Monday, February 27, 2023

ত্রিপুরারাজ্যের পুরাকাহিনি, রাজনৈতিক ইতিহাহ, ধর্ম, সংসকৃতি ও নৃত্যচর্চার ইতিহাস



ত্রিপুরা রাজ্যের পুরাকাহিনি, ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি নৃত্যচর্চার ইতিহাস

ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য হল ত্রিপুরা। এই রাজ্যের বর্তমান আযতন হল১০৪৯১'৬৯ বর্গ কিলোমিটার । ২০১১ সালের লোক গণনা অনুযায়ী ছিল মোট ৩৬ লক্ষ ৭১ হাজার ৩২ জন  । তারপর রাজ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে । লোকসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । ত্রিপুরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর আদিভূমি । প্রাচীনকাল থেকেই এরা এখানে বসবাস করে আসছে ১৯৪৯ সালে স্বাধীনোত্তরকালে ত্রিপুরা ভারতভুক্তির পরে এটি পৃথক প্রদেশরূপে স্বীকৃত হয় ত্রিপুরার মূল আদিবাসীদের ত্রিপুরী বা 'বরক' বলা হয় । ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সন্নিহিত অঞ্চল বা দেশ থেকে এরাজ্যে প্রবেশ করেছে দলে দলে অউপজাতীয় মানুষ । এর ফলে এখানে পরবর্তীকালে মিশ্র সংস্কৃতি বা কৃষ্টির সৃষ্টি হয় । ত্রিপুরা নামকরণের পশ্চাতে সত্যিই মিথ্যে মিলিয়ে নানা পৌরাণিক উপাখ্যান ও জনশ্রুতি রয়েছে । 

এ রাজ্যের ইতিবৃত্ত রাজমালায় উল্লেখিত হয়েছে যে, মহাভারতে বর্ণিত চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি ছিলেন প্রচণ্ড প্রতাপশালী শাসক । তার বংশে জন্ম নেয় দ্রুহ্য নামে এক মহাশক্তিশালী রাজা । তিনি রাজা হলেন কিরাত দেশের । দ্রুহ্য তার রাজ্যপাট আসামের ত্রিবেগ নামক স্থানে স্থাপন করেন । রাজমালায় আছে–

'ত্রিবেগস্থলেতে রুদ্র নগর করিল 
কপিল নদীর তীরে রাজ্যপাট ছিল' ।

ভারতের মানচিত্রে প্রাচীন ত্রিবেগ রাজ্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । প্রাচীনকালের ত্রিবেগ বর্তমান যুগে কি নাম ধারণ করেছে সে নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে এখনো মতভেদ আছে । সে যুগে ত্রিবেগের সীমানা ছিল পূর্বে মেখলি, পশ্চিমে কোচবঙ্গ, উত্তরে তৈরঙ্গ নদী এবং দক্ষিণে আচরঙ্গ । সংস্কৃত রাজমালায় আছে–
'যস্য  রাজস্য পূর্ব্বাস্যাং মেখলিঃ সীমতাং গতঃ ।
 পশ্চিমস্যাং কোচবঙ্গোদেশঃ সীমতি সুন্দরঃ । 
উত্তরে তৈরঙ্গ নদী সীমতাং যস্য সঙ্গতা ।
 আচরঙ্গ নাম রাজ্যে যস্য দক্ষিণ সীমতি । 
এতন্মধ্যে ত্রিবেকাখ্যাং দ্রুহ্য সুশাসিত ।

ত্রিবেগ রাজ্য আজ আর নেই । বহুকাল পূর্বেই তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে । সে সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ 'শ্রীহট্টের ইতিহাসে' লিখেছেন– "রুদ্র বংশের ত্রিপুর নামে এক নৃপতি কিরাত  ভূমে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেন । পার্শ্ববর্তী রাজাদের অপেক্ষা তিনি ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন । তাহার রাজধানী পূর্বকালে কামরূপের সন্নিকটে 'কোপিল' নদীর তীরে অবস্থিত ছিল । সে প্রাচীন রাজ্যের রাজধানীর নাম ত্রিবেগ । পরে কালের ক্ষয়ে এই নগরী বিলুপ্তি প্রাপ্ত হয়ে যায় । এবং কালক্রমে বর্তমান কাছাড় ও শ্রীহট্টের ভিন্ন ভিন্ন অংশে রাজধানী স্থাপিত হয় "

