Tuesday, September 28, 2021

তুরু রু

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু
পুব্বেতে উনাইলঅ ম্যাঘ
 পশ্চিমে বরষিলঅ গ
ভিজ্যে গ্যালঅ প্যান্ড্যালের কাপড়

ষাট ষাট বালাই ষাট
জল থৈ থৈ পথ ঘাট
এ্যামুন জাড়ে ভিজ্যে গ্যালঅ
সান্তালী বেটির কাঠামগুলো

তুরু রু তুরু রু তুরু রু
বাঁশি বজায় মারাংবুরু

Friday, September 24, 2021

হে চিরপ্রণম‍্য

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2937681976365454&id=100003710406641হে চিরপ্রণম‍্য ( প্রিয় শিক্ষক কাশিনাথ দাস স‍্যরের প্রয়াণে

Thursday, September 23, 2021

বি ষা দ প তা কা

তোমার খোঁজ চলে শেকড়ে ও শিশিরে
ফেরারি মেঘ আকাশকে ভুলিয়ে
চলে যায় নৌকো বেয়ে

বুকের ভেতর জলছত্র গান
বিপন্নতার বিষাদপতাকা নেড়ে
সন্ধ্যামাদুরের কাছে
ঘন হয়ে আসে

আকাশের ঠোঁটরঙা সন্ধ্যার দিকে
চোখ রেখে আউলাঘরের
পাশেই দেখি আমার পারঘাটা

ছায়ামাঝির অপেক্ষায় আছে
মায়ানোঙর আর কৃষ্ণডিঙি

আ। লো

এই কলহান্তরিতা বাদল দিনে 
রাত্রির মতো অন্ধকার নেমে এলে
তোমাকেই মনে মনে ভাবি

এমন সময় তুমি আলোর শরীর নিয়ে
আমার সামনে এসে দাঁড়ালে
সমস্ত অন্ধকার পালিয়ে গেল

তোমার বিচ্ছুরিত বিভায় আলোময়
হয়ে উঠলো আমার ঘর

*** আ  লো ***
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

Tuesday, September 21, 2021

শূ ন‍্য তা

শূন্যতা

দূরের দেও নদী কাছে এসে ভদ্রাসন ভেঙে দিয়ে যায় / জনপদজীবনের হাহাকার হয়ে মুছে ফেলে প্রাচীন বাস্তুচিহ্ন/ প্যারী মাসটারের টোলচিত্র উধাও হবার সঙ্গে সঙ্গে / কোথায় হারিয়ে যায় সদ্য খোলায় ভাজা সাদা মুড়ির উষ্ণ তৈলচিত্র / পাড়াতুতো ঠাকুমার বিবাহপ্রস্তাব একটা আবছা সংসারচিত্র/ দারিদ্র্যময় রোমান্স আর প্রেমদায় স্বপ্নমুখরতায় কবুতরের আত্মগুঞ্জন/ 

সে সব অতীত খাল বিলের স্রোতের কোমল দৌড় পেরিয়ে /  সখি আজ তোমার চোখের পর্দায়
চলমান আকাশচিত্র দেখি /

Thursday, September 16, 2021

স্ব দে শ

স্বদেশ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ছায়াপথের গভীর রেখা বেয়ে আলোর রোশনাই 
 মজে গিয়ে নিভতে থাকে অমৃতপথের বাঁধানো বাতির উজ্জলতা ।
 স্বপ্নের বদলে দেখতে দেখতে দ্রোহের তর্জমা গর্জে উঠে ।

ধৈর্যশীল নক্ষত্রের মতো অবিরাম জেগে থাকে
  বিন্দু বিন্দু আশ্বাসের রামধনু ।
ভেসে ওঠে নির্ঝঞ্ঝাট আকাশের হৃদয়ে ।

 আমাদের পিতামহগণ অক্লান্ত যাত্রিকের মতো
 এক দুরন্ত ট্রেনের সওয়ার হয়ে স্বপ্নযান দেখেছেন ।
 তাদের যুদ্ধ ভূমির গর্ভ গৃহে বারুদের মত জমেছে স্বদেশপ্রেম । 
একাকার হয়েছে স্বদেশ ও প্রেম ।
তাদের পায়ে বেজেছে অস্থির শেকড়ের ঝংকার ।
 বন্দী আকাশের গায় ফুটে ওঠে ত্রিবর্ণের আলপনা ।

আমরা বহুবর্ণে ঢেকেছি আমাদের গৌরব । 
জটিল হয়েছে ক্রমশ আমাদের যাপন ।
 স্বদেশ কার কিংবা কার নয় তারই সমীকরণ কেবল ।

 যে ঝড়ের শব্দে বেরিয়ে পড়ে চলে গেছে বহু প্রাণ । 
ফিরে আসেনি তোমার কোলে ;
 আর তাদেরই উত্তাল আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়ে 
 আমরা পালন করি প্লাটিনাম উৎসব । 
মানুষের স্বাধিকারের তমসুক বদলে যায় স্বপ্নহীন হালখাতায় ।
মানবতার গান বাঁধে অমানবিক মানুষ ।
একদল মানুষের দুখরাতে ভরে যায় দিনলিপি 
ভাতের থালা টেনে নেয় কালো পিঁপড়ের দল ।

