Friday, July 30, 2021

বর্ণমালার জোছনা

বর্ণমালার জোছনা
   অশোকানন্দ রায়বর্ধন

এক.
   মাঝরাতে গাঁয়ের গভীরে কীর্তনের আওয়াজ ভেসে উঠলে শিথিল শরীরে শিহরণ ওঠে । সমস্ত লৌকিক যন্ত্র জড়ো হয় এক উঠোনে । তাদের শরীর কথা কয় সুরেলা ভাষায় । সেখানেও তোমার মকরন্দ ঘ্রাণ । এক একটা ধ্বনি এক একটা ভাষার নিক্কন । সে ভাষা ক্লান্ত গ্রামরমণীর । ও বর্ণমালা !  সে ভাষা পরিশ্রমী প্লাবনকথা । তোমার নিত্যদিনের দারিদ্র্যপাঁচালি । সৃজনরক্তের আদ্যঘ্রাণ সে ভাষায় বেঁচে ওঠে । বৃষ্টিমাখা হলুদ নদী যুবতী হয় । তার উথলানো ভাষায় বেঁচে ওঠে নারী ও নৌকো । জোছনার ডিঙায় শরীর বিছিয়ে দিয়ে  নদীও মানুষী । তার তরল শরীরের নগ্নতায় চলমান জীবনের ফর্দ খুলে যায় । অন্তরের সঞ্চয়মধু কলরব করে ওঠে । আহা ! এক একটা বর্ণ । রৌদ্রের লালনগন্ধে বাতাসের গহনা তার গায় । ওরা মাতে ওঠে হজাগিরি দোদুলে । লোকায়ত নাচের মুদ্রায় চন্দ্রকোটর থেকে দৈবউঁকি দেয় কবিতাকরোটি । চলমান পানশালা মুখর ও মুখরা

পেট্রোল

তেল ফুরোলে লাইন হবে
সুযোগ পেলে ব্ল্যাক হবে
চিরস্থির কবে তেল হায় রে পেট্রোল পাম্পে
************************************
************************************
************************************
সেই ধন্য নরকুলে
লোকে যারে নেপো বলে
মনের মন্দিরে নিত্য দধির স্বপন

গোবিন্দ ধরের জন্মদিনে

আজ তোমার জন্মদিন ৷ পঞ্চাশে পা রেখেছ তুমি ৷ কবিতার বারান্দায় হেঁটে যেতে যেতে তুমি ফিরে ফিরে দেখেছ বাংলাসাহিত্যের লতাবিতান ৷ গোবিন্দ তুমি নিকুঞ্জপথের ধূলিরেখায়  একা কখনও হাঁটতে চাওনি ৷ সাথে নিয়েছ তুমি গোষ্ঠসখাদের ৷ একাকী উত্তরণে তুমি বিশ্বাসী নও ৷ সম্মিলিত শব্দের রাজযোগালিদের নিয়ে চারুনির্মান ৷ তুমি সুন্দর ৷ তাই তোমার নির্মানও সুন্দর হোক তাই তুমি চাও ৷ সকল নবীন সৃজনের প্রকাশস্পৃহাকে তুমি প্রকাশ করে আনন্দিত ৷ আবেগরুদ্ধ ৷ পিতার মতো তৃপ্ত ৷ তাই তুমি প্রকাশকও ৷ প্রতিটি একক ব্যক্তিত্বের মহতী বৈশিষ্টকে তুমি মর্যাদার সঙ্গে মূল্যায়ন করো ৷ অগ্রজজনকে শ্রদ্ধা জানাতে জানাতে তুমিই শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে উঠেছ অজান্তে ৷ তোমার সৃজনের সৌরভ কাঁটাতার ভেঙে ফেলে ৷ দেশকালের সীমানাকে অবলীলায় দুহাতে সরিয়ে দেয় ৷ ছড়িয়ে পড়ে আসমুদ্রসমতট ও গৌড়বঙ্গের জনপদে, অরণ্যে ৷ তোমার চলার পথের দুপাশ থেকে রাশি রাশি উৎসুক হাত এগিয়ে আসে তোমার দিকে করমর্দনের জন্যে ৷
 মানুষ ও মৃত্তিকাকে তুমি কেমন অপার মমতায় ভালোবেসে ফেলো ৷ দেওমনুপলিবিধৌত প্রকৃতির বুকেই তোমার ভালোবাসার নক্সিকাঁথা বিছানো আছে ৷ এখানেই তোমার কবিতাদয়িতা ৷ তোমার সাঁঝসকালের স্বপ্নসুন্দরী ৷ তোমার লেখনইন্ধন ৷ যজ্ঞসমিধ ৷ অর্ধশতাব্দীকাল তোমার নিরন্তর মুগ্ধপর্যটন ৷সামনে আরো, আরো পথ আছে পেরুবার ৷ হেঁটে যাবার ৷ সে পথেই এগিয়ে চলো তুমি ৷ সে পথেই খুঁজে নাও শুশ্রূষা ৷ আরো আরো বহু পল, বহু দন্ড, বহু কাল ৷ নিরবধি এগিয়ে যাও ৷ এগিয়ে চলো ৷

Wednesday, July 28, 2021

জ্বালানি বনাম জ্বলুনি

জ্বালানি বনাম জ্বলুনি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

নোয়াখালির একটা প্রবাদ আছে  :
ক্ষুধা থাইকলে হুদা অ রচে
ভেঙ্গুলে কামড়াইলে বুইড়গা অ নাচে ৷
এর অর্থ, খিদের পেটে সব্জিহীন অন্নেও অরুচি হয় না ৷ আর ভিমরুলের কামড় খেলে বুড়োকেও নৃত্য করতে হয় ৷ আমারও সেই অবস্থা ৷গতকাল দুপুরবেলা আগরতলার বটতলা থেকে নাগেরজলা স্ট্যান্ডে আসছি হেঁটে ৷ জ্বালানির অভাবে সাব্রুমের দিকে গাড়ি কম আসছে আগরতলা থেকে ৷ পড়িমরি করে ছুটছি বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে ৷ ওখানে ফলের দোকানের সারি ৷ তারই একটা দোকান মালিকের গামছার তাড়া খেয়ে উড়ে এসে আমার বাঁ হাতের কব্জির নীচের ফুলো অংশটাতে রাগ ঝাড়ল ৷ সঙ্গে সঙ্গে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলাম যেন ৷ বুঝে ওঠার আগেই কালাচাঁদ উড্ডীন হলেন আর এক ফল দোকানের দিকে ৷ ততক্ষণে কালার বিষে আমার অঙ্গ জরজর ৷ দেখলাম কোবরেজ বদ্দির অভাব নেই এই ভিড়ে ঠাসা শহরে ৷শুধু ট্রাফিক ছিল না এই ফুটপাথ দখলকারীদের তুলে দিতে ৷ একজন বললেন মধু লাগান ৷ একজন বললেন,  একটা খেজুর লইয়া ডইল্লা দেন ৷ কালহা আমারে ঘাঁই দিছ্ল আমি খেজুর ডইল্লা দিছি অহনে ব্যথা নাই ৷ যে দোকানের সামনে এই ঘটনা সে ভাবলো, তার মাগ্ না একটা খেজুর গচ্চা যাবে ৷ সে মুহূর্তে হা রে রে রে করে উঠল, না না খেজুরে কুছতা অইত' না ৷ ওই পানের দোহানডাত্তে উট্টু চুন লইয়া লাগাইয়া দ্যান ৷ এই কথাগুলোর ফাঁকেই আরএকজন বদ্দি মোক্ষম ঔষধ খুঁজছে এদিক ওদিক তাকিয়ে ৷আরে রাহ' রাহ' উট্টু গুবর লাগাইয়া দিলে ব্যথা- ফুলা একদম কইম্মা যাইবো গ ৷ সে খুঁজছিল শহুরে বেওয়ারিশ ষাঁড়েদের গোবর ৷বলাবাহুল্য সে উপচিকীর্ষুও ব্যর্থ হয় ৷ অগত্যা আমি পান দোকানদারের থেকে একটু চুন নিয়ে লাগিয়ে কিছুটা স্বস্তি ৷ ক্ষতস্থানের রক্তের উপর চুনের পোঁচ লাগিয়ে ভাবছি, লালকে কেন ভয় রে ওভাই বলে গান গাইলেও সাদাও মোটেই ফেলনা নয় ৷ পশ্চিমবঙ্গীয় বন্ধুরা এটা ঠিক বুঝেছেন ৷  আসল কথায় আসছি ৷ দুদিন নিঃসঙ্গ ঘরে বসে অনুভব করছি প্রবাদের মাহাত্ম্য ৷ ঔষধপত্র, ইনজেকশান কিছুকেই তোয়াক্কা না করে এই বরষায় হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ........, না থাক,  বুড়ো বয়সে আর কথা বাড়াচ্ছি না ৷ দয়া করে পাঠকবর্গ মন্তব্য করলে নাচ থামিয়ে একটু বিরতি নিতে পারব ৷

