Sunday, June 17, 2018

ঋ ণ স্বী কা র

আজ আমার এক বিরল অভিজ্ঞতা হল ৷ তুলে ধরার আগে প্রিয় পাঠকবর্গের কাছে বিনীত আবেদন রাখছি আজ অন্তত পাঠের পর লাইক বাটন চেপে এড়িয়ে যাবেন না ৷ ছোট্ট একটা মন্তব্য রাখার প্রয়াসও নেবেন ৷ আপনাদের সুচিন্তিত মন্তব্য থেকে রসদ নিয়ে আমি পুষ্ট হতে চাইছি আজ ৷ মনের গহনের একটা দ্বন্দ্বের নিবৃত্তিও চাইছি ৷
ভীষণ নিস্তরঙ্গ শান্ত আমার শহরটা ৷ মাঝে মাঝে সীমান্ত নদীটাই অশান্ত হয় ৷ উত্তাল ঢেউ তুলে দুকুল ভাসায় ৷ এই যেমন কদিন আগে বেপরোয়া প্লাবনে কাঁদিয়েছে আমাদের গ্রাম জনপদ ৷ আর মাঝে মাঝে দু একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের হঠাৎ অচিনপুরে চলে যাওয়ায় আমরা ব্যথিত হই ৷ এছাড়া প্রতিদিন ছোটোখাটো সুখদুঃখের স্মৃতি নিয়েই আমাদের নিত্যযাপনচিত্র ৷ মহকুমা শহর থেকে প্রতিদিন যাওয়া আসা করা বাসগুলোই রাজধানীর ও রাজ্যের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগের অবলম্বন ৷ প্রয়োজনে একে অন্যের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে যাতায়াত করি ৷ এরই ফাঁকে কারো প্রয়োজনীয় ঔষধটা এনে দেওয়া, কারো পড়ুয়া ছেলেমেয়ের কাছে টাকাটা চাউলটা পৌঁছে দেওয়া, মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের ভোগের পেঁড়া এনে দেওয়া এসব ছোটোখাটো ফুটফরমাশ আমরা একে অন্যের জন্যে হাসিমুখেই কেউ না কেউ কখনো সখনো করে থাকি ৷ এসবের জন্যে কেউ কারো কাছে ঋণী থাকেন বা দুর্বলতা অনুভব করেন না ৷ তেমন করে কেউ মনেও রাখেন না ৷ জীবন তার মতো করে গড়িয়ে যায় ৷ যে বা যিনি উপকার করলেন তিনিও কী আর মনে রাখেন এসব !  আসলে এই মফস্বল শহরে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই একে অন্যের সঙ্গে কম বেশি পরিচিত ৷ খবরাখবর রাখি ৷ সুসম্পর্ক রাখি ৷ রাজনীতি এই শহরে এখনও তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছায়নি ৷ যার যার কর্মসূচীর শেষে একসঙ্গে বসে চা পান করেন ৷ এখনও দুদিন দেখা না হলে আন্তরিক উদ্বিগ্নতার জবাব দিতে দিতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে বিলম্ব হয় ৷ নগর বা মহানগর হয়ে ওঠেনি এখনও আমার শহর ৷ শতাব্দীপ্রাচীন শহর এখনও নিষ্কলঙ্ক বলেই জানি ৷
