Saturday, May 28, 2022

কালু কামার

কালু কামার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কালু কামার ৷ কে কালু কামার?  গায়ের রঙ কালো বলে কী কালু কামার?  নাকি কালো পাথরের সাথে ছেনিসঙ্গমে জাগিয়েছে প্রাণ তার জন্যে? যে দেবতারা জীবকে সৃষ্টি করে বলে অহংকৃত মিথমগজ জনারণ্যে দাপিয়ে বেড়ায়,  সেই দেবতার জন্মদাতা কালু কামার? 

এতোবড়ো ধৃষ্টতার জন্যেই ঊনকোটি দেবতারা স্বীকৃতি দেওয়ার সাহস পেলি না তোদের জনককে ৷ 

পরিচয়হীন কালু কামার ৷ মজাদার বাক্যবন্ধের জন্যে বিখ্যাত যে রমাকান্ত কামার ৷ তেমন কেউও হতে পারল না কালু কামার ৷ 

যুগে যুগে  পাহাড় কন্দরে জন্ম ও লালনে দেবতা গড়ে তোলে  তিলে তিলে ঘাম ও রক্তে ৷ 
নিভৃত লুঙ্গায় মশালের আলোয় আর মশার কামড়ের যন্ত্রণা ভুলে যে দেবকুলকে গড়ে তোলে কালু কামার, 

ত্রিভুবনবাসের আভিজাত্যে তারা কালু কামারকে চেনে না ৷ পিতা নেই তাদের ৷ তাদের গোষ্ঠীপতি স্বয়ম্ভুনাথ ৷ ঊনকোটিপতি ৷

কালু কামার আজো সাব অল্টার্ণ একলব্যপ্রতিম ৷

Tuesday, May 24, 2022

স্বপ্নদাদা

স্বপ্নদাদা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি । দাদাদের বয়সী । দাদারা কেউ কেউ আছেন । অনেক দাদা নেই । তাঁরা শূন্যটিলায় ফিরে গেছেন । যাঁরা চলে গেছেন তাঁদের আমি দাদা ডাকি । আর যে দাদার রয়েছেন তাঁরা তো দাদাই । বয়সকালে এই দুই দাদারাই দাদাগিরি করতেন । আমি অনুজ সেই দাদাদের অনুকরণ করেছি । একসময় আমিও দাদা হয়ে উঠেছি । আমাকে এখন অনেকেই দাদা ডাকে । আসলে আমি আমি আমার দাদাদের নিয়ে সবসময় ভাবতাম । কিকরে যে তারা দাদা হল । আমি তাদের রাতে ঘুমুলে স্বপ্ন দেখতাম । কখনও কখনও দিনেও স্বপ্ন দেখতাম ।  তাঁরা আমার স্বপ্নদাদা ।

এই স্বপ্নদাদাদের একজন আমার ঘরেও ছিল । তবে আমি তাঁকে দেখিনি । বড়ো হয়ে মা-বাবার মুখে শুনেছি । পাড়া পড়শি সেই দাদার গল্প করত । সেও একদিন আমার স্বপ্নদাদা হয়ে যায় । আমার মা-বাবা নাকি গঙ্গার অভাবে তাকে ব্রহ্মপুত্রে বিসর্জন দিয়েছেন । কারণ সেকালে আমরা ব্রহ্মপুত্রের পারে থাকতাম । আমার ঘরের স্বপ্নদাদাকে তাঁরা কেন বিসর্জন দিয়েছেন তা কেউ জানে না । জানলেও আমাকে বলে না । না মা বাবা । না পড়শিরা । সে ঘটনার বহু পরে নাকি আমি আসি । তখন থেকে সবাই আমাকে দেখে । আমার ঘরোয়া স্বপ্নদাদাকে দেখে না । আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে । কখনও আমাকেও বলে । আমার ব্রহ্মপুত্র দাদাই নাকি আমার শরীর নিয়ে ফিরে এসেছিল মায়ের কাছে । তার সব দাদাগিরিও ভর করেছিল আমার শরীরে । চারদিকে আমার অগণিত অনুজ । গণদাদা আমি । আমার দাদাগিরি আমার এবং তাদের উপর । 

এখন মাও নেই । বাবাও নেই । সর্বশেষ যে কজন দাদা ছিলেন তাঁরাও নেই । দাদাগিরির শংসাপত্র হিসেবে বাবা আমাকে বাজারের শূন‍্য থলেটা দিয়ে গেছেন । আমাকে রোজ সেটা ভরে তুলতে হয় । থলেটা শূন্য হয় ।...আবার আমাকেই ভরে তুলতেই হয় ।...
              

Tuesday, May 17, 2022

মিলন হবে কত দিনে...

মিলন হবে কতদিনে

মেলা ভেঙে গেলে মনটা নরম হয়ে যায় । ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে । কেবল শূন‍্যতা । কেবল ভাঙার শব্দ । ভাঙনের আওয়াজ। মেলার মাঠে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে আবর্জনা । ভাঙা বেড়া বাঁশের খুঁটি । পলিপ‍্যাকের টুকরো । হাজার মানুষের পায়ের চাপে ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর মাটি । নিঃসঙ্গ বুদ্ধমন্দিরের নীরব গৈরিক চূড়া । বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ । প্রতিটি মেলা শেষে সেই পরিচিত চিত্র। 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!'

গত রাতে শেষ হয়েছে সাব্রুমের বৈশাখীমেলা। ত্রিপুরার দক্ষিণ সীমান্তিক শহরের প্রাচীনতম মেলা । বহু মানুষের স্বপ্নের মেলা । প্রতি বছরই বহু মানুষের সমাগম হয় এই মেলায় । এই জেলার মানুষজন ছাড়াও বাইরে থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে মেলার দিনগুলোতে । আত্মীয়তার সূত্রে । পরিচয়ের সূত্রে । নাম শুনে । পেশাগত কারণে যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁরাও বাড়ি ফেরেন মেলাকে কেন্দ্র করে । বাইরে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েরা বাপের বাড়িতে নাইওর আসেন মেলা উপলক্ষে । প্রায় প্রতি বাড়িতে কদিন হাট-বাজার একটু বেশি করতে হয় এ কদিন । 'অতিথি দেব ভব' ভাবনায় । 