 পরবর্তীকালে এই ত্রিবেগেই ত্রিপুরা নামে পরিচিত হয় । দ্রুহ্যর পরে রাজা হন ত্রিপুর । তিনি ছিলেন এক প্রজাপীড়ক রাজা । কথিত আছে রাজা ত্রিপুরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রজাবর্গ দেবাদিদেব এর কাছে আকুল প্রার্থনা নিবেদন করলে স্বয়ং মহাদেব তার অমোঘ অস্ত্র ত্রিশূলের আঘাতে রাজা ত্রিপুরকে নিধন করে প্রজাগণকে রক্ষা করেন । বলা হয় এই ত্রিপুর রাজার নাম অনুসারে এই স্থানের নাম হয় 'ত্রিপুরা' ।  আবার কেউ কেউ মনে করেন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরেশ্বরী বা ত্রিপুরাসুন্দরীর আবাসভূমি বলে এই রাজ্যের নাম 'ত্রিপুরা' । প্রসঙ্গত, হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত ত্রিপুরার পুরাতন রাজধানী উদয়পুরে অবস্থিত ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে বা ত্রিপুরেশ্বরী মায়ের মন্দির দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ । এই পীঠস্থানে দেবীর ডান পায়ের গোড়ালি পড়েছিল বলে প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে । এটি ভারতের অন্যতম দেবীতীর্থ । 

যাইহোক, ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি সংক্রান্ত যে মতবাদ গুলি রয়েছে সেগুলি ঐতিহাসিক যুক্তি নির্ভর নয় বা ঐতিহাসিক সত্যতার অনুকূলে নয়। কেননা প্রাচীন রাজা ত্রিপুরার কাহিনি নিছকই পৌরাণিক ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করার মত কোন উৎস নেই । তাছাড়া অধিষ্ঠাত্রী দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর নামানুসারে এই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা এর স্বপক্ষে সত্যতা মেনে নেয়া যায় না । কারণ উদয়পুরে দেবী প্রতিষ্ঠিত হন ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে । এর অনেক পূর্বেই এই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা ছিল বলে তথ্য রয়েছে । তাহলে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তির বিষয়ে রাজমালা প্রণেতা প্রয়াত কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয় পূর্ববর্তী মতবাদের প্রতি সাড়া না দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন । তার মতানুসারে 'তুই' এবং 'প্রা' এই দুই শব্দ মিলে তৈরি হয় 'তুইপ্রা' । যার অর্থ–দুই জলধারা বা নদীর মিলনের স্থল । অতীতে কোন এক সময়ে ত্রিপুরার প্রাচীন কোন রাজা হয়তো মেঘনা বা ব্রহ্মপুত্র বা তার শাখা নদীর মোহনার তীরবর্তী জায়গায় রাজ্যপাট স্থাপন করেন । তাই সেই জায়গার নাম হয়েছিল 'তুইপ্রা' । এই 'তুইপ্রা' শব্দটি কালক্রমে রূপান্তরের পথে যথাক্রমে তুইপ্রা > তিপ্রা > ত্রিপুরা নামে পরিণত হয়ে যায় । কৈলাসচন্দ্র সিংহ মহাশয়ের এই মতবাদকে আজকের ইতিহাসকারগণ স্বীকার করেন । 
আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন মহোদয় তাঁর 'বৃহৎ বঙ্গ' গ্রন্থে লিখেছেন– "ভারতবর্ষে বর্তমান কালে যত রাজ্য বিদ্যমান আছে তাহাদের মধ্যে ত্রিপুরার রাজবংশই প্রাচীনতম । আদিকাল হইতে ১৮৪ পুরুষের নাম আর কোন বংশে একাধারে পাই না । এই বংশের আদিপুরুষ দ্রুহ্যু কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগনগরী স্থাপন করেন । লৌকিক বিশ্বাসে এই বংশ কিরাত বলিয়া অখ্যাত হইতেন । ত্রিপুরা রাজ্যের অনাচার ও অনার্য শ্রেণীতে বিবাহাদির জন্য এই বংশে কিরাতও ঢুকিয়া ছিল । এই কপিল আশ্রম 'সাগর' নামক স্থানে অবস্থিত ছিল । সাগর সন্নিহিত বিস্তৃত ভূখণ্ড পাঁচটি সমৃদ্ধ নগরী ও দুই লক্ষ লোকসহ ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে জলপ্লাবনে ডুবিয়া গিয়াছে ।"

