Sunday, October 30, 2022

কার্তিকের কাব‍্যকথা

কার্তিকের কাব‍্যকথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে
 হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে
 ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো– দীপালিকায় জ্বালাও আলো 
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে ।                                                                ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

 বাঙালি জীবনের বারোমাস‍্যায় কার্তিকেরও ভূমিকা রয়েছে ।আশ্বিনের সংক্রান্তির সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় কার্তিকের আবাহন । হেমন্তের ঋতুর শুরুও এই সময় । প্রাচীন রীতি অনুযায়ী কার্তিকমাসব‍্যাপী রাত্রিবেলা প্রতি গৃহস্থের উঠোনে জ্বালানো হয় আকাশপ্রদীপ ।  ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সারা কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ জ্বালানোর মধ্য দিয়ে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয় । শাস্ত্রে আছে ভগবান বিষ্ণু দীর্ঘ চারমাস যোগনিদ্রায় অভিভূত থেকে এই মাসেই জেগে ওঠেন । তিনি পৃথিবীকে পালন করেন । তাই তাকে সন্তুষ্ট রাখতে ধর্মপ্রাণ হিন্দু জনগণ সারা কার্তিক মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঘি বা তেল দিয়ে  প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে । বাড়ির সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পূর্ব বা উত্তরমুখী করে প্রদীপ জ্বালানো হয় ।

 এই মাটির প্রদীপ আসলে মানবদেহেরই  প্রতীক । ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব‍্যোম এই পঞ্চভূতে যেমন নশ্বর দেহ তৈরি হয় মাটির প্রদীপ ঠিক তেমনি । ক্ষিতি বা মাটি দিয়ে প্রদীপের শরীর তৈরি হয় । অপ বা জল দিয়ে তার আকৃতি গঠন করা হয় । তেজ বা আগুন আত্মার মতো স্থিত হয় প্রদীপের অন্তরে । বাতাস সেই আগুনকে দহনে সহায়তা করে । আর ব‍্যোম বা অনন্ত শূন‍্য জেগে থাকে তার গর্ভে । জীবন্ত কর্মময় মানুষের প্রতীক প্রদীপ নির্বাপিত হওয়া জীবনেরই পরিসমাপ্তি । লোকবিশ্বাস মানুষ মৃত্যুর পরে বিষ্ণুলোকে গমন করে । কাজেই মৃত্যুর পরে মানুষের উপর বিষ্ণুরই অধিকার রয়েছে । সেকারণেই পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির লক্ষ্যেই ভগবান বিষ্ণুকে প্রসন্ন রাখার উদ্দেশ্যে এই সময়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন । 

এছাড়া এইসময়ে শীতের শুরু হয়ে যেত একসময় । বর্তমানে পরিবেশে বিশাল পরিবর্তন হওয়ার ফলে মূল শীত ঋতুতেও ততটা শীত থাকে না । প্রাচীন মানুষ শীতনিবারণের জন্য অগ্নির ব্যবহার করত । শীত ঋতুতে অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাসের কারণেও এই প্রদীপ জ্বালানোর প্রথা । আবার এইসময়ে নতুন ধান পাকতে শুরু করে । এই সুযোগে সুপুষ্ট ধানকে পোকায় কেটেও নষ্ট করতে থাকে । এই মাসে আকাশ প্রদীপের আলো দেখে ধানের পোকাগুলো আলোর দিকে উড়ে আসে । খেতের ফসল পোকার হাত থেকে রক্ষা করার লৌকিক পদ্ধতিও ছিল এই প্রদীপ প্রজ্জলন । এক কথায় কার্তিকমাসের এই প্রদীপ জ্বালানোর  সঙ্গে বেশ কয়েকটা ধর্মীয় লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার এবং লোকবিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে ।

