Monday, October 23, 2023

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

'মাস্তুলে মেঘের পতাকা'  অনিশ্চয়চেতনার প্রতীকী নির্মান

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জীবন ও নদী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত । জীবনের সঙ্গে নদীর তুলনা, নদী জীবনের উপমা একটি সাধারন আলংকারিক বিষয় । কাব্যেও নদী ও জীবনকে পাশাপাশি চলতে লক্ষ্য করা যায় । নদীর যেমন রয়েছে নাব্যতা তেমনি জীবনের রয়েছে চলিষ্ণুতা । নদীর গতির পক্ষে চলে যে জলযান সে শুধু ভাটির দেশ আর মোহনার গতিপথ চেনে । গন্তব্য তার নির্ধারিত । সে জলযান উজান চেনেনা । পার্বত্য জলঘূর্ণি তার অজানা । সংঘাত সংকুল নদীর বিপরীতের চলনলড়াইয়ের  অভিজ্ঞতা তার থাকে না । জীবন ও তেমনি অভিজ্ঞতাময় ।

"আমার দাদু বলতেন নদীর পাড়ে এই শীতে 
কচ্ছপের মতো হয়ে যারা পড়ে আছে
 তারা একেক জন আহত সৈনিক
 অনেক ঝড় জলে ডোবা ভাষার দুঃসাহসের উপকথা 
তারা জানে
 তাদের কাছে এখনো মানুষের প্রথমদিনের
তরঙ্গলিপির মগ্ন চিরকুট রয়েছে 
তারাই প্রথম কলসি-কাঁখে মেয়েদের গান শুনেছিল 
বৌ-ঝিদের নাইয়র নিয়ে তারাই গিয়েছিল 
বিল পেরিয়ে দূর কোনো গ্রামে
 আকাশের দুরন্ত মেঘ তারাই প্রথম বশ
 মানিয়ে তাদের মাস্তুলে বেঁধেছিল
 ওই যে শঙ্খচিল তাদের ইঙ্গিতেই ঘুরপাক খায় 
আর জলের উপর শুকনো মাছের আঁশটে গন্ধ ছড়ায়" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

 গড়পড়টা জীবনের মত একঘেয়ে গতিতে চললে জীবনের বৈচিত্র্য আসে না । জন্ম, বেড়ে ওঠা, আহার, নিদ্রা, মৈথুন আর মৃত্যুর গৎ বাঁধা নিয়মেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । জীবনের দুঃসহ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের অভিজ্ঞতায় বাঁচতে চাইলে চলমান প্রবাহের বিপরীতে পা বাড়াতে হবে । সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বিপরীত অভিযাত্রায় গড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবনকে । চেতনার ভেতর জাগিয়ে তুলতে হবে সেই বোধব্রহ্ম । কবির কবিতার শরীরের চিত্রকল্পে আসবে সে অনুষঙ্গ । উপমায় আসবে তেমনি সুদৃঢ় বেস্টনী ।

বিপরীত বহমানতার জন্যে, হাওয়ার পক্ষে চলার জন্যে, সংক্ষুব্ধ স্রোতের প্রতিকূলে চলার জন্য নৌকার থাকে শক্ত খুঁটি । তার নাম মাস্তুল । সেই মাস্তুলে পাল খাটানো হয়ে থাকে স্রোতের অনুকূলে বা প্রতিকূলে হাওয়া প্রবাহিত হলে মাস্তুলে বাঁধা পাল হাওয়ার চাপে নৌকাকে  নির্ধারিত পথেই তরতরিয়ে নিয়ে যায় । অনুকূলের পথ তো ভবিতব্য । তার মধ্যে কোন বৈচিত্র থাকে না । আর স্রোতের বিপরীতে যখন নৌযান চালানো হয় তখন বিপরীতমুখী স্রোতের বেগের সঙ্গে বিপরীত হাওয়া থাকলে মাস্তুলে বাঁধা পাল নৌকার সংঘাতশক্তিকে অনেকটা সহায়তা করে । নৌকাকে বিপরীত প্রবাহমানতার সংঘাতশক্তি যোগায় প্রকৃতিনির্ভর বায়ু প্রবাহ । অনুকূল হলে পালের শক্তি প্রকাশ পায়। মানব যাপনের সংঘাতেও সংহতির চেতনার দ্যোতক হল গতিমান বায়ুপ্রবাহ । বায়ুপ্রবাহ নৌযানের যে কাজটি করে মানবের সংহতিচেতনাও তেমনি গতানুগতিকতার বিপরীতে প্রতিবাদমুখর করে নদীর বুকে পালখাটা নৌকা আর প্রবহমান জীবনের বুকে মানুষের সংহতিচেতনা সমস্ত অশুভের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় । সে জায়গায় কবি যখন তাঁর কবিতার বা কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম দেন 'মাস্তুলে মেঘের পতাকা' তখনই থমকে যেতে হয় পাঠককে ।