ত্রিপুরী সম্প্রদায় ও রাজ্যের মূল আদিবাসী নয় বলে পরিগণিত  হলেও শুধু প্রাচীনকাল থেকে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সন্নিহিত অঞ্চল বা রাজ্যসমূহ থেকে এই রাজ্যের প্রবেশ করেছে । ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব ও  নৃবিজ্ঞানীগণ অভিমত প্রকাশ করে থাকেন যে, রাজ্যের সকল আদিবাসী সম্প্রদায়গোষ্ঠী সহস্রাবদের পূর্বে চীন দেশ পরিত্যাগ করে তীব্বত ও ব্রহ্মদের অতিক্রম করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে অনুপ্রবেশ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে । কালক্রমে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করে ত্রিপুরার আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত হয় । 

অতীত ত্রিপুরা আদিবাসীদের বাসভূমি হলেও বর্তমান ত্রিপুরারাজ্য মিশ্র জনগোষ্ঠীর বাসভূমি । দেশ স্বাধীন হওয়ার  আগে ও পরে বছরের পর বছর হিন্দু মুসলমানগণের সম্প্রদায়িক কলহের কারণে পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাতারে কাতারে হিন্দু জনগণ ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করার ফলে এখানকার আদিবাসীরা সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয় । তবে সুদূর ত্রিপুরা প্রাচীনকালেও, যখন এই রাজ্যের অধিবাসীরা সংখ্যাগুরু তদানীন্তন পূর্ববাংলার পূর্ব সীমান্ত সবটাই সবুজ বনানী ঘেরা অরণ্যকুন্তলার ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরা বর্তমানে উত্তর পূর্ব ভারতের সাত বোনের এক বোন । অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যের ( আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা ) অন্যতম হচ্ছে ত্রিপুরা । আয়তনের দিক থেকে ছোটো হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সে স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল এবং সারা ভারতেই বিশেষভাবে আলোচিত একটি নাম । 

তদানীন্তন ব্রিটিশ শাসনকালে ত্রিপুরার অবস্থান ছিল একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে ।  ইংরেজের বর্বর শাসন সমাপ্ত হওয়ার পর রাজন্য ত্রিপুরা ভারত ডোমিনিয়ন এ যোগ দেয় । ত্রিপুরা ভারতের সঙ্গে কার্যকরীভাবে যুক্ত হয় ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ সালে । সেইসঙ্গে অবসান ঘটে ৫ শতকের মানিক্য রাজবংশের ধারাবাহিক শাসনক্রম । ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ভারতের নিজস্ব সংবিধান রচিত হয় । এবং ত্রিপুরা সেসময় 'গ' শ্রেনিভুক্ত রাজ্য হিসেবে তার যাত্রা শুরু করে । ১৯৫৬ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের সংবিধানের সপ্তম সংশোধন করা হয় ।এই সংশোধনীতে ভারতের রাজ্যগুলির পুনর্ববিন্যাস ঘটানো হয় । নতুন পুনর্বিন্যাসে ত্রিপুরা রাজ্যকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় । ১৯৭১ সালে উত্তর-পূর্ব এলাকাসমূহ পুনর্গঠন আইন প্রবর্তন করা হয় ।এ আইন অনুসারে ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে 1972 সালের একুশে জানুয়ারি ।

রাজতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের পর লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মহাত্মার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ভারত ব্রিটিশের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে । এর ঠিক আগে ত্রিপুরার মহারাজা ছিলেন মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর । মহারাজা পরিকল্পনা করেছিলেন ত্রিপুরাকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্তির । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতের স্বাধীনতার প্রাক লগ্নে ১৯৪৭ সালের ১৭ মে রাত আটটা চল্লিশ মিনিটে মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর পরলোক গমন করেন ।  বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের মৃত্যুর পর যুবরাজ কিরীটবিক্রম রাজ্যের রাজা হবার অধিকারী হলেও নাবালক হেতু রাজা হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি । তখন ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহারানী কাঞ্চনপ্রভা দেবীকে সভাপতি বানিয়ে কাউন্সিল অফ রিজেন্সি গঠন করা হয় ত্রিপুরার শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ১৯৪৭ সালের ৮ই আগস্ট এই ঘোষণার দ্বারা কাউন্সিল অফ রিজেন্সি ত্রিপুরা শাসনভার গ্রহণ করে । উক্ত কাউন্সিল যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তারা হলেন
১) মহারানী কাঞ্চন প্রভা দেবী–সভাপতি ২) মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মণ–সদস্য
৩) মেজর বঙ্কিম বিহারী দেববর্মন–সদস্য
৪) সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়–সদস্য

ভারতের স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরার রাজতন্ত্রের সূর্য অস্তমিত হয় । ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নতুন দিল্লিতে ত্রিপুরার রিজেন্ট মহারানী কাঞ্চন প্রভা দেবী, তার নাবালক পুত্র কিরীটবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুরের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ত্রিপুরাকে ভারত সরকারের হাতে অর্পণ করে । এই সময় থেকে ত্রিপুরা ভারত সরকারের 'গ' শ্রেণি ভুক্ত রাজ্যের মর্যাদা পায় । মুখ্য প্রশাসক বা চিফ কমিশনার প্রশাসনিক পদে বৃত হন । ত্রিপুরার প্রথম চিফ কমিশনার পদে শ্রী রঞ্জিত কুমার রায় ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবর নিযুক্ত হন । প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর চিফ কমিশনারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, শ্রী সুখময় সেনগুপ্ত এবং জিতেন্দ্র দেববর্মা । ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠিত হয় । ফলে ত্রিপুরা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয় । ১৯৫৬ সালে নতুন করে আঞ্চলিক পরিষদীয় আইন অনুযায়ী ত্রিপুরায় আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয় । মোট ৩২ জন সদস্যবিশিষ্ট আঞ্চলিক পরিষদের দুজন সদস্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হয় । বাকি ৩০জন সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয় । ১৯৬৩ সালের মে মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে কেন্দ্রের অধীনস্থ আইন আঞ্চলিক আইন কার্যকরী হয় এবং আইন মোতাবেক সংবিধানের ২৩৯ ধারা বলে কেন্দ্রশাসিত রাজ্যসমূহের জন্য রাষ্ট্রপতি একজন প্রশাসক নিযুক্তির প্রচলন করেন ।

আঞ্চলিক আইন বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরায় আঞ্চলিক পরিষদীয় ব্যবস্থার অবসান হয় এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালের পয়লা জুলাই ত্রিপুরায় জনপ্রিয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয় শ্রীশচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে । গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও পরিবর্তিত হয় । এবং এই কাঠামো চলতে থাকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত । এইভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় ।

ত্রিপুরা রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের গণতান্ত্রিক আশা ও অধিকার কে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের পার্লামেন্ট আইন মোতাবেক ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের একুশে জানুয়ারি ত্রিপুরাকে পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয় । ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বিপুল ভোটে জয়ী হয় এবং সেই সুখময় সেনগুপ্তের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয় । ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের প্রথম রাজ্যপাল নিযুক্ত হন শ্রীযুক্ত ব্রজকুমার নেহেরু, আইএএস । এভাবে প্রাচীন রাজন্যশাসিত ত্রিপুরা একটি গণতান্ত্রিক পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা প্রাপ্ত হয় ।