প্রতিটি পনেরোর তুমি আলোকিত হয়ে ওঠো উজ্জ্বল রোদে 
আর আমরা সামনে দেখি আরো ফর্সা দীর্ঘ পথ।

Monday, September 13, 2021

সৎ ও সততা

মন রে, ভবের নাট‍্যশালায়
মানুষ চেনা দায় রে ।
শুধু সৎ হলেই হবেনা । সৎ প্রমাণ করার জন‍্যে কর্তার আখড়ায় নিয়মিত হাজিরাটাও দিয়ে যেতে হয় । নইলে সবই মিছে ।

Saturday, September 11, 2021

পান নিয়ে পাঁচালি : লোকসংস্কংতি ও লোকসাহিত‍্যে

পান নিয়ে পাঁচালি : লোকসংস্কৃতি ও সাহিত‍্যে

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে পূজা পার্বণ থেকে শুরু করে নানাবিধ ঔষধি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে পানের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে । আনুমানিক প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষের পান খাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল । সেই ধারা আজও প্রবহমান রয়েছে । আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের 'চিরঞ্জীব বনৌষধি' এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগ থেকে বাংলাদেশের পান এর ব্যবহার চলে আসছে । জাতকের গল্পে ও একাধিক পালি গ্রন্থেও তাম্বুল বা পানের ব্যবহার এর উল্লেখ পাওয়া যায় । হিতোপদেশেও পানের ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে । প্রায় ২ হাজার বছর পূর্বে  আয়ুর্বেদ গ্রন্থকার সুশ্রুত রচিত 'সুশ্রুত সংহিতা'য় আহার্য খাদ্যদ্রব্য পরিপাকের বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,গুরু ভোজনের পরে যেকোনো কোষ্ঠকারক বা কটু স্বাদযুক্ত ফল কিংবা সুপারি কর্পূর জায়ফল লবঙ্গ প্রভৃতি সহযোগে যেন তাম্বুল চর্বন করেন । পানের উপকরণের এই তালিকা থেকে বোঝা যায় সুশ্রুতের কালে পান খাওয়া বিলাসিতায় পরিণত হয়েছিল এবং তা কতখানি পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল । পণ্ডিতেরা প্রাচীনকালে আরও যেসব গ্রন্থে তাম্বুল বা পানের উদাহরণ পেয়েছেন তার মধ্যে 'চরক সংহিতা' ও কালিদাসের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

পান পিপুল পরিবারের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার লতাজাতীয় গাছের পাতা । আর্য ও আরবগণ পান কে তাম্বুল নামে অভিহিত করতেন। নিঃশ্বাস সুরভিত করা ও ঠোঁট ও জিহ্বা কে লাল করার জন্য মানুষ পান খায় । পান একটি গাছের নাম । এর পাতাকে পান বলা হয় । সংস্কৃত 'পর্ণ' শব্দ থেকে পানের উৎপত্তি । যার অর্থ পাতা । পান খাওয়ার ফলে এক ধরনের তাম্রবর্ণের রসের সৃষ্টি হয় মুখের লালার সঙ্গে মিশে । 'তাম্র' থেকে হয়েছে 'তাম্বুল' । পানের সঙ্গে সুপারি দেওয়া হয় । অনেকে সুপারি ছাড়াও পান খেয়ে থাকেন । ভোজের অনুষ্ঠানের শেষে নানাবিধ সুগন্ধিসহ পান পরিবেশন করে অতিথি কে প্রস্থানের ইঙ্গিত করা হয় । আমাদের নানা উৎসব- অনুষ্ঠান ও মাঙ্গলিক আচারে পান এর ব্যবহার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে রয়ে গেছে । মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল'-এ ধনপতি সওদাগরের বিবাহ উপলক্ষে পান-সুপারির উল্লেখ রয়েছে– 'তৈল সিন্দুর পান গুয়া /বাটা ভরি গন্ধ চুয়া / আম্র দাড়িম্বপাকা কাঁচা/ পাটে ভরি নিল খই / ঘড়া ভরি ঘৃত দই / সাজায়‍্যা সুরঙ্গ নিল বাছা ।' পান পরিবেশনের জন্য নানা বিধ সরঞ্জামের ব্যবহারও দেখা যায় । সে গুলোকে পানদানি বা 'বাটা' বলা হয় ।ঘুম পাড়ানি গানে শোনা যায় 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি যেও / বাটা ভরা পান দেব গাল পুরে খেও।'