''আকাশের ওই সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে
 আমি চেয়েছিলাম গোলুইয়ের ঢেউয়ের শব্দ শুনি
 ঢেউগুলো নৌকার তলপেট ছুঁয়ে সরে যাচ্ছে 
আর নৌকা সেই ঢেউ ভেঙে ভেঙে
 ঢেউয়ের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে 
কাঞ্চন মালার দেশে পাড়ি জমাচ্ছে" ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) ।

যে কাজ করবে মাস্তুলের মাথায় বাঁধা পতাকার মতো পাল সে জায়গায় নিশ্চিন্ত পালের বদলে মেঘকে বেঁধে দিলে কি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে ? কাব্যনাম কেমন যেন এক বিরোধাভাসের সৃষ্টি করে এখানে । মেঘ তো পালের মতো দৃঢ় দৃশ্যমান নয় । এক ধোঁয়াশার উপর তার কাল্পনিক উপস্থিতি তাছাড়া মেঘকে বেঁধে রাখা যায় না । তার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ও নিশ্চিন্ত নয় । কবি নিজেও তার এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই এই অনিশ্চয়তার কথা পরপর দুবার উল্লেখ করেছেন—
ক) কেন জানি কাল রাতে 
      একটিও মেঘ আসেনি । এবং
খ) সারারাত জেগে ছিল সে 
    তবু একটি ও মেঘ নামেনি । ( মেঘ শিকার ) ।
আবার কবি বলছেন–
 "আমার পূর্বপুরুষের বিয়ে হয়েছিল কোন এক নদীর সাথে 
সেই নদীর সন্তানেরাই মাস্তুলে মেঘের পতাকা উড়িয়েছিল 
তারাই দূর দ্বীপের ঘাটে ঋতুমতী মেয়েদের 
আয়ত চোখের কোলে প্রেমের কাজল এঁকেছিল
 নদীর জলে তাদের গান আজও 
মনসার করণ্ডি মতো ভাসে 
নদীর ভিজে বাতাস এখনও তাদের
 গায়ের ঘাম মুছিয়ে দেয়"

কবি দিলীপ দাসের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থে "মাস্তুলে মেঘের পতাকা"র অভ্যন্তরবাসী চব্বিশটি কবিতায় কোনো না কোনো ভাবে এই অনিশ্চয়তার চেতনা দ্বন্দ্বমুখর হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে । অনিশ্চিত জীবনকে বয়ে বয়ে কবির চেতনায় জন্ম নিয়েছে অতৃপ্তির অসহায়তা—
"আমি শ্যাওলার জীবন চাইনি কখনো
 ঝড়ের মুখে হাল ভাঙা নৌকা হলে
 অনুতাপ হতো না কোন পাথরে ছোবল মেরে 
বিচূর্ণ হবার সাধ সারা জীবন অপূর্ণ রয়ে গেল—"( ভুল করে বড়ো আগে চলে এসেছি ) । 
তিনি লক্ষ্য করেছেন–
 "সৃজন ও ধ্বংসের সময়টুকু উন্মাদ
 নদীর মতো । আর তালডোঙার মধ্যবর্তী ছায়ার
নির্জীব কাল শুধু হিজড়ের জীবনযাপন
 শুধু পত্রহীন ডালে বসে কামার্ত কূজন" ( ওই ) ।

