Sunday, January 14, 2018

ভিক্ষাবৃত্তি

মানুষ বিভিন্ন কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে ৷সেই নির্ধারিত কর্মই হল পেশা বা বৃত্তি ৷ যখন একটিমাত্র কর্মই কারো পেশা হয়ে দাঁড়ায় তখন ওই পেশার সঙ্গে তার কর্মের পরিচয় যুক্ত হয়ে যায় ৷ সমাজে এরকম বহুবিধ বৃত্তি রয়েছে ৷ আমাদের ভারতীয় সমাজে দেখা যায় কিছু কিছু বৃত্তি বংশপরম্পরাক্রমে চলে আসে এবং এইসব বৃত্তিতে তারা নিজস্ব ঘরানা ও দক্ষতার পরিচয় রাখে ৷ আবার কিছু পেশা ব্যক্তিবিশেষের ক্রমাগত উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ৷ পেশাগত পরিচয়ের মাধ্যমেই কেউ কেউ সমাজে পরিচিতি লাভ করেন ৷ পেশাগত দিক দিয়ে অনেকে আবার বিশেষ চারিত্র বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে থাকেন ৷ যেমন ' বান্যা ' ভাঁড়ু দত্তকে কবিকঙ্কন ধূর্ত চরিত্র হিসেবে অঙ্কন করেছেন ৷ কাস্টমারকে ঠকানোর জন্যে সেই বলতে পারে 'সোনা রূপা নহে বাপা, এ বেঙ্গা পিত্তল/ঘষিয়া মাজিয়া বাপা কইরাছ উজ্জ্বল' ৷
         পেশার মধ্যে আবার স্তরবিভাজনও রয়েছে ৷ সংস্কৃত প্রবাদে রয়েছে - বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী তদর্ধং রাজসেবায়াং / তদর্ধং কৃষিকর্মেন ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ ৷ তেমনি বাংলা প্রবাদ রয়েছে - উত্তম পেশা সদাগরি /মধ্যম পেশা চাষা / মধ্যম পেশা মাইগ্গা খাওন/জীবনের নাই আশা ৷ প্রবাদোক্ত 'মাইগ্গা খাওন'টাই হল খুঁজে খাওয়া বা ভিক্ষাবৃত্তি ৷ যে ভিক্ষালব্ধ অন্নে জীবিকা নির্বাহ করে সে হল ভিক্ষুক ৷ সমাজের সবচাইতে নিরুপায় পেশা হল ভিক্ষাবৃত্তি ৷ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গৃহস্থের দোরে দোরে ঘুরে অন্ন আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের মতো অসহায় পেশার নাম হল ভিক্ষা ৷ তাই ভিক্ষুককে সমাজও করুণার চোখে দেখে ৷ ভিক্ষুককে দান করার মধ্য দিয়ে অনেকে পরমার্থের সন্ধানও করেন ৷ আমাদের বাঙালি হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ পরিবারে উপনয়ন অনুষ্ঠানকালে নবোপবীতধারীকে কয়েকঘর মুষ্ঠিভিক্ষা করার রীতি প্রচলিত আছে ৷ আবার ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী বোষ্টমরা ভিক্ষান্নে জীবনযাপনের মতো কৃচ্ছতা বেছে নেন ৷
          ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে আহৃত অন্নের মানের বিচার করা যায় না ৷ কথায় বলে, 'ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া' ৷ যা ভাগ্যে জোটে তাই পরমান্ন ৷ ভিক্ষাবৃত্তিতে কিছু সমস্যাও রয়েছে ৷ পরিচিতির কারণে 'গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না' ৷ অনেকসময় কুকুরের কামড়ের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে গৃহস্থকে অনুরোধ করে বলতে হয় 'থাক ভিক্ষে, তোর কুত্তা সামাল' ৷ আমাদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতে ঈশ্বরানুরাগীর আবেদনেও 'আমি দীন ভিখারি, পারের কড়ি ফালাইছি হারাইয়া' বলে  বিষয়টি প্রতীকী রূপ নিয়ে গভীর  বার্তা করে এসেছে ৷ তবে অনেকসময় ভিক্ষাবৃত্তির মতো মর্মবাহী পেশার মাধ্যমে অনেকেই যে আখের গোছায় সে বিষয়ে ব্যাখ্যায় আর যাচ্ছি না ৷ ভুক্তভোগী মাত্রেরই কমবেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ তবে ভিক্ষাবৃত্তির ভদ্র ও আধুনিক সংস্করণ বলে আমার মনে হয় চাঁদাবাজি ৷
শেষ করব মধুকবির একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি দিয়ে ৷ ইংরেজীচর্চার মোহে বিদেশে গিয়ে বিফল মনোরথে পুনরায় বাংলাভাষার চর্চা শুরু করার লগ্নে তাঁর বিখ্যাত 'বঙ্গভাষা' কবিতায় লিখেছেন , 'পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি/কাটাইনু বহুকাল সুখ পরিহরি' ৷ আসলে ভিক্ষাবৃত্তি সুখের পেশা নয় ৷

No comments:

Post a Comment