Wednesday, January 31, 2024

পরিযায়ী বৈঠক

পরিযায়ী বৈঠক

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

পরিযায়ী বৈঠকের পাশে সারি সারি টংদোকান 
আমাদেরও অনেকেই পরিযায়ী আড্ডায় আসেন 
উত্তরে দামছড়া চুড়াইবাড়ি কাঞ্চনপুর কৈলাশহর 
ধর্মনগর কমলপুর খোয়াই সদর উত্তর অঞ্চলের মানুষ 
দক্ষিণে শান্তিরবাজার বাইখোরা নলুয়া, বিলোনিয়া,
জোলাইবাড়ি  হরিনা ও সাব্রুম ছোটোখিল
কিংবা প্রাচীন রাঙ্গামাটি শহর উদয়পুর থেকে,
মাঝে মাঝে আসেন বাংলাদেশ ও 
বহির্রাজ্যের মননের মানুষেরা

 এই স্মার্ট সিটির অনেকেই আসেন প্রতি সন্ধ্যায় 
বাইক স্কুটি কিংবা হেঁটে অনেকটা ট্রাফিক এড়িয়ে 
বাহন নিয়ে এলে সুবিধা আছে তাতে হেলান
 দেওয়া যায় ।
অন্যথায় চায়ের দোকানের রমণীর বরাদ্দ চারখানা আসন 
মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ব্যবহার করতে হয় ।

সাহিত্য ও শাস্ত্রকথা থেকে শুরু করে দলীয় রাজনীতি 
কোন দলে তারুণ্য আর কোথায় বরিষ্ঠ নাগরিকের মরুদ্যান,
 মাঝে মাঝে কারো কারো ভেন্টিলেশনে যাবার খবর আসে
কোনো সন্ধ্যায় রবীন্দ্র পরিষদে গুচ্ছ স্মরণসভা হয় । 

তরুণদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে চলে যায় লং ড্রাইভে 
আবার ফিরেও আসে । বড়দের কেউ গেলে একদম ফেরারি ।
এর মাঝে কেউ কেউ পেশাগত কারণে দূর মফস্বলে যায় ।
এ রাজ্যে এটা দস্তুর যখন যেই আসুক শাসনের তখতে, 
রাজনৈতিক সন্দেহ হলে ছাপোষা কর্মীর নির্বাসনে যেতে হয় ।
তাঁরা হাসতে হাসতে বেরিয়ে যান । ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়ান না ।

রাত বাড়লেই টঙের দিদিটা শেষবারের মতো নিয়ে আসেন 
নানাবর্ণের চা আর তাড়া দেন আসনগুলো ফেরত পাবার জন্যে
কারণ তাঁকেও বাড়ি ফিরে যেতে হবে শহরতলির আঁধারে ।

তখনই  প্রথম মুখ খোলেন দু-একজন পরিচিত কবি–
কাল বাংলাদেশ যাচ্ছি হে, কবিতা পড়ব জাতীয় কবিতা পরিষদে ।
ঠেকের অন্যরা হাঁ হয়ে থাকে । এতদিন তো শুনিনি এ কথা । 
আসলে উদার আকাশের নিচে এই কদমতলার ঠেক যদিও 
চারদিকে ঝলমলে আলোয় রাতের আকাশকে যেমন 
নকল দিন বানায় তেমনি ঠেকের মেধাবীরা সব 
হাসির আড়ালে অনেক বার্তা চেপে যান ।

 পরিযায়ী বৈঠকের অনেক সৃজন ও বার্তালাপ 
মূলত শীতের পরিযায়ী পাখি ।

Tuesday, January 30, 2024

নজরুলের কবিতা ও গানে লোকসাধারণ ও লোকায়ত দর্শন

নজরুলের কবিতা ও গানে লোকসাধারণ ও লোকায়ত দর্শন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম । বিদ্রোহী ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা স্বদেশ চেতনা, বৈপ্লবিক চেতনা এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ করেছেন । তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে গেছেন দেশের জনগণের মধ্যে । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবিকতার মূর্ত প্রতীক রূপে স্মরণীয় হয়ে আছেন । তাঁর অবিস্মরণীয় চিন্তা-চেতনা এবং জীবনদর্শনের আদর্শ সবকিছুই তিনি মানুষের কল্যাণেই নিবেদন করেছেন । তাঁর শিল্পসাহিত্যের প্রতিটি ধারাতেই সমগ্র মানুষের কল্যাণ কামনার ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে । শৈশব থেকেই তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি ঘটেছে । বিদ্যালয় শিক্ষাগ্রহণ তাঁর পক্ষে ততটা সম্ভব না হলেও তিনি অসাধারণ মেধা ও মননচিন্তার অধিকারী ছিলেন । সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চকোটির মানুষের অন্তরে পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের বিশালতা ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল । তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন তেজস্বী চেতনাশক্তি এবং আধুনিক মননভাবনায় সমৃদ্ধ হয়ে তিনি একাধারে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সৈনিকজীবন, কুলি-মজুর ও দক্ষ রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উন্নীত ছিলেন । সাধারণ মানুষের স্বার্থে তাঁর প্রতিবাদীচেতনা সেসময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভীষণ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । পরাধীন ভারতের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষজনের মুক্তির বার্তা নিয়ে তিনি তাঁর লেখনি ধারণ করেছিলেন । তাঁর গগনচুম্বী মননশীলতা ও সৃজনক্ষমতা সেইসঙ্গে বলিষ্ঠ সাহিত্যভাবনা তাঁকে বাংলাসাহিত্যভুবন চিরকালের জন্য স্মরণীয় করে রাখবে ।

 তাঁর গান, কবিতায়  সাধারণ মানুষ,সমাজের উপেক্ষিত জনগণ যেমন কৃষাণ, জেলে, কুলি, মজুর নারী শ্রমিক বেদে, বাউল, সাঁওতাল, পতিতা, হরিজন, প্রভৃতি অখ্যাত, উপেক্ষিত সাধারণ জনগণের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনী ধারণ করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :

"কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন 
কর্মেও কথায় সত্য আত্মীয়তার করেছে অর্জন 
যে আছে মাটির কাছাকাছি 
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি ।
................................................
 এসো কবি অখ্যাতজনের 
নির্বাক মনের 
মর্মের বেদনা করিয়া উদ্ধার 
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার 
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি 
রসে পূর্ণ করে দাও তুমি ।"

রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই সেই অসাধারণ প্রতিভার প্রকাশ ঘটে । নজরুলের কবিতা গল্প উপন্যাস গান ও নাটকে রবীন্দ্রনাথের আশার প্রতিফলন ঘটতে থাকে । বাংলার লোকায়ত জীবনের চরম দুর্দশাগ্রস্ত পরিশ্রমী মানুষগুলোকে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এক অসাধারণ মাত্রায় উপনীত করেছেন ।