পান ও পানের ব্যবহারের উৎস ও এদেশে আগমনের ইতিহাস সন্ধানে জানা যায় যে পান অস্ট্রো-এশিয়াটিক । পন্ডিতদের মতে পানের ব্যবহার ও  প্রসারণটি অস্ট্রোনেশীয় জনগণের নিওলিথ সম্প্রসারণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত । এটি প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ইন্দো- প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়ে । দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে ছিল ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত  । আদি ঠিকানা– ফিলিপিনস, কিংবা জাভা, বোর্নিও । তবে ভারতীয়দের ধারণা, পান একান্তই এ দেশের নিজস্ব সম্পদ ।

পানের জন্ম সম্বন্ধে বহু লৌকিক পৌরাণিক ও ধর্মীয় কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে । মহাভারতের উৎস থেকে জানা যায় যে, অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় পানের জন্য পাণ্ডবরা সারা দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলেন । শেষ পর্যন্ত পানের সন্ধান পাওয়া যায় পাতালপুরীতে, সাপের আবাসে । তখন বাসুকি তাদের অনুসন্ধানে সন্তুষ্ট হয়ে উপহার দেন তাঁর হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলি । সেই আঙ্গুল মাটিতে পোঁতার পরে তা থেকে জন্মায় পানের বল্লরী । সে গাছে ফুল নেই, ফল নেই । কেবল সবুজ পাতা । একারণেই সংস্কৃতে পানের আরেক নাম 'নাগবল্লরী' । এ ছাড়া আর একটি পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় যে, সমুদ্র মন্থনের ফলে উঠেছিল হলাহল । সেই বিষ নিয়ে দেবতারা প্রচন্ড সমস্যায় পড়ে যান । শেষে সেই বিষ গলায় ধারণ করে দেবাদিদেব মহেশ্বর নীলকন্ঠ হলেন । বিষের জ্বালায় তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়েন । তখন তার কপালের ঘাম ও শরীরের ময়লা সংগ্রহ করে একটি তামার পাত্রে রাখা হয় । সেই মিশ্রণ থেকে জন্মায় এক সুদর্শন পুরুষ । নারায়ন তার নাম রাখেন 'তাম্বুলপুত্র' । জন্মানোর পর সে যায় নাগলোকে । তার রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় নাগকন্যা । সেখানে দুজনের বিয়ে হয় । তাদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করে পানরূপী 'নাগবল্লরী' । অনেকে আবার মনে করেন যে অর্জুন স্বর্গ থেকে পানের চারা চুরি করে এনেছিলেন । সেটি তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে লাগিয়েছিলেন । সেই থেকেই মর্তে পানের ব্যবহারের প্রচলন হয় । শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়ঘটিত আরেকটি কাহিনি থেকে জানা যায় যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একবার গোপনে বিজেতার ঘরে যান । শ্রীকৃষ্ণকে হাতেনাতে ধরার জন্য শ্রীমতি রাধারানি বিজেতার গৃহে উপস্থিত হন । অন্তর্যামী শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পেরে স্বয়ং সুপারি গাছের রূপ  ও বিজেতা পান গাছের রূপ ধরে লতার মতো তাঁকে জড়িয়ে থাকেন । এ কারণে পানসুপারি দেবতার প্রসাদ হিসাবে গণ্য হয় । এছাড়াও কথিত আছে যে, দেবর্ষি নারদ বৈকুণ্ঠ থেকে এই সুপারি পৃথিবীতে মানুষের ভোগের জন্য এনেছিলেন । শাস্ত্রমতে ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাদেব চুনে । পানের খিলিতে বাস করেন ত্রিদেব বা ত্রিনাথ । পানের আরেক নাম সপ্তশির । যেকোনো ধরনের পানে সাতটি শিরা আছে ।

মার্কণ্ডেয় পুরাণে পান খাওয়ার বিধিও বর্ণনা করা হয়েছে । বলা হয়েছে পানের অগ্রভাগে পরমায়ু, মূল ভাগে যশ, এবং মধ্যে লক্ষীর অবস্থান । এ কারণে এই তিন অংশ ফেলে তারপর পান খাওয়া উচিত । মূল ভাগ খেলে কঠিন রোগ, অগ্রভাগ খেলে পাপের ভাগী, কমবে আয়ু আর পানের বোঁটা খেলে নষ্ট হবে বুদ্ধি । পিকও ফেলতে হবে নিয়ম মেনে । পান, সুপারি, মশলায় তৈরি পান চিবানোর পর সৃষ্ট প্রথম রস বিষের মত, দ্বিতীয় রস রেচন, ও তৃতীয় রস অমৃত । এই কারণে প্রথম দুবার এরস খাওয়া চলবে না । শুধু পানই নয় । রয়েছে পান মশলা খাওয়ার নিয়মও । সকালের পানে থাকবে বেশি সুপারি । দুপুরের পানে খয়ের এবং রাতে চুন । সুপারি ছাড়া পান খাওয়া মহাপাপ । এই  পাপস্খালনের জন্য করতে হবে গঙ্গা স্নান ।

আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে পান এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিবাহে । বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু হয় পানের খিলি দিয়ে । বিবাহ সংক্রান্ত প্রাথমিক নিমন্ত্রণকে বলা হয় 'পানচিনি' নিমন্ত্রণ । বিবাহের জন্য পাত্র কন্যার বাড়িতে রওনা হওয়ার সময় নিয়ে যায় 'যাত্রার' পানসুপারি  । মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গলে আছে ধনপতি বিবাহ উপলক্ষে পানগুয়া নিয়ে যাওয়ার কথা– 'তৈল সিন্দুর পানগুয়া / বাটা ভরি গন্ধ চুয়া  / আম্র দাড়িম্ব পাকা কাঁচা । /পাটে ভরি নিল খই / ঘড়া ভরি ঘৃত দই / সাজায়‍্যা নিল বাছা ।' বিবাহে পান-সুপারির ব্যবহার বংশবৃদ্ধির প্রতীক । কারণ এগুলির প্রচুর ফলন হয় । বিবাহের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে এগুলোর ব্যবহারে ভাবি দাম্পত্য জীবনকে সফল ও ফলবানরূপে দেখার কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটে । 'কুলাসাজানো' বা বরণডালা, অধিবাস, গায়ে হলুদ  সর্বত্রই থাকে পান আর সুপারির অবস্থান । জামাই বরণ এর সময় এর ব্যবহার রয়েছে । মুকুন্দরাম তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু উপাখ্যানে কালকেতু ফুল্লরার বিবাহ  সভায় উপস্থিত হয়ে জামাতাকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে শিরে ধান দূর্বা 'নিছিয়া' পান ফেলে এবং গলায় মালা পরিয়ে প্রচলিত আচারের মাধ্যমে বরণ করতে দেখা যায় । 'করিয়া বিরল স্থান/ জামাতারে করে মান/ প্রেমবতী ব‍্যাধের অবলা । / শিরে দিয়া দূর্বা ধান /  নিছিয়া ফেলিল পান / গলে দিল বনফুল মালা ।' অথবা বিবাহের সাত পাকের অনুষঙ্গ হিসেবে চন্ডীমঙ্গল কাব্যে শিব গৌরী বিবাহে পাই– 'শিবে প্রদক্ষিণ গৌরী কৈল সাতবার । / নিছিল পান কৈল নমস্কার ।।

বাঙালির বিবাহের আনন্দঘন অনুষ্ঠান বাসর ঘর সংক্রান্ত আচার । বাসর ঘর বরবধূর কাঙ্খিত ও আনন্দময় অনুষ্ঠানস্থল । বাসরঘরে নতুন বরকে নিয়ে নানাবিধ ও কৌতুক আনন্দের আসর করা হয় । বরপক্ষ কন্যাপক্ষ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পর নানা প্রতিযোগিতা ও হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে । বাসর ঘরে কন্যাপক্ষ পাত্র পক্ষের জন্য পান সাজিয়ে রাখে । পানের মধ্যে ঝাল লঙ্কা ঢুকিয়ে নতুন জামাইকে বিব্রত করতে দেখা যায় শালিকা কিংবা কনের বান্ধবীকে । সতর্ক বর পানের খিলি খুলে তবে মুখে দেয় । আবার এই পান খাওয়ার আগে পাত্রপক্ষকে কন্যা পক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় । সেখানেও থাকে পানকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ধাঁধা । এরকম একটি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক ধাঁধা যেখানে পানের জন্মকথা জানতে চাওয়া হয় ।  প্রতিবেদকের সংগৃহীত এরকম একটি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক ধাঁধা নিচে তুলে ধরা হলো–প্রশ্ন :  :পান খাও পন্ডিত ভাই কথা কও লা রে / পানের জন্ম কোন অবতারে? / যদি না কইবা পানের  কথা / ছাগল অই খাইবা হর্বার পাতা ।'পাত্র পক্ষের একজন উত্তরের বিনিময়ে অসম্ভব কিছু দাবি করে বসে–'আগে আন ছ'মন খই  ন'মন দই / তই যাই পানের কথা কই ।' সবশেষে একজন আবার ছড়া কেটে ধাঁধার উত্তর দিয়ে দেয়– 'লঙ্কায় জর্মিছিল পানগুয়া রাবণের দেশে / ছিরাম গেছিল যন সীতার তালাইশে /   পোপনপুত্র হনুমান গেছিল তার সাথে / হারি আইনছিল চারা রামের অজ্ঞাতে / সাত মুড়া হব্বতে আনি ছাড়ি দিল /  বারইয়ে পাই তারে যতন করি ছিল / টেকনাফের গুয়া রে ভাই মইশখালির পান / বারইয়ে জানে এই পানির সন্ধান / নিদাইন্না বৈশাখে গুয়ায় ছাড়ে ছড়া / বাইষ‍্যাকালে বরের মাঝে পানের লতা ধরা / এক কান করি ছিঁড়ে  আর বিড়া করি রাখে / বারইয়ার ঘরে ঘরে এই পান থাকে / চাইরগায় এক গন্ডা আডারো গন্ডায় বিড়া / বাজার তুন কিনবা পান ভিতর খাইবা ছিঁড়া ।'