আমাদের এই শহরের চিন্তাশীল, ভাবুক,  মননশীল,তরুণ উদ্যোগী,সংবাদকর্মী, অবসরজীবী, নিষ্কর্মা এবং বুদ্ধিব্রতীদের মরূদ্যান হল এবিসিডি ৷ অর্থাৎ অশোক বসাকের চায়ের দোকান ৷ মালিক অশোকদা ব্যবসার তুলনায় এই মানুষগুলোর আড্ডা, হৈ চৈ, স্বভাব,ব্যবহার, আবদার নীরবে সহ্য করেন ৷ তাঁর বিখ্যাত রসগোল্লার মতো নিজেও সুরসিক ৷ দিনের বিভিন্ন সময়ে আড্ডার সদস্য পাল্টায় ৷ যেসময়ে অশোকদা থাকেননা তখন আড্ডাস্থল তাঁর ছেলে গৌরসুন্দরের বন্ধুদের দখলে চলে যায় ৷  এখানে আড্ডা দিতে আসা প্রত্যেকের সম্বন্ধে একটা করে ক্যারেকটারিস্টিক নোম্যানক্লেচার ব্যবহার করেন অশোকদা ৷ সবাই মজাও পায় ৷ আর জানেন কার কীরকম খাবার পছন্দ ৷ কে জিলিপি ভালোবাসেন, কে রসমালাই, কে গরম রসগোল্লা, কে কোন মিষ্টি নিরিবিলি বাড়ি নিয়ে যেতে পছন্দ করেন এমনকি কার বাড়িতে কারা কী পছন্দ করে সব তাঁর জানা ৷ আর জানেন কে চায়ে চিনি খাননা, কে কম খান, কে লিকার চা খান, কে দুধচিনিচা খান ৷ সব তাঁর নখদর্পনে ৷ অর্ডার দিলেই হল ৷ চেহারাটা দেখে নিয়ে সেভাবেই প্লেস করেন ৷ আমরাও যখন আড্ডায় মশগুল হই ৷ কেউ না কেউ চায়ের অর্ডার দিই ৷ সে সময়ে কেউ কোন কারণে খেতে আগ্রহী না হলে জানিয়ে দেয় ৷ কেউনা কেউ পেমেন্ট করি ৷ এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়না ৷ নির্ভেজাল আড্ডায় যেমন হয় আর কী ৷ দাম বাকি রাখতে হলে অশোকদা নিজেই জেনেবুঝে খাতায় লিখে রাখেন ৷
আজও বিকেলবেলা বাড়িতে বাজারটা পৌঁছে দিয়ে এখানে আড্ডা দিতে বসেছি ৷ আমার অগ্রজপ্রতিম দীপকদা (স্বপনদা)  সঙ্গে তাঁর এক বন্ধু আগে থেকেই এ দোকানের বারান্দার বিখ্যাত পার্লামেন্ট কর্নারে বসেছিলেন ৷ তাঁরা কথাবার্তা বলছিলেন ৷ আমি বসেই তিনটে চায়ের অর্ডার দিলাম ৷ খোকন এসে চায়ের ধরন বুঝে নিচ্ছে ৷ নবাগত দাদা প্রথমত নিমরাজি হলেন পরে বললেন আমার সুগার ৷ চা টা অবশ্যই সেভাবে দিও কিন্তু ৷ খোকন ফিরে গিয়ে ঠিকঠাকমতোই চা করে এনে আমাদের দিল ৷ বেশ কতক্ষণ কথাবার্তা বললাম আমরা তিনজন ৷ একসময় স্বপনদার বন্ধু বাজারে যাবেন বলে উঠলেন ৷ আমাকে বললেন, আপনি আমাকে চা খাইয়েছেন ৷ আমি আপনার কাছে ঋণী রইলাম ৷ আমি আর একদিন চা খাওয়াব আপনাকে ৷ আপনি না করতে পারবেননা ৷ আমি বললাম, আরে একি বলছেন আপনি ৷ না না....... এ কী ৷ স্বপনদা বললেন, আরে কী কও তুমি ৷
তিনি চলে গেলেন ৷ আর বিশেষ কথা হলনা ৷
আমার একটু খটকা লাগল ভদ্রলোকের সৌজন্যতায় ৷ এমন অঙ্কের হিসাবে আমরা কী খাই না খাওয়াই ৷ তাও এককাপ মাত্র চা ৷ ভদ্রলোকের এথিকস হয়তো এটা ৷ ভালো খারাপ বুঝে উঠতে পারছিনা ৷ আসলে আমি কী এই এক কাপ চায়ের বিনিময়ে উত্তমর্ণ হয়ে গেলাম ৷ রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, 'গ্রহণ যতো করেছ, ঋণী ততো করেছ আমায়' ৷ একথাটার মানে তাহলে কী? বিনীত ঋণী হওয়ার সুযোগ কোথায়?

No comments:

Post a Comment