নজরুল বাংলার লোকায়ত জীবনের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন । তিনি নিজেও ছিলেন একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান । কাজেই তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে গ্রামীণ জীবনকে দেখেছেন । বাংলার  জীবনযাত্রার কেন্দ্রে রয়েছে সাধারণ মানুষ । এই মানুষগুলোই হল লোকমানুষ । অর্থাৎ সাধারণ মানুষ । এদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই । এরা স্বশিক্ষিত । গভীর দুর্দশা এবং কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে বসবাস করলেও এই মানুষগুলোই তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন । এঁদের শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে । তাঁদের গানের সুরে এক অপূর্ব দোলার সৃষ্টি হয় বাংলার ভুবনে । তাঁদের জীবনের দুঃখ-বেদনা তাঁদের সংগীত, নৃত্যানুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে থাকে বাংলার লোকায়ত আকাশ বাতাস । কবি নজরুল ইসলাম এই লোকায়ত জীবনকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন । লেটোগান রচনা করার সময় তিনি গ্রামীণ সরল মানুষজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছেন এবং তাঁদের লোকজ চিন্তাভাবনাকে বোঝার সুযোগ পেয়েছেন । পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় কিংবা ঢাকা কুমিল্লার মতো শহরে বিচরণ করলেও  বাংলার গ্রামীন সাধারণ লোকায়ত জীবনের সঙ্গে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তার কোন ফারাক ঘটেনি । এ সম্পর্কে তিনি তার নিজের সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় ( ২ জুন ১৯৪২ ) 'আমার সুন্দর' নিবন্ধে আত্মমূল্যায়ন করে লিখেছেন—
" আট বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতাম । এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসলাম । মনে হল এই আমার মা তার শ্যামস্নিগ্ধ মমতায়, তার গভীর স্নেহরসে, আমার দেহ-মন-প্রাণ শ্রান্ত উদার আনন্দ ছন্দে ছন্দায়িত হয়ে উঠল । আমার অন্তরের সুন্দরের এই অপরূপ প্রকাশকে এই দেখলাম প্রকাশ-সুন্দর রূপে ।"

এক সময় কাজী নজরুল ইসলামের এই ভাবনা বিশ্বমানবতাবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় । তিনি তাঁর শিল্প, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, প্রবন্ধে বিশ্বমানবতার যে জয়গান গেয়েছেন তার সূত্রটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাংলার লোকজ জীবনের মধ্যে । তিনি তাঁর রচনার এক জায়গায় বলেছেন, "এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল সমাজের সুন্দরের ধ্যান তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার সাধনা । যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব । আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি ।"

কাজী নজরুল ইসলামের লোকজনঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে কবি জীবনানন্দ দাশ এক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন করেছেন । তিনি উল্লেখ করেছেন যে, 
"বাংলার এ মাটি থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসে প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি নজরুল ইসলাম । তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম । পরবর্তী কবিরা এর সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধুকবি বলে জনসাধারণ মেনে নেবে । জন ও জনতার বন্ধু দেশপ্রেমিক কবি নজরুল । এই জিনিসের বিশেষ তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারা যায় যে, সময়ও যেখানে জনমানুষ তার প্রার্থিত জিনিস পেয়েছে বলে মনে করে সেখানে বাস্তবিকই তা অদ্বিতীয় ।"

কাজী নজরুল ইসলাম সবার উপরে মানুষ সত্য এ কথাটি বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর সাহিত্য ও কাব্যসৃষ্টির প্রধান শক্তিই ছিল এখানে । নিপীড়িত মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তাঁর কলমকে বিরামহীন গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । তিনি সুন্দরের ধ্যান ও স্তব গানের পাশাপাশি এদেশের কৃষক-জেলে-মজুর-শ্রমিক-তাঁতি-জোলা-নাপিত-কামার-কুমার-ফেরিওয়ালা-মাঝি এই লোকমানুষদের ও সর্ব মানবতাবাদের জয়গান গেয়ে ফিরেছেন । তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিম-পারসিক-অগ্নিউপাসক-ইহুদি-উপজাতি সকল মানুষকে একমানুষ হিসেবে দেখেছেন । এবং সবার সম্মিলিত এক মিলনমোহনা রচনার স্বার্থে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে সজাগ রেখে গেছেন । সে কারণেই তাঁর সৃষ্টি মানুষের অন্তর স্পর্শ করে আছে । ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ কামনায় তিনি সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন, লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ।   মানুষের কল্যাণার্থে সোচ্চার হয়েছেন । তিনি ভারতবর্ষের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রয়াস নিয়েছেন । হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে যাতে হিংসা হানাহানির বাতাবরণ সৃষ্টি না হয় এবং সমস্ত ভারতবাসী যাতে একসূত্রে গাঁথা হয়ে থাকে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করেন এই ছিল তাঁর মূলচিন্তা । প্রাণের আকুতি নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন–

 গাহি সাম্যের গান–
 যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান 
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান 
কে তুমি ? –পার্সি, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভিল, গারো ? ( মানুষ )

তিনি 'মানুষ'কবিতায় বারবার মানুষের জয় গান গেয়েছেন তিনি বলেছেন–

"গাহি সাম্যের গান–
 মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান 
নেই দেশ কাল পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্ম জাতি
 সব দেশে সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।"

"আদম দাউদ ইশা মশা ইব্রাহিম মোহাম্মদ 
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির বিশ্বের সম্পদ ।"

"ও কে ? চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য জীব
 ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব ।
আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী সম্রাট 
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে করিবে নান্দীপাঠ ।"

সমাজের একেবারে নিম্নবর্গের মানুষজন, প্রান্তিক মানুষগুলি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় । তিনি এইসব প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছেন । জাতপাতের ভেদাভেদ তিনি মানেন না । তিনি বলেন 'শূদ্রের মাঝে জাগিছে  রুদ্র ।' সমাজের অবহেলিত নিম্নবর্গের মানুষ যারা–ডোম, মেথর, কুলি-মজুর, কৃষক, তাঁতি, জেলে, জোলা, নাপিত, কামার, কুমোর, ফেরিওয়ালা, মাঝিমাল্লার সুখ,দুঃখ আবেগ অনুভূতিকে কবি গভীরভাবে অনুভব করেছেন। নজরুল তাঁর কবিতায় ও গানে এদের মুক্তির বার্তা তুলে ধরেছেন । 

"হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, 
পাহাড় কাটা, সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
 তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
 তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধুলি,
 তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
 তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান !"

নজরুল পুরুষ ও নারীতে কোনো ভেদাভেদ রাখতে চান না । তিনি বলেছেন–

 "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
 অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর নারী ।"

নারীমুক্তির স্বপক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন ।  নারীর শরীরে যে গয়না বা অলংকার পরানো হয় এবং তা নারীর সৌন্দর্যের নিদর্শন বলে মনে করা হয় তাকে নজরুল বলছেন শেকল । নজরুল তাঁর কবিতায়ও গানে নারীর এই শৃংখল মুক্তির কথা উচ্চারণ করেছেন ।

"স্বর্ণ-রোপ্য অলংকারের যক্ষপুরীতে নারী
 করিল তোমায় বন্দিনী বল, কোন সে অত্যাচারী ?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সে ব্যাকুলতা, 
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা !
চোখে চোখে আজও চাহিতে পারো না, হাতে রুলি, পায়ে মল
মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেলো নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল !
যে-ঘোমটা তোমা করিয়াছি ভীরু ওড়াও সে আবরণ !
দূর করে দাস-দাসীর চিহ্ন ওই যত আভরণ !"