কার্তিক মাস এলেই প্রকৃতি অপরূপ রূপ নিতে থাকে । গাছে গাছে সাদা শিউলি ফুটে থাকে । ভোরের দিকে ঝরে পড়া এই ফুল কুয়াশায় মিশে খইয়ের মত গাছ তলায় পড়ে থাকে । শিউলির মৃদুগন্ধ ভোরের পরিবেশকে মধুর করে তোলে ।  বিস্তীর্ণ ক্ষেতের ধান ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ধরতে থাকে । কুয়াশামাখা সোনালি ধান মাঠের বুকে যখন ছড়িয়ে থাকে তখন মনে হয় সোনার বসন পরে যেন এক অপরূপা রমণী মাঠময় শুয়ে আছে ।  একদিন ঘরে নতুন ধান উঠে । কৃষকের প্রাণে নতুন বার্তা সঞ্চারিত হয় । আয়োজন চলে নবান্নের । কার্তিকের প্রকৃতির অপরূপ রূপ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে–

 আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে– এই বাংলায় 
হয়তো মানুষ নয়– হয়তোবা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
 হয়তো ভোরের কাক হয়ে কার্তিকের নবান্নের দেশে 
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় 
                                                           ( রূপসী বাংলা )

কার্তিক মাস এলেই নতুন ধানের সৌরভের প্রত্যাশায় প্রকৃতি আর মাঠের সোনালি ধানের সোনারঙের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেয় আবহমান বাঙালি । তার ভরসার মাস এই কার্তিক ।

Saturday, October 29, 2022

তিতাভাত

তিতাভাত

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

প্রথমে পাতে থানকুনি পাতা ও আদা । ভাতের মধ‍্যে নিমপাতা । ডালের মধ‍্যে উচ্ছে বা করলার টুকরো । অথবা হেলেঞ্চার ডাঁটাকুচি দিয়ে মুগ ডাল । গিমে শাক, সর্ষে দিয়ে পেপের সুক্তো । শেষপাতে গ্রাইন্ডারে নিমপাতা চটকে সরবত । যাতে এগুলো খেলে যমে না ছোঁয় । নরমাংস তেতো লাগে তার কাছে । তাই পরিবারের গুরুজন মারা গেলে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর পরবর্তী প্রজন্মকে যমের হাত থেকে রক্ষা করতে অন‍্য আত্মীয়স্বজনরা তিতাভাতের আয়োজন করেন ।

Friday, October 28, 2022

কালো মেয়ে

কালো মেয়ে
---------------------------------
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
**********************
আলোরাতের কালো মেয়ে লো  হৈমন্তী ঘ্রাণ তোর গায়ে 
কুয়াশার দীঘল রুমালে তুই  রেখেছিস জড়ায়ে

 লিপিদাগ শীতের আমন্ত্রণের  বিরল টেরাকোটা
লিখেছিস অমোঘ আখরে কালোবরণ ফোঁটা

যতোই জানি তোর ঠিকানা এই যে আঁধারমায়াগলি 
ততোবারই ভুলে যাই আমার কষ্ট গেরস্থালি

  এত কাল অবলীলায় মেখে নিলি তুই অঙ্গে
 তোর আলো বিলিয়ে দিলি তোর রূপটানেরই সঙ্গে ৷

সারিন্দার ধুন

সারিন্দার ধুন 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

যাত্রার আসরে সারিন্দার সুর বেজে উঠলেই,
 ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখের প্রথম বউ হয়ে ওঠা
 নারীটাও বুঝে যেত এবার বিষাদের দৃশ্য  ।

 বাজনদারের হাতের ছড়ের ঘায়ে কেঁপে যায় তারযন্ত্র–
নবীন বউয়ের বুকের ভেতর ফেলে আসা প্রেমিকের সংলাপ 
সুরের স্রোতে কেঁদে কেঁদে ভেসে যায় ।

কুয়াশা ঘেরা মাঠে হেমন্তের জোছনা ঠেলে 
বেরিয়ে যায় রাসমঞ্চের দিকে ।গোপিদের ঘোমটার ছায়া বিষন্নতা মাখে শেষরাতে
বউটা নিজেও একেকজন রাসরমণীর মতো
 পাক খায় স্মৃতি প্রেমিকের চারধারে ।

