Thursday, September 6, 2018

শিক্ষক হতে চেয়ে এই পেশায় এসেছিলাম ৷ একজন নিষ্ঠ শিক্ষার্থীও হতে পারলামনা ৷ গত শতাব্দীর আটাত্তর সালে মালিগাঁওয়ে জয়েন করার আহ্বান এসেছিল সহকারি স্টেশন মাস্টার হিসেবে ৷ ঘরকুনো স্বভাব আর পড়াশুনোর প্রতি আগ্রহ আর আদর্শের প্রতি আনুগত্যে বিদ্যালয় শিক্ষকতায় এলাম ৷ দেখলাম যে বিদ্যা আর জ্ঞান নিয়ে এ পেশায় এসেছি অনেক শিক্ষার্থী আমার চেয়ে অনেক বেশিই জানে ৷ আর সহকর্মী শিক্ষক শিক্ষিকাগণ তো যার যার বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী৷ দিকপাল সব ৷আমি তো 'হংসমধ্যে বকযথা' ৷ জ্ঞানবিদ্যার দুর্বলতায় কুঁকড়ে যাই প্রতিদিন ৷ শ্রেণিকক্ষে রোজ যাই ৷ ডায়াসে গিয়ে দাঁড়াই ৷ আক্ষরিক একটা ব্যবধান তৈরি হয় ছাত্রশিক্ষকের সত্যি ৷ কিন্তু আমি মনশ্চক্ষে দেখি নিজেকে ওই শিক্ষার্থীদের পেছনের সারিতে ৷ হ্যাঁ, ভাবলাম আমার পেশাগত উৎকর্ষতা আনতে হলে আমাকেও শিক্ষার্থী হতে হবে ৷ হয়ে গেলাম শিক্ষার্থী ৷ প্রতিদিন আমি নিয়ম করে বাধ্য ছাত্রের মতো বইয়ের সান্নিধ্যে থাকতাম ৷ ছাত্রছাত্রীদের ভালো পাঠ দেওয়ার জন্যে থাকত আমার প্রস্তুতি ৷ প্রতিদিন ক্লাসের শেষে নিজেকে প্রশ্ন করতাম, দিনের সেরা পাঠটা দিতে পারলাম তো? সত্যি কথা তৃপ্তি কোনোদিনই আসতনা ৷ লাজুক প্রকৃতির কম কথা বলা মানুষটা কীভাবে আকর্ষক বাচনভঙ্গী আয়ত্ব করব ৷ বারান্দায় পায়চারী করে উৎকর্ণ হয়ে শুনতাম অগ্রজ শিক্ষকদের পাঠদান ৷ অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম তাঁদের কৌশল ৷ সবার গুণগুলোকে ফুলের মতো আহরণ করে মালা গেঁথে গলায় পরে আমি নকল গুরুদেব শুধু করেই খেয়েছি গোটাজীবন ৷ পেশায় দক্ষতা আনার জন্যে যেই গুরুদের একলব্যের মতো অনুকরণ করেছি আড়ালে সেই গুরুদের প্রণাম ৷ গুরুগিরির অভিনয়ে কোন ফাঁক রাখিনি ৷ আর এখানে সফল তার প্রমান পেলাম গতকাল ৷ সকাল থেকে অজস্র ফোন, মেসেজে শুভেচ্ছা, স্টিকার ৷ কাছের ৷ দূরের ৷ দূরান্তের ৷ সবাই আমার ছাত্র কিংবা ছাত্রী ৷ 'আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি'৷ ওদের কীকরে বোঝাই আদতে 'সবার আমি ছাত্র' ৷ আমি তোমাদের কাছ থেকে অনেক নিয়েছি আমি ৷ তোমরা 'গ্রহণ যত করেছ ঋণী তত করেছ আমায়' ৷ পেশাগত দিক থেকে সরকারি বিদায়পত্র পেলেও যেন আমার রেহাই নেই ৷ ভাবছিলাম বেলা তো পড়ে এল ৷ একটু ঘুরেটুরে বাকি দিনগুলো গুজরান করে দেব ৷ চলছিলও তেমনটা ৷ চক্কর দেওয়া শুরু করেছিলাম ৷ পেশার নেশায় মত্ত দিনগুলোতে সহধর্মিনীকে নিয়ে একসঙ্গে বেরুইনি একদিনও ৷ লজ্জায় ৷ ছোট্ট জায়গা ৷ সবাই সবার পরিচিত ৷ অনেকে গ্রামীন সরল রসিকতাও করেন সম্পর্কের অশ্লীলতা মিশিয়ে ৷ একটা উদাহরণ দিচ্ছি ৷ বিয়ের পরপরই নববধূকে নিয়ে এক প্রতিবেশির বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় যাচ্ছি ৷ ঠা ঠা দুপুর ৷ গাঁয়ের বটগাছের তলায় বিশ্রাম করছেন মনমোহন কাকা ৷ আরো কয়েকজন ৷ পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় মনমোহন