   গত দুই বছর করোনা মহামারীর কারণে মেলা হয়নি । ঘরবন্দী মানুষ দিন গুনেছেন মুক্তির । প্রকৃতিসৃষ্ট হোক বা মনুষ‍্যসৃষ্ট । মানুষকে বেঁধে রাখতে পারেনা কেউই । মানুষ ভেঙে ফেলে বন্দীত্বের শৃঙ্খল । সামাজিক দূরত্বের কারণে সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ আবার মিলনের উৎসবে সম্মিলিত হয়েছে এই বৈশাখীমেলাকে কেন্দ্র করে । বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছে মেলার মাঠে । ঝড়-বাদলে প্রকৃতির পরিবর্তন, রাজ‍্য রাজনীতির পরিবর্তন এই মেলাপাগল মানুষের গায়ে কোনো
আঁচ ফেলতে পারেনি । নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব আনন্দের অংশীদার হয়েছেন তাঁরা । মেলার পরিধি এবারে অনেক বিস্তৃত হলেও তিলধারণের জায়গা ছিলনা কোথাও । মেলাকে ঘিরে জনপ্লাবন বয়ে গেছে । এতো এতো মানুষের সমাগম । একটাও অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ নেই । এটাই এই মেলার বৈশিষ্ট্য। শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা সাব্রুমের চিরন্তন ঐতিহ‍্য । যার জন‍্যে সাব্রুমবাসী গর্ব করে । আশির দাঙ্গার বীভৎসতা দেখেনি এ মাটি । ঐক‍্য ও সম্প্রীতি সাব্রুমের মুকুটের বৈদুর্যমণি । সদ‍্যসমাপ্ত সেই মেলাতেও সেই ধারা রক্ষিত হয়েছে ।

      তার পরেও মেলা শেষ হয় । বিষাদ নেমে আসে প্রান্তর জুড়ে । ফাঁকা ফাঁকা লাগে কোথায় যেন । ঘরে ফেরা মানুষের পায়ের ধুলো ওড়ে বাতাসে । আকাশেও মেঘ গুড় গুড় করে যেন বিসর্জনের বাজনা বাজায় । ক্লান্ত মানুষ ঘরে ফেরে । ফেরে যার যার সধ‍্যমতো তৈজসপত্র নিয়ে । ফেরে মিলনের বার্তা নিয়ে । প্রিয়জনের হাত ধরে ঘুম জড়ানো চোখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে, আবার 'মিলন হবে কত দিনে...' ।

Monday, May 16, 2022

স্বপ্ন ও চাঁদ

স্বপ্ন ও চাঁদ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

ঠাকুমার স্বপ্নবোনা চাঁদ ঘরে ঢুকে পড়েছে ভেবে 
আমপাতা জামপাতায় সাজাই ভাঙা ঘরের চারধার
 উঠোনে দু'চারটে বিদেশি ফুলের চারা টবে বাড়ে
 আম্রপালি আম গাছ বেড়েছে জলে ও জৈব সারে 

বছরের পর বছর শরৎ আর বসন্ত যায় চাকা বেয়ে
 গাছেদের মত বেড়ে ওঠে স্বপ্ন ডালপালা নিয়ে 
ঘরে বাড়ে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, আরও কত কি 
বারবার দিতে হয় অকাট‍্য প্রমাণ নাগরিক পরিচয়ের
এখন আর তারাদের মিছিলে তাকানোর সময় হয়না 
উপরের জগৎটা বন্দি হয়ে যায় করপোরেট চুক্তিতে ।

অভায়ারণ্যে পর্যটনে গেলে অপেক্ষার পর দেখা যায় 
বাঘ আসে, বাঘ গেলে  সিংহ আসে, সিংহের পর গন্ডার
 যে যায় কিংবা আসে হিংস্রতার হেরফের হয় না
 তবুও অভয়ারণ্যের  জন‍্যে বের করতে হয় উইক এন্ড ।

ভোট এলেই স্বপ্নেরা উড়ে আসে গাছের ডালে ও পাতায়
স্থবির গাছেরাও হওয়ায় দুলে ওঠে পাতাদের নাচায় 
ভোটের পরে ছিটেফোঁটা নিয়েও গাছেদের দিন গুজরান 
ছাপ্পা ভোটের কোনো ঝুঁকি নেই সবটাই বিজয় ।

লাইটপোস্ট থেকে নেমে আসে দাগি কালোবাজারি 
মই বেয়ে । সে মই বেয়ে আকাশে উঠে যায় তেলের দাম 
নিত্যদিন জিনিসের দাম বাড়লেও কর্পোরেট দুনিয়া 
নতুন শিবালিক পর্বত গড়ে ভঙ্গিল মানুষ নিয়ে
 দূরে যায় স্বপ্ন ও চাঁদ, ঠাকুমার শোলকের আঁচল ।

পরিচয়

পরিচয়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কালের ধারা বহুদূর চলে গেলেও
 তুমি রয়ে গেছ স্থির স্থায়ী ইমারত ।
 ধরে রেখেছে মানুষ মানুষ অন্তহীন বুকের গভীরে ।
সুপ্রিয় স্মৃতিটির  চিরন্তন কথার মতো স্থায়ী হয়ে আছে ।
ব‍্যর্থ মানুষ আজও দিনান্তের অন্ধকারে আশ্রয় খুঁজে পায় 
তোমার শব্দের ভান্ডারে, কবিতার কথায়, সঙ্গীতসুরে ।

এখনো পরাজিত মানুষ আবার উঠে দাঁড়ায়
 শিরদাঁড়া সোজা করে তোমার কবিতায়
 এখনো তোমার গানের ভেতর অলৌকিক জাদু
 সর্বাঙ্গে তোলপাড় করে সুরের আলাপ
 জাগায় নতুন ইন্ধন । সুরে সুরে ভেসে যায় পাপের কালিমা ।
 রাত ভেঙে নতুন ভোর আসে চিরকালীন নিয়মে ।

যারা রোদ্দুরের আশায় সুর্যোদয় দেখে প্রতিদিন 
পেছন থাকে তোমার দীর্ঘ ছায়া ঐতিহ্যের বিস্তার
ছয় ঋতুময় তুমি জেগে থাকো তোমার গানে ও কবিতায় ।

 শিশিরে লাগা সূর্যবিন্দু যেমন মুক্তোর হাসি ছড়ায়
তেমনি তুমি সমুজ্জ্বল বিভায় থাকো অনন্ত কাল।
এই আকাশছোঁয়া অবয়ব আমার পরিচয় ।