বাংলার লোকায়ত জীবনের এক বিশাল ব্যাপ্তি রয়েছে । শব্দটিরও রয়েছে নানারকম ব্যাখ্যা । কেউ কেউ বলেন, 'লোকেষু আয়তো লোকায়ত' । অর্থাৎ যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বহমান তা লোকায়ত । আবার কেউ কেউ বলছেন, এই প্রাত্যহিক যাপনের জগতের নামই লোকায়ত । যতটুকু আমাদের দৃষ্টির গোচর সেটুকুই লোকের পরিব্যাপ্তি । এই লোকায়ত জীবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে লোকধর্ম । লোকধর্ম বলতে দুটি ভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়কে বোঝায় । একটি হল লোকসংস্কৃতির মধ্যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অবস্থান । অপরটি হল বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার সাথে লোকসংস্কৃতির উপাদানের অন্তর্ভুক্তি । স্থানীয়, জাতিগত ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় দেবদেবীর পূজার যে ধর্মধারা প্রচলিত তাই লোকধর্ম । লোকধর্মের সঙ্গে জড়িত যেসব দেবদেবীর পূজা করা হয় তা ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না । লোকসাধারণ তাদের নিজস্ব পুরোহিতের মাধ্যমে নিজস্ব বিধিবিধানে পূজা করে থাকেন ।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতা করে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলার লোকধর্ম গড়ে উঠেছিল । ইংরেজিতে এইসব লোকায়িত ধর্মকে বলা হয় 'মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টর' । বাংলায় গড়ে ওঠা সহজিয়া, রাধাশ্যামী, রুইদাসী, কর্তাভাজা, সাহেবধনী, বলরামি, জগবন্ধু ভজনিয়া ইত্যাদি লোকায়ত ধর্ম । এগুলো লোক হিন্দুধর্ম ।

বাংলায় লোকায়ত হিন্দু ধর্ম যেমন রয়েছে তেমনি বিদ্যমান লোকায়ত ইসলাম । ভারতবর্ষের পির, আউলিয়া, সুফি, সাঁই,দরবেশ, হযরতী, কবিরপন্থী, দাদুপন্থী  ইত্যাদি লোকায়ত ইসলামের নিদর্শন । বাংলার লোকধর্মের এই ধারায় মধ্যযুগে যে ইসলামের প্রচার হয়েছে তা স্থানীয় আচার-বিশ্বাস, রীতি-নীতির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এক বিশেষ সহজিয়া রূপ পেয়েছিল । পারস্যদেশ থেকে আসা সুফিবাদি ইসলাম এ দেশের সাধারণ জনগণের অন্তরে স্থান করে নিয়ে ইসলামের সৃষ্টি করেছিল ।

বাংলার লোকায়ত হিন্দুধর্মের আরও দুটি শাখা বিস্তার লাভ করেছিল । তা হল, বৈষ্ণবসাধনা ও কালীসাধনা । ষোড়শ শতকে ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা এবং লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মের উদার আহ্বান করে শ্রী চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন । এই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম লোকায়ত বৈষ্ণবধর্ম । সেকালে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার রোধ করার উদ্দেশ্যেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এক উদার সমন্বয়ধর্মী বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেছিলেন । এই লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি সপ্তদশ শতকে বাংলায় আগমবাগিশের হাত ধরে শুরু হয়ে অষ্টাদশ শতকে রামপ্রসাদের মাধ্যমে প্রচার ও প্রসার পেতে থাকে শাক্তধর্ম । এই সময়ে শাক্তধর্ম নবরূপ লাভ করে এবং বাংলা সমাজ সংস্কৃতিতে তা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার লাভ করে । উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় চিন্তাধারায় যুক্ত হয়ে কালীসাধনায় এক দার্শনিক মাত্রা পায় ।

হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকধর্মের মধ্যে এক আশ্চর্য মিল বর্তমান । তা হল, স্রষ্টা ও সৃষ্টির একাত্মতা অনুভব । একে বলা হয় অদ্বৈতবাদ । অদ্বৈতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোন ফারাক নেই । উভয়ে অভিন্ন । স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্কঊ প্রেমের । প্রভুভৃত্যের নয় । এ এক দার্শনিক অনুভূতি । বাংলার লোকমানুষের এই অনুভব লোকায়ত দর্শন । এই দর্শনকে ঘিরে রচিত হয়েছে বৈষ্ণবপদাবলী, শাক্তসাহিত্য বাউল ও ইসলামী গান ।‌ প্রেমচেতনায় ঋদ্ধ হয়ে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকে এক করে দেখার যে দর্শন নজরুল তাঁর ধর্মীয় সংগীতসমূহে রেখেছেন তা বাংলার লোকায়ত দর্শনের উত্তরাধিকার । শ্যামা ও শ্যামসঙ্গীতে নজরুলের সমন্বয়চেতনার রূপ তাঁর স্বীয় ধর্মদর্শনের অভিব্যক্তি । তাঁর শ্যামা সংগীত গুলো যেমন–
১) মহাকালের কোলে এসে গৌরী হলো মহাকালী 
২) বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলে শ্যামা মায়ের চরণতল 
৩) শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধুপকাঠিতে 
যত জালি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে 
৪) আমার হাতে কালি মা মুখে কালি
 আমার কালী মাখা মুখ দেখে মা 
পাড়ার লোকে হাসে খালি 
৫) শ্মশানে জাগিছে শ্যামা অন্তিমে সন্তানে দিতে কোল 
৬) মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয় 
৭) জগৎ জননী শ্যামা 
৮) আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
     দেখে যারে আলোর নাচন–ইত্যাদিতে তিনি শাক্ত হয়ে যান । তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটাকেও একটি রাঙাজবা করে তুলে ধরতে চান । আবার শ্যামসঙ্গীতে লোকায়ত ঐতিহ্যের চিরকালীন নায়ক নায়িকা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকেই মানবিক রূপ দান করেছেন । তিনি রূপকের আড়ালে প্রেমিকের প্রতি প্রেমাস্পদের পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষাকেই প্রকাশ করেছেন । তাঁর এই পর্যায়ের সংগীতসমূহ–

১) হে গোবিন্দ রাখো চরণে
২) প্রভুজি তুমি দাও দরশন 
৩) জাগো মোহন প্রীতম 
৪) হে মাধব হে মাধব হে মাধব তোমারে এই প্রানের বেদনা কব 
৫) কৃষ্ণ কৃষ্ণ বল রসনা রাধা রাধা বল
৬)  বনে যায় আনন্দ দুলাল বাজে চরণে নুপুরের রুনুঝুনু তান 
৭) এসে নুপুর বাজাইয়া যমুনা নাচাইয়া কৃষ্ণ কানাইয়া হরি 
৮) আমার নয়নে কৃষ্ণ নয়ন তারা হৃদয়ে মোর রাধা প্যারি 
৯) হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই 
১০) গাহ না অবিরাম কৃষ্ণ নাম কৃষ্ণ নাম
একেবারে ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েও বাংলার সংগীতের ইতিহাসে এত সফল বৈষ্ণব ও শাক্তসঙ্গীত রচনার কৃতিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর খুব একটা দেখা যায় না । এই ধারার সংগীতে ভক্তি ও অনুরাগের পাশাপাশি শাক্ত ও বৈষ্ণবের মধ্যে মিলনের বা সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টাও নজরুলের সংগীতের মধ্যে পাওয়া যায়–

মা আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম 
মা হলেন মোর মন্ত্র গুরু ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম ।