 নিজে কান্নার সুর তুলে রাতের মৌনতা বিপন্ন করলেও 
সারিন্দা জানেনা সে কাকে কাঁদিয়ে যায় ।
 বউটা একাকী উঠে যায় আসর ছেড়ে
 সামনেই তার আলোকিত চিকচিকে নীল যমুনার জল ।

ঘরোয়া মানুষ

ঘরোয়া মানুষ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ঘাড় ফেরালেই একটা মুখও দেখা যায় না 
যে মুখে আছে প্রশান্তির আলো 
শুধু ভ্রষ্ট কথার রঙিন ফুলছড়ির তীব্র আলোয় 
ঝলসে যায় মানুষের মুখগুলো 

এই ঝলসানো মুখের মানুষগুলো স্বপ্ন ছুঁতে গিয়ে 
রাস্তায় দাঁড়ায় । রাস্তায় হাটে দল বেঁধে
 আশায় থাকে একদিন তারা পৌঁছে যাবে
 আকাশ গঙ্গার মৃদু আলোর শিবিরে ।

 আরো অনেকেই সাথী হয় স্বপ্নের খোঁজে
 দগ্ধ মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের পথ করে নেয়। 

মন্থন শেষে বিশেষ ভন্ড ফেলে অমৃত কলস নিয়ে 
দৌড়ে পালায় বাহুজীবীরা ।
 বারবার স্বপ্ন ভেঙে যায় মাটির মানুষদের ।

আঘাতের পর আঘাত পেয়ে আবার জড়ো হয় 
ঘরোয়া মানুষগুলো । আবার গড়ে মানববন্ধন ।
তালুর বাঁধনে বাঁধনে হয়ে যায় অলৌকিক আত্মীয়তা‌ ।
 ভাঙতে ভাঙতে বারবার ওঠে বন্ধনের গান ।

Monday, October 24, 2022

সুলেখা কালি ও আমার কাকা ।

আমার বাবার মুখে শোনা আমার এক কাকা ( নামটা মনে নেই, অমরেশ কিংবা কিরণ হতে পারে । উপাধি বর্ধন ) সুলেখা কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন । পুরোনো তথ‍্য ঘাঁটলে হয়তো পাবেন । দেশভাগ আমাদের সম্পর্ক নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে ।

Saturday, October 15, 2022

ছাতা

ছাতা

ছাতা হারালে আর পাওয়া যায় না । 
ছাতা যে হারাবে অনেকেই জানে । 
তবুও ছাতা হারায় । 
তারপর একদিন নিজেরাও ছাতা হয়ে ওঠে । 
পুরোনো ছাতার কথা ভুলে যায় তারা । 
নতুন ছাতারা জানে না যে তারাও একদিন হা্রিয়ে যাবে । যথারীতি তারাও হারায় । 
ছাতা, ছাতা হারানো, আবার ছাতা । 
এটাই নিয়ম ।

Wednesday, October 12, 2022

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অক্ষরের দীপান্বিতায় কবিতার বিভা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বড় রহস্যময় শব্দের শিল্প । কবিতা তো শব্দের চারুরাগ । চেতনার অন্তর্লীন বিস্ময়ভুবন । হৃদয়ের মসলিন শিল্প। হাজার আলোকবর্ষ থেকে ভেসে আসা শব্দের নিজস্ব স্রোত ।অসীম অনন্ত লোক থেকে সুরেলা আওয়াজ তুলে আসে শব্দ । আসে ঢেউ তুলে তুলে । ভেসে এসে বসে যায় জীবনের আখড়ায় । বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সব জোট বাঁধে । অশরীরী কে একজন অলক্ষ‍্যে থেকে এগিয়ে দেন শব্দমালাকে ।

