজেমালের দোকান ছিল সবগুলো থেকে খুঁজে পেতে কয়েক বস্তা সবুজ আবির যোগাড় করা হয় । শরণার্থী শিবির গুলো থেকে খুঁজে আনা হয় বাংলাদেশের পতাকা । মাইকে বাজতে থাকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এবং 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি' গানদুটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের রমনা ম দানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড । রাজপথে শুরু হয়ে যায় আবির নিয়ে মাখামাখি । সারা রাস্তায়, নদীর পাড়ে মানুষ গিজগিজ করছে । কে শরণার্থী, কে স্থানীয় বোঝার উপায় নেই । লোকে লোকরণ‍্য । মানুষ ওপারে যেতে চাইছে । বি এস এফ বাধা দিচ্ছে । কে শোনে কার কথা ।  ফেনী নদীর উপর রামগড় থানা ও সাব্রুম বাজার বরাবর যে অস্থায়ী সেতু ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার পাক হানাদাররা সেটা ভেঙে দিয়েছিল । পরে তা আবার মেরামত করা হয় । রামগড় মুক্ত হওয়ার  বার্তা পেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সব বাধা ঠেলে সেতু পেরিয়ে, নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে ওঠেন । একদল উৎসাহী এপার থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে ওপারে গিয়ে রামগড়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন । সেদিনের সাব্রুমের তরুণ-কিশোরদের অধিকাংশই সেদিন ফেনী নদী পেরিয়ে রামগড় পৌছেছিলেন । স্কুল ছুটির পর ছাত্ররা বাই-সাইকেল নিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে সারা রামগড় চক্কর দিয়েছিল । যাদের বাড়ি সাব্রুম শহরের পশ্চিমদিকের গ্রাম ছোটোখিল, মনুঘাট ছিল তারা আনন্দের আতিশয‍্যে সাইকেলে চড়ে রামগড় পাকা সড়ক ধরে বাগানবাজারে গিয়ে নদী পেরিয়ে এপারের রানিরবাজার ঘাটে উঠে বাড়ির পথ ধরেছিল । ছাত্রদের এই অ্যাডভেঞ্চার পরবর্তী বেশ কিছুদিন জারি ছিল । বয়স্করাও কিছুদিন বাজারসদাইও করেছিলেন রামগড় বাজার থেকে । 

৮ ডিসেম্বর বিকেলে রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান'-এ ভূষিত হন । তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

Monday, December 6, 2021

আট ডিসেযম্বর একাত্তর ও সাব্রুম

প্রশ্ন :-- সাব্রুম মহকুমা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা । সেখানকার রাষ্ট্রীয় জীবনের সুঃখ দুঃখ ত্রিপুরাবাসীকে আন্দোলিত করে । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের অবদান ও ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ রামগড় হানাদার মুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুমবাসীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন ।
উ:-- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে । এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড়ের সুলতান আহমেদ, বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি তদানিন্তন মুখ‍্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সেতু দিয়ে এপারথেকে ভারতীয় সৈন‍্যের যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশের অভ‍্যন্তরে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ।

 ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । সেদিন দুপুর থেকেই সারা সাব্রুমে প্রচন্ড উল্লাসের বাতাবরণ বয়ে যায় । মুহূর্তে স্কুল-অফিস-কাছারি ছুটি হয়ে যায় । বাজি পটকা ফুটতে শুরু করে । তখন সাব্রুম বাজার ছিল ছোটো । দোকানপাট কম ছিল । যে কয়টা বাজেমালের দোকান ছিল সবগুলো থেকে খুঁজে পেতে কয়েক বস্তা সবুজ আবির যোগাড় করা হয় । শরণার্থী শিবির গুলো থেকে খুঁজে আনা হয় বাংলাদেশের পতাকা । মাইকে বাজতে থাকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এবং 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি' গানদুটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের রমনা ম দানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড । রাজপথে শুরু হয়ে যায় আবির নিয়ে মাখামাখি । সারা রাস্তায়, নদীর পাড়ে মানুষ গিজগিজ করছে । কে শরণার্থী, কে স্থানীয় বোঝার উপায় নেই । লোকে লোকরণ‍্য । মানুষ ওপারে যেতে চাইছে । বি এস এফ বাধা দিচ্ছে । কে শোনে কার কথা ।  ফেনী নদীর উপর রামগড় থানা ও সাব্রুম বাজার বরাবর যে অস্থায়ী সেতু ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার পাক হানাদাররা সেটা ভেঙে দিয়েছিল । পরে তা আবার মেরামত করা হয় । রামগড় মুক্ত হওয়ার  বার্তা পেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সব বাধা ঠেলে সেতু পেরিয়ে, নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে ওঠেন । একদল উৎসাহী এপার থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে ওপারে গিয়ে রামগড়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন । সেদিনের সাব্রুমের তরুণ-কিশোরদের অধিকাংশই সেদিন ফেনী নদী পেরিয়ে রামগড় পৌছেছিলেন । স্কুল ছুটির পর ছাত্ররা বাই-সাইকেল নিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে সারা রামগড় চক্কর দিয়েছিল । যাদের বাড়ি সাব্রুম শহরের পশ্চিমদিকের গ্রাম ছোটোখিল, মনুঘাট ছিল তারা আনন্দের আতিশয‍্যে সাইকেলে চড়ে রামগড় পাকা সড়ক ধরে বাগানবাজারে গিয়ে নদী পেরিয়ে এপারের রানিরবাজার ঘাটে উঠে বাড়ির পথ ধরেছিল । ছাত্রদের এই অ্যাডভেঞ্চার পরবর্তী বেশ কিছুদিন জারি ছিল । বয়স্করাও কিছুদিন বাজারসদাইও করেছিলেন রামগড় বাজার থেকে । 

৮ ডিসেম্বর বিকেলে রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান'-এ ভূষিত হন । তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

Saturday, December 4, 2021

সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি সাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানেও বহু কালীমন্দির রয়েছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ‍্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ‌। অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ‍্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার  প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।

এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ‍্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত‍্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনী নদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী  কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ‍্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত  'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন‍্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই  মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত‍্যেক অমাবস‍্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ  মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী দৈত‍্যেশ্বরী কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ‍্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।

দেবী দৈত‍্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত‍্যছরাতে পাওয়া যায় ।  সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত‍্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে দৈত‍্যেশ্বরী ।  আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাকে সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের  একটি ছরার পাড়ের  পাহাড়ের একটি গুহার মধ‍্যে এই বিগ্রহটি ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহাথেকে রাজকর্মচারীরা তুলে  নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ‍্যই ছিল ।
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন‍্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত‍্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত‍্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত‍্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত‍্যু হলে দৈত‍্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক‍্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত‍্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
        দ্রুহ‍্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।

রাজা দৈত‍্যের সময়কাল থেকে  রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত‍্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ‍্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত‍্যআশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকা দেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আ । অস্ত্রবিদ‍্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ‍্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত‍্য অরণ‍্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে  রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত‍্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক‍্যের পুত্র রত্নমাণিক‍্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত‍্যনারয়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ‍্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন ।বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ‍্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত‍্যনারায়ণ । দৈত‍্যনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত‍্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা হয় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ‍্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন‍্যকুল তাঁদের পূর্বজবংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক‍্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ )সময়ে এই রাজ‍্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ‍্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব‍্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকূটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ‍্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
 এবিষয়ে রাজ‍্যের বিশিষ্ট কবি লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে,'এ অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ এলাকা ডাকাত বা মগ দস‍্যুদের আস্তানা ছিল । এই দস‍্যুদের পূজিতা দেবী হিসাবে 'দৈস‍্যেশ্বরী' নামকরণ হতে পারে । এই দৈস‍্যেশ্বরীই রাজপুরুষ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর সংস্কৃতায়িত হয়ে 'দৈত‍্যেশ্বরী' হয়েছে । এছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বাংলাভাষায় ( নোয়াখালি )  দৈত‍্যকে দৈস‍্য উচ্চারণ করা হয় । যেমন, ব্রহ্মদৈত‍্যকে বলা হয় ব্রহ্মদৈস‍্য । কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দৈত‍্য শব্দটিই আসছে দেবীর নামকরণে উৎসরূপে ।' (সাব্রুমের দেবী দৈত‍্যেশ্বরীর ইতিহাস –অশোকানন্দ রায়বর্ধন ) । গবেষণার জন‍্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।

যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত  ব‍্যানার্জী পরিবার ( রাজ‍্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব‍্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস‍্য সতীশ ব‍্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব‍্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । তার প্রভাব সাব্রুমেও পড়ে ।

সাব্রুম অত‍্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব‍্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব‍্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত‍্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব‍্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব‍্যবসায়ী  গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের সদ‍্যবিজয়ী জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন‍্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস‍্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন‍্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক‍্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।

চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার,  কার্তিকী অমবস‍্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি  দেহত‍্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্র বর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ‍্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
 রাজন‍্য আমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দির সংলগ্ন তহশিলী কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ‍্যাহের জন‍্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । রাজার আমল  থেকে এই পুজো চলে আসছে কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল‍্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান‍্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান‍্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । য়ন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব‍্যয় নির্বাহ হয় ।

রাজন‍্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ‍্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর নামে পরিচিত । মন্দিরের কালিকাবিগ্রহ একখন্ড পাথরবিশেষ । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।

দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন‍্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ‍্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল  তাঁদের জন‍্য দৈত‍্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ‍্যেশ‍্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত‍্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ‍্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ‍্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ‍্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন  করতে আসেন ।


বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গঙ্গোপাধ‍্যায় মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন‍্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ‍্য তেমন কাজ হয়নি ।

সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত‍্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন‍্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ‍্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ‍্যক ।

হুঁইচা

কৃষিকাজে ব‍্যবহৃত একটি লোকসরঞ্জামের নাম 'হূঁইচা' ।। 'হুঁইচা' কথাটা ভুলেই যেতে বসেছিলাম । বরাক বাঁশের তৈরী বাঁক যার দুটো মাথাই থাকে সুঁচালো । সুঁচ বা হুঁইচের মতো দেখতে । তাই হুঁইচা । ধানের বোঝা গেঁথে কাঁধে তুলে নেওয়ার জন‍্যে বাঁকের মতো এটি ব‍্যবহার করা হয় । তারপর এক বিশেষ তালে গতির সঙ্গে পা ফেলে ধানের বোঝা বাড়ি নিয়ে আসা । চলার ছন্দে ঝুলন্ত বোঝা থেকে ঝুলন্ত ধানের গোছা থেকে মৃদু একটা মিষ্টি শব্দ বেজে যায় । ওই শব্দই চাষার বুকে সফলতার আনন্দ দেয় । ফলানো ফসল যখন চোখের সামনে মাঠে মারা যায় তখন চাষার দুঃখের অবকাশ থাকেনা ।
এক কর্ম কাজ । আর এক কর্ম ভাগ‍্য । দুটো নিয়েই কৃষকের জীবন । 'কর্ম কইল্লে অপরাধ নাই' । তীব্র উদ্দীপক বার্তা । আবার 'কর্ম করি আইনছো কি কইর্বা' । ভাগ‍্যকে দায়ী করেই জীবন গড়িয়ে নেওয়া সরল কৃষকের । 


Thursday, December 2, 2021

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ভালোবাসা মুগ্ধ অন্তরের পদাবলি ।
 ভালোবাসা শুধু নিঃস্ব করে না । হৃদয়ের আত্মীয়ও করে । আর সেই ভালোবাসা যদি হয় কবিতায় সহবাস, তাহলে সেই হংসধ্বনি সমোচ্চার আন্দোলিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে । কবিতার অনুভবে যারা ঋদ্ধ তারা পরস্পরের আত্মার ধ্বনি শোনে । হৃদয় থেকে বেরিয়ে এ নিনাদ দেশকালের সীমা টপকে যায় ঋজুগতিতে । এক চিরায়ত বন্ধন সৃষ্টি হয় আত্মীয়তার মতো । স্থানিকতা থেকে মহাস্থানগড় । উৎস থেকে অনন্তবাথান । এক অদৃশ্য হাওয়াপথ তৈরি হয়ে যায় অমোঘ কলকন্ঠে । ঘন বনে ঢাকা  টিলাপথের শেষ প্রান্তের উত্তুঙ্গ টংঘর থেকে হাইটেক প্রাসাদের অন্তঃকোন অবধি ।

কবিতার দীঘল শরীর যখন বুনো নৈঃশব্দ্যের থেকে উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, তার শরীর থেকে সরে যায় সমস্ত প্রাকৃত বাকল । অন্তর্লীন রহস্যের সাত সমুদ্দুর উদোম খেয়াঘাটে যেন প্রণয়প্লাবন ছড়িয়ে দেয় । ফিনকি দিয়ে উঠে শীৎকারবগাথা । কামগান । বিগত শ্রাবণে অবিশ্রান্ত স্নানের পর তার শরীরে মেদুর কারুকথা ভেসে ওঠে । মুক্তোর রেণুর রুপালি জলজ ভ্রূণ কুহকবার্তায় টেনে আনে সৌররশ্মি । থেকে থেকে উড়ালপাঁচালি আর গোধূলিতানের নম্র সুর বেড়ে ওঠে মুগ্ধ চরাচরে । তখন ক্ষীরনদীর ধারা যেন অবিরল ভেসে যায় পাললিক জ্যোৎস্নার অলৌকিক চরাচর
পথে ।

তোমার আমার মাদকনির্যাস হে কবিতা, ভূর্জপত্রের ঠোঙায় ভরে রেখে দেবো অমোঘ জীবনে । আমি আজ আর্যপুত্র, তুমি আর্যনারী । আমাদের মিলনবাসনার পানশি ঝরেপড়া শিউলি তুলে নেবে ।  কামে ও প্রেমে টইটুম্বুর করে দেবে আমাদের প্রণয়সন্ধ্যা । জীবনের আসন্ন কৌমকোমল বার্তা অবিনাশী সমর্পণের মায়ায় বিদগ্ধ শিস দিয়ে যাবে বিষাদের হাটে । কলকল কথাপুঞ্জ অনিঃশেষ স্রোতে গড়িয়ে যাবে পাতাসবুজ অরণ্যের গা ঘেঁষে । শব্দের পর শব্দের সাতকাহন পলিমাটির গভীরে চলে যাবে । মানুষ আর মানুষীর চিরন্তন কথাই তোমার বশীকরণভাষা । এই ভাষাতেই অনন্তজীবন আর মৃত্তিকামৃদঙ্গের তান । দেহাতি চাঁদের ওলান থেকে ঝরে পড়া সন্ধ্যার নস্টালজিয়া নিঃসঙ্গে হেঁটে যায় অনন্তের আলপথে । একথা জানে আখড়ায় বাউলের কন্ঠ ।

লোকচরাচরে শেষ উপত্যকা পেরিয়ে মহাবিশ্বের রহস্যের দিকে যাত্রা কবিতার । সেই মহাসড়কে জোছনার ডিঙা আছে কিনা কে জানে ! সেখানে চলে কি জীবনতাঁতির অনন্তবয়ন ? সেখানে কি খলনারীর  ফাঁদ পেতে রাখে বিষকন্ঠী মরণবালা ? 

এ দুয়ের দ্রোহে আর প্রেমের কবিতার অভিযাত্রা । মহাকবিতার সৃজন । এ এক আঁধারঘেঁষা ছলাখেলা । এখানে কবি অবোধ খেলোয়াড় । তার উষ্ণীষ গড়ায় শব্দের ভূমিতে । জগত বালুকার বুকে লেখে সে জীবনের আদ্যপাঠ আর মরণের বিরহপত্রিকা । এইসব শব্দপুঞ্জে জেগে ওঠে আনন্দজলধারার কবোষ্ণ দুপুর ।
 রোদ্রের লালনগীতি সুরের প্লাবন নিয়ে মেঠোশরীরে উঠে আসে কাম নদীর জল ভেঙে । সঞ্জীবনীকথায় পাতাঝরা কথক পরকীয়া প্রহরে গোধূলিছায়ায় পবিত্র গলায় মায়া শোলক আওড়ায় । সমস্ত শব্দের অর্থ তখন মধুকূপী ঘাসের মতো শরতের বাতাসে নেচে ওঠে । উত্তরের দৈববাতাস হরিহর প্রতিমার যুগলমূর্তিকে ফিনফিনে কাঁপন দিয়ে যায় । কলঙ্কের টিপ খুলে চন্দ্রকরোটি যেন অষ্টমঙ্গলার ঘরের দেওয়া অবধি উঁকি দিয়ে দেখে । মানুষবিহীন খেয়াঘাটে তখন কাঁপতে থাকে অনাথ নৌকো আর মুমূর্ষু নদী । নিবিড় শীর্ণ গাংচিলেরা উড়ে যায় অগ্রগামী ভোরের দিকে । অফুরান পদাবলির বিরহগান মায়া সন্ধ্যায় তির তির করে কাঁপে । বাতাস আনমনা হয়ে যায় কবিতার জন্য ।

Sunday, November 28, 2021

স্ব প্ন

স্বপ্ন 

এটিএমের কিউমুখী কবিতা
হাঁপিয়ে উঠলে হাওয়ামিঠাই
রঙচঙে ও লোভনীয় হয়ে ওঠে

যেমন ব্রেক আপ মিটমাট হলে
জলদাপাড়া কিংবা কাজিরাঙা
যেখানেই যাই ঝালাই মিস্ত্রিরা
বখশিসের হাত বাড়িয়েই রাখে ৷

Wednesday, November 24, 2021

#কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক#

কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক

জীবনের দুই চেতনা । একটা বাইরের । আরেকটা ভেতরের । বহির্চেতনা আর অন্তর্চেতনা । বাইরেরর চেতনা মৌমাছির মতো আহরণ করে প্রকৃতি মকরন্দ ।আর সেই মকরন্দ জমা হয় অন্তরের মৌচাকে । রূপ নেয় মধুতে । জীবনের মধু-আর মননের মধু । বাইরের চেতনার আদিগন্তপাথার থেকে অন্তর্চেতনার মায়াঅলিন্দে । এই পরিনিমজ্জন ও পরিব্রাজন, এটাই মগ্ন চেতনার কেলিকুহেলি । মগ্ন চেতনার সহজসাধনায় প্রাণবিন্দু জেগে ওঠে । সৃষ্টি পা রাখে শিল্পের পৈঠায় । শিল্প হয়ে ওঠে প্রকৃত ও প্রাকৃত শিল্প । 

