Wednesday, July 11, 2018

বিলুপ্তপ্রায় লোকক্রীড়া 'লাঠিখেলা'

সংস্কৃত 'যষ্ঠি' শব্দ থেকে প্রাকৃতায়িত হয়ে বাংলায় লাঠি হয়েছে ৷ একসময় বিনোদন ও আত্মরক্ষার উপকরণ ছিল এই লাঠি ৷  যাঁরা লাঠিচালনায় পারদরশী তাঁদের বলা হয় লাঠিয়াল বা লেঠেল ৷ একসময় জমিদাররা আত্মরক্ষায়, জমিরক্ষায় কিংবা জমি দখল নিতে লাঠিয়াল নিয়োগ করতেন ৷ সেসময়ে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ও মেলায় বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে লাঠিখেলার আয়োজন করা হত ৷ বেশ উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হত এই লাঠিখেলাকে কেন্দ্র করে ৷ অপরাধীকে শায়েস্তা করার জন্যে 'লাঠ্যৌষধম্' প্রয়োগ করা হত ৷ প্রবাদ আছে, 'লাডিরে ভূতেও ডরায় ৷ বাংলাসাহিত্যে লাঠিয়াল বা লাঠি খেলার অনেক প্রসঙ্গ আছে ৷ লাঠিয়াল চরিত্রের মধ্যে প্রমথ চৌধুরীর 'মন্ত্রশক্তি' গল্পের 'ঈশ্বরী পাটনী' বিখ্যাত হয়ে আছে ৷ তেমনি বিখ্যাত তার উক্তি, 'হুজুর,  নেশায় শরীরের শক্তি যায় কিন্তু গুরুর কাছে শেখা বিদ্যে তো যায়না' ৷  বাংলার অধুনালুপ্ত এই খেলা বাংলার মার্শাল আর্টের বিশেষ উদাহরণ ৷রাজ্যের তরুণ গবেষক ও বিশিষ্ট কবি-সম্পাদক গোপাল দাস এই লোকক্রীড়াকে আবার তুলে এনেছেন পাদপ্রদীপের আলোয় ৷ তিনি তাঁর গবেষণাধর্মী লেখায় তুলে এনেছেন, লাঠি খেলা
গোপালচন্দ্র দাস