 পারিজাত গন্ধ নিয়ে শব্দের পরিব্রাজন । শব্দ বসে বসে কথা হয় । সে কথায় থাকে অদ্ভুত মোহময়তা । সম্মোহনজালিকা । শব্দের গাঁথুনিতে যে কথার নির্মাণ তা হয়ে ওঠে নশ্বরতাহীন দৈবী টংকার । জীবনের মৃদঙ্গে আওয়াজ তুলে শব্দ জেগে ওঠে মুগ্ধ নয়নে । কুয়াশার বলিরেখা ভেদ করে জেগে ওঠে আলোর নির্ঝর । এক একটা চিত্র ভাষ্য স্পষ্ট হয় কাগজের বুকে কালো অক্ষরের স্বপ্নসন্ধানে । অন্তরেখ মায়া নদী বাঁক নেয় অবচেতনের পলিতে । 

আত্মউৎস খুঁজে নেবার জন্য আধিপথের দিকে ধায় মাধুকরী । পথের শুরুরও খোঁজ করতে হয় । সেখানে আলো জ্বলে । অতীতের দূমহলে ঘর তার । মাঠ পেরুলে পাথার । পাথারের নাম তেপান্তর । তেপান্তরের পরে আসে রূপকথার নদী ও সমুদ্র । সেসব অতিক্রমণের সাথে সাথে হারিয়ে যায় চেনা পথ । পুরনো দিগন্তের পরিচয় । আদ্যরশ্মির রেখা । 

পরিচয় এর জন্যই উল্টোসাধন । আলোদলিলের সন্ধান কর্ম তুলে দেয় শৈশবের শিস । ক্রমাগত অন্ধকারের মধ্যে পর্যটন শেষে আদিবীজ ভেসে ওঠে ফসিল স্তুপের ভেতর ।  সে বীজ হাতে নিলে দেখা যায় উজ্জ্বল সূর্যোদয় । ফিনকি দিয়ে ছোটা রশ্মিরেখার আকাশ আলোকিত । সে আকাশ থেকে পরিচিত নির্যাস ভাসে বাতাসে । আকাশমুক্ত বলেই তার গায়ে মৃগগন্ধ লেগে থাকে ‌ আকাশ স্বাধীন হতে শেখায় । ডানার কৌশল জানে আকাশ । নির্মিত ডানার বুনন আকাশের গোপন বিদ্যা । নির্মাণ শেষে বীজমন্ত্র দিয়ে দেয় মুক্তির । কুয়াশার চাদর থাকে না । থাকে ভ্রমণকথা । আলোর বিম্বে স্পষ্ট হয় ডানার ভেতরের রক্তের চলাচল ।  হাওয়ায় ভাসমান ডানায় সচল হয় শোণিতের কার্যক্রম।

শোণিতেরর তৎপরতার ভেতর নির্মাণ হয় দৃশ্যের মানচিত্র । সত্তার আনন্দবোধ কিংবা বেদনাবেহাগ ।শোণিতের চলমান বিন্দুও শব্দ হয় । জীবনের প্রহেলিকাকে যন্ত্রণার রূপ দেয় । যন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি নেয় বিষাদবিগ্রহ । সে বিষাদের অর্চনা করতে করতে জীবনের সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় হয় । সৌন্দর্য বিস্মিত করে স্রষ্টাকে । সৌন্দর্যের অপার আলোর বিভার ভেতর দেখা যায় কাব্যপ্রতিমাকে । তাকে ঘিরে জ্যোতির বলয় । কবি তার আত্মাকে নিয়ে বসায় সে বলয়ে । কবি তখন হাসে আপন মনে । আপন নির্মাণখেয়ালে । কবিতার দীপান্বিতায় কবির স্নান হয়।

Tuesday, October 11, 2022

শুভকথা

শুভকথা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
এই ভোরেই বেজে উঠেছে জলঘুঙুর
হাতের কলাপ ভিজিয়ে নিয়ে শীতল করেছ 
তোমার শরীর হে নওলকালের বাদলামেয়ে
ইচ্ছাপত্রে শুভকথা লিখে রেখেছ জলের আখরে
ভেজা কলাপাতার জলচিহ্ন সারা গায়ে মেখে
ভোরাই আহ্বানে যেন এক অচিন মায়াডাক
অপরকালের অতল ইসারায় যে পুরাণগান
ঘরে ঘরে ভালোবাসার সগন্ধী ধূপধোঁয়া 
ছড়িয়ে দিয়ে গেছ সুরের আবেশের মতো
আজো হে জাগতিক বর্ষণবেলায় তোমার
অশ্রুত প্রণয়ের গান বড়ো বেশি জরুরি যে
ছড়িয়ে দিয়ে যাও সে গান লোকালয়ে 
মানুষের হৃদয় এখন ফুল আর প্রেমের প্রত্যাশায়
বৃষ্টির কাতরতার মতো কাঙাল হয়ে আছে