প্রতিটি সত্তা বাইরে ব্যক্তি । অন্তরে শিল্পী । কবিও অন্তর্লোকের শিল্পী । মগ্নসংসারের কারিগর ‌‌। মাটির তাল নিয়ে শিল্প গড়ে মৃৎশিল্পী ‌। এই মাটি যতক্ষণ ভূমিতে ততক্ষণ মাটি । শিল্পীর হাতে তা হয়ে ওঠে পার্থিব বস্তুর প্রতিরূপ ‌ প্রকৃতির নিপুণ সৌন্দর্যকে আহরণ করেন তিনি । আর আরোপ করেন তা নিজের সৃষ্টিতে । তাঁর মগ্নচেতনায় সৃষ্টিকে সুন্দর করার গোপন কৌশলগুলি জেগে ওঠে ।‌ শিল্পী সে কৌশল প্রয়োগ করেন তাঁর সৃষ্টিতে । বাইরের উঠোনের সৃষ্টিকে প্রাণিত করার তাগিদে অন্তরের প্রকোষ্ঠেও প্রবাহিত হয় আর এক সৃজনবাতাস । জেগে ওঠে কুলকুণ্ডলিনী, সৃষ্টিসম্ভবা ।

কবির অন্তরে বাহিরেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে নিরন্তর । কবির সামনেও আছে প্রকৃতি । সে চিরন্তনী নারী । যাকে ভালোবেসে আশ মেটে না । যাকে দেখে দেখে নয়নের পিপাসা পরিসমাপ্তি হয় না । যার রূপ অরূপ, অপরূপ, সাগরপ্রতিম । সেই গহীন সাগরে ডুবে মরতে চান কবি । কিংবা চান অলীক রত্ন সন্ধান করতে । সে এক অনিঃশেষ কল্পমৈথুনে যুগনদ্ধ  হন কবি ও প্রকৃতি । জগৎ সৃষ্টির আদিকারণ নারী । আর আদিরমণী প্রকৃতি । প্রকৃতি আদ‍্যাশক্তি । প্রকৃতির শক্তিতে পুরুষ  শক্তিমান । প্রকৃতির শক্তিতে কবি হন শক্তিমান । যার নাম কবিত্বশক্তি । প্রকৃতি ভিন্না । কবি ভিন্ন । আবার কবি ও প্রকৃতি অভিন্ন অবশ্যই ।

 কবি ও প্রকৃতির পারস্পরিক শৃঙ্গারফসল কবিতা । প্রকৃতির আশ্লেষে নিষিক্ত হয় শব্দডিম্ব । কবির শুক্ররক্তের কল্পনারসের সঙ্গে শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয় কাব্যভ্রূণ । এ এক পরাবোধিক প্রক্রিয়া । 'আলে গুরু উঅসই শিষ, / বাকপথাতীত কাহিব কিস / গুরু বোব সে শিষ কাল, / যত ভি বোলই / তত ভি টাল ।'–এর বর্ণনা বাক‍্যপথের অতীত । এর ভাষা অনুক্তপ্রয়াসী ।  এখানে এসেই মোড় নিতে হয় পথের । 'প্রভু কহে এহো বাহ‍্য, / আগে কহ আর ।'

কবি জীবনদাতা । কবি শব্দের জীবনদান করেন । শব্দের ব্যবহার হয় কবির হাতে গূঢ়ভাবে । সাংকেতিক অর্থে । কবির নিজস্ব ভুবনে শব্দ হয়ে ওঠে নবীন চিত্রভাষ্য । প্রতিটি শব্দের যে স্বাভাবিক চিত্রকল্প, চেনারূপ মানসপটে নিহিত থাকে তার মধ্যে কবির ব্যবহৃত শব্দ আনে নতুন ভাষা, নতুন রূপ,  নতুন ছলম । অর্থের দিক থেকেও এক নতুন জাদুকথার যেন সৃষ্টি হয় । কবির মননে এবং দর্শনে এক সান্দ্র ভাষাশৈলী তৈরি হয়ে যায়, যা কবির এক নিজস্ব ভাষাভূগোল । নিজস্ব ছন্দবাতায়ন । একান্ত আপন কাঁঠালিচাঁপায় সাজিয়ে তোলেন কবি । 

শব্দ যদি প্রকৃতির ভ্রূণ, কবি যা লেখেন প্রকৃতি নিয়ে লেখেন । কবির যা খেলাধুলো । শব্দকে নিয়েই সে সব । সব শব্দই যেন তার চেনা । শব্দ কে স্পর্শ করে তিনি অনুভব করতে পারেন ‌। শব্দের ঘ্রাণ তাঁকে মাদকতা দেয় । সৃষ্টির মাদকতা । শব্দের চিত্র তাঁর কল্পনাকে রৌদ্রমাখা আকাশে ওড়ার সাহস যোগায়  । শব্দের ছবি মেঘবজ্রকৃষ্টির নভোকালিমায় ভীরু বিরহী করে তোলে ।  শব্দকে কেমন ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা কবির নিজস্ব পাকশৈলী । তাঁর মননতাঁতে কবি শব্দ সাজান টানা ও পোড়েনে । তার উপর দেন কারুজ্যামিতিক চিত্রকথা আর অলংকারের ছন্দিত কোলাজ । আর তাও শব্দেই সৃষ্ট । একটা আশ্চর্য উদ্ভাসিত ধানভূমি তৈরি করেন কবি তাঁর বয়নে । এ বয়ন চলতেই থাকে তো চলতেই থাকে । কবি থেমে থাকেন না । বুননে বয়নে ভরাট হয়ে উপছে পড়ে তাঁর সৃষ্টি ‌। তাকেই বলি কবিতা । কবিতার কোন থামা নেই । কবিতার কোন অবকাশ নেই । এক মহা প্রান্তরকে ক্রমশ ছেয়ে ফেলার জন্য তার উড়াল কিংবা ভাসান কিংবা পদযাত্রা । 

তুমুল গৃহশ্রমে মগ্ন থেকেও কবি যেন নিঃসঙ্গ কীর্তনীয়া । গেয়ে ফেরেন ভোরাই একাকী । জনপদ থেকে জনকোলাহলে । বিষন্ন সায়াহ্নে কবি শব্দের ভিখারী হয়ে ওঠেন।  হয়ে যান শব্দের কাঙাল । প্রাত্যহিকের পরিখাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কবির অভিসার । কোন ঘেরাটোপ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না । কোন দুর্বার বেড়ি তা়ঁকে বেঁধে রাখতে পারে না । বাস্তববন্দি শিবিরে অন্তরীণ থেকে খুঁজে নেন উন্মোচিত পরিসর । 

কবির প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি ক্ষণের চর্যায়  তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পারলেও কোন ক্ষতি নেই । কবি প্রতিদিন তার শরীরভাষাকে অবগুন্ঠিত রেখে নিভৃতে চর্চা করেন কবিতাযাপনের । অনুশীলন করেন কবি হয়ে ওঠার । কবিতা নির্মাণের করণকলা অধ্যয়নের । তার যাবতীয় অধ্যাবসায় শব্দকে নিয়ে ‌‌। সামগ্রিক আয়াশ কবিতার জন্যে ।  জীবন ও সন্ন্যাস এই দুই পরস্পর বিপরীত চর্যার বিরোধাভাসকে কবি প্রয়াসঅভিঘাতে ক্রমশ চূর্ণ করে দেন ব্যবধানের দেয়াল ।  জীবনের মধ্যে থেকেও কবি সন্ন্যাসকল্প পুরুষ । এ দুয়ের রসায়নে কবি খুঁজে পেতে চান আশ্চর্য সব কাব‍্যরহস্য ।

 কবির অন্তরে এক অনন্ত দহন । 'মন পড়ে সখি জগজনে জানী । বন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী ' । কবিও পোড়েন ।কবির অন্তর পোড়ে । পুড়তে পুড়তেই কবি দেখেন জগত । কবি অনুভব করেন জীবন । মনপোড়া কবির উপলব্ধির ঘটে কাব্যিক উন্মোচন । দগ্ধচিত্তে দেখেন আদিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত আকাশ ।কবি চিনে উঠতে পারেন তাঁর চিরপরিচিত আসমুদ্র সংসারক্ষেত্রটিকে । তাঁর মাথার উপরে আকাশ শূন্য । তাঁর পরিচিত ভূমি প্রদেশ চলিষ্ণুতায় উচ্ছল । এই উচ্ছলতার যে জলধিসুনামি  তাই কবিকে তোলপাড় করে । জীবনের মুহূর্মুহূ বদলে যাওয়ার বর্ণের বিচ্ছুরণে হয় কবির অন্তরের ইন্ধন । কবি জ্বলে উঠেন বারবার । 

কবির দেহেও আছে ষটচক্র । কবির সাধনাও দেহতাত্ত্বিক । কবির শরীরেও আছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ি । কবি তাঁর সাধনায় প্রকৃতি ও জীবনরসের মায়াভ্রমণ ঘটান তার শরীরময় । নাভিপদ্মে নিদ্রিতা কুন্ডলিনীকে জাগান তিনি কাব্যিক ইশারায় । শব্দের পর শব্দের বাণসৃষ্টিতে  তিনি কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দেন । সেখানে ঘটে প্রকৃতি ও পুরুষের অদ্বয়মিলন । কবিও জীবনের মিলিত পরমানন্দ । এ আনন্দই কাব্যের মহাভাব । এ আনন্দ ই 'মহাসুহসঙ্গ' । এটা কবির অন্তরের স্থায়ী আনন্দ । যার জন্য কবির অনন্তবাসর । যার থেকে কবির সিদ্ধি । কবির  শরীরে তখন আসে কবিতার জোয়ার । কবি তাকে প্রবহমান রাখেন তার ইচ্ছানুরূপ । এভাবেই কবি পান স্থায়ী আনন্দ ।চিরসুখ । কবির পর্যটনসার ।

Monday, November 22, 2021

আত্মকথন

#খুব ছোটোবেলার কথা ৷ আমি তখন বাল্যশিক্ষা পড়ি ৷ একদিন মা তাঁর ট্রাংক খোলার পর লক্ষ করলাম সেখানে 'মহিলা' নামে একটা বই ৷ বাল্যশিক্ষা ছাড়া যে আর কোনো বই থাকতে পারে সে বয়সে তা আমার জানা ছিলনা ৷ মূলত সেটা ছিল সেসময়ের মহিলাদের মাসিকপত্র ৷ সেটা খুলে দেখেছিলাম পরপর কয়েকটি পৃষ্ঠার ওপরে 'বেনের মেয়ে' লেখা ৷ পরে জেনেছিলাম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ( ৬ডিসেম্বর ১৮৫৩— ১৭নভেম্বর ১৯৩১)  'বেনের মেয়ে' উপন্যাসটি প্রথম মহিলা মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের অংশবিশেষ 'আশ্বিনের ঝড়' নামে আমাদের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল# ৷

Friday, November 12, 2021

সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন: নমস্কার স্যার, আপনি কেমন আছেন?
উত্তর: নমস্কার । ভালো আছি আমি ।

প্রশ্ন: বর্তমানে অবসর জীবন কিভাবে কাটছে আপনার?

উ : কই ? আমার অবসর কোথায় ? সাংসারিক দায়দায়িত্ব, নানা সামাজিক কাজকর্ম, লেখালেখি, বইপড়া, ঘোরাঘুরি ও ঘুম । এই নিয়ে চলছে বেশ ।

প্রশ্ন: আজকের দিনে সাহিত্যে অনেকটা ব্যাপ্তি আপনার।সাহিত্যে আপনার হাতেখড়ি পর্বের কথা শুনতে চাই

উ: সাহিত‍্যপাঠে ও চর্চায় আমি এখনও শৈশব কাটিয়ে উঠতে পারিনি । স্কুলে পড়াশুনার সময় থেকেই টুকটাক ছড়া কবিতা লেখালেখির মধ‍্য দিয়ে সাহিত‍্যচর্চার হাতে খড়ি । আমার সৌভাগ‍্য যে, বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে গল্পকার মানিক চক্রবর্তী, দেবতোষ চৌধুরী, সদ‍্যপ্রয়াত কাশিনাথ দাশ, সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী,প্রাণতোষ কর্মকার, মাণিকলাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মতো শিক্ষকদের নিবিড় স্নেহসাহচর্য পেয়েছি । তাঁরাই আমার লেখালেখিতে প্রেরণা জুগিয়েছেন । কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ম‍্যাগাজিন আমার প্রথম লেখালেখির প্ল‍্যাটফর্ম । বিলোনিয়া কলেজজীবনে অধ‍্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সরকার ( খ‍্যাতিমান ভাষাগবেষক পবিত্র সরকারের অনুজ ) প্রমুখ এবং হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, হরিভূষণ পাল, ভূপাল সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত, সুবোধ কংসবনিক ও কৃষ্ণকুসুম পালের যত্ন পেয়েছি আমি । হরিনারায়ণদা আমাকে খুব কাছে কাছে রাখতেন । সে সময়ের  তরুণ গল্পকার রুমা পাল আমার লেখালেখির নিবিড় পাঠক ও সমালোচক ছিল । কিন্তু শক্তিময়ী রুমা একসময় লেখালেখি থেকে একদমই সরে যায় । যা আমাদের সাহিত‍্যপরিমন্ডলে তথা বাংলাসাহিত‍্যের জন‍্যে এক বিরাট ক্ষতি বলে আমি আজও মনে করি । আমার বাংলায় স্নাতকোত্তর যোগ‍্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমার গ্রামের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন মজুমদারের( কবি রূপন মজুমদারের দাদু ) প্রত‍্যক্ষ অবদান আমি কোনোদিন ভুলবনা । পরবর্তী সময়ে রাজ‍্যের পরিমন্ডলে লেখালেখিতে অগ্রজ কবিমানস পাল ও নকুল রায় জাগরণ সাহিত‍্যবাসরের ও সৈকত সাময়িকীর মাধ‍্যমে হাত ধরে তুলে এনেছেন । প্রয়াত কবি অরুণ বনিক আমার দুঃখের দিনের মরূদ‍্যান ছিলেন । আমাকে তিনি পাঠসমৃদ্ধির জন‍্যে বহু বইপত্র জুগিয়ে গিয়েছেন । আমার বইপড়ার অভ‍্যাস ছোটোবেলা থেকেই । স্কুলবেলায় পেয়েছি স্কুল লাইব্রেরির সুযোগ । সেখানে সরকারি কোয়ার্টার্সে থাকতেন চিকিৎসক দম্পতি ডা. মুকুন্দলাল বসু ও ডা. লীলা বসু । তাঁদের একমাত্র সন্তান শিবাজী বসু বয়সে একটু ছোটো হলেও খেলার সাথী ছিল । তাদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল । সেখানে বাছাই করা সব বই, পুজো সংখ‍্যা, বিশ্বসাহিত‍্যের অনুবাদের বিশাল সংগ্রহ ছিল । আমি নাইন টেনে পড়তেই সেগুলো শেষ করেছি । তাঁরা সেসময় নবকল্লোল, শুকতারা ও দেশ পত্রিকা রাখতেন । আমার বাবা রাখতেন জাগরণ ও অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার । তারপর কলেজ লাইব্রেরি, বিলোনিয়া ও সাব্রুমের পাবলিক লাইব্রেরির সুযোগ তো পেয়েছিই । আর অনবরত উৎসাহ জুগিয়েছেন রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিব‍্যেন্দু নাগ ও দিলীপ দাস । প্রবন্ধচর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ভূপেন দত্তভৌমিক ও মৃণালকান্তি কর । লোকসংস্কৃতির পাঠ নিয়েছি ড. রঞ্জিত দে ও ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর কাছে ।

প্রশ্ন: এ যাবৎ আপনার ক'টি বই প্রকাশিত হয়েছে?
উ: পাঁচটি । বিনীত চুম্বন ( কাব‍্যগ্রন্থ ), ভার্চুয়াল রাই ( কাব‍্যগ্রন্থ ), ত্রিপুরার লোকজীবন ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), লোকসংস্কৃতির তত্বরূপ ও স্বরূপসন্ধান ( প্রবন্ধ ), মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি (সম্পাদিত প্রবন্ধ ) ।

প্রশ্ন: সাহিত্যের কোন শাখায় অধিক যাপন আপনার এবং কেন?

উ: কবিতা এবং কবিতাবিষয়ক গদ‍্যরচনা । কারণ কবিতাই আমার প্রথম প্রেম । কবিতায় আমি স্বাচ্ছন্দ‍্য বোধ করি । জগৎ জীবন প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে আমার অনুভব, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, হতাশা, সংক্ষোভ, শ্লেষ, প্রতিবাদকে আমি কবিতার মাধ‍্যমেই প্রকাশ করতে অভ‍্যস্ত । আমার আত্মপর্যবেক্ষণের শব্দরূপও কবিতা ।

প্রশ্ন: লোকসংস্কৃতি গবেষণায় সুদীর্ঘ ব্যাপ্তি আপনার। ঠিক কিসের নেশায় এটাকে নিয়ে এতো চর্চা?