সিলেটের অঞ্চলের বিনোদনের এক অংশ ছিলো এই লাঠি খেলা।বাজারে ঢোল পিটিয়ে লাঠিখেলার স্থান সময় বলে দেওয়া হতো।বিশেষ এক ধরনের বাঁশ যা আকারে বেশী বড় হয় না,ভেতরে ফাঁপা বা ছিদ্র কম থাকে( যাকে সিলেটি ভাষায় নিষ্ফুল্লা বলে)। এ ছারা কেউ কেউ টেটুয়া কনক‌ই অথবা কোন কারন বশতঃ বড় না হ‌ওয়া বরাক(ছিংলা বড়ুয়া) ও উক্ত খেলায় ব্যবহার করে থাকেন। গাড় বাসন্তি রঙ এর টেকস‌ই ও মজবুত বাঁশ। অমাবশ্যায় বিশেষ করে শনিবার অথবা মঙ্গলবার হলে তো আর কথাই নেই। লাঠি খেলার বাঁশ অন্যের বাঁশঝাড় থেকে বেশীর ভাগ‍ই চুরি করে কাটা হয়।একটি বড় বাঁশ চাইলে এমনিতেই দিয়ে দিতে পারে কিন্তু লাঠি খেলার বাঁশ দেবে না বা বিক্রিও করবে না।কেউ লাঠিতে তৈল মর্দন করেন আবার কেউ খেলার পূর্বে রীটা(এক ধরনের গাছের গুটা যা ক্ষারযুক্ত)দিয়ে লাঠি ও নিজ হাত ধুয়ে নেন যাতে হাত থেকে লাঠি পিছলে না যায়।
খেলার আগে, ও চলাকালিন সময়ে ঢোলের বাজনা চলে।ঢোলের তালে তালে অনেকটা মার্শাল আর্টের বুলির মতো খেলোয়ার বুলি আউরান।দুদিকে দুই খেলোয়ার খেলার লাঠি নিয়ে যার যার সাধ্যমতো কসরৎ ও বিদ্যার বাহাদুরি প্রদর্শন করে অনেক হাত তালি ও হর্ষধ্বণি পান।
এক লাঠি দিয়ে অনেকেই খেলেন,কেউ কেউ কানজোখা (মাটি থেকে কান পর্যন্ত)লাঠি ব্যবহার করেন কিন্তু আসল লাঠি খেলাতে বাঁশ খাড়া করে যে ব্যক্তি লাঠি খেলবেন সেই ব্যক্তি মাটি থেকে বত্রিশ মুষ্টি উপরে বাঁশ কাটবেন এবং ঐ লাঠি শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তির জন্যে প্রযোজ্য অন্য কারো জন্যে নয়।খেলা শিখতে ওস্থাদ বা গুরু ধরতে হয়।
পুরো খেলাকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে,প্রতি ভাগে আট মুষ্টি। পুরো খেলা বত্রিশ মুষ্টি(৪×৮=৩২)।প্রথম ৮ কলা,উনি এক‌ই সাথে আটটি কলা কসরৎ প্রদর্শন করতে পারেন,এটা শিক্ষনীয় প্রাথমিক পর্যায়। এভাবে ১৬ মুষ্টি ২য়,২৪ মুষ্টি ৩য় ধাপ ও সর্বশেষ ৩২ মুষ্টি একজন পূর্ণ খেলোয়ার বা ওস্থাদ। উনি খেলা শিখাতে পারেন।উনি কঠোর সাধনা করেন ও সংযমী থাকেন।সাধারন হানাহানি মারামারিতে সেই কলা প্রয়োগ করেন না। শুধু প্রাণ রক্ষার্থে এই কলা ব্যবহার করতে পারেন।বত্রিশ মুষ্টির খেলোয়ারের অনেকের‌ই লম্বা চুল থাকে।নিজ চক্ষু প্রতিদ্বন্ধি খেলোয়ারকে দেখান না।পা ও চোখের দিকে তাকিয়ে অনেক সময় প্রতিদ্বন্ধি বুঝতে পারেন এখন শরীরের কোন অঙ্গে আঘাত আসতে পারে। খুব সাবধানে প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালন ও সতর্কতার সহিত প্রতিটি পা ফেলতে হয়।
একজন পূর্ণ খেলোয়ার খেলা শুরু হ‌ওয়ার পূর্বে সোনা রুপা তুলসী ও আতপ দুধ দিয়ে লাঠিকে শোধন করে নিজ কলা ,ওস্থাদ ,ও লাঠিকে যেমন সন্মান করেন তেমনি কিছু তুকতাক্ ,টোটকাও করে থাকেন।অমাবশ্যা শনিবার,অভাবে শুধু শনিবার অথবা শুধু অমাবশ্যায় মৃত ব্যক্তির দাহকাঠি(সিলেটি ভাষায় খুঁছিবারি)তে লেগে থাকা অঙ্গার খেলার লাঠির দুই মাথায় প্রবেশ করিয়ে পিতলের বাট লাগিয়ে বশিকরণ মন্ত্র তিনবার উচ্ছারণ করেন। আবার কেউ খেলা শুরুর প্রাক্ মুহূর্তে পূর্ববন্ধি করেন:- উত্তরে হিমালয় বন্ধি,হরগৌরী বন্ধি,পশ্চিমে জগন্নাথ বন্ধি,দক্ষিণে কালিদয় সাগর বন্ধি,পাতালে বাসুকির চরণ বন্ধি,পর্ব্বতে রাক্ষুসী বন্ধি,যে আমারে হিংসা করবো রাক্ষুসী তারে খাইবো। তিনবার লাঠিতে ফু দেওয়া হয়। লাঠি খেলা নিয়ে সিলেটি ভাষায় ক'লাইন দেওয়া হলো:-
মুঠির উপরে মুইট
যে ধরবা লাঠি
তান বত্তিশ মুইট।
সোনা রুপা তুলসী
লাঠিত ঘষাও আওয়া দুধ
বেটিন্তর কাপরের নীচেদি
যাইও নারে পুত।
মায় মুরব্বির আশিব্বাদ ল‌ও
উস্থাদ ধর সাইচ্ছা
চুক নায় বুদ্ধি দিয়া দেখ
শত্রু তোমার সামনে বাইচ্ছা।
                শুধু শক্তি দিয়ে উত্তেজিত হয়ে এই খেলায় জয়লাভ করা যায় না। আত্ম সংযম, কলা কুশলী, বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার করতে হয়।
লাঠি খেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে ছোটখাটো মেলা বসে।ছোট বড় সবাই এই খেলা ও মেলাকে উপভোগ করেন।
এই খেলায় শর্তশাপেক্ষে না হয়ে যদি খোলা মেলা রীতি অনুযায়ী হয় ,তাহলে অনেকের‌ই  হাত মাথা ফেটে যায়,এবং খেলা শেষে প্রতিদ্বন্ধিকে সহনুভূতি সহ মলম পট্টি করাতে দেখা যায়। বাস্তবে এটা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ খেলা,যা আজকাল লুপ্তপ্রায়। ( লাঠিখেলা - গোপালচন্দ্র দাস) ৷

11-07-2018
পারমিতার জন্যে
সম্পাদক:- অমিশা দাস

No comments:

Post a Comment