Thursday, December 30, 2021

সনন্ধিমুহূর্ত

সন্ধিমুহূর্ত
             
           তীব্র হুল্লোড়, পটকা আর বাদ্যগর্জনে ভেঙে যাচ্ছে নৈশনিরবতা ৷ ক্রমান্বয়ে সন্ধিক্ষণের দিকে এগোচ্ছে রাত ৷ শেষ নির্যাস নেবার জন্যে নোঙর খুলে দেওয়া হয়েছে ৷ কালের জাবেদা খাতায় এই বিভাজনের কোনো বুকমার্ক নেই ৷ তবুও ক্ষণজীবী মানুষেরা অপসৃয়মান সময়ের সিঁড়িতে দাগ রেখে দেবার জন্যেই করে এত আয়োজন,  এই বোধন ৷ সুখের অতীত আর আশার আগামীর মাঝে একটু আনন্দ আস্বাদনের নিষ্কলুষ প্রয়াস ৷ পেছনের ছায়াপথে চুম্বনচিহ্ন রেখে সামনের নীহারিকার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় যেন চলমান মুহূর্তকে প্রাণবন্ত করে তুলতে উৎসুক ৷

এক একটি অনাগত পল তাই আগামী আনন্দরাগের প্রাকবয়ন ৷ সন্ধিপুজোর দিকেই যেন আমাদের মার্চ-পাস্ট ৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া একাত্ম এলাকায় ৷

Monday, December 27, 2021

দুটি কবিতা

১.

হে শীতের হিম, তুমি অসফল হবে জেনেও সারারাত শিশিরে ভিজিয়ে দাও ঘাসের শরীর বিনিদ্র সেবিকার মতো ৷

তোমার উদার পারানির আশায় সারারাত 
জেগে কাটায় সমবেত  ঘাসপরিজন ৷


২.
আঙুল কেটে কলম বানিয়ে যে রক্তের আখর লিখেছো প্রান্তিক কবি
তার পাঠ হবে কোন পাঠশালায়
কবে আর সেই পাঠ নিয়ে ভূমধ্যরেখার দুই পাশে বানাবো বিনম্র বাগান ৷ যেখান থেকে ফোটা ফুলের সৌরভ ছড়াবে দশদিগন্তের 
পাতার কুটির থেকে আকাশমিনারে

কবির আঙুল কবে যে নির্দেশক হয়ে উঠবে প্রেমের পদাবলিতে

Thursday, December 9, 2021

একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর রামগড় পাক হানাদালমুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুম

একাত্তরের ৮ডিসেম্শেবর রামগড় পাক হানাদারমুক্ত  হওয়ার পর সাব্রুম

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে । এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড়ের সুলতান আহমেদ, বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি তদানিন্তন মুখ‍্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সেতু দিয়ে এপারথেকে ভারতীয় সৈন‍্যের যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশের অভ‍্যন্তরে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ।

 ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । সেদিন দুপুর থেকেই সারা সাব্রুমে প্রচন্ড উল্লাসের বাতাবরণ বয়ে যায় । মুহূর্তে স্কুল-অফিস-কাছারি ছুটি হয়ে যায় । বাজি পটকা ফুটতে শুরু করে । তখন সাব্রুম বাজার ছিল ছোটো । দোকানপাট কম ছিল । যে কয়টা বাজেমালের দোকান ছিল সবগুলো থেকে খুঁজে পেতে কয়েক বস্তা সবুজ আবির যোগাড় করা হয় । শরণার্থী শিবির গুলো থেকে খুঁজে আনা হয় বাংলাদেশের পতাকা । মাইকে বাজতে থাকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এবং 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি' গানদুটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের রমনা ম দানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড । রাজপথে শুরু হয়ে যায় আবির নিয়ে মাখামাখি । সারা রাস্তায়, নদীর পাড়ে মানুষ গিজগিজ করছে । কে শরণার্থী, কে স্থানীয় বোঝার উপায় নেই । লোকে লোকরণ‍্য । মানুষ ওপারে যেতে চাইছে । বি এস এফ বাধা দিচ্ছে । কে শোনে কার কথা ।  ফেনী নদীর উপর রামগড় থানা ও সাব্রুম বাজার বরাবর যে অস্থায়ী সেতু ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার পাক হানাদাররা সেটা ভেঙে দিয়েছিল । পরে তা আবার মেরামত করা হয় । রামগড় মুক্ত হওয়ার  বার্তা পেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সব বাধা ঠেলে সেতু পেরিয়ে, নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে ওঠেন । একদল উৎসাহী এপার থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে ওপারে গিয়ে রামগড়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন । সেদিনের সাব্রুমের তরুণ-কিশোরদের অধিকাংশই সেদিন ফেনী নদী পেরিয়ে রামগড় পৌছেছিলেন । স্কুল ছুটির পর ছাত্ররা বাই-সাইকেল নিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে সারা রামগড় চক্কর দিয়েছিল । যাদের বাড়ি সাব্রুম শহরের পশ্চিমদিকের গ্রাম ছোটোখিল, মনুঘাট ছিল তারা আনন্দের আতিশয‍্যে সাইকেলে চড়ে রামগড় পাকা সড়ক ধরে বাগানবাজারে গিয়ে নদী পেরিয়ে এপারের রানিরবাজার ঘাটে উঠে বাড়ির পথ ধরেছিল । ছাত্রদের এই অ্যাডভেঞ্চার পরবর্তী বেশ কিছুদিন জারি ছিল । বয়স্করাও কিছুদিন বাজারসদাইও করেছিলেন রামগড় বাজার থেকে । 

৮ ডিসেম্বর বিকেলে রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান'-এ ভূষিত হন । তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

Monday, December 6, 2021

আট ডিসেযম্বর একাত্তর ও সাব্রুম

প্রশ্ন :-- সাব্রুম মহকুমা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা । সেখানকার রাষ্ট্রীয় জীবনের সুঃখ দুঃখ ত্রিপুরাবাসীকে আন্দোলিত করে । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের অবদান ও ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ রামগড় হানাদার মুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুমবাসীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন ।
উ:-- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে । এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড়ের সুলতান আহমেদ, বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি তদানিন্তন মুখ‍্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সেতু দিয়ে এপারথেকে ভারতীয় সৈন‍্যের যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশের অভ‍্যন্তরে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ।

 ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । সেদিন দুপুর থেকেই সারা সাব্রুমে প্রচন্ড উল্লাসের বাতাবরণ বয়ে যায় । মুহূর্তে স্কুল-অফিস-কাছারি ছুটি হয়ে যায় । বাজি পটকা ফুটতে শুরু করে । তখন সাব্রুম বাজার ছিল ছোটো । দোকানপাট কম ছিল । যে কয়টা বাজেমালের দোকান ছিল সবগুলো থেকে খুঁজে পেতে কয়েক বস্তা সবুজ আবির যোগাড় করা হয় । শরণার্থী শিবির গুলো থেকে খুঁজে আনা হয় বাংলাদেশের পতাকা । মাইকে বাজতে থাকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এবং 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি' গানদুটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের রমনা ম দানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড । রাজপথে শুরু হয়ে যায় আবির নিয়ে মাখামাখি । সারা রাস্তায়, নদীর পাড়ে মানুষ গিজগিজ করছে । কে শরণার্থী, কে স্থানীয় বোঝার উপায় নেই । লোকে লোকরণ‍্য । মানুষ ওপারে যেতে চাইছে । বি এস এফ বাধা দিচ্ছে । কে শোনে কার কথা ।  ফেনী নদীর উপর রামগড় থানা ও সাব্রুম বাজার বরাবর যে অস্থায়ী সেতু ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার পাক হানাদাররা সেটা ভেঙে দিয়েছিল । পরে তা আবার মেরামত করা হয় । রামগড় মুক্ত হওয়ার  বার্তা পেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সব বাধা ঠেলে সেতু পেরিয়ে, নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে ওঠেন । একদল উৎসাহী এপার থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে ওপারে গিয়ে রামগড়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন । সেদিনের সাব্রুমের তরুণ-কিশোরদের অধিকাংশই সেদিন ফেনী নদী পেরিয়ে রামগড় পৌছেছিলেন । স্কুল ছুটির পর ছাত্ররা বাই-সাইকেল নিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে সারা রামগড় চক্কর দিয়েছিল । যাদের বাড়ি সাব্রুম শহরের পশ্চিমদিকের গ্রাম ছোটোখিল, মনুঘাট ছিল তারা আনন্দের আতিশয‍্যে সাইকেলে চড়ে রামগড় পাকা সড়ক ধরে বাগানবাজারে গিয়ে নদী পেরিয়ে এপারের রানিরবাজার ঘাটে উঠে বাড়ির পথ ধরেছিল । ছাত্রদের এই অ্যাডভেঞ্চার পরবর্তী বেশ কিছুদিন জারি ছিল । বয়স্করাও কিছুদিন বাজারসদাইও করেছিলেন রামগড় বাজার থেকে । 