উ: ব‍্যাপ্তি শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে । ব‍্যাপ্তি শব্দের অর্থ বিশালতা । যা আমার আদৌ নেই । আমার শুধু তৃষ্ণা আছে । অপার তৃষা । তৃষ্ণা মেটানোর জন‍্যেই আমি  আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের উৎসজলসত্র  খুঁজে ফিরি । লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির সমূহ আত্মবীজ । সেখান থেকেই ছড়ায় তাবৎ সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা । যে জাতির লোকসংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি সামগ্রিকভাবে তত সমৃদ্ধ । হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির শেকড় সন্ধান । সমাজেতিহাস সন্ধান । এই অনুসন্ধানও এক তীব্র নেশা । খুঁজতে খুঁজতে কত গভীরে চলে যাওয়া যায় । অরূপরতনের ভান্ডারে প্রবেশ করা যায় । একটা জাতির দর্শনকে উপলব্ধি করা যায় । সেই জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় জাতির গৌরবমন্ডিত অতীত । ইতিহাসেরও উপাদান । নেশাটা আমার ঠিক এখানেই । অতীতসমুদ্রে ডুবে থাকা মূল‍্যবান সাংস্কৃতিক বৈদুর্যমণি তুলে আনার ডুবুরির ভূমিকায় নবিশ আমি । 'ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন' । এ নেশাই আমার জন্মতিলক ।

প্রশ্ন: সাহিত্যের এ সুদীর্ঘ যাপনে যদি আপনার কোনো অভিমান, অভিযোগ,ক্ষোভ বা বিরক্তির কথা জানতে চাই, জানতে পারি কী?

উ: জীবনপথ তো কুসুমাস্তীর্ণ নয় । পায়ে ফোস্কা পড়বে বলে কী পথ চলবনা ? ' ভালোমন্দ সুখদুঃখ অন্ধকার আলো / এই নিয়ে ধরনির সবকিছু ভালো ।' নইলে সবই মিছে । কাজেই এসব মনে রেখে লাভ নেই । যেখানে মনান্তর ঘটে, বা মনে ব‍্যথা পাই, সংঘাতে যাইনা । নিরবে সরে আসি । আমার নিজস্ব অপূর্ণতা মনে করে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করি । আমার প্রাপ্ত অভিমান, অনুভবগুলো মনে গভীরে থেকে সৃষ্টির প্রেরণাদায়ক । নিজের কাছে নিজে কতটা সৎ , দিনান্তে চোখ বন্ধ করে সেটা ভাবি সর্বদা ।

প্রশ্ন : কখনো কখনো দেখা যায় একটা অদৃশ্য শক্তির ভয়ে থমকে যায় কলম-- বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

উ: হ‍্যাঁ ,এরকমটা তো দেখা যায়ই । এটা সবটাই মননের ম‍্যাচুরিটির বিষয় । চেতনার উৎকর্ষতার স্তরানুযায়ী ফল ।সমৃদ্ধচেতনা ব‍্যক্তিকে অকুতোভয় করে । জীবন ধরা দেয় স্বচ্ছ কাঁচের মতো । ব‍্যক্তিকেন্দ্রিক বাসনা অতিক্রম করতে না পারলে নিজের চৌকাঠ থেকে বেরুনো যায়না । চেতনাদীপ্ত প্রাণ কোনো পরাশক্তিকে ভয় পায়না । ঊণচেতন দোলাচলে ভোগে । ভোগে সিদ্ধান্তহীনতায় । তার কলম সুযোগসন্ধানী । কর্তার ইচ্ছেতে যে কীর্তন করে তার কালির তলানিতে থাকে সেডিমেন্ট । শক্তিমান কর্তার বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কলম থিতু হয়ে যায় । সুদিনে যে কলমবাজ সুযোগের সন্ধানে মিছিলের অগ্রভাগে ব‍্যানারবাহক হয় সেই দুঃসময়ে সটকে পড়ে এবং নবব‍্যানারের লুব্ধবাহক হয় । তারই থাকে অদৃশ্যশক্তির রক্তচক্ষুর ভয় । প্রকৃত কলমশিল্পীর অদৃশ‍্যশক্তির ভয় নেই । কলমও থমকায়না তাঁর ।   তিনি চেনেন অশুভশক্তিকে । তাঁর স্পষ্ট ও দৃঢ় কলমকারি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে । দুঃখেও । দ্রোহেও । ফলে প্রিয়জনেরও তিনি বিরাগভাজন হন । যেখান থেকে তিনি সম্মান স্বীকৃতি পাওয়ার কথা সেখানেই তিনি বঞ্চিত হন । সুযোগসন্ধানী এবং স্তাবক  সুবোধরূপী গোপাল ননীভান্ড হাতিয়ে নেন । কিন্তু প্রকৃত শিল্পীর কলম থামেনা । আঁচড়ে আঁচড়ে সমাজের ক্ষত , অশুভশক্তির মুখোশ উন্মোচন করেন তিনি ।

প্রশ্ন: রাজ্যের দক্ষিণ জেলার বাসিন্দা আপনি। দক্ষিণ জেলার অধিকাংশ মানুষ নোয়াখালি ভাষায় কথা বলে। এ ভাষায় সাহিত্য বা সৃষ্টিকর্মের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মতামত কী?

উ: কথায় বলে নোয়াখালির লোক নাকি আফ্রিকার অরণ‍্যেও নাকি পাওয়া যায় । নোয়াখালি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষের ভাষা । আমাদের অন্তর্গত অর্জন । পরিচয়ের ঠিকুজি । তার বিশাল লোকসাংস্কৃতিক ভান্ডারও রয়েছে । ভুল উচ্চারণে মান‍্য বাংলা বলা বা বাচ্চাদের শেখানোর অপপ্রয়াস করার চাইতে ব্রাত‍্য আঞ্চলিক ও পূর্বপুরুষের ভাষা নোয়াখাইল্লা উচ্চারণ অনেক ভালো । নোয়াখালি ভাষাতেও যে বৈচিত্র‍্য আছে সেটা জানতে হবে । জানতে হবে বৃহত্তর নোয়াখালির ইতিহাস । কুমিল্লাসীমান্ত সন্নিহিত লাকসম, চোদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ, ভোলা, নোয়াখালি, মূল ভূখন্ড, নোয়াখালির সন্দীপ, চরবদু ইত‍্যাদি চরাঞ্চল, চট্টগ্রাম সীমান্তসংলগ্ন মীরসরাই, সীতাকুন্ড,ফেনীনদীর তীরবর্তী শুভপুর, মুহুরীগঞ্জ, খন্ডল পরগণা, লক্ষ্মীপুর, কোম্পানীগঞ্জ ইত‍্যাদি নোয়াখালি ভাষাভাষী অঞ্চলের উচ্চারণে কিছু কিছু ফারাক রয়েছে । উচ্চারণ শুনে বুঝতে হবে বক্তা কোন অংশের বাসিন্দা । আমাদের রাজ‍্যেও অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বিরাট অংশে নোয়াখালি ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত । রাজ‍্যের অন‍্যত্র ও কম বেশি এই ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন । এই জনবিন‍্যসটা স্পষ্ট জানা থাকা দরকার । এটা আয়াসসাধ‍্য ব‍্যাপার ।  সাহিত‍্যসৃষ্টিতে এই জ্ঞান অতি অপরিহার্য । অন‍্যথায় তর্ক চলতে থাকবে কে ঠিকঠাক নোয়াখালি ভাষাব‍্যবহার করছেন তা নিয়ে । বাংলাদেশে এই ভাষা নিয়ে কাজ হচ্ছে ভালোই । নোয়াখালি ভাষায় নাটক রচিত হচ্ছে । সংবাদ চ‍্যানেল কাজ করছে । সোস‍্যাল মিডিয়া, ইউ টিউবে চর্চা হচ্ছে । অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই ভাষাব‍্যবহারে আগ্রহী ।
আমাদের রাজ‍্যেও নোয়াখালি ভাষায় কিছু কিছু সাহিত‍্যসৃষ্টি বিচ্ছিন্নভাবে হয়ে আসছে । এই চর্চা আরও নিবিড়ভাবে হওয়া দরকার । বিশেষ করে কথাসাহিত‍্যে এই ভাষাটি ব‍্যবহার করে দক্ষিণ ত্রিপুরার জীবনচিত্রের বাস্তব রূপ দেওয়া যায় । শুধু ভাষা নয় । নোয়াখালিভাষীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও যাপনচিত্রও স্থান পেতে পারে সাহিত‍্যে । ফলে এই জেলার সাহিত‍্যের একটা নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হবে । যা পক্ষান্তরে বাংলা আঞ্চলিক সাহিত‍্যকেই সমৃদ্ধ করবে । 

প্রশ্ন: ত্রিপুরার তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য আপনার বিশেষ পরামর্শ কী হবে ?

উ: ত্রিপুরার তরুণ কবি সাহিত‍্যিকরা প্রচুর লিখছেন এখন । ভার্চুয়ার দুনিয়ার সুবাদে তাঁরাও আজ বিশ্বপথিক । কাজেই সৃষ্টির মানের উত্তরোত্তর উন্নতি না ঘটালে টিঁকে থাকা যাবেনা । তার জন‍্যে লেগে থাকতে হবে । প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে । প্রশংসার চোটে আত্মম্ভরী হলেই বিপদ । সাপলুডোতে অনেক উপরে উঠেও সাপের মাথায় পড়লে যা হয় তা পড়তে হবে । অন‍্যের লেখা পড়তে হবে মনযোগ দিয়ে । নিজের লেখার নিজেই সমালোচক হতে হবে । তাতেই আসবে সিদ্ধি ।

Tuesday, November 9, 2021

দা মি নী

দামিনী

আহা, ভেসে ওঠে অন্তহীন দীপালিকার সারি
তাহাদের কবোষ্ণ আহ্লাদ বিসর্পিল আন্দোলন
হিমেল বায়ুপ্রবাহ নৃত্যের সমিধ সাজিয়ে দিয়ে যায়
অচেনা নর্তকীর সমবেত শরীরী হিল্লোলে যে আবাহন থাকে
তাতে শুধু চোখের স্নান
শরীরের ঘন নির্যাস নেবার বশীকরণের টানে 
ছুটে গেলে, ছুঁতে গেলে এই শৈল্পিক অগ্নিরেখার 
কোমল হিন্দোল স্তব্ধ হিমরাতেও দাবানল হয়ে ওঠে
খান্ডবগ্রাসে খাক করে দেবে  নষ্ট ও কামুক শরীর 

বাহিরে ছন্দহীন শিশিরের অবিরাম পতনের মূর্ছনায়
দামিনীরা জেগে থাকে বুকে আগুনের আবলি নিয়ে

এক আসন্ন ক্রুদ্ধ রাতে তো জেগে উঠবে সমুহ সাহস নিয়ে

আঁধারবিনাশিনী হে

আঁধারবিনাশিনী হে

আজ সন্ধ্যেটা তোমার জন্যেই রেখে দেবো, রাই  !
সূর্যাস্তের পেরিয়ে যাওয়া পশ্চিমম সরোবর থেকে
লোককাব্যের ঘরোয়া বউটি সেজে তুমি যখন
চাটাবাতি হাতে উঠোনের এমাথা থেকে সেমাথা
দ্রুত হাত চালিয়ে যাবে এক একটি তেলসিক্ত
সলতের প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্যে,চক্ষুদানের জন্যে৷
আমি বুক ভরে দেখবো তোমার দীপদানের উচ্ছ্বাস

হাতের প্রদীপের মৃদু আলোয় তোমার আরক্ত মুখ
হাওয়ার ঝাপটায় বুক কাঁপা বাতিটা আলোছায়ার
সিল্যুএট তৈরি করবে তোমার মসৃণ মুখমন্ডলে
আধফোটা তোমার চোখের পাতা, তোমার নাকের
তিলফুল, কপালের ওপর দু একটা দলছুট চুল
কানের দু পাশে ঝুলে পড়া উজ্জ্বল ঝুমকো দুল
মৃত্যুঞ্জয়ী সিঁদুরে ঠোঁটের রঙে নেয়ে উঠে পবিত্র
প্রশান্তিতে বিরল বার্তা বইবে সুখময় গার্হস্থ্য দিনের

আলো জ্বালাতে জ্বালাতে তোমার যে চলনমূর্ছনা
তোমার যে প্রাঙ্গনপরিক্রমা, তা ওই কৃষ্ণকায়া নগ্নিকা
শবারোহীনীর লুকানো বীররসের ছটার মতো ছিটকে
উঠবে আজ এই মায়াসন্ধ্যার আঁধারবিনাশী বন্যায়
আমি সেই বানডাকা জোয়ারে ডুবে যেতে চাই আজ

তোমার ঘোমটার লালপাড়ে ডুবে যাওয়া আবছা মুখে
কোনো বরাভয় মুদ্রা কী লুকিয়ে রেখেছো, সহেলি রাই  !
আমি তাও দেখবো এ সন্ধ্যায় তুমুল তোলপাড় করে হে

সা ক্ষা ৎ কা র

লোক গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধনের মুখোমুখি সম্পাদক বিজন বোস 
--------------------------------

প্রশ্ন 
------- ১ ) আপনার জন্ম কী সাব্রুমেই ? উত্তর যদি না হয়ে থাকে তবে কখন এলেন?  সাব্রুমের আদি ইতিহাস সম্পর্কে যদি কিছু বলেন ...
  উ:--না । বাবার চাকুরিসুত্রে আমরা দীর্ঘদিন সাব্রুমের বাইরে কাটিয়েছি । মাঝে মধ‍্যে গ্রামের বাড়িতে আসতাম বাবার সঙ্গে । একাত্তরের যুদ্ধের সময় কিছুদিন এবং বাবার ছোটোখিল সরকারি ডিসপেনসারিতে বদলির কারণে বাহাত্তর সাল থেকে পাকাপাকিভাবে আছি । সাবরুম এর ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাসের দিকে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২ খ্রি.– ১৮৯৬ খ্রি. ) পুত্র রাধা কিশোর মানিক্য (১৮৯৬ খ্রি.–১৯০৯ খ্রি. ) প্রায় 40 বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন যুবরাজ থাকাকালীন সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন পরিচালনার বিষয়ে তার দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন । রাধা কিশোর মানিক্য হাজার ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পুলিশ ও তহশীল বিভাগকে আলাদা করেন পুলিশ বিভাগকে তহশীল ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় পুলিশ বিভাগকে পৃথক করার পর ত্রিপুরা রাজ্যে অনেকগুলি নতুন নতুন থানা ও তহশীল কাছারি গড়ে তোলা হয় সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রথম পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন সেই সময়ে সাবরুম থানা ও তহশীল কাছারি স্থাপন করা হয় বর্তমানে যেখানে থানার দালানটি রয়েছে তার বেশ কিছুটা দক্ষিনে সামনের দিকে দরজা স্থানীয় পর্যায়ের বেড়া দেওয়া চৌচালা বড় ঘর ছিল পাশে বড়বাবু থাকতেন । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২মার্চ ( ২৮ শে ফাল্গুন ১৩১৮ খ্রি. ) উত্তর ভারত তীর্থ ভ্রমণের সময় কাশী থেকে সারনাথ যাওয়ার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর কাশীরাজের বাড়ি নন্দেশ্বর কুঠিতে রাধা কিশোর মানিক্য শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । রাধাকিশোরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন হাজার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মহাসমারোহে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের রাজ্যভিষেক হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে মার্চ মাসে সাব্রুম বিভাগ খোলা হয় । এর আগে এই বিভাগের কাজকর্ম উদয়পুর ওপরে বিলোনিয়া থেকে পরিচালিত হতো । ১৯১০ সালে সাবরুম বিভাগ খোলা হলেও যথেষ্ট পরিকাঠামোর অভাব ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিলোনিয়া থেকে সাব্রুম এর প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো হতো । বিলোনিয়ার হাকিমই এই বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন । মাঝেমধ্যে বিভাগ পরিদর্শনে আসতেন । প্রথমদিকে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ঠাকুর বংশের বিশিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিরা সাব্রুম এর দায়িত্ব পালন করতেন । মহকুমা শাসককে সেকালে হাকিম বলা হত । এই থানার একটু দক্ষিণে অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় সেখানেই ছিল মহকুমা শাসকের কার্যালয় । আর একটু এগোলে পূর্বদিকে বর্তমান এসপি অফিসের পাশেই ছিল জেলখানা । চল্লিশের দশকের পর থেকে ক্রমান্বয়ে সাব্রুমে স্থায়ী হাকিম বা এসডিওরা আসতে থাকেন ।
২) বছর পঞ্চাশেক আগেও ছোটখিলের রাণীরবাজার ছিল সাব্রুমের প্রধান বাজার । এই সম্পর্কে এবং সাব্রুমের অনান্য বড় বাজারগুলির ব্যবসা বাণিজ্য তথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সাব্রুমের ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে চাই...
উ: -- বছর পঞ্চাশ নয় । তারও বহু আগে রাজন‍্য আমল থেকে শুরু করে বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক পর্যন্ত জমজমাট ব‍্যবসাকেন্দ্র ছিল ছোটোখিলের রানিগঞ্জ বাজার । মূলত রাজন্য আমলে রানিগঞ্জ বাজার সন্নিহিত বাগানবাড়িতে রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজপুরুষেরা আসতেন । সেই থেকে রানিরবাজার একটা জমজমাট গঞ্জে পরিণত হয় । রাজারা আখাউড়া থেকে রেলযোগে মুহুরীগঞ্জ এসে তারপর নৌপথে ফেনী নদীর উজান বেয়ে এই রানিগঞ্জ বাজার ঘাটে এসে নামতেন । একসময় এ বাজারে বাঙালি ও অবাঙালি মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের দোকানপাট ছিল । তেলের ঘানি ছিল । বড়ো বড়ো কাপড়ের দোকান ছিল । দামি মশলাপাতি সহ বড়ো বড়ো বাজেমালের দোকানও ছিল । সে সময়ে বিলোনিয়ার মাইছরা বিমান ঘাঁটি থেকে ঘোড়ার পিঠে করে পণ‍্য আনা হত এই রানিগঞ্জ বাজারে । ভারত ভুক্তির পর সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে এ বাজারটি । অবশ্য সবটাই ছিল কালোবাজারি ব্যবস্থা । এসময় ব্যবসা করে এই বাজারের অনেক ব্যবসায়ী যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠেন তেমনি একেবারে কপর্দকশূন্য হয়ে যান অনেক ব্যবসায়ী । ষাটের দশকের শুরুতে এক বিধংসী অগ্নিকাণ্ডে এই বাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায় । এছাড়া সে সময়ে রানিগঞ্জ বাজারে ছিল এক বিশাল গোরুর হাট । পরবর্তী সময়ে সীমান্ত সংলগ্ন বাজার হওয়ার ফলে এখান থেকে বিক্রীত গরু ওপারে পাচার হয়ে যেত । ফলে স্থানীয়ভাবে  গোসম্পদের ঘাটতি দেখা দেয় । এদিকে গোরু চুরিও বেড়ে যায় খুব । তখন সরকার আইন করে রানিগঞ্জ বাজারের গোহাটটি বন্ধ করে দেন । মূলত অগ্নিকাণ্ড, গরুর বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কালোবাজারে এপার-ওপার পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার উপর সরকারি নজরদারি বেড়ে যাওয়ার ফলে রানীগঞ্জ বাজারের রমরমা ধীরে ধীরে পড়তির মুখে এসে যায় । ফলে অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী সাবরুম বাজারে এসে তাদের ব্যবসা শুরু করেন । মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা আগরতলা চলে যান ।