প্রবাদ, প্রবচন, লোকসংগীত, ছড়া ইত্যাদি লোকসংস্কৃতির বহু উপাদান এর মধ্যে প্রাণের উপস্থিতি পাওয়া যায় । প্রবাদের মধ্যে যেমন উল্লেখ পাওয়া যায়–'ভালোবাসার এমন গুণ / পানের সঙ্গে যেমন চুন / বেশি হইলে পুড়ে গাল /কম অইলে লাগে ঝাল ।'  'ছাগলের মুখে পড়ল পান/  পান বলে গেল মোর জান ।' 'খাবায় ভাত না খাবে পান / হেই ভাতের কিবা মান ।' অর্থাৎ নেমন্তন্নের পর পানের ব্যবস্থা না করলে সেই নেমন্তন্নের কদরই থাকেনা । খনার বচনে পান চাষের পদ্ধতি সম্বন্ধে উল্লেখ রয়েছে–'ষোল চাষে মূলা / তার অর্ধেক তুলা / তার অর্ধেক ধান / বিনা চাষে পান ।' বাংলা লোক সংগীতেও দেখা যায় পান প্রসঙ্গ । 'সুজন মাঝি কই যাও / একখান কথা কইয়া যাও / ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা / পান খাইয়া যাও ।'  ছড়ায় পাওয়া যায়– 'কিবা দেশে আইলাম রে ভাই কিবা দেশের গুন / একই গাছে পান-সুপারি একই গাছে চুন ।' 'পান খাইও রসিক জামাই, কথা কইও ঠারে ।'

প্রাচীন বাংলা কাব্য চর্যাপদ ও মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য গুলো লোকসংস্কৃতির উপাদানে পরিপূর্ণ । এই সাহিত্যসমূহে বাঙালির লৌকিক জীবন  যতটা আন্তরিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা মধ্যযুগের আর কোন আঙ্গিকে লক্ষ্য করা যায় না । বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার অনুষ্ঠান এবং নিজস্ব বিশ্বাস, সংস্কার বিধিনিষেধ প্রায় প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে ফুটে উঠেছে চর্যার ২৮ নম্বর পদে পাই– 'হিঅ তাঁবোলা মহাসুহে কাপুর খাই / সুন নৈরামণি কন্ঠে লইয়া মহাসুহে রাতি পোহাই ।' অর্থাৎ–শবর তাম্বুল কর্পুর খায় 
, শূন‍্য নৈরামণি আলিঙ্গনে মহা সুখে রাত ভোর করে । ময়নামতির গানে নায়িকা ময়না যে পান খেতেন তার উপকরণ ছিল গুয়ামুরি, ধনিয়া, জৈষ্ঠমধু, লং, জায়ফল, এলাচ, দারুচিনি ও কর্পুর । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তো তাম্বুল খন্ড নামে একটি অধ্যায়ই রয়েছে । বড়াই এর কাছে রাধিকার রূপবর্ণনা শুনে তাঁর রূপে মোহিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ বড়াই এর হাতে ফল তাম্বুল পাঠিয়ে রাধার কাছে প্রেমের প্রস্তাব পাঠান । এখানে বলা হয়েছে–'কথা খানি কহিল বড়ায়ি / বসিয়া রাধার পাশে ।/ কর্পূর তাম্বুল দিয়া রাধাক বিমূখ বদনে হাসে ।' কবিকঙ্কন এর চন্ডীমঙ্গলে আছে, রাজার নির্দেশে ধনপতি নৌকা নিয়ে যাত্রা করেন সিংহলের উদ্দেশ্যে । কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখেছেন– 'নানা আভরণ পরি / ডালি করে নিলো ঝারি/ বাস করে তাম্বুল সাঁপুরা /' চন্ডীমঙ্গলে দেখা যায় ভাঁড়ু দত্তের পেটে ভাত না জুটলেও পান খাওয়া চাই । 'অধরে না চিনে অধরে না চিনে অন্ন, তাম্বুল পান মুখে' । আবার মনসামঙ্গলে লক্ষিন্দরের বিবাহ পালায় কবি লিখেছেন–'ধর ধর। বলাধিক খাও গুয়া পান /  লখাইর সঙ্গে কটক যাইবে যাইবে সাজাইয়া আন ।' এছাড়া আরও লক্ষ করা যায়–১) দাসীতে যোগায় পান গালে গোটা গুয়া ( ধর্মমঙ্গল ) ২)পান বিনা পদ্মিনীর মুখে ওড়ে মাছি ( বিদ্যাসুন্দর ) ৩)তাম্বুল রাতুল হইল অধর পরশে ( পদ্মাবতী– আলাওল ) ৪) আধ মুখে ভাঙ্গ ধুতুরা ভক্ষণ / আধই তাম্বুল পুরিরে ( অন্নদামঙ্গল ) ৫)ভোজন করেন রাম পরম হরিষে/  দধি দুগ্ধ দিল রাজা ভোজনের শেষে ।। সুতৃপ্ত হইল সবে করে আচমন / কর্পূর তাম্বুল করে মুখের শোধন  রামায়ণ) ৬)সুবাসিত কর্পূর তাম্বুল পুষ্প নিয়া / যজ্ঞ পূর্ণ করে বেদ উচ্চারিয়া । ( মহাভারত ) ৭)সিদ্ধান্ত যোগী পান নাহি খায় / পানের বদলে তারা হরতকি চাবায় ।  (গোপীচন্দ্রের গান)৮) আচমন করিয়া প্রভু বসে সিংহাসনে/  কর্পূর তাম্বুল জোগায় প্রিয় ভক্তগণে ।( চৈতন্যচরিতামৃত) । ৯)হাথক দরপণ/ মাথক ফুল / নয়নক অঞ্জন/ মুখক তাম্বুল ( বিদ্যাপতি)১০) খেজুর পাতা হলদি মেঘ নাম জলদি / এক বিরা পান ঝুপ ঝুপাইয়া নাম ( ময়মনসিংহ গীতিকা )১১)জলপূর্ণ ঘটে সিঁদুরের ফোটা / আমের পল্লব দেবে তাহে এক গোটা / আসন সাজায়ে দিবে তাতে গুয়া পান / সিঁদুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান ।(লক্ষ্মীর পাঁচালি )১২)কৃষ্ণ তন্ডুলেতে মিশাইবে গুড়/ সন্দেশ শর্করা আর তাম্বুল কর্পূর ( শনির পাঁচালি ) ।