সীমানা ও আয়তন

ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান একটি নির্জন দ্বীপের মত । প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেন পাকস্থলীর মত ঢুকে রয়েছে । কারণ উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এই তিন দিক দিয়ে বাংলাদেশ ত্রিপুরাকে ঘিরে রেখেছে । উত্তরে আসাম ও পূর্বে মিজোরাম রাজ্যের সামান্য কয়েক কিলোমিটার সীমানা ত্রিপুরাকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে । উত্তর পশ্চিমে আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার সঙ্গে ত্রিপুরার সীমানা মাত্র ৫৩ কিলোমিটার এবং পূর্বে মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে এর সীমানা মাত্র ১০৯ কিলোমিটার । প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে এর আন্তর্জাতিক সীমানা ৮৩৯ কিলোমিটার । বাংলাদেশের সিলেট জেলা কুমিল্লা জেলা পূর্ব দিক ঘিরে রেখেছে । ত্রিপুরার বর্তমান আয়তন ১০৪৯১ বর্গ কিলোমিটার । সর্বাধিক বিস্তৃতি ১৮৪ কিলোমিটার । ত্রিপুরা রাজ্য ২৪'৫৬ ও ২৪'৩ ২ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১'১০ ও ৯২'২১ পূর্ব দ্রাঘিমা রেখায় অবস্থিত । প্রসঙ্গত, উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৭ রাজ্যের মধ্যে ক্ষুদ্রতম রাজ্য এই ত্রিপুরা । 

নদ-নদী 

 ত্রিপুরা রাজ্যে অগণিত ছোট ছোট পাহাড়ি নদী দেখা যায় । নদীগুলি প্রধানত উত্তর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত উত্তরবাহিনী নদী গুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে খোয়াই, ধলাই, মনু,দেও,লঙ্গাই ও জুড়ি । দক্ষিণ বাহিনী নদী গুলির মধ্যে আছে মুহুরী ও ফেনী । এছাড়াও রয়েছে গোমতী, হাওড়া ইত্যাদি । পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোট বড় ছড়া ত্রিপুরা নদীকে স্রোতস্বিনী করে রেখেছে তবে সবগুলো নদী সারা বছর নৌ চলাচলের উপযোগী নয় । কারণ সব ঋতুতে জলসীমা সমান থাকে না । ত্রিপুরার প্রধান নদীর নাম গোমতী । এর দুটি উপনদী রয়েছে রাইমা ও সরমা । এ দুটির সঙ্গমস্থল হল দুচারিবাড়ি । ওখানে রাইমা ও সরমা এক হয়ে গোমতী নামে আত্মপ্রকাশ করেছে । তীর্থমুখের কাছে ডম্বুর জলপ্রপাত সৃষ্টি করে গোমতী সমভূমিতে নেমে এসেছে । প্রতিবছর মকর সংক্রান্তিতে তীর্থ মুখে বিরাট মেলা বসে । গোমতী ত্রিপুরার পবিত্র নদী । ওইদিন পূণ্যার্থীরা গোমতী নদীর জলে অবগাহন করে গঙ্গাস্নানের তৃপ্তি লাভ করে থাকেন । প্রসঙ্গত,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'বিসর্জন' নাটকে বর্ণিত উদয়পুরের ভুবনেশ্বরী মন্দির এই গোমতীর পাড়ে অবস্থিত । রাজর্ষি উপন্যাসে হাসি ও তাতা যে ঘাটের সোপানে রক্তের দাগ দেখে রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'এত রক্ত কেন ?' দুই ভাই বোনের কচি কচি হাত দিয়ে যে ঘাটের রক্তের দাগ মোছার চেষ্টা করেছিল সেই ঘাট বা সোপান এই গোমতীর তীরে অবস্থিত যার চিহ্ন আজও বর্তমান ।

পাহাড়-পর্বত

ত্রিপুরার ভূমিভাগ উঁচু-নিচু অগভীর এবং প্রশস্ত উপত্যকা সংকুল । তরঙ্গায়িত পাহাড়ের অভ্যন্তরে রয়েছে বালি পাথর আর এঁটেল স্তরিভূত মাটি । ত্রিপুরার প্রায় ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এই তরঙ্গায়িত পাহাড় শ্রেণী । আছে টিলাভূমি এবং অবশিষ্ট অংশে রয়েছে টিলা ভূমির পাদদেশ বা উর্বর নিম্নভূমি বা লুঙ্গাভূমি । আর আছে নদী উপত্যকায় অবস্থিত কিছু সমভূমি ।  ত্রিপুরার পাহাড়গুলি মূলত উত্তর দক্ষিণের প্রসারিত রয়েছে । এই পাহাড়শ্রেণীতে প্রধানত পাঁচটি রেঞ্জ আছে । পাহাড় শ্রেণীর গুলির মধ্যে প্রধান হল বড়মুড়া, আঠারো মুড়া, লংতরাই, জম্পুই এবং শাখানটাং । রাজ্যের উচ্চতম পাহাড় হচ্ছে জম্পুই রেঞ্জ । এর দৈর্ঘ্য ৭৪ কিলোমিটার । উচ্চতা ৯৩৯মিটার  । এই পাহাড়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম বেতলিং শিপ । দ্বিতীয় স্থানে আছে আঠারোমুড়া । এর দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার । এর উচ্চতম শৃঙ্গ হল জারিমুড়া এবং এর উচ্চতা ৪৮১মিটার ।