৩)  আপনার স্কুল জীবন সম্পর্কে  ...( এটার উত্তর দিতে গিয়ে যদি সাব্রুম না আসে তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও হবে )
উ:--আমার স্কুলস্তরের পড়াশুনো সাব্রুমে নয় । তবে বিশেষ অনুমতি নিয়ে উনিশ শো বাহাত্তর সালে পুজোর ছুটির পর কদিন সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে স্কুলজীবনের শেষসময়টা অলিখিতভাবে ক্লাশ করেছি । এবং সেন্টার চেঞ্জ করে কমলপুর থেকে সাব্রুম সেন্টারে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসেছি ।

৪) মানুষের জীবনে শিল্প সংস্কৃতি এক বড় অবদান রাখে ।  সাব্রুম মহকুমার সংস্কৃতি চর্চায় ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা সেকাল থেকে একাল -- কিছু বলুন 
উ:-- সাব্রুমের বৈশাখী মেলার একটা পুরোনো ঐতিহ‍্য রয়েছে । স্বাধীনতার পূর্বে সাবরুম শহরের মানুষজন ফেনী নদী পেরিয়ে ওপারের রামগড় বাজারে বাজার হাট করতেন । সে সময় ওই অঞ্চলে ছিল ব্রিটিশ সরকারের অধীন । স্বাধীনতা লাভের শুরুতে ত্রিপুরা রাজন‍্যশাসিত স্বাধীন রাজ্য ছিল । সাব্রুম সন্নিহিত ফেনী নদীর ওপারে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় । ফলে ওপারের রামগড়ে পাকিস্তানের শাসকেরা কড়াকড়ি শুরু করে দেন । ফলে এপারের মানুষজন ওপারে ততটা যাওয়া-আসা করতে পারতেন না । সেখানকার নাগরিকরাও এপারের মানুষ জনকে অনুরোধ করেন যাতে তারা আর ওপারে না আসেন কারণ পাকিস্তানী পুলিশ মিলিটারির দ্বার তাঁরা নাজেহাল ও অপমানিত হলে স্থানীয় মানুষজন তাদের সাহায্য করতে পারবেন না । এরপর থেকেই রামগড়ের সঙ্গে সাবরুম এর যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । স্থানীয় মানুষও সাব্রুমে বাজার প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেন । ১৯৪৮ সালের ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ভুক্ত হয় এবং প্রায় সেই সমযয়েই সাবরুম বাজার প্রতিষ্ঠিত হয় । তারপরেই সাব্রুম এর প্রবীণ নাগরিক গণ সাবরুম বৈশাখী মেলার আয়োজন করেন । প্রথমে বৈশাখ মাসে বুদ্ধপূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হত । ঊনিশ শো পঞ্চাশ সাল থেকে এই মেলায় সব অংশের জনগণ সামিল হন । সেসময়ে পুরো বৈশাখমাসব‍্যাপী এই মেলা হত । এবং এই সময়ে শনি-মঙ্গলবারের নির্ধারিত বাজারটিও বর্তমান মেলারমাঠে বসত।

৫) সাব্রুম মহকুমা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা । সেখানকার রাষ্ট্রীয় জীবনের সুঃখ দুঃখ ত্রিপুরাবাসীকে আন্দোলিত করে । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন 
উ:-- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে ।এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড় বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সাঁকো দিয়ে এপারর থেকে যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন রঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে । ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনীর ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । ৮ ডিসেম্বর রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

৬) খেলাধুলা ও শরীরচর্চা  রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ।  খেলাধূলায়   রাজ্যের সঙ্গে সাব্রুমের  তুল্যমূল্য আলোচনা শুনতে চাই 
উ:-- সাব্রুম খেলাধূলায়ও বিশেষ স্থান দখল করে আছে । অ্যাথলেটিকস, ফুটবল কাবাডি, খো খো, সাঁতার, ব‍্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল এবং ক্রিকেটে বহু জাতীয় স্তরের কৃতী খেলোয়াড় বেরিয়েছে সাব্রুম থেকে ।
৭)  সাহিত‍্যচর্চায় সাব্রুম কতটা এগিয়ে আসতে পেরেছে বলে আপনার মনে হয় ।  উ:--সাহিত‍্যক্ষেত্রে সাব্রুমের উপস্থিতি বেশ প্রাচীন । ছয়ের দশক থেকে এখানে লাখালেখি করে আসছেন কৃষ্ণধন নাথ, ড.রঞ্জিত দে প্রমুখ । তাঁদের পরপরই আসেন ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, হরিহর দেবনাথ, প্রণব মজুমদার, নেপাল সেন, দীপক ( স্বপন ) দাস, প্রবীর বসাক ,অশোকানন্দ রায়বর্ধন । ধীরে ধীরে নতুনরা আসতে শুরু করেন । তাঁদের মধ‍্যে সমরেন্দ্রনাথ দাস, রতন চক্রবর্তী, বিনয় শীল, ব্রজেন্দ্র বিশ্বাস, সাচীরাম মানিক, সঞ্জীব দে, বিজন বোস, জয় দেবনাথ, রূপন মজুমদার, অভিজিৎ দে, চয়ন ধর, সংগীতা শীল, পূর্ণিমা বৈদ‍্য প্রমুখরা । নতুনদের অনেকেই ইতোমধ‍্যে বৃহত্তর পাঠকমহলের নজর কাড়তে পেরেছেন । প্রবীনদের অনেকেই রাজ‍্য ও রাজ‍্যের বাইরে সুপরিচিত ।

প্র তী ক্ষা

প্রতীক্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কোমল আকাশ ভরে যায় ভাটের বন্দনাগানে ।
নির্জন চিলেকোঠা জেগে ওঠে নিঃসাড় ঘুম ভেঙে
তোমার পুজোর ফুলদূর্বা পবিত্র সাজিতে রেখে যাই
আমি ব‍্যস্ত দিনের উদ‍্যমঘোরে ভুলিনা তোমার কথা
কিন্তু ডেকে নেবার মতো সময় বের করতে পারিনা ।
গড়িয়ে পড়া কাজের সারি আমার চারধারে
ইটের বৃত্ত তৈরি করে ।
তুমি সবটাই দেখো সেই চিলেকোঠায় বসে
ঘুলঘুলি পেরিয়ে এক চিলতে হাওয়া তোমাকে সঙ্গ দেয় ।
তুমি দেখো আমার দৈনিক ঘানিটানা জীবন 
আমার আকাশের মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর তোমার জানা আছে

আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকি পাপে কিংবা পদ্মে
ঘোরলাগা দিনরাত শুধু জড়িয়ে থাকা স্থাবরে জঙ্গমে
ভুলে যাই তোমাকে কথা দিয়ে প্রতীক্ষায় রেখেছি ।
তুমি তো সহনশীল ওংকার । তাই আমার প্রতীক্ষায় 
বসে আছো অনন্তের মাঠে ।

প্ল‍্যা ট ফ র্ম

প্ল‍্যাটফর্ম

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ট্রেন চলে গেলে শূন‍্য প্ল‍্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকি একা ।
দুধারে রাবার বন । মাঝখানে মরানদীর মতো 
লুঙ্গার দীর্ঘ শরীর নিয়ে ঘুমন্ত রেললাইন ।
একপাশে সারাটা স্টেশনচত্বর দাঁড়িয়ে পাহারায় আছে ।
মাঝে মাঝে জেগে ওঠে রেললাইন হুইসেলের শব্দে
তার বুকের ওপর দিয়ে গড়ায় ধাতব অজগর ।
পাশের শহরে এখন এটাই আধুনিকতা ।  কিছুক্ষণের জন‍্যে চঞ্চল জীবন ।
তারপর আবার উত্তরের বাতাস দাপট শুরু করে

শীত এলেই রাবারের পাতাগুলো হারিয়ে যায় অনন্তে
কতোকালের ঘরদোর, খুনসুটি সংসার আর
ধীরে বড়ো হওয়া সন্তান নতুন স্বপ্নে উড়ে  যায় ।
শেকড় তাদের টানেনা । নতুন নিবাস কিংবা বাসা বাঁধে 
আকাশের কাছাকাছি । আরো উপরের কোঠায় ।

পরিচিত নিসর্গের বিন‍্যাস নেই আর আগের মতো ।
তাই সব সন্তানেরা দুধভাত ফেলে কর্পোরেট দানাপানির
খোঁজে পাড়ি দেয় সেইসব ধাতব পাতের পথে ।
চলে যাওয়া ট্রেনের গার্ডের হাতের সবুজ পতাকা
হাওয়ায় ওড়ে আর এক দীর্ঘ স্বপ্ন বদল হয় নতুন উড়ানে ।
ট্রেন চলে গেলে শূন‍্য প্ল‍্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকি একা ।

ঝ ড়

ঝড়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

যে হাওয়া বয়ে যায় তোমার শরীর বেয়ে
তা যেন ঝড় হয়ে যায় । সেই দামাল সময়কালে 
আমি বেরিয়ে পড়ব বাইরের দুনিয়ায় ।
চাইছি একটা ঝড় উঠুক । সব উপড়ে ফেলার ঝড় ।

সব কিছু ভেঙে পড়ছে । আশা ও স্বপ্ন সরে যাচ্ছে
দূরের কোনো দ্বীপে । এখানে ভাঙচুর হয়ে পড়ে আছে
পাখির ডানা, নীড় । প্রভাতের সূর্যের রাজমহল 
ঘিরে কালো সেপাই । রাঙা আলো ঢেকে
 যায় আকস্মিক দৌরাত্ম‍্যে । তাই অসহায় আমি 
চাইছি প্রবল একটা ঝড় উঠুক ।  সেই ঝোড়ো তান্ডবে
তোমরা বেরিয়ে পড়বে সব বাধা ঠেলে ।

আমদের মিলিত হাত ধরাধরি আর
 সমবেত কোরাস তীব্র গর্জনে বেরিয়ে পড়বে
উত্তাল হাওয়ায় । ঝড়, ঝড়ই তো বয়ে আনবে
আসন্ন শান্তির সংকেত । চলো বেরিয়ে পড়ি ।
ঝড়ের বন্দনাগানই হোক আমাদের আগামী সংকেত ।

Saturday, November 6, 2021

সৌমিত বসু ও পৌলমী সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ওয়েবজিন 'জলপাইদ্বীপের আলো'-র চাঁদ বিষয়ক দ্বিতীয় সংখ‍্যা গত ৬.১১.২০২১ সন্ধ‍্যা ৭-০০টায় ভার্চুয়ালি আমি উদ্বোধন ঘোষণা করি । এ সংখ‍্যায় আমার একটি মুক্তগদ‍্য 'চাঁদমঙ্গল' স্থান পেয়েছে । রচনাটি নিচে দেওয়া হল :–

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

Friday, November 5, 2021

ই রে জা র

এভাবেই মুছে যাই, মুছে যেতে হয়
যারা ভালোবাসে আর কাছে টেনে নেয়
তাদেরই কেউ কেউ মুছে ফেলে আমাকে 
আর অন্য যারা ভাসমান দোনামনায় আছে
তারাও অবসরবিনোদনের কালে পাঁজিপুথি দেখে
খুঁজছে মাহেন্দ্র কিংবা অমৃতযোগ
কখন ছেঁটে ফেলা যায় আমাকে

এইসব মোছামুছি আর ঘষাঘষির ফলে
আমার শরীরে এখন চুম্বনচিহ্নের মতো
শুধু ফ্যাকাশে ইরেজারের ঘষটানো দাগ

Tuesday, November 2, 2021

আ র শি ন গ র

বাড়ির পাশে আরশিনগরের কথা
বাউল বলেছেন বলেই
উঁকি ঝুকি দিই পাশের উঠোনে

ভাবি সীমান্তহাট খুললেই
খরচপাতি করে পাড়ের কড়ি নিতে পারি
আবার মনের ঝরোখাটাকে হাট করে খুলে দিতে পারি

তখন আর সীমানার কাঁটাতার থাকবে না

Monday, November 1, 2021

চোদ্দোপিদিম

যমআঁধারে আটকে আছেন পিতৃগণ
আলোর প্লাবনে না নিয়ে এলে
কোথায় পাবো চর্যাপদ
তাঁদের কাছেই তো আমাদের জিয়নকাঠি

এসো না এবার
পূর্বজদের ছায়াপথে চোদ্দোপিদিম জ্বালাই

Sunday, October 31, 2021

মি। স। ক। ল

আলোর উল্লাস উদার হয়ে জেগে উঠলেই
তোমাকে কেবলই মনে পড়ে

ভাবছি ভার্চুয়াল ফোঁটার জন্যে
তোমাকে মিসকল দেবো

Thursday, October 28, 2021

কালো মেয়ে

কালো মেয়ে
---------------------------------
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
**********************
আলোরাতের কালো মেয়ে লো  হৈমন্তী ঘ্রাণ তোর গায়ে 
কুয়াশার দীঘল রুমালে তুই  রেখেছিস জড়ায়ে

 লিপিদাগ শীতের আমন্ত্রণের  বিরল টেরাকোটা
লিখেছিস অমোঘ আখরে কালোবরণ ফোঁটা

যতোই জানি তোর ঠিকানা এই যে আঁধারমায়াগলি 
ততোবারই ভুলে যাই আমার কষ্ট গেরস্থালি

  এত কাল অবলীলায় মেখে নিলি তুই অঙ্গে
 তোর আলো বিলিয়ে দিলি তোর রূপটানেরই সঙ্গে ৷

চাঁ দ ম ঙ্গ ল

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

Monday, October 25, 2021

নির্বিকল্প জাগরণের কবি পীযুষ রাউত

নির্বিকল্প জাগরণের কবি পীযুষ রাউত 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশ ও বহির্বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে । এই সংকট আমাদের চিন্তা চেতনা অস্তিত্ব এবং সৃষ্টিতেও গভীর ছাপ পড়তে বাধ্য । এই সময়ে যে সংকট, যে যন্ত্রণা তা কবি অনুভব করেন তাঁর শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে । প্রত্যেক কবি তাঁর অন্তর্গত হৃদয়ের ক্ষত এবং প্রকাশ ভঙ্গিমায় সমকালের প্রতিফলন ঘটান । কালের গতির ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে কবি কবিতায় ব্যক্তিগত ভাবনা, মেধার ক্ষরণ এবং শিল্প সত্তাকে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিশীল এবং হৃদয় সংবেদী বক্তব্য প্রকাশ্যে তৎপর থাকেন । তাঁর মগ্ন চৈতন্যে আলোড়িত বিশ্বসংসারের ক্রমপরিণতি, তাঁর যাপন আর উপলব্ধির মধ্য থেকে উঠে আছে নিবিড় অভিজ্ঞতা । তাঁর ভাষার চলনে  জীবনের দিগন্তব‍্যাপী সঞ্চরণশীল শব্দমধুকর বয়ে যায় স্বচ্ছ নিসর্গলাবণ‍্য নিয়ে । কবিতার বয়নে চিত্রিত হয় স্বতস্ফুর্ত লিরিকলিপি । কবিতার ভাষার আশ্রয়ে কবি সংকেতনিগূঢ় ভাষায় পাঠককে উপহার দেন আত্ম-অভিজ্ঞতার বাচনিক রূপান্তর । কবির ব‍্যক্তিচেতনার পারাপারহীন বোধবিন্দুর অস্থিরতা ও সংশয়, বিপন্নতা ও দ্বন্দ্ব বিশুদ্ধকথায় প্রকাশিত হয় । চারদিকের শংকা ও অনিশ্চয়তার মধ‍্যেই কবি তাঁর সৃষ্টির সংবেদনা অর্জন করেন ।
কবিতা পাঠকের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটা পাঠক বিশেষে তারতম্য ঘটে । এই প্রজন্মের পাঠক যেমন এক অসহ্য দহনকালের প্রতিনিধি তেমনি কবির কাছেও জীবনদাহ‍্য সমস্ত প্রকরণ, সমস্ত জটিল শব্দায়ণ অন্ধকার ও আলোকের সমান্তরাল উপলব্ধি যেন বিদগ্ধবাচনিক অনুভবের ও উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পাঠকের সামনে তার স্বরূপ উপলব্ধ হয় । কবি তার সৃষ্টিতেও পাঠকের মননভান্ডে একটা সম্পর্ক তৈরি করেন । প্রাকৃতজীবনের স্পন্দন ও তার প্রাকরণিক প্রকাশে জীবনের সঙ্গে নিবিড় সংযোগসূত্র রচনা করে । এই ফল্গুবাহী সূত্রই পাঠকের অন্তর্লীন কাম‍্য । অন্বয়ের বীক্ষণ । কবির এই শিল্পবৈদগ্ধ‍্য পাঠকজনকে গাঢ়সম্পৃক্ত করে ।