Sunday, May 8, 2022

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো

ত্রিপুরার সৃজনক্ষেত্রে আজ অস্থিরতা ৷ অবিশ্বাসের অশনিনির্ঘোষ ৷এই বিষবৃক্ষের বীজ অনেক আগেই পোঁতা হয়েছিল ৷ আজ সে গাছে ফল ধরেছে ৷ তার বিষক্রিয়ায় আজ আমরা সবাই লক্ষীন্দর ৷ ত্রিপুরা রাজ্যে আমরা যারা সুন্দরের আরাধনাকে জীবনের আর দশটা নিজস্ব কর্মের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছি তারা কেউই ব্যক্তিগত লাভালাভের মোহে সেটা করছিনা ৷ কর্মক্ষেত্রে পরিচিতির পদমর্যাদার স্তরবিন্যাস থাকলেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে সে ব্যবধান থাকেনা ৷ সেখানে সবাই একে অন্যের সতীর্থের মতো একাত্মতা অনুভব করি ৷ আমরা জানি আমাদের এই প্রান্তিক ভুবনের সৃজন বৃহত্তর বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গনে স্থায়ী দাগ রাখার মতো সৃষ্টি এখনও করে উঠতে পারিনি ৷ কিন্তু আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস রয়েছে স্থান নেবার জন্যে ৷ সেকারণেই আমরা একে অন্যের সৃষ্টিকে তুলে ধরার প্রয়াসী হই ৷ এভাবেই ত্রিপুরার প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকেও আজ উঠে এসেছেন সৃজনকর্মীরা ৷ সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের দীন আঙিনা ৷ কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো উদ্যোগ নিলে শরিক হবার বা পাশে দাঁড়াবার সুযোগ নিই ৷ কিন্তু আমরা এও লক্ষ্য করেছি, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো উদ্যোগ নিলে অন্য আর একদল সেটাকে পাশ কেটে যান ৷ অনুষ্ঠানের ধারে কাছে থাকেননা কিন্তু বাইরে থেকে শলা নাড়েন ৷ উপযাচক হয়ে আগত অতিথিদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন ৷ উদ্যোক্তাদের নির্ধারিত পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটান ৷ বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথি যেমন এখানে নৈশভোজের আসরে লাঞ্ছিত হয়েছেন তেমনি আমাদের রাজ্যের প্রিয় কবিদের বিরুদ্ধে ওদেশের কেউ সোস্যাল মিডিয়ায় বিশ্রী স্ট্যাটাস দেয় তখন এরাজ্যেরই কোনো সম্মানিত ব্যক্তিত্ব মুহূর্তে সেই স্ট্যাটাসকে ছড়িয়ে দিয়ে সেই নোংরামিকে উসকানি দেন ৷ আর নিজেদের মধ্যে ফেসবুকে ল্যাং মারামারি, কাউকে ছাগদুগ্ধ সেবনের পরামর্শ, কারো ব্যক্তিগত বিষয় উন্মোচন এসবতো আকছারই ঘটেছে ৷ যাঁর অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো অতিথি ব্যক্তিত্ব ফিরে গিয়ে বিষোদ্গার করেন, তাঁর পাশে কেউ প্রতিবাদ করার পর দেখা যায় কোনো এক উজ্জ্বল ভোরে দেখা যায় সাপে নেউলে একসাথে সেলফিশোভন হাসি বিতরণ করেন ৷ এও এক আজব আচার ৷ ফারাকটা হলো একসময়ে অঘটনগুলোর কর্তারা স্বনামেই কাজগুলো করেছেন ৷ আর আর আজকে মুখটাকে 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা' করে পরিচিতিকে অর্ধনারীশ্বর করে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো করছেন ৷ এখানে আমি কারু সাহসের বা ভীরুতার তুলনা করছিনা ৷ পুরীষ উভয়েই ঘাঁটছেন ৷ কেউ কেউ কানকথায়ও প্রিয়জনকে ভুল বুঝছেন ৷ বেদনাহত হচ্ছি প্রিয়জনের লাঞ্ছনায়, মানসিক যন্ত্রণায় ৷ 
 অবসান ঘটানো যায়না কী এই কন্টকাকীর্ণ পরিবেশের ৷ এই অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের ৷ আসুন না, তরুণ কিংবা বরিষ্ঠজনেরা ৷ বসুন না সামনাসামনি ৷ রাগ অভিমান ঝেড়ে ফেলে এই কিরাতভূমির সৃজনকে সম্মিলিতভাবে তুলে ধরি বৃহতের আঙিনায় ৷ জীবনের যে সিঁড়িতে এসে পৌঁছেছি ৷ যে কোনদিনই পুষ্পস্তবক আমার জন্যে খুঁজে রাখতে হতে পারে ৷ আসুন না এই ভূমি আর তার প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিই ৷ সেই বিরাটপুরুষের জন্মদিনে এই বোধটাই ছড়িয়ে দিই সকল প্রাণে ৷

Tuesday, May 3, 2022

মেলাবেন তিনি মেলাবেন

মেলাবেন তিনি মেলাবেন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাংলার ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ‍্যে সমন্বয়ধর্মীতার ধারাটি বহু প্রাচীন । সেই ধারাকেই অনুসরণ করে আউল বাউল পীর ফকিরদের ধর্মধারাটি প্রবাহিত হয়ে এসেছে । তাদের আচরিত ধর্মে মানুষের, মানবতার জয়গানই উচ্চারিত হয়েছে বারবার । সেই ধারা বিভিন্নভাবে আজও বহমান । আজ পাশাপাশি অবস্থানকারী দুই ধর্মের জনগোষ্ঠীর দুটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিন । হিন্দুদের অক্ষয় তৃতীয়া ও মুসলমানদের ঈদ-উল-ফিতর । বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত হলে তাকে অক্ষয় তৃতীয়া বলে । অক্ষয় অর্থ হল যার ক্ষয় নাই ।  মানুষের মনে বিশ্বাস এই তিথিতে কোন সম্পদ সৃষ্টি করলে তা অক্ষয় থাকে । এছাড়াও হিন্দু ধর্মীয় বিধি অনুসারে নানা আনুষ্ঠানিকতা জড়িয়ে আছে এই তিথিকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে মুসলমানদের রমজান মাসে দীর্ঘ একমাস ব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধনের পর আসে ঈদ । ঈদ মানে উৎসব । ঈদ-উল- ফিতরের এই উৎসবে মুসলমান জনগণ আনন্দে মেতে ওঠেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে এই দিনটি পালন করেন  ।