কবির মানসদ্বন্দ্বের বীজ নিহিত রয়েছে পূর্বপুরুষের চিরকালীন নদীসংসার ছেড়ে, ভদ্রাসন ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দেওয়া জীবনের যন্ত্রণায়, দেশভাগের যন্ত্রণায় । দেশভাগ, বঙ্গবিভাজন বহু মানুষের জীবনকে উথাল-পাতাল করে দিয়েছে । উৎখাত করে দিয়েছে চিরায়ত শেকড় থেকে । এই বেদনা তিনি জানান আরেক বিখ্যাত জীবনকে, অগ্রজ কবি অনিল সরকারকে—
বিক্ষুব্ধ বেদনায় তার বুক 
ভাঙা নৌকার মতো উপুড়
 হয়ে আছে । হৃদয় ভরে আছে দ্রব
 অভিমানে । তবু এই অভিমানের গভীরে
 এক টলটলে জলের পুকুর 
নিজের দুঃখের দরজায় কড়া নাড়ে
 অমাবস্যার ভোর— ( অমাবস্যার ভোর )  ।
দেশভাগ নিয়ে কবির অনুভব–
" তুমি আমায় দিয়েছ
 শ্যাওলার ভাসমান জল 
উদ্বাস্তু জীবন 
আর প্রত্যহের শেকড়হীনতার 
জীর্ণ রামধনু ।
তুমি দিয়েছ এক খঞ্জ পিঞ্জরের
 আকাশ ঝরোকা 
কাঁটাতারে ঝরে যাওয়া দ্বিখন্ড দুপুর ( স্বাধীনতা–৫০ ) ।
দেশভাগের পরিস্থিতিতে কবি সংক্ষুব্ধ । ক্ষোভ ও অভিমানে কবি এই পরিণতিকে ইঙ্গিত করে বলেন—
" তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই
 তুই নিয়েছিস তুই 

তুই নিয়েছিস কলমি দাম বিলের পানকৌড়ি 
শুশুকভাসা বিকেল আর ভাটিয়ালি সারী 

তুই নিয়েছিস মেঘনা তিতাস দত্তখলার চর 
সহজ সুখ সহজ জীবন গান শালিখের ঘর 

তুই নিয়েছিস তুই 
আমার নদী শাপলা বিল সরষে হলুদ ভুঁই ( তুই নিয়েছিস ) ।
ভিটেছাড়া, ছন্নছাড়া কবি অনেক প্রত্যাশা নিয়েএক নতুন স্বাধীন দেশে এসে প্রতারিতই হয়েছেন শুধু । যে স্বপ্ন জন্মেছিল স্বাধীন দেশকে নিয়ে তাঁর বুকের ভেতর, সেটা তাঁর কাছে ' মনে হয় এ শুধু কথার খেলাপ' । যে—
 "কথা ছিল ল্যাম্পপোস্টগুলো হবে হাওলার ফাঁসির খুঁটি 
গডম্যানরা সব যাবে জেলখানায় 
ইঁদুরের গর্তে আর জমবে না বেনামী ফসল 
কথা ছিল সব চাষা ভুমি পাবে সব জেলে জাল
 মজুরের হাতে রবে কারখানার রশি
 ভিখারি উধাও হবে রাজপথ থেকে,
 কোনদিন আসবেনা গেস্টাপোর সকাল
 মসজিদের আযান হবে মন্দিরের ঝকঝকে চূড়ো" (প্রতারণার পঞ্চাশ বছর ) । "সব কথা আজ নেড়ি কুকুরের মত রাস্তায় গড়ায়" । আর স্বাধীনোত্তর দেশে–
"বিখ্যাত খুনিদের জন্য সবাই জানে
 ফাঁসির দড়ি তৈরি হয় না । এ অহিংসার দেশে তাদের জন্য রাজকীয় উপঢৌকন— অশোক চক্রের মেহগনি চেয়ার —
 তাদের জন্য বাতাসে উড়ে নিলামবালা ছ'আনা ভোটের টিকিট 
পত্রিকার পাতায় উছলে উঠে কামাতুর উচ্ছ্বাস
 স্বাধীনতা দিবসে তাদের জন্যই মখমল তাকিয়া" ( খুনীর হাত ) ।