নজরুল একদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত । তেমনি অন্যদিকে লিখেছেন ইসলামী ভক্তিমূলক গান, মুর্শিদী ও মারফতি । লেটোর দলকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতপ্রতিভার বিকাশ ঘটে । এখানে পালা রচনা করতে গিয়ে তাঁকে হিন্দু ও মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করতে হয় । তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনি ও গীতরচনার উপাদান সংগ্রহ করেছেন অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন । তাঁর সেই সময়কার রচনায় এই দুই ঐতিহ্যের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায় । নজরুলের  শ্যাম ও শ্যামাসংগীতে প্রেমিকের, সাধকের যে রূপ ইসলামী গান ও ভক্তিগীতিতেও সেই একই রূপকল্পই লক্ষ্য করা যায় । এখানেও প্রেমের আবেদন তীব্র আবেগের ও অনুভবের । নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিয়ে সৃষ্টিতে মিশে এক হয়ে যেতে চেয়েছেন সাধক কবি নজরুল । সুফিবাদীরা একেই বলেন 'ফানা ফিল্লাহ' । অদ্বৈতসত্তার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া । মিলনের এমন নিবিড় অনুভব নজরুলের ইসলামী সংগীত পাওয়া যায়–

১) তাকে যে পাইতে চায় হযরত কে ভালবেসে 
২) হে নামাজী আমার ঘরে 
৩) তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে 
৪) মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই 
৫) ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ 
৬) তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম 
৭) শোনো শোনো ইয়া এলাহী 
৮) রোজ হাশরে আল্লাহ আমার
৯)  ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ 
১০) আল্লাহকে যে পাইতে চায়

গ্রামীন চিরায়ত লোকসংস্কৃতির রূপকে প্রকাশ করার জন্যই নজরুলের যত শিল্পের প্রয়াস । লোকচেতনার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার একটা যোগ রয়েছে । ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটা উদার মানবতাবাদী দর্শনের নাম লোকায়ত দর্শন । বাঙালিজাতি আবহমানকাল ধরে এই দর্শনকে লালন করে আসছে । এই লোকায়ত দর্শনেরই আধুনিক প্রকাশ ঘটেছে নজরুলের কবিতা ও গানে । লোকায়ত চেতনার ধারায় সিঞ্চিত সংগীতের মাধ্যমে চলে আধ্যাত্মিক সাধনা । বাউলধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা সংগীতের মাধ্যমে সাধনভজন করে থাকেন । তাঁদের সংগীতে ফুটে উঠে লোকসুর । নজরুলের গানের কথা সুর ও বিষয়বৈচিত্র্যে সেই লোকায়ত জীবনের ঐতিহ্যময় সহাবস্থানের বিষয়টাই বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে । 

বর্তমান হিংসাদীর্ণ বিশ্বে যখন মানবমারণযজ্ঞের হোমানল চারিদিকে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে , সন্ত্রাস আর আধিপত্যবাদের দাপটে সারা পৃথিবী পর্যুদস্ত, বার বার পৃথিবীর নানাপ্রান্তে রণহুংকারে কেঁপে উঠছে পৃথিবী এই সময়ে নজরুলের সৃষ্টিসম্ভারকে অধ্যয়ন করতে হবে । সত্য সুন্দর কল্যাণের পূজারী নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানুষের মুক্তি । বস্তুত তাঁর সাম্যবাদী ও সমন্বয়ধর্মী চিন্তা আর সম্প্রদায় নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে ।‌ হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের যৌতুক না হয়ে চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক শক্তি । এদেশে লোকজনগণ এবং লৌকিক ঐতিহ্যকেই নজরুল মানবকল্যাণের জন্য চিহ্নিত করতে পেরেছেন ।

Tuesday, January 23, 2024

শ্রীরাম ও রামলালা

শ্রীরাম ও রামলালা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

রাম, রামবিগ্রহ, রামমন্দির নিয়ে গতকাল সারাদেশ এক বিপুল উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল । আমরা এতকাল শ্রীরামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম 'রামচন্দ্র', 'রাঘব', 'রঘুপতি', 'সীতাপতি' ইত্যাদি বহু নামে । কিন্তু এবারে পেলাম নতুন শব্দ 'রামলালা' । আমরা বাঙালিরা এই শব্দটির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নই । কিন্তু কাল এই শব্দটাই মুখে মুখে ঘুরেছে । কিন্তু খুব কম জনই জানতে চেয়েছি এই 'লালা' শব্দের উৎস ও অর্থ । কাল সারাদিন অনেকেই অযোধ্যার পথে হেঁটে রামলালার জন্যে যতটা লালায়িত হয়েছেন, রাম কেন লালা তার খোঁজ মোটেও করেননি। এই অবসরে আমি একটু ভাষাতত্ত্বের আশ্রয়ে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছি তার উৎস ও অর্থ । জনিনা কতটা সার্থক বা কতটা সফল আমি ।

মহাকবি তুলসীদাস ( ১৪৯৭ ) ১৫৭৫ সালের চৈত্র মাসের শুক্লা নবমী বা রামনবমী তিথিতে 'রামচরিত মানস' লেখা শুরু করে ১৫৭৭ সালের অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে তাঁর রচনা শেষ করেন । গ্রন্থটি তিনি অবধি বা আওয়াবী ভাষায় লিখেছিলেন । অবধি বা আওয়াধি উত্তরপ্রদেশের অবধ অঞ্চলের এবং নেপালের তরাই অঞ্চলের একটি ইন্দো আর্য ভাষা । একে অনেকে হিন্দি উপভাষাও বলেন । অনেকে বলেন পূর্বে হিন্দি । রামের জন্মভূমি অযোধ্যা অবধ ভাষার কেন্দ্রভূমি । হিন্দির আরেকটি উপভাষা হল ব্রজভাষা । এটি পশ্চিম হিন্দি উপভাষা । এই উপভাষাটি শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান প্রাচীন ব্রজভূমির ভাষা । মথুরা এই ব্রজভাষা অঞ্চলের কেন্দ্রভূমি । এই দুই উপভাষাই এসেছে সৌরশেনী প্রাকৃত থেকে ।

সেকালে অবধ ভাষায় রচিত আরো সাহিত্যের নিদর্শন রয়েছে । মালিক মোহাম্মদ জাইসির 'পদুমাবৎ' বা পদ্মাবতী ( ১৫৪০ ) কাব্যও এই অবধি ভাষায় রচিত । তুলসীদাস রামায়ণ সংস্কৃত ভাষায় রচনা না করে অবধি ভাষায় রচনা করেছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ তা পড়তে ও বুঝতে পারে ।

এই অবধ ও ব্রজভাষায় পুত্রসন্তানকে 'লালা' বলা হয় মূলত শব্দটি এসেছে 'লল্লা' থেকে । যার অর্থ আদুরে শিশু ।
যেমন ব্রজ ভাষায় দেখি শ্রীকৃষ্ণ নন্দের শিশুপুত্র অর্থে 'নন্দলালা' । তেমনি অবধ ভাষায় ভক্তরা শ্রীরামকে তাদের শিশুপুত্র হিসাবে মনে করে নাম দিয়েছেন লালা ( স্নেহের শিশু ) । তাছাড়া অযোধ্যার গর্ভগৃহে যে রামে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তা বালক রাম । পঞ্চমবর্ষীয় নাবালক রাম । তাই তিনি রামলালা । এটুকুই আমার সন্ধান । ভুল হলে শুধরে দেবেন প্রাজ্ঞজন ।

Friday, January 19, 2024

কবির বর্ম

কবি সত্যকথা বলেন । এটাই তার মনন ।
তাই কবির উপর অনেকে বিরক্ত হয় ।
কেউ কেউ কবিকে ভাবে ভীষণ বোকা  ।
কারো কারো কবির জন্যে মায়া হয় খুব ।

কবি এসব কথা জানেন না তেমনটা নয়
তবুও কবি সত্যের কাছে অবনত থাকেন ।
কবিতাই কবির বর্ম, সাহসের শক্তিময় ঢাল
কবিতার শব্দে শব্দে সত্যকে তুলে ধরেন

আঁধারের প্রাণীরা সব কবির উপর খেপে যায়
তারা কবিকে নির্বাসনের ফতোয়া ধরায়
 কবি তখন দূর মফস্বলে নিয়মিত নিত্যযাত্রী ।

পরিজনহীন ভূখন্ডে কবি নতুন দুনিয়া গড়েন ।
কবি খুঁজতে থাকেন, সে ভূখন্ড সত্য কোথায় আছে ?

