জ্যোতির্ময় শিবের থানে অশোকপুষ্পের অঞ্জলি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আমার বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে ও পরবর্তীতে আমারও পেশাগত কারণে স্থানান্তরের অভিজ্ঞতা ও বহু বেদনাবিধুর স্মৃতিভার রয়েছে । স্বল্পকালীন হলেও সাময়িক বাসভূমিকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয় । স্থানিক প্রকৃতি ও মানুষজনকে স্বজন ও সুজন মনে হয় । সেইখানের প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে, মানুষের সাথে মিশলে, তাঁরাও বেঁধে নেন আত্মিক বন্ধনে । প্রস্থানবেদনায় সকলেরই পরান পোড়ে স্যর । আপনার মতো আমরাও বেদনাতুর । আপনার বেদনার বিনিময়ে আমরা আমাদের বেদনাকেই ফিরিয়ে দিতে পারি আমরা । আর আমি শুধু বেদনা নয় মধুময় স্মৃতির মৌচাক বয়ে বেড়াব বুকের ভেতর যতদিন বসুমাতার বুকে আছি । আমাকে দেখলেই আপনার সেই মায়াভরা চাহনি আর সমস্ত প্রটোকল ভেঙে বুকে জড়িয়ে ধরা, আলিঙ্গন করা আমার বিরলতম প্রাপ্তি । সন্তানসম হয়েও পিতার নিরাপত্তায় যেন আমাকে বেষ্টন করে রেখেছিলেন আপনি । আমার জীবনে দেশে ও বিদেশে বহু সম্মান ও বহু পুরস্কার আমি পেয়েছি । কিন্তু নিজের মাটিতে নিজের শহরে সরকারিস্তরে মহকুমা প্রশাসন আয়োজিত দুহাজার চব্বিশ সালের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মাঠভর্তি মানুষের সামনে বিরল সম্মানটি আপনিই আমার হাতে তুলে দিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন ।
মনে পড়ে, দুবছর আগে বন্যায় যখন আমার ভদ্রাসনটিসহ আমার গ্রাম ছোটখিল জলের তলায় ডুবে যাচ্ছিল, সেসময়, আমি মাঝরাতে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়েছিলাম দাসপাড়ায় বাঁধের উপর কজন মানুষ আটকে আছেন । আপনি দ্রুত ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নৌকা পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করে প্রিয়জনদের কাছে শিবিরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন । আর্তজীবনরক্ষায় আপনার সেদিনগুলোর অনিদ্র ভূমিকার কথা আর কজনই বা জানেন ।
সাব্রুমের ধর্মপ্রাণ মানুষের পীঠভূমি দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের উন্নয়নে, রাজ্যের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক মানচিত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে দেওয়ায় আপনার ভূমিকা অপরিসীম। মাতা দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সুপ্রাচীনতার প্রামান্য ইতিহাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আমার গবেষণাপত্রটি আপনি ভাষান্তর করে যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নজরে এনেছেন । যার সুফলেই আজ দৈত্যশ্বরী মন্দির রাজ্যের এক বিশিষ্ট ঐতিহ্যঅঙ্গন । শিব তাঁর তৃতীয় নয়নের জ্যোতিপ্রবাহে যে কর্মকান্ডের সুরুয়াত করে গেলেন তা আগামীদিনে বহধাবিস্তৃত হবে । বহুবছর আগে এই মহকুমার আরেকজন সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মানিক গাঙ্গুলি এ মন্দিরের প্রাথমিক সংস্কারের কাজটি করেছিলেন । আর এই প্রজন্মের নবীন প্রতিনিধি আপনি এই মন্দিরের উন্নয়নের সিঁড়িটা মজবুত করে দিয়ে গেলেন । ইতিহাস ও ঐতিহ্য এভাবেই ফিরে ফিরে আসে।
সাব্রুমের ঐতিহ্যবাহী বৈশাখীমেলা, এই জনপদের মানুষের প্রাণের মেলাকে আপনি নবনান্দনিক রূপদান করলেন আপনি । কবিসম্মেলন, চিত্রাংকন সমারোহ, স্মরণিকা 'শ্রীচরণেষু'র প্রকাশ ইত্যাদি শুভকর্মযজ্ঞ সারা ত্রিপুরার নন্দনচর্চার মানুষমানুষীদের এক মঞ্চে এক মহামিলনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । 'শ্রীচরণেষু' আসলে দেবী দৈত্যেশ্বরী মায়ের শ্রীচরণে ও গণদেবতার ওই আসনতলে মাটির পরে আপনার ও আমাদের সম্মিলিত প্রণাম ।
আপনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। আপনি একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী । ফটোগ্রাফিতেও আপনার নান্দনিক দৃষ্টির প্রকাশ ঘটান আপনি । আপনি ধুলোমুঠি ধরলে সোনামুঠি হয়ে ওঠে । আপনার নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে আপনার প্রশাসনিকসহ নানাবিধ কর্মবিস্তৃতির যেটুকু জেনেছি তা বিশাল হিমশৈলের অগ্রভাগ মাত্র । আপনাকে জানা আমাদের ফুরাবে না ।
আপনার এগিয়ে যাবার বেলায় আর পিছুডাক নয় । বরং শাঁখ বাজিয়ে জানিয়ে দেব এই শঙ্খধ্বনির মতো বিশাল আমাদের সম্মিলিত হৃদয় জুড়ে আপনি আছেন । থাকবেন আরো বহুদিন । আপনার কর্মময় জীবন আরো বিস্তৃত হোক । আপনার লেখনী, আপনার শিল্পীসত্তা আরো আরো গতিশীল হোক স্রোতস্বিনীর মতো জীবনের বাঁকে বাঁকে। নতুন কর্মস্থল ও আপনার আপন ঠিকানা হয়ে উঠুক ।আপনি আগের মতোই সাব্রুমবাসী কারো বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবেন এই আশা রাখি । আপনার দীর্ঘজীবন, সুস্বাস্থ্য ও সার্বিক কুশল কামনা করি ।❤️
No comments:
Post a Comment