Sunday, July 25, 2021

মনসার গান

মনসার গান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শ্রাবণের কান্নরাতে কাঁপানো মোমউঠোন
যুবতী দুলে দুলে সাপিনীসুরে গেয়ে যায়
মনসার বিলাপি গান । আলোপিদিমে
উজ্জ্বল হয় তার নাকফুল
বেয়ে গড়ানো অশ্রুপ্রপাত । 
ধুয়ার সুরে গলে যায় পদ্মাপুরাণের 
তুলট পাতার শরীর ।

গ্রামশিল্প অবিরাম হৃদয়ের চিঠি ওড়ায়
প্রাচীন ডাকবাক্সের কুঠুরি থেকে ।
এ গানেও কালসন্ধ‍্যার তীব্র দাগ থেকে
মুক্তির জন‍্যে আসরের দোহারেরা 
একসুরে গায়, ওমা বিষহরি–
করতলে এঁকে দাও করোনাবিহীন সকাল‌ ।

চারটি কবিতা

উইকএন্ড কার্ফ‍্যু

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

টারবাইন জীবনেও মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হয়
পাহাড়ে মেঘের রাজত্বে রোজকার বন্দীত্ব ছুঁড়ে ফেলে
উদার এবং উদাস হতে মন চায়

মেঘেরা কতো সরল সাদা আর দূরগামী জাহাজ
পাহাড়ের ছাদে ছাদে তাদের যৌথ ভ্রমণ

সপ্তাহে দুটো দিনই তো কেবল মুক্তির ট্রেন
বেহায়া উইকএন্ড কার্ফ‍্যু গিলে খায় সব উল্লাস

নিঃশব্দে রাতের পর রাত পেরোতে হয়
অপর কোনো বিরতির হাটবারের আশায় ।



বর্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বর্ষার জল পড়ে জেগে ওঠে গাছপালা,
পাখিদের স্নান, সাপের শঙ্খলাগা,
পাতারা রান্নাবান্নায় মগ্ন সবুজ ক্লোরোফিলে ।

খেতের লাঙলের ফলায় জেগে ওঠে জানকীর মুখ
জান কবুল করে বৃষ্টিতে ভেজে চাষি
ভাতশিল্প রচনার কৌশলে মেলে ধরে মাটির ইজেল

কৃষাণবউয়ের ফেসবুকে অংকুরের আভা
ফসলের আশায় নেভায় রাতশয‍্যার কুপিবাতি ।



লকডাউন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সব মিরাক্কেল রসিকতার নয় । মঞ্চের হাসাহাসি
মাটিতে নামলেই জন্ম নেয় একাকীত্বের ।

মানুষ এখন ভীষণ সাহসী পুলিশের তোয়াক্কা করেনা ।
প্রশাসকও ক্রমাগত কড়া লকডাউন লাগিয়ে যায় ।
ডিউটিসফল পুলিশ । চৌমাথায় দাঁড়িয়ে
মোবাইলে পাবজি খেলে কিংবা অন‍্য থানায়
বদলি হয়ে যাওয়া তরুণী সতীর্থের সঙ্গে
ভিডিও চ‍্যাটিংএ গভীর মনযোগী ।

মানুষ মরে আর প্রশাসন হাসে
ভেবোনা, সামনে আরো কঠোর কার্ফ‍্যু আছে ।



জার্নি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ভালোবাসি বলেই অ‌পেক্ষায় থাকি
অন্ধকারেও দেখি ওই ডালিমমুখের বিশ্বাস

ভালোবাসা হারায়না ।
বাক‍্যহীন বেড়ে যায় প্রতিটি সুগন্ধী সন্ধ‍্যায়
মৃগনাভির সম্পদ নিয়ে এগোতে থাকে ।

বেলাশেষে যে করুণ আলো দিগন্তে ছড়ায়
তাকে নিয়ে গবেষণা করলে পাই বিদায়ের তর্জমা

অপরপথের পথিক কবিতা দুরপথে সরে যায়
তার কাছে পৌঁছুতে গেলে চাই মায়াশব্দের ছু-মন্তর

অবেলায়ও তোমার শুভনাম নিয়ে আমাদের যৌথজার্নি ।

Friday, July 23, 2021

পুরানো দিনের কথা

ফেনির ইলিশ ৷ ফেনি নদীর গলদা চিংড়ি ৷ 

বলবেন স্বপ্নের কথা ৷ ফেনি নদীতে একসময় ইলিশ এবং গলদা চিংড়ি অবাধে পাওয়া যেত ৷ ফেনি নদীর পাড়ে বসবাস করেন এমন আপনার প্রতিবেশী যে কোন বয়স্ক জনকে জিজ্ঞাসা করলেই সন্দেহমুক্ত হবেন ৷ অন্তত চুরাশি পঁচাশি সাল পর্যন্ত ফেনি নদীতে প্রচুর পরিমানে ইলিশ মাছ এবং গলদা চিংড়ি ( কাঁডা ইচা)  পাওয়া যেত ৷ আমাদের এপারের তরুণ যুবকদের মধ্যে বলেন্দ্র চক্রবর্তী,কানাইলাল নাথ, হীরালাল নাথ, মানিক বসাক, কালাচাঁদ দে, কানাইলাল মজুমদার, মিলন মজুমদার, মিলন মালি, বিভীষণ বড়ুয়া ছোটোখিলের মনোরঞ্জন ভৌমিক, ছানালাল ভৌমিক, জাপান দে,মানিক মালাকার, দুলাল মালাকার, দীপেন আচার্জী, দ্বীপের পাশের পাড়া মজুমদারদের সব তরুণরা,কান্তি ভৌমিক এছাডা় আরো অনেকে রয়েছেন যাঁদের ফেনি নদীতে কাঁডা ইচা এবং ইলিশ ধরার অভিজ্ঞতাও রয়েছে ৷ ছোটোখিলের কালিপদ ভৌমিক তো ফেনি নদীর চরে বালির উপর দৌড়ে দৌড়ে একসময় জাতীয় স্তরে শ্রেষ্ঠ দৌড়বিদের পুরস্কারও নিয়ে আসে ৷ নদীতে যখন ইলিশ মাছ উজায় তখন জলের মধ্যে একটা রেখা তৈরি হয় ৷ সেই রেখা ধরে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসা ইলিশ লক্ষ্য করে বালির উপর দৌড়ানো যে কী কষ্ট তাই কালিপদর দৌড় প্র্যাকটিসের সহায়ক হয়েছিল ৷ আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এই কথাগুলো বলছি ৷ আমি জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারতামনা ৷ ইলিশ মাছ ধরা হত ছটকি, আধাছটকি জাল দিয়ে ৷ আমি ছিলাম ডুলা ধরন্যা ৷ জাল আলগানো আর ছুঁড়ে মারা আমার অসাধ্য ছিল ৷ তাদের জালে বড়ো বড়ো ঠ্যাংওয়ালা কাঁডা ইচা উঠে আসত ৷ বাজারেও তখন প্রচুর ইলিশ ও গলদাচিংড়ি পাওয়া যেত ৷ আটের দশকে আমার শ্বশুরবাড়িতে অনেকদিনই এখান থেকে ইলিশ মাছ আর গলদাচিংড়ি পাঠিয়েছি ৷ বাইরে থেকে যাঁরা এসে সাব্রুমে চাকরি করে গেছেন তাঁরা আজো স্মৃতিচারণ করেন ৷ একসময় প্রায় প্রতিদিন বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না ও খাওয়ার ফলে থালাবাসনেও ইলিশের গন্ধ লেগে থাকত কদিন ধরে ৷এমনটা যদি সাব্রুমে হয়ে থাকে তাহলে ফেনি নদীর অপর পাড়েও এই প্রাচুর্য ছিল অবশ্যই ৷ মাছ ধরার সুবাদে দুপারের যুবকরা তখন পাড়ে আড্ডাও জমাত ৷ আমাদের ছেলেরা বাংলাদেশের পেপার বাইন্ডেড রমনা বিড়ি এবং স্টার সিগারেট খুব পছন্দ করত ৷ তেমনি ওপারের যুবকদের পছন্দ ছিল পাতা বাঁধানো বিড়ি ৷ সেসব আজ ইতিহাস ৷ একসময় ফেনি নদীর উজানে আমলিঘাটের মেরুকুম পর্যন্ত জোয়ার আসত ৷ জোয়ারকে স্থানীয় লোকজন বলতেন 'সর' ৷ জোয়ারের জলে ভেসে আসত এইসব মাছের সাথে চিড়িং, বাইলা, বাটা, পাবদা, কালিবাউস, আইড় ইত্যাদি মাছ ৷ বর্ষাকালে প্রচুর বোয়াল মাছও পাওয়া যেত ৷ লৌহশলাকানির্মিত কোঁচ, ট্যাঁডা দিয়ে বোয়াল ধরা হত ৷ ছোটোখিলের জগদীশ ভৌমিক, যতীশ ভৌমিক  ও ক্ষিতীশ ভৌমিক এরা তিনভাই এবং সুরেশ দাশ, ননী মজুমদার ট্যাঁডা চালনায় পারদর্শী ছিলেন ৷ মনুঘাটের কাছে কল্যাণনগরের শেষ প্রান্তে সাব্রুম মহকুমার আর একটি নদী মিলিত হয়েছে তার নাম মনু ৷ এই নামে ত্রিপুরায় আরো কয়েকটি নদী ও স্থান আছে ৷ সে অন্য কথা ৷ ফেনি বেয়ে মনু নদীতেও উঠে আসত ইলিশ ও গলদা চিংড়ি ৷ স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে গেল খুব ৷