দুর্গোৎসবের সময় দশমীর দিন দুর্গাকে সিঁদুরে রাঙিয়ে, মিষ্টিমুখ করিয়ে, পান, ধান, দূর্বা দিয়ে বিদায় জানানোর রীতি-রেওয়াজ রয়েছে । পান চাষের ক্ষেত অর্থাৎ পানের বরে স্ত্রীলোকের প্রবেশ নিষেধ রয়েছে । এতে নাকি পান নষ্ট হয়ে যায় । ছোটো শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্যের দরুন মলত্যাগে অসুবিধা হলে গুহ্যদ্বারে পানের বোঁটা দিয়ে রাখলে সুফল পাওয়া যায় এছাড়া পেট ব্যথা করলে পান পাতায় ঘি মাখিয়ে গরম করে পেটে সেঁক দিলে ব্যথা কমে । এছাড়া পানের আরো লোকওষধি গুণ রয়েছে ‌। ১)পান পাচনশক্তি বাড়ায় ।২)গলার আওয়াজ পরিষ্কার করতে পান উপকারী ৩)রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পান সাহায্য করে ৪)পান খেলে মুখের স্বাদ ফিরে আসে ৫)হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে ৬)পান খেলে পেট পরিষ্কার হয় ৭)সর্দি কাশি হলে পানের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায় ৮)পানের সাথে গোলমরিচ লবঙ্গ মিশিয়ে খেলে কাশি কমে ৯)মুখে ঘা হলে পানের মধ্যে কর্পূর দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে বারবার পিক ছেলে ফেললে সুফল পাওয়া যায় ১০)পানের মধ্যে থাকা গুলকন্দ কর্মক্ষমতা বাড়ায় ।

পান খাওয়া একটি বিলাসিতার অঙ্গ । যথার্থ পানরসিক সাজিয়ে গুছিয়ে পান খেতে বসেন । পান খাওয়ারও তাই নানা সরঞ্জাম রয়েছে ।পানের বাটা, পানদানি, পানের ডিবি, চুনের কৌটো, পিকদানি, জাঁতি ইত্যাদি । বয়স্কদের জন্য পান চূর্ণ করে পরিবেশন করার জন্য রয়েছে হামানদিস্তা । এইসব সরঞ্জামের গঠনশৈলীতে রয়েছে নানা কারুকাজ, নানা নকশা । কাঠের,লোহার, রুপার কিংবা পিতলের হয়ে থাকে এসব সরঞ্জাম ।পান সাজার মধ্যেও রয়েছে নির্মাণ কুশলতা ।নানা আকারে দৃষ্টিনন্দন করে তৈরি করা হয় পানের খিলি । এককথায় এর মধ্যে বাংলার লোকশিল্প শিল্পের নিদর্শনটি স্পষ্ট ।

পান নানা আভিচারিক ক্রিয়ায়ও ব্যবহার হয় । যেমন পান বশীকরণ মন্ত্রের প্রধান উপাদান । যাকে বশ করা হবে শনি কিংবা মঙ্গলবারে তার কাছ থেকে একখিলি পান সংগ্রহ করে আনলে গুনিন তা দিয়ে তার যাদু-টোনা করেন । এরকম অন্য আভিচারিক ক্রিয়ায় একদমে বাজার থেকে পান কিনে আনতে হয় ।

