Wednesday, August 10, 2022

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে নিতে হবে অখন্ডতার শিক্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা । এই ঘটনা একদিকে যেমন আনন্দের । অন্যদিকে অত্যন্ত বেদনার । আনন্দের হল এই যে ১৯ ৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তিলাভ করে । প্রবল পরাক্রমশালী ইংরেজকে ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে হয় । তারা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । ঘোষণা করতে হয় স্বাধীন রাষ্ট্রের । কিন্তু ইংরেজরা তাদের কূটকৌশল ব্যবহার করে দেশটাকে ভাগ করে দিয়ে যায় । শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশটি ভারত ও পাকিস্তান দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

 ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন লর্ড ওয়াভেলকে প্রতিস্থাপিত করে ভারতের ভাইসরয় পদে নিযুক্তি হওয়ার আগেই তিনি বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের একটি অপরিকল্পিত সীমানা নির্ধারণ করেছিলেন । কোন প্রদেশের কোন অঞ্চল কোন অধিরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য ব্রিটিশ সরকার অন্তর্বঙ্গ ও অন্তর্পাঞ্জাব উভয় সীমানা অঞ্চলে দুটি নির্ধারণ কমিশন গঠন করেন । উভয় কমিশনের সভাপতি পদে আসীন ছিলেন স্যার শেরিল রেডক্লিফ । ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা তার নাম অনুসারে 'রেডক্লিফ লাইন' নামে পরিচিত । তাঁর সৃষ্ট বিভাজন অনুযায়ী সিন্ধু, বেলুচিস্থান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব, পূর্ব বাংলা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলার কিছু অংশ নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় । ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া 'ভারত স্বাধীনতা আইন' অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে । ভারতের আকাশে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উড়ে । আর বেদনাজনক ঘটনাটি হল, এই দেশভাগকে কেন্দ্র করে তার কিছু আগেও পরে দেশব্যাপী ব‍্যাপক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের অত্যাচারে সেখানকার হিন্দু শিখ প্রভৃতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয় ও ছিন্নমূল হয়ে দলে দলে ভারতের অন্তর্গত পূর্ব পাঞ্জাবে উদ্বাস্ত হয়ে আশ্রয় নেয় । অন্যদিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব পাঞ্জাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও শিখদের অত্যাচারে দলে দলে মুসলমান পশ্চিম পাঞ্জাবে আশ্রয় গ্রহণ করে । অন্যদিকে দেশের পূর্বাঞ্চল বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা  দিতেই সেখানে ব্যাপক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । 

১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংগঠিত হয় ভয়ংকর দাঙ্গা । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে 1946 সালের 29 শে জুলাই বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের অধিবেশনে যেভাবে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয় যে-,"The Muslim Nation to resort to Direct Action to achieve Pakistan and the consequent fixing of August 16th as Direct Day." { Letter of Sir F. Burrows ( bengal ) to Field Marshal Viscount Wavell, Calcutta, 22 August,1946, Letter No. 197 T. P. Vol-VIII } মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শুক্রবারে সারা ভারতবর্ষে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয় । তার প্রস্তুতি হিসেবে প্ররোচনামূলক লক্ষাধিক পুস্তিকা বিতরণ করা হয় । এই ঘোষণার পর থেকেই  দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল । দেশভাগকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল 1946 সালের "The great Calcutta killing" । উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য এবং মুসলমানদের নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবিতে তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে ১৬ আগস্ট কে Direct Action Day হিসেবে নির্ধারণ করে  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, "What we have done today ( the day when League Council passed the Direct Action resolution ) is the most heroic act in our history. Never have we...none anything except ...By constitutional methods." ( The Dawn, 30 August 1946 ) ১৬ আগস্ট তারিখ সকাল থেকে কলকাতার বুকে নেমে আসে এক বিভীষিকার কালো রাত । মানিকতলা, রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মৌলালী, শোভাবাজার, মেছুয়াবাজার, ট‍্যাংরা, টালিগঞ্জ, টেরেটিবাজার, বেলগাছিয়া এবং অন্যান্য হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে হিন্দুদের উপর আক্রমণ শুরু হয়ে যায় । এই সময় তোলা বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায়, এই দিন ময়দানে মুসলিম লীগের সভায় উপস্থিত জনতা লাঠি তরবারি ছুরি ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে উপস্থিত হয় । এই সভায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেয় এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আহ্বান করে মিছিলফেরত উত্তেজিত জনতা হিন্দু দোকানগুলিতে লুটপাট ও নির্বিচারে হিন্দু নিধন ও নারীর ধর্ষণ চালাতে থাকে । মুখ‍্যমন্ত্রী হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে লালবাজারে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে থেকে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখেন । এর প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে । যদিও ১৭ আগস্ট শান্তি রক্ষার্থে সব দলের নেতাদের সম্মিলিত আবেদন প্রচারিত হয়:–