মনসার গান

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2885781458222173&id=100003710406641

চারটি কবিতা

উইকএন্ড কার্ফ‍্যু

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

টারবাইন জীবনেও মাঝে মাঝে বিরতি দিতে হয়
পাহাড়ে মেঘের রাজত্বে রোজকার বন্দীত্ব ছুঁড়ে ফেলে
উদার এবং উদাস হতে মন চায়

মেঘেরা কতো সরল সাদা আর দূরগামী জাহাজ
পাহাড়ের ছাদে ছাদে তাদের যৌথ ভ্রমণ

সপ্তাহে দুটো দিনই তো কেবল মুক্তির ট্রেন
বেহায়া উইকএন্ড কার্ফ‍্যু গিলে খায় সব উল্লাস

নিঃশব্দে রাতের পর রাত পেরোতে হয়
অপর কোনো বিরতির হাটবারের আশায় ।



বর্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বর্ষার জল পড়ে জেগে ওঠে গাছপালা,
পাখিদের স্নান, সাপের শঙ্খলাগা,
পাতারা রান্নাবান্নায় মগ্ন সবুজ ক্লোরোফিলে ।

খেতের লাঙলের ফলায় জেগে ওঠে জানকীর মুখ
জান কবুল করে বৃষ্টিতে ভেজে চাষি
ভাতশিল্প রচনার কৌশলে মেলে ধরে মাটির ইজেল

কৃষাণবউয়ের ফেসবুকে অংকুরের আভা
ফসলের আশায় নেভায় রাতশয‍্যার কুপিবাতি ।



লকডাউন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সব মিরাক্কেল রসিকতার নয় । মঞ্চের হাসাহাসি
মাটিতে নামলেই জন্ম নেয় একাকীত্বের ।

মানুষ এখন ভীষণ সাহসী পুলিশের তোয়াক্কা করেনা ।
প্রশাসকও ক্রমাগত কড়া লকডাউন লাগিয়ে যায় ।
ডিউটিসফল পুলিশ । চৌমাথায় দাঁড়িয়ে
মোবাইলে পাবজি খেলে কিংবা অন‍্য থানায়
বদলি হয়ে যাওয়া তরুণী সতীর্থের সঙ্গে
ভিডিও চ‍্যাটিংএ গভীর মনযোগী ।

মানুষ মরে আর প্রশাসন হাসে
ভেবোনা, সামনে আরো কঠোর কার্ফ‍্যু আছে ।



জার্নি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ভালোবাসি বলেই অ‌পেক্ষায় থাকি
অন্ধকারেও দেখি ওই ডালিমমুখের বিশ্বাস

ভালোবাসা হারায়না ।
বাক‍্যহীন বেড়ে যায় প্রতিটি সুগন্ধী সন্ধ‍্যায়
মৃগনাভির সম্পদ নিয়ে এগোতে থাকে ।

বেলাশেষে যে করুণ আলো দিগন্তে ছড়ায়
তাকে নিয়ে গবেষণা করলে পাই বিদায়ের তর্জমা

অপরপথের পথিক কবিতা দুরপথে সরে যায়
তার কাছে পৌঁছুতে গেলে চাই মায়াশব্দের ছু-মন্তর

অবেলায়ও তোমার শুভনাম নিয়ে আমাদের যৌথজার্নি ।

Sunday, July 18, 2021

করোনাকাল ও দেশের শিক্ষাব‍্যবস্থা

করোনাকালে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে গভীর কালো মেঘের ছায়া

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সারা পৃথিবী এই মুহূর্তে সীমাহীন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে ৷ ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আজ ঘরবন্দী মানুষ ৷ একটিমাত্র সমস্যায় বিপন্ন হয়ে আতংকে আজ দিন কাটাতে হচ্ছে সারা পৃথিবীকে ৷ বিশ্বজুড়ে এক করাল বিষন্নতা আর মৃত্যুভয় এক অপরিচিত ও অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে ৷ কোভিড-19এর থাবায়  জনজীবন, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ও সেবা সর্বত্রই এক স্থবিরতা বিরাজ করছে ৷ লকডাউনের ফলে অবর্ণনীয় দুর্দশার মুখোমুখি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ৷ 

গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে করোনাকালীন এই দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে ৷ গতবছরের মার্চ মাসের শেষের দিকে শুরু হওয়া করোনা অতিমারীর থেকে বাঁচার জন্যে লকডাউন লাগু হওয়ার পর থেকে দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে ৷ ইউনেস্কোর পরিসংখ‍্যান অনুযায়ী বিশ্ব জুড়ে  ১৯১টি দেশের ১৫৭কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাগ্রহণ প্রভাবিত হয়েছে, তার মধ‍্যে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সংখ‍্যা ৩২ কোটি । স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় মোট শিক্ষার্থীর ৯৪ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে  যে ব্যবস্থা অনুসরণ করা হত তা আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে ৷ বিশ্বের আশি শতাংশ শিক্ষার্থী আজ এই বিরাট সমস্যার সম্মুখীন ৷

নিবন্ধের এইটুকুতে এলেই হয়তো অনেকে হা রে রে রে করে উঠবেন ৷ পড়াশুনা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা এক অংশের, মানুষ, মানতেই চাইবেননা ৷ তাঁরা বলবেন, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলে কী হবে, অনলাইনে তো পড়াশুনা চলছে ৷ এই অনলাইন পড়াশুনা নিয়ে একটা বিতর্ক চলছে সর্বত্রই ৷ একদল বলছেন, অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর পঠনপাঠনে ব্যাঘাত ঘটছেনা ৷ আর একদল বলছেন এতে শিক্ষার্থীরা গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৷ তেমন কোনো পূর্বপ্রস্তুতি বা ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং আকস্মিকভাবে অনলাইন  শিক্ষা চালু করে দেওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি একেবারে উদোম হয়ে পড়ছে ৷ দেশের শাসকগোষ্ঠীও করোনাকালীন বিপদসংকুল পরিস্থিতির ডামাডোলে শিক্ষাক্ষেত্রে একতরফাভাবে সিদ্ধান্তের অদলবদল করে চলছে ৷ এই তুঘলকী সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষাপরিবেশের মধ্যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ৷

অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতি পুরোটাই হল ইন্টারনেট নির্ভর ৷ আমাদের দেশের সব প্রান্তে এখনও ইন্টারনেট পরিষেবা সহজলভ্য নয় ৷ কোথাও কোথাও দেখা যায়, ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়া গেলেও তার স্পিড অত্যন্ত কম ৷ দুর্বল গতির কারণে ঘন ঘন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ৷ ভারতের বিশাল সীমান্ত এলাকা জুড়ে বহু মানুষের বাস ৷ রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষাজনিত কারণে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় ইন্টারনেট পাওয়া যায়না ৷ খবরের কাগজ খুললে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্যে প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে চেষ্টা করছে ৷ কোথাও কোথাও ঘরের চাল, ছাদে কিংবা গাছের উপর চড়ে বসে বিপজ্জনকভাবে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জালের সুযোগ নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে ৷ ফলে অনলাইন কার্যক্রমে শিক্ষা নিতে গিয়ে খাজনার থেকে বাজনা বেশি হচ্ছে ৷