পান যেমন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে আছে তার ব্যবহারিক গুণে তেমনি পানকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটে যেতে পারে । ইতিহাসের উদাহরণ থেকে সংগ্রহ করা ঘটনাটি বিবৃত করে এই প্রবন্ধের সমাপ্তি টানব । পানে বিষ মিশিয়ে শত্রু বা অনাকাঙ্ক্ষিত জনকে হত্যা করার কাহিনি ইতিহাসে রয়ে গেছে । ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের সে কাহিনী বর্ণনা করেছেন । মুঘল আমলে আগত ইউরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ছিলেন ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার  (১৬২০- ১৬৮৮) । ১৬৫৮ সালে যুবরাজ দারাশিকোর অনুরোধে তিনি শাহজাহানের চিকিৎসক হিসেবে দিল্লিতে এসেছিলেন ফ্রান্সে ফিরে তিনি ভয়েজেস (১৬৭০)নামে একটি ভ্রমণ কাহিনি লেখেন । তার লেখা বিবরণে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহান একসময় সন্দেহ করতে শুরু করেন যে, তার বড় মেয়ে জাহানারা নজর খাঁ নামে এক সুপুরুষ যুবকের সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত । সম্রাট প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে যুবককে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন । একদিন তিনি সভাস্থলে নিজ হাতে ওই যুবককে একটি পানের খিলি উপহার দিলেন । যুবক তার প্রেমের সফলতার স্বপ্নে মশগুল হয়ে সম্রাটের দেওয়া পানের খিলি নিঃসন্দেহে গ্রহণ করল । পানটি খেয়ে দরবার ছেড়ে বাড়ির পথ ধরার জন্য পালকিতে উঠলো । কিন্তু তীব্র বিষক্রিয়ায় যুবকটি পথেই প্রাণ ত্যাগ করল ।

Thursday, September 9, 2021

'আগুনপাখি'–র আলোচনা

দ্রোহ ও দাহভরা 'আগুনপাখি'

আমাদের চারপাশে অহরহ অসংখ্য কবিতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে । সেই সমস্ত কবিতায় কতটা জীবন আছে, কতটা সাহস, প্রেরণা কিংবা সান্ত্বনার অভিব্যক্তি রয়েছে তা মূল্যায়ন করা কবিতার এক  ধ্রুব ইঙ্গিত । সময়ে সময়ে কবিতার সৌন্দর্য দর্শনে জীবনকে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায় । এক এক কবিতায় এক এক দৃষ্টিতে জীবনের আলো-ছায়ার রং বদল ঘটে এবং বস্তুবাস্তবের অর্থ ও তাৎপর্য অনেক পাল্টে যায় । কবিতার কথা তার জীবন তার দাহ দ্রোহ কবিকে চিহ্নিত করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ১৫ আগস্ট ২০২১ জ্ঞানবীক্ষণ, উদয়পুর, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত রূপন মজুমদারের প্রথম কাব‍্যগ্রন্থ 'আগুনপাখি'র বারোটি কবিতায় সেই অনুভবই ধরা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।

কবি রূপন মজুমদার মজুমদার এই সময়ের এক শক্তিমান তারুণ্য । তার কবিতা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে অনুসরণের কথা বলে বারবার । তার কবিতায় দেখি–' মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকা/আমার পূর্বপুরুষের রক্ত ঘাম (রক্ত ঘাম) অথবা 'বাবার রেখে যাওয়া সেই.../জামাটির গায়ে/ এতকালের লেপ্টে থাকা ঘামের গন্ধ/ কেমন যেন বারুদ বারুদ ঠেকাচ্ছে । (উত্তরাধিকার সূত্র) । এই উত্তরাধিকারকে, এই কর্মময় জীবনকে পুরুষানুক্রমে ধরে লালন ও যাপন করার কথা কবিরূপন মজুমদার বারবার বলেন তার কবিতায় । 'সেই কাজ ফুল হাতে আসবে ঠাকুরদাদা থেকে বাবা/ এভাবে একদিন বাবা থেকে আমি..../ যার ভার বইতে বইতে আমার মেরুদন্ড বেয়ে যায় ।'( ফুল )
কবিতা রূপনের কাছে দ্রোহপ্রতীক । 'জ্বলন্ত ইশতেহারে রেখেছি হাত,/ আগুনে পুড়ছে পান্ডুলিপি/ ছিড়া জিন্সের পকেটে রাত্রি ভরে/পুড়ে যাওয়া দুহাত মেলেছি ।' (আড়ি-১) অথবা 'আমার শরীরে পা রেখে.../ দ্রোহের কবিতার অন্তরীণ আগুন/ জ্বলে ওঠে নীরবে ।
 নিলাম হয় প্রত্নপ্রভাত আর.../ হরিৎ মাটির সোঁদা গন্ধ । তবু পেশী টান টান করে ধরে রাখে বেঁচে যাওয়া ভয়ার্ত স্বরলিপির সুর ।/আগুনপাখি)এবং বারবার ব‍্যর্থ হয়ে মাতৃভূমির প্রতি শিশুময় অভিমানে বলতে পারেন 'সাথে পড়ছে চোখের ঘুম/ নিলাম ওঠা বউয়ের শাড়ি/ ভরা জনসভায় দাঁড়িয়ে বলছি/ ভারত বর্ষ তোমার সাথে আড়ি । /আড়ি-২)