৮ ডিসেম্বর বিকেলে রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান'-এ ভূষিত হন । তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

Saturday, December 4, 2021

সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি সাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানেও বহু কালীমন্দির রয়েছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ‍্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ‌। অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ‍্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার  প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।

এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ‍্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত‍্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনী নদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী  কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ‍্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত  'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন‍্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই  মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত‍্যেক অমাবস‍্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ  মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী দৈত‍্যেশ্বরী কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ‍্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।

দেবী দৈত‍্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত‍্যছরাতে পাওয়া যায় ।  সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত‍্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে দৈত‍্যেশ্বরী ।  আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাকে সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের  একটি ছরার পাড়ের  পাহাড়ের একটি গুহার মধ‍্যে এই বিগ্রহটি ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহাথেকে রাজকর্মচারীরা তুলে  নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ‍্যই ছিল ।
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন‍্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত‍্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত‍্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত‍্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত‍্যু হলে দৈত‍্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক‍্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত‍্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
        দ্রুহ‍্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।

রাজা দৈত‍্যের সময়কাল থেকে  রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত‍্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ‍্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত‍্যআশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকা দেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আ । অস্ত্রবিদ‍্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ‍্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত‍্য অরণ‍্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে  রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত‍্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক‍্যের পুত্র রত্নমাণিক‍্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত‍্যনারয়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ‍্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন ।বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ‍্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত‍্যনারায়ণ । দৈত‍্যনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত‍্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা হয় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ‍্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন‍্যকুল তাঁদের পূর্বজবংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক‍্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ )সময়ে এই রাজ‍্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ‍্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব‍্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকূটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ‍্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
 এবিষয়ে রাজ‍্যের বিশিষ্ট কবি লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে,'এ অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ এলাকা ডাকাত বা মগ দস‍্যুদের আস্তানা ছিল । এই দস‍্যুদের পূজিতা দেবী হিসাবে 'দৈস‍্যেশ্বরী' নামকরণ হতে পারে । এই দৈস‍্যেশ্বরীই রাজপুরুষ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর সংস্কৃতায়িত হয়ে 'দৈত‍্যেশ্বরী' হয়েছে । এছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বাংলাভাষায় ( নোয়াখালি )  দৈত‍্যকে দৈস‍্য উচ্চারণ করা হয় । যেমন, ব্রহ্মদৈত‍্যকে বলা হয় ব্রহ্মদৈস‍্য । কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দৈত‍্য শব্দটিই আসছে দেবীর নামকরণে উৎসরূপে ।' (সাব্রুমের দেবী দৈত‍্যেশ্বরীর ইতিহাস –অশোকানন্দ রায়বর্ধন ) । গবেষণার জন‍্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।

যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত  ব‍্যানার্জী পরিবার ( রাজ‍্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব‍্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস‍্য সতীশ ব‍্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব‍্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । তার প্রভাব সাব্রুমেও পড়ে ।

সাব্রুম অত‍্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব‍্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব‍্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত‍্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব‍্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব‍্যবসায়ী  গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের সদ‍্যবিজয়ী জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন‍্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস‍্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন‍্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক‍্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।

চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার,  কার্তিকী অমবস‍্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি  দেহত‍্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্র বর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ‍্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
 রাজন‍্য আমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দির সংলগ্ন তহশিলী কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ‍্যাহের জন‍্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । রাজার আমল  থেকে এই পুজো চলে আসছে কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল‍্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান‍্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান‍্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । য়ন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব‍্যয় নির্বাহ হয় ।

রাজন‍্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ‍্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর নামে পরিচিত । মন্দিরের কালিকাবিগ্রহ একখন্ড পাথরবিশেষ । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।

দৈত‍্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন‍্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ‍্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল  তাঁদের জন‍্য দৈত‍্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ‍্যেশ‍্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত‍্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ‍্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ‍্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ‍্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন  করতে আসেন ।


বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গঙ্গোপাধ‍্যায় মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন‍্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ‍্য তেমন কাজ হয়নি ।

সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত‍্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন‍্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ‍্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ‍্যক ।

হুঁইচা

কৃষিকাজে ব‍্যবহৃত একটি লোকসরঞ্জামের নাম 'হূঁইচা' ।। 'হুঁইচা' কথাটা ভুলেই যেতে বসেছিলাম । বরাক বাঁশের তৈরী বাঁক যার দুটো মাথাই থাকে সুঁচালো । সুঁচ বা হুঁইচের মতো দেখতে । তাই হুঁইচা । ধানের বোঝা গেঁথে কাঁধে তুলে নেওয়ার জন‍্যে বাঁকের মতো এটি ব‍্যবহার করা হয় । তারপর এক বিশেষ তালে গতির সঙ্গে পা ফেলে ধানের বোঝা বাড়ি নিয়ে আসা । চলার ছন্দে ঝুলন্ত বোঝা থেকে ঝুলন্ত ধানের গোছা থেকে মৃদু একটা মিষ্টি শব্দ বেজে যায় । ওই শব্দই চাষার বুকে সফলতার আনন্দ দেয় । ফলানো ফসল যখন চোখের সামনে মাঠে মারা যায় তখন চাষার দুঃখের অবকাশ থাকেনা ।
এক কর্ম কাজ । আর এক কর্ম ভাগ‍্য । দুটো নিয়েই কৃষকের জীবন । 'কর্ম কইল্লে অপরাধ নাই' । তীব্র উদ্দীপক বার্তা । আবার 'কর্ম করি আইনছো কি কইর্বা' । ভাগ‍্যকে দায়ী করেই জীবন গড়িয়ে নেওয়া সরল কৃষকের । 


Thursday, December 2, 2021

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার

ভালোবাসা মুগ্ধ অন্তরের পদাবলি ।
 ভালোবাসা শুধু নিঃস্ব করে না । হৃদয়ের আত্মীয়ও করে । আর সেই ভালোবাসা যদি হয় কবিতায় সহবাস, তাহলে সেই হংসধ্বনি সমোচ্চার আন্দোলিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে । কবিতার অনুভবে যারা ঋদ্ধ তারা পরস্পরের আত্মার ধ্বনি শোনে । হৃদয় থেকে বেরিয়ে এ নিনাদ দেশকালের সীমা টপকে যায় ঋজুগতিতে । এক চিরায়ত বন্ধন সৃষ্টি হয় আত্মীয়তার মতো । স্থানিকতা থেকে মহাস্থানগড় । উৎস থেকে অনন্তবাথান । এক অদৃশ্য হাওয়াপথ তৈরি হয়ে যায় অমোঘ কলকন্ঠে । ঘন বনে ঢাকা  টিলাপথের শেষ প্রান্তের উত্তুঙ্গ টংঘর থেকে হাইটেক প্রাসাদের অন্তঃকোন অবধি ।

কবিতার দীঘল শরীর যখন বুনো নৈঃশব্দ্যের থেকে উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, তার শরীর থেকে সরে যায় সমস্ত প্রাকৃত বাকল । অন্তর্লীন রহস্যের সাত সমুদ্দুর উদোম খেয়াঘাটে যেন প্রণয়প্লাবন ছড়িয়ে দেয় । ফিনকি দিয়ে উঠে শীৎকারবগাথা । কামগান । বিগত শ্রাবণে অবিশ্রান্ত স্নানের পর তার শরীরে মেদুর কারুকথা ভেসে ওঠে । মুক্তোর রেণুর রুপালি জলজ ভ্রূণ কুহকবার্তায় টেনে আনে সৌররশ্মি । থেকে থেকে উড়ালপাঁচালি আর গোধূলিতানের নম্র সুর বেড়ে ওঠে মুগ্ধ চরাচরে । তখন ক্ষীরনদীর ধারা যেন অবিরল ভেসে যায় পাললিক জ্যোৎস্নার অলৌকিক চরাচর
পথে ।

