Saturday, May 11, 2019

রাজনৈতিক ভাষণে শালীনতার চাপান উতোর

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কটুভাষণ বা গালাগাল সাহিত্যের অঙ্গ ৷ আর সাহিত্যের গালাগালের মধ্যে শিল্পও থাকে ৷ বাংলার লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি কবিগানে কবিওয়ালারা প্রতিপক্ষকে চাপান-উতোরের মাধ্যমে অত্যন্ত শিল্পময় মন্দোক্তি করতেন ৷ বাংলা কবিগানের যুগে কবিওয়ালাদের মধ্যে ভোলা ময়রা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ ও এন্টনি ফিরিঙ্গি কবিগানের আসরে পরস্পরকে রসব্যঞ্জক গালাগাল দিতেন ৷ সেগুলো যেমন ছিল বুদ্ধিদীপ্ত তেমনি ছিল সাহিত্যরসসমৃদ্ধ ৷ একটি আসরে এন্টনি ফিরিঙ্গির প্রতি ঠাকুর সিংহের চাপান ছিল-'বল হে এন্টনি আমি একটি কথা জানতে চাই/ এসে এদেশে এবেশে তোমার কেন কোর্তা নাই?' এর প্রত্যুত্তরে এন্টনি ফিরিঙ্গিরও বুদ্ধিদীপ্ত উতোরটি ছিল-' এই বাংলায় বাঙালির বেশে আনন্দেতে আছি/হয়ে ঠাকরো সিংহের বাপের জামাই কুর্তি টুপি সব ছেড়েছি ৷' তেমনি রাম বসুর চাপান ছিল-'সাহেব! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি/ও তোর পাদরি সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চুনকালি ৷' এক্ষেত্রে এন্টনি ফিরিঙ্গির ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক উতোরটি লক্ষ্যণীয়-' খৃষ্টে আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই/শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই ৷' গালাগালকে শ্রীরামকৃষ্ণ দুভাবে দেখেছেন ৷ নটনাট্যকার গিরিশ ঘোষ যখন নেশসক্ত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণকে গালাগাল দিচ্ছিলেন খাওয়ার পাত থেকে তুলে দিয়ে তখন তিনি ভাগনের কাছে অনুযোগ করছিলেন-রাখালে,গিরিশ আমাকে দেড়খানা নুচি খাইয়ে এমন গালাগাল দিলে রা?  আবার কেউ যখন তাঁর কাছে নালিশ করতেন গিরিশ তাঁকে গালাগাল দিচ্ছে বলে ৷ তখন শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন- দে দে ৷ গালাগাল দিতে দে ৷ ওতে বদরক্ত বেরিয়ে যায় ৷ সেকালে গালাগাল ছিল তেমনি ৷

কবিগানের যুগ আর এখন নেই ৷ এখন রয়েছে রাজনীতির মঞ্চ ৷ সেই মঞ্চ থেকে চলে রজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি চাপান-উতোর ৷ তার মধ্যেও একসময় সৌন্দর্য ছিল ৷ কিন্তু অতিসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে মার্জিত ও মজাদার শ্লেষগুলো যেন কাঁচা খিস্তিতে পরিণত হচ্ছে রাজনেতাদের মুখ দিয়ে ৷ কারো নাম উল্লেখ করে কোনোদিকে ঝোল টানার চেষ্টা করছিনা ৷ খিস্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীরা কারো থেকে কেউ কম যাননা ৷ এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় ৷ 'তরু হতে যেবা সহিষ্ণু, তৃণ হতে দীনতর' কেউই নেই রাজনীতির ময়দানে ৷ কেউ কারো কথা মাটিতে পড়তে দেননা ৷ শূন্যেই ছোঁ মেরে তুলে নেন ৷

এবারের নির্বাচনের প্রচারে রাজনেতাদের পরস্পরের প্রতি আক্রমণের ভাষা কবিগানের চাপান-উতোরকে ছাড়িয়ে খেউড়গানের পর্যায়ে চলে গেছে ৷ কে কতোটা শালীনতার মাত্রা পেরুতে পারেন তারই যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে এবারের নির্বাচনের প্রচারে ৷ নীতি নিয়ে কথা নেই ৷ উন্নয়ন নিয়ে বার্তা নেই ৷ পরস্পর কুৎসিত ও ঘৃণ্য বাক্যবিনিময়ের প্রতিযোগিতা চলছে ৷ চলছে ব্যক্তি আক্রমণ ৷ সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন ৷ ফলে এইসব রাজনীতিবিদ সম্পর্কে জনমনেও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ৷ পরুষবাক্যের মধ্য দিয়ে কী তাঁরা সমাজকে সঠিক দিশা দেখাবেন? 'মানো হি মহতাং ধর্মং' কী তাঁরা ভুলে গেছেন? সম্মান দিলে যে সম্মান পাওয়া যায় এটা কী তাঁরা জানেননা?  রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন-'রাজা সবারে দেন মান/সে মান আপনি ফিরে পান৷' তাহলে?

No comments:

Post a Comment