আমাদের দেশের জনসংখ্যার এক বৃহত অংশ দৈনিক শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে ৷ অসংগঠিতক্ষেত্রের এই শ্রমিকরা একদিন কাজে না গেলে তাদের ভাত জোটেনা ৷ এমনিতে সরকারি সুযোগ পেতে ও বিশেষ করে পারিবারিক যোগাযোগ, রেশন, রান্নার গ্যাস, ব্যাংকের লেনদেন ইত্যাদিক্ষেত্রে তথ্যের আদান-প্রদানের জন্যে আজকাল প্রত্যেক পরিবারেই অত্যন্ত স্বল্পমূল্যের হলেও একটি মোবাইল ফোন রাখতে হয় ৷ এদিকে করোনা অতিমারীর কারণে দেশের বহু শ্রমজীবী পরিবারের আয় কমে গেছে কিংবা কর্মহীন হয়ে গেছে ৷ জীবনধারণের জন্যে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী যোগাড় করতেই জেরবার হয়ে যেতে হচ্ছে ৷ সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্যে একটা স্মার্টফোন কিনে দেওয়া আকাশের চাঁদ পেড়ে এনে দেবার মতোই অবস্থা ৷ তার উপরে পরিবারে যদি একাধিক পড়ুয়া সন্তান থাকে তাহলে তো এ চাপ আরো বাড়তে বাধ্য ৷ কারণ একই সময়ে একাধিক সন্তানের ক্লাশ থাকতে পারে ৷ ফলে প্রত‍্যেকের হাতে একটি একটি করে এন্ডরয়েড ফোন জুগিয়ে যাওয়ার মতো ব‍্যয়ভার বহন করতেগিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অভিভাবকদের ।  আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী শ্রমজীবী পরিবার থেকেই উঠে আসে ৷ ফলে আর্থিক দৈন্যে শিক্ষার্থীরা পাঠগ্রহণে পিছিয়ে পড়ে ৷ তা থেকে তাদের মনে হীনন্মন্যতার জন্ম হয় ৷ খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, বাবা-মায়ের কাছে স্মার্টফোনের আব্দার করে না পেয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ৷

পূর্বের কোনো ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইন পঠনপাঠনে অংশগ্রহণ করছে । এই পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ করতে গেলে যে উন্নতমানের ভিডিওচিত্র, রেফারেন্স ফাইল, স্পষ্ট শ্রবণের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমানে ডিভাইস সংগ্রহ করা অত‍্যন্ত ব‌্যয়বহুল । এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকলে শিক্ষার্থীকে পাঠদানের পূর্বে ও পাঠদানকালে অনলাইন কোর্স ম‍্যাটেরিয়াল ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রয়োজনীয় তথ‍্য, স্লাইড ইত‍্যাদি সরবরাহ করা সম্ভব হয় । কোর্স ম‍্যাটেরিয়ালের মাধ‍্যমে বছরের শুরুতেই পুরো কোর্সের পরিকল্পনা এবং লেকচার প্রেজেন্টেশান, পরীক্ষার নম্বর বিভাজন ইত‍্যাদি পূর্বাহ্নেই জানা না থাকায় শিক্ষার্থীরা একট ভাসা ভাসা ধারনা নিয়ে পাঠ‍্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে । দীর্ঘসময় পাঠগ্রহণের পর দেখা যায়, হঠাৎ করে সিলেবাস সংক্ষেপ করে ফেলা হয় । এতে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ‍্যে একটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয় ।

বাস্তবজীবনে শিক্ষকদের মধ‍্যে অনেকেরই স্মার্টফোন ব‍্যবহারের তেমন কোনো। প্রয়োজন পড়েনি । এই করোনাকালীন সময়ে তাঁদের স্মার্টফোনের ব‍্যবহার ঠেকে শিখতে হচ্ছে । হঠাৎ করে এই ডিভাইস ব‍্যবহার করতে গিয়ে তাঁরা সমস‍্যার সম্মুখীন হচ্ছেন । অনলাইন ক্লাশ করতে বসে কোনো সমস‍্যার সম্মুখীন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধান করতে না পারার কারণে পাঠদান প্রক্রিয়াও ব‍্যাহত হচ্ছে । এছাড়া এই ডিভাইস ব‍্যবহার করতে গিয়ে শিক্ষক মহাশয়কে যে আর্থিক দায়ভার বহন করতে হচ্ছে সেটা এই করোনাকালে তাঁর জীবিকার উপরও আর্থিক চাপ ফেলছে ।

''বর্ষে বর্ষে দলে দলে / আসে বিদ‍্যা মঠতলে / চলে যায় তারা কলরবে। / কৈশোরের কিশলয় /পর্ণে পরিণত হয় /  যৌবনের শ‍্যামল গৌরবে ।'' ( ছাত্রধারা– কালিদাস রায় )–করোনাকলীন সময়ে কবিশেখর কালিদাস রায়ের সেই চিরন্তন চিত্রটি একেবারে পাল্টে গেছে । করোনা ভাইরাস শিক্ষাব‍্যবস্থাকে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সামনে এনে ফেলে দিয়েছে । অনলাইন শিক্ষাব‍্যবস্থা কোনোভাবেই বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন পদ্ধতির বিকল্প হতে পারেনা । বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক যুগ পর্যন্ত আমরা দেখে আসছি শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে উপস্থিত থেকে পাঠপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে । এই বিষয়টি যুগপরম্পরাক্রমে আমাদের রক্তের ভেতর গেঁথে গেছে। সেই ক্ষেত্রে শিক্ষাব‍্যবস্থাকে রাতারাতি ভার্চ‍্যুয়াল করে ফেললে শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের মানসিক সংগঠনে বেশ বাধার সৃষ্টি করে ।

অনলাইন শিক্ষাপ্রক্রিয়ার মাধ‍্যমে বিভিন্ন বিষয়ের তাত্ত্বিক ক্লাশ করা সম্ভবপর হলেও ব‍্যবহারিক ক্লাশ সম্ভব নয় । লকডাউনের ফলে শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি, ল‍্যাবরেটরি ইত‍্যাদির প্রত‍্যক্ষ পরিষেবাগুলো নিতে পারছেনা । তাছাড়া অনলাইন শিক্ষাব‍্যবস্থার মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাযুক্ত শিশুরা খুব একটা সুফল লাভ করতে পারেনা । বিশেষ করে অটিস্টিক বিশেষ চাহিদাযুক্ত ( শ্রবণ, দর্শন ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ) শিশুদের শিক্ষণক্ষেত্রে শিক্ষককে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় ।

প্রাচীন শিক্ষাব‍্যবস্থায় যে আন্তরিকতা, যে মূল‍্যবোধ ছিল  আধুনিক শিক্ষবিদগণও শিক্ষাক্ষেত্রে সেই মূল‍্যবোধের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করছেন। মহাভারতের কাহিনি 'আরুণির উপাখ্যান'–এ পাই, গুরু ঋষি আয়োদধৌম‍্য শিক্ষার্থীকে নির্দেশ দিচ্ছেন–'ধান‍্যক্ষেত্রে সব জল যাইছে বহিয়া / যত্ন করি আলি বাঁধি জল রাখ গিয়া / আজ্ঞা মাত্র আরুণি যে করিল গমন/আলি বাঁধিবারে বহু করিল যতন / দন্ডেতে খুদিয়া মাটি বাঁধে লয়ে ফেলে / রাখিতে না পারে মাটি অতি বেগ জলে । / জল সব যায় গুরু পাছে ক্রোধ করে / আপনি শুইল নিজে বাঁধের উপরে ।' গুরুর আজ্ঞা পালনের জন‍্যে শিষ‍্যের কী অসীম প্রচেষ্টা । গুরু-শিষ‍্যের মধ্যে গভীর আত্মিক যোগাযোগ না থাকলে এমনটা হওয়া সম্ভব নয় । শুধু গুরু-শিষ‍্যের মধ্যে সুসম্পর্ক নয় দীর্ঘকাল যাবত শিক্ষক মহাশয়গণ অভিভাবক কিংবা সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । মূল‍্যবোধের শিক্ষা সমাজকে বিশেষ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল । মধ‍্যযুগেও আমরা দেখতে পাই যে, বাদশাহ্ আলমগির একদিন তাঁর সন্তান ও অন্যান্য রাজপুরুষের সন্তানগণের পাঠশালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা জিনিস লক্ষ করে মৌলবি সাহেবকে ডেকে পাঠালেন । মৌলবি সাহেব তো বাদশাহের ডাক পেয়ে দুরু দুরু বুকে তাঁর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন । 'বাদশাহ কহেন, সেদিন প্রভাতে/দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে / নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন / পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ / নিজ হামনেতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে 
/ ধুয়ে দিল নাকো কেন সে চরণ স্মরি ব‍্যথা পাই  । ( শিক্ষকের মর্যাদা-কাজি কাদের নিওয়াজ ) । বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে ব‍্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স শিক্ষার ক্ষেত্রকে পুরোপুরি যান্ত্রিক করে ফেলছে । শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ‍্যে যে নিবিড় সম্পর্কের বাতাবরণ, জীবনের রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত‍্যাদির নিবিড় উপলব্ধি থেকে বা প্রতিদিনের জীবনের ঘটে যাওয়া নানা বিচিত্র ঘটনাবলি থেকে টেনে আনা উপমা, উদাহরণ, হাসি-মজা-আনন্দ মিলিয়ে শ্রেণিকক্ষের যে আনন্দঘন পরিবেশ তা বর্তমান ব‍্যবস্থায় সত‍্যিই দুর্লভ । ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে । এছাড়া অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতিতে শারীরশিক্ষা কিংবা সহপাঠ‍্যক্রমিক কার্যাবলির কোনো ব‍্যবস্থা না থাকায় এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা একঘেয়েমির শিকার হয়ে পড়ে ।