কৃষিজ, ও প্রাকৃতিক সম্পদ :-

উত্তরপূর্ব ভারতের কোলে তার ছোট্ট সন্তান । ত্রিপুরা কৃষিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ । পাহাড় পর্বতময় এই রাজ্যটির অধিকাংশ সবুজ বনানীতে ঘেরা ।এখানে সমতল ও পাহাড়ে জাতি-উপজাতি জনগোষ্ঠীর অনাদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে । ত্রিপুরার সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে জীবিকা নির্বাহের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ । এই সম্পদসমূহ ত্রিপুরার অধিবাসীদের প্রাণধারা কে সমৃদ্ধ করে রেখেছে ।

পার্বত্য ত্রিপুরার প্রায় ৬৯ শতাংশ বনাঞ্চল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ । ত্রিপুরার অধিবাসীরা কৃষি ও অরণ্য নির্ভর জীবনজীবিকা নির্বাহ করে থাকেন । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে বন বনানীতে, পাহাড়ে পর্বতে, নদ-নদীতে । বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আধুনিক ত্রিপুরায় গ্যাস ও তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে । মাটির নিচে প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে আছে এই খনিজ সম্পদসমূহ । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় । একটি হচ্ছে জৈব ও আন্যটি অজৈব । জৈব প্রাকৃতিক সম্পদ গুলি হল- বাঁশ, কাঠ, বিভিন্ন ধরনের পশু, পাখি ইত্যাদি । অজৈব প্রাকৃতিক সম্পদ হল খনিজতৈল ও প্রাকৃতিক গ্যাস । কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে চা ও রাবার ত্রিপুরার প্রধান শিল্পদ্রব্য । এছাড়া ত্রিপুরার মাটিতে গম, ধান, পাট, তিল, সরিষা, মেস্তা, আলু এবং বিভিন্ন ফল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় । ত্রিপুরার বনাঞ্চলে কড়ই,জাম, শাল, সেগুন, গামাই, জারুল, আউয়াল, কনক, গর্জন,চামল মেহগনি ইত্যাদি মূল্যবান গাছ পাওয়া যায় । এই গাছগুলির গৃহনির্মাণ, আসবাবপত্র, জ্বালানি কাঠ, এবং পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করে । ত্রিপুরার অরণ্যে নানারকম ভেষজ গাছগাছালিও রয়েছে । ত্রিপুরার বাঁশ বেতের কুটির শিল্প দেশ-বিদেশে সমাদৃত । ত্রিপুরার বাঁশ বেত দিয়ে তৈরি হয় সৌখিন আসবাবপত্র, আইসক্রিমের কাঠি, টুকরি,ধারী, ধূপকাঠির শলাকা, খেলনা, মোড়া, ঘরের বেড়া, ঘরের খুঁটি ইত্যাদি । এগুলো ত্রিপুরার অর্থকরী ফসল । ত্রিপুরার বন্যপ্রাণীর মধ্যে হাতি, নেকড়ে, হরিণ, শূকর, ভাল্লুক, চিতাবাঘ বনমোষ, শিয়াল, সজারু, বন বিড়াল, রামছাগল, বাইসন, বনরুই, বানর, হনুমান  বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ত্রিপুরার বনাঞ্চলে টিয়া, কাকাতুয়া, ধনেশ, ময়না, ফিঙে, কবুতর, ডাহুক, হাঁস, মোরগ, চিল, শকুন, সারস,বুলবুল, বাবুই,  চড়াই ইত্যাদি নানা রকমের পাখি দেখতে পাওয়া যায় । ত্রিপুরায় প্রচুর দিঘি, নদনদী, জলাশয় ও হ্রদ রয়েছে । এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় ।

No comments:

Post a Comment