পঞ্চাশের দশকে বাংলাকবিতায় জীবনানন্দের অনুষঙ্গ যেভাবে ছায়াবিস্তার করেছিল তা ক্রমশ  স্বাবলম্বিতা অর্জনের দিকে এগিয়ে যায় বৈদগ্ধ‍্য, নাগরিক পরিশীলনে, বিমূর্ত ভাববিন‍্যাসে, অনিকেত আধুনিকতায় ও আন্তর্জাতিক  সূত্রসন্ধানে । এই দৃষ্টিভঙ্গি  ক্রমে স্বতন্ত্র বিশ্ববীক্ষণে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়না । ষাটের শুরুতেই সৃষ্ট নানা কবিতা  আন্দোলন বাংলাকবিতার  নতুন সম্ভাবনার অভিযাত্রা । কিন্তু কেবলমাত্র ধ্বংস, বিনাশ, আত্মপীড়ন, ক্ষুৎকাতর ও জান্তববৃত্তির প্রকাশই কবিতার একমাত্র পরিচয় নয় । এই আত্মবিস্মৃতি ও আত্মপ্রতয়ের ঘূর্ণ‍্যাবর্তের হুল্লোড়ের মধ‍্যেই অস্থির অন্বেষণে উঠে আসে আর এক প্রত‍্যয়ী চেতনা । নবনির্ণিত এই চেতনায় কবিতার ভাববীজে যুক্ত হল আটপৌরে ও অভ‍্যস্ত শব্দবন্ধের উপল প্রবাহ ।

ষাটের দশকে 'অতন্দ্র' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পূর্বোত্তরের বরাক উপত‍্যকায় বাংলাকবিতার চর্চায় শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, উদয়ন ঘোষ, বিমল চৌধুরী, করুণাসিন্ধু দে,ত্রিদিবরঞ্জন মালাকার, অতীন দাশ,দীনেশলাল রায়, কালীকুসুম চৌধুরী, ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ, জিতেন নাগ, রুচিরা শ‍্যাম, উমা ভট্টাচার্য্য, শান্তনু ঘোষ,রণজিৎ দাশ, মনোতোষ চক্রবর্তী, 'সাহিত‍্য'তে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য্য প্রমুখ জীবনবৃত্তের প্রাকরণিক প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন । সেসময়ের 'অতন্দ্র' পত্রিকার মাধ‍্যমে প্রথম পরিচিতি পান কবি পীযুষ রাউত । ফলে বরাক উপত‍্যকার কবিতাভূমির সমৃদ্ধ সৃষ্টিভান্ডার তাঁকে করেছিল পরিপুষ্ট ।

উত্তর-পূর্ব ভারতের শক্তিমান কবি ও প্রাবন্ধিক বিজিতৎকুমার ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধ লেখেন, 'পীযূষ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫৯ সালে কাছাড় থেকে কৈলাশহর গিয়েছিলেন । কাছাড়ের কবি করুণাসিন্ধুর বন্ধু সিতাংশু পাল ছিলেন পীযুষেরও বন্ধু । ওখানেই তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতার সঙ্গে সম্পর্কের শুরু ।১৯৬৩তে কৈলাশহর থেকে পীযূষ যখন ত্রিপুরার প্রথম কবিতার কাগজ 'জোনাকি' প্রকাশ করেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন কবি মানিক চক্রবর্তী, প্রদীপ বিকাশ রায় এবং শিল্পী-কবি বিমল দেবও কৈলশহরের এক দল শক্তিশালী কবি গোষ্ঠীর কাগজ ছিল 'জোনাকি' ( 'রামনাথ বিশ্বাস স্মারক বক্তৃতা'–উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা কবিতা/ বিজিত কুমার ভট্টাচার্য ) ।

ষাটের দশক থেকে কবি পীযূষ রাউত বাংলা কাব্যজগতে তার যে অভিযাত্রা শুরু করেন,আজও তিনি বাংলা কাব্যে সমানভাবে এবং অক্লান্তভাবে পরিক্রমা করে চলেছেন । ইতোমধ্যে তাঁর প্রায় কুড়িটির অধিক কাব্যগ্রন্থ ও অন‍্যান‍্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।  জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও অনুভবের যাত্রাপথে প্রতিনিয়ত বিরামহীন অতিক্রম করে চলেছেন তিনি । প্রত‍্যহিক জীবন থেকে আহৃত গভীর বিশ্বাস এবং দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর এক একটি কাব্যগ্রন্থে । তাঁর কবিতা ইতোমধ্যে অসংখ্য পাঠকের বিমুগ্ধ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে ।  তাঁর কাব্যে তিনি কখনো মূর্ত থেকে বিমুর্ত, কখনো সময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, কখনো অভিজ্ঞতার নির্যাসের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন । তাঁর অক্লান্ত আত্মপর্যটনে এক স্বতন্ত্র কবিসত্তা নিয়ে বাংলা কাব্যে তিনি বিরাজ করছেন । ১৯৫৮ সালে ছোটগল্প দিয়ে তাঁর লেখালেখি শুরু । তারপর তিনি একের পর এক কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করে চলেছেন । ত্রিপুরার প্রথম কবিতার কাগজ 'জোনাকি' পীযূষ রাউত শুরু করেছিলেন ষাটের দশকের সূচনায় তারপর তিনি ছোটগল্পের কাগজ 'স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন' সম্পাদনা করেন । তাঁর সম্পাদিত শেষ কাগজ 'অরণ্যে আমরা' । কবি পীযূষ রাউত প্রতিদিন কবিতা রচনা করেন এবং কবিতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত তার বসবাস ।
একজন যথার্থ কবি তাঁর কবিতায় সর্বদা একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষা করে চলেন । একজন মৌলিক কবি তাঁর কবিতায় শুধুমাত্র নিজস্ব পরিচিতি রক্ষা করেন না । তিনি কবিতাকে তিল তিল করে রচনা করে তার নিজস্ব কাব্য ভুবন গড়ে তোলেন । যে কাব্য ভুবন অন্য কারো সঙ্গে মিশ খায় না । দেখা যায় যে একজন শক্তিশালী কবি তার পূর্বজ কোন কবির প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত হন  । কিন্তু ধীরে ধীরে সে কবি তাঁর একটা নিজস্ব কাব্যভুবন গড়ে তুলতে সক্ষম হন । এক সময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যভুবন থেকে বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব কাব্যমানস ভুবন রচনা করেছিলেন । আবার রবীন্দ্রনাথের কালেই নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে এক স্বকীয় ভুবন গড়ে তোলেন । রবীন্দ্রসমকালীন রবীন্দ্রবলয় ভেঙে বেরিয়ে আসেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ । পীযূষ রাউত ও তার সমকালে শক্তি-সুনীল, উত্তর-পূর্বের শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, করুণা সিন্ধু দে প্রমুখদের যে কাব্য বলয় তা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন । কবি প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙছেন এবং গড়ছেন।  তাই তাঁ দ্বিধাহীন উচ্চারণ– 'তাহলে পীযূষ রাউত তিন মাস এক বছর অন্তর অন্তর/ তুমি পিনকোড বদলাচ্ছ/ বদলাচ্ছ মোবাইল সিমও ।/ এটা অবশ্য তোমার বহুবছরের শখ ।এটা তোমার/  রক্তবাহিত অভ্যাস গৃহস্থের চোখে/ বদ অভ্যাস।/ হতে পারে এটা তোমার ভবিতব্য ।'( যাযাবর ) কবি পীযুষ রাউতকে আজও আমরা সমানভাবে এই সময়ের কাব্যভুবনের একজন পরিচিত স্বতন্ত্র মেধা হিসেবে দেখছি । তাঁর স্বকীয়তা, তাঁর স্বাতন্ত্র‍্য বিষয়ে তিনি নিজেই উচ্চকিত–' আমাদের সম্মিলিত চোখে মৃত মানুষের অভিব্যক্তি/ আমাদের কন্ঠে পৃথিবীর গভীরতা নির্জনতা/ কর্ণকুহরে শীতরাত্রির দীর্ঘশ্বাস/ অনুভূত এই অপমৃত্যু শুধু কি আমার?/ এ আমাদের সম্মিলিত বোধ / বহুজনের অভিশপ্ত প্রাত্যহিক/  বহুজনের ম্লান দিনলিপি/  তবু নৈসর্গিক রীতি মেনে এখনো সুর্যোদয় প্রতিদিন....'(  তবুও ) ।

জীবন অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে কবি তার প্রতিফলন ঘটান তাঁর কবিতায় । তাঁর শব্দে, তাঁর মনের ভাবকে তাঁর ব্যক্তিজীবনের পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী থেকে তাঁর যে অভিজ্ঞতা অর্জন সেগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অত্যন্ত সাবলীল শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তোলেন তাঁর কবিতার প্রাণ । তাঁর মানসস্তরে কবিতা দারুণভাবে এক অবিভাজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলে। তিনি নিজেকে নিয়ে প্রতিমুহূর্তে বিশ্লেষণ করেন । জীবনঅনুভূতিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়েও শব্দরূপ প্রকাশ করেন –১.
' আমার তুচ্ছ স্বপ্নগুলি লৌকিক নেশার মত আমাকে/  সর্বক্ষণ পেয়ে বসে; এই ধরুন বাড়ি ফেরবার মুখে/ এখন রাত বারোটায়! মনে পড়ে/ সাদা শ্বেত পাথরের মতো সেই ইস্কুলবাড়ি,/  আমার সমস্ত দুপুরের চিন্তাভাবনা দূর হলে/  শহরের উপকণ্ঠে সূর্যাস্ত সময়ের শীতল কোনো মন্দাক্রান্তা মাঠ,/ অনুর্দ্ধ তিরিশের  কোন কোন যুবতীর অনুষ্টুপ মুখ/  আমার চোখের উপর শেষ স্ট্রাম এখনো অনেক দূর' । ( লৌকিক আশ্রয় ) । ২. ' বুকের অসুখ, বেশকিছু কাঁচাপাকা চুল ।/ ভাদ্র রোদে ধাঁ ধা করছে বালি । যতদূর দৃষ্টি যায়/ শুধু বালি আর বালি ।/ বালিতে বন্ধ্যা নারী  তার গোপন আছে ।/  তির তির দুঃখ আছে মনে।/ সজ্ঞানে অস্বীকার করি তাকে/ অভিনয় এক নিদারুন শিল্প হয়ে/  চৈতন্য দিয়েছে অন্ধকার মেঘ/  অচিরেই একদিন/ বেদুইন সরদারের পাথর রুক্ষতা অবয়বে নিয়ে/  মুখোমুখি হব শত্রুর ।' ( জন্মজুয়াড়ী ) কবির আত্মমুখী এই যে পর্যালোচনা, এই যে জীবনপরম্পরার দহন তা তো বিশ্বরূপেরই বাস্তব রূপের প্রকাশ । যা তিনি নিজের  অবয়বের ক্রমপরিণতির প্রতীকী নির্ণয় করেছেন । এ তো প্রতিদিনের বিশ্বরূপের পরিবর্তনের গোপন কারুকৃতি ।

কবিতার প্রাণ হলো কবির মনোজগৎ । কবির মনের ভাব ও তার বিভিন্ন মনোজাগতিক বিষয়কে অনুভব করে কবিতা গড়ে ওঠে । সুনির্বাচিত শব্দের বিন্যাস সার্থক কবিতাকে সৃষ্টি করে সুন্দর বাচনিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কবিতাও সুন্দর হয়ে ওঠে । 'জীবন, এ তুই কেমনতর হতচ্ছাড়া চরিত্র ।/ কোন কিছুতেই তোর ধৈর্য নেই । কোনো কিছুতেই আসক্তি/ না নারী না সুরা/ না কোন সৃষ্টিকর্ম না কোনো/ ভালো লাগার নদী ও স্বদেশ । (হতচ্ছাড়া এক চরিত্র ) । শব্দের এই যে সৌন্দর্য সম্ভার এবং তার আপন বিন্যাস,  কবিতার বৈভব এবং অবয়বকে চিত্তাকর্ষক করে তোলে । আবার কবিতা কখনো কখনো একেবারেই আটপৌরে একেবারেই  প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাসের মত স্বাভাবিক প্রকৃতি নিয়ে স্বভাব সুলভ গতিতে সহজ শব্দ বিন্যাসের মধ্য দিয়ে এক অনাবিল গদ্য শৈলীকে মাধ্যম করে কবি পীযূষ রাউত তার প্রিয় কণ্ঠস্বরকে কবিতায় তুলে ধরেন । তাঁর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য সহজ সরল অনাড়ম্বর শব্দের বাঁধনি । যেখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই । যেখানে কোন আবরণের চাকচিক্য নেই । সহজ সরল অনাবিল গদ্যশৈলী তার কবিতার লক্ষণ । যেমন– ১. ' কিছু লিখতে গেলেই/ আমার অতি প্রিয় ভাঙা চায়ের পেয়ালা কথা,/ আমার চুরি যাওয়া হংকং মেড এভারেডি টর্চের কথা,/ কৈশোরে পঠিত ঠাকুরমার ঝুলি, গোপাল ভাঁড়/ কিংবা আরব্য উপন্যাসের কথা চারিধারে ভিড় করে আসে' । ( পরিদর্শক আমি ) । ২.নবকুমার নই তো,/  সমুদ্রে সকাল দেখে/ বলে উঠব, বাঃ অদ্ভুত সুন্দর/  আশিকির রাহুল নইতো,/ তোমাকে দেখেই নিমেষেই/  ছলকে উঠবে বুক...( নগরবাসী ) ৩.  'যে যাই বলুক/ যাই ভাবুক/ তোর এই অকম্পিত হাতের উপর হাত রাখলে/ পুড়তে থাকে ত্বক/ পুড়তে থাকে বিশ্বাস...(  না ভালোবাসার কয়েকটি লাইন ) ৩. ' একজন প্রবীণ ও একজন প্রবীণার পক্ষে/ দেড় হাজার বর্গফুটের চার কামরার এই ঘর/ বিশাল এক শুনশান প্রান্তর। প্রভূত নির্জনতা আর প্রায় একলা থাকার । এরকম সুযোগ আর উপকরণ দ্বিতীয় কোথায় ?/ আর দুজনের পক্ষে ভালোলাগার ?/ সে যদি হতো দূরের অতীত, স্বীকৃতি মুহূর্তমাত্র/ বিলম্বিত হতো  মোটেই । ( এই ঘর এই বাড়ি )

দেশবিভাগের ফলে কবিকে হারাতে হয় তার পুরনো বাস্তু ভূমি । প্রাচীন ভূগোল, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি । সেই সব হারানো স্মৃতিগুলো স্টালজিক বয়নে বারবার তার কবিতায় ফিরে আসে । 'দেশের বাড়ির সেই কুশিয়ারা নদী কিংবা শারদীয় কাশফুল/ কিংবা সবুজের পটভূমি জুড়ে হলুদ সরষে-ফুল/ কিংবা নারকেল বোঝাই নৌকার মিছিল কিংবা/ কলকাতার গন্ধমাখা মালবাহী স্টিমার কিংবা পাঁচিল-শাসিত/ তিন বিঘা জমির উপর সুবিশাল বাড়ি কিংবা উত্তরকালে/ দেশবিভাগের পর টিলা ও সমতল সমন্বিত চাতলা-ভ‍্যালি...কিংবা ' আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য/ চিরকাল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব । যেমন দেশের বাড়িতে/ নৌকার জন্যে প্রতীক্ষমান মা ও আমি, আমিও ছোট ভাই/ নদীতীরে/ উদ্দাম হওয়ার মধ্যে/ আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য....( আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য ) । আপন বাস্তুভূমির জন‍্যে এই হাহাকার তিনি আজীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন । ' নারকেল কিংবা চাল কিংবা অন্য কোনো পণ্য-বোঝাই/ বিশাল গুমটি নৌকায় সেই কবে ষাট বছর আগে/ দেখেছিলাম নদীমাতৃক জন্মভূমি আমার । তারপর/ এইতো সেদিন, চার দিন চার রাত্রির আকস্মিক দেখা ।/ জন্মভূমি মাত্রেই কারো কারো ক্ষেত্রে স্বদেশ নয় এই যেমন/ হতভাগ্য আমি ।/ তবু একথা সত্য যে,/ সেই সাহেব শাসনের কালে আমার ছেলে বেলায়/ সত্যি সত্যি স্বদেশ ছিল জন্মভূমি আমার।( বাংলাদেশ, কবিতা সফর )। সেই স্বদেশ সম্পর্কে তাঁর অন্তরঙ্গ অনুভূতি ' প্রথম কান্নার দিন/ প্রথম দেখার দিন/ আমার পবিত্র কৈশোরের দিন/ স্বদেশ ছিল সে ।/ এখন পর দেশ, বিদেশ ।/ তবু নাড়ির টান যুগ যুগান্তর/ অতিক্রান্ত, এখনো কোনও কোনও দিন অনুভূত হয় ।/ তাকে খুঁজি/ মানচিত্রে কাঁটাতারে ওপারে, লোকমুখে, কখনোবা/ টিভি চ্যানেলে, খবরের কাগজে, শামসুর রাহমানের কবিতায় । ( বাংলাদেশ কবিতা সফর )