দেশজুড়ে ধান্দাবাজ সুযোগসন্ধানীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে দখল নিতে চায় সমস্ত সম্পদের । এরা শামুকের মতো ।
"শামুকেরা সব খায় 
আইনস্টাইনের মজ্জা খায় 
ইতিহাসের পাতা খায়,
 মানুষের উত্থান খায়, মেধার উজ্জ্বল খায় 
রঁদার ভাস্কর্যে কাদামাখা হাত বাড়ায়
 ব্রেখটের বই পোড়ায় 

শামুকেরা যেদিকে যায় পেছনে পুরাণ-শাণিত দাঁতের অন্ধ চিহ্ন 
ঘাসের পোড়া বুকে একে যায় ( শামুক ) ।
আর এদের হাতে নিহত হয় আমাদের অন্নদাতা, সভ্যতার সঞ্চালক কৃষকেরা ।
 "পাঁচ হাজার বছর ধরে আমাদের অন্নের রক্ষক
 যাদের রক্তের ফোঁটায় ভরে ওঠে শস্যের গোলা 
নিখিল মানব শিশু যার স্নেহের কাঙাল
 তাকে কাল খুন করা হয়েছে—

সসাগরা পৃথিবীর মুখে যিনি ভাত তুলে দেন 
সেই অন্নের রক্ষক 
হাজার আলোয় উদ্ভাসিত এ দেশের এক করুণ অন্ধকারে 
কাল একগাছা দড়িতে নিজেকেই খুন করেছেন" ( অন্নের রক্ষক ) । জীবনানন্দীয় শব্দবন্ধে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেন কবি এই অসহায়তায় । 
এখন শুধু ক্ষমতাধর এর দাপাদাপি বীরভোগ্যা বসুন্ধরার মত ক্ষমতার কাছাকাছি যারা পৌঁছতে পারে তারাই জীবনের সব সুখ এবং সম্পদের অধিকারী । আজ 'ক্ষমতার প্রকাশ আকাশে বাতাসে অন্তরীক্ষে' । কবির দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অন্তরাত্মা তাই আওয়াজ তোলেন—
"বৎস শোনো, ক্ষমতা মানুষের শুভ্র হৃদয়ে 
দুরারোগ্য ক্ষতির মতো । ক্ষমতা
 সেই দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম 
যার কাছে কোন নিরীহ মনুষ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারে না । কিন্তু এই 
ঘামের কাছে লেপ্টে থাকে উন্নাসিক,
 ক্ষমতা এবং অ-ক্ষমতার মাঝে নির্জীব থাকে অতি সাধারণ,
 আর ক্ষমতাহীন কিন্তু ক্ষমতার লুব্ধরা হয় রাজনীতিক । 
ক্ষমতা অর্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী 
কিন্তু ক্ষমতা লিপ্সু অর্থ-দাস ( ক্ষমতা বিষয়ে দু চার পংক্তি ) । এই যে ক্ষমতার লোভ ও তার পরিণতিতে অস্ত্রের ঝংকার ও নিরীহ মানুষের নির্যাতন অসহায়তা শুধু এদেশেই নয় সারা পৃথিবী জুড়েই এই অবস্থা চলছে । ক্ষমতার কারণে যুদ্ধ ও সংঘাত এবং তার ফলশ্রুতিতে নিরীহ মানুষের বাস্তুচ্যুত পরিযায়ণ, উদ্বাস্ত জীবন কবি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন । উদ্বাস্তুযন্ত্রণা সে কারণেই তাঁর অন্তরের অনুভূতি। এই অনিশ্চিত জীবন সম্বন্ধে তাঁর সংক্ষোভবিধুর আর্তি । সে কারণেই কখনো নির্ভরতার পাল হয়ে যায় ধোঁয়াশাময় মেঘের মতন । নিশ্চয়তা থেকে অনিশ্চিত জীবনের পটপরিবর্তনের সংশয়াকুল যাত্রা । সে কারণেই অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন পেরিয়ে নিশ্চিন্তে অবস্থানের আর্তি—
আমি আর কোথাও যাবো না ।
বনের আলু খেয়ে যারা এখানে বাঁচে
 তারা তো আমাকে যেতে বলে না 
ব্যাধের ভয়ে আমি কেন পালাবো ?