''অন্ন চাই প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু;/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,/ সাহসবিস্তৃত বক্ষপট'' ( এবার ফিরাও মোরে,চিত্রা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) । প্রত‍্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ করতে হলে একটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ‍্যকর পরিবেশের দরকার । ঘরে বসে অনলাইন শিক্ষাগ্রহণের ফলে শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা, দৌড়ঝাঁপ ইত‍্যাদি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে । ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে ইন্টারনেটের সামনে বসে থাকতে হচ্ছে ক্লাশ করার জন‍্যে । ফলে শিশুর শরীরের দেখা দিচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ওজন বেড়ে যাচ্ছে । ঘরে বসে থাকতে থাকতে মেদবহুল হয়ে যাচ্ছে তারা ।
এছাড়া দীর্ঘক্ষণ ধরে কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখার ফলে কানেও নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মোবাইল বা ল‍্যাপটপের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখেরও নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। করোনকালীন সময়েঅনলাইন ক্লাশ করার ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ‍্যের উপরও ব‍্যাপক প্রভাব পড়ছে । তাদের মধ্যে একধরনের একঘেয়েমির ও অবসাদ ঘিরে ধরেছে। সারাদিন ল‍্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকার ফলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । চিন্তার জগতেও পরিবর্তন আসছে । মোবাইল, ল‍্যাপটপ সঙ্গে থাকার সুবাদে  ভালো মন্দ বিভিন্ন সামাজিক মাধ‍্যমে বিচরণেরও সুযোগ থাকছে শিক্ষার্থীদের । ফলে তার প্রভাবে  শিক্ষার্থীর মনে কুচিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটে ও  তাদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটছে  । তাদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে। তাদের স্বভাবে উগ্রতা লক্ষ করা যায়। এমনকি মানুষের সঙ্গে খারাপ ব‍্যবহারও পর্যন্ত করতে শুরু করে তারা‌। সরকারিভাবে অনলাইন শিক্ষাব‍্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো পরিকল্পনা বা ব‍্যবস্থা নেই।এছাড়া ইন্টারনেট কিভাবে ব‍্যবহার করতে হয়, ইন্টারনেটের ভালো দিক, মন্দ দিক ইত‍্যাদি বিষয়ে কোনো ধারণাই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়না । অনলাইন শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের হাতে হঠাৎ করে মুঠোফোন চলে আসায় একাংশ এটার যথেচ্ছ ব‍্যবহার করতে আরম্ভ করেছে এবং ক্রমশ মোবাইল এডিক্টেড হয়ে পড়ছে। বাস্তববর্জিত অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে, নানারকম খারাপ ভিডিও দেখে বিপথগামী হচ্ছে , অনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, নেশায় আসক্ত হচ্ছে, এমনকি হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে । অভিভাবক, শিক্ষক মহাশয় কিংবা সচেতন মানুষের কোনো সুযোগ নেই জানার যে শিক্ষার্থীরা মোবাইল নিয়ে আসলে কী করছে । আর যখন জানা যাচ্ছে তখন ঘটনা অনেকদূরগড়িয়ে যায়। সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই মোবাইলফোন হাতে পেয়ে অল্পবয়সী শিশুকিশোরদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনৈতিক আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। ফলে নানারকম অঘটনও ঘটছে। জীবন শুরু হওয়ার আগেই অকালে ঝরে পড়ছে তারা ।

দেশে বহু শ্রমজীবী পরিবার রয়েছে যাদের ছেলেমেয়েরা বিদ‍্যালয়ের  উঁচু ক্লাশে,  কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যয়ন করে । তাদের মা-বাবারা নিম্ন আয়ের হওয়ার ফলে তারা পড়াশুনার ব‍্যয় নির্বাহের জন‍্যে মা বাবা কিংবা অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি না করে ছুটকো ছাটকা কাজ করে অথবা নিচের ক্লাশের ছাত্র পড়িয়ে তাদের পড়াশোনার ব‍্যয় নির্বাহ করত । কিন্তু করোনাকালীন সময়ের নানা বিধিনিষেধের মান‍্যতা দিতে গিয়ে তাদের সেই সমস্ত রোজগারের রাস্তাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে ।  দেশের সরকার ইতোমধ‍্যে 'হিফা' অর্থাৎ Higher Education Funding Agency-র মাধ‍্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্ত পরিকাঠামোগত বরাদ্দ বন্ধ করে ৮'৫% হারে ঋণের প্রকল্প চালু করেছে । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ঋণের বোঝা লাঘব করার জন‍্যে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নরকম ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে ।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় আর্থিক সুযোগ করে দেওয়ার নামে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ঋণের বেড়াজালে । 

শিশুশ্রমিক ও স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখী করার উদ্দেশ‍্যে সর্বশিক্ষা অভিযানের মাধ‍্যমে দেশের সমস্ত বিদ‍্যালয়গুলোতে মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু করা হয়েছিল । তাতে দেশে শিক্ষার্থীর সংখ‍্যা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল । সারা দেশে ১২ কোটি ( মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ ) শিক্ষার্থী এই প্রকল্পের সুফল লাভ করেছিল ।  কিন্ত্ত এই দুঃসময়ে বিদ‍্যালয়গুলো বন্ধ থাকার ফলে আবার শিশুশ্রমিক ও স্কুলছুটের সংখ‍্যাবৃদ্ধি অবশ‍্যম্ভাবী ।  করোনাকালীন সময়ে বহু পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ‍্য ক্রয় করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে । পণ‍্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপেরও কোনো প্রয়াস নেই। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবারের অনেকেই তাদের সংসারে আয়ের রাস্তাকে বাড়াবার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার পাট চুকিয়ে রোজগারের পথে নামিয়ে দিচ্ছে । কারণ 'এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে'রা এতই অসহায় যে, তারা 'নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতরে স্মরি, / মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান / শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ রেখে দেয় বাঁচাইয়া' । ( এবার ফিরাও মোরে, চিত্রা–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ‍্যক্রমও অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে ।নেই ব‍্যবহারিক পাঠগ্রহণের ব‍্যবস্থা।  ফলে বর্ষশেষে শিক্ষার্থীরা তাদের হাতে হয়তো মূল‍্যায়নপত্র বা সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। সুরক্ষার লক্ষ‍্যে এবছর  রাজ‍্যে ও সারাদেশে সমস্ত শিক্ষাপর্ষদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ‍্যমিক পরীক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে চলেছে । দুঃসময়ে লব্ধ তাদের এই যোগ্যতা একটি ক্ষত বা ক্ষতি হিসাবে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সারাজীবন সমাজে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে অবস্থান করতে হবে। প্রাচীন শিক্ষা ব‍্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে আধুনিক শিক্ষাব‍্যবস্থায় শিক্ষককেন্দ্রিকতার বদলে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব‍্যবস্থার উপর যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, অনলাইন শিক্ষাব‍্যবস্থায় সেটা আবার 'পুনর্মুষিকঃ ভব' অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ।

অনলাইন শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও ছন্দপতন ঘটেছে । বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের আয়ের উপর আঘাত এসেছে । স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রভর্তি কম হওয়ার কারণে তাদের আয় কমে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষকদের ছাঁটাই করছে অথবা বেতন কমিয়ে দিচ্ছে । এছাড়া যারা শুধুমাত্র বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের অবস্থা আরো চরম ।অবর্ণনীয় দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন রাজ‍্যের চাকুরিচ‍্যুত ১০৩২৩ সংখ‍্যায় আখ‍্যায়িত শিক্ষকগণ । এই অতিমারীর ডামাডোলে তাদের কাতর আবেদন প্রশাসনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছেনা । করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা উপকরণ ও শিখনসামগ্রীর চাহিদাও কমে গেছে । ফলে এই ধরনের সামগ্রীর সঙ্গে জড়িত ব‍্যবসায়ীরাও সাংঘাতিকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন । পাশাপাশি বিদ্যালয়ের স্কুলবাসের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিদ‍্যালয় চত্বরে ক্যানটিন বা টিফিনের দোকান করেও অনেকে সংসার প্রতিপালন করছিলেন । তারাও এইসময়ে অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছেন । করোনাকালীন সময়ে সরকারি নজরদারি না থাকায় বিদ্যালয়গুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে । বিদ‍্যালয় চত্বরে অসামাজিক কার্যকলাপ, নেশার আড্ডা ও দুর্বৃত্তের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্কুলবাড়ির দরজা-জানলা,ফ‍্যান-লাইট ও অন্যান‍্য বৈদ‍্যুতিক সামগ্রী, কম্পিউটার ইত‍্যাদির মতো মূল‍্যবান সামগ্রী । নষ্ট করা হচ্ছে চেয়ার টেবিল ব‍্যাঞ্চ ও অন‍্যান‍্য আসবাবপত্র। করোনার অবসান হওয়ার পর স্কুল খুললেও সেখানে ক্লাশ করার মতো পরিবেশ সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যাবেনা । সর্বোপরি বিদ‍্যালয়কে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে গেলে বিদ‍্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে বহু অর্থ ব‍্যয় করার ঝুঁকি নিতে হবে । করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার ফলে একদিকে যেমন শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় মন্থর গতি এসেছে তেমনি তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবও অপেক্ষা করছে যা এই মুহূর্তে ধারনাও করা যাচ্ছেনা । 