এই তিথিতে শ্রীশ্রীরামঠাকুর মাতৃদেহে প্রবেশ করেন । আবার এই তিথিতে তিনি তিরোহিত হন । এই অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতেই তিনি সূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় প্রক্রিয়ায় গুরু মন্ত্র লাভ করেন । তিনি তাঁর সুদীর্ঘ প্রায় নব্বই বছরের জীবনে সবধরনের বৈষম্যহীন কুসংস্কার মুক্ত সমাজগঠনে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানবতার জাগরণের মধ্য দিয়ে মানবের আধ্যাত্বিক মুক্তির উপায় সন্ধান করেছেন । তিনি প্রকৃত অর্থে ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানব সম্প্রদায়ের ধর্মের প্রচার করেছিলেন । জাতি-ধর্ম-বর্ণ সূচি অশুচির কোনো ভেদ তাঁর ধর্মাদর্শে ছিলনা ।

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজ জীবনে কুসংস্কার, ব্রিটিশ রাজশক্তির সৃষ্টি করা বিভেদনীতি ও ধর্মীয় দাঙ্গার বিরুদ্ধে শুধু আধ্যাত্মিক চেতনায় মানুষকে বলিয়ান করাই নয় পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের এক সার্থক রূপকার ছিলেন শ্রী শ্রীশ্রীরাম ঠাকুর ।
আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান বাংলাদেশে ধর্ম সমন্বয়ের একটি প্রাচীন ধারা বিদ্যমান । এই সমন্বয়ধর্মীতার ফলে এখানে বাঙালি হিন্দুর লৌকিক দেবী বনদেবী, ওলাইচন্ডী পরিণত হয়েছে মুসলমানের বনবিবি ও ওলাবিবি রূপে । শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেব ভারতের এই সুপ্রাচীন ধর্মসমন্বয়ের ধারাটিকে তাঁর আধ্যাত্মিকতাবাদ  প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন । তিনি এখানে দেবতা হিসেবে সত্যনারায়ণ পূজার প্রবর্তন করছেন । সত্যনারায়নকে তিনি বলছেন সত্যপীর । তার হস্তলিখিত সত্যনারায়ণের পাঁচালিতে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন– 'সত্য সত্য সত্য পীর সর্ব সিদ্ধি দাতা / বাঞ্ছা বড় বাড়িল বর্ণিতে ব্রত কথা ।' এই সত্যপীর ইসলাম এবং স্থানীয় লৌকিকধর্মের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক আধ‍্যাত্মিক পুরুষ যাকে বাংলার লোকধর্মের ধারার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে মুসলিম সত্যপীর এবং হিন্দু সত্যনারায়ন একই বিশ্বাস এবং আচারের প্রতিনিধিত্ব করে । বাংলাদেশ সুফিবাদ যখন প্রাধান্য লাভ করে সেই সময়ে বাংলাসহ সংলগ্ন রাজ্য উড়িষ্যায় তার জনপ্রিয়তা অর্জন করে । এই সত্যপীর ঐতিহ্যকে মান্য করে আজও হিন্দুরা সত্যনারায়ন ও পীরকে একসঙ্গে পূজা করেন । শ্রীশ্রীরামঠাকুর আমাদের ধর্মীয় সমন্বয়ের প্রতিভূ এই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে তাঁর ধর্মসাধনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন । তার আসল উদ্দেশ্য হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনগণের মধ্যে শাসক শ্রেষ্ঠ যে বিভেদ রয়েছে তাকে  দূরীভূত করা এবং পাশাপাশি আধ্যাত্মিক উপাসনার পদ্ধতি অনুসরণ করা । ফলে দুই ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থান ও ধর্মাচরণ এই যুগসন্ধিক্ষণের দুই ধর্মের মানুষকে একসূত্রে গাঁথার একটা প্রয়াস সেতু তৈরি করবে । সত্যনারায়ণ পূজায় যে সিন্নি ব্যবহার করা হয়– দুধ, কলা' আটা / ময়দা কিংবা চাল' নারকেল ও অন্যান্য হল ফলপসারযুক্ত যে ভোগ নৈবেদ্য তা মুসলিম সংস্কৃতি থেকেই পাওয়া । ডক্টর গিরীন্দ্রনাথ দাসের মতে–''পীর' শব্দের আভিধানিক অর্থ 'বৃদ্ধ' বা প্রাচীন এবং ভাবার্থ আধ্যাত্মিক গুরু । শব্দটি ফারসি থেকে আগত । ফারসি 'পীর' শব্দের ন‍্যায় বৌদ্ধগণ কর্তৃক ব্যবহৃত  'থের' শব্দের অর্থ বৃদ্ধ । সংস্কৃত 'স্থবির' শব্দের একটি অর্থ বৃদ্ধ ।পীরগণ ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারক ।'' ( বাংলা পীর সাহিত‍্যের কথা ) । তাঁরা সুফি নামে অভিহিত ।  সুফি শব্দটি আরবি  'তসাওফ'  বা 'সুফ' শব্দ থেকে এসেছে । রাজা গণেশ ( শাসনকাল ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ ) বা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ( শাসনকাল ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯ খ্রি) আমলে সমাজের সত্যপীর পূজার প্রচার করেন বলে অনেকে অনুমান করেন । ( যাই হোক এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করা যাবে । ) এখানে লক্ষণীয় যে শ্রীশ্রী রামঠাকুর শুধু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন না সমাজের সংকটময় মুহূর্তে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে যেখানে ছোঁয়াছুঁয়ির নামে শুচিবায়ুগ্রস্ত মনোভাব, বর্ণবৈষম্য এবং ধর্মান্ধতার মত কুপ্রথার প্রভাব ছিল সেখানে সমাজ সংস্কারের এক সার্থক রূপকার হিসেবে শ্রীশ্রীরামচন্দ্রদেব তাঁর ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করে গেছেন । ফলে তাঁর বহু মুসলমান শিষ‍্যও রয়েছেন ।

আজ এমনই একটা দিন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলমানরা ও তাদের ঈদ উৎসব পালন করে আসছেন । আদিকালের কৃষিউৎসবই যে পর্যায়ক্রমে ঈদ উৎসবে রূপান্তরিত  এবং সে সময়ে মানুষ আজকের মত ধর্মীয় বিভিন্নতা  মধ্যে জীবনযাপন করতেন না ‌। পরবর্তী  সময়ে ধর্মীয়চিন্তা এসেছে । হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি নানা ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে ।  মূলত এই সত্যপীর বা সত্যনারায়ন সেই একই সত্তারই প্রতীক । 
 আজও যেন সেই বাঙালির চিরঐতিহ্য এক সূত্রে এসে মিলিত হয়েছে । আজও সমস্বরে উচ্চারিত হোক, আমাদের ধর্মীয় সমন্বয়ধর্মীতার  জয় হোক । জয় হোক মানবতার ।