খন্ডিত স্বদেশ নিয়েও কবি ক্ষুব্ধ । সংক্ষোভের অস্থিরতার কবি স্বধীনতাকে দেখেন তীব্র শ্লেষে অঙ্গারে । স্বপ্নে আর বাস্তবে যে ফারাক তা ধরা পড়ে তাঁর চেতনার আরশিতে । ' বিমল জানিস তো নেহেরু শান্তির জন্য কবুতর উড়াতেন ।/ ইদানিং ওইসব কবুতর কঙ্কাল সম্বল করে যাদুঘরে, কাচের টেবিলে সুদূর অতীত । ম্লান গন্ধের মধ্যে সুদূর অতীত' । ( কবুতর ) । ' সাতচল্লিশের পনরো আগস্ট গান্ধীজী বলেছিলেন–/ আজ আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে । বোঝেনি । কেউ/ বোঝেনি ।/ স্বাধীনতার ঘোড়া কিন্তু অনুভব সচেতনায় বুঝেছিল সব । ( স্বাধীনতার ঘোড়া ) এই পঞ্চক স্বাধীনতায় অনবরত প্রতারিত হতে হতে মানুষ যেন প্রতিবাদের ভাষাও আজ হারিয়ে ফেলছে । কবি সে কথাই বলছেন তাঁর কবিতায়– 'খা খা সব গিলে খা–  এই বলেই /বক্তা নিমেষের মধ্যেই/ আত্মগোপন করলো ইঁদুরের গর্তে ।/একজন চরিত্রহীন মাস্টারমশাই বললেন– দেখলে তো,/ এই আমাদের চরিত্র । বদলে গ‍্যাছে প্রতিবাদের ভাষা এবং/ এ্যাকশন ।/ রুখে দাঁড়াবার হাত নেই, পা নেই, এই যেমন/ টিম-ইন্ডিয়ার ধোনি । নেই বলেই/ ভোট প্রহসনে সেজেগুজে অংশ নিই ।/ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে/ আগুনের সর্বনাশ দেখি। আগুনের ভাষা আমরা/ আদপেই বুঝি না ( প্রতিবাদ ) । কবি তাঁর কবিতায় অগ্রজ কবিদের প্রভাবকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের অবস্থান সম্বন্ধে স্পষ্টতই বলেছেন –' এই যে বেঁচে থাকা/ বড় তীব্র ভাবে বেঁচে থাকা, আসক্তি-অনাসক্তিকে/ সমগুরুত্ব দিয়ে এই যে প্রতিদিন/ শব্দ শব্দ খেলা,/ এই যে শুধু কবিতার জন্য/ অমরত্ব তাচ্ছিল্য করা–এ শুধু তোমাকেই মানায় ।/ শক্তির মেঘ মেঘ রহস্য থেকে দূরে,/ বহুদূরে তোমার ভালবাসায় নিরহংকার সারল্যকে স্যালুট ।/ বলেছ–হে তরুণ, আমাকে দ‍্যাখো । আমারই হাতে/ সমবেত হাত হে সৈনিক ।/ এভাবেই বেঁচে থাকা, এভাবেই আমার/ প্রত্যেকটি দিন । এই আমার নির্বিকল্প আমি । আমি জেগে আছি । দারুণ দারুণ ভাবে বেঁচে আছি / দেশে দেশান্তরে, সর্বত্র । (সুনীল কথা ) । কবি যাপনের অফুরান শক্তি লাভ করেন কবিতার সময়চিহ্নিত অবস্থান থেকেই । স্বচ্ছতায় স্পষ্ট তাঁর  কথাবীজ । তিনি তাই বলেন -' বারংবার জন্মজুয়াড়ীর মতো মেতে উঠি আত্মঘাতী বিনষ্ট খেলায়' । এ যেন 'প্রভু নষ্ট হয়ে যাই'র মতোই সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি ।
কবি পীযুষ আজীবন মানুষের কথাই বলে বেড়িয়েছেন তাঁর আত্মজৈবনিক উপাচারের অঞ্জলিতে । তাঁর নাতনিকে নিয়ে লেখা 'তোর্ষা সিরিজ'ও সংবেদনশীল মানবিকতায় উত্তীর্ণ । জীবন-আভিজ্ঞান ও বোধের অভিজ্ঞতার কবিতার অন্তরে বাজে মানবিকতার সুর । শিশু তোর্ষা এখানে মানবিকতার প্রতীক । ' তোর্ষা, এখন রাত এগারোটা ।/ তোর হরিণ হরিণ চক্ষুদুটি কপাট বন্ধ । ঘুমোচ্ছিস ?নাকি বুড়োবন্ধু কাছে নেই বলে ঘুম আর না-ঘুমের/ সীমান্তে পৌঁছে অতীত-কাতর ? ( তোর্ষা-৮ )

আমাদের কাব্য ভুবনের 'দ্বাদশ অশ্বারোহী'র এক অশ্বারোহী পীযূষ রাউত । আরেকজন অগ্রণী অশ্বারোহী স্বপন সেনগুপ্ত পীযূষ সম্বন্ধে বলেন– 'পীযুষের লেখার বিষয় চলমান সময়, মানুষ ও সমাজ । বহমান সমাজ ওসময়ের  প্রতিটি দাগ একটু নিবিড় ভাবে তাকালে তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় । যত বয়স বাড়ছে তত পরিণত গূঢ় কণ্ঠস্বর বেজে উঠছে তার কবিতায় । কখনও মনে হয় আর্দ্র, কখনো স্থিতধী । আবার কখনো মনে হয় প্রচন্ড অতীতের দিকে ফিরে তাকানো । পীযুষের ভালোলাগা এবং মন্দ লাগা ব্যাপারটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, প্রচন্ড গতিশীল । বরাক উপত্যকার প্রতি তার নিবিড় চলা টান দীর্ঘকালের । ওখানকার খন্ড চিত্র, চিত্রকল্প, ছবিও মানুষ বারবার তার কবিতায় ফিরে এসেছে । নগর সভ্যতা নিয়ে নির্মম পরিণতি ও হাহাকার এবং পরিহাস আছে পীযূষের কবিতায় । মানুষের অধঃপতন স্বাভাবিকভাবেই তাকে আহত করে । করে বিচলিত । এই সময়ের সমস্ত দাগই তার কবিতায় উঠে এসেছে, যা কখনো প্রচ্ছন্ন, কখনো ভাসমান । (বন্ধু পীযূষ রাউত –স্বপন সেনগুপ্ত ) তাঁর কবিতায় বরাক উপত‍্যকার চিত্র ১.' কুশিয়ারার শান্ত জলে অশান্ত কল্লোল তুলে/ সেকালের বন্দর শহর শিলচরে যেত ।(একটি প্রাচীন চিত্র )। 'বাম হাতে চা বাগানের অনুচ্চ টিলাভূমির অনন্ত সবুজ' । ( চাতলার মুখ ) । ২. 'আংকিক হিসাবে তিপ্পান্ন বছর তো হবেই। / সেই সময় রাঙিরখাড়ি থেকে/ শিলচর হাইলাকান্দি সড়ক ধরে যেতে যেতে/ পথের দু'ধারে ধু ধু করা ধানমাঠ আর/ বাতাসের অবাধ উচ্ছ্বাস ।/ বাম হাতে/ সোনাই রোড ধরে শেষ টার্নিং পর্যন্ত খালি চোখ দেখে/ কদা- কদাচিৎ ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলা গাড়ি/ সে হতে পারে বাস/ হতে পারে পণ্যবাহী লরি ।( শিলচর টু জ্বালেঙ্গা ) । তেমনি পাই ত্রিপুরার নৈসর্গ চিত্রও–১.' ঊনকোটি বেলকুমের দাবানল শহর ধর্মনগর থেকে/ চোখে পড়ে না । অনুমিত হয় হেমন্ত শীত ঋতুতে জ্বলে উঠছে/ অনুল্লেখ্য লিলিপুট পাহাড় । (ঊনকোটি বেলকুম থেকে )। ২.' একা । অসহায় । আর আমি ?/ পুরনো বসতির শহর ধর্মনগরে/ বইমেলার আলোয়/ অন্যরকম ধর্মনগর/ সুবেশ মানুষের ব্যস্ততাবিহীন ভিড়ে/ ততোধিক সম্মিলিত/ ততোধিক উজ্জ্বল । ( অসুখ– ইতি তোমারই )
কবি পীযূষ রাউত তার কবিতা সম্বন্ধে নিজস্ব অনুভব প্রকাশ করেছেন এইভাবে 'আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, আমি কি কবিতার স্বর্গ থেকে খুব শিগগিরই বিচ্যুত হব ? যদি হই তবে আমাদের মহান শিক্ষাবিভাগকে এর জন্য দায়ী করবো । এমন এক পরিবেশে তাদের করুণায় আমি এসেছি যেখানে সাহিত্য শিল্প নিয়ে চর্চা করা সাঁতরে প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করার মত অবাস্তব ব্যাপার । অথবা অন্য একটি সন্দেহ মনের মধ্যে হতে চেষ্টা করে । কবি নয়, একজন সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেই কি এই অন্যমনস্কতা অনীহা অথবা আলস‍্য ? তবু আশাবাদ আমার প্রচন্ড । জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু কবিতাকে পারিনা । কোন বিশেষ আইডিয়া কিংবা আদর্শবোধ কিংবা বিশেষ কোন মতবাদ প্রকাশের জন্য আমি কবিতা লিখি না । আমি যে ব্যক্তিমানুষ তার সুখ-দুঃখের ব্যক্তিক অনুভূতি প্রকাশ করতে আমি আগ্রহী । পাঠকের মনের সঙ্গে আমার বক্তব্য যদি মিলে যায় আপত্তি নেই । না মেলে যদি, দুঃখ নেই শুধু এইটুকু বিশ্বাস করি, যেহেতু দৈনন্দিন অভাবক্লিষ্ট নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন নিতান্ত সাধারণ মানুষ আমি, সেহেতু আমার দুঃখ আমার সুখ পাঠকের মনকে স্পর্শ না করে পারবেনা  ।' ( কবিতা লেখার ইতিহাস–  পীযূষ রাউত / জোনাকি, নবমবর্ষ, দশম সংখ‍্যা,শরৎপর্যায় হাজার ১৯৭১ )।
দীর্ঘকালব‍্যাপী নিরন্তর নিরবচ্ছিন্নভাবে অগণিত কবিতা রচনার মাধ‍্যমে কবি তাঁর সৃজনে বিষয়ের বহুবৈচিত্র‍্যসহ কালচেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলেছেন এবং তা পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের হৃদয়ের অতলপ্রদেশেও ।

Friday, October 22, 2021

বৃ ষ্টি

বৃষ্টি,বুঝেছি তোমার চটুলকলা
বেরুতে তো দেবে না
আর কানাঘুষোর ভয়ে আঁকড়ে ধরতেও বাধা

শূন্যবিরতি তাই  ঝরে চলেছো
অন্তত ঘরে তো থাকবো
তোমার চোখের চাতালে

ভেতরচালাকি কে বুঝবে আর

Thursday, October 21, 2021

দুর্গাপুজো

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব ৷ দুর্গোৎসবের সঙ্গে দুটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রবহমান ৷ তার মধ্যে একটি আর্য-পৌরাণিক ও অপরটি লৌকিক  ৷ পৌরাণিক ধারা অনুযায়ী দেবীপূজার মূল উৎস ধরা হয় বেদ ও অন্যান্য কিছু পুরাণ কাহিনিকে ৷ বেদে আছে  অম্ভৃণ ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তাঁর অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত ৷ এই দেবীসূক্তই মাতৃবন্দনার মূল ৷
শারদীয়া দুর্গাপূজাকে বলা হয় 'অকালবোধন' ৷ কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুযায়ী রাম ও রাবনের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল ৷ হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন ৷ তাই এই সময়ে তাঁদের পূজা করা বিধেয় নয় ৷ অকালে পূজা করা হয়েছিল বলে এই পূজার নাম 'অকালবোধন' ৷ এই দুই পুরাণ অনুযায়ী রামকে সাহায্য করার জন্যে ব্রহ্মা স্বয়ং দেবীর বোধন ও পূজা করে ছিলেন ৷ অন্যদিকে কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন রাম স্বয়ং দেবী দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন ৷
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ মহাভারতে বর্ণিত আছে, শ্রীকৃষ্ণের রাজত্বকালে কুলদেবী হিসেবে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন ৷ কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন অর্জুন ও প্রদ্যুম্ন দুর্গাদেবীর পূজা করেছিলেন ৷ বিভিন্ন সময়ে দেবদেবীরা যে দুর্গাপূজা করেছিলেন তার একটি তালিকাও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাওয়া যায় ৷ এটি নিম্নে তুলে ধরা হলো: -
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা ৷
বৃন্দাবনে চ সৃষ্টাদ্যৌ গোলোকে রাগমন্ডলে ৷৷
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মনা সা দ্বিতীয়তঃ ৷
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা ৷৷
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা ৷
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী ৷৷
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈঃ মুনিমানবৈঃ ৷
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভুব সর্বতঃ সদা ৷৷
সৃষ্টির আদিতে গোলোকস্থ আদি বৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমন্ডলে কৃষ্ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন ৷ দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন ব্রহ্মা ৷ মধু ও কৈটভ দৈত্যদ্বয়কে নিধনের জন্য তিনি দেবীর শরণাপন্ন হন ৷ ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মহাদেব তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন ৷ দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন তা চতুর্থবারের দুর্গাপূজা ৷ দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করার পর ক্ষীরোদসাগরের তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দুর্গার পূজা করেন ৷ জাগতিক মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঋষি মান্ডব্য,হারানো রাচ্য ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য এবং কার্তবীর্যার্জুন বধের জন্যে বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম দেবী দুর্গার পূজা করেন ৷
বাংলার অত্যন্ত প্রাচীন দুর্গাপূজা হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা ৷দেবী মৃন্ময়ী ছিলেনমল্লভূমের রাজরাজেশ্বরী, মল্ল রাজবংশের কুলদেবী ৷ মল্লরাজ জগৎমল্ল 997 খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন ৷ কোন কোন ইতিহাসবিদ রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণের কথা উল্লেখ করেন ৷ 1606 খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলার দেওয়ান রাজা কংসনারায়ণ খ্যাতিলাভের উদ্দ্যেশ্যে আট লাখ টাকা খরচ করে ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন ৷ নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, কোচবিহারের রাজবাড়ি সর্বত্র এই সময়ে দুর্গাপূজার সূচনা হয় ৷কোলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার1610 সালে সপরিবার দুর্গা্পূজার প্রচলন করেন ৷ এজন্যেই সপ্তদশ শতাব্দীকে দুর্গাপূজার সূচনা ধরা হয় ৷

Wednesday, October 20, 2021

স্বীকার্য

স্বীকার্য

উত্তরের কথা যদি বলো তুমি আমি যাবো দক্ষিণে  
জল যদি সামান্য গড়ায় আমি বসতে পারি না 
জল যদি উঠোনে গড়ায় আমি দাঁড়াতে পারি না
জল যদি পথে গড়ায় পারি না আমি এগোতে
আর জল যদি ভূখন্ড ভাসায় আর 
হৃদয়ে যদি নতুন বাঁক আনে গড়ানো জল
তখন কোথায় যাবো, বলো ফুলসই? 

উত্তরের কথা বলো যদি তুমি আমি যাবো রাই দক্ষিণে ৷

Tuesday, October 19, 2021

ঠি। কা। না

ঝোলার ভেতর খাতা ও কলম
       একহাতে একতারা
গান লিখি আর গেয়ে বেড়াই
       দিন যে হলো সারা
দিনের শেষে ঝোলা ঝাড়ি
     পারের কড়ি কই
বিলাপ আর বারমাস্যা
   খাতায় তুলে লই
একতারাতে সুর তুলি তার 
     মেঠো পথে ফিরে
দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে
    আঁধার আসে ঘিরে
সেই আঁধারে পাড়ি দেবো
    পথ যে অজানা
সেই আঁধারেই খুঁজে পাবো 
      আমার ঠিকান

পেট্রোল

তেল ফুরোলে লাইন হবে
সুযোগ পেলে ব্ল্যাক হবে
চিরস্থির কবে তেল হায় রে পেট্রোল পাম্পে
************************************
************************************
************************************
সেই ধন্য নরকুলে
লোকে যারে নেপো বলে
মনের মন্দিরে নিত্য দধির স্বপন

তুরু রু

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু
পুব্বেতে উনাইলঅ ম্যাঘ
 পশ্চিমে বরষিলঅ গ
ভিজ্যে গ্যালঅ প্যান্ড্যালের কাপড়

ষাট ষাট বালাই ষাট
জল থৈ থৈ পথ ঘাট
এ্যামুন জাড়ে ভিজ্যে গ্যালঅ
সান্তালী বেটির কাঠামগুলো

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু

কালো দলিল

কালো দলিল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সময়ের চাকার সাথে সাথে বদলে যাবার কথা
আদিম ধারনা, পুরোনো পোষাক । 
আধুনিকতা আসবে
কলাপাতার নবীন রঙে ।

 লোকায়ত সব তহবিলের থাকেনা 
কোনো চাবি কিংবা আলতারা
অথচ সেইসব পুরোনো গোষ্ঠীযুদ্ধ 
জিনগত পাপের মতো 
মননে গেঁথে থাকে ।

সেইসব ঘুমন্ত কীটকুল  চাড়া দিয়ে ওঠে
অজানা গুজবের অন্ধ আবেগে ।
মধ‍্যযুগের পাতা ছিঁড়ে খুঁড়ে 
ওড়ে কালের বাতাসে ।
মানুষের বিবেক তখন আবার অমানুষ হয় । 
আর এক কালো দলিল সংখ‍্যায় বাড়ে ।

ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল

ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো......
******************************
মাটির প্রদীপের শিখা মাটির বুকে তির তির করে জ্বলতে থাকুক কিংবা অট্টালিকার কার্নিশে কার্নিশে সমবেত বৃন্দশিখায় মেতে উঠুক তাদের সম্মিলিত কুচকাওয়াজ এই ধরণীকে মাতিয়ে তোলার জন্যেই নিবেদিত ৷ ভুবনপুরের অন্ধকার দূর করার জন্যেই নিবেদিত প্রাণ নিভৃতে তৈলাধারে সংরক্ষিত রসদকে পাথেয় করে আলোকবন্দনায় রত ৷ যে রাতকীটসমূহ তাদের পক্ষবিধূননের মাধ্যমে বাধার সৃষ্টি করে আলোকযাত্রার সুরম্য উপাসনার, তার কোনো প্রতিবাদ করে না আলোকদল ৷ আজ যে আলোকোৎসবের ক্ষণ ৷ আজ শুধু আলোদান আর আলোকিত হওয়ারই ব্রতক্ষণ ৷ সমবেত আলোবিতরণে নিজেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আলোপ্রদীপ ৷ অপরকলঙ্ক বিকশিত করা  আজ আলোকাভিসারীর অভীষ্ট নয় ৷ তিমিরনিশার কলঙ্ক ঘুচানোর, আলোকস্নানে স্নিগ্ধ করার সপ্রদীপ মহড়়া এরাতের লক্ষ্য ৷ অন্তহীন অন্ধকার পথযাত্রীর হাতে আলোকবর্তিকা তুলে দেওয়ার মাঝে পবিত্র হওয়ার যে কুম্ভস্নান সেই স্নানে সিক্ত হয়ে দূরীভূত হয় অন্তরের তমসা ৷ সেই মহাহোমের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশীদার হলেও এক পরম তৃপ্তি পরমানন্দ ৷ আলোর দীপালিকা সেই চিরানন্দের বার্তাবাহক ৷ পবিত্র স্নাতক ৷ আসুন আলোকস্নাত হই অফুরন্ত আলোকুম্ভে ৷