তোমার আমার মাদকনির্যাস হে কবিতা, ভূর্জপত্রের ঠোঙায় ভরে রেখে দেবো অমোঘ জীবনে । আমি আজ আর্যপুত্র, তুমি আর্যনারী । আমাদের মিলনবাসনার পানশি ঝরেপড়া শিউলি তুলে নেবে ।  কামে ও প্রেমে টইটুম্বুর করে দেবে আমাদের প্রণয়সন্ধ্যা । জীবনের আসন্ন কৌমকোমল বার্তা অবিনাশী সমর্পণের মায়ায় বিদগ্ধ শিস দিয়ে যাবে বিষাদের হাটে । কলকল কথাপুঞ্জ অনিঃশেষ স্রোতে গড়িয়ে যাবে পাতাসবুজ অরণ্যের গা ঘেঁষে । শব্দের পর শব্দের সাতকাহন পলিমাটির গভীরে চলে যাবে । মানুষ আর মানুষীর চিরন্তন কথাই তোমার বশীকরণভাষা । এই ভাষাতেই অনন্তজীবন আর মৃত্তিকামৃদঙ্গের তান । দেহাতি চাঁদের ওলান থেকে ঝরে পড়া সন্ধ্যার নস্টালজিয়া নিঃসঙ্গে হেঁটে যায় অনন্তের আলপথে । একথা জানে আখড়ায় বাউলের কন্ঠ ।

লোকচরাচরে শেষ উপত্যকা পেরিয়ে মহাবিশ্বের রহস্যের দিকে যাত্রা কবিতার । সেই মহাসড়কে জোছনার ডিঙা আছে কিনা কে জানে ! সেখানে চলে কি জীবনতাঁতির অনন্তবয়ন ? সেখানে কি খলনারীর  ফাঁদ পেতে রাখে বিষকন্ঠী মরণবালা ? 

এ দুয়ের দ্রোহে আর প্রেমের কবিতার অভিযাত্রা । মহাকবিতার সৃজন । এ এক আঁধারঘেঁষা ছলাখেলা । এখানে কবি অবোধ খেলোয়াড় । তার উষ্ণীষ গড়ায় শব্দের ভূমিতে । জগত বালুকার বুকে লেখে সে জীবনের আদ্যপাঠ আর মরণের বিরহপত্রিকা । এইসব শব্দপুঞ্জে জেগে ওঠে আনন্দজলধারার কবোষ্ণ দুপুর ।
 রোদ্রের লালনগীতি সুরের প্লাবন নিয়ে মেঠোশরীরে উঠে আসে কাম নদীর জল ভেঙে । সঞ্জীবনীকথায় পাতাঝরা কথক পরকীয়া প্রহরে গোধূলিছায়ায় পবিত্র গলায় মায়া শোলক আওড়ায় । সমস্ত শব্দের অর্থ তখন মধুকূপী ঘাসের মতো শরতের বাতাসে নেচে ওঠে । উত্তরের দৈববাতাস হরিহর প্রতিমার যুগলমূর্তিকে ফিনফিনে কাঁপন দিয়ে যায় । কলঙ্কের টিপ খুলে চন্দ্রকরোটি যেন অষ্টমঙ্গলার ঘরের দেওয়া অবধি উঁকি দিয়ে দেখে । মানুষবিহীন খেয়াঘাটে তখন কাঁপতে থাকে অনাথ নৌকো আর মুমূর্ষু নদী । নিবিড় শীর্ণ গাংচিলেরা উড়ে যায় অগ্রগামী ভোরের দিকে । অফুরান পদাবলির বিরহগান মায়া সন্ধ্যায় তির তির করে কাঁপে । বাতাস আনমনা হয়ে যায় কবিতার জন্য ।