নিপাট সজ্জনের গল্প

নিপাট সজ্জনের গল্প

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মহামারীর কালে শান্তিপল্লীর মানুষেরা কত ই না কষ্ট করেছে । দুবেলা খাবার জোটেনি । প্রতিবেশীরাও কাছে আসে না কেউ কারো । অসুখে ঘরে পড়ে মরে যায় । চিকিৎসা হয় না । মৃতের সৎকারের লোক আসে না ।

এই দুঃসময়ে এক নিপাট সজ্জন মানুষ আসে পল্লীতে । তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ভদ্র সভ্য মানুষ । সজ্জনের কথাবার্তায়, চলনে বলনে মার্জিত রুচির ছাপ আছে । মুখের ভাষায় যেন মধু ঝরে । এই দুর্দিনে তার কথায় সব দুঃখ ভুলে যেতে হয় ।  মানুষটি কি জাদু জানে ! দুঃখী মানুষগুলোর খোঁজখবর নেয় । পাশে এসে দাঁড়ায় । তার সঙ্গীরাও এগিয়ে আসে । তারা একেক সময় একেক রঙের মোমবাতি নিয়ে আসে । ওদের হাতের নানারঙের মোমবাতি জ্বলে ওঠে আর নানা রঙ ছড়ায় । ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ।

 সেই নিপাট সজ্জন মানুষটি আর তার সঙ্গীরা তাদের সামনে মোমের রঙিন আলো মেলে ধরে । তাদের আলোর গল্প শোনায় । তাদের গাঁয়ের কথা বলে । সে এক স্বপ্নের গাঁ । স্বপনপুর যার নাম । শান্তিপল্লীর অভাবী মানুষদের নিয়ে যেতে চায় সেখানে । সুখ আর সুখ ! তাদের সুখের দেশে পৌঁছে দেবার হাজারো প্রতিশ্রুতি দেয় । তাদের রহস্যময় ভাষায় সম্মোহিত হয় শান্তিপল্লীর মানুষ । 

শহরতলী থেকে উঠে আসা প্রান্তিক মানুষেরা অচিন গন্তব্যের পথে পা বাড়ায় । রঙিন মোমের আলো ঝলমল করে তাদের পথ । গ্রাম ছাড়িয়ে অরণ্যের অভ্যন্তরে আঁকাবাঁকা পথের দু'ধারে অলৌকিক সব ব্যানার সাজানো । স্বপনপুরের তোরণের ছবি তাতে সাঁটা । দুধারে এত সজ্জা । অথচ সারাটা পথ কাঁটা ঝোপে ঘেরা । শ্বাপদ-সরীসৃপস সংকুল ।  সরল মানুষ হাঁটতে থাকে কন্টকময় পথেই । পা থেকে রক্ত ঝরে । গা থেকে ঘাম ঝরে । তবুও সামনে আরো আলো আছে । এই ভেবেই ।

 সেই সজ্জন মানুষটির আরেক দল অনুগামী তাদের পেছন পেছন চলে । তাদের দ্বিচক্রযানের শব্দে বনভূমি কম্পিত হয় । তারা এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া পদচিহ্ন মুছে ফেলে । তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেইসব স্বপ্নকাম মানুষদের । আর ক্লান্ত মানুষদের সরিয়ে ফেলে পথ থেকে । চলতে চলতে একসময় এক শূন্যতার সামনে মানুষগুলো এসে দাঁড়ালে সজ্জন মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে, হে গণদেবতাগণ ! আমরা সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ফেলেছি । সামনে দেখো বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তর । খোলা আকাশ । মুক্ত বায়ু । স্বপ্নকাতর পথচলা মানুষের দল গুঞ্জন তোলে, কোথায় স্বপনপুর ! দেখছি নাতো কিছুই ! এ যে মরুভূমি  সামনে ! 