Thursday, January 18, 2024

কবিতা

কবিতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কত কথা আসে কত কথা চলে যায়
মনে হয় কিছু কিছু শব্দ ধরি করতলে
কিংবা মণিকোঠায় পুরে আটকে রাখি
 যাতে না পালায় । কিন্তু শব্দ চঞ্চল ।
কথারা আটকে থাকে না কোনো বাঁধনে ।

শব্দ কিংবা শব্দ জুড়ে কথার শরীর
যাই বলো না কেন সে যদি কবিতা হয়
তার শরীর থেকে কবিতার কস্তুরী ফোটে
তাহলে তাকেই বেঁধে রাখব বুকের ভেতর

Wednesday, January 17, 2024

লোকধর্ম ও লোকাচার

লোকধর্ম ও লোকাচার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


পৃথিবীর যে কোন দেশেরই সৃষ্টিশীল কর্মপ্রণোদনায় সেই দেশের লোকসংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । মূলত, লোকসংস্কৃতি সৃষ্টিশীলতার আদি ও অকৃত্রিম উৎসমূল । আধুনিক বাংলাসাহিত্য বহিরঙ্গে যতই কৃত্রিম অলংকারের সজ্জিত হোক না কেন, তার অন্তর্মূলে লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাকে অস্বীকার করা যায় না ।  সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞে লোকসংস্কৃতি প্রণোদনা শেকড় অভিমুখী অভিযাত্রা । লোকসংস্কৃতির সূত্র ধরেই মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচেতনা ও আদিমননের উৎসে পৌঁছানো যায় । যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে লোকসংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে থাকার ফলে তার সূত্র ধরে একটা জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক বিবর্তনের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় ।

লোকসংস্কৃতির বহু শাখার মধ্যে অন্যতম লোকধর্ম ও লোকাচার । মানুষের দুর্বল মানসিকতা অনিশ্চয়তার আশঙ্কা শুভ ও শুভ বোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে লোকধর্মের । লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লোকধর্মের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । লোকধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে লোকসংস্কৃতিক উপাদান নিহিত থাকে । লৌকিক ধর্মাচরণকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার জন্য লোকসংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার করা হয় । আবার লোকসংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালনের সময়ও ধর্মীয় বিষয় তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে । ফলে সাংস্কৃতিক আচরণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকধর্ম ও লোকসংস্কৃতি ও প্রত্যভাবে জড়িত হয়ে পড়ে এবং দুটি ক্ষেত্রে একটা সমন্বয়ধর্মীতা লক্ষ্য করা যায় ।

লোক ধর্মের প্রধান বিষয় হল ভক্তি বা শ্রদ্ধা । সংস্কৃতির এই পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগে– ১)  প্রকৃতির শক্তিকে ভক্তি প্রকাশ করা হয় ২) পূর্বপুরুষদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় ৩) শক্তিমান দেবতাদের ভক্তি করা হয় এবং ৪) অশুভ শক্তিতেও মান্য করতে দেখা যায় । এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে পূজা, উপাসনা কিংবা লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিলক্ষিত হয় । প্রচলিত উচ্চ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের বিপরীতে লোকধর্মের ধারাটি প্রবাহমান থাকে । লোকধর্মের মধ্যে যাদু বিশ্বাস, কুসংস্কার ও মিথের প্রভাব থাকে । লোকধর্মের বিষয়গুলো প্রচলিত ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না । কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক বিভিন্ন লৌকিক কাব্যগ্রন্থের বর্ণনায় লোকঐতিহ্য উঠে আসে । ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে লোকঐতিহ্যের অবদান বিশাল প্রভাব ফেলে । এর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ ও নিহিত থাকে । লোকধর্ম অভিজাতধর্মের সঙ্গে অনেক সময় মেলেনা । কিন্তু অভিজাতধর্মের অনুশীলনে লোকধর্মের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদান আচার বা প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয় । কাজেই অভিজাতধর্মের উৎস সন্ধান করতে গেলে লোকজ ধর্মকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় । লোকধর্মের মূল কথা একে অপরের সাথে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা। লোকজীবনের সুদৃঢ় বাঁধুনী লোকসংস্কৃতি ও লোক ধর্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত । সুসংহত সমাজসৃষ্টিতে লোকধর্মের ভূমিকা ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে ।

এই লোকধর্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বিভিন্ন লোকাচার । লোক মানে মানুষ । আচার অর্থ প্রথা বা আচরণ । অতএব লোকাচার হল এক সংহত জনগোষ্ঠীর পালিত পদ্ধতি বা আচরণ । সমাজবদ্ধ মানুষ সমাজের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নানারকম পদ্ধতি বা আচরণ অনুসরণ করে । এই সমস্ত আচরণ বা পদ্ধতির নাম লোকাচার । সমাজবিজ্ঞানী  w. G. Sumner-এর মতে 'সামাজিক পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের অজ্ঞাতে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ যেসব আচরণবিধিকে অনুসরণ করে সেই সব আচরণবিধি হচ্ছে লোকাচার ।  P Gisbert বলেন, 'স্বতঃস্ফূর্ত মানবীয় আচরণ হল লোকাচার ।'

লোকাচারের বিভিন্ন ধারা রয়েছে । ১) সামাজিক ঐতিহ্য সংক্রান্ত লোকাচার ২) পোশাক পরিচ্ছদ সংক্রান্ত লোকাচার ৩) কথোপকথন সংক্রান্ত লোকাচার ৪) আচরণ সংক্রান্ত লোকাচার ৪) শিষ্টাচার সংক্রান্ত লোকাচার ৫) ধর্ম ও উৎসব সংক্রান্ত লোকাচার ইত্যাদি ।

লোকাচারের বৈশিষ্ট্য :
১) লোকাচার সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
২) লোকাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারংবার অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজের লোকাচারের একটা মান্য রূপ পায় 
৩) লোকাচার স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিকল্পিতভাবেই সমাজে উদ্ভব হয় ।
 ৪) লোকাচারের আইনি বা নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই । লোকাচার পরম্পরা সূত্রেই প্রয়োগ হয় । 
৫) জনসমাজ ভেদে লোকাচারের ও তারতম্য ঘটে ।
৬) বিশেষ বিশেষ লোকাচার বিশেষ বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে ।

বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম লোকাচার পালন করতে দেখা যায় । কিছু কিছু লোকাচার সমাজে কঠোরভাবে মান্য করা হয় । সমাজ জীবনকে সুস্থ সুন্দর ও স্বাভাবিক রাখার জন্য সমাজবদ্ধ মানুষ এই লোকাচারগুলো পালন করে থাকে । সুসংহত জনগোষ্ঠীতে আবার কিছু কিছু বিশেষ আচার-আচরণকে পরিত্যাজ্য বলে মান্য করা হয় এবং জীবনচর্যায়ও তা অনুসরণ করা হয় । লোকাচারের অবশ্য পালনের দ্বারা অনুশাসনের মাধ্যমে সামাজিক অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে একপ্রকার শৃঙ্খলা ও সমন্বয় রক্ষা করতে দেখা যায় । সরল গ্রামজীবনে পালিত লোকাচার সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করা বা নিয়ন্ত্রণ করারও মাধ্যম । মূলত, সমাজ জীবনে লোকাচার সমূহ বংশ-পরম্পরাক্রমে পালিত হয়ে লোকধর্মের মতোই এক একটি জাতিগোষ্ঠীকে আন্তর্সম্পর্কে বেঁধে রাখে ।