তরুণের রক্তে ক্রোধ, বিক্ষোভ অবশ্যম্ভাবী । অবহেলা আর বঞ্চনায় ক্রুদ্ধ হলেই কবি অনায়াসে বলে উঠেন 'এখন অক্ষর দেখলে জোট বাঁধতে ইচ্ছে করে । ঠিক যেমন করে বাধে রাজনৈতিক নৈশ প্রহরীরা' ।( অভ্যাসের আগুন )  'আবার অখন্ড অন্ধকার সহস্ত্র পদচরণে/ বেড়ে ওঠে বৈঠাহীন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে/কত মানুষের খেরওয়ারি হুল (পাহারা) 'পেরেক বিছানো পথ হেঁটে যেতে যেতে.../ মুছে দিই ধুলোর উপরে যাবতীয় ইতিহাস ও সম্ভাবনা' (পাহারা)

মস্তিষ্কের কোষে এত যে দাহ, এত যে যন্ত্রনা তবুও কবির 'ইদানিং ঈশ্বর দেখতে ইচ্ছে করে/চোখ বুজলেই দেখি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৈভব ।/মিছিল ঝুলছে রাত্রিদিন ।(ঈশ্বর)। ঈশ্বর কিংবা দৈব নিয়ন্ত্রিত জীবনে কবির মুক্তি আসেনা । আসে না তৃপ্তি ।জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত হয় । তবুও জীবন ঘনিষ্ঠ কবি জীবনকে ভালোবেসে যান । আর 'আড়ালে উঁকি মেরে দেখি,/ জোনাক মুখ পুড়ছে চিতাকাঠে ।/কংক্রিট বিছানো কযোজন ভূমি পেরিয়ে গেলে,/ সিগনালের ওই পাড় হতে কারা যেন স্থির বিশ্বাসে ডাকে/মিশে যেতে গহীন অন্ধকারে'।(সিগন‍্যাল) কিন্তু হতাশায় নিমজ্জিত হতে চান না কবি জীবনের শেষেও আবার এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেন ।ফিরে ফিরে আসতে চান এই মাটিতে । কবি বলেন 'আমার লাশ পোড়া মুঠো মুঠো ছাই,/ তোমার ভরসাবৃত মাটিতে ছড়িয়ে দিও,/ আমি গঙ্গায় ভেসে বিলীন নয়/ এ মোহিনী প্রকৃতি মানুষের মাঝে থাকতে চাই '(ছাই)।
প্রথম প্রয়াসেই বাংলাকবিতার অঙ্গনে কবি নিজেকে জোরালোভাবেই হাজির করতে পেরেছেন ।

Wednesday, September 8, 2021

আ য় জী ব ন আ য়....

আয় জীবন আয়...

মা ছুটছেন । মা ছুটছেন । রাতের ঘরোয়া পোষাক আলুথালু । কোথায় যাবেন এত রাতে ? কোথায় আশ্রয় ? পেছনে দগ্ধ ভদ্রাসন । রাজপথে আগুনের লেলিহান শিখা । আর কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী । দম বন্ধ হয়ে আসে । কানে আসে শিকারীর পশু ঝলসানোর বীভৎস উল্লাস !  মা ! মা ! কই যাও মা ! আমারে লইয়া যাও । আমিও যামু তোমার লগে । মা...আ....আ.....আ......।

এত রক্ত কেন ? কেন এত রক্ত ? কেন এত আগুন ? এত আগুন কেন ? বীভৎস ধোঁয়া ! অন্ধকার মেঘের মতো ধোঁয়া ! দৈত‍্যের মতো বিস্তৃত শরীর মেলে আকাশ ঘিরে ফেলে । আগুন আর ধোঁয়ার মিশেলে ভয়ংকর মারণ যজ্ঞশালা । অশ্বের হ্রেষা । অস্ত্রের ঝনঝন ।

যাজ্ঞসেনী পড়ে আছেন দ‍্যূতসভার ভূমিতে । প্রাণপণ প্রয়াস সম্ভ্রম রক্ষার । বস্ত্রাঞ্চলে পাশবিক টান । রজরক্তে লাল স্ফটিকফ্লোর ।

জতুগৃহের যজ্ঞাগ্নির শিখা ঠেলে বেরিয়ে আসুক দগ্ধপ্রাণ  । জীবনের ভান্ড । স্বাহা ও সহায় ।

অ ঘ ট ন

তুমি আমার কথায় রেগে যাও বলেই
বার বার উসকে দি তোমার অচিন অভিমান

আমার শব্দের ময়ালে শুরু হয় তোলপাড়

কবিতা হওয়ার জন্যে সে কী দৌড়ঝাঁপ
আমি আবডালে দাঁড়িয়ে কেষ্টঠাকুর

বলো তাহলে কেমন অঘটন