Sunday, May 1, 2022

ত্রিপুরায় ঈদ উদযাপন : ধর্ম ও লোকসাংস্কৃতিক পরম্পরা

ত্রিপুরায় ঈদ উদযাপন : ধর্ম ও লোকসাংস্কৃতিক পরম্পরা 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

আদিমযুগে মানুষের উৎসব পালনের সঙ্গে কৃষিজীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ঘরে ফসল ওঠার পরে মানুষের মন আনন্দে ভরে উঠত । পরবর্তীকালে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জীবনেও তার প্রতিফলন ঘটে । বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বৎসরের বিভিন্ন সময় ধর্মকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকেন । ফলে এইসব উৎসবের সঙ্গে আদিম যুগের উৎসবের লৌকিক বিষয়গুলোও যুক্ত হয়ে পড়ে । ধর্মীয় বিধিসম্মত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পূর্বতন লৌকিক সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোও  যুক্ত হয়ে  যায় । বিভিন্ন  ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে যখন মানুষ তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন করেন তখন তা হয়ে যায় আচরণের ধর্ম ও আনুষ্ঠানিকতার ধর্ম । এই আচরিত ধর্ম ও অনুষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে কে কোন ধর্মের মানুষ তাও বোঝা যায় । আচার অনুষ্ঠান ও বিধিবিধানের মাধ্যমে ধর্মাচরণ করা হলেও তার মধ্যে দুটি ভাব লক্ষ্য করা যায় । একটি জাতীয় ধর্মাচরণ ও অন্যটি সর্বজনীন ধর্মাচরণ । ধর্মের এই সমন্বয়ধর্মিতার  কারণে একটি বিশেষ ভূখন্ডে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করেন । পাশাপাশি যখন অন্যান্য ধর্মীয় মানুষের প্রতিও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে থাকেন ‌ তখন তা বিশ্বজনীন রূপ লাভ করে । ধর্মচেতনা শুধুমাত্র মানুষের আচার আচরণের উপর প্রভাব ফেলেনা । মানুষের ভাবনা ও চিন্তার জগৎকেও নিয়ন্ত্রণ করে । এই বিষয়টি ধর্মনির্বিশেষে বাঙালির জনজীবনে ও মননে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে । ধর্মনির্ধারিত আচার-আচরণের পাশাপাশি আজও বাঙালিজীবনে প্রাচীন সর্বপ্রাণবাদ ও জাদুবিশ্বাস ইত্যাদির প্রভাব রয়েছে যা পুরুষানুক্রমে অর্জিত । 

বিশ্বের মুসলমান জনগণের শ্রেষ্ঠ উৎসব ঈদ বছরের দুইসময়ে দুইবার ঈদ পালিত হয় । ঈদ উল ফিতর ও ঈদুল আযহা । ঈদ মানে উৎসব । ঈদ মানে আনন্দ । বিশ্বের অন্যান্য অংশের মুসলমান জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণ ও ঈদের সময় আনন্দে মেতে ওঠেন । পাশাপাশি বৃহত্তম রাষ্ট্র আমাদের ভারতেও এই উৎসব যথাযথ মর্যাদা ও আনন্দের সঙ্গে পালন করা হয় । ভারতে বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর বাস । এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তর অংশের হিন্দু জনগণ যেমন রয়েছেন তেমনি মুসলিম সহ অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীও রয়েছেন । তাঁদের প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট দিনগুলোতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন । ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরা বাংলাদেশসন্নিহিত রাজ্য ।বাংলাদেশের মতোই এইসব রাজ্যে কমবেশি বাঙালি জনগণ রয়েছেন । এবং তাদের অনেকেই মুসলমান ধর্মাচরণ করে আসছেন বহুদিন ধরে । ত্রিপুরা রাজ্যের তিনদিকেই বাংলাদেশের সীমান্ত । স্বাধীনতা-পূর্বকালে রাজন্য আমলে এই রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশের নিবিড় যোগাযোগ ছিল । তাছাড়া সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রিপুরার রাজার জমিদারী ছিল । ত্রিপুরার জমিদারী অংশের নাম ছিল 'চাকলা রোশনাবাদ' । সেই সূত্র ধরে ত্রিপুরারাজ‍্যে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি মুসলমানগণ বসবাস করে আসছেন । সেই সঙ্গে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ধর্মাচরণও করে আসছেন । স্বীয় ধর্মাচরণ পালনের পাশাপাশি তাঁরা প্রতিবেশী বাঙালি হিন্দু ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগণের সঙ্গে সম্প্রীতির মেলবন্ধন গড়ে তুলেছেন । দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরা রাজ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণের একটা চিরাচরিত ঐতিহ্য রয়েছে । প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকার ফলে ঈদ উৎসবে এখানে পালিত ধর্মীয় ও লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে হলেও আদিম লৌকিক ও প্রাচীন হিন্দু রীতিনীতির ক্ষীণ প্রভাব এখনো রয়ে গেছে । তাছাড়া আমাদের এই উপমহাদেশে মুসলিমদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বহিরাগতরা এসে এখানে মুসলমান ধর্ম প্রচার করেছেন । তার আগে এদেশের জনগণ হিন্দুজনগোষ্ঠীরই অংশ ছিলেন । ফলে বংশ-পরম্পরাক্রমে পালন করে আসা লোকায়ত বিশ্বাসজনিত কিছু কিছু হিন্দু রীতিনীতির প্রভাব তো রয়েই গেছে । আদিতে তো আরব এবং সিরিয়ার দামেস্কের জনগোষ্ঠীর আদিবাসীরা ঈদ উৎসবের মতো একধরনের সামাজিক উৎসব পালন করত । সেরকম ত্রিপুরার ঈদ উৎসবেও আদিম সংস্কৃতিচর্চার প্রভাব রয়েছে যা পরবর্তী সময়ে ধর্মপ্রচারকদের প্রভাবে ইসলাম ধর্মীয় উৎসবে রূপ নেয় । 