Sunday, January 14, 2024

আলন্তী

পৌষ সংক্রান্তি । উত্তরায়ণ । মকর সংক্রান্তি । অনেক নাম এই দিনটির । পৌষমাসের শেষদিন । তাই পৌষ সংক্রান্তি । এদিন সূর্য ধনুরাশি থেকে মকররাশিতে প্রবেশ করেন । যেহেতু এই দিনটি সূর্যের দক্ষিণ থেকে উত্তরে সরে যাওয়ার দিনটি সূচিত করে তাই এই দিনটিকে উত্তরায়ণ বলা হয় । তাই এই দিনটি সূর্যের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় । এই উৎসবটিও সূর্যের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করাহয় । সূর্যকে ঘিরেই এদিনের  লৌকিক আচার অনুষ্ঠান আয়োজন । কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে এইদিনের উৎসবের নাম 'আলন্তী'  । এর সঙ্থেগেও রয়েছে সূর্কেযের যোগ । হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই দিনের ভাগ ক্রমশ কমে আসতে থাকে । ফলে দিনের মধ্যে আলোকিত সময়কালও কম থাকে ।  একসময় সূর্য একেবারে দক্ষিণে হেলে পড়ায় দিনের বেলায় সূর্যের খুব কম সময়ের জন্য থাকে । এদিন থেকে তা আবার বাড়তে থাকে । ধরিত্রী আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য আলোবতী/আলোবন্তী হতে থাকেন । এই আলোবন্তী থেকে আঞ্চলিক শব্দ 'আলন্তী' । আসলে এও এক আলোর উৎসব । দিবালোকের উৎসব । হিম শীতঋতুর হাত থেকে ক্রমশ নিস্তার পাওয়ার আশায় আলোকবন্দনা । এই দিনটিকে নিয়ে যেমন বহু পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে তেমনি রয়েছে নানা লৌকিক আচার ও অনুষ্ঠান । এদিন গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় যে আলপনা দেওয়া হয় সেখানেও আছে আলোচেতনা । গৃহাঙ্গনকে উজ্জ্বল ও আলোকিত করার সুপ্তচিন্তা । সংস্কৃত আলিম্পন থেকে এসেছে আলপনা । বোঝা যায় আলপনার ঐতিহ্যও বহু প্রাচীন ।

Monday, January 8, 2024

সাব্রুমের আইসিটি ও স্থল বন্দর : সম্ভাবনা, সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা

সাব্রুমের আইসিপি ও স্থলবন্দর :  সম্ভাবনা সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার দক্ষিণ অংশের প্রান্তিক শহর সাব্রুম । এটি দক্ষিণ ত্রিপুরার একটি মহকুমা শহর । শহরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে ফেনী নদী । এই নদী ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানা নির্দেশ করে । ফেনী নদীর ওপারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা সদর রামগড় । সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে । দুদেশের সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ এই সেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু–১ ।
এই সেতুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সেতু সংলগ্ন স্থানে ভারতীয় ভূখন্ডে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট স্থাপনের প্রক্রিয়া জোর কদমে চলছে । এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ফেনী নদীকে ব্যবহার করে দুপারে যাতায়াতের ইতিহাস রয়েছে । এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । বিশেষত ত্রিপুরারাজ্যের তিনদিকেই বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত । দক্ষিণ ত্রিপুরার এই অংশ দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ASEAN-ভুক্ত একটি দেশ মায়ানমারের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপনের সুযোগ রয়েছে । ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর এবং মিজোরামের সঙ্গে মায়ানমারের সীমানা রয়েছে । কিন্তু সেগুলো খুবই দুর্গম অঞ্চল । সেই তুলনায় বাংলাদেশের সঙ্গে টেকনাফে নাফ নদীপথে যোগাযোগ অনেক সহজ এবং দীর্ঘদিন যাবত এই যোগাযোগ রয়েছে । সাব্রুমে নবনির্মিত মৈত্রীসেতুর মাধ্যমে এই যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় করা সম্ভব ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট  :  সাব্রুমের মৈত্রীসেতু এবং আইসিপিকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যপথ বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তা শুধুমাত্র ইদানিং কালের ঘটনা নয় । এর একটা সুদূর অতীত ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরার রাজআমলে মায়ানমারের ( তদানীন্তন আরাকান ) সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক তো ছিলই । খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ত্রিপুরায় অবস্থিত পিলাক ছিল নামকরা শিক্ষা কেন্দ্র  । সে সময়ে মায়ানমার তথা পূর্বতন আরাকান থেকে ছাত্ররা পড়াশোনা করার জন্য পিলাকে আসত । এছাড়া সে সময়ের পিলাক ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র । ফলে আরাকান থেকে বহু বৌদ্ধ ধর্ম পিপাসুরাও এখানে আসতেন ।  মায়ানমার বা অতীত আরাকান থেকে মানুষজন এই পথেই চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে এসে ফেনী নদী পেরিয়ে পিলাকে যেতেন ।

এছাড়া 1857 সালে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল তার ঢেউ চট্টগ্রামেও আছড়ে পড়েছিল । সে বছরের ১৮ এবং ১৯ শে নভেম্বর হাবিলদার রজব আলী খানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল সেই বিদ্রোহী সেনারা কোষাগার থেকে অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে এই পথ দিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন । চট্টগ্রাম শহরে সে সময়ে ক্যাপ্টেন P H K Dewool ছিলেন ৩৪ নম্বর রেজিমেন্ট এর প্রধান । তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ জানিয়ে ১৮ নভেম্বরের এক সপ্তাহ পরে 24 নভেম্বর একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J Hearsey K C B- কাছে যিনি প্রেসিডেন্টি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন সেই দুর্লভ চিঠিতে আছে—" I have been informed by a native named Thakur bux formally jemadar of Chittagong provincial battalion, whom the mutineerse forced to go some distance with them, that the pay-habilder of number-4 company named Rujab Ali Khan, has assumed command of the detectment, which we here has crossed the Feny river and entire the territories of Rajah of Tiperah. ( Orlich Leopold Von ( 1858 )- The Mutiny of India : Its Origin and Its Result, T and W boone, 29 newbond Street ). তিনি এই পত্রে উল্লেখ করেন যে, বিদ্রোহীরা ফেনী নদী পেরিয়ে ত্রিপুরার রাজার রাজ্যে প্রবেশ করেছে । এতে করে সাব্রুমের সীমান্ত অঞ্চলকেই বোঝায় । অর্থাৎ এই বিদ্রোহীরা রাজন্য ত্রিপুরার সাব্রুমের উপর দিয়েই সিলেট হয়ে মণিপুরের দিকে পলায়ন করেছেন । এছাড়া, সে সময়ের অন্যান্য সরকারি নথিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাওয়ার জন্য বিদ্রোহী সিপাহীরা সীতাকুণ্ড ফটিকছড়ি রামগড় হয়ে ফেনী নদী অতিক্রম করেছিলেন ( চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান প্রথম খন্ড )।