ভাইসব,

 ভাই ভাইয়ের মধ্যে এই যুদ্ধ অবিলম্বে থামাইবার জন্য আমরা আপনাদের নিকট আবেদন জানাইতেছি । যাহা ঘটিয়াছে তাহা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক । আসুন এই কাহিনী আমরা ভুলে যাই । কে দোষি আর কে নির্দোষ সেই তর্ক করিতে থাকিলে আরও জীবন ও ধনসম্পত্তি নষ্ট হইবে । যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়াছে এখানেই তাহার শেষ হউক । এই মারামারি এখন যেমন করিয়াই হউক বন্ধ করিতেই হইবে ।

 প্রত্যেক ভাইকে আমাদের অনুরোধ, আপনারা আমাদের পরামর্শ শুনুন । ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে । লাঠি বা অস্ত্র লইয়া চলাফেরা করিলে জীবন বিপন্ন বা গ্রেফতার হইবার আশঙ্কা ।

 আপনারা যে যাহার মহল্লায় থাকুন, অপরের মহল্লায় বা পাড়ায় অনধিকার প্রবেশ করিবেন না । সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি লইয়া মহল্লা শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠন করুন এবং সম্মিলিতভাবে শান্তি রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করুন ।

নিবেদক―স্বাক্ষর 

শরৎচন্দ্র বসু,  এইচ এম সোহরাবর্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, দেবীপ্রসাদ খৈতান, কিরণ শঙ্কর রায়, ভূপেশ গুপ্ত, মোহম্মদ আকরাম খাঁ, নিহারেন্দু দত্ত মজুমদার মোহর সিং জ্ঞানী, পাঁচুগোপাল ভাদুড়ী, সামসুদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসিম, ভবানী সেন, খাজা নুরুদ্দিন, হামিদুল হক চৌধুরী
( কলিকাতা ১৭ই আগস্ট ১৯৪৬ ) ( অমলেন্দু সেনগুপ্ত―উত্তাল চল্লিশ : অসমাপ্ত বিপ্লব, পাল পাবলিশার্স, ১৯৯১, কলকাতা, পৃষ্ঠা–১৪৭ ) । ১৮ তারিখ হিন্দুরা মুসলমান অঞ্চল গুলিতে ভয়াবহ আক্রমণ চালায় । ১৮ আগস্ট সকালে বাস ও ট্যাক্সি ভর্তি হিন্দু ও শিখ তরোয়াল, লোহার রড, এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহযোগে প্রতিরোধ আক্রমণ শুরু করে । মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শহরের চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায় । প্রায় এক লক্ষ বাসিন্দা গৃহহারা হন । এদিকে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রায় এক সপ্তাহ অব্যাহত ছিল । 

কোলকাতা দাঙ্গার ঠিক সাত সপ্তাহ পরে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় একই রকম ভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে মূলত কলকাতার দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা জেলায় ছোট বড় দাঙ্গা ঘটে গেলেও ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বকোণে নোয়াখালী ত্রিপুরা কুমিল্লা ও সন্দীপ এলাকায় একতরফা হিন্দু নিধন ও উৎপাদন শুরু হয় । এবং প্রায় চার সপ্তাহ ধরে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় স্থানীয় মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুদের উপর সংগঠিত হয় গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট, হিন্দু মন্দির ধ্বংস বা অপবিত্র করা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা । লিগ সরকার প্রায় এক সপ্তাহ এ খবর প্রকাশ করতে দেননি । এই দাঙ্গায়  কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার হিন্দু হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয় । তাছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দু নারীপুরুষকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয় । ব‍্যাপক বাস্তুত‍্যাগেরও ঘটনা ঘটে । এই সময় উপদ্রুত এলাকাগুলো থেকে প্রায় ৭৫ হাজার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্ত্রীপুরুষ শিশুসহ কুমিল্লা চাঁদপুর আগরতলা ইত্যাদি স্থানের ত্রাণ কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শেষ দিকে মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালী সফর ও গ্রামে গ্রামে পরিদর্শন হয়তো হিন্দুদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । ফলে উত্তরোত্তর সন্ত্রাসের তাড়নায় আবারো পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন । এই দুই নারকীয় ঘটনাই ভারত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে ‌। কবি জীবনানন্দ দাশের ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় রাজনীতির আড়ালে সৃষ্ট এই ধর্মীয় সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে–


মানুষ মেরেছি আমি তার রক্তে আমার শরীর / ভরে গেছে পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার / ভাই আমি আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু / হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর / কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে / বধ করে ঘুমাতেছি ..../ যদি ডাকি রক্তের নদী থেকে কল্লোলিত হয়ে / বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি, / হানিফ মোহাম্মদ মকবুল করিম আজিজ / আর তুমি আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে / চোখ তুলে শুধাবে সে, রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে / বলে যাবে গগন বিপিন শশী পাথুরেঘাটার ; / মানিকতলার শ্যামবাজারের গ্যালারি স্ট্রিটের এন্টালির । (১৯৪৬-৪৭ জীবনানন্দ দাশ )