আমি এখানেই থাকবো ।
এই টিলা-লুঙ্গা-ছড়ার কিনারে 
বয়ে যাওয়া ছোট নদীটির মত তিরতির
 যদি পারি খরার দিনগুলোতে 
এক অঞ্জলি তৃষ্ণার জল দিয়ে যাবো—
 সেইসব ভূমিপুত্রদের বলে দাও 
সেইসব ব্যাধ আর খোঁয়াড় ব্যবসায়ীদের বলে দাও 
আমি এখানেই থাকবো—
 এই ছড়া–এই টিলা–এই লুঙ্গা–এই বাঁশবন 
আমায় যতদিন না ছাড়ে 

যারা যেতে চায় তারা চলে যাক ।
আমি আর কোথাও যাবো না ( উদ্বাস্তু সংলাপ ) ।

নতুন দেশে নতুন জীবনকে অতি আপনার করে নিতে চান কবি ।তার পরেও অতিবাহিত জীবনের মাঝে ফ্ল্যাশব্যাকের মত হাজির হয় অতীত জীবনের কথা । অতীত ভূখণ্ডের কথা । যে ভূমিতে কবি বেড়ে উঠেছেন । কবির আলোকদর্শন ঘটেছে সেই বাংলাদেশের কথা ।
 "দরগারঘাট পেরোলেই মাশাউড়ার মঠ
 আদিগন্ত জলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্ন স্বদেশ
 তার পাশে দূরদর্শী এক তালগাছ
 সারাদিন নিজের ছায়ায় 
খুঁজে মরে স্মৃতির অতল প্রদেশ ।

 এইখানে একদিন বিলের চিকন রোদে
 পুটি মাছের পাখনা ঝিকমিক রুপো ছড়াত
 তখনও চালের কেজি কুড়ি টাকা নয়
 জীবন শাঁসহীন শামুকের 
খোলের মতো তখন ভাসমান ছিল না
 তখনও শুয়োরের বুনো চিতকার এমন উৎকট ছিল না, যুবতী রোদ্দুর গিলে খায়নি রাতের শামুক 

সেই সব অপাংশু দিনের কথা
 আমি যখন বলি আমার তরুণ বন্ধুরা, যাদের বয়স খুব বেশি নয় 
চোখে নিষ্পৃহ উদাসীন রেখে 
আমাকে দ্যাখে 
যেন নস্টালজিক এক বুড়ো বটগাছ । এমনতো 
ছিল না আমার জন্মভূমি ? 'উদ্ভট উটের পিঠে' কোথায় চলেছ তুমি ?" ( বাংলাদেশ- ৯৫ ) ।
 অতীতের স্মৃতিভরা প্রিয় দেশের অস্থিরতায় তিনি চঞ্চল হয়ে ওঠেন । প্রশ্ন তোলেন —"
একটা যুদ্ধ যদি তিরিশ লাখ মানুষের
 রক্ত ও শেষ না হয় তাহলে আরো 
কত লাখ মানুষের রক্ত চাই 
বলতে পারেন শামসুর ভাই ?" ( ঐ ) ।

আসলে জীবনের পরতে পরতে ঘাত প্রতিঘাত সংঘাত পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কারণে কবির বোধের ভেতর গভীর আলোড়ন তোলে । আর সে আলোড়ন থেকেই সৃষ্টি হয় মননদ্বন্দ্বের । দ্বান্দ্বিক জীবনে তাই দৃঢ় সংহত পাল হয়ে যায় পলকা, অস্থায়ী আর অস্পষ্ট মেঘের প্রতীকে । এই অস্পষ্টতার মধ্যেও কবির মনে আশার অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়—
"আকাশে যারা সাদা পাল তুলেছে 
আমি তাদের কথা আর কতটুকু জানি
 আমি এক নদীহীন মানুষ—
 পরম্পরাহীন এক অপটু নাবিক 
তবুও আমি চেয়েছিলাম 
আকাশের সাদা মেঘগুলো মাস্তুলে জুড়ে দিয়ে 
গলিয়ে ঢেউয়ের শব্দ শুনি— ( মাস্তুলে মেঘের পতাকা ) । এই ঢেউয়ের শব্দ আসলে জীবনের শব্দ । জীবনের বৃন্দগান । মাস্তুলের মেঘ সেই সঙ্গীতকেই বয়ে নিয়ে যাবে বলে কবি বিশ্বাস করেন ।

No comments:

Post a Comment