ত্রিপুরা রাজ্যে ঈদের দিনের পূর্ব থেকে একমাসব্যাপী যে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে মুসলমান জনগণ অতিবাহিত করেন তার মধ্যে কিছু কিছু সামাজিক মেলবন্ধনের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় । রোজার দীর্ঘ একমাস সময় ধরে মুসলমানগণ সিয়াম কিয়াম, কুরআন তেলাওয়াত, দান-খয়রাত ইত্যাদি কর্মের মাধ্যমে প্রতিবেশীর সঙ্গে সহনশীল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলেন । এ সময় তাঁরা দরিদ্র মুসলমানদের মধ্যে যেমন সাহায্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন । তেমনি এই সময়ে প্রতিবেশী কোন হিন্দু বা উপজাতীয় মানুষের ঘরে কোন দরিদ্র মুসলমান কোনরকম সাহায্য বা সন্ধ্যায় রোজার শেষে ইফতারের জন্য আহার্য প্রার্থনা করলে প্রতিবেশী অন্য ধর্মাবলম্বী গৃহবধূ কিন্তু আগত প্রার্থীকে তাঁর সাধ্যমত ধান-চাল, সবজি কিংবা মুড়ি,চিড়া, খই ইত্যাদি থালায় সাজিয়ে দিয়ে আপ‍্যায়ণ করে থাকেন । রোজার মাস এলে গ্রামের ফকির-মিসকিনদের রোজার শেষে ইফতারি সংগ্রহের এই দৃশ্য এখনো প্রায়শই দেখা যায় । এছাড়া রমজান মাস জুড়ে এখানকার নানা সংগঠন সামাজিক সংস্থা ও রাজনৈতিক দল সন্ধ্যায় ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেন । সেখানে ধর্ম-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হন এবং ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণের পাশাপাশি পারস্পরিক সৌহার্দ্য পূর্ণ ভাব বিনিময় করেন । 

আমাদের শৈশবের দেখেছি আমাদের সঙ্গে পাঠরতা মুসলিম মেয়েরা ঈদের আগের দিন বিকেলে মেহেন্দি পাতা সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত । গৃহস্থবাড়ির সীমানায় সেকালে মেহেন্দি, নিশিন্দা ইত্যাদি গাছ দিয়ে বেড়া দেওয়া হত । এগুলো যেমন সীমানা নির্দেশক বেড়া ছিল কিংবা গোরু-ছাগলের প্রবেশ প্রতিবন্ধক তেমনি এগুলোর ঔষধি গুণও ছিল । গৃহস্থরা মেহেন্দি গাছের ডালা কেটে ছেঁটে বেড়ার একটা সুন্দর রূপ দিতেন । হিন্দু গৃহস্থের বাড়ির বেড়া হলেও মুসলমান মেয়েরা এখান থেকে মেহেন্দি পাতা সংগ্রহ করত । মেহেন্দিকাঁটায় যাতে বাচ্চা মেয়েগুলোর হাত কেটে ছড়ে না যায় তার জন্য গৃহকর্তা কিংবা বাড়ির মেয়েরা এসে তাদের সাহায্য করতেন । মেহেন্দি সংগ্রহের এই বিষয়টা অনেকটা আমাদের হিন্দুবাড়ির পূজার ফুল তোলার মতো মনে হত । বাঙালি হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিনের 'ফুলবিশু' অনুষ্ঠান এবং চাকমাদের বিঝুর আগের দিনের 'ফুলবিঝু' অনুষ্ঠানের ব‍্যাপক মিল পাওয়া যায় । এই দুটি অনুষ্ঠানই আদিম সংস্কৃতিজাত । তারপর সংগ্রহীত পাতা শিলনোড়ায় বাটার ধুম পড়ে যেত । কারণ ঈদের দিন মেয়েরা মেহেন্দির রঙে হাত রাঙাত ও চিত্রাঙ্কন করত । এখন এসব উঠে গেছে । এখন আর কষ্ট করে আগের মত মেহেন্দি সংগ্রহ করে বেটে নিতে ‌হয় না । বাজারে বিভিন্ন নামিদামি কসমেটিক কোম্পানির প্যাকেটজাত মেহেন্দি পাওয়া যায় । এখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা বিবাহ বা অন্য অনুষ্ঠানে হাতে মেহেন্দি ব্যবহার করেন । ঈদ উৎসবের মেহেন্দি আজ সর্বজনীন রূপ পেয়েছে । এই মেহেন্দির ঔষধি গুণ রয়েছে । ত্বকের পরিচর্যার লোকঔষধ মেহেন্দি ব্যবহারের মধ্যে আদিম লৌকিক আচারের একটি ধারা লক্ষ্য করা যায় । এই অঞ্চলের এ হিন্দু বাঙালি ঘরে এখনো চৈত্র সংক্রান্তির দিন ও বিবাহে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিশিন্দা হলুদ গিলা ফল ইত্যাদি গায়ে মেখে  স্নান করার রেওয়াজ রয়েছে । 

ঈদের দিন সকালে এই  রাজ‍্যের মুসলমান জনগণ অন্যান্য মুসলমানদের মতোই সকালে নামাজ পড়ার আগে চুল-দাড়ি-নখ ইত্যাদি কেটে, দাঁত মেজে গোসল সেরে নেন । তারপর যার যার সাধ্যমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নতুন পোশাক পায়জামা-পাঞ্জাবি-টুপি ইত্যাদি পরে, আতর মেখে ঈদগাহে সমবেত নামাজে অংশগ্রহণ করেন । নামাজ শেষে পরস্পর কোলাকুলি করে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন । এদিন পরবর্তী সময়ে অন্য ধর্মাবলম্বী কোন প্রতিবেশী সঙ্গে দেখা হলে বা সাক্ষাতে গিয়ে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ও করেন । ঈদগাহে নামাজের শেষে মুসলমানগণ চলে যান গোরস্থানে । সেখানে তারা সারিবদ্ধভাবে পশ্চিমমুখী হয়ে মৃত আত্মীয়-পরিজনের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন । পূর্ব পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই ধারা বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবহমান । আমাদের্ হিন্দুদের মধ্যেও আশ্বিনের মহালয়ার দিন ও চৈত্রমাসে বারুণী তিথিতে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে স্নান ও তর্পন করা হয় । মূলত পূর্বপুরুষদের বিশেষ দিনে স্মরণ করার এই ধারাটি আদিম জনসংস্কৃতি থেকে এসেছে । আদিতে কিভাবে ঈদ উৎসব পালিত হত তার উৎস অনুসন্ধান করা যথেষ্ট গবেষণাসাপেক্ষ ।  তবুও এইসব অনুষ্ঠানের কিছু কিছু উদাহরণ থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারমধ্যে লৌকিক ধর্মের প্রভাব রয়েছে । লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে ধারা এসে মিলিত হয়েছে এখানে । কখনো কখনো শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশ অনুসারে কিছু কিছু অনুষ্ঠান যুক্ত ও পরিমার্জিত হয়েছে মাত্র । 