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে বিহারে দাঙ্গা শুরু হয় । কলকাতার গণহত্যা ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পর ৩০ অক্টোবর ও ৭ নভেম্বরের মধ্যে ঘটা এই দাঙ্গার ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে । ২৫ থেকে ২৮ অক্টোবর এর মধ্যে ছাপরা ও সরণ জেলায় মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে । অতি দ্রুত পাটনা মুঙ্গের এবং ভাগলপুর মারাত্মক সহিংসতার জায়গায় পরিণত হয় । ১৯৪৬ এর শেষ দিকে এবং ১৯৪৭ এর গোড়ার দিকে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে প্রদেশেও দাঙ্গা হয়েছিল । দাঙ্গা যেমন দুই বাংলাতেই সংঘটিত হয়েছে তেমনি প্রতিরোধও হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রয়াসে । কোলকাতায় যেমন বহু হিন্দু বাঙালিরা আতংকিত মুসলমানদের লুকিয়ে রেখেছেন, ঠাঁই দিয়েছেন নিজেদের ঘরে তেমনি পুববাংলায়ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমানগণ এগিয়ে এসেছিলেন হিন্দুদের জীবন ও ধনসম্পদ রক্ষায় ।  রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন হিন্দু অধ‍্যুষিত পাড়াগুলোতে । অপারগ হয়ে উঠলে গোপনে এগিয়ে দিয়ে এসেছেন সীমান্ত পর্যন্ত । হিংসার বহ্ন‍্যুৎসবের মধ‍্যেও স্ফুলিঙ্গের মতো উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছিল সেদিন মানবিকতা ।

এই দাঙ্গার ফলেই সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ লাভ করে অগণিত উদ্বাস্তুর স্রোত । দেশভাগের ফলে শুধু হিন্দু বাঙালিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি । তার বলি হয়েছে মুসলমানরাও । তারাও দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে । এই দেশভাগ ও তার যন্ত্রণা আমাদের ইতিহাস চর্চার সামনে বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় । স্বাধীনতা ও দেশভাগ আধুনিক ভারতের ইতিহাসের সামনে এক অলঙ্ঘনীয় লক্ষণরেখা টেনে আনে । সেই ইতিহাস চর্চা শুধুমাত্র সরকারি তথ্যনির্ভর থাকেনি । আর্কাইভনির্ভর খাতে প্রবাহিত হয়নি । প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতার কথাও উঠে এসেছে । যারা দেশভাগের শিকার হয়েছেন, ধর্মীয় সহিংসতায় সবকিছু থেকে উৎখাত হয়ে ভাসমান জীবন অতিবাহিত করেছেন তাঁদের থেকেও তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে । অনেকে সে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন পার করে দিয়েছেন । অনেকে আজও বেঁচে আছেন সেই দগ্ধ অন্ধকার দিনের চিতানলকে বুকে নিয়ে । তাদের স্মৃতিতে ঠাসা হয়ে আছে অনেক যন্ত্রণা । অনেক বেদনা । আর স্মৃতি তো চিরকাল অমলিন থাকে না দেশভাগের অভিজ্ঞতা ও অব্যক্ত স্মৃতিও একদিন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় । আজও হারিয়ে যাচ্ছে এমন অনেক স্মৃতি । স্মরণ ও বিস্মরণ এবং উত্তরপ্রজন্মের অভিজ্ঞতা যা আছে তা তুলে নেওয়ার প্রয়াস শুরু হয়েছে আবার । 

হয়তো অনেকে বলবেন– 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালবাসে?'  না, এ বেদনা জাগাতে হবে । এই বেদনা একটা জাতির রক্তাক্ত ইতিহাস । এ বেদনার অভ্যন্তরে রয়েছে দেশভাগের বিষবৃক্ষটি । তাকে চিহ্নিত করতে হবে । তাকে উৎখাত করতে হবে, যাতে এই জাতীয় পরিস্থিতি যেন আর সৃষ্টি না হয় । জানাতে হবে । জাগাতে হবে উত্তর প্রজন্মকে । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার উদ্বাস্তু কবিতায় আক্ষেপ করে বলেছেন–

            আমরা সবাই উদ্বাস্তু 
            কেউ উৎখাত ভিটেমাটি থেকে
             কেউ উৎখাত আদর্শ থেকে । ( উদ্বাস্তু-অচিন্ত‍্যকুমার সেনগুপ্ত )

আদর্শ থেকে উৎখাত হয়ে গেলে একটা জাতির আর কিছু থাকে না । আদর্শের ভিত্তিটাকে দৃঢ় করার জন্য, পারস্পরিক সম্প্রীতির বাতাবরণকে সুদৃঢ় করার জন্য, 'আজাদী কা অমৃত মহোৎসব'-এ দেশভাগের অভ্যন্তরে নিহিত তীব্র ধর্মীয় দ্বেষ নামক গরলটাকে মন্থন করে তুলে ফেলতে হবে । তাতেই রক্ষা হবে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব ।

No comments:

Post a Comment