এই সীমাহীন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রগুলোকে এখনই চিহ্নিত করে মোকাবেলায় উদ্যোগ না নিলে এর কুফল দীর্ঘদিন জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে । আর মানবসম্পদের উন্নয়ন ব‍্যহত হলে জাতির অগ্রগতিও ব‍্যহত হতে বাধ‍্য ।

Friday, July 16, 2021

ঊনজীবনের 'সুগন্ধী ছাই'

ঊনজীবনের 'সুগন্ধী ছাই'

অশোকানন্দ রায়বর্ধন (১৬ জুলাই-২০২১ বজ্রকন্ঠ অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত )

  সব ছন্দপতন মেনে নেয়া যায়না ৷ মেনে নেয়া যায়না অসময়ে চলে যাওয়া ৷ যখন আমাদের বয়সী মানুষেরা চলে গেলে সমাজের তেমন ক্ষতি হয়না ৷ জগৎজীবনে ততটা আলোড়ন তোলেনা ৷ কিন্ত সেসময়ে একেবারে ঝকঝকে তারুণ্যের কালে কিংবা জীবনসীমার প্রথমার্ধ না পেরুতেই জীবননদী পেরিয়ে সুদূরের পথে চলে যাওয়া তীব্র ঝাঁকুনি দেয় সমাজের বুকে ৷ তেমনি চলে যাওয়া সুমিতা ধর বসুঠাকুরের ৷ সুমিতার ৷ কদিন আগে অগ্রজ কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ও আরো কয়েকজনের দেওয়া সোস্যাল মিডিয়ার বার্তায় জেনেছিলাম সে খুব অসুস্থ ৷ কিন্তু সুস্থ হয়ে আর ফিরলনা ৷ রেখে গেল প্রাণপ্রিয় স্বামী ও সন্তানকে ৷ আর বাংলা কবিতার ভুবনে তার কবিতার খাতার খোলা পৃষ্ঠা ৷

    খুব অল্প সময়ের জন্যে সাহিত্যভুবনে  ঝকঝকে উপস্থিতি এই বিদুষী বোনের ৷ এই শতাব্দীর প্রথমদিকে আগরতলা বইমেলায় কবিতাপাঠে বা অন্য কোনো সাহিত্যের আসরে তাঁকে দেখতাম নিজের কবিতটি পড়ার জন্যে দীর্ঘক্ষণ দর্শকাসনে বসে অন্যদের কবিতা শুনতেন ৷ কবিতাপাঠের পরে সাধারণত আর থাকতেননা ৷ সেসময় তিনি হিন্দি কবিতাই পড়তেন বেশির ভাগ ৷ কিন্তু প্রতিভাটিকে ঠিক নজরে পড়ে রাজ্যের অগ্রজ কবি ও সংগঠক পূর্ণেন্দু গুপ্তের ৷ তাঁরই প্রেরণায় ধীরে ধীরে তাঁর কাব্যপ্রতিভা কিরাতভূমির সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাকবিতা বৃহত্তর ভুবনে ছড়িয়ে পড়ে ৷ আজ তাঁর অকাল প্রয়াণে যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই করোনাকালীন সময়েও আন্তর্জালের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে নানা শৈল্পিক আঙ্গিকে, বেদনায় সিক্ত হয়ে ৷ তাতে অনুভব করা যায় তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ  কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ 
কবিতায়, গানে, আবৃত্তি, সঞ্চালনায়, শিক্ষিকা, সুগৃহিনী হিসেবে এক প্রাণোচ্ছল জীবন ৷ গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন ৷ বাড়িতে রেখে অত্যন্ত সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলেছিলেন তাঁকে ৷ সন্তান সোহমকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি ৷ 

প্রথমা, সুগন্ধি ছাই, ঘুমের ভেতর, ছন্দে ছন্দে আসমানী ইত্যাদি পরপর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর ৷ সর্বশেষ 'ঋতুবতী মেঘ' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় আগরতলার নীহারিকা প্রকাশন থেকে ৷নিজের সংসারের সব কাজ সামলে, সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করে আপন সন্তানের মতো লালিত হয়েছে তার ম্যাগাজিন 'আকাশের ছাদ' এর প্রতিটি সংখ্যা বহু প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিন  সম্পাদকদের ঈর্ষার কারণ ছিল বিষয়বস্তু নির্বাচনে, নির্মানশৈলীতে ৷ মলাট উন্মোচনের ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত যত্ন ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রাখতেন তিনি ৷ একা হাতে দক্ষ রাঁধুনির মতো পরিপাটি করে হলভাড়া থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যন্ত সুশৃঙ্খলার ছাপ রাখতেন ৷ কবিতার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা, নিবিড় মমত্ববোধ না থাকলে এমনটা সম্ভব নয় ৷
কবিতায়ও তিনি তেমনি লেখেন—
'কার লাগি বাজি রাখে প্রাণ/বাকিটা জীবন সুখের সুখ/আর কবিতা তোর শরীরে/রঙ এঁকে আজ ঢাকি মুখ
( ওগো কবিতা-সুমিতা ধর বসুঠাকুর) ৷ সুমিতা ধরবসুঠাকুর যাপনে যেমন ছিলেন সোজাসাপ্টা মনের মানুষ তেমনি তাঁর কবিতায়ও সহজ সরল শব্দে তার প্রকাশ ঘটে—'কলমের বুকে ঝুলছে রাজনীতির লকেট/কি বিক্রি করে জীবন কিনব?এক বাজারে সব কিছু বন্ধক/নিস্তব্ধতা মেরে ফেলেছে শব্দের ধার,/নিজেদের মধ্যে বিভেদহীন গীতা কোরান/কখনো উল্টে দেখেনি পৃষ্ঠার ভূমিকা রক্তশোষী/উল্কি ওড়ায় হাওয়ার গায়ে, আগুন ছয়লাপ/চল সাজাই বিপন্ন অক্ষর হে ব্রহ্মচারী' ( অক্ষর কান্না) ৷ কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রণয় অকপটে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতায়-'তোমার গভীর ঘুমকে যদি টেনি হিঁচড়ে নিয়ে আসি আমার কাছে,/জিদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে কি নরম শয্যায়!/দেখ, কেমন গুছিয়ে দিচ্ছি তোমার আলুথালু মন ৷/একটু একটু করে উপোসি বেলা ভরে গেল যত্নের রঙ দিতে দিতে/তুমি কিন্তু রেখে যেও চিরকুটের সবুজ উত্তরমালা' ৷ ( ঋতুমতী মেঘ) ৷ অথবা-'মরণ যখন হাওয়ায় ওড়ে, পরায় শেকল পায়ে/তখন তুমি সঙ্গোপনে প্রেম রাখ এই গায়ে'৷ কর্মচঞ্চলা অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর কবি নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদসীন বলেই কী লেখেন-'এখানে মন মৃত, প্রেম অনন্ত শয্যায়/যার সাথে রাত হেসে ওঠে রোজ/সেই বাসরের প্রথম ফুলে ইঁটের কবজ/সিঁথির লাল  নাকের ডগায় ঘাম মুছে জ্বলে ওঠে যে বাতিদান/তার ঝিরঝিরে মোম বর্ষায়,/সুরক্ষিত হতে ভুলে যায় মেঘ ( হারিয়ে গেলে-সমিতা ধরবসুঠাকুর) ৷ 
আমি আমার এই বয়সে ত্রিপুরার সাহিত্যাকাশে অনেক গুণীজনের সান্নিধ্যে এসেছি ৷ এমন বহুভাষায় পারদর্শী, এত প্রতিভা,এমন প্রাণোচ্ছল আর একজনও দেখিনি ৷ আমার জানার বহর কম হতে পারে ৷ তবুও বলছি কথাটা ৷ বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষায় সমান বিচরণ তাঁর ৷ বাংলা কবিতা ভূমন্ডলে তিনি যেমন পরিচিত মুখ ৷ তেমনি হিন্দি কবিতায়ও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী ৷ সেই আকাশেও তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র ৷ অনুবাদক হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ছিল ৷ এই প্রতিভাময়ীর অকালে চলে যাওয়া আমাদের বিরাট ক্ষতি ৷