ঈদের দিন ভালোরকম খাওয়া-দাওয়া করার রেওয়াজ এখানকার মুসলমানদের মধ্যেও রয়েছে । এদিন গৃহস্থ ঘরে সেমাই, পায়েস ও নানা রকম পিঠার বিপুল আয়োজন থাকে । সেইসঙ্গে মাছ মাংস মিষ্টি ইত্যাদিও যার যার সাধ্যমতো জোগাড় করেন । অনেকে প্রতিবেশীর ঘরেও সাধ্যমত বিলি করেন যাতে দরিদ্র অংশের মানুষ এই দিনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হন । প্রতিবেশী  হিন্দুদের ও উপজাতীয়দের বাড়িতে পাঠানো হয় 'সিধা'  । অর্থাৎ, একটা ডালায় ভর্তি করে এক পরিবারের সারাদিনের আহার্য কাঁচাসামগ্রী, সবজি, মসলা ইত্যাদি দিয়ে আসা হয় সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে । ঈদের দিনের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন আসলে আমাদের প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সাংস্কৃতিক জীবনধারাকে বয়ে আনে । সারাবছরের পরিশ্রমে সংগৃহীত নিজের ঘরের ফসল ভাগ করে খাওয়ার আনন্দের মধ্যে এক আশ্চর্য উন্মাদনা কাজ করে । এখানকার হিন্দুরাও এদিন পরোক্ষভাবে ঈদ উৎসবে শামিল হন । গৃহস্থ ঘরের পালিত গবাদি পশুর শাবক প্রসবের আগে অনেকেই মানত করেন, পশুটির সুখপ্রসব হলে তার দুধ কিংবা পরিশ্রমের খেতে ভালো ফসল হলে আসন্ন ঈদের দিন নিকটস্থ তাকিয়াতে পিঠা, শিরনি, ফসলের একটা অংশ ও দুধ নিবেদন করবেন । এবং এইদিন তা করেও থাকেন । 

কোথাও কোথাও ঈদ উপলক্ষে গ্রামের মাঠে গ্রামীণ হাডুডু বা কাবাডি, দড়ি টানাটানি,কলসি ভাঙা, কুস্তি-খেলা,ষাঁড়ের লড়াইর পাশাপাশি ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলারও আয়োজন করা হয় । সেই উপলক্ষে সেখানে মেলাও বসে । জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই মেলা ও খেলাধূলা অংশগ্রহণ করেন । মেলা ও খেলাধুলার মাধ্যমে বহু লোকের সমাগম ঘটানো প্রাচীন লোকসাংস্কৃতিক ধারারই উদাহরণ ।

গান ছাড়া বাঙালির কোন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পুর্ণ হয় না । ঈদ উপলক্ষে গৃহস্থবাড়িতে গজল, কাওয়ালী ইত্যাদি গানের জলসা বসে । বর্তমানে বিখ্যাত শিল্পীরা ঈদ উপলক্ষে গান বাঁধেন ও পরিবেশন করেন । স্থানীয় রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । বর্তমান সময়ে ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছাবার্তা বা ঈদের কার্ড বিনিময় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে । এছাড়া সাম্প্রতিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ছোট্টরাজ্য থেকেও দেশ বিদেশে অবস্থানরত প্রিয়জনদের কাছে ঈদের খুশি আনন্দ আবেগ ভাগ করে নেওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে । এই শুভেচ্ছা বিনিময়ে অন‍্য ধর্মের মানুষও অংশগ্রহণ করেন ।

এভাবেই  ত্রিপুরারাজ‍্যের মুসলমান জনগণ ধর্মাচরণের মাধ‍্যমে সংস্কৃতিগত পৃথক সত্তা বহন করে নিজস্ব ধর্মশাস্ত্রীয় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান মেনে ঈদ উৎসব পালন করলেও তাঁদের কিছু কিছু লোকাচার মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর আদিম লোকধর্ম ও লোকবিশ্বাসের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ।  এর ফলে ঈদ উৎসব এখানে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে । সমন্বয়ধর্মীতাই এখানকার ঈদ উৎসবের বিশেষ লক্ষণ । যার মূল ভিত বৃহৎবঙ্গের লৌকিক ধর্ম ও লোকায়ত দর্শন ।

বৈশাখের চেতনাময় পংক্তিমালা

বৈশাখের চেতনাময় পংক্তিমালা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস । চৈত্র মাসের শেষবসন্তের বিকেলে যখন অমলতাস বৃক্ষ ছেয়ে যায় পাকা সোনারঙা হলুদ ফুলের ঝাড়ে,  কৃষ্ণচূড়া যখন গাছে গাছে লাল রং বিছিয়ে জাঁকিয়ে বসে তখনই আসে বৈশাখ । চৈত্রের চেতনাবিনাশী খরতাপের মধ্যেই প্রাণের স্পন্দন তৈরি করে আসে বৈশাখ । প্রখর তপ্ত দহন নিয়ে বৈশাখের আগমন ঘটে  । বৈশাখের থাকে অগ্নিজ্বালা । কিন্তু তার মধ্যেই থাকে নূতন সৃষ্টির বার্তা । প্রাণের গুঞ্জরণ । ঋতু পরিবর্তনের শরীরীভাষ‍্য নিয়ে আসে প্রকৃতি । বৈশাখের মাঝেই প্রকৃতির দুই রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সূর্যের রুদ্র তেজোদীপ্ত মূর্তির পাশাপাশি সৌম্য শান্ত রূপও দেখা যায় বৈশাখে । বৈশাখেই প্রকৃতিতে আসে তুমুল ধ্বংসাত্মক রূপ । তেমনি বৈশাখেই দেখি শান্ত সমাহিত উদাসী প্রকৃতিকে ।

এই বৈশাখেরই একটা প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী ঝড় । যার নাম 'কালবৈশাখী' । কালবৈশাখী একটি স্থানীয় বৃষ্টিপাত ও বজ্রবিদ্যুৎসহ জোরালো ঝড় যা ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহার, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড ও বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রবাহিত হয়ে থাকে । কবি মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায়ও– 'নববর্ষের পুণ‍্যবাসরের কালবৈশাখী আসে' এবং 'চৈত্রের চিতাভস্ম উড়ায়ে জুড়াইয়া জ্বালা পৃথ্বীর' কালবৈশাখী ধেয়ে যায় । এই  কালবৈশাখীকে নজরুল জাগরণের বার্তাবাহীরূপে  দেখেন । তাঁর গানে পাই– 'নাচে ওই কালবোশাখী/ কাটাবি কাল বসে কি?/ দে রে দেখি/ ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি ।' 