Friday, October 8, 2021

সু র

ভেবেছিলাম তোমার শরীরের স্পষ্ট আকাশ
আরো স্বচ্ছনীল হয়ে ভেসে উঠবে
বাহা শাড়ির জমকালো আচ্ছাদন  ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়বে বিস্ফারিত ভূগোল

এই কাশের মেলায় উজ্জ্বল দোলা চাই
তোমার জীবনার্ত বিভঙ্গে
পিপাসা মেটাবার মিনারেল জল যেমন শোভন শোকেসে সেজেগুজে থাকে

তুমি  তেমন হলে
বুকের মধ্যে অদৃশ্য ঘন্টি
করুণ শাস্ত্রীয় সুরে 
বেজে যাবে বেজেই যাবে

Tuesday, October 5, 2021

জী ব ন

বিসর্জন থেকে ফিরে এলে
অমোঘ স্নানে মনন সিক্ত হয়

জলবিন্দু মাখা শরীরে মুক্তো হেসে ওঠে
কোলাহল স্তিমিত হয়ে জাগে শান্তকাল

মিলনের ভাঙনে যেন
আবার সৃজনের ভিতে ঢালাইয়ের আস্তর বিছানো হয়

ধীরঘুম থেকে চোখ তোলে জীবন


শরৎ শান্তি

শরৎ শান্তি

এখন শরৎকাল ৷ আমরা মেতে উঠছি উৎসবে ৷ 
আসলে কী শরৎকাল?  আসলে কী উৎসবের ঋতু এখন?
এই কিরাতপ্রদেশ থেকে এখনো অরণ্য যায় নি অগস্ত্যের পথে ৷
এখনো পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজ আবিরের মাখামাখি ৷ স্বাধীন সবুজের সমারোহ ৷
স্বাধীন বলছি এই জন্যে, এইসব অফুরান প্রাকৃতিক রঙগুলো 
আজ আর স্বাধীন নয় ৷এরা এক একটি রাজনৈতিক প্রতীক ৷
 সিঁথিরঙ লাল একদলের, সন্ন্যাসচিহ্ন গেরুয়া একদলের, তরুণ ঘাসের সবুজে চিহ্নিত হয় আর কোনো দল ৷
তবুও  কিরাতঅরণ্যের গায়ে মাখা সবুজ
তার চিরবান্ধব ৷ আজন্মপরিচয় ৷ আজো তার
শিখর থেকে নদীবিছানা সবুজকে জড়িয়ে আছে
 আশরীর৷
তারপরেও এই শরৎ কোন সীমান্তের কাঁটাতারের ওপারে আটকে আছে ৷
এখনো এই প্রদেশের দূরবর্তী কোনো শান্ত নিভৃত গাঁয়ে তাপমাত্রার পারদ
চৈত্রের দুপুরকে ছাড়িয়ে যায় ৷
আকাশের উদ্দাম নীল এখনো কালো মেঘের গর্জনের ভয়ে
পালিয়ে বেড়ায় ৷
রাতের ঘাসের কোনো তাগিদ নেই শিউলির জন্যে হিমের বিছানা পেতে রাখবার ৷ কুয়াশা ঝরে না মৃদু ও নিঃশব্দ ধারাপাতে ৷
 তবুও এই আগুনের আঁচে র মধ্যে আমরা উৎসবকে আবাহনের জন্যে অন্তরের বরণডালা সাজাই ঘরে ঘরে ৷ উৎসবের সিরিজ আমাদের সাথে এগিয়ে চলে  ধনী নির্ধন নির্বিশেষে ৷ ####################
এপারে মানুষ, ওপারেও মানুষ ৷ এই মানুষের হৃদয়ের রঙ লাল৷ ওই মানুষের হৃদয় রক্তিম বরণ ৷
তবু দুই পারের মানুষের মাঝে কাঁটাতার কেন?  কারা দিনরাত একে তাতিয়ে যায়, ওকে উস্কে যায় অবিরাম ৷
যাদের গোলায় মজুদ মারণাস্ত্রগুলো জং ধরতে ধরতে বাজারে তোলবার অযোগ্য হবার ভয়ে আর লোকসানের দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না তারাই দিনরাত কানমন্ত্র দিয়ে যায় কখনো ডান কানে, কখনো বা বাঁ কানে ৷ বিষমন্ত্র শুন শুনে ক্রমশ তলিয়ে যায় দুপারের বিবেক ৷ হাত পা ছুঁড়তে শুরু করে পরস্পরের বিরুদ্ধে ৷ ক্রমে ক্রমে ক্রোধের পারদ চড়ে ৷ উৎসবের মঞ্চ ভেঙে পড়ে ৷ একে অন্যকে ঘায়েল করাই উৎসবের উন্মাদনা ৷ঢাকের কাঠি হয়ে যায় রণদামামা ৷অদৃশ্য নির্দেশকের বাঁশি বেজে ওঠে এক বীভৎস ইঙ্গিতের ভাষায় ৷ লুকায় শান্তি,  হারায় উৎসব ৷ মৃৎপ্রতিমা নয় ৷ মৃত্যুপ্রতিমা কাঁধে কাঁধে চলে শোকভাসানে যেন ৷ এই শরতের ধাবমান নীলের শরীরে চলো আমরা  গুঁজে দিই সাদা সাদা পালক ৷ শান্তির নিশানের মতো যারা উড়ে বেড়াবে সারা আকাশ জুড়ে ৷ 
এসো বন্ধু, এসো প্রিয় পড়শি, আমাদের ধুনুচি নাচের ধ্রুপদী ধোঁয়ায় একসাথে মেশাই ভালোবাসার মুখর সুবাস ৷
 বলো,  বলো হে সবাই একসাথে, একই ঐকতানে - শান্তি, শান্তি এবং শান্তি আসুক নেমে আমাদের প্রতিটি চৌকাঠে ৷

Friday, October 1, 2021

ব‍্য থা

তুমি তো এলে মাগো
ঘাটের সেঁউতি সোনারই রয়ে গেল

আজও আমার মতো করে
বইতে পারলাম না

অর্থহীন সুন্দর গড়াগড়ি যায়

Tuesday, September 28, 2021

তুরু রু

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু
পুব্বেতে উনাইলঅ ম্যাঘ
 পশ্চিমে বরষিলঅ গ
ভিজ্যে গ্যালঅ প্যান্ড্যালের কাপড়

ষাট ষাট বালাই ষাট
জল থৈ থৈ পথ ঘাট
এ্যামুন জাড়ে ভিজ্যে গ্যালঅ
সান্তালী বেটির কাঠামগুলো

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু

Friday, September 24, 2021

হে চিরপ্রণম‍্য

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2937681976365454&id=100003710406641হে চিরপ্রণম‍্য ( প্রিয় শিক্ষক কাশিনাথ দাস স‍্যরের প্রয়াণে

Thursday, September 23, 2021

বি ষা দ প তা কা

তোমার খোঁজ চলে শেকড়ে ও শিশিরে
ফেরারি মেঘ আকাশকে ভুলিয়ে
চলে যায় নৌকো বেয়ে

বুকের ভেতর জলছত্র গান
বিপন্নতার বিষাদপতাকা নেড়ে
সন্ধ্যামাদুরের কাছে
ঘন হয়ে আসে

আকাশের ঠোঁটরঙা সন্ধ্যার দিকে
চোখ রেখে আউলাঘরের
পাশেই দেখি আমার পারঘাটা

ছায়ামাঝির অপেক্ষায় আছে
মায়ানোঙর আর কৃষ্ণডিঙি

আ। লো

এই কলহান্তরিতা বাদল দিনে 
রাত্রির মতো অন্ধকার নেমে এলে
তোমাকেই মনে মনে ভাবি

এমন সময় তুমি আলোর শরীর নিয়ে
আমার সামনে এসে দাঁড়ালে
সমস্ত অন্ধকার পালিয়ে গেল

তোমার বিচ্ছুরিত বিভায় আলোময়
হয়ে উঠলো আমার ঘর

*** আ  লো ***
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

Tuesday, September 21, 2021

শূ ন‍্য তা

শূন্যতা

দূরের দেও নদী কাছে এসে ভদ্রাসন ভেঙে দিয়ে যায় / জনপদজীবনের হাহাকার হয়ে মুছে ফেলে প্রাচীন বাস্তুচিহ্ন/ প্যারী মাসটারের টোলচিত্র উধাও হবার সঙ্গে সঙ্গে / কোথায় হারিয়ে যায় সদ্য খোলায় ভাজা সাদা মুড়ির উষ্ণ তৈলচিত্র / পাড়াতুতো ঠাকুমার বিবাহপ্রস্তাব একটা আবছা সংসারচিত্র/ দারিদ্র্যময় রোমান্স আর প্রেমদায় স্বপ্নমুখরতায় কবুতরের আত্মগুঞ্জন/ 

সে সব অতীত খাল বিলের স্রোতের কোমল দৌড় পেরিয়ে /  সখি আজ তোমার চোখের পর্দায়
চলমান আকাশচিত্র দেখি /

Thursday, September 16, 2021

স্ব দে শ

স্বদেশ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছায়াপথের গভীর রেখা বেয়ে আলোর রোশনাই 
 মজে গিয়ে নিভতে থাকে অমৃতপথের বাঁধানো বাতির উজ্জলতা ।
 স্বপ্নের বদলে দেখতে দেখতে দ্রোহের তর্জমা গর্জে উঠে ।

ধৈর্যশীল নক্ষত্রের মতো অবিরাম জেগে থাকে
  বিন্দু বিন্দু আশ্বাসের রামধনু ।
ভেসে ওঠে নির্ঝঞ্ঝাট আকাশের হৃদয়ে ।

 আমাদের পিতামহগণ অক্লান্ত যাত্রিকের মতো
 এক দুরন্ত ট্রেনের সওয়ার হয়ে স্বপ্নযান দেখেছেন ।
 তাদের যুদ্ধ ভূমির গর্ভ গৃহে বারুদের মত জমেছে স্বদেশপ্রেম । 
একাকার হয়েছে স্বদেশ ও প্রেম ।
তাদের পায়ে বেজেছে অস্থির শেকড়ের ঝংকার ।
 বন্দী আকাশের গায় ফুটে ওঠে ত্রিবর্ণের আলপনা ।

আমরা বহুবর্ণে ঢেকেছি আমাদের গৌরব । 
জটিল হয়েছে ক্রমশ আমাদের যাপন ।
 স্বদেশ কার কিংবা কার নয় তারই সমীকরণ কেবল ।

 যে ঝড়ের শব্দে বেরিয়ে পড়ে চলে গেছে বহু প্রাণ । 
ফিরে আসেনি তোমার কোলে ;
 আর তাদেরই উত্তাল আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়ে 
 আমরা পালন করি প্লাটিনাম উৎসব । 
মানুষের স্বাধিকারের তমসুক বদলে যায় স্বপ্নহীন হালখাতায় ।
মানবতার গান বাঁধে অমানবিক মানুষ ।
একদল মানুষের দুখরাতে ভরে যায় দিনলিপি 
ভাতের থালা টেনে নেয় কালো পিঁপড়ের দল ।

প্রতিটি পনেরোর তুমি আলোকিত হয়ে ওঠো উজ্জ্বল রোদে 
আর আমরা সামনে দেখি আরো ফর্সা দীর্ঘ পথ।

Monday, September 13, 2021

সৎ ও সততা

মন রে, ভবের নাট‍্যশালায়
মানুষ চেনা দায় রে ।
শুধু সৎ হলেই হবেনা । সৎ প্রমাণ করার জন‍্যে কর্তার আখড়ায় নিয়মিত হাজিরাটাও দিয়ে যেতে হয় । নইলে সবই মিছে ।

Saturday, September 11, 2021

পান নিয়ে পাঁচালি : লোকসংস্কংতি ও লোকসাহিত‍্যে

পান নিয়ে পাঁচালি : লোকসংস্কৃতি ও সাহিত‍্যে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে পূজা পার্বণ থেকে শুরু করে নানাবিধ ঔষধি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে পানের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে । আনুমানিক প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষের পান খাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল । সেই ধারা আজও প্রবহমান রয়েছে । আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের 'চিরঞ্জীব বনৌষধি' এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগ থেকে বাংলাদেশের পান এর ব্যবহার চলে আসছে । জাতকের গল্পে ও একাধিক পালি গ্রন্থেও তাম্বুল বা পানের ব্যবহার এর উল্লেখ পাওয়া যায় । হিতোপদেশেও পানের ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে । প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে  আয়ুর্বেদ গ্রন্থকার সুশ্রুত রচিত 'সুশ্রুত সংহিতা'য় আহার্য খাদ্যদ্রব্য পরিপাকের বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,গুরু ভোজনের পরে যেকোনো কোষ্ঠকারক বা কটু স্বাদযুক্ত ফল কিংবা সুপারি কর্পূর জায়ফল লবঙ্গ প্রভৃতি সহযোগে যেন তাম্বুল চর্বন করেন । পানের উপকরণের এই তালিকা থেকে বোঝা যায় সুশ্রুতের কালে পান খাওয়া বিলাসিতায় পরিণত হয়েছিল এবং তা কতখানি পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল । পণ্ডিতেরা প্রাচীনকালে আরও যেসব গ্রন্থে তাম্বুল বা পানের উদাহরণ পেয়েছেন তার মধ্যে 'চরক সংহিতা' ও কালিদাসের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

পান পিপুল পরিবারের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা । আর্য ও আরবগণ পান কে তাম্বুল নামে অভিহিত করতেন। নিঃশ্বাস সুরভিত করা ও ঠোঁট ও জিহ্বা কে লাল করার জন্য মানুষ পান খায় । পান একটি গাছের নাম । এর পাতাকে পান বলা হয় । সংস্কৃত 'পর্ণ' শব্দ থেকে পানের উৎপত্তি । যার অর্থ পাতা । পান খাওয়ার ফলে এক ধরনের তাম্রবর্ণের রসের সৃষ্টি হয় মুখের লালার সঙ্গে মিশে । 'তাম্র' থেকে হয়েছে 'তাম্বুল' । পানের সঙ্গে সুপারি দেওয়া হয় । অনেকে সুপারি ছাড়াও পান খেয়ে থাকেন । ভোজের অনুষ্ঠানের শেষে নানাবিধ সুগন্ধিসহ পান পরিবেশন করে অতিথি কে প্রস্থানের ইঙ্গিত করা হয় । আমাদের নানা উৎসব- অনুষ্ঠান ও মাঙ্গলিক আচারে পান এর ব্যবহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে রয়ে গেছে । মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল'-এ ধনপতি সওদাগরের বিবাহ উপলক্ষে পান-সুপারির উল্লেখ রয়েছে– 'তৈল সিন্দুর পান গুয়া /বাটা ভরি গন্ধ চুয়া / আম্র দাড়িম্বপাকা কাঁচা/ পাটে ভরি নিল খই / ঘড়া ভরি ঘৃত দই / সাজায়‍্যা সুরঙ্গ নিল বাছা ।' পান পরিবেশনের জন্য নানা বিধ সরঞ্জামের ব্যবহারও দেখা যায় । সে গুলোকে পানদানি বা 'বাটা' বলা হয় ।ঘুম পাড়ানি গানে শোনা যায় 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি যেও / বাটা ভরা পান দেব গাল পুরে খেও।'

পান ও পানের ব্যবহারের উৎস ও এদেশে আগমনের ইতিহাস সন্ধানে জানা যায় যে পান অস্ট্রো-এশিয়াটিক । পন্ডিতদের মতে পানের ব্যবহার ও  প্রসারণটি অস্ট্রোনেশীয় জনগণের নিওলিথ সম্প্রসারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত । এটি প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ইন্দো- প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়ে । দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে ছিল ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত  । আদি ঠিকানা– ফিলিপিনস, কিংবা জাভা, বোর্নিও । তবে ভারতীয়দের ধারণা, পান একান্তই এ দেশের নিজস্ব সম্পদ ।

পানের জন্ম সম্বন্ধে বহু লৌকিক পৌরাণিক ও ধর্মীয় কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে । মহাভারতের উৎস থেকে জানা যায় যে, অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পানের জন্য পাণ্ডবরা সারা দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলেন । শেষ পর্যন্ত পানের সন্ধান পাওয়া যায় পাতালপুরীতে, সাপের আবাসে । তখন বাসুকি তাদের অনুসন্ধানে সন্তুষ্ট হয়ে উপহার দেন তাঁর হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলি । সেই আঙ্গুল মাটিতে পোঁতার পরে তা থেকে জন্মায় পানের বল্লরী । সে গাছে ফুল নেই, ফল নেই । কেবল সবুজ পাতা । একারণেই সংস্কৃতে পানের আরেক নাম 'নাগবল্লরী' । এ ছাড়া আর একটি পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে, সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠেছিল হলাহল । সেই বিষ নিয়ে দেবতারা প্রচন্ড সমস্যায় পড়ে যান । শেষে সেই বিষ গলায় ধারণ করে দেবাদিদেব মহেশ্বর নীলকন্ঠ হলেন । বিষের জ্বালায় তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়েন । তখন তার কপালের ঘাম ও শরীরের ময়লা সংগ্রহ করে একটি তামার পাত্রে রাখা হয় । সেই মিশ্রণ থেকে জন্মায় এক সুদর্শন পুরুষ । নারায়ন তার নাম রাখেন 'তাম্বুলপুত্র' । জন্মানোর পর সে যায় নাগলোকে । তার রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় নাগকন্যা । সেখানে দুজনের বিয়ে হয় । তাদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে পানরূপী 'নাগবল্লরী' । অনেকে আবার মনে করেন যে অর্জুন স্বর্গ থেকে পানের চারা চুরি করে এনেছিলেন । সেটি তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে লাগিয়েছিলেন । সেই থেকেই মর্তে পানের ব্যবহারের প্রচলন হয় । শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ঘটিত আরেকটি কাহিনি থেকে জানা যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার গোপনে বিজেতার ঘরে যান । শ্রীকৃষ্ণকে হাতেনাতে ধরার জন্য শ্রীমতি রাধারানি বিজেতার গৃহে উপস্থিত হন । অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পেরে স্বয়ং সুপারি গাছের রূপ  ও বিজেতা পান গাছের রূপ ধরে লতার মতো তাঁকে জড়িয়ে থাকেন । এ কারণে পানসুপারি দেবতার প্রসাদ হিসাবে গণ্য হয় । এছাড়াও কথিত আছে যে, দেবর্ষি নারদ বৈকুণ্ঠ থেকে এই সুপারি পৃথিবীতে মানুষের ভোগের জন্য এনেছিলেন । শাস্ত্রমতে ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাদেব চুনে । পানের খিলিতে বাস করেন ত্রিদেব বা ত্রিনাথ । পানের আরেক নাম সপ্তশির । যেকোনো ধরনের পানে সাতটি শিরা আছে ।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে পান খাওয়ার বিধিও বর্ণনা করা হয়েছে । বলা হয়েছে পানের অগ্রভাগে পরমায়ু, মূল ভাগে যশ, এবং মধ্যে লক্ষীর অবস্থান । এ কারণে এই তিন অংশ ফেলে তারপর পান খাওয়া উচিত । মূল ভাগ খেলে কঠিন রোগ, অগ্রভাগ খেলে পাপের ভাগী, কমবে আয়ু আর পানের বোঁটা খেলে নষ্ট হবে বুদ্ধি । পিকও ফেলতে হবে নিয়ম মেনে । পান, সুপারি, মশলায় তৈরি পান চিবানোর পর সৃষ্ট প্রথম রস বিষের মত, দ্বিতীয় রস রেচন, ও তৃতীয় রস অমৃত । এই কারণে প্রথম দুবার এরস খাওয়া চলবে না । শুধু পানই নয় । রয়েছে পান মশলা খাওয়ার নিয়মও । সকালের পানে থাকবে বেশি সুপারি । দুপুরের পানে খয়ের এবং রাতে চুন । সুপারি ছাড়া পান খাওয়া মহাপাপ । এই  পাপস্খালনের জন্য করতে হবে গঙ্গা স্নান ।

আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে পান এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিবাহে । বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু হয় পানের খিলি দিয়ে । বিবাহ সংক্রান্ত প্রাথমিক নিমন্ত্রণকে বলা হয় 'পানচিনি' নিমন্ত্রণ । বিবাহের জন্য পাত্র কন্যার বাড়িতে রওনা হওয়ার সময় নিয়ে যায় 'যাত্রার' পানসুপারি  । মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গলে আছে ধনপতি বিবাহ উপলক্ষে পানগুয়া নিয়ে যাওয়ার কথা– 'তৈল সিন্দুর পানগুয়া / বাটা ভরি গন্ধ চুয়া  / আম্র দাড়িম্ব পাকা কাঁচা । /পাটে ভরি নিল খই / ঘড়া ভরি ঘৃত দই / সাজায়‍্যা নিল বাছা ।' বিবাহে পান-সুপারির ব্যবহার বংশবৃদ্ধির প্রতীক । কারণ এগুলির প্রচুর ফলন হয় । বিবাহের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহারে ভাবি দাম্পত্য জীবনকে সফল ও ফলবানরূপে দেখার কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটে । 'কুলাসাজানো' বা বরণডালা, অধিবাস, গায়ে হলুদ  সর্বত্রই থাকে পান আর সুপারির অবস্থান । জামাই বরণ এর সময় এর ব্যবহার রয়েছে । মুকুন্দরাম তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু উপাখ্যানে কালকেতু ফুল্লরার বিবাহ  সভায় উপস্থিত হয়ে জামাতাকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে শিরে ধান দূর্বা 'নিছিয়া' পান ফেলে এবং গলায় মালা পরিয়ে প্রচলিত আচারের মাধ্যমে বরণ করতে দেখা যায় । 'করিয়া বিরল স্থান/ জামাতারে করে মান/ প্রেমবতী ব‍্যাধের অবলা । / শিরে দিয়া দূর্বা ধান /  নিছিয়া ফেলিল পান / গলে দিল বনফুল মালা ।' অথবা বিবাহের সাত পাকের অনুষঙ্গ হিসেবে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে শিব গৌরী বিবাহে পাই– 'শিবে প্রদক্ষিণ গৌরী কৈল সাতবার । / নিছিল পান কৈল নমস্কার ।।

বাঙালির বিবাহের আনন্দঘন অনুষ্ঠান বাসর ঘর সংক্রান্ত আচার । বাসর ঘর বরবধূর কাঙ্খিত ও আনন্দময় অনুষ্ঠানস্থল । বাসরঘরে নতুন বরকে নিয়ে নানাবিধ ও কৌতুক আনন্দের আসর করা হয় । বরপক্ষ কন্যাপক্ষ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর নানা প্রতিযোগিতা ও হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে । বাসর ঘরে কন্যাপক্ষ পাত্র পক্ষের জন্য পান সাজিয়ে রাখে । পানের মধ্যে ঝাল লঙ্কা ঢুকিয়ে নতুন জামাইকে বিব্রত করতে দেখা যায় শালিকা কিংবা কনের বান্ধবীকে । সতর্ক বর পানের খিলি খুলে তবে মুখে দেয় । আবার এই পান খাওয়ার আগে পাত্রপক্ষকে কন্যা পক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় । সেখানেও থাকে পানকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ধাঁধা । এরকম একটি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক ধাঁধা যেখানে পানের জন্মকথা জানতে চাওয়া হয় ।  প্রতিবেদকের সংগৃহীত এরকম একটি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক ধাঁধা নিচে তুলে ধরা হলো–প্রশ্ন :  :পান খাও পন্ডিত ভাই কথা কও লা রে / পানের জন্ম কোন অবতারে? / যদি না কইবা পানের  কথা / ছাগল অই খাইবা হর্বার পাতা ।'পাত্র পক্ষের একজন উত্তরের বিনিময়ে অসম্ভব কিছু দাবি করে বসে–'আগে আন ছ'মন খই  ন'মন দই / তই যাই পানের কথা কই ।' সবশেষে একজন আবার ছড়া কেটে ধাঁধার উত্তর দিয়ে দেয়– 'লঙ্কায় জর্মিছিল পানগুয়া রাবণের দেশে / ছিরাম গেছিল যন সীতার তালাইশে /   পোপনপুত্র হনুমান গেছিল তার সাথে / হারি আইনছিল চারা রামের অজ্ঞাতে / সাত মুড়া হব্বতে আনি ছাড়ি দিল /  বারইয়ে পাই তারে যতন করি ছিল / টেকনাফের গুয়া রে ভাই মইশখালির পান / বারইয়ে জানে এই পানির সন্ধান / নিদাইন্না বৈশাখে গুয়ায় ছাড়ে ছড়া / বাইষ‍্যাকালে বরের মাঝে পানের লতা ধরা / এক কান করি ছিঁড়ে  আর বিড়া করি রাখে / বারইয়ার ঘরে ঘরে এই পান থাকে / চাইরগায় এক গন্ডা আডারো গন্ডায় বিড়া / বাজার তুন কিনবা পান ভিতর খাইবা ছিঁড়া ।'

প্রবাদ, প্রবচন, লোকসংগীত, ছড়া ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির বহু উপাদান এর মধ্যে প্রাণের উপস্থিতি পাওয়া যায় । প্রবাদের মধ্যে যেমন উল্লেখ পাওয়া যায়–'ভালোবাসার এমন গুণ / পানের সঙ্গে যেমন চুন / বেশি হইলে পুড়ে গাল /কম অইলে লাগে ঝাল ।'  'ছাগলের মুখে পড়ল পান/  পান বলে গেল মোর জান ।' 'খাবায় ভাত না খাবে পান / হেই ভাতের কিবা মান ।' অর্থাৎ নেমন্তন্নের পর পানের ব্যবস্থা না করলে সেই নেমন্তন্নের কদরই থাকেনা । খনার বচনে পান চাষের পদ্ধতি সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে–'ষোল চাষে মূলা / তার অর্ধেক তুলা / তার অর্ধেক ধান / বিনা চাষে পান ।' বাংলা লোক সংগীতেও দেখা যায় পান প্রসঙ্গ । 'সুজন মাঝি কই যাও / একখান কথা কইয়া যাও / ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা / পান খাইয়া যাও ।'  ছড়ায় পাওয়া যায়– 'কিবা দেশে আইলাম রে ভাই কিবা দেশের গুন / একই গাছে পান-সুপারি একই গাছে চুন ।' 'পান খাইও রসিক জামাই, কথা কইও ঠারে ।'

প্রাচীন বাংলা কাব্য চর্যাপদ ও মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য গুলো লোকসংস্কৃতির উপাদানে পরিপূর্ণ । এই সাহিত্যসমূহে বাঙালির লৌকিক জীবন  যতটা আন্তরিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা মধ্যযুগের আর কোন আঙ্গিকে লক্ষ্য করা যায় না । বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার অনুষ্ঠান এবং নিজস্ব বিশ্বাস, সংস্কার বিধিনিষেধ প্রায় প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে ফুটে উঠেছে চর্যার ২৮ নম্বর পদে পাই– 'হিঅ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই / সুন নৈরামণি কন্ঠে লইয়া মহাসুহে রাতি পোহাই ।' অর্থাৎ–শবর তাম্বুল কর্পুর খায় 
, শূন‍্য নৈরামণি আলিঙ্গনে মহা সুখে রাত ভোর করে । ময়নামতির গানে নায়িকা ময়না যে পান খেতেন তার উপকরণ ছিল গুয়ামুরি, ধনিয়া, জৈষ্ঠমধু, লং, জায়ফল, এলাচ, দারুচিনি ও কর্পুর । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তো তাম্বুল খন্ড নামে একটি অধ্যায়ই রয়েছে । বড়াই এর কাছে রাধিকার রূপবর্ণনা শুনে তাঁর রূপে মোহিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ বড়াই এর হাতে ফল তাম্বুল পাঠিয়ে রাধার কাছে প্রেমের প্রস্তাব পাঠান । এখানে বলা হয়েছে–'কথা খানি কহিল বড়ায়ি / বসিয়া রাধার পাশে ।/ কর্পূর তাম্বুল দিয়া রাধাক বিমূখ বদনে হাসে ।' কবিকঙ্কন এর চন্ডীমঙ্গলে আছে, রাজার নির্দেশে ধনপতি নৌকা নিয়ে যাত্রা করেন সিংহলের উদ্দেশ্যে । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখেছেন– 'নানা আভরণ পরি / ডালি করে নিলো ঝারি/ বাস করে তাম্বুল সাঁপুরা /' চন্ডীমঙ্গলে দেখা যায় ভাঁড়ু দত্তের পেটে ভাত না জুটলেও পান খাওয়া চাই । 'অধরে না চিনে অধরে না চিনে অন্ন, তাম্বুল পান মুখে' । আবার মনসামঙ্গলে লক্ষিন্দরের বিবাহ পালায় কবি লিখেছেন–'ধর ধর। বলাধিক খাও গুয়া পান /  লখাইর সঙ্গে কটক যাইবে যাইবে সাজাইয়া আন ।' এছাড়া আরও লক্ষ করা যায়–১) দাসীতে যোগায় পান গালে গোটা গুয়া ( ধর্মমঙ্গল ) ২)পান বিনা পদ্মিনীর মুখে ওড়ে মাছি ( বিদ্যাসুন্দর ) ৩)তাম্বুল রাতুল হইল অধর পরশে ( পদ্মাবতী– আলাওল ) ৪) আধ মুখে ভাঙ্গ ধুতুরা ভক্ষণ / আধই তাম্বুল পুরিরে ( অন্নদামঙ্গল ) ৫)ভোজন করেন রাম পরম হরিষে/  দধি দুগ্ধ দিল রাজা ভোজনের শেষে ।। সুতৃপ্ত হইল সবে করে আচমন / কর্পূর তাম্বুল করে মুখের শোধন  রামায়ণ) ৬)সুবাসিত কর্পূর তাম্বুল পুষ্প নিয়া / যজ্ঞ পূর্ণ করে বেদ উচ্চারিয়া । ( মহাভারত ) ৭)সিদ্ধান্ত যোগী পান নাহি খায় / পানের বদলে তারা হরতকি চাবায় ।  (গোপীচন্দ্রের গান)৮) আচমন করিয়া প্রভু বসে সিংহাসনে/  কর্পূর তাম্বুল জোগায় প্রিয় ভক্তগণে ।( চৈতন্যচরিতামৃত) । ৯)হাথক দরপণ/ মাথক ফুল / নয়নক অঞ্জন/ মুখক তাম্বুল ( বিদ্যাপতি)১০) খেজুর পাতা হলদি মেঘ নাম জলদি / এক বিরা পান ঝুপ ঝুপাইয়া নাম ( ময়মনসিংহ গীতিকা )১১)জলপূর্ণ ঘটে সিঁদুরের ফোটা / আমের পল্লব দেবে তাহে এক গোটা / আসন সাজায়ে দিবে তাতে গুয়া পান / সিঁদুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান ।(লক্ষ্মীর পাঁচালি )১২)কৃষ্ণ তন্ডুলেতে মিশাইবে গুড়/ সন্দেশ শর্করা আর তাম্বুল কর্পূর ( শনির পাঁচালি ) ।

দুর্গোৎসবের সময় দশমীর দিন দুর্গাকে সিঁদুরে রাঙিয়ে, মিষ্টিমুখ করিয়ে, পান, ধান, দূর্বা দিয়ে বিদায় জানানোর রীতি-রেওয়াজ রয়েছে । পান চাষের ক্ষেত অর্থাৎ পানের বরে স্ত্রীলোকের প্রবেশ নিষেধ রয়েছে । এতে নাকি পান নষ্ট হয়ে যায় । ছোটো শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের দরুন মলত্যাগে অসুবিধা হলে গুহ্যদ্বারে পানের বোঁটা দিয়ে রাখলে সুফল পাওয়া যায় এছাড়া পেট ব্যথা করলে পান পাতায় ঘি মাখিয়ে গরম করে পেটে সেঁক দিলে ব্যথা কমে । এছাড়া পানের আরো লোকওষধি গুণ রয়েছে ‌। ১)পান পাচনশক্তি বাড়ায় ।২)গলার আওয়াজ পরিষ্কার করতে পান উপকারী ৩)রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পান সাহায্য করে ৪)পান খেলে মুখের স্বাদ ফিরে আসে ৫)হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে ৬)পান খেলে পেট পরিষ্কার হয় ৭)সর্দি কাশি হলে পানের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায় ৮)পানের সাথে গোলমরিচ লবঙ্গ মিশিয়ে খেলে কাশি কমে ৯)মুখে ঘা হলে পানের মধ্যে কর্পূর দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে বারবার পিক ছেলে ফেললে সুফল পাওয়া যায় ১০)পানের মধ্যে থাকা গুলকন্দ কর্মক্ষমতা বাড়ায় ।

পান খাওয়া একটি বিলাসিতার অঙ্গ । যথার্থ পানরসিক সাজিয়ে গুছিয়ে পান খেতে বসেন । পান খাওয়ারও তাই নানা সরঞ্জাম রয়েছে ।পানের বাটা, পানদানি, পানের ডিবি, চুনের কৌটো, পিকদানি, জাঁতি ইত্যাদি । বয়স্কদের জন্য পান চূর্ণ করে পরিবেশন করার জন্য রয়েছে হামানদিস্তা । এইসব সরঞ্জামের গঠনশৈলীতে রয়েছে নানা কারুকাজ, নানা নকশা । কাঠের,লোহার, রুপার কিংবা পিতলের হয়ে থাকে এসব সরঞ্জাম ।পান সাজার মধ্যেও রয়েছে নির্মাণ কুশলতা ।নানা আকারে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হয় পানের খিলি । এককথায় এর মধ্যে বাংলার লোকশিল্প শিল্পের নিদর্শনটি স্পষ্ট ।

পান নানা আভিচারিক ক্রিয়ায়ও ব্যবহার হয় । যেমন পান বশীকরণ মন্ত্রের প্রধান উপাদান । যাকে বশ করা হবে শনি কিংবা মঙ্গলবারে তার কাছ থেকে একখিলি পান সংগ্রহ করে আনলে গুনিন তা দিয়ে তার যাদু-টোনা করেন । এরকম অন্য আভিচারিক ক্রিয়ায় একদমে বাজার থেকে পান কিনে আনতে হয় ।

পান যেমন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছে তার ব্যবহারিক গুণে তেমনি পানকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটে যেতে পারে । ইতিহাসের উদাহরণ থেকে সংগ্রহ করা ঘটনাটি বিবৃত করে এই প্রবন্ধের সমাপ্তি টানব । পানে বিষ মিশিয়ে শত্রু বা অনাকাঙ্ক্ষিত জনকে হত্যা করার কাহিনি ইতিহাসে রয়ে গেছে । ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের সে কাহিনী বর্ণনা করেছেন । মুঘল আমলে আগত ইউরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ছিলেন ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার  (১৬২০- ১৬৮৮) । ১৬৫৮ সালে যুবরাজ দারাশিকোর অনুরোধে তিনি শাহজাহানের চিকিৎসক হিসেবে দিল্লিতে এসেছিলেন ফ্রান্সে ফিরে তিনি ভয়েজেস (১৬৭০)নামে একটি ভ্রমণ কাহিনি লেখেন । তার লেখা বিবরণে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহান একসময় সন্দেহ করতে শুরু করেন যে, তার বড় মেয়ে জাহানারা নজর খাঁ নামে এক সুপুরুষ যুবকের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত । সম্রাট প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে যুবককে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন । একদিন তিনি সভাস্থলে নিজ হাতে ওই যুবককে একটি পানের খিলি উপহার দিলেন । যুবক তার প্রেমের সফলতার স্বপ্নে মশগুল হয়ে সম্রাটের দেওয়া পানের খিলি নিঃসন্দেহে গ্রহণ করল । পানটি খেয়ে দরবার ছেড়ে বাড়ির পথ ধরার জন্য পালকিতে উঠলো । কিন্তু তীব্র বিষক্রিয়ায় যুবকটি পথেই প্রাণ ত্যাগ করল ।