আর সাম্প্রতিককালের ঘটনা তো অনেকেরই স্মরণে আছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকেই । এবং চট্টগ্রাম থেকেই মূল সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল । সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রামগড় হয়ে ফেনীনদী পেরিয়েই ভারতের সাব্রুমে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং সাব্রুমের হরিনাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একনম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ইতিহাস তো সবারই জানা ।

অবস্থানগত সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা  :  সাব্রুমে আইসিটি স্থাপনের ফলে সাব্রুমের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন শহর রামগড়ও এই অঞ্চলের বাণিজ্য মানচিত্রে চলে এসেছে । ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই আইসিপির কার্যকলাপের সুফল হিসাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সাব্রুম আইসিপি থেকে সড়কপথে ও রেলপথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্রুত যাওয়া সম্ভব হবে । এখনো সাব্রুম থেকে রামগড় পৌঁছানোর পর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই বারইয়ারহাট হয়ে বিশ্ব রোডের মাধ্যমে সে দেশের অভ্যন্তরে যে কোন জায়গায় যাওয়া যায় । সাব্রুমে আইসিপি স্থাপন হওয়ার ফলে সাব্রুম থেকে বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্র ও নদী বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে । চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দর । এটি সাব্রুম থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । সেইসঙ্গে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চতুর্থ সমুদ্র বন্দরও ব্যবহার করা সম্ভব হবে ।  এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে খুলনা বিভাগে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দ্বিতীয় ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর মংলা বন্দরকেও ব্যবহার করা যাবে । বন্দরটি পশুর নদী ও মংলা নদীর বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী সংযোগস্থলে অবস্থিত । এটি সে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সমূহ ও খুলনা নগরীর মাধ্যমে সারাদেশের সাথে রেলপথে সংযুক্ত । এছাড়া সাব্রুম আইসিপির পশ্চাদভূমি হিসাবে বাংলাদেশের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকেও যুক্ত করা যাবে । চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে মাত্র তিন ঘন্টায় ট্রান্সক্রিপমেন্টের পণ্য আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা সম্ভব । এখান থেকে সড়ক ও রেল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আটটি রাজ্যে সরাসরি পণ্য প্রেরণ করা সম্ভব হবে । ফলে এ অঞ্চলের পাঁচকোটির বেশি মানুষ উপকৃত হবেন । বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য কলকাতা বন্দর থেকে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে ১২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয় ।  চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করে সাব্রুম আইসিপি দিয়ে এ দেশে পণ্য আনা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে প্রেরণের সুযোগের ফলে যেমন দূরত্ব কমে যাবে তেমনি সময়ও কম লাগবে । পরিবহন ব্যয় কম হবে ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে । এছাড়া বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ে অল্প দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এদেশের মাটিতে পণ্য নিয়ে আসার ফলে সেদেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার যে কর দিতে হবে তাও আনুপাতিক হারে কম লাগবে । পণ্য পরিবহন পথের দূরত্ব কম হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা স্বল্প ব্যয়ের পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারবেন । এছাড়া আইসিপি সন্নিহিত ল্যান্ডপোর্টে কারগো বিল্ডিং এর সুবিধা থাকায় সেখানে তাদের পণ্য মজুদও রাখতে পারবেন ।

আরেকটি লক্ষনীয় বিষয় যে, প্রায় প্রতিবছরই বর্ষার সময় পাহাড়ের ধ্বস নামার ফলে ত্রিপুরা মিজোরাম ও আসামের বরাক উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ফলে বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থায় সেই সময়ে এই অঞ্চলে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । সাব্রুম আইসিপি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হলে এই দুরবস্থার চিরস্থায়ী সমাধান হবে । সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের রামগড় হয়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরের সড়ক পথ ও রেলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারও ত্রিপুরার খোয়াই, কমলপুর, কৈলাশহর ও আসামের কাছাড়ের করিমগঞ্জের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহের মধ্যে পণ্য পরিবহন করতে পারবে । আমাদের দেশের অভ্যন্তরের উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল বাংলাদেশও গ্রহণ করতে পারবে । এছাড়া চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সে দেশের রেললাইন সম্প্রসারিত হলে এবং তা সাব্রুমের আইসিটি পর্যন্ত এগিয়ে আনা হলে এই পরিবহন ব্যবস্থা আরো সময় সাশ্রয়ী সুগম ও কম দূরত্বের হবে । টেকনাফ হয়ে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা থাকার ফলে সাবরুম আইসিপির শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক করিডোর হিসেবে প্রাধান্য লাভ করবে এই আইসিপির মাধ্যমে শুধু চট্টগ্রাম নৌবন্দর নয় এখান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন শহরে যাওয়া যাবে । পাশাপাশি সে দেশের মানুষ সাবরুম আইসিপি দিয়ে এসে মাত্র ৩০ টাকা ব্যায়ে আগরতলার মহারাজা বীর বিক্রম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরও সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে । প্রসঙ্গতা উল্লেখ্য যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু যে নদীটির উপর নির্মিত সেই ফেনী নদীতে যদি ড্রেজিং করে তার নাব্য্যতা বাড়ানো হয় তাহলে এই জলপথটিও পণ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যাবে এবং এই আইসিপিকে কেন্দ্র করে সাব্রুমে একটি নদীবন্দর গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে । এক সময়ে এই ফেনী নদীতে নৌযান চলাচল করত । নৌকা করে পণ্য পরিবহন চালু ছিল বহুদিন । এই নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপি থেকে বা সাব্রুম আইসিপিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পণ্য সুলভে পরিবহনের এই মাধ্যমকে আবার শুরু করা যেতে পারে ।

সাব্রুমের সম্ভাবনাময় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ( Special Economic Zone ) প্রস্তুতি ও সুবিধা : সাব্রুমের পশ্চিম জলেফায় আইসিপি ও রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ জোর কদমে চলছে । এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প, চা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বাঁশশিল্প, বস্ত্রশিল্প, রাবারভিত্তিক শিল্প, হস্ত-কারু ও ছোটো ছোটো কুটির শিল্প গড়ে তোলা হবে । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে ত্রিপুরা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই স্পেশাল ইকোনমিক জোনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য সাবরুম আইসিপিও স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ি ও মংলা ও বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভোক্তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যাবে ।

সাব্রুম আই সি পি ও স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি সম্ভাবনা  :  সাব্রুম আইসিটি ও স্থলবন্দর এর মাধ্যমে দুই ধরনের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে প্রথমত পণ্য আদান-প্রদান এবং দ্বিতীয়টি হল পরিষেবা বিষয়ক আদান-প্রদান । পণ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাবারের কথা । এই অঞ্চলে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের রাবার উৎপন্ন হয় । সাব্রুমে বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ফলে এখানে রাবার ভিত্তিক শিল্প কেন্দ্রে উৎপাদিত পণ্য এই পথ দিয়ে সরাসরি পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপণনের ব্যবস্থা করা যাবে । ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরেকটি বিশেষ অর্থকরী ফসল হলো চা । ত্রিপুরার চা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের । ব্রিটিশ আমলে  ত্রিপুরায় উৎপন্ন চা চট্টগ্রামের চা-বাজারে তোলার উদাহরণ রয়েছে । পরবর্তী সময়ে দেশভাগের ফলে এই কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বর্তমানে এই উদ্যোগটিকে আবার পুনর্জীবিত করা যায় । ত্রিপুরার অন্যতম বাগিচা ফসল আনারস বিখ্যাত । ইতোমধ্যে আনারস আরব আমিরশাহীতে রপ্তানি হচ্ছে । সাব্রুম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেন্দ্রে আনারস ও অন্যান্য স্থানীয় ফল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এর বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়া যেতে পারে । এছাড়া নানারকমের মশলা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্য বিশেষ ধরনের পাথর ও এই আই সি পি ও স্থলবন্দরের এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রেরণ করা যেতে পারে ।

সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তৈরি পোশাক, মাছ ও শুটকি ইত্যাদি আনা যেতে পারে । উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের মাছ ও শুটকির খাদ্যাভ্যাস রয়েছে হলে এই পণ্য গুলির ব্যাপক আমদানির সুযোগ রয়েছে এছাড়া বাংলাদেশ থেকে সুলভে ইট সিমেন্ট ও প্রসাধন সামগ্রী ইত্যাদি আনা যাবে ।

সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে পরিষেবা মূলক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প, উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার প্রসার ঘটানো যাবে । উত্তর-পূর্ব থেকে সমুদ্র সৈকতে দেখতে হলে আমাদের দিঘা কিংবা পুরীতে যেতে হয় বহু পথ পাড়ি দিয়ে । অথচ এই রাস্তা দিয়ে অতি সহজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যাওয়া যায় । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় হিন্দু জনগণেরও পরিভ্রমণ করার মতো অনেকগুলো তীর্থক্ষেত্র রয়েছে সেই তীর্থ ভ্রমণ করা যাবে এই আইসিপি দিয়ে । বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুরাও অতি অল্প সময়ে সাব্রুম আইসিপি পেরিয়ে সড়ক ও রেলপথে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের জন্য যেতে পারেন । পাশাপাশি বিত্তবান মানুষেরা এই পথ দিয়ে আগরতলায় গিয়ে বিমান যাত্রার সুযোগ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারেন । প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বহু রোগি চিকিৎসার জন্য কলকাতা চেন্নাই ব্যাঙ্গালোর ও হায়দ্রাবাদ যান । সাধারণত বাংলাদেশের বিত্তবান লোকেরাই এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন । নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পক্ষে তা অধরাই থেকে যায় । সাব্রুম আইসিপির অদূরে কিংবা ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরে কোথাও বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি হলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ রোগী অত্যন্ত কম ব্যয়ে এখানে এসে চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারবেন । তাছাড়া এই অঞ্চলে দুপারের মানুষজনের ভাষা একই রকম হওয়ায় তারা চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার সময় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন । উভয় অঞ্চলে একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস থাকায় সে ক্ষেত্রেও কোন অসুবিধা হবে না । সর্বোপরি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষজনের পক্ষে এই সুযোগ ব্যয়বহুল বলে মনে হবে না । পর্যটন ও চিকিৎসা পরিষেবাকে কেন্দ্র করে এখানে অন্যান্য পণ্যাদির ব্যবসার পাশাপাশি হোটেল, লজ, ঔষধ এর দোকান ইত্যাদি ঘিরে করে প্রচুর কর্মসংস্থানের ও সুযোগ সৃষ্টি হবে ।

সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর পুরোদমে চালু হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা : ২০১৫ সালে মৈত্রীসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে প্রকল্পটি শেষ করে ২০২১ সালের ৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও সম্মেলনের মাধ্যমে ৪১২ মিটার দীর্ঘ ও ১৪'৮০ মিটার প্রস্থ ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটির উদ্বোধন করেন । উদ্বোধন হওয়ার পর প্রায় দু বছর হতে চলল কিন্তু মৈত্রী সেতুর উপর দিয়ে চলাচলের পথ এখনো উন্মোচিত হয়নি । পাশাপাশি সময়ে স্থল বন্দরের কাজ শুরু হলেও আজ অবধি তার শেষ হয়নি । লক্ষ্য করা গেছে, এই নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতি ও খুব ধীর । এছাড়া মৈত্রীসেতু সংলগ্ন আইসিপিতে নিজস্ব ঘরসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাবে অন্তত মানুষজন পারাপারের ব্যবস্থাটিও আজ পর্যন্ত চালু করা যায়নি ।

অন্যদিকে মৈত্রী সেতুর অপর প্রান্তে বাংলাদেশেও আই সি পি স্থাপনের কাজে তেমন কোন অগ্রগতির লক্ষণও নেই । গত নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে সে দেশে মৈত্রীসেতুসংলগ্ন স্থানে শুধুমাত্র প্যাসেঞ্জার টার্মিনালটির উদ্বোধন করা হয়েছে । এটিও এদেশের মত এখনো চালু করা হয়নি । রামগড়ের স্থলবন্দরের মূল কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে বলে সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে । এছাড়া নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত বাংলাদেশের রেলপথ সম্প্রসারণের বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । কবে তা শুরু হবে তাও জানা যাচ্ছে না । যতদিন পর্যন্ত দু দেশের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমাধা না হয় ততদিন পর্যন্ত যতই আকাশচুম্বী স্বপ্ন থাকুক এই আইসিপি ও স্থলবন্দরের সুফলের শুরুটাও দেখা যাবে না । এক্ষেত্রে দু'দেশের কর্তৃপক্ষের দ্রুত যৌথ বৈঠক করে সামগ্রিক কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সীমানা সংক্রান্ত কোনো প্রোটকল থাকলে সে ক্ষেত্রে দুই দেশেই নরম মনোভাব গ্রহণ করে নিঃস্বার্থে এর সরলীকরণ করা দরকার । এই মৈত্রী সেতু ভারত-বাংলাদেশের জনগণের আবেগের বিষয় । সে কারণেই দু পারের স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে দাবি উঠছে, স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়া সাপেক্ষে যেন দুপারের মানুষজন আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি অন্তত ত্বরান্বিত করা হয় । এতে যেমন দুপারের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তেমনি দুদেশের মানুষজনের পণ্যের চাহিদার বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে আসবে ।

পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীসেতুকে কেন্দ্র করে সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর নির্মাণের যে বিশাল কর্মকান্ড চলছে, এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাব্রুম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য গুলির বাণিজ্যিক রাজধানী যে হয়ে উঠবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই । সেই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেবে । পাশাপাশি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি সম্পর্ক ও সুদৃঢ় হবে । কোনো অঞ্চলের জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হলেই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায় । আসলে, এই কাজটা যতটা ত্বরান্বিত হবে তত শীঘ্রই এই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবেন ।

( লেখক ত্রিপুরার একজন সমাজ-সংস্কৃতিক ও লোকগবেষক । গত ৬ জানুয়ারি ২০২৪ ভারত সরকারের গবেষণা সংস্থা ASIAN Confluence-এর আমন্ত্রণে সাব্রুম আইসিপিতে আয়োজিত 'Technical Consultation On Upcoming ICP in Sabroom  :  Prospects, Opportunities and Challenges'-এ এই গবেষণাপত্রটি পেশ করেন ) ।

Monday, January 1, 2024

কবিতাবতী

কবিতাবতী গর্ভবতী কবিতা পড়তে গিয়ে 
ছন্দবতী কবিতা লেখে স্বপ্ন বুকে নিয়ে
কলম খাতা নিয়ে
কবিতাবতীর স্বপ্ন ভাঙে কবি হতে গিয়ে
অক্ষরবতী অশ্রু লেখে বিষাদ নিয়ে
ঝরনা কলম দিয়ে