   কবছর আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি ভাষাবিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে সুমিতার সঙ্গে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ৷ দেশের সব অঞ্চলের হিন্দিভাষার কবিরা তাঁকে চেনে ৷ তাঁর কবিতাকেও জানে ৷ হোয়াটস অ্যাপএ বাংলা हिन्दि সাহিত্যচর্চা নামে তাঁর সৃষ্ট একটা গ্রুপ আজও সচল ৷ বহুভাষিক সঙ্গীতশিল্পীও ছিলেন সুমিতা ৷ তার স্বাদ অনেকেই পেয়েছেন ৷ 

   লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক সুমিতা ৷ তিনসুকিয়া, গুয়াহাটি, আগরতলা সর্বত্রই উপস্থিত ছিলেন তিনি ৷ লিটল ম্যাগ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ৷ লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনগুলোতে বর্ষিয়ান সন্দীপদার শরীরের প্রতি খুব লক্ষ্য রাখতেন সুমিতা ৷ গত নবছর ধরে প্রকাশ করে চলছিলেন লিটল ম্যাগাজিন "'আকাশের ছাদ' ৷ এই ম্যাগাজিনটি প্রকাশের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই তাঁকে সাহায্য করে গেছেন রাজ্যের আর একজন প্রাণস্পন্দনে ভরপুর কবি ৷ সুমিতা তাঁর কাগজটি প্রকাশের ব্যাপারে এতো যত্নশীল ছিলেন যে তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার জন্যে অনেকের কাছে পরামর্শ ৷ আমি আগরতলায় থাকাকালীন তিনি কয়েকবার আমার ভাড়া বাসায় এসে লেখা নিয়ে গেছেন ৷ কাগজের প্রিন্ট নিয়ে এসে প্রুফ দেখানোসহ টুকটাক গুছানোর কাজ করিয়ে নিয়ে গেছেন ৷ আর ছিল সবার সঙ্গে মেশার বিরল দক্ষতা ৷ অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা ৷ অনুজদের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ তাঁর যাপনের সঙ্গী ছিল ৷ যখন যেখানে যেতেন হৈ চৈ, গান, কবিতায় মাতিয়ে রাখতেন ৷ অপরিচিতজনের সাথে আমার পরিচয় দিতেন অশোকানন্দ দাদা বলে ৷

বইমেলার লিটল ম্যাগ প্যাভেলিয়ন সুমিতাকে ছাড়া যেন অপূর্ণ থাকত ৷ একদিকে যক্ষের ধন আগলে থাকতেন কবি নকুল রায় ৷ অন্যদিকে তুমুল কবিতাপাঠ, আড্ডা, কোনো কাগজের নতুন সংখ্যা প্রকাশের তোড়জোড়, হাতে হাতে কাগজ তুলে দিয়ে মলাট উন্মোচন, একযোগে ছবি তোলা, সবেতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সুমিতার ৷ সুমিতা সাজতে ভালোবাসতেন আর সবাইকে নিয়ে ছবি তোলায় তাঁর একটা বিশেষ   ভূমিকা ছিল ৷ বইমেলা, কোনো সেমিনার, লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে আমার শরীরের খোঁজ নিয়েছেন প্রতিনিয়ত ৷ আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আজ মর্মাহত ৷  প্রায়শই আমরা কবিতায় কবিতায় চাপান-উতোর খেলা খেলতাম অবসরে ৷ নিজেই আজ ছন্দের জাল কেটে বেরিয়ে গেলেন সুমিতা ৷

    একান্ত শিবভক্ত সুমিতা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শিবমন্দির দর্শন করেছে ৷ কথা ছিল প্যানডেমিক শেষ হলে আমার এখানে আসবে ৷ বউদির সঙ্গে ঝগড়া করবেন ৷ আমাদের নিয়ে জলেফা শিববাড়ি দর্শনে যাবেন ৷ কবি বিজন বসুকে ডেকে নেবেন ৷ এরপর কবি সাচিরাম মানিকের আমলিঘাটের বাড়িতে যাবেন ৷ সেখানকার শিবমন্দিরটি দর্শন করবেন ৷ 
 
    হলনা কিছুই ৷ সাধ না মিটিল আশা না পুরিল ৷ আকাশের ছাদের বাসিন্দা হয়ে গেল সুমিতা ৷ বড়ো ঊণবেলায় ৷ সুমিতা, বোন আমার! আকাশের ছাদময় ক্যানভাসে দেখছি তোমার শিবসুন্দর মুখটি ৷ আর গুনগুন করছি তোমার অমোঘ উচ্চারণ—'একটু সরলতা রেখে গেলাম কুড়িয়ে নিও তাপ বেলা' ৷ ( বিকেল)
সেদেশেও ভালো থেকো সুমিতা ৷

Sunday, July 11, 2021

বন্দী দুঃসময় অনুষ্ঠানে

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=510758960172373&id=1027561650 10/07/2021 বন্দি দুঃসময় অনুষ্ঠানে বেলায়েত হোসেন, বৈশম্পায়ন চক্রবর্তী ও পিনাকপাণি দেবের সঙ্গে

Tuesday, July 6, 2021

দুধের প্যাকেট

দুধের প্যাকেট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আজ কতদিন হল ঘরবন্দী ৷ প্রথমে লকডাউন ৷ তার কদিন পরই আবার কঠোর লকডাউন ৷ কি কঠোর কে জানে ৷ আগে যেমন এখনও তেমন ৷ কে মানে কার আইন ৷ পুলিশ নিরীহ লোকদের ধরে ধরে পেটায় ৷ বাইক আটকে মাস্কের জন্যে আর সহযাত্রীর হেলমেটের জন্যে জরিমানা আদায় করে ৷ টেনে হিঁচড়ে থানায় ঢোকায় ৷ হুজ্জতি করে ৷ সরকারি দলের মিছিল হলে মাস্ক লাগেনা ৷ সামাজিক দূরত্বও লাগেনা ৷ হাটে বাজারে ঢুঁসোঢুসি, গাড়িতে গাদাগাদি ৷ পুলিশ ওসব দেখেনা ৷ 

 আজ একমাস হল রামু বাড়ি থেকে বেরোয়না ৷ রাজমিস্ত্রির যোগালি কাজ করে সে ৷ ওই দিনহাজিরার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালায় ৷ বুড়ো মায়ের ঔষধ আর চার বছরের মেয়েটার দুধের প্যাকেট নিয়ে আসে ৷ আজ একমাসের উপর রুজি নেই একটাকাও ৷ কাজেই কোনো খরচাপাতি তেমন করে করতে পারছেনা ৷ এদিকে আবার বউটার পেটে বাচ্চা এসেছে ৷ পাঁচমাস পেরিয়েছে ৷ ভালোমন্দ খাওয়ানো দরকার ৷ তাও জুটছেনা ৷ দুঃসময়ের জন্যে জমানো সামান্য টাকা ভেঙেই চলছে লকডাউনের সংসার ৷ সরকারি সাহায্যও জোটেনি ভাগ্যে ৷ সরকার থেকে নাকি দেয়া হয়েছে ত্রাণ ৷ সে নাকি ক্যাটাগরিতে পড়েনা ৷ রেশনশপে গিয়ে ফিরে এসেছে ৷ মারধরের ভয়ে তর্ক করেনি ৷ রেশনদোকানের সামনে মাতবর গোছের ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে ৷ গতবছর কোভিডের সময় ত্রাণের জন্যে মিছিলে যাওয়ায় তাকে বেদম পিটিয়েছিল ওরা ৷ এবারেও লকডাউনের মধ্যে ওরা বাইরের আরো কিছু ছেলেসহ বাইক নিয়ে পাড়ার অনেকের বাড়িতে হামলা করেছে ৷ ভাঙচুর করেছে ৷
রামু চলে আসে ৷ সে কিছুটা ভীতুও ৷ লকডাউনের মধ্যে অনেকে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে কাজ যাচ্ছে ৷ ও সাহস করেনি ৷