আমাদের গ্রামজীবনে কালবৈশাখী নতুন  জীবনযাত্রার  সংকেত নিয়ে আসে । বাংলা ভাষাভাষী জনগণ অধ‍্যুষিত অঞ্চলে বৈশাখের প্রথমদিন পালিত হয় নববর্ষ উৎসব । যা রূপ নেয় অসাম্প্রদায়িক উৎসবের । জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়-পরিজন, প্রিয়জনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, ভালো খাওয়াদাওয়া এদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ‍্য । হালখাতা দিয়ে শুরু হয় ব‍্যবসায়িক কাজকর্ম । পালিত হয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা উৎসব । ত্রিপুরিদের 'বুইসু', চাকমাদের 'বিঝু', মগদের 'সাংগ্রাই' ইত‍্যাদি ।
 এই বৈশাখেরই শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে পালিত হয় ' অক্ষয় তৃতীয়া' । 'অক্ষয়' মানে যার ক্ষয় নাই । প্রাচীন বিশ্বাস, এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভ কাজ করলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয় । এ দিনেই ছয়মাস বন্ধ থাকা কেদার-বদ্রী-যমুনোত্রীর মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয় । দরজা খুললেই দেখা যায় ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে রেখে যাওয়া অক্ষয়প্রদীপের শিখা । এছাড়াও অক্ষয়তৃতীয়াকে কেন্দ্র করে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে । সম্প্রতি উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ‍্যেও পড়েছে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন স্বর্ণ কেনার রীতি-রেওয়াজ । লৌকিক বিশ্বাস এই শুভতিথিতে রত্ন বা জিনিস পত্র কিনলে গৃহে শুভযোগ বৃদ্ধি পায় । সুখ-শান্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি পায় । এই আশাতেই মানুষ এদিন কিছু না কিছু ক্রয় করে থাকেন ।

বৈশাখমাস বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মমাস । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বৈশাখকে দেখেছেন অন‍ন‍্য বিভঙ্গে । তাঁর গানে পাই–
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে 
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক
 এসো এসো ।
এসো হে বৈশাখ এসো এসো
যাক  পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি 
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
 মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা
 অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা ।
রবীন্দ্রদৃষ্টিতে বৈশাখ এসেছে গৈরিকরূপে । গেরুয়া রঙ বৈরাগ‍্যের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের রূপে দেখেছেন গৈরিক বৈরাগ‍্য ।

এবছর এই বৈশাখেই পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাঙালি দুই জনগোষ্ঠী হিন্দুদের 'অক্ষয়তৃতীয়া' ও মুসলমানদের 'ঈদ-উল-ফিতর' । এই দুই অনুষ্ঠানের মধ‍্যেই রয়েছে প্রাচীন কৃষিজীবি মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস । 'অক্ষয়তৃতীয়া'য় রয়েছে গোষ্ঠীজীবনের কৃষিপণ‍্যের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির ভাবনা । 'ঈদ'এর অর্থ উৎসব । কৃষিকার্যের মাধ‍্যমে প্রাপ্ত কৃষিজ ফসল সম্মিলিতভাবে ভাগ করে নেওয়ার প্রাচীন আনন্দোৎসব 'ঈদ' উৎসবের উৎস । এ দুয়ের মধ‍্যে কেমন এক মেলবন্ধনের ফল্গুধারা প্রবাহিত ।

সেই সূত্র ধরেই  আমাদের প্রার্থনা হোক আজকের দিনে, এই বৈশাখে–অক্ষয় তৃতীয়া আর ঈদোৎসবের মিলনে অক্ষয় হোক আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহাবস্থান ‌।

খাগতর্পণ

খাগতর্পণ

কলমে সৃজন হয় ৷ মসীতে রক্ত ঝরে ৷ খাগবিন্দু ঘামের আলপনা ৷কলম যে হৃৎশ্রমের হাতিয়ার ৷ কলমের অগ্রভাগে ভেসে ওঠে যে নির্মিতি, অক্ষরের অলংকারে জেগে ওঠে যে নন্দন, সেতো অন্নস্বপ্ন ৷

 আগত সন্ততিজীবন ও অষ্টপ্রকোষ্ঠের নবদ্বারের বাঁধুনির মৃদঙ্গদেয়াল ঘিরে যে ঘর্মাক্ত আলপনা সে যে মেধার গঙ্গামৃত্তিকা ৷ এ সুলক কেবল মসীশ্রমিকই জানে ৷ 

কলমও নির্মমরাজের বিপরীতে আওয়াজ তোলে ৷ স্লোগান রচনা করে ৷ কলম ঊষার আকাশে গায় জাগরণীগান ৷ 

কলমের মাধুকরী আর কর্মজীবীর মোটাভাতের গন্ধ এক ৷ আশ্চর্য নীবার ৷ খাগের অন্তরে নীরবে বাজে হাতুড়িধুন ৷ কাস্তেকিঙ্কন ৷ 

কলমের নিবেদন শুভকালের প্রত্যাশায় ৷ কলম তখনই আয়ুধ যখন ক্রোধ কুসুমিত হয় কৃষ্ণচূড়ার আগ্নেয়শাখায় ৷

  যদি কোনো হন্তারক ক্রুশকাঠের মতো  কলমকে বয়ে নিয়ে যায় বধ্যভূমির দিকে ৷ সম্মিলিত কলমমজুরেরা দাঁড়িয়ে যায় কলমের চারপাশে ৷ ভীরু হন্তারক পেছনে সরে যায় ৷

 মসীমজুর কলমের কল্পনায় আঁকে ভুবনপাহাড়ের খোলা আকাশ ৷ লিখে যায় শিল্পগ্রামের অমৃতকবিতা ৷ জীবনীশোধক বর্ণাশ্রম ৷
 
প্রতিটি মসীজীবীও শ্রমিক ৷ অন্নগন্ধ কিংবা সৃজনসৌরভ তারও শরীরের মোক্ষম চলাচল ৷ রক্ততঞ্চন ৷ প্রতিটি মে-দিন তার জরুরি উদযাপনের দিবস ৷ তপ্তবৈশাখী ৷ শব্দশ্রমিকের দৃঢ়আঙুল জাগবার দিন ৷ অনিবার্য পালনেই তার সম্মান ৷