নিপাট সজ্জনের চোখ লাল হয়ে ওঠে । কে বলে এই কথা ? আমাদের একশো শতাংশ কাজ শেষ । এবার মরুভূমিকে নিয়ে প্রকল্প হবে । দূর্বিনীত সব ! 

হে দ্বিচক্রযানারোহীগণ ! চালাও চাবুক ! হিসফিসিয়ে উঠে একশ চাবুক ।গর্জে উঠে একশো দ্বিচক্রযান ।

'ঘুরে দাঁড়াও'...'

 সবাই মুহূর্তে হাজারো কন্ঠে প্রতিধ্বনি করে ঘুরে দাঁড়ায় । শূন‍্যভূমি কেঁপে ওঠে জনগর্জনে ।

Monday, October 10, 2022

ধ্বংসের মুখে ফেনী নদী

ধ্বংসের মুখে ফেনী

দক্ষিণের সীমান্তনদী ফেনীকে বাঁচাতে হলে একেবারে উজানের দিক থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে । ফেনীর উৎস থেকে আমলিঘাট পর্যন্ত দুপারে দুদেশের সীমা নির্দেশ করে । এই অংশটাতে এখন নাব‍্যতাই নেই । অথচ একসময় শিলাছড়ি-ঘোড়াকাপা, অযোধ‍্যা-দেওয়ানবাজার, সাব্রুম-রামগড়, রানিগঞ্জবাজার-বাগানবাজার, আমলিঘাট ইত‍্যাদি দুপারের গঞ্জ ও ব‍্যবসাকেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো নৌকা ভিড়ত । কিন্তু এখন আর নদীতে বর্ষাকালেও তেমন জল থাকে না । নৌকা চলাচল তো দুরস্ত । উভয়তীরেরই পাহাড়ে যথেচ্ছ মাটি কেটে নেওয়া, বৃক্ষছেদন ও বনধ্বংসের ফলে পাহাড় জলধারণ ক্ষমতা হারাচ্ছে । বছরের বেশির ভাগ সময় নদীতে জল থাকে না । নদীর বুকে চড়া পড়ে গেছে । এই সমস‍্যা নিরসনের ক্ষেত্রে দূই রাষ্ট্রের তরফ থেকে যৌথভাবে কর্মসূচি নিতে হবে । মুহুরী প্রকল্পের ফলে ভাটির দিক উন্নত হয়েছে সত‍্য কিন্তু উজানের মানুষের কাছে ফেনী নদীর মাছ কিংবদন্তীর পর্যায়ে চলে গেছে । অথচ ফেনীনদী একসময় রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউস, বাইলা, চিড়িং, চেলস, কাঁডা ইচা, ইলিশ ইত‍্যাদি নানারকম মাছের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল । হালদা নদীর মতো ফেনীনদীও ছিল নানা প্রজাতির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র । আজ সব ধ্বংস হয়ে গেছে । এসব নিয়ে কেউ কথা বলে না। নদীর দুইতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মনমুগ্ধকর । নাব‍্যতার উপযোগী করা গেলে এই নৌকাভ্রমণের মাধ‍্যমে পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটানো যেত । নৌপরিবহনের মাধ‍্যমে দুদেশের মধ‍্যে স্বল্পব‍্যয়ের বাণিজ‍্যসম্ভাবনাও সৃষ্টি করা যেত ।

Thursday, October 6, 2022

এবারের পুজো

এবারের পুজোর মরসুমে প্রকৃতিও বৈরী । এই উৎসবের  সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু প্রান্তিক মানুষের জীবিকাও । পুজোর তিনদিন সময়ের আয় দিয়েই পুজোর পরেই পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবার স্বপ্ন দেখেছেন । লিখতে গেলে তা বিশাল হয়ে যাবে । এত এত মানুষের শ্রমে ও শিল্পে সৃষ্ট মন্ডপের নান্দনিক আয়োজন । সব মিলিয়েই তো পুজোর আনন্দ মা ! এবারের আনন্দ কি জলে ভেসে যাবে আনন্দময়ী !