কমল তার কজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দুস্থদের ত্রাণ দিচ্ছে ৷ নিজেরাই চাঁদা তুলে দিচ্ছে সব ৷ কিছু কিছু সহৃদয় লোকও তাদের সাহায্য করছেন ৷ বেশির ভাগ তাদের ট্যুইশানির আয় থেকে বাঁচিয়ে ৷ যারা কোনোরকম সরকারি সাহায্য পায়নি এমন পরিবারকেই ত্রাণ বিলি করছে তারা ৷ আর দিচ্ছে কোভিড আক্রান্ত গরিব পরিবারকে ৷ যারা কোয়ারেন্টাইনে ঘরবন্দী ৷

ঘরের এক কোনায় ত্রাণের প্যাকেটটা নিয়ে রাখল রামু ৷ ছেলেরা এখনো ফিরে যায়নি ৷ উঠোনে দাঁড়িয়ে দূরত্ব বজায় রেখে রামুদের আর কি অসুবিধা রয়েছে জেনে নিচ্ছে ৷ এই অবসরে রামুর মেয়েটা প্যাকেটের ভেতর হাতড়াতে শুরু করেছে ৷ কতক জিনিসপত্র ব্যাগ থেকে বের করে মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলছে  ৷

 ওরা চলে যেতেই রামু ঘরে ঢুকে দেখে মেয়ে আটার পুটলি খুলে মেঝেতে, হাতে, মুখে একাকার করে ফেলেছে ৷ রামু হায় হায় করে ওঠে, মা একি করছিস তুই?  প্যাকেটটা নেড়ে ঘেঁটে ঘেমে নেয়ে মেয়ে চিৎকার করে বলে  প্রশ্ন করে, আমার দুধ কই বাবা? দুধের প্যাকেট?
রামু থমকে যায় ৷ মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ত্রাণের ছেলেরা জাতীয় সড়কের দূরের মোড়টা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে ৷

Sunday, July 4, 2021

ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন উৎসব—2018

ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব- 2018  : একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনসমুহের চলমান সংকট ও সমস্যার পর্যালোচনা করার জন্যে, নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে একটা প্ল্যাটফরমের প্রয়োজন অনুভব হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে ৷  সেই লক্ষে প্রাথমিকভাবে বার্তা ছড়ানোর জন্যে গঠন করা হয় ছোটো একটা অস্থায়ী কমিটি ৷ এই কমিটি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছোটোখাটো সভা করার মধ্য দিয়ে একটা উৎসব করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ৷ ভিতরে একটা বেদনাও ছিল ৷ উত্তর-পূর্ব লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের তিনসুকিয়ার অনুষ্ঠানে আগরতলায় পরবর্তী সম্মেলন করার সিদ্ধান্তে স্বীকৃতি দানের পর ত্রিপুরায় এসে পরবর্তী একবছরেও সেই অনুষ্ঠান করা যায়নি উদ্যোগের অভাবে, পরনির্ভরতায় ও অকারণে ৷ আসলে যাঁরা দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা উত্তর পূর্বাঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিনের মেজাজটাই ধরতে পারেননি ৷লিটল ম্যাগাজিনের সৈনিক যে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে লড়াই করেনা তা তাঁরা অনুমানই করতে পারেননি ৷ সমালোচনা হলেও বলতে হচ্ছে, দাদা কখন কাঁধ পেতে দেবেন সেই আশায় অপেক্ষা করতে করতে  সুবর্ণ সময়টা হারিয়ে গেল ৷ সেই বেদনায়ও এই উৎসব করার তাগিদ বোধহয় রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের ৷ সিদ্ধান্ত হয় উৎসব করার ৷  চারিদিকে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের কাছে ৷ সোস্যাল মিডিয়ায়ও পোস্ট দিলেন গোবিন্দ ধর, সঞ্জীব দে, গোপাল দাস, অপাংশু দেবনাথ প্রমুখ কবি ও সম্পাদকবৃন্দ ৷ কিন্তু তেমন বিশেষ সাড়া পাওয়া যায়নি ৷ একটা নীরব শীতলতা লক্ষ করা যায় ৷ ফলে উৎসবের প্রচেষ্টা সংকটের মুখে এসে দাঁড়ায় ৷ আর্থিক সাশ্রয় এবং সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজনে কুমারঘাটকেই বেছে নেওয়া হয় সম্মেলনের স্থান হিসেবে ৷ দায়িত্ব বর্তায়  রাজ্যের শক্তিমান সাহিত্যসংগঠক , কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধরের উপর ৷ স্রোত প্রকাশনার কর্ণধার গোবিন্দ ধরের এই ধরণের বড়ো অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ সহযোগী আছেন কবি ও সম্পাদক গোপাল দাস ৷ আর আছেন মাথার উপর ছাতা ধরে রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি ও  সপ্তপর্ণা সাহিত্যপত্রের সম্পাদক নিয়তি রায়বর্মন,  কবি ও পূর্বমেঘ সম্পাদক রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কবি দিলীপ দাস , কবি ও জলজ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক সন্তোষ রায়, উত্তরপূর্বের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক দেবব্রত দেব, কবি ও গল্পকার রণজিৎ রায় প্রমুখ ৷ এনারা যদি স্নেহের পরশ রাখেন তাহলে রাজ্যের যে কোনো প্রান্তেই সাহিত্য সংস্কৃতিতে ঝড় বইয়ে দেওয়া যায় ৷ তাঁরা প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সাহচর্য দিয়ে গেছেন ৷কাজেই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিদীপ্ত নীরবতা লক্ষ করা গেলেও কাজ কিন্তু থেমে থাকেনি ৷ গত দোসরা সেপ্টেম্বর বিশেষ আলোচনসভা ডাকা হল ৷ দেশের ও দেশের বাইরের অতিথিদের আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল ৷  আরো দ্রুত গতিতে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ৷ সাবেক সমগ্র উত্তর ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ৷ গোবিন্দ ধরের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই সাহিত্য-সংস্কৃতির মহীরুহের এক একটি ডালপালা ৷ তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন সপরিবারে গোপাল দাস এবং রণজিৎ চক্রবর্তী ৷ সবাই মিলে তাঁরা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন ৷ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বাংলাদেশের অগ্রণী কথাসাহিত্যিকেরও দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টি ৷ 
তেইশ সেপ্টেম্বর কুমারঘাটে হয়ে গেল 'ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন উৎসব—2018 এতদিনের কী হয়! কী হয় উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে সেদিন ৷ কুমারঘাটের 'মাঙ্গলিক'এ আছড়ে পড়ে ত্রিপুরা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের ঢেউ ৷ কবিরা সাহিত্যসেবীরা মঙ্লচিন্তাই তো করেন ৷ জগতের মঙ্গল, সমাজের মঙ্গল, যাপনে মঙ্গল ৷ তাই এদিন মাঙ্গলিকে মিশেছিল সমস্ত শুভচেতনারা ৷ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, কোনো দাদার শ্রীপাদুকা ছাড়া, কোনো রাজপুরুষের কাঠিছোঁয়া ছাড়া শুধুমাত্র সংহতিচেতনার অবগাহনে এতোবড়ো একটা অনুষ্ঠান করা যায় তা এদিন দেখা গেল কুমারঘাটে ৷আর্থিক দৈন্যে হয়তো সম্মানিত অতিথিদের যথাযোগ্য মর্যাদায় আপ্যায়ণ করা যায়নি কিন্তু আন্তরিকতায় খাদ ছিলনা ৷ গোবিন্দ ধর, গোপাল দাস, রণজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁদের গৃহকে রীতিমতো অতিথিশালা বানিয়ে ফেলেন ৷
সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আসেন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস, কবি জয়দুল হোসেন, প্রাবন্ধিক মানবর্ধন পাল ও কবি দেবব্রত সেন ৷ 
কথায়, কবিতায়, গানে, আলোচনায় টানটান ছিল অনুষ্ঠান ৷ লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে বিজ্ঞাপন নীতি নিয়ে দাবি ওঠে উৎসবে ৷ একশো জনেরও অধিক কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক এই উৎসবে যোগ দেন ৷ ত্রিশটিরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় ৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উত্তরবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিদের কুড়িটির বেশি এক ফর্মার কবিতাসংকলন প্রকাশিত হয় ৷ 
 অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে কবি হারাধন বৈরাগি ও ছড়াকার অমলকান্তি চন্দ জানালেন আগামী উৎসব জম্পুই পাহাড়ের পাদদেশে কাঞ্চনপুরে অনুষ্ঠিত হতে হবে ৷
     এতোবড়ো সাফল্যের পরেও কথা থেকে যায় লিটল ম্যাগাজিনের পরিচয়জনিত যে দুর্বলতা,   ছোটো করে রাখার যে প্রবণতা  তাকে কাটিয়ে উঠতে হলে তাহলে আরো বেশি সাংগঠনিক শক্ত দরকার ৷ আরো বেশি নিবিড় হওয়া দরকার পারস্পরিক সম্পর্ক ৷ এই বার্তাই দেন উদ্বোধক কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস ৷