কাকা বলে উঠলেন, কিআ রেবা ৷ তোঁয়ার মারে লই কনডে য'র? উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল ৷ বলে কি রে এ ব্যাটা ! চোখে দেখতে পায়না? আমি এমন বেকায়দায় পড়িনি কখনও ৷ একে গরম ৷ তার মধ্যে লজ্জায় আমার চোখ -মুখ-কান দিয়ে গরম ভাপ ছুটছে ৷ জবাব দেব না ঝগড়া করব ৷ মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করলেন আমার সঙ্গের ভদ্রমহিলা ৷ তাঁর চটপট জবাব, আন্নের মারে এনা লই যার ৷ এই এনা ৷ আক্কল ওক ৷ আর কইবানি? যারা এতক্ষণ আদি রসিকতায় হেসেছিল তারাই একযোগে মনমোহন কাকাকে ইঙ্গিত করল ৷এই সমাধানে আমি রীতিমতো চমকে যাই ৷ মনে মনে ভাবি, জীবনে একজন শক্ত বডিগার্ড পেয়েছি ৷ সেই থেকে আমরা দুজন নিজের এলাকায় খুব একটা একসঙ্গে বেরুতামনা ৷ বেরুলেও একটা নিরাপদ দূরত্ব থাকত দুজনের মধ্যে ৷ শুধু উনি গোস্সা করে বাপের বাড়ি গেলে সেখানে গিয়ে একসঙ্গে ঘোরাফেরা করেছি গিন্নির মান ভাঙানোর জন্যে ৷ রিটায়ার করার পর বেশ ঘুরছিলাম দুজনে ৷ ছবিটবিও দিচ্ছিলাম ফেসবুকে তারমধ্যেই মহকুমার শিক্ষক দিবস উদযাপন কমিটি তলব করল আমাকে ৷ দায়িত্বও একটা কাঁধে চাপল ৷ গতকাল আবার ধরে বেঁধে তুলে দেওয়া হল অনুষ্ঠানমঞ্চে ৷ মঞ্চভীতি আমার বরাবরের ৷ আমি আড়ালে থেকে কাজ করতে ভালোবাসি ৷ দায়িত্ব এলে ফাঁক রাখিনা ৷ বেশি সিরিয়াস হতে গিয়ে কষ্টও পেতে হয় ৷ এমনসব প্রিয়জনের কাছ থেকে আব্দার এল যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি দীর্ঘদিন, শিক্ষার্থী হিসেবে পেয়েছি, পেশাগত প্রশিক্ষণ দেবার সময় সান্নিধ্য পেয়েছি ৷ ' অনুরোধ তার এড়ানো কঠিন বড়ো' ৷ বসতেই হল অনুষ্ঠানমঞ্চে ৷ আবরণ উন্মোচন হল স্মরণিকার ৷ যা সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব বর্তেছিল আমার উপর ৷ সময়ে লেখা, বিজ্ঞাপন না আসা, টাইপিংয়ের সমস্যা,প্রুফ দেখা সর্বোপরি ছাপতে দেওয়ার সময় গোদের উপর বিষফোড়ার মতো টানা বিদ্যুৎবিভ্রাট ৷ সব মিলিয়ে দক্ষযজ্ঞের মধ্যে এই স্মরণিকা প্রকাশ ৷ ফলে যা হবার তাই হয়েছে ৷ হাঁসজারু গোছের একটা কিছু হাজির করা গেছে ৷ এসব কাজ যথেষ্ট সময় নিয়ে না করলে সমৃদ্ধ হয়না ৷ সাফল্যও আসেনা ৷ উনিশ বছর ধরে যখন স্মরণিকাটি প্রকাশ হয়ে আসছে তাহলে কয়েকমাস আগে থেকেই তো লেখা সংগ্রহ করা যেতেই পারে ৷ শিক্ষকরা যেখানে লেখক সেখানে মান আর বিষয়বৈচিত্র্যের অভাব ঘটার কথাই নয় ৷ প্রতিকূলতা সত্বেও এ সংখ্যাটি যথেষ্ট সমৃদ্ধই হয়েছে ৷ ত্রুটি বা ঘাটতি যা রয়েছে সবই আমার ৷ এখানে এসেই আমার অভিনয়ে ব্যর্থতা ৷ গতকাল তাই দীর্ঘদিন পর কিছুটা ব্যস্ততায় কাটিয়েছি ৷ মঞ্চে বসেও অনেক মেসেজ পেয়েছি ৷ কিন্তু জবাব দিতে পারিনি ৷ গতকাল যাঁরা আমাকে বিভিন্নভাবে শুভেচ্ছা, সম্মান জানিয়েছ/জানিয়েছেন সবাইকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভকামনা জানাচ্ছি ৷ সর্বশক্তিমান সবার মঙ্গল করুন ৷

No comments:

Post a Comment