গত কবছর ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে যে, পুজোর সময়েতেই যেন আসল বর্ষাটা নামে । আর শারদোৎসবের সমস্ত আয়োজন মাঠে মারা যায় । বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আমাদের খন্ডের ঋতুচক্র তছনছ হয়ে গেছে । প্রকৃতি ক্রমশ রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে । এটা ক্রমশ বাড়বেই । মূলত ভারতীয় কৃষিজীবন এই এবারের পুজো

এবারের পুজো

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ঋতুচক্র মেনেই অতিবাহিত হত । বর্ষাবিদায়ের কালে শরতের আগমণে প্রকৃতি ক্রমশ শান্ত হয়ে এলেই হত দেবীর বোধনের আয়োজন । মাঠের ফসল তখন পূর্ণগর্ভা । তার দিকে তাকিয়ে আশায় বুক বাঁধে কৃষক । আর এই কৃষকদের ঘিরেই রয়েছে নানা পেশার মানুষ । যাদের জমি নেই, জিরেত নেই । বীজ বোনা আর ফসল তোলার মাঝখানে তাদের কোনো কাজ থাকে না । একটা টানা অভাবের মধ‍্য দিয়ে তাদের দিনাতিপাত করতে হয় । গ্রামীন অর্থনীতিতে এইসময়টা বন্ধ্যা সময় । আর এই সময়টাতেই হয় দেবীর বোধনের আয়োজন । অকালবোধন । মানে অসময়ের বোধন । দুঃসময়ের বোধন । এসময়ে এই অসময়ে সমাজের নানা প্রান্তিক পেশার মানুষকে যুক্ত করে কাজের বিনিময়ে খাদ‍্যের ব‍্যবস্থা করে দেয়া এই বোধনের আর এক উদ্দেশ‍্য । ভূস্বামীর দয়ায় নয় । অনুদানে নয় । কর্মের মাধ‍্যমে দুঃসময়ের রসদ সংগ্রহ করবেন প্রান্তিক মানুষ । শ্রদ্ধার শ্রমলব্ধ আয় তার জীবিকার দানাপানি । কৃষিভিত্তিক আর্থসামাজিক জীবনে এও ছিল দেবীবোধনের অন্তর্রহস‍্য । সেই ধারা আজও চলে আসছে ।
 
কিন্তু ক্রমশ প্রকৃতি  বৈরী হয়ে উঠছে । আমরা প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ব‍্যবহার করেছি এতদিন । প্রকৃতিকে আমরা নিংড়ে নিয়েছি শুধু । লুঠ করেছি তার সব সম্পদ । প্রকৃতিকে দিইনি কিছুই। তাই তার এত ক্ষোভ । এত রুদ্ররোষ । কেড়ে নিচ্ছে আমাদের লোভার্জিত সম্পদ । আমাদের হর্ষ, আনন্দ । উৎসব । আর তাতেই দেবীবোধনের এই সময়টা হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে । প্রকৃতির কাছে আমরা অসহায় । অথচ বছরের এই সময়টার দিকে মুখ চেয়ে অপেক্ষায় কত শত শান্ত শুষ্ক অসহায় মুখ ! পরের চাঁদায় গড়ে তোলা লাখোয়ারি পুজো জলে ভেসে গেলে বারো ইয়ারের কি আর ক্ষতি । কিন্তু এতে যে একদল অসহায় মানুষের রুটিতে টান পড়ে ।তাদের চোখের জলে বানভাসি হয় ।এভাবে চলতে থাকলে আগামীদিনে কি সম্ভব হবে দেবীর অকালবোধন ? শক্তিরূপা,শক্তিময়ীর কাছে আর্জি রাখা ছাড়া আর কোনো গত‍্যন্তর নেই আমাদের ।